রইল বাকি নয় এখন

রইল বাকি নয় এখন

কমনওয়েল্‌থ অফ বাহামা-র নাসাউ দ্বীপের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম লিনডেন পিন্ডলিং। সেখানকার ডিপার্চার লাউঞ্জ দিয়ে সন্ধে সাড়ে ছ’টার সময় বাইরে বেরোল ওয়ারিস্তানের সেনাপ্রধান আজাদ মালিক। প্রাক্তন সেনাপ্রধান রকি চৌধুরী আসতে পারবে না। কারণ তার নামে ইন্টারপোল থেকে ‘রেড কর্নার নোটিস’ জারি করা আছে। রকির দূত হয়ে এসেছে আজাদ।

নাসাউ হল কালো টাকা সাদা করার স্বর্গরাজ্য। এখানকার ব্যাঙ্ক এবং নন-ব্যাঙ্কিং অফিসে বিদেশ থেকে প্রতি মুহূর্তে বিলিয়ন ডলার জমা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থিত অজস্র ব্যাঙ্কের মাধ্যমে হাতবদল হয়ে টাকা পৌঁছোয় গ্রহীতার কাছে। পদ্ধতিটি এতই জটিল যে কম্পিউটারও ‘মানি ট্রেল’ বা টাকা আদান প্রদানের গতিপথের খেই হারিয়ে ফেলে। একেই বলে ‘মানি লন্ডারিং’ বা ‘বেআইনি অর্থ পাচার।’

নাসাউতে প্রাক্তন সেনাপ্রধান রকি চৌধুরীর একটি অফিস আছে। সেখানে কাজ করে কিয়ারা নামের একটা মেয়ে। মেয়েটা গত কয়েক মাস ধরে অদ্ভুত আচরণ করছে। অধিকাংশ সময় ফোন ধরেছে না, মেল পাঠালে উত্তর দিচ্ছে না, ‘মানি লন্ডারিং’-এর কাজেও অনিয়মিত। কিয়ারা কুসঙ্গে পড়েছে কি না দেখতেই আজাদের আসা।

ডিপার্চার লাউঞ্জের বাইরে যে কমবয়সি, মঙ্গোলয়েড মুখশ্রীর মেয়েটি ‘ওয়েলকাম মিস্টার মালিক’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাকে দেখেই চিনতে পারল আজাদ। রকির মোবাইলে তোলা কিয়ারার যে-ক’টা ফোটো দেখেছে আজাদ, সেগুলোর সঙ্গে মিল কম। তবে ওগুলো কয়েক বছর আগের ছবি। বয়সের সঙ্গে মানুষের চেহারায় বদল আসে। তবে কিয়ারার মধ্যে সেই চনমনে, ফুর্তিবাজ স্পিরিটটা এখনও আছে। মেয়েটিকে দেখে ভালো লাগল আজাদের।

দশ মাস আগে

‘কাইমেরা কি উঠে যাবে?’ সাউথ ব্লকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রঞ্জিত গগৈয়ের অফিসে বসে জিজ্ঞাসা করল প্রথমা লাহিড়ী। তার পাশে বসে রয়েছে ষষ্ঠী লাহিড়ী, আয়েশা খাতুন আর অভিনন্দন কাপুরো।

কাইমেরা হল ভারতবর্ষের গোপনতম ইনটেলিজেন্স উইং। আন্তর্জাতিক অপরাধ দমনের জন্যে এই উইং তৈরি করেছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি অরুণ চট্টোপাধ্যায়, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হরভজন সিংহ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রঞ্জিত গগৈ। গত কয়েক বছর ধরে কাইমেরা অজস্র গোপন মিশনে সফল হয়েছে। কিছু মিশনে ব্যর্থও হয়েছে। কাইমেরার পাঁচ এজেন্টের মধ্যে একজন মারা গেছে। বাকিরা এখানে বসে। কাইমেরার টিম লিড হল প্রথমা। তার রিপোর্টিং অথরিটি রঞ্জিত।

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হরভজন সিং এবং তাঁর দলের নীতি ছিল পড়শি দেশের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে চলা। ভারতের বিদেশ নীতিও সেই রকমই ছিল। নতুন প্রধানমন্ত্রী বীরেন্দ্র মেহতা এবং তাঁর দলের নীতি হল, ‘আমরা ভালোর ভালো। মন্দের যম।’ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ওয়ারিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্যে বীরেন্দ্র সব সময় প্রস্তুত। নতুন রাষ্ট্রপতি জিতু কেডিয়াও এই নীতির সমর্থক।

‘তোর প্রশ্নের এক কথায় উত্তর দেওয়া মুশকিল।’ কাগজে আঁকিবুঁকি কাটতে কাটতে বললেন রঞ্জিত, ‘প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেই বীরেন্দ্র মেহতা কাইমেরার প্রতিটি ক্লাসিফায়েড নথি পড়েছেন। তাঁর মত হল, ভারতবর্ষের বিদেশনীতি বদলেছে। নতুন ভারত গোপনে আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন করবে না। সে ময়দানে যুদ্ধ করবে। কাজেই, আগের কাইমেরা উঠে যাবে।’

‘আগের কাইমেরা?’ অভিনন্দন বলল, ‘এই কথাটার মানে কী?’

রঞ্জিত হাসলেন। ‘গুড কোশ্চেন। আগের কাইমেরার বদলে আসবে কাইমেরা ভার্সন টু। এর লক্ষ্য খুব নির্দিষ্ট। পৃথিবী জুড়ে যে সমস্ত সংস্থা, রাষ্ট্র বা ব্যক্তি ভারতের সার্বভৌমত্বের পক্ষে বিপজ্জনক, তাদের টার্মিনেট করতে হবে।’

‘তার মানে কাইমেরা ভার্সন টু পেশাদার খুনির কাজ করবে?’ বলল ষষ্ঠী।

‘ঠিক ধরেছিস।’ এই প্রথম কাগজের আঁকিবুঁকি কাটা বন্ধ করে সামনের দিকে তাকালেন রঞ্জিত। ‘বেসিকালি নতুন কাইমেরাকে প্রফেশনাল অ্যাসাসিন, হুইস্‌ল ব্লোয়ার, কনট্র্যাক্ট কিলার, অ্যানার্কিস্ট… সবকিছু একসঙ্গে হতে হবে।’

‘চারজনে মিলে এত কাজ কী করে করব?’ ঘাবড়ে গিয়ে বলে আয়েশা, ‘নতুন রিক্রুটমেন্ট হবে না?’

রঞ্জিত মৃদু হেসে বললেন, ‘কাইমেরা ভার্সন টুতে রিক্রুটমেন্ট হবে না। উল্টে অভিনন্দন আর ষষ্ঠীকে অন্য জায়গায় সরিয়ে দেওয়ার অর্ডার এসেছে। এখানে কাজ করবি শুধু তুই আর প্রথমা। রিসার্চের দায়িত্বে তুই। মূল কাজ করবে প্রথমা। তোদের অফিস নতুন জায়গায় শিফ্‌ট করবে। এখন তোরা নিজেদের সিটে গিয়ে ইমেল চেক কর। সব তথ্য পেয়ে যাবি।’

‘ইয়েস স্যর!’ এক সঙ্গে বলল চারজন। ওরা জানে, ভবিষ্যতে চারজনের এক সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য।

অভিনন্দন, আয়েশা আর ষষ্ঠী বেরিয়ে গেলেও রঞ্জিতের ইশারায় প্রথমা রয়ে গেছে। তার দিকে তাকিয়ে রঞ্জিত বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী দশটা টার্গেট বেঁধে দিয়েছেন এলিমিনেট করার জন্যে। তার ভিত্তিতে পরের প্ল্যানিং হবে।’

‘যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সংগ্রহ করা ‘হারাধনের দশটি ছেলে’ কবিতাটা মনে পড়ে গেল স্যর,’ হাসছে প্রথমা। প্রথম চারটে লাইন হল…

‘হারাধনের দশটি ছেলে

ঘোরে পাড়াময়,

একটি কোথা হারিয়ে গেল

রইল বাকি নয়…’

একটা মোটকা ফাইল প্রথমার হাতে তুলে দিয়ে রঞ্জিত বললেন, ‘খারাপ বলিসনি। কাইমেরার প্রথম প্রজেক্টে যাদের নিয়ে তোকে ডিল করতে হবে, তাদের মধ্যে একজন হারিয়ে যেতে চাইছে।’

প্রথমা চুপ। ফাইলের প্রথম পাতায় একজন ছেলের ছবিতে তার চোখ আটকে গিয়েছে।

এখন

‘হাই কিয়ারা!’ হাত নাড়ল আজাদ।

‘ইয়েলো এল্ডার’ বা ‘চন্দ্রপ্রভা’ ফুলের তোড়া এগিয়ে কিয়ারা বলল, ‘ওয়েলকাম টু নাসাউ, মিস্টার মালিক। রকি কেমন আছে?’

বাহামার জাতীয় ফুল যে ইয়েলো এল্ডার, এটা আজাদ জানে। তোড়া গ্রহণ করে সে বলল, ‘ভালো আছে।’

কিয়ারা বলল, ‘আমার সঙ্গে আসুন।’ তারপরে কার পার্কিং-এর দিকে এগোল। সেখানে কিয়ারার ‘ফেরারি’ দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইতালির এই লাক্সারি স্পোর্টস কারটি আজাদেরও খুব পছন্দের। তার দুটো ফেরারি আছে। মনে মনে গাড়ির মালকিনের রুচির প্রশংসা করল আজাদ।

সমুদ্রের সমান্তরাল চলেছে চকচকে এবং পরিষ্কার একটি রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে হু-হু করে যাচ্ছে ফেরারি। মাঝেমধ্যে দু-একটা দামি গাড়ি উল্টো দিকে চলে যাচ্ছে। মিনিট পনেরো বাদে গাড়ি দাঁড় করাল কিয়ারা।

ফেরারি থেকে নেমে আজাদ দেখল রাস্তার একদিকে সবুজ আর স্বচ্ছ সমুদ্র, নীল আকাশ, হলুদ সৈকত। রাস্তার অন্য দিকে গুটি কয়েক একতলা বাড়ি। সব বাড়ির সামনেই আরামকেদারা পাতা রয়েছে। সাদা, কালো এবং হলুদ চামড়ার মানুষরা সেখানে বসে বিয়ার খাচ্ছে, বই পড়ছে বা ঘুমোচ্ছে।

কিয়ারার বাড়ির নাম ‘নো হোয়্যার ল্যান্ড’। সে কাঠের গেট খুলে আজাদকে বলল, ‘ভেতরে এসো।’

ন’মাস আগে

ওয়ারিস্তানের ইস্টার্ন প্রভিন্সে অবস্থিত আশিকানা প্রাসাদের একটি ঘরে বসে মিটিং করছেন প্রধানমন্ত্রী ইমরাজ, সেনাপ্রধান আজাদ এবং প্রাক্তন সেনা প্রধান, পঁয়ষট্টি বছরের রকি চৌধুরী।

এই মিটিং-এ শীর্ণকায়, ছোট্ট চেহারার রকির থাকার কথা নয়। কয়েক বছর আগে, ওয়ারিস্তানের সেনাপ্রধান থাকাকালীন সে দেশ ছেড়ে পালায়। হয়ে যায়, ওয়ারিস্তানের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড পারসন।’ পরবর্তীকালে বেনামে ওয়ারিস্তানে ফেরতও আসে। রকির স্ত্রী জিয়া অতীতে ওয়ারিস্তানের বিরোধী রাজনৈতিক দল ‘ওয়ারিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’-র নেত্রী ছিল। ক্যু-এর মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সে কিছুদিনের জন্যে ওয়ারিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিল। পরে ক্ষমতাচ্যুত হয়।

ওয়ারিস্তানে এই সব পাপের একটাই পরিণতি। মৃত্যু। কিন্তু সেটা হয়নি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরাজ এবং সেনাপ্রধান আজাদ গোপনে জিয়া আর রকির ওপরে চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারি চালাত। ওদের বাড়িময় গোপন ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোন লাগানো ছিল।

দীর্ঘ নজরদারি চালানোর পরে ইমরাজ এবং আজাদ বুঝতে পেরেছে, অতীতে চৌধুরী দম্পতি যতই অন্যায় করে থাকুক না কেন, ওদের আদর্শের জায়গাটা আগের মতোই আছে। সেটা হল ভারত বিরোধীতা। ওয়ারিস্তান সরকারের অজান্তে ওরা পাঁচজন ভারতীয় উচ্চপদস্থ আমলাকে হত্যা করেছে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি অরুণ চ্যাটার্জিকে হত্যার পরিকল্পনাও করেছিল, যেটা শেষ মুহূর্তে বাঞ্চাল হয়ে যায়।

বাঞ্চাল করেছিল ভারতীয় এজেন্ট প্রথমা লাহিড়ী। মেয়েটার ওপরে প্রবল রাগ আছে রকি এবং জিয়ার।

প্রথমার ওপরে ইমরাজ এবং আজাদেরও রাগ আছে। কারণ ওর সাহায্যেই ওয়ারিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মায়া মল্লিক ভারতবর্ষে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে কয়েক সুটকেসভর্তি ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্ট। সেগুলো ভারতের নতুন সরকারের হাতে পড়েছে। ভাবলেই ইমরাজ এবং আজাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়।

এই সব কারণেই রকির অতীতের ভুল ক্ষমা করে তাকে আশিকানা প্রাসাদে ডেকেছে ইমরাজ এবং আজাদ।

‘আমাদের মূল সমস্যা এখন অর্থনীতি।’ রকির দিকে তাকিয়ে বলল ইমরাজ, ‘মায়া মল্লিক ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্ট নিয়ে চলে যাওয়ার পরে ন্যাশনাল সিকিয়োরিটি টাইট করার জন্যে জলের মতো টাকা খরচ হচ্ছে। সরকারের প্রতিটি দপ্তরের ডেটাবেস সিকিয়োর রাখতে গিয়ে রাজকোষের হাল খারাপ। কী করব বুঝতে পারছি না।’

রকি চুপ। আশিকানা প্রাসাদে ডেকে পাঠানো হয়েছে শুনেই সে বুঝতে পেরেছে, তার সম্পর্কে সব কথা ওয়ারিস্তানের বর্তমান সরকার জানে। ফাঁসির দড়ি না আজীবন কারাগার—কোন শাস্তিটা তার জন্যে রাখা আছে, এইটা জানতে এসেছে সে। কিন্তু এখানে এসে দুই ওজনদার লোকেদের সঙ্গে মিটিং করতে গিয়ে মনে হচ্ছে তৃতীয় কোনও অপশান আছে।

‘তোমার অতীতের কথা আমরা জানি।’ রকির দিকে তাকিয়ে বলল ইমরাজ।

‘কী জানো?’ বোকা সাজার অভিনয় করে রকি বুঝতে চাইছে এরা কতটা জানে।

‘ন্যাকামি কোরো না,’ বলল আজাদ, ‘তুমি যে বেঞ্জামিন ডিসুজা ছদ্মনামে ওয়ার্কিং ভিসা নিয়ে নাসাউতে দীর্ঘকাল লুকিয়েছিলে, এটা জানি। ওখানে মানি লন্ডারিং-এর অফিস খুলেছিলে, সেটাও জানি। বাকিটা তোমার কাছ থেকে শুনতে চাই।

‘ওয়ার্কিং ভিসা?’ এই দুটি শব্দ শুনে রকি নিশ্চিন্ত হল। সে যে কিয়ারাকে বিয়ে করে বাহামার চিরস্থায়ী নাগরিকত্ব পেয়ে গিয়েছিল, এটা এরা জানে না। তার মানে এরা কিয়ারার কথাও জানে না। নিজেকে অনেকটা নিরাপদ মনে হয় রকির। সে বলে, ‘তোমরা কী চাও?’

‘সোজা কথাটা সোজা করে বলা যাক।’ বলল ইমরাজ, ‘ইন্ডিয়ার সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্যে সিনচান রাষ্ট্র আমাদের এক হাজার কোটি টাকা দেবে। পুরোটাই ব্ল্যাক মানি। তোমাকে টাকাটা সাদা করে দিতে হবে।’

রকি বলল, ‘আমার অফিস এখনও নাসাউতে আছে। এক কর্মচারী চালায়।’

‘আমরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাই।’ বলল আজাদ।

‘ওইভাবে কাজ হয় না।’ ঠান্ডা গলায় বলল রকি। ‘কাজটা আমি করে দেব। তবে টোটাল অ্যামাউন্টের দশ পার্সেন্ট আমার চাই।’

ইমরাজ বলল, ‘আট পার্সেন্ট দিতে পারি।’

‘ঠিক আছে,’ করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে রকি।

এখন

কিয়ারা বাড়িতেই রান্না করতে চেয়েছিল। আজাদ বলল, ‘এখানে এসে ক্যারিবিয়ান ড্রিঙ্ক আর ক্যুজিন না খেলে ওয়ারিস্তান ফিরে গিয়ে কী জবাব দেব? চলো, এখানকার কোনও ভালো রেস্তোরাঁয় যাই। আজ রাতে ডিনারের দায়িত্ব আমার।’

কিয়ারা বলল, ‘তুমি তা হলে গেস্টরুমের টয়লেটে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমিও একটু সাজগোজ করি। “ক্যারিবিয়ান ব্রিজ” রেস্তোরাঁটা খুব বিখ্যাত। সারা পৃথিবীর লোকে নাম জানে।’

আজাদ পরেছে লিনেনের ফ্লোরাল প্রিন্টের হাফ শার্ট আর বারমুডা। পায়ে হাওয়াই চপ্পল। কিয়ারা পরেছে ‘লিটল ব্ল্যাক ড্রেস’। পায়ে স্টিলেটো। মেয়েটার রূপ দেখে মাথা খারাপ হয়ে গেল আজাদের।

ফেরারি চালিয়ে মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পরেই চলে এসেছে ক্যারিবিয়ান ব্রিজ রেস্তোরাঁ। বিরাট বড় রেস্তোরাঁর এক কোণে বসে ওয়েটারকে ডেকে কিয়ারা বলল, ‘আমাদের জন্যে দুটো ‘স্টর্মি নাইট’ পাঠিয়ে দাও।’

‘সেটা কী?’ জিজ্ঞাসা করল আজাদ।

‘জিঞ্জার এল আর গস্‌লিং-এর ব্ল্যাক সিল রাম দিয়ে তৈরি ককটেল। খেয়ে দেখো। ভালো লাগবে।’

ওয়েটার দুটি গ্লাস নিয়ে এসেছে। ‘চিয়ার্স’ বলে রক্ত রঙের পানীয়তে চুমুক দিল আজাদ।

আট মাস আগে

দিল্লির পাহাড়গঞ্জ এলাকার একটি চায়ের দোকানে বসে রয়েছে সুশীলা সিং আর অ্যাল। সুশীলার মুখ ওড়নায় ঢাকা। অ্যাল নিজের চেহারা লুকোনোর চেষ্টা করেনি। রাস্তার দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় সুশীলা কথা বলে যাচ্ছে। অ্যাল চা খেতে খেতে মন দিয়ে শুনছে।

কলকাতার বাসিন্দা অ্যালের সঙ্গে দিল্লির সুশীলা সিং-এর আলাপ হয়েছে গতকাল সকালবেলা। সুশীলার অফিসের ল্যান্ডলাইনে ফোন করেছিল অ্যাল। প্রথমেই অ্যালের লম্বা ইন্টারভিউ নিয়েছিল সুশীলা। জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘ফোন নম্বর কোথা থেকে পেলেন?’

‘আপনার প্রাক্তন ক্লায়েন্টের কাছ থেকে পেয়েছি’—এই উত্তর বিশ্বাস করতে চায়নি সুশীলা। বলেছিল, ‘আমি যাদের সাহায্য করি, তারা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়। তাদের একজনকেও খুঁজে পাওয়া মানে আমার ব্যর্থতা।’

অ্যাল বলেছিল, ‘তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে অজানা নম্বর থেকে ফোন করে আমাকে আপনার ল্যান্ডলাইন নম্বর দিয়ে বলেছে, “সাউথ-ইস্ট এশিয়ায় যত ভ্যানিশিং এজেন্ট আছে, তাদের মধ্যে আপনিই সেরা।” ’

সুশীলার হাজার অনুরোধেও বন্ধুর নাম বলেনি অ্যাল। নিজের সম্পর্কে বলেছিল, ‘আমার নাম অলোক সরকার। বাড়ি কলকাতায়।’ বাকি তথ্য সুশীলা জোগাড় করেছে।

গুগল করলে ‘ভ্যানিশিং এজেন্ট’ সম্পর্কে কিছু জানা যাবে না, কারণ এই টার্মটি সুশীলার তৈরি। সে আদতে মানুষকে হারিয়ে যেতে, মিলিয়ে যেতে সাহায্য করে। বা বলা ভালো, আগের পরিচয় ছেড়ে নতুন পরিচয়ে বাঁচতে সাহায্য করে। অ্যালকে গতকাল সুশীলা ফোনে বলেছিল, ‘এখন সন্ধে সাতটা। আগামিকাল সন্ধে সাতটার সময় নিউ দিল্লি স্টেশানের বাইরে এসে আপনি আবার এই ফোন করবেন।’ তারপর ফোন কেটে দিয়েছিল।

এখন চায়ের দোকানে বসে ওরা কথা বলছে। সুশীলা বলছে, ‘হারিয়ে যাওয়া সহজ। শক্ত হল নতুন পরিচয়ে বাকি জীবন কাটানো। তার জন্যে মেটিকুলাস প্ল্যানিং লাগে। সবার আগে একটা ডেট ঠিক করতে হবে। চার মাস পরের একটা তারিখ ঠিক করতে হবে।’

‘চার মাস?’ চায়ে চুমুক দিল অ্যাল, ‘এত দিন কেন লাগবে?’

‘অনেক কাজ আছে। প্রথম কথা হল, যেখানে যত লোক টাকা পাবে, সব মিটিয়ে দিন। গ্যাস, ইলেকট্রিসিটি, মোবাইল বিল, প্রপার্টি ট্যাক্স, ইএমআই, কার লোন, হাউস বিল্ডিং লোন এলআইসি-র প্রিমিয়াম—সব। এই সব জায়গায় পেমেন্ট করবেন টাকায়। নেট ব্যাঙ্কিং, ডিজিটাল ওয়ালেট, ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড ব্যবহার করবেন না। এবং পেমেন্ট করার সঙ্গে সঙ্গে নিজের নাম কাটিয়ে নেবেন।’

‘কেন নাম কাটাচ্ছি? কারণ কী বলব?’

‘বলবেন কাজের সূত্রে অন্য জায়গায় যাচ্ছেন। এবং ওই মিথ্যেটাই বারবার বলবেন।’

অ্যাল ঘাড় নাড়ল।

‘আপনার এই জীবনের সব তথ্য মোবাইল কোম্পানির কাছে রাখা আছে। কাজেই নতুন জীবন শুরু করার আগে পুরোনো স্মার্টফোন, কম্পিউটার বা অন্য সব ইলেকট্রনিক গ্যাজেটকে গুডবাই জানান। আমি আপনার ব্যবহারের জন্যে সিম কার্ড সমেত একটা বেসিক ফোন জোগাড় করেছি।’ ছোট্ট একটা বেসিক ফোন বেঞ্চিতে রেখে সুশীলা বলল, ‘সোশাল মিডিয়ায় অ্যাকাউন্ট আছে? মেল আইডি?’

‘না।’

‘ভেরি গুড। পরের ধাপ হল ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ক্লোজ করে সব লিকুইড ক্যাশ নিজের কাছে রাখা। বাড়িতে যা জিনিসপত্র আছে, সব চোরবাজারে বেচে ক্যাশে পেমেন্ট নিন। তার পরে আসছে নাম বদলানোর পালা। কলকাতায় আমার চেনা উকিল আছে। সে সাহায্য করবে। এই কাজটা করতে সময় লাগবে বলেই আমি চার মাস সময় নিচ্ছি।’

‘এফিডেবিট বা হলফনামা করে নাম বদলাতে চার মাস লাগে না।’ আপত্তি করে অ্যাল।

‘এইবারে আসছি সব থেকে কঠিন পর্বে। আপনার পরিবারে কে কে আছেন?’

‘মা। শেষ দেখা হয়েছিল এক বছর আগে।’

‘ভেরি গুড। মায়ের সঙ্গে আর দেখা করতে হবে না। ফোনও করবেন না।’

অ্যালের চা খাওয়া শেষ। সে ভাঁড় ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে বলল, ‘মা প্রতি মাসে আমাকে একবার ফোন করে। আমার মায়ের প্রতি কোনও দরদ নেই।’

‘বন্ধুবান্ধব? বউ বা বান্ধবী? কোনও পোষ্য?’

‘কেউ নেই।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে অ্যাল।

‘সত্যি বলছেন তো? ইমোশনাল বন্ডিং ছিঁড়ে ফেলা কিন্তু সব থেকে শক্ত কাজ। নতুন জীবনে প্রবেশ করার মানে হল আগের জীবনকে একদম মুছে ফেলা।’

‘বুঝেছি।’

‘এবারে অন্য কথা হোক। আমার প্রফেশনাল ফি হল পঁচিশ লাখ টাকা। সেটা কী ভাবে দেবেন?’

‘পেয়ে যাবেন। কিন্তু আমার নতুন আইডেন্টিটির যাবতীয় ডকুমেন্ট কবে পাব?’

‘ইনিশিয়ালি আমাকে এক লাখ টাকা দিন। এর পরে প্রতি মাসে ছ’লাখ টাকা কলকাতায় আমার এজেন্টের কাছে জমা করবেন। আপনার নামের এফিডেবিট হয়ে যাওয়ার পরে পাসপোর্টের জন্যে অ্যাপ্লাই করতে হবে। অন্যান্য ডকুমেন্টও তৈরি হয়ে যাবে।’

‘নতুন দেশে গিয়ে আমি চুপ করে বসে থাকতে পারব না। সেখানে একটা কাজ চাই।’

‘আপনি যে দেশে যাবেন, সেখানকার একজনের নাম-ঠিকানা দিয়ে দেব। ওর অফিসে স্টাফ লাগবে।’

‘আমি যাচ্ছি কোথায়?’

‘নাসাউ আইল্যান্ড, বাহামা।’

আমার পঁচিশ লাখ টাকা নিয়ে আপনি কেটে পড়লে আপনার কপালে দুঃখ আছে কিন্তু!’ ঠান্ডা গলায় বলে অ্যাল।

‘আপনি যে একজন কনট্র্যাক্ট কিলার, আপনার মা যে প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের এক যৌনকর্মী, আপনার বায়োলজিকাল ফাদার কে—সেটা আপনি বা আপনার মা যে জানেন না, এগুলো আমি জানি। সাইবার জালিয়াতি করে কলকাতা শহরে আপনার অপরাধে হাতেখড়ি হয়। পরবর্তীকালে পেশাদার খুনে হিসেবে সারা ভারতে কাজ করেছেন। সিনচান দেশের এক রাষ্ট্রদূতকে খুন করে এখন সিনচানের রাডারে আছেন বলে পুরোনো নামে পুরোনো দেশে থাকতে ভয় পাচ্ছেন। এমন একজন ঠান্ডা মাথার খুনিকে আমি খুবই ভয় পাচ্ছি।’

‘আমাকে ভয় পাবেন না।’ সুশীলার দিকে তাকাল অ্যাল। তার কানে ফিশফিশ করে কিছু একটা বলে, এক লাখ টাকার খাম বেঞ্চিতে রেখে, সুশীলার দেওয়া বেসিক ফোন নিয়ে চলে গেল।

এখন

ওয়েটার খাবার নিয়ে এসেছে। কিয়ারা অর্ডার করেছে কোকোনাট শ্রিম্প, চিকেন পাস্তা, পর্ক রিবস উইথ গুয়াভা বার্বিকিউ সস আর লাইম পাই। খাবারের সঙ্গে অনুপান হিসেবে চলছে স্টর্মি নাইট। আজাদ গ্লাসের পর গ্লাস উড়িয়ে দিচ্ছে। তারই মধ্যে জিজ্ঞাসা করছে, ‘রকি বলছিল, তোমাকে ফোন করলে ফোন ধরো না। কেন?’

‘আমি মোবাইল ব্যবহার করি না। আমার যা কাজ, তাতে মোবাইল ব্যবহার না করাটা বাধ্যতামূলক। ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট না থাকাই আমার কাজের চাবিকাঠি। রকি সব জেনেও ছেলেমানুষি করছে।’

‘মেল করলে উত্তর দাও না কেন?’

‘একই কারণ,’ ফর্ক দিয়ে চিকেন পাস্তা নাড়াচাড়া করতে করতে বলল কিয়ারা। ‘অফিশিয়াল মেল আমি অফিসের কম্পিউটার থেকে খুলি। উত্তরও দিই। কিন্তু পারসোনাল ল্যাপটপ নেই। নেট সার্ফ করার জন্যে আমাকে কয়েক কিলোমিটার দূরের বাজারে যেতে হয়।’

‘অফিসের কাজেও তো মন নেই। রকি অভিযোগ করছিল, সিনচানের কাজটা নিয়ে তুমি খুব ঝুলিয়েছ।’

মিষ্টি হেসে কিয়ারা বলল, ‘এমন সুন্দর একটা রাত। আমরা কি অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারি না? অফিসের কথা বলার জন্যে তো কালকের গোটা দিনটা পড়ে আছে? তোমার ফ্লাইট তো কাল রাতে!’

স্টর্মি নাইটে চুমুক দিয়ে আজাদ বলল, ‘আমি কবে যাব, সেটা তুমি কী করে জানলে?’

‘রকি বলেছে,’ আজাদের চোখে চোখ রেখে বলল কিয়ারা। ‘এবার আমরা উঠি। আকাশ ভালো নয়। ট্রপিকাল স্টর্ম ককটেল গ্লাসেই ভালো। তার বাইরে শুরু হলে ঘোর বিপদ।’

‘নাইস জোক!’ বিড়বিড় করে বলল আজাদ।

কিয়ারা ইশারায় ওয়েটারকে বিল আনতে বলল। মাতাল আজাদকে নিয়ে ফিরতে হবে। তারপরেও অনেক কাজ আছে…

চার মাস আগে

লিনডেন পিন্ডলিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে এল অ্যাল স্মিথ। বছর ত্রিশেক বয়স, মাথা ন্যাড়া। কেতাদুরস্ত একটা গোঁফ আছে। চোখে রিমলেস চশমা। কাঁধে ব্যাকপ্যাক, হাতে দুটো চাকা লাগানো সুটকেস।

এফিডেভিট করানোর আগে, নতুন নাম কী হবে এই নিয়ে সুশীলার সঙ্গে অনেক ঝগড়া করেছে অ্যাল। সুশীলা বলেছিল নতুন নাম হবে ‘জিমি।’ অ্যাল বলেছিল, ‘সমস্ত ডকুমেন্টে আমার নাম অলোক সরকার। খুব কম লোক আমাকে অ্যাল নামে চেনে।’ দীর্ঘ আলোচনার শেষে অ্যালের দাবি মেনে নেয় সুশীলা। তবে পদবি বদলাতে বাধ্য করে।

অ্যালের চেহারাতেও বদল এসেছে। আগে এক মাথা চুল ছিল। এখন ন্যাড়া। সুশীলার পরামর্শে চোখে চশমা উঠেছে। টুকটাক, খুচরো বদল। যা দীর্ঘ সময় ধরে মেনটেন করা যাবে।

সুশীলা চারটে পাসপোর্ট বানিয়ে দিয়েছিল। সুশীলার সঙ্গে যোগাযোগের দু-মাস পরে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে, প্রথম পাসপোর্ট ব্যবহার করে অ্যাল এক মাস এমন হোটেলে থেকেছে যেখানে সিসিটিভি নেই এবং কম্পিউটারে ডেটা এনট্রি হয় না। কলকাতা ছাড়ার দিন হোটেল থেকে এয়ারপোর্ট এসেছে বাসে চেপে। প্রথম পাসপোর্ট দেখিয়ে কলকাতা থেকে মুম্বইতে উড়ান। সেখানে সস্তার হোটেলে তিন সপ্তাহ থাকার পরে দ্বিতীয় পাসপোর্ট দেখিয়ে মুম্বই থেকে ওয়ারিস্তান। সেখানকার হোটেলে একদিন কাটানোর পরে অ্যাল স্মিথের পাসপোর্ট দেখিয়ে সোজা নাসাউ। তার যাবতীয় সম্পত্তি এখন মার্কিন ডলারে বদলে গেছে। এই তিনটে ব্যাগ ছাড়া আর কিছু নেই।

ডিপার্চার লাউঞ্জের বাইরে যে কমবয়সি, মঙ্গোলয়েড চেহারার মেয়েটা ‘ওয়েলকাম মিস্টার স্মিথ’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাকে দেখেই চিনতে পারল অ্যাল। এর নাম কিয়ারা। এই মেয়েটার কথাই সুশীলা বলেছিল।

‘হাই কিয়ারা!’ হাত নাড়ল অ্যাল।

ইয়েলো এল্ডার ফুলের তোড়া এগিয়ে কিয়ারা বলল, ‘ওয়েলকাম টু নাসাউ, মিস্টার স্মিথ। রকি কেমন আছে?’

‘ভালো,’ সংক্ষিপ্ত উত্তর অ্যালের।

কিয়ারা বলল, ‘আমার সঙ্গে এসো।’ তারপরে অ্যালের কাছ থেকে চাকা লাগানো সুটকেসদুটি নিয়ে পার্কিং এরিয়ার দিকে এগোল। ওই সুটকেসে রাখা আছে অ্যালের সারা জীবনের সঞ্চয়। পুরোনো জীবনের খোলস ছেড়ে নতুন জীবনে প্রবেশ করছে সে। আরও কয়েকটা জিনিস ছাড়তে হবে। তা হলেই অলোক সরকার চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবে।

ফেরারির পিছনের সিটে চাকা লাগানো সুটকেস রেখে ড্রাইভারের আসনে বসল কিয়ারা। বলল, ‘বাড়ি পৌঁছোতে মিনিট দশেক লাগবে। তার মধ্যে কাজের কথা সেরে নেওয়া যাক।’

অ্যাল চুপ করে শুনছে কিয়ারার কথা। সে বলছে, ‘রকির কাছ থেকে রেকমেন্ডেশান এসেছে বলে আমি তোমাকে কাজ দিতে বাধ্য। কিন্তু একটা কথা সব সময় মনে রাখবে। আমি বস আর তুমি আমার সাবর্ডিনেট স্টাফ।’

অ্যাল মুখ খোলেনি।

কিয়ারা বলল, ‘আমরা এসে গেছি। এইটাই আমার বাড়ি, এইটাই অফিস।’

নো হোয়্যার ল্যান্ডে ঢোকার সময়েই অ্যাল বুঝতে পারল হারিয়ে যাওয়া মানুষদের থাকার জন্যে এটাই আদর্শ জায়গা।

এখন

ক্যারিবিয়ান ব্রিজ থেকে আজাদকে বার করে গাড়িতে তুলতে হিমশিম খেয়ে গেল কিয়ারা। মাত্রারিতিরিক্ত পান করে ন্যালব্যাল করছে সাড়ে ছ’ফুট লম্বা লোকটা। দুজন বাউন্সারের সাহায্য নিতে হল। ফাঁকা রাস্তা দিয়ে ফেরারি চালিয়ে বাড়ি ফেরার সময়ে বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করেছে। গ্যারাজে গাড়ি ঢোকানোর আগেই বৃষ্টি নামল ঝমঝম করে। একা হাতে ওই বিরাট লাশকে বাড়িতে ঢোকাতে গিয়ে ভিজে গেল কিয়ারা। গেস্টরুমে লোকটাকে শুইয়ে, পোশাক খুলে সারা শরীর মুছে গায়ে কম্বল চাপা দিল। এবারে নিজেকে মেরামত করতে হবে।

বাথরুমে গিয়ে স্নান করল কিয়ারা। বৃষ্টিতে মেকআপ নষ্ট হয়ে গেছে। আর এক প্রস্থ মেকআপ করল। নতুন পোশাক পরে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। ঝড়বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশ জুড়ে মস্তবড় একটা চাঁদ উঠেছে। বাইরে বেরোনোর জন্যে ছাতা বা বর্ষাতি লাগবে না। তবে রিস্ক নিয়ে লাভ নেই। একটা বর্ষাতি গলিয়ে নো হোয়্যার ল্যান্ড থেকে বেরোল কিয়ারা।

নাসাউতে লোকাল বাসকে ‘জিটনি’ বলে। অনেক রাত পর্যন্ত চলে এই বাস। বাসে উঠে কিয়ারা শহরের মূল বাজারের দিকে এগোল। এখানে দোকান বেশি, লোক বেশি, বিদেশি টুরিস্ট আর দেশি টুরিস্ট গাইড বেশি। কেউ কারও খেয়াল রাখে না।

বাস থেকে নেমে রাস্তার ধারের দোকান থেকে সে একটা হাত ফেরতা, ‘ইউজ অ্যান্ড থ্রো’ মোবাইল কিনল। এই মোবাইল এবং এর মধ্যে ভরে রাখা সিম কার্ডের মালিক পৃথিবীর যে কেউ হতে পারে। ফোনে নির্দিষ্ট পরিমাণ ‘টকটাইম’ ভরা আছে। এবং এই ফোন নম্বরটি মাস্কিং করা আছে। কেউ ট্যাপ করলেও কোথা থেকে ফোন আসছে, বোঝা অসম্ভব।

ওদিক থেকে একটি মহিলা কণ্ঠ বলল, ‘বলো।’

কিয়ারা বলতে শুরু করল…

তিন মাস আগে

সারাদিনের কাজকর্ম চুকিয়ে অ্যাল আর কিয়ারা আরামকেদারায় বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দুজনের হাতে পানীয়ের গ্লাস। সমুদ্র সৈকতে বসে এক ছোকরা গিটার বাজিয়ে বিট্‌লসের একটি বিখ্যাত গান গাইছে। ‘হি ইজ রিয়্যাল নোহোয়্যার ম্যান, সিটিং ইন হিজ় নোহোয়্যার ল্যান্ড, মেকিং অল হিজ নোহোয়্যার প্ল্যানস ফর নোবডি।’

গান শুনতে শুনতে কিয়ারা বলল, ‘ব্যাঙ্ক অফ সিনচান থেকে এত ব্ল্যাক মানি ঘুরপথে ওয়ারিস্তানে ঢুকছে কেন? এই নিয়ে তোমার চিন্তা হচ্ছে না?’

অ্যাল চুপ।

কিয়ারা বলল, ‘তোমাকে আমার খুব রহস্যময় লাগে। এত কম কথা বলো কেন? পার্সোনাল কথা জিজ্ঞাসা করলেই চুপ করে যাও কেন? এক মাস একসঙ্গে রয়েছি। একে অপরকে ভালোবাসি। এখনও বিশ্বাস করতে পারছ না?’

অ্যাল পানীয়তে চুমুক দিয়ে বলল, ‘আমি কথা বলতে ভালোবাসি না।’

‘তা হলে কী ভালোবাসো?’ খিলখিল করে হাসছে কিয়ারা। ‘গত এক মাসে আমাদের যত উপার্জন হয়েছে, তারপরে বাকি জীবন কাজ না করলেও চলবে। তুমি আমাদের ভবিষ্যত নিয়ে কিছু ভেবেছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘রিয়্যালি?’ লাজুক মুখে চোখ পিটপিট করে কিয়ারা, ‘ফিউচার প্ল্যান কী?’

‘কীরকম প্ল্যান হলে তোমার ভালো লাগবে?’ আরামকেদারা থেকে উঠে কিয়ারার হাত ধরে দরজা খুলে বেডরুমে ঢুকল অ্যাল।

‘তুমি যা চাইবে, সেটাই আমার ভালো লাগবে।’ অ্যালের কাঁধে মাথা রেখে বলল কিয়ারা।

বেডরুমের দরজা বন্ধ করে কিয়ারার গালে হাত বুলিয়ে অ্যাল বলল, ‘আমাকে তুমি ভালোবাসলে কেন? কী দেখেছ আমার মধ্যে?’

খিলখিল করে হেসে কিয়ারা বলল, ‘আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা এই দ্বীপে। বাবা মারা গেছে জন্মের আগে। পাঁচ বছর বয়সে মা মারা গেল। আমার কোনও ভাইবোন নেই। যে মামার কাছে বড় হয়েছি, সে যখন মারা গেল, তখন আমার বয়স পনেরো। তিনকূলে আমার কেউ নেই। নাসাউতে বেড়াতে আসা দাদুর বয়সি রকির প্রেমে পড়ে যাই। মনে হয়েছিল, ও আমাকে সত্যিই ভালোবাসে। পরে জানলাম ও বিবাহিত। এখানকার পার্মানেন্ট সিটিজেনশিপ পাওয়ার জন্যে আমাকে বিয়ে করেছিল। আমি আর ওকে ভালোবাসি না।’

‘আমাকে বিয়ে করতে চাও?’ কিয়ারার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করল অ্যাল।

‘তোমাকে স্বয়ং রকি পাঠিয়েছে। এই বিয়ের কথা ও যদি জেনে যায়?’ স্বন্ত্রস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল কিয়ারা।

‘রকিকে নিয়ে চিন্তা কোরো না। তোমার আর আমার কথা আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ জানে না।’

‘রকি জানে! ওই তো তোমাকে পাঠিয়েছে।’

‘রকি আমাকে পাঠায়নি,’ হাসল অ্যাল। কিয়ারার গলায় দু-হাত রেখে বলল, ‘এই ‘নোহোয়্যার ল্যান্ড’-এ আমি একজন ‘নোহোয়্যার ম্যান’। তোমার জন্যে আমার একটা ‘নোহোয়্যার প্ল্যান’ আছে। সেটা জানতে চাও?’

কিয়ারা আর কথা বলছে না।

এখন

‘বুঝলাম,’ বলল সুশীলা সিং ওরফে প্রথমা লাহিড়ী। সে বসে রয়েছে কাইমেরার নতুন অফিসে। পাহাড়গঞ্জের এই এলাকায় গাদা গাদা ট্রাভেলিং এজেন্টের অফিস। তার মধ্যেই ‘মহাবীর ট্রাভেলিং এজেন্সি’ কাইমেরার ‘ফ্রন্ট অফিস’ হিসেবে কাজ করে। অফিসের বেসমেন্টে, সকলের চোখের আড়ালে আছে নতুন কাইমেরার হাই-টেক অফিস। এখানে বসেই সারা বিশ্বের সমস্ত গোপন খবর পেয়ে যায় কাইমেরা।

রঞ্জিতের কাছ থেকে যে মোটকা ফাইলটা পেয়েছিল প্রথমা তাতে লেখা ছিল, ওয়ারিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরাজ এবং সেনাপ্রধান আজাদ মিলে সিনচান রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করে কিছু একটা ঘটাতে চলেছে। ওয়ারিস্তানে নিজের সোর্স কাজে লাগিয়ে প্রথমা জানল যে প্রাক্তন সেনাপ্রধান রকি নাসাউতে মানি লন্ডারিং-এর কাজ করে। সেখানে তাকে সাহায্য করে কিয়ারা নামের একটা মেয়ে।

এই ঘটনার এক মাসের মধ্যে আয়েশা খবর আনল যে সিনচানের এক রাষ্ট্রদূতকে খুন করে কলকাতার প্রফেশনাল কিলার অ্যাল ভারত ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছে। অন্ধকার জগতের বৃত্তে খোঁজ করছে, কে তাকে নতুন পরিচয়ে অন্য দেশে রিলোকেট করতে পারবে।

সঙ্গে সঙ্গে ভ্যানিশিং এজেন্ট সুশীলা সিংকে তৈরি করে প্রথমা। সারা দেশের বিভিন্ন অপরাধীকে জানানো হয় যে সুশীলা টাকার বিনিময়ে মানুষকে হারিয়ে যেতে সাহায্য করছে গত দশ বছর ধরে।

ছিপ ফেলে বসে থাকা কাইমেরার রুটিন কাজ। ফত্‌না না নড়লেও কাজ চালিয়ে যেতে হয়। কিন্তু ফত্‌না নড়ল। অলোক সরকার যোগাযোগ করল সুশীলার সঙ্গে।

রঞ্জিতের অনুমতি নিয়ে অ্যালকে নাসাউতে রিলোকেট করে প্রথমা। অ্যালকে চারটে পাসপোর্ট বানিয়ে দিয়েছিল সে। প্রথম তিনটে ব্যবহার করে নাসাউতে এসে কিয়ারার বাড়িতে উঠেছিল অ্যাল। চতুর্থ পাসপোর্টটি ছিল কিয়ারার নামে।

পাহাড়গঞ্জের সেই চায়ের দোকানের বেঞ্চি থেকে উঠে যাওয়ার আগে অ্যাল বলেছিল, ‘আমি একজন রূপান্তরকামী। বহিরঙ্গে ছেলে হলেও মনের দিক থেকে মেয়ে। নতুন জীবনে প্রবেশ করার জন্যে শুধু নাম, পদবি, দেশ বা চেহারা বদলাব না। সেক্সুয়াল রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারি করিয়ে ছেলে থেকে মেয়ে হয়ে যাব।’

অ্যালকে যে রকি পাঠিয়েছে, এই মিথ্যে তথ্য সন্তর্পণে কিয়ারাকে ফিড করেছিল প্রথমা। অ্যাল এখানে আসার এক মাসের মাথায় কিয়ারাকে খুন করে বডি হাপিশ করে দেয়। নষ্ট করে যাবতীয় ডকুমেন্ট। স্থানীয় প্লাস্টিক সার্জনের কাছে গিয়ে নিজের সেক্সুয়াল রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারির কাজ শুরু করে। গোটা পৃথিবী থেকে অজস্র ধনী মানুষ গোপনে প্লাস্টিক সার্জারি করানোর জন্যে নাসাউতে আসেন। এখানে এই জাতীয় চিকিৎসার রমরমা বাজার।

অ্যাল আর কলকাতার অলোক সরকার নয়। সে এখন বাহামার কিয়ারা। বয়স একটু বেড়েছে। হর্মোন ট্রিটমেন্টের কারণে মুখে ছাপ পড়েছে। প্লাস্টিক সার্জারি করে মুখটাকে মঙ্গোলয়েড করে নিয়েছে সে। আজাদের সঙ্গে প্রথম মোলাকাতের সময় ভয় ছিল যে, পুরোনো ছবির সঙ্গে ও যদি এই কিয়ারাকে মেলাতে না পারে। প্রথমা অভয় দিয়েছিল। ‘মানুষের মন মিল খুঁজতে চায়। এটাই স্বাভাবিক প্রবণতা। ওই ছবির সঙ্গে তোমার মুখের সঙ্গে মিল না থাকলেও আজাদ ধরে নেবে যে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তোমার চেহারা বদলেছে।’

‘আমি একটা ভুল করেছি।’ বলল কিয়ারা। ‘আজাদকে বলে ফেলেছি যে ও আগামিকাল ফিরবে। আমাকে জিজ্ঞাসা করল, আমি কী করে জানলাম। আমি বলেছি, রকির কাছ থেকে জেনেছি। ওয়ারিস্তান ফিরে ও যদি ক্রসচেক করে, তাহলে আমার বিপদ আছে।’

‘ওই নিয়ে ভেবে লাভ নেই। তুমি যে কিয়ারা নও, এটা ভাবা খুব শক্ত কাজ।’

‘ঠিকই।’ ঘাড় নাড়ল কিয়ারা। ছেলে থেকে মেয়ে হয়ে যাওয়ার পরেও তার গায়ের জোর একটুও কমেনি। গত রাতে আজাদকে ফেরারিতে তুলতে দুজন বাউন্সার লেগেছিল। নো হোয়্যার ল্যান্ডে ফেরার পরে কিয়ারা একাই পাঁজাকোলা করে গেস্টরুমে শুইয়ে দেয়।

‘আমার টকটাইম ফুরিয়ে আসছে।’ বলল অ্যাল। ‘এখন কী করব বলে দাও।’

‘তুমি নতুন জীবন চেয়েছিলে। সেটা পেয়ে গেছ।’ বলল প্রথমা, ‘অলোক সরকার বা অ্যাল স্মিথের আর কোনও অস্তিত্ব নেই। তুমি এখন কিয়ারা। রকির অফিস সামলাও। আনন্দে থাকো। ওয়ারিস্তানের হয়ে কাজ করো। তবে প্রতি সপ্তাহে আমাকে একবার ফোন করে জানিও, গত সাতদিনে কী কী ঘটেছে। না হলে কিন্তু…’

কথা শেষ হয়নি প্রথমার। ফোন কেটে গেছে। সিম কার্ড বার করে স্টিলেটোর হিল দিয়ে গুঁড়িয়ে দিল কিয়ারা। মোবাইলেরও একই দশা হল। ভাঙা টুকরোগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে জিটনির জন্যে অপেক্ষা করছে সে।

এখন দুটো কাজ। মোবাইলের টুকরোগুলোকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া। কিছু নর্দমায়, কিছু ডাস্টবিনে, কিছু সমুদ্রে। দ্বিতীয় কাজ হল আজাদকে আগামিকাল প্লেনে তুলে দেওয়া। তারপরেই অগাধ শান্তি।

জিটনি আসছে। ফুরফুরে মেজাজে কিয়ারা অথবা অ্যাল অথবা অলোক সরকার গান ধরল, ‘হি ইজ রিয়্যাল নোহোয়্যার ম্যান, সিটিং ইন হিজ নোহোয়্যার ল্যান্ড, মেকিং অল হিজ নোহোয়্যার প্ল্যানস ফর নোবডি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *