রইল বাকি চার

রইল বাকি চার

প্রথম রাত

রাত ন’টার সময় সিনচান রাষ্ট্রের রাজধানী পিজিং শহরের জেমলিন স্ট্রিট জনমানবহীন। সেখানে অবস্থিত চেয়ারম্যান লি ঝাউয়ের প্রাসাদের শয়নকক্ষের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে বাইশ বছরের ফ্রিদা।

ফ্রিদার চোখেমুখে ধারালো সৌন্দর্য, যা সিনচান রাষ্ট্রের মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিরল। স্বচ্ছ রাতপোশাক পরে থাকার কারণে দেখা যাচ্ছে ফ্রিদার আকর্ষণীয় শরীর। কিন্তু ফ্রিদার মুখে হাসি নেই। সে জানলা দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে উত্তর দিকে। ওই দিকেই তার বাড়ি। উত্তর সিনচানের তুইঘুর প্রদেশের বাসিন্দা সে। যেখানে রয়েছে তার বাবা-মা, চাচা-চাচি, নানা-নানি এবং আট ভাইবোন। তুইঘুরকে সিনচান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বাইরের দুনিয়ার থেকে সম্পূর্ণ আড়াল করে রেখেছে। অতীতে একে বলা হতো আয়রন কার্টেন বা লৌহপর্দা। কোনও রকম মিডিয়ার প্রবেশ সেখানে নিষেধ। ইন্টারনেট কানেকশান, মোবাইল ফোন, ল্যান্ড লাইন নেই। রেডিও, টিভি, খবরের কাগজ, ট্রানজিস্টার, পোস্ট অফিস নেই। শুধু আছে রাষ্ট্রীয় অনুশাসন মেনে গণহত্যা। আর বাছাই করা ছেলেমেয়েদের তুলে এনে পার্টির নেতাদের প্রথম রিপু চরিতার্থ করে মাংসের বাজারে বিক্রি করে দেওয়া।

ফ্রিদাকে আনা হয়েছে সেই জন্যেই। পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যান লি ঝাউ হলেন সিনচানের সব থেকে ক্ষমতাবান মানুষ। তাঁর পছন্দ হয়েছে ফ্রিদাকে। ফ্রিদা আন্দাজ করতে পারে, লি তাকে ভালোবেসে ফেলেছেন। ধর্মান্তরিত করার পরে হয়তো বিয়েও করবেন। পঁয়ষট্টি বছরের লিয়ের প্রথম স্ত্রী একমাস আগেই আত্মহত্যা করেছেন। ওঁর এখন একজন জীবনসঙ্গী দরকার। বিয়ে করলেই ফ্রিদা হয়ে যাবে সিনচানের ফার্স্ট লেডি। সবথেকে ক্ষমতাবান মানুষের ওপরে যে ছড়ি ঘোরায়, আসল ক্ষমতা তো তার হাতে!

ফ্রিদা সেটা চায় না। সে চায় পরিবারের লোকের মুক্তি, তুইঘুর প্রদেশের সবার মুক্তি। কী ভাবে সেটা অর্জন করা যাবে? আরব্য রজনীর গল্প মনে পড়ে ফ্রিদার। ওই গল্পের শুরুতে লুকিয়ে রয়েছে সমাধান।

মুখ ঘোরাল ফ্রিদা। বাইরে থেকে বন্ধ দরজা খুলে ভিতরে ঢুকছেন পঁয়ষট্টি বছরের লি। বাইশ বছরের ফ্রিদা এগিয়ে গেল তাঁর দিকে। ফ্রিদার হাত ধরে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলেন লি। চুম্বন করতে করতে বেড সুইচ টিপে ঘর অন্ধকার করে দিলেন।

ঠিক পাঁচ মিনিট পরে আবার আলো জ্বলে উঠল। ফ্রিদা মুখ কালো করে বসে আছে। লি চিন্তান্বিত মুখে বাথরুমে গেলেন। একটু পরে ফিরে এসে বললেন, ‘সরি।’

ফ্রিদা চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি কমরেড। আপনার দাসি হয়ে সারা জীবন কাটাতে পারি। আপনার একাকীত্ব, সব যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিতে পারি। কিন্তু বিনিময়ে আমারও তো কিছু চাই!’

‘কী চাই বলো?’ গদগদ হয়ে বললেন লি। ‘অর্থ? যশ? প্রতিপত্তি?’

‘বাইশ বছরের মেয়ের চাহিদা খুব সামান্য। সেটা কী আপনি জানেন। সেইটুকু পূরণ না হলে আমি কী করে আপনাকে ভালোবাসব? আপনি আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিন। দূর থেকেই আমি আপনাকে ভালোবাসব।’

‘আমার বয়স হয়ে গেছে। আমি আর যুবক নেই!’ ভেঙে পড়েছেন লি।

‘এক মাসের মধ্যে আমার চাহিদা পূর্ণ করুন। না হলে…’

‘না হলে?’ স্বৈরতান্ত্রিক প্রধানের রাগ, বৃদ্ধের অসহায়তা, পুরুষ মানুষের ভালোবাসা—সব অনুভূতি ফুটে উঠল ওই দুটি শব্দে।

‘আপনি অনুমতি দিলে বাড়ি চলে যাব। অনুমতি না দিলে ওপরে।’ গলায় কাল্পনিক দড়ি পেঁচিয়ে আত্মহত্যার অভিনয় করে ফ্রিদা।

লি ম্লান মুখে বললেন, ‘এক মাস…’ তারপর শয্যাকক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। এবার আর দরজা বাইরে থেকে বন্ধ হল না। ফ্রিদা শ্বাস ছাড়ল। এক মাসের জন্যে বুড়ো হারামজাদার মুখ দেখতে হবে না! শান্তি!

সিনচানের চিকিৎসা বিজ্ঞান বহু পুরোনো। তার সঙ্গে পাশ্চাত্যের আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির কোনও মিল নেই। গাছগাছালি, জীবজন্তু, পাখপাখালির শরীর থেকে নির্যাস নিংড়ে জড়িবুটি তৈরি করা হয়। এর নাম প্রথাগত সিনচানি চিকিৎসা। যে দপ্তরের পূর্ণমন্ত্রী হলেন বৈদ্যরাজ ডেং চাও। তিনি থাকেন জেমলিন স্ট্রিটেই, লিয়ের প্রাসাদ থেকে মাত্র একশো মিটার দূরে।

রাত পৌনে দশটার সময় বৈদ্যরাজের অফিসে বসে সব কথা বলে ডেঙের হাত ধরে লি বললেন, ‘আমাকে বাঁচান কমরেড!’

ডেং বললেন, ‘খুবই সাধারণ সমস্যা। এর ওষুধ আছে। তবে সমস্যাও আছে। কাঁচামাল জোগাড় করা খুব শক্ত।’

‘কী লাগবে? আপনি মুখ ফুটে বলুন একবার!’

‘আপনাকে একটা স্যুপ খেতে হবে, যার প্রধান উপাদান হল বাঘের পুরুষাঙ্গ।’ বললেন ডেং, ‘যৌন বলবর্ধক রাসায়নিকের কারণে একবার পান করলে এক বছরের জন্যে নিশ্চিন্ত।’

এটা ঠিক যে সিনচানের সঙ্গে বাঘের সম্পর্ক অনেক পুরোনো। প্রথাগত সিনচানি চিকিৎসা অনুযায়ী বাঘের পুরুষাঙ্গে যে রাসায়নিক পদার্থ আছে সেটি পৌরুষ পুনরুদ্ধারের ক্ষমতা রাখে। এই কারণে সিনচানে অতীতে নিয়মিত বাঘ শিকার করা হতো। লি দায়িত্ব নিয়ে চোরাশিকার বন্ধ করেছেন। এই দেশে বাঘ মারার শাস্তি মৃত্যু। বাঘের চামড়া, দাঁত নখ আর হাড় ওষুধ আর ওয়াইন তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। তবে সব থেকে বেশি দাম বাঘের লিঙ্গের। অতীতে সিনচানে হাজার হাজার বাঘ থাকলেও এখন আর একটিও নেই।

ডেংকে ধন্যবাদ জানিয়ে লি বেরোলেন। ফোন করে পরদিন সকাল সাতটার সময় নিজের অফিসে ডেকে নিলেন সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের উপপ্রধান চ্যাং ওয়াংকে।

দ্বিতীয় দিন

চ্যাং ওয়াঙের বয়স পঁয়তাল্লিশ বছর। মিলিটারি সার্ভিসের প্রধান পদটি রাজনৈতিক হলেও উপপ্রধান মনোনীত হন আর্মির লোক। চ্যাং যে মিলিটারি সার্ভিসে আছেন, সেটা তাঁর উচ্চতা, হাঁটাচলা, পেশী ও চুলের ছাঁট দেখেই বোঝা যায়। সেনাবাহিনীতে খুব কম বয়সে উপপ্রধান হয়ে তিনি খুশি। কিন্তু বাকি জীবনে উন্নতির সুযোগ নেই, এই ভেবে বিরক্ত। মাঝেমধ্যে ভাবেন, পার্টির লোকের সেনাপ্রধানের পদ পাওয়া নিয়ে আপত্তি করবেন। পরে নিজের ভালো ভেবে চুপ করে যান। অফিসের এক আর্দালি ওঁদের চা দিয়ে গেল।

লিয়ের সমস্যা আর ডেং-এর সমাধান শুনে চ্যাং কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘এখন পৃথিবীর তেরোটি দেশে বাঘ আছে। সেই দেশগুলোতে বাঘ সংরক্ষণ করা হচ্ছে, তাদের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। আমরা নীতিগতভাবে ওই তেরোটি দেশের সঙ্গে যুক্ত আছি। কাজেই প্রকাশ্যে বাঘ শিকার সম্ভব নয়। বিদেশে গিয়ে বাঘ মেরে তার লিঙ্গটি কেটে আনতে হবে। এবং এই কাজে ভরসা করতে হবে বিদেশি চোরা শিকারিদের ওপরে। যাতে প্রোজেক্টটি ব্যর্থ হলে সিনচানের গায়ে আঁচ না লাগে।’

‘কোনও প্ল্যান ভেবেছ?’

একটুও না ভেবে চ্যাং বললেন, ‘থাইল্যান্ডের একটা মেয়ে, নাম ফ্যানি, ইন্ডিয়ার অসম প্রদেশে গন্ডার চোরাশিকার করতে গিয়ে প্রায় ধরা পড়ে যাচ্ছিল। অরুণাচল প্রদেশের সেফ প্যাসেজ হয়ে এখন সিনচানে আছে। আমরা ওকে থাকতে দিয়েছি। এই কাজটা ও করে দেবে। ওর সঙ্গে থাকবে লুসি।’

‘সে কে?’

‘লুসি আমাদের দেশেরই নাগরিক। এখন জেলে আছে। আমাদের দেশের শেষ বাঘটা ওই মেরেছিল।’

‘আমরা ওকে মৃত্যুদণ্ড দিইনি কেন?’

‘কারণ পার্টির আর এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের একই সমস্যার জন্যে সিনচানের শেষ বাঘটিকে হত্যা করা হয়।’ বাঁকা হাসলেন চ্যাং।

প্রসঙ্গ বদলাতে লি দ্রুত বললেন, ‘ওদের সঙ্গে আর কেউ যাবে?’

‘বাঘ শিকার একটা টিম এফর্ট। বিশেষত সেটা যদি বিদেশে চোরাশিকার হয়। ওদের সঙ্গে দিতে চাই ওয়ারিস্তানের রায়হান আর জায়েনকে। ওরাও চোরাশিকারি, আমাদের জেলে বন্দি আছে। এই কাজটা সফল ভাবে করতে পারলে ওদের মুক্তি দিতে হবে, এটা আগে থেকেই বলে রাখলাম।’

‘আর ব্যর্থ হলে?’

‘যে দেশে শিকার করতে যাচ্ছে, সেই দেশের জেলখানায় ফ্যানি, রায়হান আর জায়েন পচে মরবে। আমাদের দায়িত্ব থাকবে মুখ খোলার আগে লুসিকে শেষ করে দেওয়ার। না হলে সিনচানের বদনাম হবে।’

‘হ্যাঁ,’ ফ্রিদার কথা ভাবতে ভাবতে লি বললেন, ‘মৃত্যু সবার নিয়তি। কারও আগে, কারও পরে। যাই হোক, বাঘ মারার জন্যে কোন দেশের কথা ভাবছ?’

‘এমন দুটো দেশের কথা ভাবছি, যারা প্রতিবেশী। বাঘের আবাসস্থল, মানে জঙ্গল যেখানে এক দেশের সীমা অতিক্রম করে অন্য দেশে মিশে গেছে। যেখানে এক দেশের বাঘ অন্য দেশে চলে যায় বলে বাঘসুমারিতে ত্রুটি থাকে। যেখানে একটা বাঘ মরে গেলে কারও কিছু আসে যায় না।’

‘ভারত আর শ্যামলদেশ!’ হাততালি দিলেন লি, ‘ব্রিলিয়্যান্ট আইডিয়া। কিন্তু টুরিস্ট হিসেবে গিয়ে বিপদে পড়বে না তো?’

আর্দালি চায়ের কাপ নিতে এসেছে। খালি কাপ তার হাতে তুলে দিয়ে চ্যাং বললেন, ‘ওয়ারিস্তানের এক এজেন্ট ভারত আর শ্যামলদেশের স্লিপার সেলের সদস্য। ওর নাম কিয়ারা। বাহামার নাগরিক হলেও ভারত আর শ্যামলদেশকে হাতের তালুর মতো চেনে। ও সঙ্গে থাকবে। রায়হান, জায়েন, লুসি, ফ্যানি আর কিয়ায়ার টিম শ্যামলদেশের সীমান্ত পেরিয়ে জলপথে ভারতে ঢুকে বাঘ শিকার করে শ্যামলদেশ হয়ে ফিরে আসবে। দুটো দেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে যে জঙ্গলটা, তার নাম…’

‘সুন্দরবন,’ একগাল হাসলেন লি। ‘আমি একবার ঘুরে এসেছি অনেক বছর আগে। ইন্ডিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির আমন্ত্রণে।’

‘এটা বেশ ঝামেলার কাজ।’ চেয়ার থেকে উঠলেন চ্যাং, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী বীরেন্দ্র মেহতা খুবই এফিসিয়েন্ট লোক। আমাদের সাবধানে এগোতে হবে।’

আর্দালি চায়ের ট্রে নিয়ে রসুইখানায় চলে গেছে। সে গোপনে কাউকে মেল করছে…

চতুর্থ দিন

রঞ্জিত গগৈয়ের অফিসে ঢুকে আয়েশা বলল, ‘আমি একাই এলাম স্যর। প্রথমা ছুটিতে আছে।’

‘ভালোই হয়েছে।’ হাসলেন রঞ্জিত, ‘ওর বাড়ি কোলাঘাটে। আর আমাদের পরের কাজটা…’

‘এবার কী কাজ স্যর?’ আয়েশা উত্তেজিত।

রঞ্জিতের ইশারায় আর্দালি চা আর বিস্কুট দিয়ে গেছে। চায়ে চুমুক দিয়ে রঞ্জিত বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বীরেন্দ্রজিকে শ্যামলদেশের প্রধানমন্ত্রী নাসরিন বানু গতকাল ফোন করেছিলেন। ওদের গোয়েন্দা বিভাগের নাম হল ‘ন্যাশনাল সিকিয়োরিটি ইনটেলিজেন্স’ বা ‘এন এস আই।’ এন এস আই খবর পেয়েছে যে শ্যামলদেশ হয়ে জলপথে সিনচান, ওয়ারিস্তান আর বাহামার পাঁচজনের একটা টিম ভারতে ঢুকবে। ওরা আসছে বাঘ শিকার করতে।’

‘বাঘ মারতে সুন্দরবনে? আর জায়গা পেল না?’

‘এটা নাসরিন বানু বলতে পারেননি,’ অসহায় ভাবে কাঁধ ঝাঁকালেন রঞ্জিত। ‘বর্ডার সিকিয়োরিটি ফোর্স অবৈধ গরু পাচার আটকাতে পারছে না, আর এ তো মহার্ঘ বাঘ! আমাদের দেশে গোপনে বাঘ শিকার হয় কি না, বাঘের চামড়া বা অন্যান্য অঙ্গ দেশে বা বিদেশে বিক্রি হয় কি না—এই নিয়ে কোনও তথ্য আমাদের কাছে নেই। পুরোটাই গ্রে জোন। তবে ২০২৩ সালের আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবসের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে এই মুহূর্তে বাঘের সংখ্যা ৩৯২৫ এবং এর মধ্যে বাংলায় বাঘের সংখ্যা মাত্র ১০০। এদের মারার জন্যে বিদেশ থেকে চোরাশিকারি আসছে। আমাদের কাজ ওদের হাতেনাতে ধরা।’

‘শিকারিকে মেরে দিলেই তো হয়!’ বলল আয়েশা, ‘একটা হিন্দি গান আছে, ‘শিকারি খুদ শিকার হো গ্যয়া!’’

‘আমারও তাই মত। কিন্তু শিকারিদের হাতেনাতে ধরতে পারলে ওয়ারিস্তান আর সিনচানকে রাজনৈতিক ভাবে মারা যাবে। তাই না?’

রঞ্জিতের প্রস্তাব পছন্দ হয়নি আয়েশার। সে বলল, ‘আমাকে কী করতে হবে?’

‘ওরা কবে শ্যামলদেশে ঢুকছে, এখনও জানা যায়নি। কিন্তু আমাদের রেডি থাকতে হবে। আমার একটা প্ল্যান আছে।’ আয়েশার দিকে প্যাডের ছেঁড়া পাতা এগিয়ে রঞ্জিত বললেন, ‘সবার আগে প্রথমাকে বল কোলাঘাট থেকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় চলে যেতে। বাকি কী কী কাজ করতে হবে, আমি এখানে লিখে দিয়েছি। পড়ে কাগজটা নষ্ট করে দিস।’

‘বাহামার কিয়ারা? সে তো আমাদের লোক।’ বলল আয়েশা, ‘ও প্রথমাকে চেনে সুশীলা সিং হিসেবে। আমার কাছে কিয়ারার সমস্ত ডকুমেন্ট আছে। ওর ফোন ট্যাপ করলেই সব খবর পেয়ে যাব।’

‘প্রথমাকে আগে ইনফর্ম কর।’

‘বেচারি ছুটিতে আছে। কেন ওকে বিরক্ত করছেন?’ চা শেষ করে কাগজটা নিয়ে উঠল আয়েশা।

সপ্তম দিন

রঞ্জিত ফোন করলেন প্রথমাকে।

প্রথমা ফোন ধরল না।

নবম দিন

প্রথমাকে রঞ্জিতের এনক্রিপ্টেড মেল। ‘কাজ কতদূর এগোল।’

উত্তর এল। ‘এগোচ্ছে।’

পঞ্চদশ দিন

রঞ্জিতের ফোন আয়েশাকে। ‘কাজ কেমন এগোচ্ছে?’

‘প্রচুর ঝামেলা স্যর। ফোনে বলা যাবে না। ওরা কবে আসবে জানতে পারলেন?’

‘পঁচিশে মে। তার মধ্যে ফাঁদ পাতা যাবে তো?’

‘যাবে স্যর।’

‘প্রথমা কোথায়?’

‘ঘুমোচ্ছে স্যর। পরে কথা বলবে।’

রঞ্জিত ফোন কেটে দিলেন। প্রথমার সঙ্গে একবারও কথা হল না কেন? তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ।

পঁচিশতম দিন

‘সুন্দরবন হল পৃথিবীর সব থেকে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। আয়তন প্রায় দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার, যার অর্ধেকের বেশি আছে শ্যামলদেশে।’ সকাল সাতটার সময় শ্যামলদেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে পড়ল ফ্যানি। তার সঙ্গে রয়েছে লুসি, রায়হান আর জায়েন। পাসপোর্ট অনুযায়ী ওরা নাম একই আছে, শুধু পদবি বদলে গেছে। ওরা এখন আমেরিকার নাগরিক। পরিচয়পত্র অনুযায়ী ‘ইন্টারন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল’-এর ফোটোগ্রাফার। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জীবনযাপন শুট করতে এই দেশে এসেছে। সবার পরনে জিন্‌স, টি-শার্ট, স্নিকার। মাথায় বেসবল ক্যাপ আর চোখে সানগ্লাস। কোভিড পরবর্তী জমানায় মুখে মাস্ক আর হাতে দস্তানাটা স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গেছে।

ওদের জন্যে প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে বিমানবন্দরের ঠিক বাইরে রয়েছে একটি মেয়ে। ফ্যানি হাত নেড়ে বলল, ‘আপনার নাম কিয়ারা? আমি ফ্যানি। আর এরা হল…’

পরিচয়পর্ব শেষ হতে পাঁচজনে এগোল পার্কিং লটের দিকে। সেখানে ওদের জন্যে অপেক্ষা করছে একটি সেভেন সিটার এসইউভি। গাড়ির চালক একটি অল্পবয়সি ছেলে। পরে আছে জিন্‌স ও পুরোহাতা জামা। এরও মাথায় বেসবল ক্যাপ, পায়ে স্নিকার, চোখে সানগ্লাস, মুখে মাস্ক ও হাতে গ্লাভস। গাড়িতে ওঠার পরে কিয়ারা বলল, ‘আলাপ করিয়ে দিই। এর নাম সামিউল বা স্যাম। আমাদের গাড়ির চালক। পরে ট্রলারও চালাবে।’ সামিউল নিঃশব্দে সবার হাতে ব্রেকফাস্টের প্যাকেট আর মিনারেল ওয়াটারের বোতল তুলে দিল। যাত্রা শুরু হল।

খেতে খেতে ফ্যানি বকবক করছে কিয়ারার সঙ্গে। ‘সুন্দরবন পুরোটা ঘুরতে কতক্ষণ লাগে?’

কিয়ারা বলল, ‘শ্যামলদেশের পাঁচটা জেলার অংশ জুড়ে আছে সুন্দরবন। ঘুরতে অনেক সময় লাগবে। আমরা রাজধানী থেকে স্টার্ট করলাম সকাল সাতটায়। ঘুলনা যেতে মিনিমাম আটঘণ্টা লাগবে।’

দুপুর তিনটে নাগাদ ঘুলনায় গাড়ি পৌঁছোল। সেখানকার রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাওয়া সেরে নদীর ধারে পৌঁছোল ছ’জন। এসইউভিটি পার্কিং-এ রেখে সামিউলও চলে এসেছে।

ওদের সামনে বিশাল চওড়া রূপসী নদী। নদীর ধার বরাবর অজস্র ডিঙি, নৌকো, লঞ্চ, ট্রলার, স্পিডবোট, টুরিস্ট বোট আর জাহাজ দাঁড়িয়ে রয়েছে। নদীমাতৃক দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি এইসব জলযান।

সামিউল একগাদা কাগজ কিয়ারার হাতে তুলে দিল। সেগুলো দেখে কিয়ারা বলল, ‘আমাদের তিনদিনের সুন্দরবন সফরের সব ডকুমেন্ট রেডি। আপনারা দেখে নিন।’

কাগজ দেখার ব্যাপারে কারও আগ্রহ নেই। সবাই লম্বা লম্বা চোঙাওয়ালা বাক্স ঘাড়ে ট্রলারে উঠল। এই বাক্সগুলো প্লেনে এসেছে। এর মধ্যে ক্যামেরা আছে। তবে ঘুলনায় নামার পরে এর মধ্যে ঢুকেছে ‘হল্যান্ড অ্যান্ড হল্যান্ড কোম্পানি’-র তৈরি পয়েন্ট ফোর ফাইভ এইট উইনচেস্টার ম্যাগনাম রাইফেল, যা বাঘ শিকারের পক্ষে আদর্শ। চারটে রাইফেল জোগাড় করেছে কিয়ারা।

সবাই ট্রলারে ওঠার পরে সামিউল ইঞ্জিনে স্টার্ট দিল। কিয়ারা বলল, ‘এখান থেকে আমরা যাব ঝুনোখালি টাইগার পয়েন্ট। সেখানকার বন বিভাগের রেস্ট হাউসে রাতে থাকার জন্যে তিনটে ডাবল বেড রুম বুক করে রেখেছি। আপাতত আপনারা প্রকৃতি দেখুন।’

প্রকৃতি দেখার ব্যাপারে জায়েন, রায়হান, ফ্যানি বা লুসির কোনও আগ্রহ নেই। তারা ছোট্ট কেবিনে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়ল। ট্রলারের ইঞ্জিন রুমে বসে রয়েছে সামিউল আর কিয়ারা। নিস্তরঙ্গ নদী দিয়ে দীর্ঘ চার ঘণ্টা শেষে ঝুনোখালি এসে গেল।

পঁচিশতম দিন

‘কী খবর?’ রঞ্জিতের এনক্রিপ্টেড মেসেজ।

‘পয়েন্ট বি রিচ করেছি।’ আয়েশার এনক্রিপ্টেড মেসেজ।

‘হোয়্যার ইজ শি?’ রঞ্জিত।

‘আছে।’ আয়েশা।

পঁচিশতম রাত

সন্ধে সাতটা নাগাদ ঝুনোখালি পৌঁছোল ট্রলার। অন্ধকারে বোঝাই যাচ্ছে না যে কাছাকাছি স্থলভূমি আছে। কিয়ারা সবাইকে ঘুম থেকে তুলে বলল, ‘আজ রাতটা খেয়েদেয়ে ঘুমনো যাক। কাল ভোরে কাজ শুরু।’

রেস্ট হাউসটি আহামরি কিছু নয়। এই রকম দুর্গম জায়গাতে থাকার ব্যবস্থা আছে, দুজন স্টাফ আছে, এটাই যথেষ্ট। তিনটে ডাবল বেড রুমের একটা জায়েন আর রায়হানের জন্যে, একটা লুসি আর ফ্যানির জন্যে, একটা কিয়ারা আর সামিউলের জন্যে। ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে সবাই চলে এল ডাইনিং রুমে। লুসি বলল, ‘শ্যামলদেশে আসার আগে আমি মোরগ পোলাও বানাতে শিখেছি। সেটা সবার জন্যে রান্না করব। রেস্ট হাউসের স্টাফেদের জন্যেও।’

দুই কর্মচারী প্রথমে গাঁইগুঁই করছিল। পরে অতিথিদের জোরাজুরিতে রাজি হল। রাত ন’টার মধ্যে রান্না চুকিয়ে সবাই মিলে ড্রয়িং রুমে বসল। কর্মচারী দুজন বলল, ‘অতিথিদের সঙ্গে আমাদের বসা বারণ।’

লুসি বলল, ‘তোমাদের খাবার নিয়ে যাও।’

ওরা খাবার নিয়ে চলে যাওয়ার পরে ছ’জন খেতে বসল। এক চামচ পোলাও মুখে দিয়ে ফ্যানি বলল, ‘বনবিবি শব্দটা বারবার শুনছি। এটা কী ব্যাপার?’

‘বনবিবি হলেন সুন্দরবনের দেবী,’ বলল কিয়ারা, ‘উনি সুন্দরবনের মানুষদের বাঘের হাত থেকে রক্ষা করেন। একই সঙ্গে তিনি হিন্দুধর্মের দেবী এবং ইসলাম ধর্মের পিরানি।’

‘ইন্টারেস্টিং!’ বলল জায়েন।

লুসি খাওয়া থামিয়ে স্টাফ কোয়ার্টার ঘুরে এসে বলল, ওরা পেট ভরে খাচ্ছে। আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়বে। কাল ভোরে আমাদের ব্রেকফাস্ট দিতে হবে!’

কিয়ারা বলল, ‘যারা সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে যায়, তাদের মউলে বলে। জঙ্গলে ঢোকার আগে জেলে আর মউলেরা বনবিবির মানত করা লাল সুতোর মাদুলি বা তাবিজ পরে। এই নিয়ে নানা লোককথা আছে।’

কথায় কথায় অনেক রাত হয়েছে। সবাই খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে চলে গেল। কর্মীদের কোনও সাড়া শব্দ নেই।

রাত একটা নাগাদ নিজের রুম থেকে বেরোল লুসি। নিঃশব্দে স্টাফ কোয়ার্টারে ঢুকল এবং একটু পরে বেরিয়ে এল। মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে সে দুজন স্টাফকে গলা কেটে খুন করেছে।

ওদের মোরগ পোলাওতে কড়া ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল। যারা মড়ার মতো ঘুমোয়, তাদের গলা কাটতে বিশেষ সময় লাগে না। বিশেষত লুসির মতো চোরাশিকারির পক্ষে। রক্ত দিয়ে বড় একটি বৃত্ত এঁকে সে মুন্ডুদুটি মাঝখানে রাখল। তারপর বৃত্তের মধ্যে ও বাইরে নানান আজগুবি ও মনগড়া চিহ্ন আঁকল।

বাকি সবাই চলে এসেছে। জায়েন বলল, ‘এর মানে কী?’

‘কোনও মানে নেই।’ হাসল লুসি, ‘ভারতীয় উপমহাদেশের লোকেরা ধর্ম নিয়ে খুব সেনসিটিভ। এদের মধ্যে ঝগড়া বাধানো সোজা। আমাদের খোঁজ না পেয়ে পুলিশ এখানে এসে এইসব দেখে ঘাবড়ে যাবে। ভাববে একদল বিদেশি এসে তন্ত্রসাধনা করেছে এবং নরবলি দিয়েছে। এই নিয়ে বিরাট বাওয়াল হতে পারে। তাই সরকার এই ঘটনা চেপে দেওয়ার চেষ্টা করবে। তাতে আমাদের লাভ। ওদের কনফিউশানের মধ্যে আমরা ইন্ডিয়ায় ঢুকে একটা বাঘ মেরে সিনচানের ফ্লাইট ধরে নেব।’

ফ্যানি বলল, ‘আমরা ক’টায় বেরোব?’

‘ভোর চারটে,’ বলল লুসি, ‘ইন্ডিয়ান ট্রলার এখান থেকে সত্তর কিলোমিটার দূরে আছে। ওই অবধি যাওয়া সামিউলের কাজ।’

বাকি রাতটুকু ঘুমিয়ে ভোর চারটের সময় ওরা আবার ট্রলারে উঠল। বিশাল নদী বেয়ে অন্ধকারে ভেসে যাচ্ছে ট্রলার। সবাইকে জাগিয়ে রাখার জন্যে লুসি বলল, ‘কারও এটা মনে হচ্ছে, যে ওই লোকদুটোকে না মারলেও হতো?’

রায়হান আর ফ্যানি চুপ করে রইল। জায়েন বলল, ‘আমার মনে হয়েছে।’

‘বিমানবন্দরে নামার পর থেকে আমাদের আসল চেহারা কেউ দেখেছে?’

‘একমাত্র এই দুজন দেখেছে। খাওয়ার জন্যে আমরা মাস্ক খুলতে বাধ্য হয়েছিলাম,’ বলল জায়েন।

‘এখনও কি মনে হচ্ছে যে লোকদুটোকে না মারলেও হতো?’ প্রশ্ন করল লুসি।

জায়েন বলল, ‘আর মনে হচ্ছে না।’ বাকিরা কিছু বলল না। একটু পরে ওরা ঘুমিয়ে পড়ল। বুঝতেও পারল না কখন ট্রলারটি ‘বর্ডার গার্ড শ্যামলদেশ’ বা ‘বি জি এস’-কে এড়িয়ে সীমান্ত টপকে ভারতবর্ষে ঢুকে গেল। কখন ‘বর্ডার সিকিয়োরিটি ফোর্স’ বা ‘বি এস এফ’-কে লুকিয়ে খাঁড়ির মধ্যে ঢুকল। এখানেই ইন্ডিয়া থেকে আসা ট্রলার নিয়ে অপেক্ষা করছে হালিমা নামের এক মহিলা। সবাই ফটাফট ভারতীয় ট্রলারে উঠে পড়ার পরে সামিউল পুরোনো ট্রলারের ইঞ্জিন ঘরে ঢুকে গলুইতে ফুটো করে দিল। শ্যামলদেশের ট্রলার ডুবে যাওয়ার আগেই সে চলে এসেছে ভারতের ট্রলারে। এসে বলল, ‘এখানে জলের গভীরতা খুব বেশি। এই ট্রলার বি এস এফ বা কোস্ট গার্ড কোনও দিনও খুঁজে পাবে না। খুঁজে পেলেও শ্যামলদেশের ট্রলারের নিয়ে মাথা ঘামাবে না।’

‘সামিউলের খোঁজ পড়লে?’ জিজ্ঞাসা করল লুসি।

‘পড়লে কিছু করার নেই।’ খসখসে গলায় বলল সামিউল। ‘আমি আদতে ইন্ডিয়ার নাগরিক। গত চব্বিশ দিন ধরে জাল পরিচয়পত্র নিয়ে সামিউল সেজে ঘুলনায় ট্রলার চালানো শিখছিলাম।’

সবাই অবাক হয়ে সামিউলের দিকে তাকাল।

পঁচিশতম রাত

‘হোয়ার ইজ প্রথমা?’ রঞ্জিতের কণ্ঠস্বর রাগে কাঁপছে।

‘আছে স্যর। আপনি স্ট্রেস নেবেন না।’ নিচু গলা আয়েশার।

‘আমি এক্ষুনি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ রঞ্জিত চিৎকার করলেন।

আয়েশা ফোন কেটে দিল।

ছাব্বিশতম দিন

ভোরবেলা জঙ্গলের চেহারা রহস্যময়। সুন্দরবনের নদীতে ভোর হওয়ার চেহারা আরও রহস্যময়। ট্রলার যাচ্ছে সরু একটা খালের মধ্যে দিয়ে, খুব আস্তে আস্তে। ইঞ্জিনের শব্দ নেই। জলের স্রোত যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে সেদিকে ভেসে যাচ্ছে। দু-দিকে সুন্দরী, গরান, গেওয়া, বাইন, হেঁতাল, কেওড়া আর ধুন্দুল গাছ ডালপালা মেলে এগিয়ে আসছে ট্রলারের দিকে। সূর্য উঠেছে কি না সেটা এই কালচে সবুজ টানেলের মধ্যে বোঝার উপায় নেই। রাতের কালিগোলা আকাশে রঙের ছিটে নেই, তবে অন্ধকার কিছুটা পাতলা হয়েছে।

কোথাও কোনও প্রাণের সাড়া নেই। পাখি ডাকছে না, জন্তু-জানোয়ার ঘুমোচ্ছে। ট্রলারের ডেকের চারদিক বসে রয়েছে চার শিকারি। সামনে আর পিছনে ফ্যানি আর লুসি। দু-দিকে রায়হান আর জায়েন। সবার হাতে পয়েন্ট ফোর ফাইভ এইট উইনচেস্টার ম্যাগনাম। ইঞ্জিনরুমে রয়েছে সামিউল আর হালিমা। কিয়ারাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

সামিউল নিচু গলায় হালিমাকে বলল, ‘এটা কোর এরিয়া, তাই না?’

হালিমা বলল, ‘হ্যাঁ। মাত্র এক সপ্তাহ আগে এক মউলেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে।’

‘এদের একটা ছেলে বাঘ চাই।’

‘বাঘ তো আর “আধার” কার্ড সঙ্গে আনবে না যে তুমি নাম, ধাম, বয়স জেনে নেবে। বা ন্যাজ তুলে দেখার সময় পাবে—হুলো না মেনি। যেটা চোখের সামনে পাবে, সেটাই মারতে হবে। কপাল ভালো থাকলে সেটা ছেলে বাঘ হবে। কপাল খারাপ থাকলে…’

‘মেয়ে বাঘ?’

‘সেটা হতে পারে…নয় তো বাঘ তোমার টুঁটি ধরে জঙ্গলে টেনে নিয়ে দেখবে তুমি কেমন খেতে!’ কণ্ঠস্বরে শ্লেষ মিশিয়ে বলল হালিমা।

ওদের কথার মধ্যে আকাশ আর একটু পরিষ্কার হয়েছে। নদীর জল কিছুটা দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। কোথাও কোনও প্রাণের সাড়া নেই। অস্বাভাবিক রকমের স্তব্ধ জঙ্গল। সামিউল বলল, ‘আচ্ছা, এখানে ফেউ আছে?’

‘শেয়ালের কথা বলছ?’ হঠাৎ কথা থামিয়ে হালিমা চিৎকার করল, ‘বাঘ!’

‘কোথায়?’ আঁতকে উঠে ইঞ্জিন রুম থেকে বেরোল সামিউল। সে আর হালিমা একসঙ্গে ডেকে পৌঁছে দেখল ফ্যানি, রায়হান আর লুসি রেলিং-এর গায়ে ঝুঁকে একের পর এক গুলি চালাচ্ছে। জায়েনকে দেখা যাচ্ছে না। চলে এসেছে কিয়ারাও।

দৌড়ে ওদের পাশে গিয়ে সামিউল নদীর দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল।

বিরাট বড় একটা বাঘ জায়েনের টুঁটি কামড়ে সাঁতার কেটে পাড়ের দিকে যাচ্ছে। দুই চোয়ালের মধ্যে আটকে থাকা জায়েন এখনও তাদের দিকে তাকিয়ে। দৃষ্টিতে আতঙ্ক আর বেদনা লেগে আছে। একটু পরে সেগুলোও আর থাকবে না। হঠাৎ বাঘটা বিকট চিৎকার করে জায়েনকে মুক্তি দিয়ে জল তোলপাড় করে হুঙ্কার দিল। ওর শরীরে বুলেট লেগেছে।

জঙ্গলের মধ্যে আহত বাঘের হুঙ্কার শোনার অভিজ্ঞতা যার নেই, সে এই অভিঘাত সহ্য করতে পারবে না। কিয়ারাও পারল না। সে পোশাকে প্রস্রাব করে ফেলে দৌড় দিল বাথরুমের দিকে।

সামিউল মোবাইল ফোনে ভিডিও রেকর্ড করছিল। সে বলল, ‘জায়েনকে আর বাঁচানো যাবে না। কপাল ভালো, বাঘটার গায়ে গুলি লেগেছে। আমাদের এইখানেই থাকতে হবে। ও বেশিদূর যেতে পারবে না।’

জলে ভাসতে ভাসতে জায়েন দূরে চলে যাচ্ছে। সে দিকে তাকিয়ে রায়হান বলল, ‘বাঁচুক আর মরুক। জায়েনকে ট্রলারে তুলতেই হবে! তুমি ইঞ্জিনে স্টার্ট দাও!’

‘ইঞ্জিনের দায়িত্ব এখন হালিমার।’ বলল সামিউল।

হালিমার দিকে বন্দুক তাক করে রায়হান বলল, ‘ইঞ্জিনে স্টার্ট দাও। কুইক!’

হালিমা বলল, ‘আমি একমাত্র কিয়ারার হুকুম তামিল করব। তোমাকে আমি চিনিই না!’

‘দুই কানের মাঝখান দিয়ে গরম সিসে ঢুকলে বুঝতে পারবে কার হুকুম তামিল করতে হবে।’ হিশহিশ করে বলল রায়হান।

কিয়ারা এর মধ্যে বাথরুম থেকে বেরিয়েছে। সে বলল, ‘অনেকগুলো গুলি চলেছে। এখানে থাকা নিরাপদ নয়। আমরা বরং অন্য কোথাও চলে যাই। বি এস এফ একবার ধরলে…’

তার দিকে বন্দুক তাক করে রায়হান বলল, ‘শাট আপ বিচ! যা বলছি শোন। জায়েনকে আগে ট্রলারে তোল।’

কিয়ারা উদাসীন মুখে বলল, ‘আমার কথা পছন্দ হল না? তা হলে তুই মর!’ তারপরে সামিউল আর হালিমাকে একসঙ্গে টেনে ইঞ্জিন ঘরে ঢুকে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল।

বাইরে একটানা গোলাগুলি চলছে। তার মধ্যেই কিয়ারার মনে পড়ছে নিজের অতীতের কথা। নাসাউতে যাওয়ার এক মাসের মাথায় আসল কিয়ারাকে খুন করে বডি হাপিশ করে সে। নষ্ট করে মেয়েটির যাবতীয় ডকুমেন্ট। নিজের সেক্সুয়াল রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারি করায়। তারপরে কিয়ারা হয়ে যায়। সে নাসাউতে থাকত, ওয়ারিস্তানের হয়ে কাজ করত, কিন্তু ইন্ডিয়ার ডাবল এজেন্ট হয়ে প্রতি সপ্তাহে সুশীলা সিংকে জানাত ওয়ারিস্তানের সব খবর।

সুশীলাই তাকে বলে নতুন অবতারে, নতুন অ্যাডভেঞ্চারে নামতে হবে। সে হবে একই সঙ্গে শ্যামলদেশ আর ভারতে ওয়ারিস্তানের স্লিপার সেলের টেররিস্ট।

আইডিয়াটা পছন্দ না হলেও তার কিছু করার ছিল না। সুশীলা হাতে টিকি বাঁধা আছে বলে অনিচ্ছার সঙ্গে রাজি হয়। এই কাজটা উতরে গেল। এবার এখান থেকে পালাতে হবে। সুশীলা সে ব্যবস্থা করে দেবে বলেছে।

মুশকিল হল, এখানে আসার পর থেকে সুশীলা আর ফোন ধরছে না। তার বদলে অন্য একটা মেয়ে ফোনে নির্দেশ দিচ্ছে। এবার কী হবে কে জানে!

বাইরের শুট আউট বন্ধ হয়েছে। কেউ একজন ইঞ্জিন রুমের দরজা খটখটিয়ে হিন্দিতে বলল, ‘বাহার আজাইয়ে। উই আর বি এস এফ। আই অ্যাম ডি আই জি অফ সুন্দরবন এরিয়া, প্রবাল রেড্ডি!’

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সামিউল বলল, ‘যাক বাবা! বাঁচা গেল!’

তার দিকে তাকিয়ে কিয়ারা বলল, ‘তুমি তো শ্যামলদেশের বাসিন্দা! তোমাকে তো অ্যারেস্ট করবে! ভয় করছে না?’

ইঞ্জিন রুমের দরজা খুলে সামিউল বলল, ‘তুমি যেমন কিয়ারা নও, আমিও তেমন সামিউল নই। তুমি সেক্স চেঞ্জ করে মেয়ে হয়েছ। আর আমি সেক্স চেঞ্জ না করেই ছেলে হয়েছি। এবার বাইরে চলো।’

কিয়ারা হাঁ করে সামিউলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

ছাব্বিশতম রাত

‘আমার মাথা কাজ করছে না। ঠিক কী হল বলুন তো?’ ফোনে উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইলেন রঞ্জিত।

বর্ডার সিকিয়োরিটি ফোর্সের সুন্দরবন এলাকার ডি আই জি প্রবাল রেড্ডি বললেন, ‘সবটা এখনও জেনে উঠতে পারিনি স্যর। ইন্টারোগেশান চলছে। মোদ্দা কথা হল, পাঁচজন লোক শ্যামলদেশ হয়ে জলপথে ওয়েস্ট বেঙ্গলের সুন্দরবনে ঢুকেছিল বাঘ শিকার করতে। এরা হল ওয়ারিস্তানের রায়হান আর জায়েন, সিনচানের ফ্যানি আর লুসি। জায়েন বাঘের কামড়ে মারা গেছে। আমরা ওর লাশ পেয়েছি। বাকি তিনজনকে গ্রেফতার করে কলকাতার ইস্টার্ন কমান্ডে আনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক চোরা শিকারিদের বাঘ মারার খবর এখন টিভি আর সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল। তবে ওরা কতজন ছিল, কোন দেশ থেকে এসেছে— এগুলো বলা হয়নি।’

‘বেশ। আর কিছু?’

‘আমরা স্যর…’ একটু থেমে বললেন প্রবাল, ‘শ্যামলদেশের এক ট্রলার চালককে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। ওর নাম সামিউল। কিয়ারা নামে বাহামার একটি মেয়ে আর হালিমা নামে লোকাল একটি বউকেও ছেড়ে দিয়েছি। এটা আপনার ইনস্ট্রাকশান মতো হয়েছে।’

‘ওই নিয়ে ভাবতে হবে না,’ দ্রুত প্রসঙ্গ বদলান রঞ্জিত।

‘আপনি যখন বলছেন, ভাবব না। কিন্তু স্যর, আমার একটা কথা আছে। সামিউল ছেলে নয়। ও মেয়ে। মেক আপ করে ছেলে সেজে ছিল।’

‘ওদের নিয়ে ভেবো না। ভারত মাতার আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে ওরা কাজে নেমেছিল।’

ভারত মাতার নাম শোনার পরে আর তর্ক করা যায় না। ‘ইয়েস স্যর’ বলে ফোন কাটলেন প্রবাল।

সেই রাতেই ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটে কলকাতা ছাড়ল কিয়ারা। তার নতুন পরিচয়পত্র জোগাড় করে দিয়েছে সামিউল। এই ফ্লাইট ব্যাংকক হয়ে দোহা যাবে। সেখান থেকে নিজের রাস্তা খুঁজে নেবে কিয়ারা।

ছাব্বিশতম রাত

সেই রাতেই সিনচান মিলিটারি সার্ভিসের উপপ্রধান চ্যাং ফোনে দুঃসংবাদটা দিলেন চেয়ারম্যান লিকে। লি দৌড়ে গেলেন বৈদ্যরাজ ডেং-এর কাছে। তিনি সব শুনে বললেন, ‘মেয়েরা যুগে যুগে, কালে কালে মানব জাতির সর্বনাশ করে এসেছে। বিপ্লবের অন্তরায় এরা। আপনি ফ্রিদাকে ত্যাগ করুন।’

‘পারব না!’ হুহু করে কাঁদছেন লি। আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি।’

‘আপনি ওকে ভালোবাসলেও ও আপনাকে ভালোবাসেনি কমরেড!’ হাসলেন ডেং, ‘আমি যতদূর জানি, টিভিতে চোরাশিকারি ধরা পড়ে যাওয়ার খবর পেয়ে ফ্রিদা আপনার প্রাসাদ থেকে পালিয়েছে।’

‘কী বললেন?’ বাঘের মতো হুঙ্কার দিয়ে ডেং-এর অফিস থেকে ছুটে বেরোলেন লি। রাগে তাঁর মুখ লাল! ফ্রিদা তাঁকে ধোঁকা দিল? এত বড় সাহস?

তিনি খেয়ালও করলেন না যে তাঁর গাড়ির ঠিক পিছনেই একটি মিলিটারি জিপে বসে রয়েছেন চ্যাং। পাশে বসে, চ্যাঙের হাতে হাত রেখেছে ফ্রিদা। গত তিন সপ্তাহ ধরে প্রেমের অভিনয় দিয়ে এই লোকটাকে জয় করেছে সে। এখন একটাই কাজ। সিনচানের সেনা প্রধানের আর উপপ্রধানের মধ্যে ঝগড়া বাঁধানো। শরীরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে সিনচানকে ধুলোয় মিশিয়ে দেবে ফ্রিদা। মুক্ত করবে তুইঘুর প্রদেশের সব নাগরিককে! ওপরওয়ালার কসম খায় ফ্রিদা!

ছাব্বিশতম রাত

সেই রাতেই রঞ্জিতের অফিসের ল্যান্ডলাইনে ফোন করেছে সামিউল। রঞ্জিত ফোন ধরে বললেন, ‘আয়েশা, প্রথমা কোথায়?’

আয়েশা বলল, ‘অন্যবার প্রথমা বলে এই ছড়াটা। এবার আমি বলি?’

‘কোন ছড়া?’

আয়েশা বলল,

‘হারাধনের পাঁচটি ছেলে

গেল বনের ধার,

একটি গেল বাঘের পেটে

রইল বাকি চার।’

‘সে তো বুঝলাম! কিন্তু প্রথমা কোথায়?’ রঞ্জিত উত্তেজিত হয়ে বললেন।

‘আপনার কী মনে হয়?’ হাসছে আয়েশা। ‘এই অ্যাডভেঞ্চারে প্রথমা কে?’

‘আমি তো গোড়ায় ভেবেছিলাম যে প্রথমা আগে থেকে শ্যামলদেশ গিয়ে সামিউল হিসেবে নিজের পরিচয় তৈরি করেছে। আর তুই হালিমা সেজে ইন্ডিয়া হয়ে ওদের সঙ্গে জয়েন করেছিস। পরে জানলাম যে হালিমা সত্যিই এই বাংলার ট্রলার চালক। তাই ওকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি কিয়ারা আর সামিউলকেও। তুই সামিউল হলে প্রথমা কে?’

‘এই অ্যাডভেঞ্চারে আমি প্রথমাকে ডাকিনি,’ এখনও হাসছে আয়েশা, ‘ও কোলাঘাটে বাবামায়ের সঙ্গে ছুটি কাটাচ্ছে। ওকে বিরক্ত করার কোনও মানে হয়? আমি একাই সামলে দিলাম তো! দিলাম না?’

‘তা ঠিক। তুই তা হলে ফিরে আয়। আর ওখানে থাকিস না।’ ফোন রাখলেন রঞ্জিত।

অফিসের জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন রঞ্জিত। ভুরু কুঁচকে আছে। আয়েশা কেন প্রথমাকে ডাকল না? এটা ওদের নিজস্ব বোঝাপড়া? নাকি আয়েশা প্রথমার প্রতি ঈর্ষান্বিত? ওদের মধ্যে কি কোনও দূরত্ব তৈরি হচ্ছে? কে জানে!

পরের বার বোঝা যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *