রইল বাকি এক
চৌঠা সেপ্টেম্বর
দুপুর দুটোর সময় কাইমেরার অফিসে লাঞ্চ করতে বসেছে প্রথমা আর আয়েশা, এমন সময় টেবিলে রাখা আদ্যিকালের সাদা-কালো ল্যান্ডলাইন ফোন বেজে উঠল। প্রথমা ফোন ধরে বলল, ‘লাঞ্চ করছি। এক ঘণ্টা পরে যাই?’ তারপর উত্তর না শুনেই রিসিভার ক্রেড্লে রেখে মাছের ঝোল আর রুটি দিয়ে লাঞ্চ সারল। সে ভাত খেতে খুবই ভালোবাসে। তবে কাজের সময় ভাত খেলে ঘুম পায়।
আয়েশা চিকেন স্যান্ডুইচে কামড় দিয়ে বলল, ‘গতকাল রঞ্জিত স্যর রিসার্চের যে কাজটা দিয়েছিলেন সেটা সেরে ফেলেছি। তুই ডকুমেন্টটা পড়েছিস?’
দু-দিকে ঘাড় নেড়ে প্রথমা বলে, ‘রিসার্চ তুই করবি। আমার কাজ ফিল্ড ওয়ার্ক।’
‘একটু পরেই স্যর পড়া ধরবেন। তখন বুঝবি ঠেলা!’ ফোড়ন কাটল আয়েশা।
কাইমেরার দুই এজেন্টের মধ্যে কে কী করবে, কে কী করছে না—এই নিয়ে খিটিরমিটির করতে করতে দুজনে পৌঁছে গেল রঞ্জিত গগৈয়ের অফিসে। চেম্বারে রঞ্জিত একাই ছিলেন। ওদের দেখে বললেন, ‘লাঞ্চ করতে এক ঘণ্টা লাগবে বললি। চলে এলি পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাথায়!’
বসের অনুমতি নিয়ে চেয়ারে বসে প্রথমা বলল, ‘আমরা হলাম সরকারের পোষা গুন্ডা। শরীর ফিট রাখতে হয়। বেশি খেলে চলে না।’
রঞ্জিত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘আয়েশা, ওয়ারিস্তানের এখনকার অবস্থা নিয়ে যে কাজটা করতে বলেছিলাম…’
মুচকি হেসে আয়েশা বলল, ‘এক লাইনে বলব না ডিটেলে বলব?’
‘আগে ওয়ান লাইনার শুনি।’
‘ওয়ারিস্তানের ইকনমির বারোটা বেজে গেছে।’
‘এবার ডিটেলে বল।’
‘ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড বা আইএমএফ-এর রিপোর্ট বলেছে যে এই মুহূর্তে ভয়ংকর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ওয়ারিস্তান। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে নাজেহাল সাধারণ মানুষ। দেশটা এখনও পর্যন্ত আইএমএফ থেকে চোদ্দোবার ধার নিয়েছে, একবারও শোধ করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী ইমরোজ বলেছেন, ঋণশোধ করতে তাঁর আরও ঋণের প্রয়োজন। আইএমএফ বলেছে তাদের সব শর্ত মেনে নিলে ওয়ারিস্তান দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ পাবে। প্রতিবেশী দেশ সিনচানও ঋণ দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত।’
আয়েশা থেমেছে। রঞ্জিত বললেন, ‘হয় আইএমএফ-এর কাছ থেকে ঋণ, না হয় সিনচান থেকে। ভারতের ক্ষেত্রে কোনটা বেশি বিপজ্জনক?’
‘দ্বিতীয়টা স্যর,’ বলল প্রথমা, ‘সিনচান যদি ওয়ারিস্তানকে কনট্রোল করে তা হলে আমাদের দ্বিগুণ বিপদ। দুটো শত্রু দেশ মিলে আমাদের লাইফ হেল করে দেবে।’
‘মজার কথা হল, ইমরোজ কারও কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার আগে এক সপ্তাহ সময় চেয়েছেন। ওয়ারিস্তানের এই তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে এক সপ্তাহ সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। গণবিদ্রোহ শুরু হলে সরকার পড়ে যেতে পারে। সেটা জেনেও রিস্কটা ইমরোজ নিচ্ছেন। তার কারণ এই লোকটা।’ ল্যাপটপের কি বোর্ডে ঠোক্কর মারলেন রঞ্জিত। তাঁর পিছনের দেওয়াল জুড়ে মাউন্ট করা মনিটরে ফুটে উঠল একটা মুখ।
‘কে এ?’ জিজ্ঞাসা করল আয়েশা।
‘পল ক্লিন্টন,’ বললেন রঞ্জিত, ‘পয়লা সেপ্টেম্বর পল এবং তাঁর স্ত্রী আলিয়া ক্লিন্টনকে ওয়ারিস্তানের এক্সট্রিমিস্ট গ্রুপ ‘‘হাইড্রা’’ কিডন্যাপ করেছে।’
‘হাইড্রা ব্যাপারটা কী?’ জিজ্ঞাসা করল প্রথমা।
‘ “রাই ধৈর্যং রহু ধৈর্যং…” হাসছেন রঞ্জিত, ‘আয়েশাকে আমি আর একটা কাজ দিয়েছিলাম। পল ও আলিয়া ক্লিন্টন নিয়ে খোঁজখবর নেওয়ার কাজ।’
আয়েশা বলল, ‘পাবলিক ডোমেনে যা আছে সেগুলো আগে বলি। পলের জন্ম ক্লিভল্যান্ডে, বিয়ে করেছেন কলেজের বান্ধবী আলিয়াকে, যিনি দ্বিতীয় প্রজন্মের আমেরিকান। আলিয়ার বাবা এবং মায়ের জন্ম ওয়ারিস্তানে হলেও ওঁরা পড়াশুনো করার জন্যে চলে আসেন আমেরিকায়। আর ফেরত যাননি। আমেরিকাতেই প্রেম ও বিয়ে। এখন ওঁরা বোস্টনে থাকেন। পলের বাবা-মা আমেরিকান, থাকেন ক্লিভল্যান্ডে। পল বা আলিয়ার সঙ্গে তাঁদের বাবা-মায়ের যোগাযোগ নেই। আলিয়া আর পল থাকেন নিউ ইয়র্কে। পল চাকরি করেন “সেলফার্ম” নামের বহুজাতিক ফার্মা কোম্পানির “রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট” বিভাগে।’
আয়েশা চুপ করতে রঞ্জিত বললেন, ‘পাবলিক ডোমেনের বাইরে কী পেলি?’
‘আমাদের “রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকাল উইং”-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। ওদের কাছে পলের নামে আলাদা একটা ফোল্ডার আছে। সেটা বলছে যে পল নাকি “মধুমেহ” বা “ডায়াবিটিস” রোগের নতুন ওষুধ আবিষ্কার করেছেন। সেটা নিয়ে পল বা সেলফার্ম—দুজনেরই মুখে কুলুপ। আমেরিকান সরকারও কিছু জানে না। তবে “র” মনে করছে, ওষুধটার গ্লোবালি খুব বড় ফিনান্সিয়াল ইমপ্যাক্ট আছে। পল এই মুহূর্তে আমাজনের জঙ্গলে রিসার্চের কাজে ব্যস্ত। সঙ্গে আলিয়াও আছেন।’
‘তুই যা বললি, সেটুকু আমিও পয়লা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জানতাম,’ টেবিলে তাল ঠুকছেন রঞ্জিত, ‘সিচুয়েশান বদলে গেল দোসরা সেপ্টেম্বর, যেদিন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন বাইডেন আমাদের প্রাইম মিনিস্টার বীরেন্দ্র মেহতাকে ফোন করে জানালেন যে পল ক্লিন্টন মুখে খাওয়ার ইনসুলিন আবিষ্কার করেছেন। এবং সেই আবিষ্কারের চেন রি-অ্যাকশানে বাকি ঘটনাগুলো ঘটেছে।’
আয়েশা আর প্রথমা চুপ।
রঞ্জিত বললেন, ‘আমি বুঝিয়ে বলছি। পৃথিবী জুড়ে ইনসুলিনের বাজার দু-হাজার একুশ সালে ছিল উনিশ বিলিয়ন ইউ এস ডলার। উনত্রিশ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়াবে তেইশ বিলিয়ন ডলারে। ইনসুলিন ওষুধটা নিতে হয় সূচ ফুটিয়ে। এবং এই রোগ সারে না। যাদের সারা জীবন ধরে রোজ ইনসুলিন ইনজেকশান নিতে হয়, তাদের কষ্ট এই ট্যাবলেট আবিষ্কারের ফলে কতটা কমবে, সেটা আন্দাজ করতে পারছিস? ইনসুলিনের পুরো বাজারটা ইনজেকশান থেকে ট্যাবলেটে চলে যাবে। এবং সেই বাজার থাকবে “সেলফার্ম” কোম্পানির হাতের মুঠোয়।’
‘এখনও বুঝতে পারলাম না।’ বলল প্রথমা।
‘এক্সট্রিমিস্ট গ্রুপ “হাইড্রা” চলে ওয়ারিস্তান সরকারের টাকায়। পলকে কিডন্যাপ করিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ইমরোজ। হাইড্রার মেম্বার ওমর নামের একটা লোক। সে পলের কাছ থেকে ওরাল ইনসুলিনের ফরমুলা কেড়ে নিয়েছে। এখন পল আর আলিয়ার মুক্তিপণ হিসেবে সেলফার্ম এবং মার্কিন সরকারের কাছ থেকে ওরাল ইনসুলিন তৈরির কারখানা ওয়ারিস্তানে খোলার জন্যে “নো অবজেকশান সার্টিফিকেট” বা “এনওসি” চাইছে।’
‘পল কি আমাজনের জঙ্গলে ল্যাবরেটরি খুলে বসেছিলেন?’ জিজ্ঞাসা করল আয়েশা।
‘হ্যাঁ। নতুন মলিকিউলটি পল খুঁজে পেয়েছেন একটি ব্যাং-এর শরীর থেকে। আমাজন নদীর ধারে একটা মেক শিফ্ট ল্যাবরেটরিতে সেই মলিকিউল কৃত্রিম ভাবে তৈরি করেছেন। সেটা জানতে পেরে পয়লা সেপ্টেম্বর পল ও আলিয়াকে কিডন্যাপ করে ওমর। এবং সেদিনই সেলফার্মের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজের দাবি জানায়। সেলফার্ম জানায় জন বাইডেনকে।’
‘পল আর আলিয়া এখন কোথায়?’ প্রশ্ন করল প্রথমা।
‘আমাজন নদীর ধারে, জাটুয়ারানা নামের একটা দুর্গম জায়গায় তিনটে ট্রেকার্স টেন্ট নিয়ে ওরা আছে। ওমরের ফোনের পর থেকেই জায়গাটা স্যাটেলাইট মারফত মনিটর করছে আমেরিকা। অনেকগুলো “ব্ল্যাক হর্নেট ড্রোন”-ও চক্কর মারছে ওদের মাথার ওপরে। নরওয়ের তৈরি এই পুঁচকে “আনম্যান্ড এয়ারিয়াল ভেহিক্ল”-গুলো পোকার সাইজের। ওরা বুঝতেও পারছে না ওদের মাথার ওপরে ড্রোন উড়ছে এবং দৃশ্য ও শব্দ রেকর্ড করে আমেরিকায় পাঠাচ্ছে। লাইভ স্ট্রিমিং-এ হাইড্রার দুজন লোক এবং পলকে দেখা গেলেও আলিয়াকে দেখা যাচ্ছে না। তিনটে টেন্টের মধ্যে একটায় বাইরে থেকে তালা দেওয়া। দিনে দুবার সেটা খুলে হাইড্রার একজন লোক ভিতরে খাবার দিয়ে আসে। একটু পরে খালি পাত্র নিয়ে বেরিয়ে আসে। অর্থাৎ আলিয়া ওখানেই আছে।’
‘আমাদের কী করতে হবে?’ বলল প্রথমা।
রঞ্জিত বললেন, ‘তুই প্রতিবার ছড়াটা বলিস। আজ আমি বলব।’
“হারাধনের দুইটি ছেলে
মারতে গেল ভেক,
একটি ম’ল সাপের বিষে
রইল বাকি এক।”
প্রথমা মৃদু হেসে বলল, ‘এর মানে হল, নিজের দেশের বিপদের সময় আমেরিকা আঙুলটি নাড়াবে না। ওরা ভারতকে দায়িত্ব দিয়েছে হাইড্রার দুই মেম্বারকে এলিমিনেট করে পল আর আলিয়াকে উদ্ধার করার জন্যে।’
‘রাইট! এর ফলে আমাদের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ভালো হবে এবং আমেরিকার সঙ্গে ওয়ারিস্তানের সম্পর্ক খারাপ হবে। হুইচ ইজ গুড ফর ইন্ডিয়া।’
‘বুঝলাম।’ উঠে দাঁড়াল প্রথমা।
এক টুকরো কাগজ প্রথমাকে দিয়ে রঞ্জিত বললেন, ‘ওখানকার এমব্যাসিতে আমাদের লোকের ফোন নম্বর লেখা আছে। বাকি ডকুমেন্ট তোরা বানিয়ে নে। প্ল্যান নিজেরা কর।’
ফোন নম্বর মুখস্ত করে কাগজটা রঞ্জিতকে ফেরত দিয়ে অফিস থেকে বেরোল প্রথমা আর আয়েশা।
তেসরা সেপ্টেম্বর
আমাজন অববাহিকা! দক্ষিণ আমেরিকার এই অংশটি আমাজন নদী এবং উপনদীর দু-ধারে অবস্থিত। চব্বিশ লক্ষ বর্গমাইল জুড়ে বিস্তৃত এলাকার মধ্যে ঢুকে গেছে একাধিক দেশ। আমাজন বেসিনের বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে আমাজন রেন ফরেস্ট। এখান দিয়েই বয়ে চলেছে আমাজন নদী। আন্দিজ পর্বতমালায় জন্মে চার হাজার মাইল প্রবাহিত হওয়ার পরে মিশেছে আটলান্টিক মহাসাগরে।
আমাজন বেসিনের জৈব বৈচিত্র তুলনাহীন। এর কারণ হল প্রবল বৃষ্টিপাত এবং বিস্তৃত চিরহরিৎ অরণ্য। সূর্যালোক মাটিতে কম পৌঁছোয় বলে মাটি অন্ধকার এবং স্যাঁতসেঁতে। একদিকে বাদাম, রাবার আর পামগাছের জঙ্গল, অন্যদিকে বহমান নদী। এখানে সহস্রাধিক রকমের স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, মাছ, উভচর প্রাণী আর সাপ আছে।
জাটুয়ারানা নামের জনমানবহীন জায়গাটি আমাজন নদীর ধার থেকে মাত্র দশ মিটার দূরে। গভীর জঙ্গলের মধ্যে সেখানে পাশাপাশি তিনটে সবুজ রঙের ট্রেকার্স টেন্ট রয়েছে। একটি টেন্টের বাইরে বসে রয়েছেন হারপেটোলজিস্ট পল ক্লিন্টন। বয়স বছর পঞ্চান্ন। পরনে লং স্লিভ টি-শার্ট, রেন জ্যাকেট, শর্টস আর ট্রেকিং শু। গা ভর্তি পোকা-তাড়ানো মলম জ্যাবজেবে করে লাগানো। তিনটি টেন্টের মধ্যে একটিতে রয়েছে হাই-এন্ড ল্যাবরেটরি। অন্য দুটি টেন্টে পল আর আলিয়া ভাগাভাগি করে থাকছিলেন। পয়লা সেপ্টেম্বর কোথা থেকে দুজন মুখোশ পরা অস্ত্রধারী এসে আলিয়ার হাত-পা বেঁধে একটা টেন্টে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা মেরে দিল। লোকদুটোর নাম ওমর আর মার্কোস।
এখন পল একটি টেন্টে থাকছেন। তাঁকে সব সময় নজরে রাখছে মার্কোস। ওমরের বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা হল পলের ল্যাবরেটরি।
আগেই বলা হয়েছে, পল একজন হারপেটোলজিস্ট। এটি প্রাণীবিদ্যার এমন একটি শাখা যা উভচর প্রাণী এবং সরীসৃপ নিয়ে গবেষণার সঙ্গে সম্পর্কিত। টিকটিকি, কচ্ছপ, কুমির, ব্যাং—সবই হারপেটোলজির মধ্যে পড়ে।
জুওলজি নিয়ে পড়াশুনোর ফাঁকে কী ভাবে হারপেটোলজিস্ট হয়ে গিয়েছিলেন পল, আজ আর মনে পড়ে না। কলেজে অধ্যাপনা করতে করতে কী ভাবে ‘সেলফার্ম’-এর গবেষক হয়ে গেলেন, মনে পড়ে না তাও। ধীরে ধীরে তাঁর কাজ হয়ে গেল এমন নতুন মলিকিউল খুঁজে বার করা, যার থেকে ওষুধ তৈরি করা যেতে পারে।
আজকের সবজান্তা পৃথিবীতে নতুন মলিকিউল খুঁজে পাওয়ার জন্যে এমন জায়গায় যেতে হবে যেখানে আগে গবেষকদের পা পড়েনি। আমাজন বৃষ্টি-বনানী তার জন্যে আদর্শ জায়গা। এখানে তাই উন্নত দেশের গবেষক ও চোরেদের আনাগোনা লেগে থাকে। কখনও গবেষক নিজেই চোর হয়ে যান পলের মতো।
এখানে জেনে রাখা ভালো যে মাদক, হিরে এবং অস্ত্রের পরে চোরাচালান-শিল্পের চতুর্থ বৃহত্তম পণ্য হল জীবন্ত প্রাণী। এবং আমাজন বেসিন হল জীবজন্তু চোরাকারবারীদের স্বর্গরাজ্য।
পল গবেষণা করছিলেন ‘সিউডিস প্যারাডক্সা’ বা ‘প্যারাডক্সিক্যাল ফ্রগ’ নিয়ে। নামের এই আপাত বৈপরীত্যের কারণ হল, ব্যাঙাচিটি এগারো ইঞ্চি লম্বা হলেও পূর্ণবয়ষ্ক ব্যাং দেড় থেকে তিন ইঞ্চি লম্বা হয়। অর্থাৎ ছোট অবস্থায় বড় থাকে এবং বড় অবস্থায় ছোট!
সিউডিস প্যারাডক্সার চামড়া থেকে নিঃসৃত কেমিকাল ‘সিউডিলিন’ মানুষের শরীরে ইনসুলিনের ক্ষরণ বাড়ায়। সেটি আবিষ্কার করেছেন পল। শুধু তাই নয়, সিউডিলিনকে ওরাল মেডিসিন হিসেবে ল্যাবরেটরিতে বানিয়ে ফেলেছেন। আলিয়া মধুমেহর রোগী। ওষুধটি খেয়ে তাঁর রক্তে চিনির পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। পলের প্ল্যান ছিল আমেরিকা ফিরে সিউডিলিন নিয়ে অ্যাকাডেমিক পেপার করবেন, ‘পিয়ার রিভিউ জার্নাল’-এ সেই পেপার প্রকাশিত হবে। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী সমাজ তাঁর দাবি মেনে নিলে সেলফার্ম পেটেন্ট দাবি করবে সিউডিলিনের ওপরে। পল বিজ্ঞানী মহলে সম্মান পাবেন। ওরাল ইনসুলিনের মুনাফা ঘরে তুলবে সেলফার্ম।
‘সন্ধে হয়ে গেল। ঘরে চলুন সেনর।’ পিছন থেকে নরম গলায় বলল ওমর। সবুজ আলখাল্লা পরা, মাস্কে মুখ ঢাকা মানুষটির কথা শুনে উঠে দাঁড়ালেন পল। মার্কোস আশাপাশেই আছে। লোকটা কখনও কথা বলে না।
পলও কথা কম বলেন। তিনি নিশ্চিত যে স্যাটেলাইট স্ক্যানার আর ড্রোন মারফত নজরদারি চালাচ্ছে আমেরিকা। এখানে বেফাঁস কিছু বলা মানে মৃত্যু ডেকে আনা।
‘জন বাইডেনকে ঠিক সাত দিন সময় দিয়েছিলাম,’ বলল ওমর, ‘উনি আমাদের কথা না শুনলে কী হবে আপনি জানেন।’
‘আপনারা আলিয়াকে হত্যা করবেন, তাই তো?’ ভয়ে কাঁপছেন পল।
‘সেই সঙ্গে আপনাকেও, সেনর।’ মৃদু হাসলেন ওমর।
শিউরে উঠে পল তালাবন্ধ টেন্টের দিকে তাকালেন। ওখানেই বন্দি রয়েছেন আলিয়া।
ওমর বলল, ‘আপনাদের কপাল ভালো যে বাইডেন আমার প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন। উনি মহিলা ডিপ্লোম্যাট হ্যালি স্মিথকে পাঠাচ্ছেন মধ্যস্থতা করার জন্যে। হ্যালি একজন পেশাদার নেগোশিয়েটার। উনি আমাদের দাবিদাওয়া নিয়ে কথা বলবেন এবং আমাদের সেফলি ওয়ারিস্তান উড়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন। যদি সব ঠিকমতো চলে তা হলে আপনারা দুজন হ্যালির সঙ্গেই আমেরিকা চলে যাবেন।’
হঠাৎ পল প্রশ্ন করলেন, ‘আমি যে এখানে কাজ করছি সেটা আপনারা জানলেন কী করে?’
প্রশ্নটা শুনেই মার্কোস তার অ্যাসল্ট রাইফেল পলের রগে ঠেকাল।
মার্কোসের হাত এক ঝটকায় সরিয়ে ওমর বলল, ‘আপনার কী মনে হয়? কে আমাকে খবর দিয়েছিল?’
পল বললেন, ‘আমি, আলিয়া আর আমাদের লোকাল গাইড বেলা আলভারেজ গত পাঁচমাস ধরে এখানে ঘাঁটি গেড়েছি। আপনারা এলেন পয়লা সেপ্টেম্বর। আপনি আসার ঠিক একদিন আগে থেকে বেলার কোনও খবর নেই। অনুমান করতে অসুবিধে হয় না, আপনারা কার কাছ থেকে আমাদের খবর জেনেছেন।’
সশব্দে হেসে ওমর বললেন, ‘একদম ঠিক ভেবেছেন সেনর।’
‘আমার বলা এখনও শেষ হয়নি,’ ওমরকে থামিয়ে পল বললেন, ‘বেলা এখানকার গ্রামের মেয়ে। এলাকার বাইরে কী আছে জানেই না। পর্তুগিজ ছাড়া অন্য কোনও ভাষা জানে না। ওর পক্ষে ওয়ারিস্তানের টেররিস্ট গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়।’
মার্কোস আবার অ্যাসল্ট রাইফেলের নল পলের রগে ঠেকাল। ওমর ভুরু কুঁচকে পলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
পল বললেন, ‘আলিয়ার জন্ম আমেরিকায় হলেও ওর বাবা-মায়ের জন্ম ওয়ারিস্তানে। দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে শিকড়ের টান বেশি দেখা যায়, কারণ তারা বাবা-মায়ের মুখে দেশ সম্পর্কে শুধু ভালো কথাই শুনেছে। খারাপ জিনিসগুলো সম্পর্কে জানে না। এরা খুবই দেশপ্রেমী হয়…’
কথা ঘোরাতে ওমর বলল, ‘হ্যালি পরশু দিন ব্রাজিল এয়ারপোর্টে পা রাখছেন। এয়ারপোর্ট থেকেই আমাদের লোক পেড্রো ওঁর সঙ্গে থাকবে। লোকাল যে গাইডকেই ভাড়া করুন না কেন, সে আমাদের লোক হবে। উনি কোনও উল্টোপাল্টা প্ল্যান করলে আপনাকে আর সেনোরাকে গুলি করে উড়িয়ে দেব।’
পাঁচই সেপ্টেম্বর
ব্রাজিলের রাজধানী সাও পাওলোর বিমানবন্দরে ভারত থেকে আসা টার্কিশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট পৌঁছোল রাত পৌনে ন’টায়। উড়ান-সময় তেইশ ঘণ্টা। জিন্স, টপ আর স্নিকার পরা নুরি ডিকস্টা ফ্লাইটে দেওয়া একটি খাবার বিনি পয়সায় পেয়েছিল। সেটা খেয়ে গোটা উড়ান ঠেসে ঘুমিয়েছে।
পাসপোর্ট অনুযায়ী নুরি আমেরিকার নাগরিক। অন্য ডকুমেন্ট অনুযায়ী সে সাও পাওলো ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশান করে দীর্ঘদিন আমাজন বৃষ্টি-বনানীতে বিদেশি টুরিস্টদের জন্যে গাইডের কাজ করেছে। হাতে ডলার জমতেই সোজা চলে গিয়েছিল ভারতবর্ষের দিল্লি শহরে, অ্যানথ্রোপলজি নিয়ে পড়তে। হঠাৎ মার্কিন সরকারের জরুরি আমন্ত্রণে ব্রাজিলে ফিরেছে।
এয়ারপোর্টে নেমে প্রথম কাজ মুদ্রা বদল করা। সঙ্গে যা ভারতীয় টাকা আছে, তাকে ব্রাজিলিয়ান রিয়্যাল আর আমেরিকান ডলারে বদলে বিমানবন্দর থেকে বেরোল নুরি। দ্বিতীয় কাজ হল স্থানীয় মোবাইলের দোকানে ঢুকে দুটো প্রিপেড ফোন কেনা। এগুলোকে ‘বার্নার ফোন’ বলে। ফোন কেনার জন্যে পরিচয়পত্র দেখাতে হয় না। সিম কার্ডে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থের ‘টক টাইম’ ভরা থাকে। পয়সা খতম হলেই ফোনের আয়ু শেষ। ভারতে এইরকম ফোন এখনও চালু হয়নি।
হাঁটতে হাঁটতে কাছাকাছির মধ্যে একটি বাজেট হোটেলে ঢুকল নুরি। রুম আগে থেকে বুক করা ছিল। রিসেপশানিস্ট মেয়েটিকে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দেখিয়ে রুমে ঢুকে স্নান-খাওয়া সেরে ঘুম দিল। আমেরিকার ডিপ্লোম্যাট হ্যালির সঙ্গে আগামিকাল দেখা হবে।
ছয়ই সেপ্টেম্বর
ভোর পাঁচটার সময় হোটেল থেকে চেক আউট করে আবার এয়ারপোর্টে গেল নুরি। মানাউস যাওয়ার টিকিট কাটল। সাও পাওলো থেকে মানাউসের দূরত্ব তিন হাজার কিলোমিটারের মতো। উড়ান-সময় চার ঘণ্টা।
মানাউস হল আমাজন বৃষ্টি-বনানীতে ঢোকার প্রবেশ দ্বার। নিগ্রো আর সলিমোস নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত শহরটিতে সারা বছরই পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। প্লেন থেকে নেমে নুরি দেখল, দিনের বেলাও বেশ অন্ধকার, কারণ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন।
কার পার্কিং এরিয়ায় অজস্র বাস আর চারচাকা দাঁড়িয়ে। নম্বরপ্লেট মিলিয়ে নিয়ে একটি এসইউভিতে উঠল নুরি। গাড়িতে এক আমেরিকান মহিলা আগে থেকেই বসে আছে। পরনে ফুল-ফুল শার্ট আর সবুজ কারগো। মাথায় স্ট্র হ্যাট, পায়ে হান্টিং শু। আমেরিকা থেকে আগত যাত্রীর নাম হ্যালি স্মিথ।
হ্যালি আর নুরির সঙ্গে কুশল বিনিময় করে চালক পেড্রো গাড়িতে স্টার্ট দিল। বার্জে চেপে গাড়িসহ নিগ্রো নদী পেরোল ওরা। যাত্রাপথের ভূগোল বদলাতে লাগল দ্রুত। বড়, মাঝারি আর ছোট গ্রাম পেরোনোর পরে শুরু হল জনশূন্য জঙ্গল। বিকেল পাঁচটার সময় গাড়ি দাঁড়াল আমাজন নদীর ধারে। আঁধার সবে নামছে। শুরু হয়েছে বৃষ্টি।
গাড়ি থেকে নেমে এক দৌড়ে ওরা উঠল সরু আর লম্বাটে নৌকোয়। রোগা এবং শ্যামলা চেহারার একটি মেয়ে নৌকোটির মালকিন। নৌকো চালাচ্ছে একটি বাচ্চা মেয়ে। রোগা মেয়েটি ইংরিজিতে বলল, ‘আমার নাম মারিয়ানা। নৌকো ভাড়া দিই, গাইডের কাজও করি। পেড্রো বলল আপনাদের গাইড লাগবে।’
পেড্রো ডাঙা থেকে বলল, ‘হ্যাঁ! ওঁদের গাইড লাগবে।’
নুরি পর্তুগিজে বলল, ‘আমি নিজেই গাইড।’
পেড্রো কী বুঝল কে জানে! সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে মোবাইলে কারও সঙ্গে কথা বলতে লাগল। কোথাও কোথাও দুর্বল হলেও এখানে মোবাইলের সিগনাল দিব্যি আছে।
নৌকো চালাচ্ছে বাচ্চা মেয়েটা, মারিয়ানা ইংরিজিতে বকবক করছে। ‘এই মেয়েটার নাম আমান্ডা। আমার গ্রামের মেয়ে। ওর মা মারা যাওয়ার পরে কাজে জুতে দিয়েছি।’
কিছুক্ষণ নৌকো চলার পরে এসে গেল ডাঙা। এবং অতিথিশালা। হ্যালি আর নুরিকে ফলের রস খাইয়ে স্বাগত জানাল অতিথিশালার কর্মীরা। আলাদা রুমে জায়গা হল ওদের। নুরি আর হ্যালি কিছুক্ষণের মধ্যেই রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং এরিয়ায় বসে গল্প শুরু করল। হ্যালির মতো নুরিও এসেছে মার্কিন সরকারের নির্দেশে। নুরিকে ডেকে পাঠানোর কারণ, সে ব্রাজিলের নাগরিক না হওয়া সত্ত্বেও আমাজন অঞ্চলে গাইডের কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে।
হ্যালি নিচু গলায় বলল, ‘এই প্রজেক্টে স্থানীয় লোকের ওপরে ভরসা করা যাবে না।’
‘পেড্রো স্থানীয়,’ বলল নুরি, ‘গেস্ট হাউসের কর্মীরা স্থানীয়। নৌকাচালক মারিয়ানা আর আমান্ডাও স্থানীয়।’
‘মেনে নিলাম। কিন্তু যতটা পারা যায় সুরক্ষিত থাকার চেষ্টা করছি। তুমি জানো কি না জানি না, আমাকে সব সময় মনিটর করা হচ্ছে। ওই জন্যেই ব্রাজিল থেকে প্লেনে মানাউস আসার সময় তোমার সঙ্গে কথা বলিনি। এস ইউ ভি-তেও কথা বলিনি। এখানে বলছি, কারণ আমরা দুজন একসঙ্গে এখানে আছি। কাল একসঙ্গে ঘুরতে বেরোব। দুজন টুরিস্ট আলাদা ভাবে এখানে এসে বন্ধু হয়ে গেছে। দুজনেই মেয়ে বলে এই বন্ডিং স্বাভাবিক।’
‘এর মধ্যে বিপজ্জনক কোনও ব্যাপার নেই তো?’
হ্যালি মৃদু হেসে বলল, ‘আমাজন খুবই বিপজ্জনক জায়গা। সেটা আমার থেকে তুমি ভালো জানো।’
নুরি বলল, ‘আমি এই এলাকায় দীর্ঘদিন গাইডের কাজ করেছি। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কয়েকটা কথা বলি। বেআইনি খাদানের ভাড়া করা গুন্ডা, ড্রাগচক্রের কর্মী, শত্রুভাবাপন্ন গ্রামবাসী—যে কেউ আমাদের খুন করতে পারে। খুন হয়ে গেলে আমাদের বডি কোনও দিনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাজন এত ভয়ানক যে কোনও টুরিস্ট একা জঙ্গলে ঢুকলে দশ থেকে বারো ঘণ্টার মধ্যে জলে ডুবে, রাস্তা হারিয়ে বা সাপের কামড়ে মরে যাবে। এসবের হাত থেকে যদি বেঁচেও যায়, তা হলে খাবার বা পানীয় জল না পেয়ে মরে যাবে। কী ভাবে পরিষ্কার পানীয় জল খুঁজে বার করতে হয়, কী ভাবে নিরাপদ জায়গায় টেন্ট খাটাতে হয়, কী ভাবে খাবার খুঁজে পেতে হয়, সাপের কামড় এড়াতে কী ভাবে হাঁটতে হয়, বিষাক্ত পোকামাকড় থেকে কী ভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হয়, সাপের কামড় খেলে কী করতে হয়—এসব জানার জন্যে গাইড জরুরি। যাই হোক! আমার কাজটা কী?’
ভুরু কুঁচকে হ্যালি বলল, ‘আমার কাছে হাতে আঁকা একটা ম্যাপ আছে। সেখান পর্যন্ত তুমি আমাকে নিয়ে চলো। বাকিটা আমার দায়িত্ব।’
ওদের সব কথা ওমর শুনতে পাচ্ছে। কারণ পুরো অতিথিশালাটিতে আড়িপাতার যন্ত্র লাগানো আছে। নুরি আর হ্যালি যখন শুতে গেল তখন চারদিক কুপকুপে অন্ধকার। তার মধ্যেই শনশন বাতাস বইছে, ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে, দূর থেকে ভেসে আসছে জন্তু-জানোয়ার আর পাখির ডাক…
কাল কী হবে কে জানে!
সাতই সেপ্টেম্বর
ভোর সাড়ে চারটের সময় ব্রেকফাস্ট সেরে নুরি আর হ্যালি বেরিয়ে পড়েছে মারিয়ানা আর আমান্ডার সঙ্গে। মারিয়ানার পায়ে হান্টিং শু, হাতে সাপ ধরার লাঠি। সঙ্গে রয়েছে নাইলনের তৈরি বেশ বড় একটা ব্যাগ, যেটা নৌকোর গলুইতে রাখা রয়েছে। নুরির মতো ভিনদেশি গাইড দেখে সে বিরক্ত। হাবেভাবে সেটা বুঝিয়েও দিচ্ছে।
নুরির ভ্রুক্ষেপ নেই। নৌকোয় উঠে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমরা প্রথমে কোথায় যাব?’
মারিয়ানা কর্কশ গলায় বলল, ‘কোথায় যাবেন, সেটা তো আপনি বলবেন।’
নুরি বলল, ‘প্রথমে ব্ল্যাক রিভারের আদিবাসী গ্রামে চলো।’
নুরির কথা শুনে আমান্ডা নৌকো চালাতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পরে সূর্য উঠল। আমাজন নদীতে সূর্যোদয় মানে রঙের বিস্ফোরণ! ফুলের পাপড়ি যেভাবে পরতে পরতে খোলে, ঠিক সেই ভাবে খুলে যাচ্ছে এক একটি রঙের পর্দা। কালো থেকে ধূসর থেকে বিবর্ণ হলুদ থেকে হলুদ থেকে কমলা! সব শেষে লালের বিস্ফোরণ! সবাই হতবাক হয়ে বসে রইল।
সূর্য পুরোপুরি উঠে যাওয়ার পরে আবার নৌকো বওয়া শুরু হয়েছে। কিছুক্ষণ পরে নুরি বলল, ‘আমরা এসে গেছি। এসো হ্যালি।’
হ্যালির ঘোরার ইচ্ছে নেই। কিন্তু ওমরের সঙ্গে দেখা করার সময় সকাল এগারোটা। তাই ঘোরাঘুরি করতে হচ্ছে। মারিয়ানার কাছে এই ট্রিপটাকে ‘টুরিস্টি’ দেখানোর দায়ও আছে।
আদিবাসী গ্রামটির জনসংখ্যা বড়জোর পঞ্চাশ। ঝকঝকে গ্রাম। বাচ্চারা পড়াশুনো করছে। ওরাই শিখিয়ে দিল কী করে মাছ ধরতে হয়। ঘন জঙ্গলের মধ্যে মাছ ধরার নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে ছিপ ফেলল হ্যালি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে দুটো মাছও ধরল। ওদের আবার জলে ছেড়ে দেওয়া হল।
দশটা পর্যন্ত সময় কাটিয়ে হ্যালি ব্যাগ থেকে ম্যাপ বার করে নুরিকে দিয়ে বলল, ‘এইখানে যাব।’
নুরি ম্যাপে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘জাটুয়ারানা যেতে আধঘণ্টা লাগবে।’ তারপর পর্তুগিজ ভাষায় মারিয়ানাকে নির্দেশ দিল। সে নির্দেশ দিল আমান্ডাকে। ভাবলেশহীন মুখে আমান্ডা নৌকো বাইছে।
কালচে সবুজ জলের দু-দিকে সারি সারি মোটা গাছের গুঁড়ি জলের ওপরে শুয়ে আছে। মাঝেমধ্যে চর দেখা যাচ্ছে। নুরি বলল, ‘এই নদীতে কুমির, ইলেকট্রিক ইল আর পিরানহা আছে। জলে পড়লে আর বডি খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
কিছুক্ষণ পরে জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গায় নৌকো দাঁড়াল। সবার আগে নৌকো থেকে নামল নুরি। সে হাত বাড়াল হ্যালির দিকে। হ্যালি নড়বড় করে নামল। নুরি বলল, ‘মারিয়ানা, তুমি আর আমান্ডা নৌকোয় বোসো। আমরা আসছি।’
মারিয়ানা বলল, ‘মাটিতে ট্যারান্টুলা আর আকাশে ভ্যাম্পায়ার ব্যাট। সাবধানে যাবে।’
মারিয়ানার ভয় দেখানো কথায় পাত্তা না দিয়ে নুরি আর হ্যালি হাঁটছে। গাছের মোটা মোটা শিকড় ডিঙিয়ে, ঝরা পাতা মাড়িয়ে, হেলে থাকা গাছের ডাল পেরোনোর সময় মাথা নিচু করে, কাঁটা ঝোপ সামলে হাঁটছে। কিছুদূর যাওয়ার পরে ওরা যেখানে পৌঁছোল এমন একটা জায়গায়, যেখানে জলের রং, জঙ্গলের রং, সূর্যের আলো—সবকিছু সবুজ। সবুজ রঙের প্রজাপতি উড়ছে, গাছের পাতায় বসে থাকা ব্যাং-এর রং সবুজ। উড়ছে সবুজ পোকামাকড়। আর, তারই মধ্যে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সবুজ আলখাল্লা পরা একজন মানুষ। মুখে সবুজ মাস্ক, হাতে জংলা-সবুজ রঙের অ্যাসল্ট রাইফেল।
লোকটা ইশারায় ওদের ডাকল।
ওর পিছন পিছন কিছুটা হাঁটার পরে দেখা গেল সামনে তিনটে ট্রেকার্স টেন্ট। দুটি টেন্ট বাইরে থেকে বন্ধ। তৃতীয়টির বাইরে চেয়ারে বসে রয়েছেন পল। হাত-পা সরু সুতো দিয়ে বাঁধা। তাঁর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে লোকটা, তার মুখ ও শরীর মাস্ক ও সবুজ আলখাল্লায় ঢাকা। হাতে অ্যাসল্ট রাইফেল।
হ্যালির দিকে তাকিয়ে প্রথম লোকটি কঠিন গলায় বলল, ‘আমি ওমর, হাইড্রার প্রতিনিধি। আপনি হ্যালি স্মিথ। আর ও হল নুরি ডিকস্টা, আপনার ইন্ডিয়ান গাইড। আলাপ পরিচয় শেষ। এবার কাজের কথা। প্রথমে বলুন নুরি ডিকস্টাকে এর মধ্যে ঢোকালেন কেন? ও ভারতীয়।’
‘নুরি জন্মসূত্রে আমেরিকান। কাজের সূত্রে ইন্ডিয়া গিয়েছিল। আপনি যেমন কাজের সূত্রে ওয়ারিস্তান থেকে ব্রাজিলে এসেছেন। বিশ্বায়িত পৃথিবীতে সীমানাটা কোনও ইস্যু না।’
‘আপনি ভালো কথা বলেন।’ সুর নরম হয়েছে ওমরের।
‘নেগোশিয়েট করা আমার কাজ। আমি কথা বেচে খাই।’
এবার ওমর হেসে ফেলেছে। ‘তবে ইন্ডিয়ানরা খুব নাক গলানো টাইপের হয়।’
ওমর আর হ্যালির কথোপকথনের মধ্যে নুরি একটি তালাবন্ধ ট্রেকার্স টেন্টের সামনের গিয়ে মাটিতে বসেছে। তাকিয়ে রয়েছে মার্কোসের দিকে। সে অন্য একটি তালাবন্ধ টেন্টের বাইরে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে।
মার্কোসের দিকে আঙুল দেখিয়ে ওমর বলল, ‘আলিয়া ওই টেন্টের মধ্যে আছেন।’ তারপরে হ্যালির দিকে ঘুরে বলল, ‘ওরাল ইনসুলিনের ফরমুলা আমরা পলের কাছ থেকে পেয়ে গেছি। আপনি কি সেলফার্ম আর আমেরিকান সরকারের ‘নো অবজেকশান সার্টিফিকেট’ এনেছেন? এনে থাকলে আমাকে দিন। আলিয়া আর পলকে ছেড়ে দিচ্ছি। আপনি ওদের নিয়ে যেতে পারবেন।’
‘এনেছি,’ ব্যাকপ্যাকের মধ্যে হাত গলিয়ে একটা ওয়াটারপ্রুফ ও ফায়ারপ্রুফ ফাইল বার করেছে হ্যালি। ‘কিন্তু এটা আপনাদের লাগবে কেন? যারা বন্দুকের জোরে সব কাজ করে তাদের কোনও রকম অনুমতি লাগে নাকি?’
‘ফরমুলা চুরি হল ব্রুট ফোর্স। গায়ের জোর খাটানো! মাত্র আধঘণ্টার কাজ! আসল কাজ হল ওয়ারিস্তানে কারখানা তৈরি করে ওরাল ইনসুলিন ম্যানুফ্যাকচার করা। তখন আলিয়া বা পল আমাদের সঙ্গে থাকবেন না। সেলফার্ম মামলা করতে পারে ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস অ্যাক্টে। সেই মামলা মোতাবেক কারখানা তৈরিতে ইনজাংশান জারি করতে পারে আমেরিকান সরকার। সেই নুইসেন্স যাতে না হয়, সেই জন্যেই “এনওসি।” ফাইলটা দিন।’
ফাইল হাতবদলের মুহূর্তে হঠাৎ নুরি চিৎকার করে বলল, ‘ওরে বাবা রে!’
‘কী হল?’ ওমরের অ্যাসল্ট রাইফেলের নল ঘুরে গেছে নুরির দিকে। ওমর অবাক হয়ে দেখল, নুরি নিজের জায়গাতেই বসে মার্কোসের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। লারণ মার্কোস ধীরে ধীরে বসে পড়ছে। আর, মার্কোসের গোড়ালিতে কামড় বসিয়েছে লালচে-বাদামি রঙের একটা সাপ। লম্বায় অন্তত চার ফুট।
‘পিট ভাইপার!’ চিৎকার করে উঠল ওমর, ‘আমাজনের বিষাক্ততম সাপের মধ্যে একটা।’
মার্কোস মাটিতে শুয়ে পড়েছে। তার হাত আর পায়ের পাতা নীল হয়ে যাচ্ছে, গ্যাঁজলা উঠে মাস্ক ভিজে যাচ্ছে, হাত থেকে খসে পড়ল অ্যাসল্ট রাইফেল। সাপটা সরসরিয়ে ঘাসের মধ্যে হারিয়ে গেল।
পল এতক্ষণে মুখ খুললেন। চিৎকার করে বললেন, ‘হাসপাতালে ভর্তি না করলে ও মরে যাবে।’
ওমর দ্রুত পলের বাঁধন খুলে দিল। দুজনে দৌড়ে গেল মার্কোসের কাছে। মার্কোসকে কোলে নিয়ে পল দৌড়োলেন নদীর দিকে। চিৎকার করে ওমর বললেন, ‘ওখানেই স্পিডবোট আছে।’
‘দাঁড়ান!’ পিছন থেকে নুরির গলা শোনা গেল, ‘হাইড্রার একজন পেটি টেররিস্টের জন্যে ডিলটা পাকা না করেই চলে যাবেন?’
‘আপনি জানেন উনি কে?’ হুঙ্কার দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ওমর। এবং চমকে উঠল। নুরির হাতে ছোট্ট ও কম্প্যাক্ট, অস্ট্রিয়ার তৈরি সেমি-অটোম্যাটিক পিস্তল, গ্লক ছাব্বিশ। দুজনকে মারার জন্যে দুটো নাইন মিলিমিটার কার্তুজই যথেষ্ট।
‘জানি,’ ওমরের কপালে গ্লক তাক করল নুরি, ‘তালাবন্ধ দুটো ট্রেকার্স টেন্টের কোনওটার মধ্যেই এখন কেউ ছিল না। থাকার কথাও নয়। কারণ আলিয়া তো কিডন্যাপ হননি। তিনি মার্কোস সেজে আপনার সাকরেদ হয়ে ঘোরাঘুরি করছেন। রাতে শুচ্ছেন পলের সঙ্গে। মেয়েলি কণ্ঠস্বর যাতে বোঝা না যায়, সেই জন্যে একটাও কথা বলছেন না। আর আপনি হলেন ওয়ারিস্তান ইনটেলিজেন্স সার্ভিসের এজেন্ট, যিনি হাইড্রার সদস্য সেজে ওয়ারিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরোজের পরামর্শ মতো কাজ করছেন।’
‘আলিয়া মারা যাচ্ছে।’ পল থরথর করে কাঁপছেন।
তাঁর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে নুরি বলল, ‘পল, আপনার মূল পরিকল্পনাটা বলে ফেলুন। তা হলেই আমরা আলিয়াকে স্পিড বোটে উঠতে দেব। পাশের গ্রামেই হাসপাতাল। সেখানে সাপের বিষের প্রতিষেধক আছে।’
‘আমরা দুজনেই আমেরিকা ছেড়ে ওয়ারিস্তানে শিফ্ট করতে চাইছিলাম। আলিয়ার ক্ষেত্রে কারণ হল দেশের প্রতি ভালোবাসা। আমার ক্ষেত্রে অর্থের প্রতি ভালোবাসা। সেলফার্মের মাস-মাইনের গবেষক হিসেবে ওরাল ইনসুলিন আবিষ্কারের জন্যে আমি এক ডলার অতিরিক্ত পাবো না। কিন্তু ওয়ারিস্তানে চলে যেতে পারলে ফার্মা কোম্পানি খুলে ওষুধ ম্যানুফ্যাকচার ও বিক্রি করব। প্রধানমন্ত্রী ইমরোজ ওপেন অফার দিয়ে রেখেছেন সফল ভাবে আমেরিকা থেকে ওয়ারিস্তানে শিফ্ট করার জন্য। শর্ত একটাই। ওই দুটো “এনওসি” নিয়ে যেতে হবে।’
‘আপনারা খুবই খারাপ লোক। তবে আমেরিকা আপনাদের থেকে অনেক বেশি খারাপ।’ হাসল নুরি, ‘ওরা আপনাদের পুরো প্ল্যানটাই জানে। ওরা আলিয়াকে খুন করতে আর পলকে অ্যারেস্ট করতে চায়। তবে ওরা খুনের রক্ত নিজের হাতে লাগাতে চায় না। তাই আমার মতো ভারতীয় খুনি ভাড়া করেছে।’
পল আর ওমর অবাক হয়ে নুরির দিকে তাকিয়ে।
নুরি বলল, ‘ভারত সরকার আবার আমেরিকার থেকেও বেশি বদ! আমরা এমন ভাবে আলিয়াকে মারলাম যে খুন বলে মনেই হবে না। আমাজনের জঙ্গলে পিট ভাইপারের কামড়ে মৃত্যু কি খুন হতে পারে? অসম্ভব!’
ওমর বলল, ‘মেনে নিলাম যে আপনি আমাজনে গাইডের কাজ করেছেন। তা বলে এত বড় রিস্ক? সাপটা সিনোরার গায়ে ছাড়লেন কী করে?’
মৃদু হেসে নুরি বলল, ‘কাজটা আমি করিনি।’
ওমর চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘যেই করে থাকুক। মরতে হবে আপনাকেই।’ তারপরে নুরির দিকে অ্যাসল্ট রাইফেল তাক করে ট্রিগারে আঙুল রাখল।
চাপা আওয়াজ হল ‘ব্লপ’ করে। পল দেখলেন ওমর সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে গেল। তার পিঠ দিয়ে ভলকে ভলকে রক্ত বেরোচ্ছে।
নদীর দিক থেকে কে গুলি করল? পিছনে ফিরে পল দেখলেন, নৌকাচালক মারিয়ানার হাতেও একটি গ্লক। সে নির্বিকার মুখে নুরির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আলিয়ার লাশটা জলে ফেলে দে! পিরানহাগুলো বাকি কাজ করে দেবে।’
‘আলিয়া মরেনি।’ হাউহাউ করে কাঁদছেন পল, ‘এখনও শ্বাস আছে।’
‘সেই শ্বাসটাও এবার বন্ধ করে দেব,’ বলল মারিয়ানা, ‘আমিই পিছন থেকে ওর গায়ে পিট ভাইপারটা ছুঁড়েছিলাম। নৌকোয় একটা “স্নেক ট্রান্সপোর্ট ব্যাগ”-এ ভরে সাপটা সেই মানাউস থেকে নিয়ে এসেছি।’
পল কাঁদছেন আর বলছেন, ‘আলিয়াকে আপনারা খুন করলেন।’
কান্না না শুনে নৌকো থেকে মারিয়ানা বলল, ‘হ্যালি, তিনটে টেন্ট থেকে যাবতীয় কাগজপত্র, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, পেনড্রাইভ বা অন্য ডেটা স্টোরেজ ডিভাইস খুঁজে বার করো। দরকার হলে পলকে নিয়ে যাও। ওর কাছে কোনও অস্ত্র নেই। ওমরকে আমি বুঝে নিচ্ছি।’
সন্তর্পণে আলিয়ার মৃতদেহ নদীর জলে শুইয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন পল। তারপর লম্বা লম্বা পায়ে টেন্টের দিকে যেতে লাগলেন। সঙ্গে হ্যালি আর নুরি। যেতে যেতেই পল শুনলেন ‘ব্লপ’ করে আর একটা আওয়াজ হল। পিছনে না ফিরেই তিনি বুঝতে পারলেন, ওমর আর নেই।
নয়ই সেপ্টেম্বর
‘তোরা এত কুইক কাজটা কী করে করলি বল তো?’ নিজের অফিসে বসে প্রথমা আর আয়েশাকে জিজ্ঞাসা করলেন রঞ্জিত।
প্রথমার জ্বর এসেছে। সে কফির সঙ্গে জ্বরের বড়ি খেয়ে কোঁ-কোঁ করে বলল, ‘ওখানে কী মশা! আমার বোধহয় ম্যালেরিয়া হয়েছে।’
তাকে থামিয়ে আয়েশা বলল, ‘এত তাড়াতাড়ি কী করে করলাম, সেটা বুঝতে গেলে আপনাকে গোটা কেসের টাইমলাইন বুঝতে হবে। দোসরা সেপ্টেম্বর জন বাইডেন ফোন করেন আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি আমেরিকার প্রস্তাবে রাজি হন। তেসরা সেপ্টেম্বর জনের সঙ্গে ওমরের কথা হয়। জন জানিয়ে দেন যে তিনি ওমরের প্রস্তাবে রাজি। যদিও তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল “এনওসি” পৌঁছে দেওয়ার অজুহাতে জাটুয়ারানা পৌঁছে আলিয়াকে খুন করা ও পলকে অ্যারেস্ট করা।’
আয়েশাকে থামিয়ে প্রথমা বলল, ‘৪ সেপ্টেম্বর আপনি আমাদের ব্রিফ করলেন। সে দিনই আমি মারিয়ানার যাবতীয় ডকুমেন্ট তৈরি করে সাও পাওলো চলে যাই। সেখান থেকে মানাউস পৌঁছোই। প্রচুর রিয়্যাল খরচা করে সাপ জোগাড় করা, নৌকো চালক আমান্ডাকে বশে আনা, ওর কাছ থেকে কয়েক লাইন পর্তুগিজ শেখা, সাপ হ্যান্ডলিং করা—সব ওই একদিনে। তবে “ব্রাজিলিয়ান ইনটেলিজেন্স এজেন্সি” আমাকে খুব সাহায্য করেছে। ওরা না দিলে গ্লক কোথায় পেতাম?’
আয়েশা বলল, ‘পরের দিন নুরি ডিকস্টা-র ডকুমেন্ট নিয়ে আমি দিল্লি থেকে সাও পাওলো গেলাম। আমিও কয়েকটা পর্তুগিজ বাক্য শিখে নিয়েছিলাম। সাও পাওলোর হোটেলে রাত কাটিয়ে ছ’তারিখ হ্যালির সঙ্গে মানাউস হয়ে আমাজনে পাড়ি দিলাম। আমেরিকা যে ওদের ওপরে নজর রাখছে, এটা পল, আলিয়া আর ওমর জানত। পল তাই ইচ্ছে করে সন্দেহভাজনের তালিকায় আলিয়ার নাম রাখে। যাতে মনে হয় লোকাল গাইড বেলা আলভারেজের সূত্রে ওমর জেনেছিল পল আর আলিয়া জাটুয়ারানায় আছে। এবং কেউ যেন বুঝতে না পারে যে মার্কোসই আলিয়া।’
প্রথমা বলল, ‘বেলা আলভারেজকে ওমর খুন করেছে। সেটা “ব্রাজিলিয়ান ইনটেলিজেন্স এজেন্সি” আমাদের জানিয়েছিল। মার্কোস ওরফে আলিয়া খাবার নিয়ে তালা খুলে টেন্টে ঢুকত। পেট পুরে খেয়ে বেরিয়ে আসত। পরে আবার টেন্টে ঢুকে এঁটো থালা নিয়ে বেরোত। আমরা ভাবতাম আলিয়া টেন্টে বন্দি অবস্থায় খেয়ে নিয়েছে। এইটা খুব ইন্টারেস্টিং মুভ ছিল।’
আয়েশা বলল, ‘হ্যালি আর আমার ওপরেও ওমরের ড্রোনের খবরদারি ছিল। আমরা কী বলছি, ওমর শুনতে পাচ্ছিল। আমাদের আসল উদ্দেশ্য যে খুন করা, নেগোশিয়েট করা নয়, এটা ওমর যাতে বুঝতে না পারে, তাই আমরা ভুলভাল কথা বলছিলাম। তবে প্রথমা গাইডের অ্যাক্টিং ভালো করেছে। আমান্ডা যে আসল গাইড, এটা ওরা বুঝতে পারেনি।’
রঞ্জিত বললেন, ‘ছ’তারিখ সাও পাওলো পৌঁছে সাত তারিখে কাজ চুকিয়ে ন’তারিখে ফিরে এলি তোরা! সুপার কুইক কাজ তো! তোদের এই একটি কাজের জন্যে ওয়ারিস্তানে ওরাল ইনসুলিনের কারখানা খুলবে না। ওয়ারিস্তান ঋণের ফাঁদ থেকে বেরোতে পারবে না। আমি যতদূর জানি, ওমর পায়ে গুলি খেয়ে ওয়ারিস্তানের হাসপাতালে ভর্তি। পল এখন আমেরিকার কোনও জেলে। সব মিলিয়ে আমি খুব খুশি। তোরা বরং আমেরিকা বেড়িয়ে আয়। খরচ ডিপার্টমেন্ট দেবে। যাকে বলে “অল এক্সপেন্সেজ পেইড ভ্যাকে!” ’
প্রথমা আর আয়েশা একসঙ্গে চেঁচিয়ে বলে, ‘আমরা সাতদিনের জন্যে বাড়ি যেতে চাই স্যর!’