রইল বাকি ছয়

রইল বাকি ছয়

এখন

‘স্যর, আমি বলছি!’ উত্তেজিত হয়ে বলল আয়েশা।

‘এটা সিকিয়োর্ড লাইন। মন খুলে কথা বল।’ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রঞ্জিত গগৈ একই রকম উত্তেজিত।

‘প্রথমার সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে না কারণ ওর মোবাইল সুইচ্‌ড অফ। শুনলাম ওর পেটে গুলি লেগেছে। খুব ব্লিডিং হচ্ছে। এক্ষুনি হাসিনাবাদের হাসপাতালে অ্যাডমিট না করালে বাঁচানো যাবে না।’

‘তোকে কে বলল?’

‘সেটা এই মুহূর্তে ইম্পর্ট্যান্ট নয়। যে বলেছে সে ভুল বা মিথ্যে বলেনি।’

‘খোচড়’ বা ‘খব্‌রি’ বা ‘সোর্স’ নিয়ে সবাই খুব সংবেদনশীল। সোর্সের পরিচয় গোপন রাখা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। রঞ্জিত তাই জোর করলেন না। আপনমনে বললেন, ‘প্রথমার বাবা-মায়ের কাছে কী জবাবদিহি করব? প্রাইম মিনিস্টার আর প্রেসিডেন্টকে কী বলব?’

রঞ্জিতের স্বগোতক্তির মধ্যে আয়েশা ফোন কেটে দিয়েছে। দিল্লিতে বসে ওয়ারিস্তানের খবর জোগাড় করা মুখের কথা নয়। তাঁকে এখন অনেকগুলো ফোন করতে হবে।

ত্রিশ দিন আগে

কাইমেরা-র অফিসে বসে সকালবেলা কাজ করছিল আয়েশা আর প্রথমা। হঠাৎ টেবিলে রাখা আদ্যিকালের সাদাকালো মোবাইল ফোন বেজে উঠল। প্রথমা ফোন ধরতেই অন্য প্রান্তের পুরুষ কন্ঠ বললেন, ‘আধঘণ্টার মধ্যে চলে আয়।’

ফোন কেটে দ্রুত অফিস থেকে বেরোচ্ছে প্রথমা। আয়েশা জিজ্ঞাসা করল, ‘বস ডেকেছে?’

‘হ্যাঁ।’ বেরোনোর আগে বলল প্রথমা। পঁচিশ মিনিটের মাথায় সাউথ ব্লকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর অফিসে ঢুকে দেখল, রঞ্জিত ছাড়া আর একজন ব্যক্তি রয়েছেন। এঁকে টিভিতে একাধিকবার দেখেছে প্রথমা। জল সম্পদ বিকাশ মন্ত্রী দীনেশ যাদব।

প্রথমা সোফায় বসা মাত্র দীনেশের দিকে তাকিয়ে রঞ্জিত বললেন, ‘আপনি প্রেজেন্টেশান শুরু করুন।’

দীনেশের হাতে একটি রিমোট। সেটা টিপতেই ঝলমলিয়ে উঠল অফিসের দেওয়ালে মাউন্ট করা বিশাল মনিটর। পর্দায় দেখা যাচ্ছে দিল্লির রাস্তায় পরপর দাঁড়িয়ে থাকা ওয়াটার ট্যাঙ্কারের ফোটো। তারপরে এল জলের জন্যে মানুষের লাইনের ফোটো। জলের জন্যে ঘড়া মাথায় নিয়ে মাইলের পর মাইল রাস্তায় হাঁটতে থাকা মহিলাদের ফোটো।

পরপর কয়েকটি স্লাইড দেখিয়ে দীনেশ বললেন, ‘এখন আমাদের সব থেকে বড় সমস্যা হল জল। আরও নির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে, ওয়াটার মাফিয়া বা জলদস্যু।’

প্রথমা আর রঞ্জিত চুপ। মনিটরে আলট্রা ভায়োলেট পয়েন্টার ঘুরিয়ে দীনেশ বলছেন, ‘এই ফোটোগুলো দিল্লি আর গুরুগ্রামের মধ্যবর্তী এলাকায় তোলা। শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্যে যেটুকু জলের প্রয়োজন, তার জন্যে এখানকার বাসিন্দারা ওয়াটার ট্যাঙ্কারের উপর নির্ভর করেন। বালতি পিছু দাম কুড়ি থেকে পঞ্চাশ টাকা। গরিব মহল্লায় পানীয় জলের জন্যে এত টাকা বার করা শক্ত কাজ। যার ফলে অপরাধ বাড়ছে। ইন ফ্যাক্ট পানীয় জল কেনার জন্যে টাকা জোগাড় করতে গিয়ে অপরাধ বাড়ছে গোটা দেশে। সোশাল সায়েন্টিস্টরা এই ঘটনাকে বলছেন “ওয়াটার ক্রাইম”।’

‘জলসম্পদ বিকাশ মন্ত্রী হিসেবে এই নিয়ে আপনি এই সমস্যার সমাধান নিয়ে কী ভেবেছেন?’ জিজ্ঞাসা করলেন রঞ্জিত।

ম্লান হেসে দীনেশ বললেন, ‘জলের কালোবাজারি ঘটছে, তার প্রধান কারণ সরকারি জল সরবরাহ ব্যবস্থার ত্রুটি। গরম পড়লেই জলস্যুরা সরকারি জল সরবরাহ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়, যাতে জল শুধুমাত্র কিনে খাওয়া যায়। আমার দপ্তর অপরাধী চিহ্নিত করতে পারে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও ক্ষমতা নেই।’

মনিটরে একটি ভিডিও চালু হল। রাস্তার ধারে বসে বাসন ধুচ্ছেন এক মহিলা। বলছেন, ‘জলের অভাবে আমাদের এই জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু যাবই বা কোথায়?’

পরের স্লাইডে পাইচার্ট আর বার ডায়াগ্রাম। দীনেশ বলছেন, ‘আমাদের দেশে যত পরিবার আছে, তার পঁচাত্তর শতাংশের বাড়িতে আজও পানীয় জল সরবরাহ করা যায়নি। প্রায় ষাট কোটি মানুষ, মানে আমাদের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক, চরম পর্যায়ের জলের ঘাটতির মুখোমুখি। এবং দেশজোড়া এই জল দুর্ভিক্ষের কারণ হল ওয়াটার মাফিয়া গজরাজ সিং।’

পরের স্লাইড। হুডখোলা জিপের পাদানিতে পা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে ছ’ফুট লম্বা এবং বিশাল শরীরওয়ালা এক মধ্যবয়সি পুরুষ। কাঁধ থেকে ঝুলছে একে সাতচল্লিশ, কোমরে গোঁজা নাইন এমএম। মোটা গোঁফে তা দিচ্ছে। পরনে জিন্‌স, টি-শার্ট আর স্নিকার। সুনীল বললেন, ‘গজরাজ সিং আদতে দিল্লির বাসিন্দা। সরকার থেকে যে ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে পানীয় জল সরবরাহ করা হয়, সেটার ড্রাইভার হিসেবে কেরিয়ার শুরু করে। ধীরে ধীরে সমস্ত ট্যাঙ্কারের মালিক হয়ে যায়। দখল নেয় সরকারের তালিকাভূক্ত ট্যাঙ্কার সাপ্লায়ার কোম্পানির। সরকারি জল ওর ট্যাঙ্কার মারফত সারা ভারতে পৌঁছোয়। সাপ্লায়ার হিসেবে ওর নাম ব্ল্যাক লিস্ট করার চেষ্টা করেছি। পারিনি। কারণ, আমারই দলের রাজনৈতিক চাপ। প্রতিবার ওয়াটার সাপ্লাইয়ের টেন্ডার সুনীলই পায়। যদি কোনও সরকারি আধিকারিক বিরোধীতা করেন, তাহলে তিনি খুন হয়ে যান।’

‘অন্য পলিটিকাল পার্টিগুলো কী করছে?’ রঞ্জিত বিরক্ত।

‘সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতাদের কিনে রেখেছে গজরাজ। সরকারি আধিকারিকদের মতো ভি আই পি-দের খুন হওয়া নিয়ে কেউ টুঁ শব্দ করছে না। সেখানে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করতে গিয়ে খুন হলে কার কী আসে যায়?’

‘দিল্লি পুলিশ কী বলছে? এনকাউন্টার নিয়ে কিছু ভাবছে?’ সরাসরি গজরাজকে খুন করার কথা বললেন রঞ্জিত।

পরের স্লাইডে যাওয়ার আগে দীনেশ বললেন, ‘ভাবলেও কিছু করতে পারছে না। কারণ গজরাজের নেটওয়ার্ক দেশের বাইরেও বিস্তৃত। দিল্লি পুলিশ পিছনে লেগেছে বুঝতে পেরেই সে ওয়ারিস্তানের ওয়াটার মাফিয়া গুলাব শাহ-র কাছে আশ্রয় নিয়েছে। দিল্লি পুলিশ তো আর ভিনদেশে গিয়ে কিছু করতে পারবে না।’

পরের স্লাইডে গুলাব শাহের ছবি। মাঝারি উচ্চতার বলশালী মানুষটির পরনে কুর্তা-পাজামা, পায়ে নাগরা। কাঁধ থেকে ঝুলছে একে ফর্টি সাতচল্লিশ, কোমরে গোঁজা নাইন এমএম।

প্রেজেন্টেশান শেষ হল। দুই মন্ত্রী কিছুক্ষণ গল্প করার পরে দীনেশ বেরিয়ে গেলেন।

এতক্ষণ প্রথমা একটাও কথা বলেনি। এবারে বলল, ‘আমাকে কেন ডেকেছেন?’

‘কাইমেরার যা কাজ সেটা করতে,’ হাসলেন রঞ্জিত, ‘গজরাজ এখন ওয়ারিস্তানে। ওকে ওয়ারিস্তানের মাটিতে মেরে আসতে হবে।’

প্রথমা বলল,

‘‘হারাধনের সাতটি ছেলে

গেল জলাশয়,

একটি সেথা ডুবে ম’ল

রইল বাকি ছয়।’

আমি আর আয়েশা মিলে ভারত আর ওয়ারিস্তানের জল সমস্যা নিয়ে একটু পড়াশুনো করি। নিজেদের সোর্স আর কনট্যাক্টস কাজে লাগাই। তারপরে আপনাকে জানাব।’

রঞ্জিত বললেন, ‘আজ সাতাশে ফেব্রুয়ারি। মার্চ মাস শেষ হওয়ার আগে কাজ চুকিয়ে ফেল।’

‘ওকে বস্‌!’ রঞ্জিতকে সেলাম ঠুকে বেরিয়ে গেল প্রথমা।

এখন

‘আয়েশা, কোনও খবর?’ আবার ফোন করেছেন রঞ্জিত।

‘আমার সোর্স স্যাটেলাইট ফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। কিন্তু সে সবটা জানে না। বেশি জানার চেষ্টা করলে বিপদে পড়বে। তাই রিস্ক নিতে পারছে না। ও খবর দিলেই আপনাকে জানাব!’

‘আর কত পরে জানাবি? দশ মিনিট তো হয়ে গেল। ব্লিডিং বন্ধ না হলে প্রথমা মরে যাবে যে!’

কঠিন গলায় আয়েশা বলল, ‘প্রথমা যে অলরেডি মরে যায়নি, তার কোনও প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। আমার সোর্স ক্রাইম সিন থেকে অনেকটাই দূরে।’ তারপরে আবার ফোন কেটে দিল।

কুড়ি দিন আগে

ওয়ারিস্তানের উত্তর সীমান্তের সিমলিলি বাঁধ। শোনাপানি নদীর ওপরে আড়াইশো ফুট উঁচু বাঁধ, যেটা ওয়ারিস্তানের রাজধানী হাসিনাবাদ থেকে একশো কিলোমিটার দূরে। এটাই ওয়ারিস্তানের সব থেকে বড় পানীয় জলের আধার। সিন্ধুকোষ পর্বত থেকে নেমে আসা শোনাপানি নদীর তুষার গলতে শুরু করে নির্দিষ্ট উচ্চতায় নেমে আসার পরে। ওয়ারিস্তানে শোনাপানি নদীকে পবিত্র বলে মনে করা হয়। দূষণহীন নদীর জল ছুঁয়ে কেউ মিথ্যে বলে না।

এই দূষণহীন শোনাপানি নদীকে বাঁধ দিয়ে আটকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয় গোটা ওয়ারিস্তানে। সিমলিলি বাঁধ কাজ শুরু করেছে দু-হাজার সালে। ‘ওয়ারিস্তান জল বিকাশ নিগম’ এটির দেখভালো করে। বলা ভালো, দেখাশোনা করত। এখন আর করে না।

এখন দেখাশোনা করে ওয়াটার মাফিয়া গুলাব শাহ। সিমলিলি বাঁধ থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে যে পানীয় জলের পাইপ লাইন, সেটা গুলাব গ্যাং-এর লোকেরা ফুটো করে সরকারি জল সরবরাহ ব্যবস্থার বারোটা বাজিয়ে রেখেছে। গ্যাং-এর লোকেরা ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে পানীয় জল বিক্রি করে। ওয়ারিস্তানে গরমকালে জলের অভাব এত বড় আকার ধারণ করে যে, এক গ্রামের বাসিন্দা সঙ্গে অন্য গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে মারামারি আর খুনোখুনি পর্যন্ত হয়। এ ছাড়াও দূষিত জল খেয়ে ডায়ারিয়া হয়ে বাচ্চারা মারা যায়। কিন্তু সরকার বাহাদুরের হেলদোল নেই। কারণ সরকারি আমলা আর মন্ত্রীরা গুলাব শাহের কাছ থেকে নিয়মিত নজরানা পেয়ে থাকেন। সিমলিলি বাঁধের ওপরে নিগমের অফিস গত দশ বছর ধরে গুলাবের দখলে। এখানে কোনও আধিকারিক আসার চেষ্টা করলে মাঝরাস্তায় খুন হয়ে যান।

রাত একটার সময় সিমলিলি বাঁধের ওপরে, পাঁচিলের ধার ঘেঁষে চেয়ার পেতে বসেছে ভারতের জল মাফিয়া গজরাজ আর ওয়ারিস্তানের জল মাফিয়া গুলাব। দুজনেই পরে আছে কুর্তা-পাজামা আর নাগরা। দুজনেই নিরস্ত্র। ওদের খাতিরদারির দায়িত্বে রয়েছে বেলাল হাওলাদার। তার সঙ্গে গুলাবের চেহারায় বেশ মিল। দুজনেই মাঝারি উচ্চতার, দুজনেরই ভালো স্বাস্থ্য, দুজনেরই মোটা গোঁফ আছে। বেলালের পরনেও কুর্তা-পাজামা, তবে পায়ে নাগরার বদলে স্নিকার।

দুটি চেয়ারের মাঝখানের টেবিলে রাখা রয়েছে স্কচ, জলের বোতল, বরফদান। গুলাবের ইশারায় বেলাল পানীয় আর বরফের টুকরো দুটি গ্লাসে দিল। সেটা দেখে গজরাজ বলল, ‘শুধু বরফের টুকরো দিয়ে আমার চলে না। জল লাগবে।’

সেই কথা শুনে গজরাজের গ্লাসে জল ঢেলে দিল বেলাল। গুলাব আপনমনে বলল, ‘আমার আবার ‘অন দ্য রক্‌স’ ছাড়া চলে না। ‘ওয়াটার, ওয়াটার এভরিহোয়্যার, নট এনি ড্রপ টু ড্রিঙ্ক।’’

ইংরিজি কবিতা শুনে গজরাজ বলল, ‘আমি ইংরিজি বুঝি না।’

‘এটা স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের লেখা কবিতা।’ বলল গুলাব, ‘আমি ইন্ডিয়ার কলকাতা শহরের প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পড়াশুনো করেছি। ইংরিজি আর বাংলা দুটো ভাষাই জানি ব্রাদার। তুমি টেগোরের নাম শুনেছ?’

‘না। কে সে?’

‘জল শুধু জল…দেখে দেখে চিত্ত তার হয়েছে বিকল।’ বাংলায় বলল গুলাব, ‘তোমার দেশের লোক আর তুমি নাম জানো না?’

‘কোথাকার গ্যাং? মুম্বই?’ হুইস্কিতে চুমুক দিচ্ছে গজরাজ।

মৃদু হেসে গুলাব বলল, ‘চেন্নাই। ওসব বাদ দাও ব্রাদার। ইন্ডিয়া থেকে নতুন কোনও খবর?’

‘দিল্লি সরকার আমার পিছনে লেগেছে। সেটা জানতে পেরে তোমার কাছে পালিয়ে এসেছি। এখন দেশে ফেরা মুশকিল। এখানে কদিন থাকব। আপত্তি নেই তো?’

‘তুমি যে এখানে আছ, সেটাই কেউ জানে না,’ হাসিতে ফেটে পড়ল গুলাব, ‘কারণ জাল পাসপোর্ট নিয়ে এসেছ। যতদিন খুশি থাকো। তবে…দূর থেকে বিজনেস সামলাতে অসুবিধে হবে না?’

‘সে চিন্তা নেই। দিল্লিতে আমার ডানহাত বাহাদুর সিং আছে। তবে…’

‘আবার “তবে” কেন? “তবে,” “কিন্তু,” “ইফ,” “বাট”—এসব আমি একদম পছন্দ করি না।’

‘বাহাদুর ফোনে খবর দিল ইন্ডিয়া থেকে আমাকে মারার জন্যে একজন এজেন্ট আসছে,’ চিন্তিত মুখে বলল গজরাজ, ‘গুলাব, তুমি একটু খবর নেবে? কোন কোন বিদেশি হাসিনাবাদ এয়ারপোর্ট হয়ে ওয়ারিস্তানে ঢুকছে সেটা জানা তোমার পক্ষেই সম্ভব। সরকারের অনেক উঁচু লেভেল পর্যন্ত তোমার হাত পৌঁছোয়।’

‘তার বিনিময়ে আমারও কিছু চাই ব্রাদার। আমার পলিসি হল গিভ অ্যান্ড টেক।’

‘কী চাই বলো!’

‘ইন্ডিয়াতে ঢোকার অ্যাকসেস চাইছি। ইন্ডিয়ার কনট্যাক্টস চাইছি। কার পায়ে তেল মাখাতে হবে, কাকে মৃত্যুভয় দেখাতে হবে, কাকে জাহান্নমে পাঠাতে হবে—সেই লিস্ট চাইছি।’

অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পরে গজরাজ বলল, ‘তুমি কি আমার কাজের জায়গায় হাত দিতে চাইছ?’

‘এলাকা কারও বাপের সম্পত্তি নয়, ব্রাদার! কথায় আছে, ‘‘জোর যার মুলুক তার’’। তুমি আমার এলাকায় কাজ করো। কে বারণ করেছে? দরকার হলে দুজনে মিলে কাজ করব। এই উপমহাদেশ আমাদের পায়ের তলায় থাকবে। কথায় আছে, ‘‘জলই জীবন’’। সেই কথা সত্যি প্রমাণ করে ভারত আর ওয়ারিস্তানের জীবন নিয়ন্ত্রণ করব আমরা দুটি ভাই।’

গুলাবের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে গজরাজ। কিছুক্ষণ পরে বলল, ‘এত বড় সিদ্ধান্ত মদের আসরে বসে নেওয়া যায় না। আজকে দশই মার্চ। পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত আমাকে ভাবতে সময় দাও। আর, এই সময়ে ইন্ডিয়ার কোন এজেন্ট ওয়ারিস্তানে ঢুকছে সেটা নজর করো।’

গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে গুলাব বলল, ‘ঠিক হ্যায়। পনেরো দিনের মধ্যে তুমি সিদ্ধান্ত জানাও। বাকিটা আমি দেখছি।’

চেয়ার থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে গজরাজ বলল, ‘এজেন্টের খবর পাওয়াটা খুব জরুরি। আমার সম্পর্কে সব খবর জেনেই সে এদেশে আসছে। ওকে আমি নিজের হাতে খুন করব!’

এখন

‘নতুন কী ঘটল?’ স্যাটেলাইট ফোনে জিজ্ঞাসা করল আয়েশা।

‘বুঝতে পারছি না আয়েশা,’ ওদিকের মহিলাকণ্ঠ বলল, ‘বাঁধের যে জায়গায় ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেটার দূরত্ব সার্কিট হাউস থেকে অন্তত আড়াইশো মিটার। আমি অনেকটা দূর থেকে দেখেছি।’

‘গজরাজ সিংকে সরিয়ে দেওয়ার জন্যে ভারত থেকে এজেন্ট যাচ্ছে—এই তথ্য আমি নিজে বাহাদুর সিংকে লোক মারফত জানিয়েছিলাম। যাতে কথাগুলো বাহাদুরের কাছ থেকে গজরাজের কাছে পৌঁছোয়। পাশাপাশি গুলাবের কানে পৌঁছে দেওয়া হয়, ভারত থেকে আসা পর্বতারোহী মুনিয়ার ওপরে নজর রাখতে। এই পর্যন্ত সব কিছু প্ল্যানমাফিক চলছে। বাকিটাও চলা উচিত।’

মহিলাকন্ঠ ভেবে ভেবে বলছে, ‘অন্ধকারের মধ্যে নাইট ভিশন বাইনকিউলার দিয়ে দেখা। আমি দেখেছি যে বাঁধের ওপরে তিনজন লোক আর মুনিয়া ছিল। মানে মোট চারজন ছিল। একজন লোক অন্য একজন লোকের বুকে এবং মুনিয়ার পেটে গুলি করে। ওই দুজন বাঁধের কংক্রিটের ওপরে পড়ে আছে। জীবিত দুজন বাঁধের পাঁচিলের ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। তারপরে কী হল জানি না।’

‘আমি হাসিনাবাদের হাসপাতালে ফোন করেছি। তোমার এখন একটাই কাজ। ওদের নজরে রাখা। খুব কাছে যাওয়ার দরকার নেই। আর ফোনটা হাতের নাগালে রেখো। একবার রিং হলেই ফোন ধরবে।’ ফোন কাটল আয়েশা।

একদিন আগে

আঠাশে মার্চ দুপুরো দুটোর সময় ওয়ারিস্তানের রাজধানী হাসিনাবাদের এয়ারপোর্টে নামল চার মহিলা পর্বতারোহী। এরা আসছে চারটি আলাদা রাষ্ট্র থেকে। শ্যামলদেশ থেকে সাহানা, ভারতবর্ষ থেকে মুনিয়া, মালব্যনগর থেকে টিনা এবং সিংহদ্বীপ থেকে শ্রীমতি। ওয়ারিস্তানে ওদের সঙ্গে যোগ দেবে অজপা। পাঁচজনের টিম যাবে সিন্ধুকোষ পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ‘তিরিয়াচিল’ জয় করতে।

উদ্যোগ নিয়েছিল ভারতবর্ষ। সার্ক অন্তর্ভূক্ত দেশগুলি থেকে একটি মহিলা টিম যাবে ‘তিরিয়াচিল’ শৃঙ্গ জয়ে, এই প্রস্তাব দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বীরেন্দ্র মেহতা বলেন, ‘গরমকালে বরফ কম থাকবে। যাত্রাপথ কম সংকটজনক হবে। শুভস্য শীঘ্রম!’ তাঁর যুক্তি মেনে নিয়ে ওয়ারিস্তান এবং অন্যান্য দেশ দ্রুত কাজ শুরু করে। মেয়েদের ভিসা এবং অন্যান্য কাগজপত্র নিমেষে তৈরি হয়ে যায়।

এয়ারপোর্ট থেকে ওরা গাড়ি করে চলে যাবে সিমলিলি বাঁধ। সেখান থেকে ট্রেকিং করে তিরিয়াচিল বেস ক্যাম্প। বেস ক্যাম্প থেকে পর্বতারোহণ শুরু হবে।

বিমানবন্দরের বাইরে একটি টেন সিটার এসি গাড়ি ওদের জন্যে অপেক্ষা করছে। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওয়ারিস্তানের পর্বতারোহী অজপা এবং গাড়ি-চালক আরমান।

এয়ারপোর্টের গায়ে একটি চমৎকার রেস্তোরাঁ আছে। সেখানে বসে লাঞ্চের অর্ডার করল অজপা। সবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এইটা আমাদের শেষ ঠিকঠাক লাঞ্চ। সবাই পেট পুরে খাও। এর পরে ভালো খাবার জুটবে এখানে ফিরে, অর্থাৎ সাতদিন পরে। অবশ্য, যদি ফিরে আসতে পারি।’

ভারতের মুনিয়া জিজ্ঞাসা করল, ‘ড্রাইভার দাদা খাবেন না?’

অজপা মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসল। ‘চিন্তা কোরো না। আমরা তোমাদের থেকে বেশি অতিথিপরায়ণ। ওই দেখো, কোণের সিটে বসে আরমান নাস্তা করছে।’

আরমানের দিকে তাকাল মুনিয়া। লোকটার উচ্চতা মাঝারি। বলশালী চেহারা, মোটা গোঁফ আছে। পরনে কুর্তা-পাজামা আর স্নিকার। চোখে সানগ্লাস।

আরমানও মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এই তা হলে ইন্ডিয়ার এজেন্ট প্রথমা লাহিড়ী! গজরাজ কয়েক দিন আগে ঠিক খবরই দিয়েছিল। ভারত যে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে এক্সপিডিশানের আয়োজন করল, তার থেকেই পরিষ্কার, ওরা কী চায়। ওয়ারিস্তানে আরও অনেক শৃঙ্গ আছে, যেগুলো জয় করা যেতে পারে। একমাত্র তিরিয়াচিল জয় করতে গেলে সিমলিলি বাঁধ হয়ে যেতে হয়। কারণটা খুব পরিষ্কার। এটা এক্সপিডিশানের অভিনয়। আসল উদ্দেশ্য গজরাজকে পাকড়াও করা। অজপাকে রুট প্ল্যান শিখিয়ে দেওয়া আছে। অজপার প্রস্তাবের উত্তরে মুনিয়া কী বলে সেটা শুনলেই ওর উদ্দেশ্য বোঝা যাবে।

আরমানের প্ল্যানমাফিক অজপা বলল, ‘লাঞ্চ সেরেই আমরা স্টার্ট করব। একটানা গাড়ি চালালে রাত দুটো নাগাদ বেস ক্যাম্পে পৌঁছে যাব।’

‘আমরা আজ রাতে মাঝামাঝি কোথাও থাকতে পারি না?’ বলল সিংহদ্বীপের শ্রীমতি, ‘বেস ক্যাম্পে যাওয়ার আগে অ্যাক্লিম্যাটাইজ করা হচ্ছে না।’

আরমান জানে যে বেশি উচ্চতায় বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকে। হুশ করে অনেকটা ওপরে উঠে গেলে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, যেটা মারাত্মক। সেই জন্যে কম অক্সিজেনে ফুসফুসকে অভ্যস্ত করে পাহাড়ে ওঠা উচিত।

রুটম্যাপ দেখে শ্যামলদেশের সাহানা বলল, ‘রাস্তায় সিমলিলি বাঁধ আছে। সেখানে সরকারি সার্কিট হাউসও আছে। ওখানে নাইট স্টে করলে হয় তো!’

মালব্যনগরের টিনা বলল, ‘আমাদের যে প্রোগ্রাম ফিক্স করা আছে, সেটা মেনে চলাই ভালো। না হলে ফেরার সময় অসুবিধে হবে।’

‘কিছু অসুবিধে হবে না ম্যাডাম!’ খাওয়া চুকিয়ে, হাতমুখ ধুয়ে ওদের টেবিলের কাছে এসেছে আরমান। মুনিয়া যে মুখ খোলেনি, এটা সে খেয়াল করেছে। মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা সিমলিলি বাঁধের সার্কিট হাউসেই রাতে থাকব। বেস ক্যাম্পে চোদ্দ ঘণ্টা কাটানো আমাদের হিসেবের মধ্যে আছে। ওর থেকে বারো ঘণ্টা যদি আমরা সিমলিলিতে কাটাই, তা হলে হরেদরে একই ব্যাপার হবে। আপনারা লাঞ্চ সারুন। আমি ততক্ষণে সিমলিলির সার্কিট হাউসে ফোন করে থাকার ব্যবস্থা করছি।’

আরমান রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গেল। মুনিয়া আর শ্রীমতি একে অপরের দিকে তাকাল। বাকিরা খেতে ব্যস্ত।

লাঞ্চ সেরে আবার গাড়িতে ওঠা। শুরু হল লম্বা যাত্রা। রাত দশটার সময় হাড় হিম করা ঠান্ডায় সিমলিলি বাঁধের সার্কিট হাউসের সামনে গাড়ি দাঁড়াল। আরমান গাড়ি থেকে নেমে বলল, ‘আমার কাছে চাবি আছে। রুম খুলে দিচ্ছি।’

‘কেউ থাকে না এখানে?’ জানতে চাইল শ্রীমতি, ‘রুমগুলো পরিষ্কার তো? আমার আবার আরশোলাকে খুব ভয়!’

বাকি মেয়েরা হাসছে। আরমান গম্ভীর মুখে বলল, ‘অফিস স্টাফ নেই। স্থানীয় লোককে ফোন করে আমি ঘর সাফ করতে বলেছিলাম। ওরা রাতের রান্নাও করে রেখেছে। আপনারা ফ্রেশ হয়ে, ডিনার সেরে ঘুমিয়ে পড়ুন। কাল সকাল ন’টার সময় বেরোব।’

মুনিয়া বলল, ‘আমার মোবাইলের টাওয়ার নেই।’

টিনা, শ্রীমতি আর সাহানা বলল, ‘আমারও নেই।’

‘একমাত্র সরকারি নেটওয়ার্ক কাজ করে।’ বলল অজপা। হতাশ হয়ে সবাই মোবাইল অফ করে দিল।

সার্কিট হাউসে ঢুকে ওরা অবাক। ঝকঝক করছে বাড়ি। প্রত্যেকের জন্যে আলাদা রুম। প্রতিটি ঘরে রুম হিটারের ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে ডিনারে এলাহি আয়োজন। রুটি আর ভেড়ার মাংস খেয়ে সবাই যে যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

মাঝরাতে মুনিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। কারণ সে শ্বাস নিতে পারছে না, দম আটকে আসছে। চেঁচাতে গিয়ে খেয়াল করল নাক-মুখ চাপা দিয়ে রেখেছে বলশালী একটি হাত। আলো অন্ধকারের মধ্যে দেখল, আরমান তার দিকে ঝকঝকে চোখে তাকিয়ে বলছে, ‘প্রথমা লাহিড়ী, তোমার খেল খতম।’

এখন

সিমলিলি বাঁধের ওপরে রাত একটার সময় চেয়ার পেতে বসে রয়েছে গজরাজ আর গুলাব। দুজনেরই পরনে কুর্তা-পাজামা আর নাগরা। দুজনের হাতেই নাইন এমএম পিস্তল। গুলাবের চোখে এত রাতেও সানগ্লাস। তৃতীয় চেয়ারে বসে রয়েছে মুনিয়া। তার হাত-পা বাঁধা থাকলেও মুখ খোলা। তিনজনের মাঝখানের টেবিলে রাখা রয়েছে স্কচ আর জলের বোতল, বরফদান।

এই তিনজনকে নজরে রাখার জন্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেলাল। তার পরনে কুর্তা-পাজামা, পায়ে স্নিকার, কাঁধে একে সাতচল্লিশ, চোখে সানগ্লাস।

গুলাব বলল, ‘বেলাল, আমাকে আর গজরাজকে ড্রিঙ্ক দিন।’

বেলাল চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। গুলাব বিরক্ত হয়ে নিজেই ড্রিঙ্ক তৈরি করল। গজরাজকে বলল, ‘আপনি তো অন দ্য রক্‌স ছাড়া খেতে পারেন না।’

গ্লাস টেবিলে রেখে গজরাজ তাকাল মুনিয়ার দিকে। বলল, ‘প্রথমা লাহিড়ী! তুই কোন এজেন্সি থেকে এসেছিস?’

মুনিয়া চুপ।

‘বিদেশে বসে আছি বলে ভাবিস না যে খবর পাই না। হঠাৎ তোকে পাঠাল কেন? আমাকে মারতে? নে, মার।’ চেয়ার থেকে উঠে মুনিয়ার হাতের বাঁধন খুলে দিল গজরাজ। নিজের নাইন এমএম পিস্তল মুনিয়ার হাতে ধরিয়ে দিল।

মুনিয়া থরথর করে কাঁপছে। পিস্তলটা ছুঁড়ে ফেলতে গিয়েও হাতে রাখল। বলল, ‘আপনাদের কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। আমি প্রথমা নই। আমার নাম…’ কথা শেষ না করে কিছুক্ষণ হাঁফাল সে। হাঁফাতে হাঁফাতেই হঠাৎ গজরাজের দিকে পিস্তল তাক করে গুলি চালাল।

‘ক্লিক’ করে আওয়াজ হল। পিস্তল থেকে কোনও গুলি বেরল না। বারবার ট্রিগার টিপল মুনিয়া। আবারও এক শব্দ। ক্লিক! ক্লিক! ক্লিক! ক্লিক!

গজরাজ মুচকি হেসে বলল, ‘ভাগ্যিস গুলি বার করে রেখেছিলাম। না হলে এতক্ষণে মরেই যেতাম।’

‘বেচারিকে মারবেন না!’ বলল গুলাব। ‘ও পিস্তল চালাতে পারে, এটা মেরে ফেলার কোনও কারণ হতে পারে না। অনেক মেয়েই আজকাল এসব পারে।’

‘প্রথমাকে বাঁচিয়ে রাখলে আমাকে মরতে হবে। কাজেই…’ কুর্তার পকেট থেকে আর একটা নাইন এমএম বার করে মুনিয়ার দিকে তাক করল গজরাজ।

‘ওকে মারবেন না।’ ঠান্ডা গলায় বলল গুলাব।

‘তুমি মেয়েটাকে বাঁচাতে চাইছ কেন?’ গুলাবের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল গজরাজ।

‘খুব সোজাসাপটা কারণ বস্‌!’ বলল গুলাব, ‘গত দশই মার্চ রাতে, ঠিক এইখানে বসে আপনি বলেছিলেন যে প্রথমা লাহিড়ী আপনার সম্পর্কে সব তথ্য জানে। সেই রাতেই আমি আপনাকে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ পলিসির কথা বলেছিলাম। আপনি বলেছিলেন, ‘পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত আমাকে ভাবতে সময় দাও।’ সেই ডেডলাইন পেরিয়ে গেছে। আপনি অনেক ভেবেও কোনও উত্তর দেননি। বাধ্য হয়ে আমি নিজের রাস্তা দেখে নিচ্ছি। মুনিয়াকে আমার চাই! জ্যান্ত! আপনার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জানার জন্যে।’

দুজনের কথা কাটাকাটির মধ্যে, পায়ে দড়ি বাঁধা অবস্থায় মুনিয়া লাফ মেরে গুলাবের পিছনে চলে যাচ্ছিল। উত্তেজিত মুনিয়ার বুক লক্ষ্য করে গজরাজ গুলি চালাল।

টার্গেট চলন্ত থাকলে অধিকাংশ শিকারির নিশানা ভুল হয়। গজরাজেরও হল। মুনিয়ার শরীরে গুলি লাগল বটে। তবে বুকের বদলে পেটে। বিকট চিৎকার করে বাঁধের রাস্তায় ছিটকে পড়ল সে।

‘এ আপনি কী করলেন বস্‌?’ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে গুলাব। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই গজরাজের নাইন এমএম আবারও ঝলসে উঠল। গুলাবের হৃদপিণ্ড ফুঁড়ে গুলি চলে গেল অন্যদিকে।

মৃত গুলাব আর মৃতপ্রায় মুনিয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে ঘুরে দাঁড়াল গজরাজ। বেলালের দিকে নাইন এমএম তাক করে বলল, ‘এখন থেকে আমি তোর নতুন মালিক। আমার সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছে আছে? না গুলি খেয়ে মরবি?’

একে সাতচল্লিশ বাঁধের পাঁচিলে নামিয়ে রেখে হাত ওপরে তুলে বেলাল বলল, ‘ওপরওয়ালার দিব্যি। আমি শুধু কাজ করতে চাই। কে আমার মালিক তাই নিয়ে ভাবি না।’

‘তোর কথা বিশ্বাস করি কী করে?’

‘আমাদের দেশে শোনাপানি নদীকে সব থেকে পবিত্র বলে মনে করা হয়। নদীর জল ছুঁয়ে কেউ মিথ্যে কথা বলে না। আমি শোনাপানির জল ছুঁয়ে শপথ করছি।’

‘চল!’ বেলালের দিকে নাইন এমএম তাক করে রেখেছে গজরাজ।

বাঁধের পাঁচিলের গায়ে ফাঁক আছে। সেখান দিয়ে হাত গলিয়ে শোনাপানিরর জল ছুঁয়ে বেলাল বলল, ‘গুলাব শাহ আগাগোড়া তোমাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে। আজ হঠাৎ ‘আপনি’ বলল কেন? অন্যদিন তোমাকে ‘ব্রাদার’ বলে ডাকে। আজ ‘বস্‌’ বলল কেন?’

‘সে তো তুইও আমাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করিস। আজ ‘তুমি’ বলছিস। কেন?’ প্রশ্ন করতে করতে ভুরু কুঁচকে যায় গজরাজের। সে চমকে উঠে গুলাব আর বেলালের মধ্যেকার মিলগুলো খেয়াল করে। দু’জনেই মাঝারি উচ্চতার, দুজনেরই ভালো স্বাস্থ্য, দুজনেরই মোটা গোঁফ আছে। দুজনের পরনেই কুর্তা-পাজামা। মৃত গুলাবের নাগরা, বেলালের পায়ে স্নিকার। সানগ্লাস পরে আছে বলে মুখের আদলের তফাত বোঝা যাচ্ছে না। তার ওপরে এই অন্ধকার!

অবাক হয়ে গজরাজ বলে, ‘তুমি কি গুলাব? আগাগোড়াই আমি ভুল লোককে চিনতাম? না কি শুধু আজ রাতের জন্যে নিজেদের জায়গা বদলেছ?’

‘শুধু আজ রাতের জন্যে।’ কথা বলতে বলতেই কুর্তার পকেট থেকে গুলাব বার করেছে নাইন এমএম পিস্তল। ট্রিগার টেপা মাত্র গজরাজের মাথার ঘিলু ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। বাঁহাতের ঝটকায় গজরাজের মৃতদেহ বাঁধের জলে ফেলে দেয় গুলাব। জলাশয়ে মৃতদেহ পড়ার ‘ঝুপ’ শব্দ হয়। আবার সব নিঃশব্দ।

কুর্তার পকেটে স্যাটেলাইট ফোন বাজছে। গুলাব অবাক হয়ে বলল, ‘প্রথমা ম্যাম? আপনি কোথায়?’

‘তুমি ভেবেছিলে যে মুনিয়া হল প্রথমা। তাই না?’ গম্ভীর গলায় বলল প্রথমা।

‘হ্যাঁ ম্যাডাম। সেটা যে নয়, এখন বুঝতে পারছি। আপনি তা হলে কোনজন? গুলিই বা লাগল কার পেটে? আপনি এখানে তাড়াতাড়ি আসুন ম্যাম।’

‘গুলি লেগেছে সিংহ দেশের শ্রীমতির পেটে,’ বলল প্রথমা। নিজের মনে মুচকি হাসল।

এই হাসির কারণ আছে। সিংহ দ্বীপের শ্রীমতি সেজে ওয়ারিস্তানে এসেছে প্রথমা। আর ভারতের মুনিয়া সেজে এসেছে কেরালার মেয়ে শ্রীমতি। জলের কালোবাজারি নিয়ে প্রতিবাদ করায় শ্রীমতির বাবা-মাকে খুন করেছিল গজরাজ। মেয়েটা বেঁচেই আছে গজরাজকে মারবে অথবা নিজে মরবে বলে। প্রথমার অনুরোধে সে এই সুইসাইড মিশনে আসতে রাজি হয়েছে।

প্রথমার মোবাইল ফোন সুইচ্‌ড অফ থাকলেও স্যাটেলাইট ফোন চালু আছে। এই স্যাটফোনের কথা গুলাব ছাড়া কেউ জানে না। এমনকী আয়েশাও নয়। গুলাব জানত না চার বিদেশি পর্বতারোহীর মধ্যে প্রথমা কে। স্যাটফোনেই কথা হয়েছে। ওয়ারিস্তানে আসার পরে আরমান সেজে থাকা গুলাব আন্দাজ করেছিল, মুনিয়াই প্রথমা।

প্রথমা বলল, ‘গুলাব, আপনি হেলিকপ্টার অ্যাম্বুল্যান্সকে খবর দিন। আমরা শ্রীমতিকে এয়ারলিফ্‌ট করে হাসিনাবাদে নিয়ে যাব। ওকে বাঁচাতেই হবে। হেলিকপ্টার এলে আমি আপনার মুখোমুখি হব।’

‘এই মেয়েটা না হয় বেঁচে যাবে। কিন্তু আমার কী হবে ম্যাডাম?’

‘আমি যখন কথা দিয়েছি যে ভারতে আপনার রাজনৈতিক আশ্রয় জুটবে, তখন সেটা হবে। আপনি আমার সঙ্গেই ইন্ডিয়া যাবেন।’

এক ঘণ্টা পরে

‘প্র্যাট! তুই কেমন আছিস? তোর কিছু হয়নি তো?’ প্রশ্ন করলেন উৎকণ্ঠিত রঞ্জিত। দুজনের মধ্যে এখন মোবাইল ফোনেই কথা হচ্ছে। হাসিনাবাদের মোবাইল নেটওয়ার্ক খুব ভালো।

‘আমার কিছু হয়নি। পেটে গুলি লেগেছে শ্রীমতির। হাসিনাবাদের হাসপাতালে ওর অপারেশান আধঘণ্টা আগে শুরু হয়েছে। সার্জন বলেছেন রক্তপাত প্রচুর হলেও প্রাণের ভয় নেই। এয়ারলিফ্‌ট করে আনার সময় থেকেই ব্লাড চলছে।’

‘আরমান আর বেলাল যে এক লোক এটা তুই কখন বুঝতে পেরেছিলি?’

‘আরমান আর বেলাল এক লোক নয় স্যর। আরমান আসলে গুলাব শাহ। বেলাল আর গুলাবের মধ্যে চেহারার মিল লক্ষ্যণীয়। সেটা দুজনেই জানে। তাই নাগরা আর স্নিকারের বদলটা মন দিয়ে করেছিল। তবে যত যাই হোক না কেন, মালিক আর ভৃত্যের মানসিকতার ফারাক তো থাকবেই। ওই জন্যেই গুলাব সাজা বেলাল আগাগোড়া গজরাজকে ‘আপনি’ আর ‘বস্‌’ বলছিল, ড্রিঙ্ক বানিয়ে দিচ্ছিল। আর বেলাল সাজা গুলাব গজরাজকে ‘তুমি’ বলছিল। এসব কথা আমি জেনেছি গুলাবের কাছ থেকে। বেলাল আর গজরাজ মৃত। গুলাব জীবিত।’

‘তুই কখন সন্দেহ করতে শুরু করলি যে আরমানই গুলাব?’

‘সার্কিট হাউসের চাবি আরমানের কাছে। সার্কিট হাউসে কোনও সরকারি স্টাফ নেই, তাও আরমান ফোন করে সার্কিট হাউসের ঘর পরিষ্কার করাচ্ছে। গিয়ে দেখলাম ঘরগুলো ঝকঝক করছে। সবার জন্যে সুস্বাদু ডিনার রেডি। এই নিয়ে টিনা, সাহানা আর অজপার মনে নানা প্রশ্ন ছিল। শুধু আমি আর শ্রীমতি সত্যিটা জানতাম।’

‘কী ভাবে?

‘ওয়ারিস্তান পৌঁছোনোর অনেক আগেই আমি গুলাবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। গজরাজ যেমন দিল্লি পুলিশের ভয়ে ওয়ারিস্তান পালিয়েছিল, গুলাবের বিরুদ্ধেও তেমন মিশন শুরু করতে চলেছে ওয়ারিস্তান সরকার। সেটা জেনে ও আমার কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় চায়। বিনিময়ে যা বলব করে দেবে। আমি এই ‘গিভ অ্যান্ড টেক পলিসি’ কাজে লাগিয়ে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুললাম।’

‘গুলাবকে আমাদের দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার ইস্যুতে ‘হ্যাঁ’ বলার আগে আমাকে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন বোধ করলি না? রাজনৈতিক আশ্রয় কি ছেলের হাতের মোয়া? এর প্রভাব পড়বে সারা পৃথিবী জুড়ে। অনেক দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যেতে পারে, তা জানিস?’

‘আপনাকে জিজ্ঞাসা করলে ‘না’ বলতেন। তাই ওটা করিনি। আর গুলাব তো নিজের নামে এ দেশে আসছে না। বেনামে এসে একটা সেফ হোমে কয়েক মাস থাকবে। তারপরে অন্য কোথাও চলে যাবে। সে নিয়ে আমরা মাথা ঘামাব না।’

‘ইনকরিজিব্‌ল!’ হতাশ রঞ্জিত বললেন, ‘এই মিশন থেকে কি শিখলাম জানিস? শিখলাম, যে যাকে আরমান ভাবা হয়েছে সে আরমান নয়। যাকে গুলাব ভেবে খুন করা হয়েছে, সে গুলাব নয়। যে মেয়েটাকে প্রথমা ভেবে খুন করার চেষ্টা হয়েছে, সে প্রথমা নয়। হ্যাঁ রে প্র্যাট, গজরাজ সত্যিই মরেছে তো? নাকি ওর বদলে অন্য কেউ মরেছে? ওকে মারাটাই এই মিশনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল।’

‘গজরাজের বডি দেশে আনা হচ্ছে স্যর। তবে গোপনে। পরে এনকাউন্টারে মৃত্যু দেখিয়ে দেবেন। যাতে ওয়াটার মাফিয়ারা ভয় পায়।’

‘আর তুই কবে ফিরছিস?’

প্রথমা হাসতে হাসতে বলল, ‘আমি ফিরছি না স্যর, ফিরছে সিংহ দ্বীপের শ্রীমতি। ভারতের পর্বতারোহী মুনিয়ার অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথা শুরু হওয়ায় এমার্জেন্সি অপারেশান করতে হয়েছে। তাই ‘মিশন তিরিয়াচিল’ বাতিল। ওয়ারিস্তানের অজপা এখানেই থেকে যাবে। শ্যামলদেশের সাহানা আর মালব্যনগরের টিনা ওয়ারিস্তান থেকে ডাইরেক্ট ফ্লাইটে নিজেদের দেশে ফিরবে। মুনিয়া আর আমি, মানে সিংহ দ্বীপের শ্রীমতি দিল্লি ফিরছি কাল সকালের ফ্লাইটে।’

‘আয়েশার সঙ্গে ফোনে কে যোগাযোগ রাখছিল? তুই? না অন্য কেউ?’

‘ওটা শ্যামলদেশের সাহানা। ওই আয়েশাকে স্যাটেলাইট ফোনে যোগাযোগ করেছিল। এটাও আমার প্ল্যান। তবে ওরা কেউই আমার আর শ্রীমতির আসল পরিচয় জানে না।’

‘উফ্‌! তোরা পারিস বটে!’

‘আপনার প্রেস মিটে শ্যামলদেশের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বের কথাটা উল্লেখ করবেন, কেমন?’

‘তুই কি আমার প্রেস ব্রিফটাও তৈরি করে দিবি?’ সস্নেহে বললেন রঞ্জিত।

প্রথমা বলল, ‘ওটি শেষ স্যর। শ্রীমতি বিপদমুক্ত।’

তারপরে ফোন কেটে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *