রইল বাকি দুই
একুশে ফেব্রুয়ারি
ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সিনিয়ার অফিসারের হাত থেকে ল্যান্ড লাইনের রিসিভার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বীরেন্দ্র মেহতা বললেন, ‘নমষ্কার।’
ও প্রান্ত থেকে আমেরিকার প্রধানমন্ত্রী জন বাইডেন বললেন, ‘হ্যালো মিস্টার মেহতা। কেমন আছেন?’
কথা হচ্ছে ইংরিজিতে। বীরেন্দ্র বললেন, ‘ভালো আছি। কেন ফোন করেছেন বলুন।’
জন বললেন, ‘বিশেষ দরকারে আপনার শরণাপন্ন হলাম। কারণ আমার দেশ সর্বশক্তিমান হলেও এই দেশটাকে নিয়ে সরাসরি কিছু করতে পারবে না।’
‘কোন দেশের কথা বলছেন?’
‘সিনচান রাষ্ট্র,’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জন, ‘আসল কথা হল, আমেরিকার বড় বড় কোম্পানিগুলো আউটসোর্সিং-এর নাম করে সব জিনিস সিনচানে বানাচ্ছে। শ্রমিক সস্তা, কর্মদক্ষতা বেশি, ইউনিয়নের ঝামেলা নেই, কাজ মসৃণভাবে হয়। কিন্তু সেই সুযোগ নিয়ে দেশটা আর একটা ওয়ারিস্তান হয়ে উঠছে। ওয়ারিস্তান ছিল মাথামোটা, টেররিস্ট কানট্রি। দুমদাম এদিক সেদিক বোমা মারত। ওদের পাল্টা মার দেওয়ার জন্যে অজুহাতের দরকার পড়ত না। কিন্তু সিনচান অন্য রকমের বদমাইশ দেশ। এরা আমাদের অর্থনীতি ভিতর থেকে ফোঁপরা করে দিচ্ছে। আরও বেশি মুনাফা করার জন্যে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলো সব কিছু ওদের হাতে তুলে দিয়ে এমন অবস্থা করেছে আমি সিনচান-বিরোধী অবস্থান নিলে আমার দেশের কোম্পানি তার বিরোধীতা করছে।’
‘ইংল্যান্ডের “ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি” আমাদের দেশে অনেক কাল রাজত্ব করেছে। কোম্পানি কী জিনিস আমরা জানি।’ হাসলেন বীরেন্দ্র, ‘ওকথা বাদ দিন। আপনি যখন বলছেন, তখন কাজটা হয়ে যাবে। এবং এই কাজের বিনিময়ে আমি কিছু চাইলে আপনি ‘না’ বলবেন না, এটাও আমি জানি!’
‘এটাকে “গিভ অ্যান্ড টেক” হিসেবে দেখবেন না প্লিজ!’
‘আমি সেই ভাবে দেখছি না তো! আমি আপনার দেশের জন্যে একটা কাজ করছি। আমি জানি যে আমার দেশের বিপদে আপনিও আমাকে সাহায্য করবেন।’
‘ইউ আর ইনকরিজব্ল বীরেন!’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জন।
বীরেন্দ্র হাসতে হাসতে বললেন, ‘এবার সমস্যাটা বলুন।’
‘দিস ইজ অল অ্যাবাউট আ ফিশ!’
‘মাছ?’ বীরেন্দ্র অবাক হয়ে শুনছেন।
দীর্ঘ ত্রিশ মিনিট ধরে কথা বললেন বাইডেন। সব শোনার পরে বীরেন্দ্র বললেন, ‘আপনার কাজ হয়ে যাবে। তবে আমি একটি জিনিস চাইব।’
‘বলুন।’
একজনের নাম করে বীরেন্দ্র বললেন, ‘আমি ওকে এলিমিনেট করতে চাই। আমার দেশের একাধিক এজেন্টকে ও মেরেছে।’
‘আপনি সিয়োর? আমি এটা ব্লাডলেস অপারেশান চাইছিলাম।’
‘ “হ্যাঁ” বা “না”-য়ে উত্তর চাই মিস্টার বাইডেন।’ কঠিন শোনাল বীরেন্দ্রর কণ্ঠস্বর।
আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে জন বললেন, ‘হ্যাঁ। তবে ওই একজনই। আর কেউ নয়।’
ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন কাটলেন বীরেন্দ্র।
বাইশে ফেব্রুয়ারি
রঞ্জিত গগৈয়ের অফিসে বসেছিল প্রথমা আর আয়েশা। হঠাৎ তাদের পিছন থেকে চেনা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে ধন্যবাদ!’
নিয়মমাফিক অভিবাদনের পরে রঞ্জিত বললেন, ‘আপনি কেন এলেন? আমাকে ডাকলে পারতেন!’
‘সময় নেই। নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে।’ কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, ‘প্রথমা আর আয়েশাও বসে পড়ো। নতুন কাজ আছে।’
সবাই বসতে না বসতেই রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকাল উইং বা ‘র’-য়ের এক কর্মচারী এসে একগাদা হাতে লেখা কাগজ দিয়ে গেল। সেগুলো নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলেন বীরেন্দ্র।
‘আপনি এখনও হাতে লেখা ডকুমেন্ট পড়েন, ল্যান্ডলাইন ব্যবহার করেন। আমার এটা খুব ভালো লাগে।’ বললেন রঞ্জিত।
‘ওসব ব্যবহার করলে ডেটা চুরির সম্ভাবনা থাকে না,’ বললেন বীরেন্দ্র। ‘পুরো ডকুমেন্ট তুমি আগে পড়ো। তারপরে ওদের বুঝিয়ে দাও। হাতে ঠিক এক মাস সময় আছে।’
র-য়ের এজেন্টের সঙ্গে বীরেন্দ্র বেরিয়ে গেলেন। আর্দালি ইতিমধ্যে চা নিয়ে এসেছে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে ডকুমেন্ট পড়ছেন রঞ্জিত। একবার, দুবার, তিনবার…
অবশেষে প্রথমার দিকে ফিরে বললেন, ‘গতকাল জন বাইডেন আমাদের প্রাইম মিনিস্টারকে ফোন করে অদ্ভুত একটা সাহায্য চেয়েছেন। তিনি অনুরোধ করেছেন ভারত যেন ডেথ ভ্যালির মাছকে সুরক্ষা দেয়।’
‘মানে?’ বলল আয়েশা।
‘ডেথ ভ্যালি তো নেভাডায়!’ বলল প্রথমা।
চায়ে চুমুক দিয়ে, কাগজের দিকে তাকিয়ে রঞ্জিত বললেন, ‘হ্যাঁ, ডেথ ভ্যালি নেভাডায় অবস্থিত। এটা উত্তর আমেরিকার সব থেকে নিচু জায়গা, পশ্চিম গোলার্ধের সব থেকে শুকনো জায়গা এবং পৃথিবীর সব থেকে গরম জায়গা। এখানে বছরে গড় বৃষ্টিপাত হয় মাত্র পাঁচ সেন্টিমিটার। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠে ছাপ্পান্ন ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত।’
‘‘‘র’’ এইসব পাঠিয়েছে? এগুলো তো গুগ্ল করলে জানা যায়।’ ফিক করে হেসে ফেলেছে আয়েশা।
‘চুপ করে শোন।’ ধমক দিলেন রঞ্জিত। ‘ডেথ ভ্যালিতে জলাশয় নেই বললেই চলে। থাকলেও সেটা নোনতা। ফার্নেসের মতো পরিবেশে দিনের বেলায় শুধুমাত্র এক ধরনের গিরগিটি দেখা যায়। সন্ধ্যার পরে ছোটখাট চারপেয়ে দেখা যায়। এছাড়াও প্রজাপতি, হামিং বার্ড, মৌমাছি আর মাছ দেখা যায়। আর ঠিক ত্রিশ দিন পরে ওয়ারিস্তান, শ্যামলদেশ আর সিনচান থেকে ডেথ ভ্যালিতে পৌঁছোচ্ছেন চারজন টুরিস্ট। “সি আই এ”-র ইনটেল অনুযায়ী এঁদের মধ্যে তিনজন আসছেন একটা নির্দিষ্ট প্রজাতির মাছ চুরি করতে।’
‘মাছ?’ আয়েশা আর প্রথমা একসঙ্গে বলল।
‘শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্যি। ডেথ ভ্যালিতে যে সব মাছ পাওয়া যায় তারা মরুভূমির নোনতা জলে বেঁচে থাকতে পারে। এদের মধ্যে একটা প্রজাতি হল “ডেভিল’স হোল পাপফিশ” বা “সাইপ্রিনোডন ডায়াবলিস”। অস্বাভাবিক বেশি তাপমাত্রা এবং খুব কম অক্সিজেনের মধ্যে একটি পাথুরে গুহায় বেঁচে থাকে এই মাছ। পাথুরে গুহার নাম “ডেভিল’স হোল”। সেখান থেকেই মাছের এই নাম।’
‘আমাদের কাজ মাছ চুরি আটকানো?’ জিজ্ঞাসা করল প্রথমা।
‘ওদের মধ্যে একজন আমাদের “রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকাল উইং” বা “র”-য়ের তিনজন এজেন্টকে খুন করেছে। কাইমেরার পরের কাজ হল, তাকে সরিয়ে দেওয়া।’
প্রথমা বলল,
“হারাধনের তিনটি ছেলে
ধরতে গেল রুই,
একটি খেলো বোয়াল মাছে
রইল বাকি দুই।”
তিনজন মাছ চোরের মধ্যে একজনকে বোয়াল মাছে খাবে। তাই তো?’
‘একদম ঠিক। এই ফাইলে ওই তিনজনকে নিয়ে যাবতীয় তথ্য আছে। বাকি তথ্য আয়েশা খুঁজে বার করবে। সাতই জুনের মধ্যে আমার একটা ফুলপ্রুফ প্ল্যান চাই।’
‘ঠিক আছে স্যর,’ চেয়ার থেকে উঠে সেলাম ঠুকল প্রথমা আর আয়েশা।
তেইশে মার্চ, দিন
‘তিন মিলিয়ন একরের বেশি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে ডেথ ভ্যালি।’ ওয়েসিস হোটেল পা রাখা ভ্রমণার্থীকে বলছে ফ্রন্ট অফিসের মহিলা কর্মচারী রুথ, ‘প্রতি বছর এখানে প্রায় চার লাখ টুরিস্ট আসেন। এবং সেটাও মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য!’
‘আমি দু-দিনের জন্যে এসেছি।’ পাসপোর্ট এগিয়ে বললেন বছর চল্লিশের এক মহিলা। কালো চুল, কালো চোখের মনি, তামাটে গায়ের রং দেখে মনে হয় ভারতীয় উপমহাদেশের বাসিন্দা।
‘লায়লা হাসান, ওয়ারিস্তান…’ কম্পিউটারে ডেটা এনট্রি করে রুথ বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি এই হোটেলের এসি ঘরেই ম্যাক্সিমাম সময় কাটাবেন। ডেজার্ট সাফারিতে যাবেন এসি গাড়িতে। আপনাকে যদি মরুভূমিতে ছেড়ে দেওয়া হয়, তা হলে দু-ঘণ্টার বেশি বাঁচবেন না। ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে মরুভূমির তাপ সহ্য করতে না পেরে মারা গেছেন আঠেরোজন পর্যটক। তাই আমাদের না বলে হোটেল থেকে বেরবেন না। বাই দ্য ওয়ে, আপনার পারপাস অফ ভিজিট?’
‘আমি একজন প্লান্ট বায়োলজিস্ট বা বোটানিস্ট। এখানে এসেছি গাছপালার বৈচিত্র দেখতে। খুব বেশি গাছপালা তো এখানে নেই। যা আছে, সেটাও পাহাড়ের নীচের অংশে আর গভীর খাদে। গাছগুলো বৃষ্টির জলকে কাণ্ডমূলে অনেক দিন ধরে রাখে। ওই কাণ্ডমূলের ফাংশান বোঝার জন্যেই দিনের বেলায় মরুভূমিতে বেরনো আমার কাছে জরুরি।’
‘সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনার সঙ্গে আমি থাকব।’ রুমের কি কার্ড এগিয়ে দিয়ে বলল রুথ, ‘আমাদের বেলবয় টেড আপনার লাগেজ নিয়ে যাচ্ছে।’
‘ধন্যবাদ।’ লায়লা এগোলেন লিফ্টের দিকে। রুথ তাকাল হোটেলের এনট্রান্সের দিকে। আর একজন টুরিস্ট ঢুকছেন।
‘হুয়া মুলান ফ্রম সিনচান।’ নিজের পাসপোর্ট এগিয়ে দিলেন বছর পঁয়ত্রিশের এক মহিলা।
কম্পিউটারে ডেটা এনট্রি করার ফাঁকে রুথ জিজ্ঞাসা করল, ‘পারপাস অফ ভিজিট?’
‘আমি একজন ফিশ মাইক্রোবায়োলজিস্ট। ডেথ ভ্যালিতে কিছু দুষ্প্রাপ্য মাছ আছে। সেগুলো দেখতে এসেছি।’
‘তার জন্যে আপনাকে ডেভিল্স হোলে যেতে হবে। আমাদের গাড়ি আপনাকে সেখানে পৌঁছে দেবে। তাই যা বলছি, সেটা মাথায় ঢুকিয়ে নিন। ডেথ ভ্যালিতে ঘোরার সময় প্রচুর জল খেতে হবে। এসি গাড়ির বাইরে বেশিক্ষণ ঘোরাঘুরি করা যাবে না।’
‘জানি,’ বললেন হুয়া।
‘নিজেকে ঠান্ডা রাখার জন্যে কয়েকটা নিয়ম মানতেই হবে। যেমন, সরাসরি সূর্যের আলো যেন গায়ে না পড়ে। হালকা, ঢিলেঢালা পোশাক পরবেন। মাথায় আর কাঁধে ভেজা কাপড় রাখতে হবে, ছাতা ব্যবহার করতে হবে। কফি, অ্যালকোহল বা সফ্ট ড্রিঙ্ক থেকে দূরে থাকুন। আর, লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট, বিপদে পড়লে আমার ইমার্জেন্সি নম্বরে যোগাযোগ করবেন।’ রুমের কি কার্ড এগিয়ে দিল রুথ।
টেড এর মধ্যে ফিরে এসেছে। তার হাতে লাগেজ তুলে দিয়ে লিফ্টের দিকে যেতে গিয়ে হুয়া বললেন, ‘আপনাদের হোটেলটা একদম নতুন, তাই না? আমিই কি প্রথম গেস্ট?’
টেড বলল, ‘মাত্র একমাস চালু হলেও আমাদের হোটেলের ফুটফল খুব ভালো। আপনি আমাদের চারশো এগারোতম অতিথি।’
টেড লিফ্টে উঠে গেল। সঙ্গে গেলেন হুয়া। রুথ দেখল, পরের অতিথি ঢুকছেন।
বছর চল্লিশের মহিলা ভ্রমণার্থী পাসপোর্ট এগিয়ে বললেন, ‘আফরা পারভিন ফ্রম শ্যামলদেশ। পারপাস অফ ভিজিট, অ্যাকাডেমিক।’
ডেটা এনট্রি করতে করতে রুথ জিজ্ঞাসা করল, ‘কোন বিষয় নিয়ে কাজ করছেন জানতে পারি?’
‘আমি একজন জিওলজিস্ট এবং পেট্রোলজিস্ট।’ উত্তর দিলেন আফরা। রুথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে বললেন, ‘পেট্রলজিস্ট মানে জানা নেই, তাই তো?’
‘হ্যাঁ!’ হাসল রুথ।
‘জিওলজি বা খনিজ বিদ্যার পরের একটি শাখা হল শিলাবিদ্যা। এই বিশেষ শাখায় পাথর ও তার বৈশিষ্ট্য নিয়ে চর্চা করা হয়।’
‘ওহ্! তার মানে আপনি স্লাইডিং স্টোন দেখতে এসেছেন!’ বলল টেড। সে লাগেজ রেখে ফিরে এসেছে।
‘একদম ঠিক বলেছ।’ ভালো ছাত্র পেয়ে খুশি আফরা, ‘ডেথ ভ্যালির চলমান পাথরের কথা এতদিন শুনেই এসেছি। এবার নিজের চোখে দেখব। পাথরগুলোকে নাকি চলমান অবস্থায় কেউ কখনও দেখেনি। কাদায় রেখে যাওয়া ছাপ থেকে এদের জায়গা পরিবর্তন সম্পর্কে আন্দাজ করা যায়।’
‘আমি তো ভাবতাম এগুলো লোকাল লোকের কাজ,’ বলল টেড, ‘ডেথ ভ্যালির রহস্য বাড়ানোর জন্যে এসব করে।’
‘ভুল ধারণা। কিছু কিছু পাথরের ওজন কয়েক শো পাউন্ড। অত ভারি পাথর কে, কী ভাবে অন্য জায়গায় সরাবে? একদল পেট্রোলজিস্ট বলেন গরমের বালি আর শীতের বরফের কারণে, তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে পাথর সরে। আর একদল বলেন, বন্যার জন্যে পাথর জায়গা বদলেছে। সত্যিটা কী নিজের চোখে দেখতে এসেছি।’
টেডের সঙ্গে আফরা লিফ্টের দিকে এগোলেন। রুথ দেখল দরজা দিয়ে ঢুকছেন নতুন অতিথি।
‘লিউ ফ্রম সিনচান।’ রুথের হাতে পাসপোর্ট তুলে দিয়ে বছর সাতাশের মেয়েটি বলল, ‘আমি একজন ট্রাভেল ব্লগার। এক্সট্রিম ওয়েদারে ঘোরাঘুরি করাই আমার ইউএসপি। আপনি ‘এক্সট্রিম লিউ’ চ্যানেলের নাম জানেন? ওয়ান পয়েন্ট এইট মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার আছে!’
‘আমি এক্ষুনি সাবস্ক্রাইব করছি।’ পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে হাসল রুথ, ‘আপনার মতো ইনফ্লুয়েন্সার আমাদের কথা বললে ওয়েসিস হোটেলের সম্মান বাড়বে।’
‘আমি পেইড প্রোমোশান ছাড়া কাজ করি না। এটা খেয়াল রাখবেন।’
টেড ফিরে এসেছে। তার হাতে লাগেজ ধরিয়ে লিফ্টের দিকে এগোলেন লিউ।
তেইশে মার্চ, রাত
‘কী খবর?’ সুরক্ষিত ফোন কলে জানতে চাইলেন রঞ্জিত।
‘হোটেলে আজই সবাই উঠেছে স্যর,’ বলল প্রথমা। ‘আজ রাতে কেউই বেরোবে না। কাল দিনের বেলায় ডেজার্ট সাফারি আছে। আমরা ইচ্ছে করে কাণ্ডমূল-ওয়ালা গাছ, ডেভিল্স হোল আর স্লাইডিং স্টোন সবার শেষে রেখেছি। যাতে ওরা বুঝতে পারে এই হোটেল থেকে জায়গাগুলো কতটা কাছে। আমার ধারণা ওরা পরশু রাতে কাজটা করে ভোরবেলা চলে যাবে।’ বলল প্রথমা।
আয়েশা বলল, ‘একটা কথা বলতেই হবে স্যর। সি আই এ এই হোটেলটা মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে বানিয়ে দিল। এটা বিরাট কৃতিত্ব। আমরা এসে দেখি সব কিছু রেডি।’
রঞ্জিত বললেন, ‘তেইশে ফেব্রুয়ারি প্রথমা আমাকে ওর প্ল্যান বলে। প্ল্যানটা আমার কাছে খুবই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। ইনফর্মেশানটা জনকে দিতেই উনি কাজ শুরু করে দেন। হোটেলটা তৈরি হতে কুড়ি দিন সময় লেগেছে।’
‘আমার একটা প্রশ্ন আছে স্যর।’ বলল প্রথমা, ‘মাছটা চুরি হবে কেন?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রঞ্জিত বললেন, ‘আয়েশার কাজ রিসার্চ করা। ও কিছু বলেনি?’
আয়েশা রেগে গিয়ে বলল, ‘ইনফর্মেশানের অভাব নেই আমার কাছে। কিন্তু সেগুলো জুড়ে আমি কোথাও পৌঁছোতে পারছি না।’
‘আচ্ছা, কী কী জানিস বল।’
‘ডেভিল্স হোলের টেম্পারেচার চৌত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অক্সিজেনের পরিমাণ বিপজ্জনক ভাবে কম। মানুষ কেন, কোনও মেরুদণ্ডী প্রাণীই এই আবহাওয়ায় এক মিনিটও বেঁচে থাকতে পারবে না। অথচ পাপফিশ এখানে বাস করছে দশ থেকে কুড়ি হাজার বছর ধরে। শেষ মৎস গণনায় দেখা গেছে, মাত্র একশো পঁচাত্তরটা মাছ আছে। এরাই পৃথিবীর বিরলতম মাছ। বিরল হওয়াই কি চুরির কারণ?’
‘ব্যবসার গন্ধ না থাকলে সিনচান কোনও কাজে হাত দেয় না। বিরলতম হওয়া কোনও বৈশিষ্ট্য নয়। আর কিছু জানিস?’
মাথা চুলকে আয়েশা বলল, ‘ডেভিল্স হোলের গভীরতা পাঁচশো ফুটের বেশি হলেও বেশিরভাগ মাছই ওপরের ত্রিশ ফুটের মধ্যে থাকে। জলস্তরের কাছাকাছি যে সব পাথর আছে তার গায়ে লেগে থাকা শ্যাওলা খেয়ে বাঁচে ও বংশবৃদ্ধি করে। জলস্তর ও তাপমাত্রার ওঠানামা, সূর্যের তেজ—সবই এদের জীবনচক্রকে প্রভাবিত করে। অন্যান্য মাছ ডেভিল্স হোলের মতো জায়গায় বেঁচে থাকতে না পারলেও পাপফিশ পারে কারণ ওদের শরীরে ‘প্যারাডক্সিকাল অ্যানারোবিজম’ নামে একটি অভিযোজন ঘটেছে যেটা বিপাকক্রিয়াকে কমিয়ে দেয়। ওরা আড়াই ঘণ্টা পর্যন্ত শ্বাস না নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে। এটা সম্ভব হয়েছে এদের অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমের কারণে।’
‘মাইক্রোবায়োম মানে কী?’ জিজ্ঞাসা করল প্রথমা।
‘মাইক্রোবায়োম হল ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাসের কালেকশান যা একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে কোনও প্রাণীর শরীরের কোনও একটি অংশে, যেমন পাচনতন্ত্রে বসবাস করে। মাইক্রোবায়োমের সদস্য কারা, তারা প্যারাডক্সিকাল অ্যানাবলিজম কী ভাবে ঘটাচ্ছে সেটা জানতে পারলে বোঝা যাবে উচ্চ তাপমাত্রায় ও কম অক্সিজেনে কী ভাবে বাঁচে পাপফিশ। কিন্তু সেটা জেনে কার কী লাভ হবে?’
রঞ্জিত বললেন, ‘এইখানে তোদের একটু হেল্প করি। তোরা কি জানিস যে ১৯০০ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর তাপমাত্রা শূন্য দশমিক এক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে?’
‘না।’ একসঙ্গে বলল আয়েশা আর প্রথমা।
‘বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে মরুভূমির বাস্তুতন্ত্র, যা পৃথিবীর প্রায় ২৫ শতাংশ জুড়ে আছে রয়েছে, বিলুপ্তির মুখে। উষ্ণায়নের প্রভাব ডেথ ভ্যালির গাছপালা এবং প্রাণীদের ওপরেও পড়ছে। তা সত্ত্বেও মাছগুলো বেঁচে আছে কী করে?’
‘কী করে?’
‘ডিজাস্টার মার্কেটিং কাকে বলে জানিস?’
আয়েশা বলল, ‘কোভিড শুরু হওয়ার পরে মাস্ক, স্যানিটাইজার আর পিপিই-র বিক্রি বেড়ে গিয়েছিল। দুর্ভিক্ষের সময় চালের দাম বাড়ে।’
‘একদমই তাই। মানুষ বিপদে পড়লে সেই বিপদ থেকে যে মুনাফা হয়, সেটাই ডিজাস্টার মার্কেটিং। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়লে আর অক্সিজেন কমলে সেই বেশি তাপমাত্রা আর কম অক্সিজেনে বেঁচে থাকার “ম্যাজিক বুলেট” তৈরি করবে সিনচান। বিশ্বের এক নম্বর শক্তি হয়ে যাবে।’
‘এইবারে বুঝলাম,’ বলল প্রথমা।
‘মাছগুলো সিনচানে নিয়ে গিয়ে রিসার্চের কাজে ব্যবহার করবে,’ বলল আয়েশা, ‘পাশাপাশি আমেরিকাকে এই বিষয় নিয়ে রিসার্চ করতে দেবে না। বিরাট বড় ছক।’
‘এতক্ষণে সবটা বুঝতে পেরেছিস। আগামী আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে রেজাল্ট চাই।’ ফোন কাটলেন রঞ্জিত।
ওয়েসিস হোটেলে প্রথমার রুম থেকে বেরিয়ে আয়েশা নিজের রুমে চলে গেল। কাল সারাদিন এবং রাত খুবই ব্যস্ততার মধ্যে কাটবে।
চব্বিশে মার্চ, রাত
রাত একটার সময় ওয়েসিস হোটেল থেকে মাত্র একশো মিটার দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক ছায়ামূর্তি। ডেথ ভ্যালির আকাশ জুড়ে অজস্র তারা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এখন সময়টা অমাবস্যার আশেপাশে। চাঁদের আলো কম বলে অন্ধকার বেশি। বালির ঢিপির একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তিকে চেনা যাচ্ছে না।
একটু পরেই তার কাছে চলে এসেছে দ্বিতীয় ছায়ামূর্তি। দুজনের পরনেই ধূসর রঙের কার্গো আর টি-শার্ট। মুখ ও মাথা ধুসর কাপড়ে ঢাকা। দুজনের কাঁধেই ব্যাকপ্যাক।
এবার এল তৃতীয় ছায়ামূর্তি। তার পরনেও এক পোশাক। তিনজনে পরস্পরের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে এগোতে লাগল।
প্রথম ছায়ামূর্তি বলল, ‘গুগল ম্যাপে খুব ক্লিয়ারলি জায়গাটা দেখাচ্ছে না। তবে ডেভিল্স হোল এক কিলোমিটারের মধ্যে, পশ্চিম দিকে। দ্যাট্স ফর সিয়োর।’
দ্বিতীয় ছায়ামূর্তি বলল, ‘দেখো লায়লা, এসব জায়গায় ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের ওপরে ভরসা না করাই ভালো। ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট একদম রেখো না। কোনও গন্ডগোল হলে সামলানো যাবে না।’
প্রথম ছায়ামূর্তি ওরফে বোটানিস্ট লায়লা বললেন, ‘আমি মোবাইল দেখেছি হোটেলের রুমে। সঙ্গে আনিনি। তবে আপনার কথা ঠিক। আপনি এই অপারেশানের ক্যাপ্টেন। আপনি যা বলবেন, তাই হবে হুয়া।’
ফিশ মাইক্রোবায়োলজিস্ট হুয়া বললেন, ‘ইংরিজিতে একটা কথা আছে। ‘প্যারাডাইম শিফ্ট।’ এর ঠিকঠাক মানে বোঝানো শক্ত। মোদ্দা ব্যাপার হল, এতদিন আমরা যেভাবে ভাবতাম এবং কাজকর্ম করতাম, তার মধ্যে বেসিক একটা বদল আসা। এবং আগের সবকিছু বদলে যাওয়া। কোভিড অতিমারি এবং লকডাউন একটা প্যারাডাইম শিফ্ট ঘটিয়েছে। পরের শিফ্টটা আসবে বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্যে। সেটা মানুষের থেকে অনেক আগে বুঝেছে প্রাণীরা। পাপফিশের কথাই ধরো। মরুভূমির ছোট্ট পুকুরে থাকা মাছের পক্ষে অন্য জায়গায় যাওয়া অসম্ভব। তাই এরা নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিচ্ছে, নিজেদের মধ্যে অভিযোজন ঘটাচ্ছে। আমরা অভিযোজনের প্রক্রিয়াটি জানতে এসেছি। কী লিউ, তাই তো?’
তৃতীয় ছায়ামূর্তি ওরফে ট্রাভেল ব্লগার লিউ এতক্ষণ কোনও কথা বলেননি। তিনি এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বাঁদিকে আঙুল দেখালেন।
সেদিকে তাকিয়ে হুয়া দেখলেন একটু দূরেই স্লাইডিং স্টোনগুলো দেখা যাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ। ওইটা আমাদের একটা চিহ্ন। সকালে রুথ দেখিয়েছিল। আর পাঁচশো মিটার গেলেই ডেভিল্স হোল।’
লায়লা বললেন, ‘রুথ মেয়েটা খুব এফিসিয়েন্ট। আজ দিনের বেলা যেভাবে আমাদের গোটা জায়গাটা ঘুরিয়ে দেখাল, তাতে বোঝা যায় যে এখানে অনেক কাল ধরে আছে।’
‘কিন্তু হোটেলটা একদম নতুন। আমরাই প্রথম লটের কাস্টমার।’ হুয়া বললেন।
‘আফরা এটা ওকে জিজ্ঞাসা করছিলেন। আমি শুনেছি।’ বললেন লায়লা। ‘রুথ আগে ডেথ ভ্যালির অন্য একটা হোটেলে কাজ করত। নতুন হোটেলে বেশি মাইনের লোভে চলে এসেছে।’
‘লিউ, আপনি তো ট্রাভেল ব্লগার। আপনি কেন এখানে এসেছেন? লায়লা, কিছু আন্দাজ করতে পারেন?’
হুয়ার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই লিউ হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাঁকে দাঁড়াতে দেখে বাকি দুজনও দাঁড়ালেন। ওঁদের চমকে দিয়ে শেয়ালের দঙ্গল দৌড়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার হাঁটা শুরু করলেন তিনজন।
লায়লা বললেন, ‘আপনাদের সঙ্গে আমার আলাপ এয়ারপোর্টে নেমে। আমরা টিম মেম্বার হতে পারি, কিন্তু সবাইকে ঠিক ভাবে চিনে উঠতে পারিনি।’
হুয়া বললেন, ‘আমি বলছি। উনি একজন মলিকিউলার বায়োলজিস্ট। উনি কাজ করছেন প্রোটিওমিক্স নিয়ে।’
‘সেটা কী?’
‘প্রোটিন নিয়ে চর্চাকে বলা হয় প্রোটিওমিক্স। তবে উনিও মাছ নিতেই এসেছেন।’
‘তাই?’ লায়লা অবাক।
‘সিনচানের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়েও পাপফিশ নিয়ে গবেষণা চলছে। লিউয়ের পাখির চোখও পাপফিশ। তবে ওঁর রিসার্চ, মাইক্রোবায়োম নিয়ে নয়, পাপফিশের প্রোটিন নিয়ে।’
‘মানে?’ জিজ্ঞাসা করলেন লায়লা। তিনজনে এসে দাঁড়িয়েছেন ডেভিল্স হোলের কাছে। সামনেই দেখা যাচ্ছে জলাশয়। সকালে যখন ওঁরা এসেছিলেন তখন গরমের চোটে প্রাণ ওষ্ঠাগত ছিল। রোদের তেজের জন্যে জলের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। এখন সেই পরিস্থিতি নেই। এখন জল আগের মতো গরম নয়। রোদের প্রতিফলনও নেই।
জলাশয়ের পাশে বসে ব্যাকপ্যাক সামনে রেখে বসলেন হুয়া। ছোট্ট একটা পাম্প লাগানো মেশিন বার করে, তার সঙ্গে জোড়া, লম্বা একটি নল জলের গভীরে পাঠিয়ে বললেন, ‘ওদের যেটুকু ডেটা পেয়েছি, তার ভিত্তিতে বলা যায় যে স্বাদ এবং গন্ধের ফারাক করার জন্যে; জলের নোনতা ভাব আর প্রবাহ চেনার জন্যে, ফোটো সেনসিটিভিটি নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে ওদের মধ্যে নির্দিষ্ট একটা প্রোটিন আপনা আপনি তৈরি হয়েছে। এই প্রোটিনই মানবজাতির সেই ম্যাজিক বুলেট।’
‘মাইক্রোবায়োম ভারসাস প্রোটিওমিক্স। জীবাণু বনাম প্রোটিন। পথ আলাদা। লক্ষ্য এক। ম্যাজিক বুলেট।’ আপনমনে বললেন লায়লা।
খুব আস্তে একটা আওয়াজ হচ্ছে। জলস্তর কমছে। নলের সঙ্গে উঠে আসা যাবতীয় প্রাণী জড়ো হচ্ছে প্লাস্টিকের পাউচের মধ্যে। বাকি জল মরুভূমিতে পড়েই মিলিয়ে যাচ্ছে। খুব বেশি জল পাম্প করার প্রয়োজন নেই। কারণ পাপফিশ জলস্তরের ওপর দিকে থাকে।
‘আমি অন্য একটা ম্যাজিক বুলেট জানি।’ বললেন লিউ। তাঁর গলার আওয়াজ শুনে হুয়া চমকে উঠে পিছন ফিরে বললেন, ‘আপনি কে? আপনি তো লিউ নন!’
সেটাই হুয়ার উচ্চারণ করা শেষ বাক্য। তৃতীয় ছায়ামূর্তির হাতে চলে এসেছে একটি ছোট্ট আগ্নেয়াস্ত্র। সেটি হুয়ার মাথার পিছনে ঠেকিয়ে গুলি চালালেন তিনি। নিঃশব্দে শুয়ে পড়লেন হুয়া। দৃশ্যটি দেখে একটিও কথা না বলে দৌড় দিলেন লায়লা। তিনি মরুভুমির দিকে যাচ্ছে না ওয়েসিসের দিকে—নিজেই জানেন না। একেই বলে মৃত্যুভয়!
মুখ থেকে ধূসর কাপড় সরিয়ে এদিক ওদিক দেখল প্রথমা। সে জানে যে আফরা আশেপাশেই আছেন। মিনিটখানেক অপেক্ষা করেও তাকে দেখতে না পেয়ে, এই নিয়ে আর মাথা ঘামাল না প্রথমা। পাম্প বন্ধ করে লম্বা নলটি জলের ওপরে তুলে নলের প্রান্তে মুখ দিয়ে প্রবল জোরে হাওয়া টানতে লাগল। মুখে নোনতা স্বাদ লাগছে, বমি পাচ্ছে, কিন্তু কিছু করার নেই। সাইফনিং না করলে জল উল্টোমুখে বইবে না। মাছগুলো মরে যাবে।
একটু পরেই জলের ধারা আবার ডেভিল্স হোলের দিকে বইতে লাগল। মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম মেনে জল এখন নীচের দিকে যাবে। মৃত হুয়ার পাশ থেকে মাছ ও অন্য প্রাণী ভর্তি প্লাস্টিকের পাউচ খুলে সেটার মধ্যে যা আছে ছেড়ে দিল প্রথমা। এর মধ্যে ক’টা পাপফিশ ছিল জানা নেই। কিন্তু সবাই যে নিজের বাসস্থানে ফিরে গেল এটা খুব ভরসার কথা।
কাজ চুকিয়ে ওয়েসিসে ফিরছে প্রথমা। ওখানে কী অবস্থা কে জানে! আজ দিনের বেলা, ডেজার্ট সাফারির পরে সে জিওলজিস্ট এবং পেট্রোলজিস্ট আফরার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেছিল। বীরেন্দ্র মেহতার অনুরোধ ফেলতে পারেননি শ্যামলদেশের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর দেশের ‘ন্যাশনাল সিকিয়োরিটি ইনটেলিজেন্স’ বা ‘এন এস আই’-এর মহিলা এজেন্টকে শিলা-বিশেষজ্ঞ সাজিয়ে পাঠিয়েছিলেন প্রথমাদের সাহায্য করার জন্যে। আফরা ওদের পিছন পিছন ডেভিল্স হোল পর্যন্ত এসেছিল। সব ঠিক আছে দেখে হোটেলে ফিরে গেছে।
আধঘণ্টা পরে রঞ্জিতের সঙ্গে কথা বলছে আয়েশা আর প্রথমা। রঞ্জিত বললেন, ‘খুব সংক্ষেপে যা বলার বলে ফেল।’
প্রথমা বলল, ‘ “র”-এর একাধিক এজেন্টকে সিনচানের যে এজেন্ট খুন করেছিলেন, তার নাম হুয়া মুলান। তিনি এখন ডেভিল্স হোলের ধারে মরে পড়ে আছেন। পাপফিশগুলো ডেভিল্স হোলেই আছে। হুয়ার দুই সঙ্গী লিউ আর লায়লা পলাতক। আফরা হোটেলেই আছে। শ্যামলদেশের নির্দেশের অপেক্ষা করছে।’
আয়েশা বলল, ‘সি আই এ-র এজেন্ট টেড বেলবয় সেজে লাগেজ বয়ে বয়ে ক্লান্ত। আমিও রুথ সেজে ফ্রন্ট ডেস্ক সামলে ক্লান্ত। প্লিজ অন্য কোনও কাজ দিন।’
‘আফরার কাছে নির্দেশ পনেরো মিনিট বাদে ওর দেশ থেকে পৌঁছে যাবে। তবে তোদের এখন একটাই কাজ। পরের প্লেন ধরে ইন্ডিয়া ফেরত আসা। বাকিটা জন বাইডেন আর আমেরিকান সরকার বুঝে নেবে।’
‘থ্যাঙ্কিউ স্যর!’ একসঙ্গে বলল প্রথমা আর আয়েশা।