রইল বাকি আট

রইল বাকি আট

এখন। চিত্তুরের জঙ্গল

জ্ঞান ফিরতে বাইশ বছরের ললিতা রেড্ডি দেখল মাথার ওপরে প্রখর সূর্য। অন্ধ্রপ্রদেশের জোরালো রোদে চোখ ঝলসে যাচ্ছে। বাঁ হাত দিয়ে চোখ ঢাকতে গিয়ে ললিতা বুঝতে পারল, মাথার পিছনটা দপদপ করছে। মনে পড়ে গেল, অচেনা লোকটা তার মাথায় লোহার রডের বাড়ি মেরেছিল। তারপর কালো কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে দিয়েছিল। ফাঁসি দেওয়ার আগে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে জহ্লাদরা ওই রকম ফেস কভার পরিয়ে থাকে।

বাবা অভয় রেড্ডির কথা মনে পড়ছে ললিতার। মনে পড়ছে মা শিবমতীর কথা। মনে পড়ছে প্রিয় বান্ধবী মুন্নি শর্মার কথা। চোখ ফেটে জল আসছে। ডান হাত দিয়ে চোখ মুছতে যায় ললিতা…

হাত নড়ছে না! ডান হাতে হ্যান্ডকাফ লাগানো। হাতকড়ার অন্য দিকটা আটকানো রয়েছে ভারি লোহার শেকলের সঙ্গে। শেকলের অন্য প্রান্ত কোথাও একটা বাঁধা রয়েছে।

ধড়মড় করে উঠে বসল ললিতা। চারিদিকে তাকিয়ে, নিজেকে কলে আটকে পড়া ইদুর বলে মনে হয়। সে এতক্ষণ শুয়ে ছিল তার বাবা অভয় রেড্ডির পরিত্যাগ করে যাওয়া করাত কলের মধ্যে, একটা লোহার বেঞ্চির ওপরে। এই বেঞ্চিতে চন্দন কাঠের গুঁড়ি রেখে পুরোনো আমলের করাত দিয়ে কাটা হতো। দু-বছর আগে অন্ধ্রপ্রদেশ পুলিশের আক্রমণের পরে অভয় এটা ছেড়ে পাশের জঙ্গলে নতুন করাত কল খুলেছে। পরিত্যক্ত এই করাত কলে ললিতাকে কে নিয়ে এল? কেই বা তার ডান হাত শেকল দিয়ে বাঁধল? ফুট তিনেক লম্বা শেকলটা বেঞ্চির পায়ার সঙ্গে তালা দিয়ে আটকানো।

নানান প্রশ্ন এবং কনফিউশানের মধ্যে একটা জিনিস দেখে আঁতকে উঠল ললিতা। বেঞ্চি থেকে মিটার দশেক দূরে, করাত কলের মেঝেয় পড়ে রয়েছে প্রিয় বান্ধবী মুন্নি শর্মার লাশ। পরনে সালোয়ার কামিজ, মাথায় ওড়না। বাঁ-ঊরুর ক্ষতচিহ্ন থেকে ভলকে ভলকে রক্ত বেরিয়ে করাত কলের কাঠের মেঝে ভিজিয়ে দিচ্ছে। হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল ললিতা। এ তার কী হল?

শ্রীভেঙ্কটেশ ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে ললিতার আলাপ হয় মুন্নির সঙ্গে। দুজনেরই এক সাবজেক্ট, ইন্টারন্যাশনাল রিলেশানশিপ। ব্যাচও এক। তবে ও ডিসট্যান্ট লার্নিং কোর্স করছে। কারণ ও দিল্লির মেয়ে। মাসে একবার, সাতদিনের জন্যে শ্রীভেঙ্কটেশ ইউনিভার্সিটিতে আসে। দুজনের রুচিতে এত মিল যে ‘বেস্টি’ হয়ে যেতে সময় লাগেনি। নেহাত অভয়ের নির্দেশ ছাড়া বাড়িতে কাউকে আনা বারণ। তাই মুন্নিকে বাড়ি দেখায়নি ললিতা। কিন্তু ক্যাম্পাস সংলগ্ন যে পেয়িং গেস্ট অ্যাকমডেশানে ললিতা থাকে, সেই রুমেই জায়গা দিয়েছে মুন্নিকে। দুজনে রাতের পর রাত আড্ডা মেরেছে, গোপনতম কথা শেয়ার করেছে। প্রিয় বান্ধবী মরে গেল?

‘কাঁদিস না!’ ইংরিজিতে, খসখসে গলায় বলল মুন্নি।

মুন্নি তা হলে মারা যায়নি! চিৎকার করে ললিতা বলল, ‘কী হয়েছে বল? পার্কে লোকটার সঙ্গে ঝগড়া করার পরে কী হয়েছিল? আমার কিছু মনে নেই।’

‘আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ। চিল আর শকুন ঘুরপাক খাচ্ছে। ওরা মৃত্যুর গন্ধ পায়…’ ক্লান্ত গলায় বলল মুন্নি, ‘আমার থাইতে গুলি লেগেছে। সাংঘাতিক ব্লিডিং হচ্ছে। আমি আর বাঁচব না। তার আগে ‘ভয়ম কিলার’ কী বলে গেল শুনে রাখ।’

‘ভয়ম কিলার?’ আঁতকে ওঠে ললিতা। এই সিরিয়াল কিলার গত দু-বছরে অন্ধ্রপ্রদেশের তিনজন ছেলেমেয়েকে খুন করেছে। ওর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছে আরও তিনজন। যারা বেঁচে ফিরেছে, তাদের কাছ থেকে ‘ভয়ম কিলার’ সম্পর্কে জানা গিয়েছে।

‘তোর বেঞ্চির পায়ার কাছে একটা চিঠি আছে।’ জিভ চেটে বলল মুন্নি। ‘আর একটা বেসিক মোবাইল ফোন আছে। ফোনে কাকু-কাকিমার মোবাইল নম্বর সেভ করা আছে। ফোনে একটা মাত্র ফোন কলের টকটাইম ভরা আছে। ভয়ম কিলার আমাকে বলে গিয়েছে, তোকে কী করতে হবে…’

দু-বছর আগে। দিল্লি

সাউথ ব্লকের প্রতিরক্ষা দপ্তরের অফিসে বসে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রঞ্জিত গগৈ বললেন, ‘কাইমেরা ভার্সন টু-য়ের কাজ কেমন চলছে, প্র্যাট?’

‘একটু ঢিলেঢালা,’ বলল প্রথমা লাহিড়ী, ‘কাইমেরার জন্যে নতুন কোনও মিশন আছে নাকি? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বীরেন্দ্র মেহতা আমাদের জন্যে দশটা টার্গেট ঠিক করেছেন। প্রথম জন এলিমিনেটেড। দু-নম্বর টার্গেট কে?’

প্রথমার দিকে মোটকা ফাইল এগিয়ে দিয়ে রঞ্জিত বললেন, ‘দ্বিতীয় প্রজেক্টে যাকে এলিমিনেট করতে হবে, তার নাম অভয় রেড্ডি। অন্ধ্রপ্রদেশের চন্দন-দস্যু।’

‘ “হারাধনের দশটি ছেলে” কবিতার দ্বিতীয় পংক্তি মনে পড়ে গেল স্যর,’ বলল প্রথমা,

‘হারাধনের নয়টি ছেলে

কাটতে গেল কাঠ,

একটি কেটে দু’খান হল

রইল বাকি আট।’

ফাইলের প্রথম পাতায় একটি ফোটো। লম্বা, রোগা, কালো, বিশাল গোঁফ এবং গালপাট্টাওয়ালা মুখের সঙ্গে প্রথমা পরিচিত। চন্দন দস্যু অভয় রেড্ডি।

রঞ্জিত বললেন, ‘অভয়ের জন্ম ১৯৭০ সালে, চিত্তুর জেলায়। অপরাধের কেরিয়ার শুরু হয় বারো বছর বয়সে, বাবার সাকরেদ হিসেবে। অভয়ের বাবাও হাতি শিকারি এবং চন্দন কাঠ পাচারকারী ছিল। অভয়ের প্রথম হাতি শিকার পনেরো বছর বয়সে, প্রথম মানুষ শিকার সতেরোয়, বিয়ে আঠেরোয়। বউয়ের নাম শিবমতী। মেয়ের নাম ললিতা।’

‘কাগজে পড়েছি লোকটা অনেকগুলো মার্ডার করেছে।’

‘ফরেস্ট রেঞ্জারকে খুন, ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিস এবং ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের অফিসারকে মার্ডার, বন দপ্তরের একুশজন কর্মীকে গণহত্যা, অন্ধ্রের সুপারস্টার রাজকুমারকে কিডন্যাপ করে দশ কোটি টাকা মুক্তিপণ নেওয়া—লোকটার অপরাধের লিস্ট লম্বা।’

‘এত বড় অপরাধীকে ধরা যাচ্ছে না কেন?’

‘অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক এবং কেরালা—চার রাজ্যের পুলিশ ওকে খুঁজছে। কিন্তু লোকটার হাত অনেক লম্বা। সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতা নেত্রীর কাছে নিয়মিত ভেট পৌঁছে যায়। ওপরতলার পুলিশের সঙ্গেও ভালো যোগাযোগ। রেডের খবর ওর কাছে অনেক আগে পৌঁছে যায়। ও তখন এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পালায়।’

‘চার রাজ্যের পুলিশ নিয়ে টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়নি?’

‘ল্যান্ড মাইন বিষ্ফোরণে টাস্ক ফোর্সের সবাই মারা গিয়েছে। সেটা জানার পরেই বীরেন্দ্র মেহতা বলেছেন, ওকে নিউট্রালাইজ করবে কাইমেরা।’

‘হাতির দাঁতের যে অনেক দাম, এটা জানি। কিন্তু চন্দন কাঠের এত দাম কেন?’

‘প্রসাধনী, পুজোর উপকরণ, ব্যথার ওষুধ—নানা কাজে চন্দন কাঠ লাগে। এক কেজি রক্ত-চন্দন কাঠের দাম সাড়ে ন’হাজার টাকা। শ্বেত-চন্দন কাঠের দাম বাইশ হাজার টাকা প্রতি কিলো। ড্রাগ বা অস্ত্রের মতো কাঠের পরিবহন বেআইনি নয়। এর সুযোগ নিয়ে অভয় রেড্ডি কয়েকশো কোটি টাকার মালিক।’

ফাইল নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে প্রথমা বলল, ‘খবরের কাগজ আর টেলিভিশনের আর্কাইভে অভয়কে নিয়ে অনেক তথ্য আছে। আপনার এই ফাইলে চার রাজ্যের পুলিশের দেওয়া ডেটা আছে। পুরোটা পড়তে, দেখতে এবং বুঝতে অনেকটা সময় লাগবে। কোনও ফুলপ্রুফ প্ল্যান মাথায় এলে আপনাকে জানাব।’

‘সময়, টাকা আর রিসোর্সের অভাব হবে না। তুই শুধু অভয়কে ধর। জ্যান্ত অথবা মৃত!’

মন্ত্রীকে স্যালুট ঠুকে প্রথমা ঘর থেকে বেরোল।

এখন। চিত্তুরের জঙ্গল

‘কী করতে হবে?’ জিজ্ঞাসা করল ললিতা।

‘আগে চিঠিটা পড়।’ বলল মুন্নি, ‘পরে বলছি…যদি বেঁচে থাকি…’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ললিতা সোজা হয়ে বসে। ওপরে তাকিয়ে দেখে, মাথার ওপরে ঝুলছে জং ধরা, লম্বা করাত। এগুলো পুরোনো আমলের করাত। ঘ্যাঁষঘ্যাঁষ করে কাঠের ওপরে চালিয়ে গুঁড়ি কাটা হতো। এখন আর ব্যবহার হয় না। এখন গাছ কাটার জন্যে ইলেকট্রিক করাত ব্যবহার করা হয়।

এইটুকু পরিশ্রমেই ললিতার ব্রহ্মতালু ঝনঝন করছে। প্রচণ্ড পরিশ্রম করে বেঞ্চি থেকে হিঁচড়ে নিজেকে নামায়, আধ বসা হয়ে বাঁ-হাত দিয়ে টেনে নেয় মোবাইল এবং সাদা কাগজটা। আবার বেঞ্চিতে বসে কাগজ খুলে দেখে, ইংরিজিতে গোটা গোটা হরফে লেখা রয়েছে…

‘তুমি আমাকে অল্পবিস্তর চেনো। আমি তোমাকে খুব ভালোভাবে চিনি। আমার তৈরি এই রিয়্যালিটি শোতে দুজনেরই দুজনকে ভালোভাবে চেনা খুব জরুরি। তাই আগে নিজের পরিচয় দেওয়া যাক। আমি ভয়ম কিলার।

‘আমি জানি যে ভয়ম কিলারকে তুমি চেনো না। তুমি চেনো দশ বছর বয়সি ‘মাস্টার শঙ্কর’-কে, যার সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছিল ‘ফিয়ার ফ্যাক্টরি’ নামের রিয়্যালিটি শোয়ের সেটে। যে শো-টা আজ থেকে বারো বছর আগে ‘সান টিভি’-তে শুরু হয়েছিল। যে শোয়ে তুমি সেকেন্ড হয়েছিলে। আর মাস্টার শঙ্কর, মানে আমি, এলিমিনেট হয়ে গিয়েছিলাম প্রথম রাউন্ডেই। কারণ তোমরা, বারোজন দশ বছরের বাচ্চা ছেলেমেয়ে মিলে ষড়যন্ত্র করে আমাকে বার করে দিয়েছিলে।

‘এখনও মনে পড়ছে না? মনে পড়ার কথাও নয়। কারণ বারো বছর আগের রিয়্যালিটি শোয়ে সেকেন্ড হওয়ার কোনও গুরুত্বই তোমার কাছে নেই। তুমি সেই অতীত পিছনে ফেলে এসেছ।

‘মাস্টার শঙ্কর, মানে আমি কিন্তু সেই সময়েই আটকা পড়ে আছি। কারণ আমি ছিলাম টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় শিশুশিল্পী। আমার আয়ে পরিবার চলত। তোমরা বারোজন মিলে বুঝতে পেরেছিলে যে আমি প্রতিযোগিতায় থাকলে তোমাদের জেতার কোনও সম্ভাবনাই নেই। তাই প্রথম রাউন্ডের গোড়াতেই ঠিক করে রেখেছিলে, এলিমিনেট করে দেবে আমাকে। সেটাই হয়েছিল।

‘পরাজিত তারকাকে জনতা পছন্দ করে না। শিশুশিল্পী হলেও করে না। আমার চাইল্ড আর্টিস্ট হিসেবে কেরিয়ার তাই শেষ হয়ে যায়। তা নিয়ে আমার কোনও দুঃখ নেই। কিন্তু ছেলের ব্যর্থতা সহ্য করতে না পেরে আমার বাবা-মা একসঙ্গে আত্মহত্যা করে। আমার স্থান হয় অনাথ আশ্রমে। সেখানে থাকাকালীন ফিয়ার ফ্যাক্টরির এপিসোডগুলো রোজ দেখতাম, বার বার দেখতাম। আমার মাথায় প্রতিটি শট গাঁথা আছে। আমি জানি যে অনন্যার জলে ভয় বলে ওকে সাঁতার কাটতে বাধ্য করা হয়েছিল। দিব্যশক্তির পোকামাকড়ে ভয় বলে ওকে মৌমাছির সঙ্গে কাচের বাক্সে এক ঘণ্টা কাটাতে হয়েছিল। মুন্নি আগ্নেয়াস্ত্রে ভয় পেত বলে ওকে দিয়ে শুটিং প্র্যাকটিস করানো হয়েছিল…’

এই অবধি পড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে ললিতা বলল, ‘মুন্নি! তুইও কি ফিয়ার ফ্যাক্টরিতে ছিলি?’

মুন্নি কোনও কথা বলল না।

আতঙ্কিত ললিতা চিৎকার করে বলল, ‘মুন্নি! কী হল তোর?’

‘কিছু না…এখনও বেঁচে আছি…’ চোখ না খুলে, ঠোঁট চেটে মুন্নি বলল, ‘হ্যাঁ, আমিও ছিলাম ফিয়ার ফ্যাক্টরিতে। সেকেন্ড রাউন্ডে বেরিয়ে যাই। কারণ আমার পিস্তল-বন্দুকে খুব ভয়। অত বছর আগের কথা আমার মনেই ছিল না। তুই যতক্ষণ অজ্ঞান ছিলি, সেই সময়ে ভয়ম কিলার ওরফে মাস্টার শঙ্কর আমাকে সব বলে গেছে। ও গত দু-বছরে তিনটে মার্ডার করেছে। হেমন্তিনী খুন হয়েছে বহুতল থেকে পড়ে। ওর উচ্চতা নিয়ে ভয় ছিল। শ্রীদীপ খুন হয়েছে ট্রেনে কাটা পড়ে। ও ট্রেনে উঠতে ভয় পেত। তাজুদ্দিন খুন হয়েছে জলে ডুবে। ওর জলে ভয় ছিল। সব ক্ষেত্রেই কেউ না কেউ দেখেছে যে ছাদ, ট্রেনের দরজা বা স্টিমার থেকে ধাক্কা দিয়ে হেমন্তিনী, শ্রীদীপ আর তাজুদ্দিনকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। অন্ধ্রপ্রদেশের পুলিশ জানে যে এগুলো একটাই লোকের কাজ। অন্ধ্রপ্রদেশের পুলিশ এটাও জানে যে, যার যাতে আতঙ্ক আছে, সেটা ব্যবহার করেই মার্ডার করা হচ্ছে। কিন্তু ওরা জানে না যে ফিয়ার ফ্যাক্টরির প্রতিযোগীরা খুন হচ্ছে। তাই মাস্টার শঙ্করকে ধরা যাচ্ছে না। লোকে জানে ভয়ম কিলার খুনগুলো করছে। এই নামটা দিয়েছে মিডিয়া। ওর আসল নাম যে শঙ্কর, এটা কেউ জানে না।’

‘তোর পায়ে গুলি কে করল?’ জিজ্ঞাসা করল ললিতা।

‘ভয়ম কিলার আমার হাতে পিস্তল গুঁজে দিয়ে বলল ট্রিগার টিপতে। আমি ভয়ের চোটে চিৎকার শুরু করি। ওই তখন আমার থাইতে গুলি করে বলে, “তুই মরবি। তবে ধীরে ধীরে। লাইক এ পেশেন্ট ইথারাইজড আপন দ্য টেবিল।” ’ কথা বলতে বলতে মুন্নি হঠাৎ চুপ করে গেল।

ললিতার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। অশ্রু মুছে সে চিঠি পড়তে লাগল…

এক বছর দশ মাস আগে। দিল্লি

দিল্লির পাহাড়গঞ্জ এলাকায় গাদা গাদা ট্রাভেলিং এজেন্টের অফিস। তার মধ্যেই রয়েছে ‘মহাবীর ট্রাভেলিং এজেন্সি,’ যেটা কাইমেরার ‘ফ্রন্ট অফিস’ হিসেবে কাজ করে। অফিসের বেসমেন্টে, সকলের চোখের আড়ালে আছে নতুন কাইমেরার হাই-টেক অফিস। সেখানে বসে কথা বলছে আয়েশা আর প্রথমা। দুজনেই বাঙালি। আয়েশার বাড়ি মুম্বইতে, প্রথমার কোলাঘাটে।

আয়েশা বলল, ‘সব কিছু পড়ে এবং দেখে একটাই কথা মনে হচ্ছে। অভয় রেড্ডিকে ধরা অসম্ভব ব্যাপার।’

‘কেন মনে হচ্ছে?’ জিজ্ঞাসা করল প্রথমা।

আয়েশা বলল, ‘লোকটার সঙ্গে সব সময় গোটা তিরিশেক দেহরক্ষী থাকে। তাদের সবার কাছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র আছে। অভয় নিজের কাছে রাখে অস্ট্রিয়ান পিস্তল, গ্লক। লোকটার রুটিন হল বাড়ি থেকে জঙ্গলের অফিস যাওয়া। এবং অফিস থেকে বাড়ি ফেরা।’

প্রথমা বলল, ‘অভয় রেড্ডি সংক্রান্ত সব তথ্য আমাদের মাথার মধ্যে এনক্রিপটেড। পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে ভাবা যাক। ওর বউকে নিয়ে কী কী জানি?’

‘শিবমতীর প্রোফাইল তৈরি হয়ে গিয়েছে।’ বলল আয়েশা। ‘স্বামীর ওপরে বারবার পুলিশি অ্যাটাক এবং স্বামীর অন্যায় পেশা—এই দুটি ঘটনা মহিলাকে মানসিক রোগী করে দিয়েছে। চিত্তুরের মনোবিদের চেম্বার থেকে সব প্রেসক্রিপশান জোগাড় করেছি। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে শিবমতীর পাহাড় প্রমাণ টেনশান করে। তখন খিঁচুনি শুরু হয়। অজ্ঞানও হয়ে যায়। যার ফলে অভয় বা ললিতা ওকে কোনও গোপন কথা বলে না। ললিতাই মায়ের দেখাশুনো করে। তবে ওর আসল বন্ডিং বাবার সঙ্গে।’

‘ললিতার প্রোফাইল কী বলছে?’

‘বাবার সঙ্গে বন্ডিং-এর কথা বলছিলাম। সেই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলি। এটা খবরের কাগজে বেরিয়েছে। বছর চারেক আগে স্কুলের একটি ছেলে অভয়কে “ডাকাত” বলেছিল। সেটা শুনে ললিতা ঘুষি মেরে ক্লাসমেটের নাক ফাটিয়ে দেয়। অভয়ও মেয়ে অন্ত প্রাণ। একবার পুলিশ অ্যাটাকের সময় মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে হাতে গুলি খেয়েছিল। ললিতা যখন স্কুলে যেত, তখন সঙ্গে দু-গাড়ি সশস্ত্র দেহরক্ষী থাকত। ও এই সপ্তাহেই চিত্তুরের শ্রীভেঙ্কটেশ ইউনিভার্সিটিতে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশানশিপ নিয়ে পড়তে ঢুকেছে। পেয়িং গেস্ট হিসেবে যে বাড়িতে থাকে, তার বাকি ঘরগুলো অভয়ের দেহরক্ষীরা ভাড়া নিয়ে রেখেছে। সব সময় ওখানে অন্তত চারজন থাকে।’

‘আর কিছু?’

‘বলার মতো একটাই ঘটনা। স্কুল লাইফে ললিতা “ফিয়ার ফ্যাক্টরি” নামের একটা রিয়্যালিটি শো-তে নাম দিয়ে সেকেন্ড হয়েছিল।’

‘ফিয়ার ফ্যাক্টরির এপিসোডগুলো দেখা যাবে?’

আয়েশা মুচকি হাসল, ‘আমার অলরেডি দেখা হয়ে গিয়েছে। বিঞ্জ ওয়াচ করেছি।’ তারপরে একটা পেন ড্রাইভ প্রথমার দিকে এগিয়ে দিল।

‘আমিও দেখি তা হলে,’ ল্যাপটপে পেন ড্রাইভ গুঁজে বলল প্রথমা।

‘আমরা অভয়ের বাড়ি তাক করে রকেট লঞ্চার ছাড়তে পারি না?’ হতাশ হয়ে বলল আয়েশা।

‘অতীতে এই চেষ্টা হয়েছে। অভয়ের বাড়ি আমাদের দেশের থেকেও সুরক্ষিত। ওর থাকার জায়গা মাটির নীচে, বাঙ্কারের মধ্যে। বোমা মারলে ওর কোনও ক্ষতি হবে না। উল্টে সরকারের বদনাম হবে।’

‘বাড়ি থেকে জঙ্গলের মধ্যে অফিস যাওয়ার সময় যদি গাড়ি লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয়?’

‘সেই চেষ্টাও অতীতে হয়েছে। রোজ পনেরো থেকে কুড়িটা গাড়ি বিভিন্ন রুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অফিস যায়। প্রতি গাড়িতে সশস্ত্র সাতজন দেহরক্ষী থাকে। কোন এসইউভিতে অভয় থাকবে, সেটা ও ছাড়া কেউ জানে না। গত বছর পুলিশি অ্যাটাকে সাত দেহরক্ষী-সহ একটা এসইউভি উড়ে গিয়েছিল। মানবাধিকার কর্মী আর মিডিয়ার কাছে জবাবদিহি করতে হয়েছিল অন্ধ্রপ্রদেশ পুলিশকে। কাজেই এই রিস্ক নেওয়া যাবে না।’

‘তা হলে কী করব?’ চেয়ার থেকে উঠে কফি মেশিনের কাছে যাচ্ছে আয়েশা।

‘বুঝতে পারছি না…’ বিড়বিড় করছে প্রথমা, ‘এই মিশনে অলরেডি দু-মাস চলে গেল। কোনও প্ল্যান মাথায় আসছে না…’

এখন। চিত্তুরের জঙ্গল

‘তোমার সঙ্গে মুন্নিকে পেয়ে আমার সুবিধে হল। এক ঢিলে দুই পাখি মারা গেল। তোমার পরিচয় আগে থেকেই জানতাম, কেন না তুমি বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত বাবার মেয়ে। শ্রীভেঙ্কটেশ ইউনিভার্সিটির কাছে যে বিল্ডিং-এ তুমি পেয়িং গেস্ট থাকো, সেখানে মুন্নি তোমার রুমমেট—এটা জানার পরে নতুন করে প্ল্যান কষলাম। তুমি নিশ্চয় এতক্ষণে বুঝে গেছ যে আমার জীবনে সময়ের কোনও অভাব নেই। এবং জীবনের লক্ষ্য একটাই। তোমাদের একে একে শেষ করে দেওয়া। বারোটা খুনের একটা নিখুঁত রিয়্যালিটি শো। ফিয়ার ফ্যাক্টরি, সিজন টু।’

এই প্যারাগ্রাফটি পড়ে ললিতার মেরুদণ্ড বেয়ে কেউটে সাপ নেবে গেল। বুকের বাঁদিকে উড়তে লাগল একপাল বাদুড়। মন শক্ত করে সে চিঠি পড়তে লাগল…

 ‘ফিয়ার ফ্যাক্টরি, সিজন টু এবং সিজন ওয়ানের চরিত্ররা একই আছে। প্রথম সিজনের সঙ্গে তফাত এই যে, সিজন টু টিভিতে সম্প্রচার হচ্ছে না। হচ্ছে গোটা অন্ধ্রপ্রদেশ জুড়ে, দু-বছর ধরে।

‘যে-কোনও রিয়্যালিটি শো বানাতে গেলে রিসার্চ করা খুব জরুরি। আমি ফিয়ার ফ্যাক্টরির দ্বিতীয় সিজনের জন্যে প্রতিটি প্রতিযোগীর রিসার্চ সেরে রেখেছি। আজ যখন তোমাদের সঙ্গে পায়ে পা বাঁধিয়ে ঝগড়া করলাম, তখন আমার মাথায় দুটো পয়েন্ট ছিল। এক নম্বর হল, তুমি বাবার নিন্দে সহ্য করতে পারো না। দু’নম্বর, শুক্রবার দুপুরে দেহরক্ষীদের পাহারা ঢিলেঢালা থাকে বলে তোমরা দুজনে ক্যাম্পাসের বাইরের পার্কে গিয়ে মেদু বড়া আর মুরুক্কু খাও। তোমার সঙ্গে ঝগড়া করার জন্যে আমি তোমার বাবাকে “ডাকাত” বললাম। তুমি আমার গালে থাপ্পড় কষালে। এই সুযোগে আমি তোমার মাথায় ডান্ডা মারলাম। তুমি অজ্ঞান হয়ে যেতেই মুখ ঢেকে দিলাম কালো ফেস কভার দিয়ে। একই কাজ করলাম মুন্নির সঙ্গেও। গাড়ি পাশেই পার্ক করা ছিল। তোমাদের দুজনকে নিয়ে এলাম এখানে।

‘তোমার বাবার ছেড়ে যাওয়া করাত কলে কেন নিয়ে এলাম? এখানেও রিসার্চ। ফিয়ার ফ্যাক্টরির প্রথম সিজনে বলেছিলে, তুমি দুঃস্বপ্ন দেখো যে তোমার বাবা অথবা মাকে করাত দিয়ে কাটা হচ্ছে। তখন ছোট ছিলাম। এই স্বপ্নের মানে বুঝতে পারিনি। এখন বুঝি, বাবার পেশা নিয়ে তোমার মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে বলেই এই দুঃস্বপ্ন।

‘আমার চ্যালেঞ্জ হল, তুমি যদি এই ভয়কে জয় করতে পারো, তা হলে এখান থেকে বেঁচে ফিরবে। না হলে ওই বেঞ্চিতে শুয়ে, জল আর খাবার না পেয়ে তিলে তিলে মৃত্যু হবে। বাকিটা মুন্নির কাছে জেনে নিও। যদি ও আদৌ বেঁচে থাকে।’

এই অবধি পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল ললিতা। চিৎকার করে বলল, ‘মুন্নি!’

অনেক কষ্টে চোখ খুলল মুন্নি। বলল, ‘কাকিমাকে ফোন করে ডেকে নে। হাতকড়ার চাবি তোর মাথার ওপরে যে করাতটা ঝুলছে, তার ব্লেডে লিউকোপ্লাস্ট দিয়ে লাগানো আছে। কাকিমা এসে চাবি দিয়ে তালা খুললেই তুই ফ্রি। কাকুকে এর মধ্যে জড়াস না। কাকিমাকে পুলিশে খবর দিতে বারণ কর। কাকুর দেহরক্ষীরাও যেন না আসে। যদি ওরা আসে তা হলে…’

মুন্নির চোখ বন্ধ হয়ে গেল। ললিতা দেখল কয়েকটা চিল আর শকুন মাটিতে নেমে এসেছে। সরাসরি মুন্নির কাছে আসছে না। ঝোপের পিছনে গিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে। কে আগে মাংস খাবে, এই নিয়ে ঝগড়া।

মোবাইল হাতে নিয়ে ওপর দিকে তাকাল ললিতা। করাতের ব্লেডের গায়ে লিউকোপ্লাস্ট দিয়ে একটি চাবি আটকানো রয়েছে। বেঞ্চির ওপরে দাঁড়ালে ললিতাই হাত পেয়ে যাবে। কিন্তু হ্যান্ডকাফ আর শেকলের কারণে সে বেঞ্চির ওপরে দাঁড়াতে পারবে না। কী করা যায় এখন? মুন্নি বলেছে মাকে ফোন করতে। বেচারা মুন্নি জানে না যে শিবমতী মানসিক রোগী। মাকে ফোন করে কোনও লাভ নেই, বরং ক্ষতি। চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করলে পরিস্থিতি জটিলতর হবে। তার থেকে বাবা অনেক ভালো। ঠান্ডা মাথায় খবরটা গ্রহণ করতে পারবে। চিল-শকুনের মারামারি দেখতে দেখতে অভয়ের মোবাইলে ফোন করে ললিতা। কপাল ভালো, বাবা-মায়ের মোবাইল নম্বর তার মুখস্থ।

এক বছর ন’মাস আগে। দিল্লি

‘এটা খুব জটিল প্ল্যানিং হয়ে যাচ্ছে না প্র্যাট?’ প্রথমাকে জিজ্ঞাসা করলেন রঞ্জিত। দুজনে বসে রয়েছেন সাউথ ব্লকে রঞ্জিতের অফিসে।

 ‘এ ছাড়া আমার কিছু মাথায় আসছে না স্যর। আমি আর আয়েশা মিলে সব রকম সম্ভাবনা খতিয়ে দেখেছি। অভয়ের জীবনযাপনের মধ্যে কোনও দুর্বল জায়গা খুঁজে পাইনি। লোকটার একটাই দুর্বলতা। নিজের মেয়ে।’

 ‘হ্যাঁ। সেটা বুঝলাম…’ রঞ্জিতের ভুরু কুঁচকে আছে। ‘প্রায় দু-বছর ধরে কাজটা চালাতে হবে। অনেক লোককে ভুল তথ্য ফিড করতে হবে। কোনও ভাবে প্ল্যান কেঁচে গেলে বিরাট কেলেঙ্কারি হবে। আমাকে রিজাইনও করতে হতে পারে।’

 প্রথমা মৃদু হেসে বলল, ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত অনেক বছর আগে লিখে গিয়েছেন, “মারি অরি পারি যে কৌশলে”।’

 ‘নাথিং ইজ রং ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার।’ কাঁধ ঝাঁকালেন রঞ্জিত, ‘ঠিক হ্যায়! তোর দাবি মেনে নিলাম। যেখানে যা বলার, বলে দিচ্ছি। তারপরে ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ।’

চেয়ার থেকে উঠে প্রথমা বলল, ‘বড় মাছ ধরতে গেলে ভালো চার লাগে, শান্ত পুকুর লাগে। আপনি সে সবের ব্যবস্থা করুন। বাকিটা আমার ওপরে ছেড়ে দিন।’

এখন। চিত্তুরের জঙ্গল

‘হ্যালো!’ সন্তর্পণে বলল ললিতা।

‘তুই কোথায়?’ ললিতাকে আমর্ষ চমকে দিয়ে চিৎকার করে উঠল শিবমতী। অভয়ের ফোন শিবমতী কেন ধরেছে?

শিবমতী হিস্টিরিয়া রোগীর মতো চেঁচাচ্ছে, ‘তোকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? মুন্নিকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? তোর বডিগার্ডরা একা ফিরে এসেছে কেন? আমার খুব ভয় করছে। এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যাব কিন্তু।’

‘নাটক না করে বাবাকে ফোনটা দাও।’ অন্য সময়ে মায়ের সঙ্গে যেভাবে খিঁচিয়ে কথা বলে ললিতা, এখনও সেভাবেই বলল। ভিতরে ভিতরে যদিও সে ভেঙে শত টুকরো হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে কাঁদতে কাঁদতে সব কথা মাকে বলতে। আর কি কখনও মায়ের সঙ্গে দেখা হবে?

‘হ্যালো?’ ওদিক থেকে অভয়ের খসখসে কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

‘ললিতা বলছি। যা বলব চুপ করে শুনবে। মুখে আনন্দের এক্সপ্রেশান রাখো। মা যেন কিছু বুঝতে না পারে। আমাকে ভয়ম কিলার কিডন্যাপ করেছে। মুন্নিকে খুন করেছে। আমি এখন চিত্তুরের জঙ্গলে, পুরোনো করাত কলে বন্দী রয়েছি।’ এক নিশ্বাসে প্রয়োজনীয় কথাগুলো বলে থামল ললিতা। বাবার কী প্রতিক্রিয়া, আগে শোনা যাক।

‘ভেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে বেড়াতে যাবি, এটা আমাদের বলে গেলে কী হতো?’ খুকখুক করে হাসছে অভয়। ‘মা যেতে দিত না? মুন্নিকে একবার ফোনটা দে। ওকে একটু বকুনি দিই।’

বাবা কথা বলার সুযোগ দিয়েছে। ললিতা গলগল করে বলছে কলেজ থেকে বেরোনোর পরে কী হয়েছে, সেই কথা। বলছে জ্ঞান ফেরার পরে কী দেখেছে সেই কথা। বলছে মুন্নির লাশ, চিঠি আর মোবাইল ফোনের কথা…

‘আরিব্বাস! তোমার সাহস আছে বলতে হবে মুন্নি!’ খুশিয়াল গলায় বলল অভয়। ‘যে হোটেল ক্রেডিট কার্ড নেয় না, সেখানে ওঠার কী দরকার ছিল? আমি বডিগার্ডের হাত দিয়ে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

বাবার অভিনয়ে মুগ্ধ ললিতা। মাকে কিচ্ছু বুঝতে দিচ্ছে না! একই সঙ্গে নিজে এখানে আসার পরিস্থিতি তৈরি করছে। ললিতা দ্রুত বলে দিল ভয়ম কিলারের প্ল্যান। ও কেন, কী ভাবে অতীতে তিনটে খুন করেছে, কী ভাবে মুন্নিকে মেরেছে, কী ভাবে ললিতাকেও মারতে চাইছে, কী ভাবে ওর শর্ত মেনে নিয়ে দেহরক্ষী ছাড়া এলে ললিতাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো যাবে…

‘হ্যাঁ, আমি বুঝেছি। দেহরক্ষীরা হোটেলে ঢুকবে না। আমি একাই যাবো। হোটেলটা কোথায়? আমি এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছোচ্ছি।’

অভয় লোকেশান জানতে চাইছে। এই সমস্যার কথা ললিতা ভেবেছে। চিত্তুরের জঙ্গলে অভয়ের একাধিক পরিত্যক্ত করাত কল আছে। কোনটায় সে আসবে? ললিতা বলল, ‘এখানে মুন্নির লাশ পড়ে আছে বলে আকাশে চিল-শকুন উড়ছে। তুমি অনেক দূর থেকে বুঝতে পারবে।’

‘আমি রাখছি।’ ফোন কাটল অভয়। শিবমতীর দিকে ফিরে মৃদু হেসে বলল, ‘ললিতা আর মুন্নি ভেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে পুজো দিতে গিয়েছিল। ভেবেছিল হোটেলে চেক ইন করার পরে আমাদের ফোন করে চমকে দেবে। হোটেল যে শুধু ক্যাশে পেমেন্ট নেয়, ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড অ্যাকসেপ্ট করে না—এটা জানত না। এখন বিপদে পড়ে আমাকে ডাকছে।’

‘দুজনের ফোন এক সঙ্গে সুইচ্‌ড অফ কেন?’ হিশহিশ করে বলল শিবমতী, ‘তুমি আমার থেকে কিছু একটা লুকোচ্ছ। তুমি কখনও এত হেসে কথা বলো না। কী হয়েছে? আমাকে বলো!’

‘ওদের ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে। ওরা চার্জার নিয়ে বেরোয়নি। যাক গে! ওসব বাদ দাও। তুমি যাবে আমার সঙ্গে?’ আবারও মিথ্যে হাসি মুখে লটকে নিল অভয়। সে ভিতরে ভিতরে রাগে ফুটছে। নেহাত ললিতা বলেছে, তাই কথা শুনছে। অন্য কেউ হলে কিস্‌সু শুনত না। ইনস্যাস, একে ফর্টি সেভেন বা গ্লক নিয়ে করাত কলে ঢুকত, ডাইনে-বাঁয়ে গুলি চালিয়ে সব সাফ করে দিত। এত বছরের কেরিয়ারে অনেক খুন করেছে, সিরিয়াল কিলার খুন করা হয়নি। সেই ইচ্ছেও পূরণ হয়ে যেত।

‘তোমার মোবাইল ফোন নিয়ে যাও,’ হাঁপের টান শুরু হয়ে গিয়েছে শিবমতীর, ‘মেয়েকে খুব বকবে অবাধ্য হওয়ার জন্যে। আর আমাকে ফোন করে মেয়ের সঙ্গে কথা বলাবে।’

শিবমতীর কথায় কান না দিয়ে বাড়ি থেকে বেরোল অভয়। হুডখোলা জিপে উঠে বসল। এই জিপে ওঠা মানে সে নিজে গাড়ি চালাবে। অফিসে যায় কালো এসইউভি চেপে। দেহরক্ষীরা রুটিন জানে।

প্রোটোকল মেনে একজন দেহরক্ষী পাশে বসল। পিছনের আসনে বসল দুজন। চারটে কালো এসইউভি ভর্তি দেহরক্ষী তার পিছু নিল। প্রতি গাড়িতে সাতজন বডিগার্ড। অভয় জিপ চালিয়ে এগোল হাইওয়ের দিকে। সেখান থেকে চিত্তুরের জঙ্গলে পৌঁছোতে বড়জোর আধঘণ্টা লাগবে। তারপরে বুঝে নিতে হবে, কে বড়? ভয়, না অভয়!

বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে ঈশ্বরকে ডাকছে শিবমতী।

ছ’মাস আগে। দিল্লি

‘তারপর?’ হাসলেন রঞ্জিত, ‘শ্রীভেঙ্কটেশ ইউনিভার্সিটিতে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশানশিপ নিয়ে ডিসট্যান্ট লার্নিং কেমন চলছে, মিস মুন্নি শর্মা?’

হাসল প্রথমাও। বলল, ‘নেহাত লার্নিংটা ডিসট্যান্ট, তাই সব সময়ে চিত্তুরে থাকতে হচ্ছে না। সারাক্ষণ অন্ধ্রপ্রদেশে থাকলে গরমে সেদ্ধ হয়ে যেতাম। আয়েশাও দিল্লিতে কাজের চাপে মরে যেত।’

‘প্রগ্রেস রিপোর্ট কীরকম?’ রঞ্জিত এবারে নো-ননসেন্স মোডে।

‘আপনি অনেকটাই জানেন। আমি ললিতার থেকে বয়সে খানিকটা বড়। মুন্নি শর্মার ভুয়ো পরিচয় নিয়ে, বয়স ভাঁড়িয়ে ভর্তি হলাম শ্রীভেঙ্কটেশ ইউনিভার্সিটিতে, একই শিক্ষা বর্ষে। আমাদের বিষয়ও এক। দ্রুত ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করলাম। ও যেখানে পেয়িং গেস্ট থাকে সেই আস্তানায় চলে গেলাম রুমমেট হয়ে। লাকিলি আপনার এজেন্সির লোকজন সব ডকুমেন্ট নিখুঁত বানিয়ে দিয়েছিল। আমার বাবা, মা আর ভাইয়ের পরিচয়, দেশের বাড়ির ঠিকানা, কে কী করে—সব কিছু অথেনটিক।’

‘ললিতার সঙ্গে তোর, মানে মুন্নির বন্ধুত্ব হওয়া নিয়ে আমার সংশয় ছিল। এটা তো আর আগে থেকে হিসেব করা যায় না! এগুলো হয়ে যায়। চান্স ফ্যাক্টর!’

‘কোনও চান্স ফ্যাক্টর নেই স্যর। ললিতার মেন্টাল প্রোফাইল আমি নিজের হাতে বানিয়েছি। প্রিয় খাবার কার্ড রাইস, প্রিয় জাঙ্ক ফুড মেদু বড়া আর মুরুক্কু, প্রিয় পোশাক জিন্‌স আর কুর্তি, প্রিয় হিরো রাজকুমার আর কমল হাসান, প্রিয় হিরোইন ভানুশীলা আর আলিয়া ভাট, প্রিয় পলিটিশিয়ান বীরেন্দ্র মেহতা, পাশ করার পরে ও আমেরিকায় সেটল করতে চায়—সবই জানতাম। কাজেই আমিও এই জিনিসগুলোকে আমার ফেভারিট বানিয়ে ফেললাম। শুধু প্রিয় হিরোইন করে দিলাম দীপিকা পাড়ুকোনকে। সব জিনিসে মিল থাকা ঠিক নয়।’

‘তাও তো অভয় রেড্ডির বাড়ির চৌকাঠ পেরোতে পারলি না।’

‘পেরোতে চাই না,’ একটা ফাইল এগিয়ে প্রথমা বলল, ‘লোকটার মুখোমুখি হওয়ার কোনও ইচ্ছেই আমার নেই। অভয় রেড্ডি অত্যন্ত ডেঞ্জারাস। লোকটা আমার বাড়ির ঠিকানায় লোক পাঠিয়ে সব খবর নিয়েছে।’

‘জানি তো! আমাদের এজেন্সির লোকজন তোর বাবা, মা আর ভাই সেজে সব সামলে দিয়েছে। অভয়ের লোক কিছু বুঝতে পারেনি। কিন্তু তোর আসল কাজ শুরু হচ্ছে কবে?’

‘আর একটু সময় দিন স্যর।’ বলল প্রথমা, ‘আপনাকে যে ফাইলটা দিলাম, তাতে প্যারালাল ন্যারেটিভের ব্যাপারটা রয়েছে। বড় মিডিয়া হাউস বা টিভি চ্যানেলকে ম্যানিপুলেট করা যাবে না। তবে সোশাল মিডিয়াতে ঢেলে প্রচার করার ফলে ছোট মিডিয়া হাউসগুলো টোপ গিলছে। পাবলিকও হেভি খাচ্ছে। এই রকম আরও কয়েকটা ইনসিডেন্স হোক। লোকের মাথায় গেঁথে যাক ভয়ম কিলারের কথা।’

‘ভয়ম কিলারের আইডিয়াটা তোর মাথায় এল কী করে?’ হাসলেন রঞ্জিত।

‘ফিয়ার ফ্যাক্টরির এপিসোডগুলো দেখতে দেখতে। প্রথম এপিসোডেই যে ভাবে মাস্টার শঙ্করকে বার করে দিল বারোটা বাচ্চা মিলে, সেটা দেখে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। তখনই মনে হল, এই প্রতিযোগীরা এখন কোথায়? শুরু করলাম খোঁজ। এবং পাঁচজনের বেশি কাউকে ট্রেস করা গেল না। আপনি সমস্ত রিসোর্স কাজে লাগিয়েও পাঁচজনের বেশি কাউকে ট্রেস করতে পারেননি। যে আটজনকে ট্রেস করা যায়নি, তারা হল মাস্টার শংকর, হেমন্তিনী, শ্রীদীপ, তাজুদ্দিন, অনন্যা, দিব্যশক্তি, প্রিয়ঙ্কা আর মুন্নি শর্মা। এই আটটি কাল্পনিক চরিত্র নিয়ে আমি ভয়ম কিলারের গল্পটা বানাই। সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে মিথ্যেগুলো একে একে ছড়াতে থাকি। প্রথম মিথ্যে, হেমন্তিনীর খুন হওয়া। দ্বিতীয় মিথ্যে, অনন্যার প্রাণে বেঁচে যাওয়া। সোশাল মিডিয়ায় এই কথাটা রটানো যে কেউ একজন অনন্যাকে রাতের বেলা সাঁতার কাটতে বাধ্য করেছে। তিন নম্বর মিথ্যে, শ্রীদীপের খুন হওয়া। চার নম্বর মিথ্যে, দিব্যশক্তির প্রাণে বেঁচে যাওয়া এবং মিডিয়ার কাছে পাঠানো অডিও ক্লিপে বলা, কেউ একজন ওকে বলেছে ভয়কে জয় করতে পারলে বেঁচে যাবে। পাঁচ নম্বর মিথ্যে, তাজুদ্দিনের মার্ডার। ছ’নম্বর মিথ্যে, প্রিয়ঙ্কার অডিও ক্লিপ, ওকে দিয়ে শুটিং প্র্যাকটিস করিয়েছে কেউ একজন। সে বলেছে ভয়কে জয় করতে না পারলে নিজের মাথায় গুলি করতে হবে।’

‘খুব রিস্কি খেলা। বড় মিডিয়া হাউস ফ্যাক্ট চেক করলে আমরা বিপদে পড়তাম।’

‘কিস্‌সু বিপদে পড়তাম না। আমরা, মানুষরা, সত্যির থেকে মিথ্যেকে বেশি বিশ্বাস করি। ‘কেউ খুন হয়নি’ আর ‘সরকার একাধিক খুন ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে’—এই দুই ন্যারেটিভের মধ্যে মানুষ দ্বিতীয়টাই বিশ্বাস করবে। সব থেকে বড় কথা, আমাদের অনেক মানুষ নিয়ে কারবার নয়। আমাদের দরকার ললিতার মাথায় এটা ঢুকিয়ে দেওয়া যে একটা সিরিয়াল কিলিং চলছে। দীর্ঘ সময় ধরে ব্রেন ওয়াশ করতে হচ্ছে বলেই দুটি বছর লাগল কেস গুটিয়ে আনতে।’

‘এবারে তা হলে কী করবি?’

ঠান্ডা চোখে রঞ্জিতের দিকে তাকিয়ে প্রথমা বলল, ‘মাছ টোপ গিলেছে। বঁড়শি গলায় আটকেছে। ফাতনা এখনও নড়েনি। আর একটু সময় দিই। তারপরে ছিপ ধরে টান মারার পালা…’

এখন। চিত্তুরের জঙ্গল

চিত্তুরের এই জঙ্গলকে অভয় হাতের তালুর মতো চেনে। এখানেই সে ছোটবেলায় হামাগুড়ি দিত, বাবার কাঁধে চেপে চন্দন গাছ কাটার কায়দা শিখত, শিখত কীভাবে কাঠ চেরাই করতে হয়, কীভাবে হাতিকে গুলি করে মারতে হয়, কীভাবে হাতির দাঁত কাটতে হয়, কীভাবে মানুষ খুন করতে হয়…

পরের দিকে এই জঙ্গলে কত সরকারি আমলা আর রাজনীতিবিদ তার হাতে খুন হয়েছে, হিসেব নেই। আজ একটা ছুটকো সিরিয়াল কিলার মেয়েকে কিডন্যাপ করে এখানে লুকিয়ে রেখেছে। মেয়ের বন্ধুকে গুলি করে মেরেছে। ভয়ম কিলার জানে না, কার সঙ্গে পাঙ্গা নিয়েছে!

জিপ থেকে নেমে, গ্লক হাতে নিয়ে জঙ্গলের চেনা রাস্তা দিয়ে এগোল অভয়। আঙুলের ইশারায় দেহরক্ষীদের বুঝিয়ে দিল কী করতে হবে। ইঙ্গিত বুঝে চারটে এসইউভি দুদিকে চলে গেল। অভয়ের জিপের তিন দেহরক্ষী গাড়িতেই বসে রইল।

জঙ্গলের গভীরে ঢুকল অভয়। মাথার ওপরে শকুন আর চিল পাক খেতে খেতে নেমে আসছে। ওদের দেখে বোঝা যাচ্ছে, মুন্নির লাশ কোথায় আছে।

পরিত্যক্ত করাত কলে ঢোকার অজস্র রাস্তার মধ্যে সব চেয়ে দুরূহ এবং গোপন পথটি বেছে নিল অভয়। এটা দিয়ে ঢুকলে সরাসরি দোতলার বারান্দায় চলে যাওয়া যায়। ওপরে থাকা মানে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা। বারান্দা থেকে নীচে তাকিয়ে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল অভয়ের। করাত কলের বেঞ্চিতে পাশ ফিরে শুয়ে রয়েছে তার আদরের ধন ললিতা। মাথার ওপরে ঝুলছে জং ধরা, পুরোনো আমলের করাত। মুন্নির লাশ পড়ে রয়েছে একটু দূরে। সেদিকে তাকিয়ে ললিতা কাঁদছে।

অভয় আর পারল না। সব কিছু ভুলে লোহার ভাঙাচোরা সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে নীচে নামল। বুটের হিলের সঙ্গে লোহার সংঘর্ষে চারদিক কেঁপে উঠছে। যদি কেউ লুকিয়ে থাকে, তা হলে সে শুনতে পাবে।

শুনতে পেলে পাক। ভয়ম কিলারকে ফুঁড়ে দিতে এক সেকেন্ড সময় লাগবে। গ্লক উঁচিয়ে ললিতার কাছে গেল অভয়। তাকে দেখে ললিতা ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, ‘বাবা!’

মেয়েকে পাঁজাকোলা করে সরাতে যেতেই সে চিৎকার করে বলল, ‘উফ্‌! হাতে লাগছে!’

অভয় চমকে উঠে বলল, ‘ওহ্‌! তাই তো! হাতকড়া! চাবি কোথায়?’

‘ওই যে!’ করাতের দিকে আঙুল দেখায় ললিতা, ‘লিউকোপ্লাস্ট দিয়ে আটকানো আছে।’

‘আমি পাড়ছি। তুই বেঞ্চি থেকে নাম। পুরোনো বেঞ্চি দুজনের ওজন নিতে পারবে না।’ ললিতাকে কোলে করে বেঞ্চি থেকে নামাচ্ছে অভয়।

‘আমি নামব না।’ আপত্তি করে ললিতা। ‘আমি তোমার পা ধরে তোমাকে স্টেডি রাখব।’

অভয় তড়াক করে বেঞ্চিতে উঠেছে। ললিতা তার পা ধরে আছে। হাত উপরে তুলে লিউকোপ্লাস্টে টান মারছে অভয়।

এমন সময় মুন্নির গলা শোনা গেল, ‘ললিতা! তুই…নেমে…যা…’

‘ভূত! ভূ-উ-ত!’ কাঁপতে কাঁপতে বেঞ্চি থেকে নামছে ললিতা। দেখছে, মৃত মুন্নি উঠে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে একটা পিস্তল। ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে আর একটি মেয়ে। তার হাতে রিমোট কনট্রোলের মতো দেখতে একটা যন্ত্র। ওদের দেখে চিল আর শকুন ভয়ের চোটে ডানা ঝাপটে পালাচ্ছে। ওদের ধারালো ঠোঁট থেকে ঝুলছে ছাগলের পা এবং নাড়িভুঁড়ি। অভয় গ্লক তাক করেছে মুন্নির দিকে।

ঠিক এই সময় করাতটি নেমে এল ডেমোক্লিসের খড়্গের মতো।

এখন। দিল্লি

‘যাক! ভালোয় ভালোয় ঝামেলা মিটল।’ সাউথ ব্লকের অফিসে বসে অভয় রেড্ডির ফাইল ক্লোজ করে বললেন রঞ্জিত। ‘অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু আর কেরলের পুলিশ খুব খুশি। নেতারাও খুশি। দিল্লির পাওয়ার করিডোরের সব্বাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বীরেন্দ্র মেহতা আর রাষ্ট্রপতি জিতু কেডিয়ার প্রশংসা করছেন।’

‘আপনার প্রশংসা কেউ করছে না। এতে আপনার মন খারাপ হচ্ছে না?’ জানতে চায় প্রথমা।

‘এটা আমাদের কাজ প্র্যাট। প্রশংসা, খ্যাতি বা যশের জন্য এসব করি না।’

‘জানি,’ প্রসঙ্গ বদলে প্রথমা বলল, ‘আপনার কোনও প্রশ্ন থাকলে বলুন। একটু পরেই তো আপনাকে কেসটা প্রেজেন্ট করতে হবে। তখন প্রধানমন্ত্রী আর রাষ্ট্রপতির প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারলে বিপদ!’

‘অনেকগুলো প্রশ্ন আছে,’ বললেন রঞ্জিত, ‘প্রথম প্রশ্ন, এত জটিল ভাবে মারার প্ল্যান করলি কেন? ওখানে আসা মাত্র অভয়কে গুলি করে মারলেই তো পারতিস। নতুন করাত কিনে, সেটাকে পুরোনো আমলের জং ধরা করাতের চেহারা দেওয়া কি খুব জরুরি ছিল?’

‘খুন একটা শিল্প স্যর। চন্দন দস্যুর মৃত্যু হয়েছে করাতে দু’আধখানা হয়ে। এবং তার মেয়ে বলছে, ‘এটা খুন!’ এর আলাদা ইমপ্যাক্ট আছে। ওই ট্রেডের বাকি লোকেরা ভয়ের চোটে এই লাইনে আর থাকবে না। ওদের কাছে এই মার্ডার একটা বড় শিক্ষা।’

‘যে লোকটা ললিতার মাথায় কাপড় চাপা দিয়ে ডান্ডা মেরেছিল, সে কে?’

‘ওটা আয়েশা। ছেলে সেজে আমার সঙ্গে ছিল। মাথার কোনখানে কতটা জোরে মারলে কতক্ষণ অজ্ঞান থাকবে, এই জ্ঞান সাধারণ মানুষের থাকে নাকি?’

‘বাজার থেকে একটা ছাগল কাটিয়ে নিয়ে গেলি কেন?’

‘মুন্নির ডেথকে রিয়ালিস্টিক করার জন্যে। যতই মরা সৈনিকের ভূমিকায় অভিনয় করি না কেন, অতক্ষণ শুয়ে থাকলে হালকা নিশ্বাস প্রশ্বাস চলবেই। বুকও ওঠানামা করবে। ললিতার সন্দেহ হতে পারত যে আমি মরিনি। আকাশ থেকে শবভোজী পাখিরা নেমে এলে কোনও সন্দেহ থাকে না। ওরা মৃত্যুর গন্ধ পায়। সেকেন্ড পয়েন্ট হল, পাখিগুলো জিপিএস-এর কাজ করবে। এটা অভয়ও জানে। চিত্তুরের জঙ্গল বিরাট বড়। সেখানে ওর অনেকগুলো পরিত্যক্ত করাত কল আছে। ঠিক কোনটায় যেতে হবে, সেটা বোঝানোর জন্যে ওই মরা ছাগলটার দরকার ছিল।’

‘ওখানে একটা হেলিকপ্টার আগে থেকে রেখে ভালো করেছিলি। তুই আর আয়েশা পালাতে পেরেছিস। তোদের এয়ারলিফ্‌ট করার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অভয় রেড্ডির আঠাশটা স্যাঙাত ওখানে পৌঁছে গিয়েছিল।’ এক চুমুক জল খেয়ে রঞ্জিত বললেন, ‘ললিতাকে যে বেসিক মোবাইলটা দেওয়া হয়ে ছিল, তাতে শিবমতীর নাম রেখেছিলি কেন?’

‘শিবমতী নিয়ে আমার রিসার্চ বলছে যে ওর মানসিক সমস্যা আছে। মেয়ের কিডন্যাপিং-এর কথা শুনলে ও অসুস্থ হয়ে পড়বে। কিন্তু ললিতা জানত না যে এই তথ্য আমি জানি। চিঠিতে শিবমতীর নাম জুড়ে দিয়েছিলাম, যাতে ললিতার সন্দেহ না হয় যে কেউ ওর বাবাকে ট্র্যাপে ফেলার চেষ্টা করছে। বাই দ্য ওয়ে, শিবমতী এখন মেন্টাল অ্যাসাইলামে। তবে ললিতা ঠিক আছে।’ চেয়ার থেকে উঠে প্রথমা বলল, ‘আমি তাহলে আসি স্যর। আপনার মিটিং শুরু হতে আর দু-মিনিট বাকি।’

‘তুই আর আয়েশা একবার বাড়ি থেকে ঘুরে আয়,’ হাত নাড়লেন রঞ্জিত, ‘তারপরে তোদের অন্য কাজ দেব।’

প্রথমা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘এবারে কে?’

রঞ্জিত মুচকি হেসে বললেন, ‘দেখা যাক!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *