রইল না আর কেউ

রইল না আর কেউ

সিনচান। পিজিং

টিভির পর্দায় সিনচান রাষ্ট্রের চেয়ারম্যান লি ঝাউয়ের মুখ। ক্যামেরার লেন্সের দিকে তাকিয়ে, টেলি প্রম্পটারের লেখা পড়ছেন তিনি। বক্তব্যের সঙ্গে মেশাচ্ছেন অভিনয়। কপালে ভাঁজ পড়ছে, ভ্রু কুঞ্চিত, নাকের পাটা ফুলে যাচ্ছে, ঘাড় ঝুঁকিয়ে শ্বাস নিচ্ছেন তিনি। বোঝা যাচ্ছে, কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। প্রতিটি দেশে এমন এক ক্রান্তিকাল আসে, যখন দেশের প্রধানকে এই অভিনয়টি করতে হয়। যখন তিনি বুঝে যান বিপদ আসন্ন, গদি ছাড়ার সময় হয়েছে।

গদি, ক্ষমতা, শক্তি, পাওয়ার! কে আর কবে ছাড়তে চেয়েছে? বিশেষত সিনচানের মতো দেশে, যেখানে সিনচান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির আধিপত্য কায়েম থাকে দশকের পর দশক জুড়ে। বিরোধী দলের যেখানে অস্তিত্বই নেই।

এমন জায়গায় পার্টির নেক্সট ইন কমান্ড, সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের উপপ্রধান চ্যাং ওয়াং রাষ্ট্রপ্রধানের পদ গ্রহণ করবেন। সিনচান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যান লি ঝাউ অবসর নেবেন। দেশের সব থেকে ক্ষমতাবান মানুষ থেকে হয়ে যাবেন আম জনতা। পার্টি যদি মনে করে তাঁর বেঁচে থাকা দেশের পক্ষে ক্ষতিকর, তা হলে পৃথিবী থেকে সরে যেতে হবে। কেউ কোনও প্রশ্ন করবে না। লি নিজেই তো তাঁর আগের রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করিয়েছেন।

কিন্তু লি খুন হতে চান না। লি অবসর নিতে চান না। লি ক্ষমতায় থাকতে চান। লি ফিরে পেতে চান ফ্রিদাকে, তাঁর বুড়ো বয়সের প্রেমকে। এই সব কিছুর জন্যে চাই ছল, বল এবং কৌশল। এই টিভি শো সেই কৌশলের অংশ। ছল ও বলের প্রয়োগ এর পরেই হবে।

‘তুইঘুর প্রদেশের জাতিহত্যার জন্যে কারা দায়ি কমরেডস? আমি? সিনচান ডেমোক্রাটিক পার্টি? চ্যাং ওয়াং? না আমাদের পলিট ব্যুরো? কেউ না! পুরোটাই মার্কিনি চক্রান্ত। সি আই এ-র গুপ্তচর এসে দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন বিভেদ ছড়াল যে ওরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরে গেল! মাত্র দশদিনের মধ্যে পঞ্চাশ হাজার মানুষের মৃত্যু! ভাবা যায়? পুরো রাজ্যটা “ওরা” দখল করে নিয়েছিল। যাকে বলে মুক্তাঞ্চল! আমাদের থানা-পুলিশ, আইন-আদালত, স্কুল-কলেজ ওরা দখল করে নেয়। ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়, মিডিয়ার প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আমরা জানতেই পারিনি দশ দিন ধরে ওখানে কী হয়েছে…’ টেলি প্রম্পটারের শেখানো মিথ্যে বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন লি। প্রম্পটার বলছে, ‘আট সেকেন্ডের জন্যে কাঁদুন। এবার নিজেকে সামলে নিয়ে চোয়াল শক্ত করুন। এবার বলুন।’

‘পাশাপাশি রয়েছে অর্থনৈতিক সমস্যা। এটা সত্যি যে বাজেট অনুযায়ী যে পরিমাণ অর্থ শিক্ষা খাতে ব্যয় করার কথা ছিল, সেটা করা যায়নি। কিছু অসঙ্গতি থেকে গেছে। সবাই ভাবছেন অসঙ্গতির জন্যে আমি দায়ী। সবিনয়ে জানাই, যাঁরা এটা রটাচ্ছেন…’ পর্দার নির্দেশ মেনে তর্জনী সামনের দিকে প্রসারিত করেছেন লি, ‘তাঁদের আমি চিনি, তাঁরা মিথ্যে কথা বলছেন, ভুল রটাচ্ছেন, আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন। আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মুখরোচক চুটকি বাজারে ঘুরছে। আপনারা ভাবতে পারেন কমরেডস, সিনচান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রধানের নামে কুৎসা রটছে?’

আবার চোখের জল। মেপে, সময় হিসেব করে। আবার চোয়াল শক্ত করে কাল্পনিক শত্রুর বিরুদ্ধে চেতাবনি দিলেন লি, ‘আমি কাউকে ছেড়ে দেব না। আমাকে মাত্র দু-মাস সময় দিন। এই ষড়যন্ত্রের আমি শেষ দেখে ছাড়ব।’

বক্তব্য শেষ। পার্টির ভিডিওগ্রাফার ও চিত্রপরিচালক কমরেড লিকে অভিবাদন জানিয়ে বিদায় নিল পিজিং শহরের জেমলিন স্ট্রিটের প্রাসাদ থেকে।

আজ তেসরা ফেব্রুয়ারি। ওরা যাওয়ার পরেই প্রাসাদ থেকে বেরলেন লি। গাড়ি করে চললেন পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরের হুয়ান রাজ্যে। সেখানেই রয়েছে সিনচানের একমাত্র ইনফেকশাস ডিজিজ ল্যাবরেটরি।

সিনচানবাসীর খাদ্যাভাসের বৈশিষ্ট্য হল, তারা সর্বভূক। পৃথিবীতে এমন কোনও প্রাণী নেই, যা তারা খায় না। পোকামাকড় থেকে শিম্পাঞ্জি-গরিলা, সবই খাদ্য। মাত্র কিছুদিন আগে বাঘের শরীরের একটি অংশ খেতে চেয়েছিলেন লি। ভিন দেশে বাঘ মারতে গিয়ে শিকারি ধরা পড়ায় সব তথ্য ফাঁস হয়ে যায় এবং সেই নিয়ে সিনচানে তোলপাড় শুরু হয়। অনেক কষ্টে সেটা সামলানো গেছে।

মোদ্দা কথা হল, পশুপাখি ও পোকামাকড়ের সঙ্গে মানুষের এই ঘনিষ্ঠ মেলামেশার ফলে ওদের শরীর থেকে অনেক ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস আর পরজীবী মানুষের দেহে চলে আসে। যে জীবাণু পাশুপাখির দেহে সহাবস্থান করে, মানুষের শরীরে প্রবেশ করে তারাই নানান রোগ তৈরি করে। পশু থেকে মানুষের মধ্যে এই সংক্রমণকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘জুনোসিস।’ হুয়ান ল্যাবের প্রধান, পঞ্চান্ন বছরের শি ঝেংলি এই বিষয়ে সব থেকে অভিজ্ঞ গবেষক। মহিলার সংগ্রহে কত যে ভাইরাস আছে, তার হিসেব নেই। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে আপাত-নির্বিষ ভাইরাস বা ব্যাক্টিরিয়াকে প্রাণঘাতী করে তোলার গবেষণা চালানোর জন্যে অতীতে তিনি লিয়ের কাছে অর্থ সাহায্যের আবেদন করেছিলেন। রিসার্চের কাজে অর্থ সাহায্য রাষ্ট্রের মৌলিক ধর্মের মধ্যে পড়ে বলে মনে করেন লি। তিনি সাহায্য করেছিলেন। সেই সাহায্যের প্রতিদান চাইতে আজ লি যাচ্ছেন হুয়ান ল্যাবে।

‘মানুষ যখন চায় বস্ত্র ও খাদ্য, সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাদ্য!’ হাসতে হাসতে বললেন শি, ‘সরকার পতনের সম্ভাবনা দেখা দিলে ‘প্রতিবেশী দেশের আক্রমণ’ বেড়ে যায়। এই ন্যারেটিভ বা আখ্যান এখন পুরোনো হয়ে গেছে। জনগণ বুঝতে পারে। তাই আপনি নতুনতর আখ্যান চাইছেন, তাই তো?’

‘হ্যাঁ এবং না।’ গম্ভীর মুখে বললেন লি, ‘এমন কোনও ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়া আপনার কাছে আছে, যার কথা মানব সমাজ এখনও জানে না। যা ছড়িয়ে পড়ে অতি দ্রুত। শরীরে ঢোকার পরে যা মানুষকে মেরে ফেলে না কিন্তু খুবই অসুস্থ করে দেয়, যার টিকা এখনও আবিষ্কার হয়নি।’

‘আমার কাছে যত ভাইরাস আছে, তারা সব এই রকম।’ তর্জনী দিয়ে বায়োসেফটি লেভেল ফোর তকমা লাগানো একটি ঘরের দিকে ইঙ্গিত করলেন শি। ‘মুশকিল হল, মানুষ মরবে না বাঁচবে—এটা জানা হয়নি। কারণ মানুষের শরীরে এদের কখনও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। যা কিছু পরীক্ষা হয়েছে, সবই ল্যাবরেটরি অ্যানিমালের ওপরে। তাদের কেউ কেউ মারা গেছে, কেউ কেউ কোনও রোগলক্ষণ দেখায়নি। আমি আপনাকে সাজেস্ট করব নোভিড ভাইরাস ব্যবহার করতে।’

মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবলেন লি। বললেন, ‘রিস্ক নিতেই হবে। নোভিড ভাইরাস ডায়াগনোজ করার কোনও ব্যবস্থা কি আপনার কাছে আছে?’

‘সেটা অবশ্যই আছে।’

‘বাজারে এখন পাওয়া যায় না, এটা বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ দরকার পড়লে এক বা দু-মাসের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে তৈরি করা যাবে? এই দেশে বা বিদেশে?’

এত ক্ষণে ভুরু কুঁচকেছে শি-র, ‘আমি ভাবছিলাম ভোটে জেতার জন্যে আপনি একটা ন্যারেটিভ চাইছিলেন। ‘গোটা সিনচান জুড়ে হেল্‌থ এমার্জেন্সি! লিয়ের নেতৃত্বে সমস্যর সমাধান হচ্ছে।’ কিন্তু এটা তো আর সিনচানের ন্যারেটিভ রইল না। ইন্টারন্যাশনাল হেল্‌থ ক্রাইসিস হয়ে যাচ্ছে। আমাকে আর একটু বলুন কমরেড!’

ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবলেন লি। অবশেষে বললেন, ‘আপনাকে বলতে আমি বাধ্য। কারণ পরে আপনাকে ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া হ্যান্ডল করতে হবে। আমার মূল শত্রু হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমার মতো আরও দুটি দেশের পিছনে লেগেছে ওই দেশের জন বাইডেন এবং তার পা-চাটা কুত্তা সি আই এ এবং পেন্টাগন। দেশদুটি হল ওয়ারিস্তান ও ব্রাজিল।’

‘ওয়ারিস্তান কেন?’

‘ওখানকার প্রধানমন্ত্রী ইমরোজ অর্থনৈতিক দুরবস্থা সামলাতে পারছেন না। তিনি ভেবেছিলেন সদ্য আবিষ্কৃত একটি ওষুধ তৈরির কারখানা খুলে ঋণশোধ করবেন। সেই প্ল্যান ভেস্তে দিয়েছে আমেরিকা ও ইন্ডিয়া। তারপরে ইমরোজের কাছে দুটো অপশন ছিল। হয় আই এম এফ-এর কাছ থেকে ঋন, না হয় সিনচান থেকে। ইমরোজ ঋণ নিয়েছে আমাদের কাছ থেকে। কাজেই ওয়ারিস্তান আর সিনচান এখন বন্ধু। আপনার ওই ভাইরাস নির্ণয় করার জন্যে যে কারখানার প্রয়োজন, সেটা হবে ওয়ারিস্তানে। যাতে ওদের অর্থনীতি সবল হয়, যাতে ওরা ভারত ও আমেরিয়ার বিরুদ্ধে আবার লড়াই শুরু করতে পারে।’

‘ব্রাজিল কেন?’

‘ব্রাজিলের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট লোবোসোনারো আমার বন্ধু। প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ানোর সময় ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে ভোটে জিতলে আমাজন রেন ফরেস্টের উন্নয়ন ঘটাবে। ভোটে জেতার পরে অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতার জন্যে জঙ্গল কেটে সাফ করে মাইনিং-এর কাজ চালু করেছে, দাবানল তৈরি করে বিস্তীর্ণ এলাকার গাছপালা সাফ করেছে। এই সময়ে আবারও আমেরিকা আর ভারত মিলে এমন একটা ঘটনা ঘটায় যে লোবোসোনারোর অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার চাপ, বিরোধীদের আন্দোলন সামলাতে সামলাতে তার অবস্থা খারাপ। কাজেই আমি, ইমরোজ আর লোবোসোনারো এখন পরস্পরের বন্ধু। আর আমাদের কমন টার্গেট হল ইন্ডিয়া আর আমেরিকা। আপনার তৈরি করা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পরে আমি হেল্‌থ ইমার্জেন্সি ইস্যুতে ভোটে জিতব। ডায়াগনস্টিক কিট ম্যানুফ্যাকচার করে ওয়ারিস্তান অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন হবে। আর টিকা আবিষ্কার ও বিক্রি করে লোবোসোনারো মানুষের আশীর্বাদ পেয়ে প্রেসিডেন্ট পদ ফিরে পাবে।’

‘নোভিড ভাইরাসের টিকা এখনও আবিষ্কার হয়নি কিন্তু কমরেড।’

‘আপনি আমাকে এক ভায়াল ভাইরাস দিন। আমি সেটা পিজিং-এর বাজারে ছড়িয়ে দিই। এটা লোকাল ইনফেকশান থেকে রাজ্যব্যপী ইমার্জেন্সি হতে মাস চারেক নেবে। তার মধ্যে আপনি টিকা বানিয়ে ফেলুন কমরেড।’

বায়ো সেফটি ফোর ল্যাবে ঢোকার জন্যে পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট পরতে হয়। ধরাচূড়া গলিয়ে সেখানে ঢুকলেন শি। মিনিট পনেরো পরে একটি সেলাই মেশিনের মতো বড় বাক্স নিয়ে বেরোলেন। বললেন, ‘কোল্ড চেন মেনটেন করে ভায়ালটা দিলাম। পিজিং মার্কেটের যেখানে বাদুড় বিক্রি হয়, সেখানে কারও গায়ে ভায়াল খালি করে দেবেন। আর যাকে দিয়ে কাজটা করাবেন, সে যেন পিপিই পরে থাকে।’

লি জানেন কাকে দিয়ে কাজটা করাবেন। তিনি কথা না বাড়িয়ে, বাক্সটি নিয়ে হুয়ান ল্যাব থেকে বেরিয়ে এলেন।

রাষ্ট্রপতির প্রাসাদের ঝাড়ুদার ৫ ফেব্রুয়ারি কেন যে পিজিং বাজারে বাদুড়ের মাংস কিনতে গিয়েছিল কে জানে! ওখান থেকে বেরোনোর পরে তাকে আর পাওয়া যায়নি। পরে, পিজিং হাসপাতাল সংলগ্ন মিরামাও জঙ্গলে তার পুড়ে যাওয়া লাশ পাওয়া যায়। ওই জঙ্গলে খুচখাচ দাবানল হয়। এই ঘটনা এতই সামান্য যে খবরের কাগজে এই নিয়ে একটা শব্দও খরচ করেনি।

তবে সেই ঘটনার এক মাস পরে হুয়ান প্রদেশের মাংসের বাজার খবরে উঠে এল সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। চৌঠা মার্চ ওখানকার এক বাদুড়ের মাংস বিক্রেতার মৃত্যু হয়েছে শ্বাসকষ্টের ফলে।

ভারতবর্ষ। দিল্লি

রঞ্জিত গগৈয়ের অফিসে ঢুকে প্রথমা বলল, ‘স্যর, সুপ্রভাত।’

রঞ্জিত মাস্ক পরে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়েছিলেন। আড়চোখে দেখে নিলেন প্রথমা মাস্ক পরে আছে কি না। তারপরে বললেন, ‘রাস্তাঘাটের কী অবস্থা?’

‘শুনশান! এরকম আরও কয়েকদিন থাকলে দিল্লির এয়ার পলিউশান শূন্য হয়ে যাবে স্যর। অনারেব্‌ল প্রাইম মিনিস্টারকে বলুন লকডাউন আরও কিছুদিন বাড়াতে।’

ইয়ার্কি না শুনে রঞ্জিত বললেন, ‘আয়েশা কোথায়?’

‘ও বাড়ি গিয়েছিল। সে সময় লকডাউন শুরু হয়। বাড়িতেই রয়েছে। তবে ও তো দিল্লির মেয়ে। ডাকলেই চলে আসবে। আমি ইচ্ছে করে ডাকিনি। ওয়ার্ক ফ্রম হোম নামে যে নতুন কাজের কালচার শুরু হয়েছে, সেটাই ও করছে। জুম অ্যাপটা ইনস্টল করে নিয়েছে বাড়ির মেশিনে। ভিডিও কলে চমৎকার মিটিং হচ্ছে ওর সঙ্গে। রিসার্চের কাজ বাড়ি থেকেই করে দিচ্ছে।’

‘নোভিড প্যানডেমিক নিয়ে কী মনে হচ্ছে?’

‘সিনচানের রাষ্ট্রপ্রধান তো ভেউ ভেউ করে কাঁদছেন টিভি ক্যামেরার সামনে। বলছেন যে এই ভাইরাসের জন্ম আমেরিকার ল্যাবরেটরিতে। ওরাই জেনেটিকালি মডিফায়েড ভাইরাস সিনচানে ছড়িয়ে বায়োলজিকাল ওয়ারফেয়ার শুরু করেছে। লি এর শেষ দেখে ছাড়বেন।’

‘এটা আমিও জানি।’

‘নোভিড ভাইরাসের আউটব্রেক অফিসিয়ালি শুরু হয় চৌঠা মার্চ। এক মাংস বিক্রেতার মৃত্যুর পরে মানুষের মধ্যে হাসপাতালে যাওয়ার জন্যে হুড়োহুড়ি দেখা যায়। সেদিন হুয়ানের মাংসের বাজারের অন্তত পাঁচজন শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। কিন্তু পিজিং-এর স্যাটেলাইট মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে এর দশদিন আগে, চব্বিশে ফেব্রুয়ারি হাসপাতালের সামনে টানা চারদিন ধরে গাদাগাদা অ্যাম্বুল্যান্স জড়ো হয়েছিল। ওগুলো কেন এসেছিল, কাদের নিয়ে এসেছিল, তারা কেন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল—কিছুই জানা যাচ্ছে না। আয়েশা প্রচুর ডকুমেন্ট জোগাড় করেছে, যার থেকে প্রমাণ হয় যে ভাইরাসটি হুয়ানের ল্যাবে তৈরি করার পরে হুয়ানের মাংসের বাজারে সচেতন ভাবে ছড়ানো হয়েছে। পৃথিবীব্যাপী এই প্যানডেমিক ও লকডাউনের মূলে আছে সিনচানের হুয়ান ল্যাব।’

‘ডকুমেন্ট মানে কী? নির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া কাউকে দোষী বলা যায় না।’

‘হুয়ানের এক টিকটকার নিয়মিত ভিডিও আপলোড করতেন। তাতে দেখা যেত লোকজন রাস্তায় শ্বাসকষ্টে মারা যাচ্ছে, হাসপাতালে ভিড় উপচে পড়ছে, অসুস্থরা চিকিৎসার দাবিতে মিছিল করলে তাদের ওপরে গুলি চালানো হচ্ছে। সেই টিকটকার এখন নিরুদ্দেশ। তাঁর প্রোফাইলও আর দেখা যাচ্ছে না।’

মৃদু হেসে রঞ্জিত বললেন, ‘ওই ডকুমেন্ট আমার কাছেও এনক্রিপ্টেড মেলে এসেছে। কিন্তু আমি তোকে অন্য খবর দিতে চাই।’

আর্দালি এসে চা আর কুকি দিয়ে গেছে। চায়ে চুমুক দিয়ে রঞ্জিত বললেন, ‘গতকাল আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে সিনচানের সেকেন্ড ইন কমান্ড, সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের উপপ্রধান চ্যাং ওয়াং ফোন করেছিলেন।’

রঞ্জিতের চেয়ারের পিছনে যে দেওয়াল, সেখানে বসানো মনিটরে ফুটে উঠেছে বছর পঁয়তাল্লিশের এক ভদ্রলোকের ভিডিও। উনি যে মিলিটারি সার্ভিসে আছেন সেটা উচ্চতা, হাঁটাচলা, পেশী ও চুলের ছাঁট দেখেই বোঝা যায়।

রঞ্জিত বললেন, ‘সিনচানের মিলিটারি সার্ভিসের প্রধান পদটি রাজনৈতিক হলেও উপপ্রধান মনোনীত হন আর্মির লোক। খুব কম বয়সে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হয়ে চ্যাং খুশি। কিন্তু বাকি জীবনে উন্নতির সুযোগ নেই, এই ভেবে বিরক্ত। বিরক্ত লিয়ের কার্যকলাপ নিয়েও। উনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য চেয়েছেন। বলেছেন কাউকে সিনচানে পাঠাতে।’

‘বিশ্বজোড়া লকডাউনের মধ্যে সাহায্য?’ চায়ে চুমুক দিয়ে ভুরু কুঁচকোয় প্রথমা। ‘যাবতীয় আন্তর্জাতিক উড়ান এখন বাতিল। কে যাবে? কী করে যাবে?’

‘প্রথমা, আমি আশা করিনি যে তুই এই তথ্যটা জানিস না। কারগো এবং মিলিটারি ফ্লাইট কখনও বন্ধ হয়নি। হবেও না। বিদেশ থেকে ভারতীয়দের এদেশে নিয়ে আসা এবং বিদেশিদের নিজের দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে “অপারেশান সমুদ্র সেতু” সদ্য শেষ হল। তাই না?’

লজ্জায় জিভ কাটল প্রথমা। এটা তার মনে ছিল না।

‘একটা কাজ আয়েশা একা করেছিল। এই কাজটা তুই একা করবি। ঠিক আছে?’

প্রথমা চুপ।

‘তোর সঙ্গে কি আয়েশার কোনও ঝামেলা হয়েছে?’ প্রশ্ন করলেন রঞ্জিত।

‘এই কথা কেন জিজ্ঞাসা করলেন স্যর?’

‘সুন্দরবনের মিশনটায় তোকে ডেকে ডেকে পাওয়া যায়নি। এটা তো আর দশটা-পাঁচটার চাকরি নয়!’

প্রথমা মাথা নিচু করে বলল, ‘সরি স্যর!’

‘যাই হোক! এই মিশনে তোকে একা যেতে হবে। এবং রাষ্ট্রপ্রধান লিকে অ্যানিহিলেট করতে হবে।’

আঁতকে উঠে প্রথমা বলল, ‘আমি তো তাঁর কাছেই পৌঁছোতে পারব না।’

‘সেটা যাতে পারিস তার ব্যবস্থা চ্যাং আর ফ্রিদা করবেন।’

মনে একাধিক প্রশ্ন জমেছে। প্রথম প্রশ্নটি করল প্রথমা, ‘চ্যাং-এর এত উৎসাহ কেন?’

‘লোকটি সোজাসাপটা কথা বলেন। উনি বলেছেন, রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার এটাই হল আদর্শ সময়। ভোটের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি। লিয়ের জনপ্রিয়তা পার্টি ও জনগণের মধ্যে অল টাইম লো। ভোটে উনি হারবেন—এটা নিশ্চিত। সেই জন্যে নোভিড তাস খেলে দিয়েছেন। ভোট অনির্দিষ্টকালের জন্যে পিছিয়ে গেল। লোকের ক্ষোভ অতদিন থাকে না। লি আবার জিতে যাবেন। এটা চ্যাং চান না। উনি লিয়ের দ্বিতীয় দুর্বলতাটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন।’

‘প্রথমটা কি ক্ষমতালিপ্সা?’

‘একদম। আর দ্বিতীয়টি হল মেয়েদের প্রতি লোভ। এই প্রসঙ্গেই ফ্রিদা মেয়েটি তোর জোটসঙ্গী হচ্ছে।’

‘সে কে?’ একটা কুকি মুখে দিয়েছে প্রথমা।

মনিটরে ফুটে উঠেছে অপূর্ব সুন্দরী একটি মেয়ের ছবি। সেটা দেখিয়ে রঞ্জিত বললেন, ‘তুইঘুর প্রদেশের বাসিন্দা ফ্রিদাকে নিজের প্রাসাদে তুলে এনেছিলেন লি। মেয়েটিকে বিয়েও করতেন হয় তো। কিন্তু আয়েশা সুন্দরবনে এমন একটা কাণ্ড ঘটাল যে বিয়ে ক্যানসেল হয়ে গেল।’

সুন্দরবনে কী হয়েছিল, আয়েশার মুখে শুনেছে প্রথমা। তাই সে পিতাসম রঞ্জিতের দিকে না তাকিয়ে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘বুঝেছি। কিন্তু সে মেয়ে তো পলাতক।’

‘ফ্রিদা আদতে চ্যাং-এর সঙ্গে পালায়। সে এখন থাকে চ্যাং-এর বাসভবনে। চ্যাং-এর স্ত্রী ফ্রিদাকে লুকিয়ে রেখেছে। জাতিদাঙ্গার নাম করে তুইঘুরের প্রচুর বাসিন্দাকে খুন করেছেন লি। ফ্রিদা এর প্রতিশোধ চায়। আর চ্যাং চায় ফ্রিদাকে ব্যবহার করে লিকে সরাতে। সেই কারণের চ্যাং ওয়াং আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছিল।’

এক চুমুকে চা শেষ করে প্রথমা বলল,

‘হারাধনের একটি ছেলে

কাঁদে ভেউ ভেউ,

মনের দুঃখে বনে গেল

রইল না আর কেউ…

ছড়াটা মনে পড়ে গেল। আমাদের প্রধানমন্ত্রী দশজনকে সরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন কাইমেরা ভার্সন টু-কে। এই কেসটা হয়ে গেলে কাইমেরা ভার্সান টুয়ের কাজ শেষ হয়ে যাবে। তারপর?’

‘পরের কথা পরে ভাবা যাবে। আগে কাজ শেষ কর।’

‘আমাকে কী করতে হবে বলুন।’

‘কাল একটা কার্গো যাচ্ছে পিজিং-এর উদ্দেশে। ওতে তুই বেরিয়ে যা। ডকুমেন্ট যা লাগবে, বানিয়ে নে। ওখানে পৌঁছোলে চ্যাং তোর দায়িত্ব নেবে। বাকিটা… তুই জানিস।’

‘একে নোভিড অতিমারি, তার ওপরে লকডাউন। যাচ্ছি বিশ্বের সব থেকে খতরনাক রাষ্ট্রপ্রধানকে অ্যানিহিলেট করতে। ডিপার্টমেন্টের সাপোর্ট বলতে মিথ্যে পরিচয়পত্র প্রোভাইড করা। মড়কে ভরপুর একটা দেশে পৌঁছে যাওয়ার পরে আর ফিরতে না পারলে বাড়িতে খবর দেবেন স্যর।’

রঞ্জিত মাথা নিচু করে বসে আছেন। তিনি জানেন যে আন্তর্জাতিক লকডাউনের কারণে এই মিশনে ভারত সরকারের কনট্রোল বিশেষ থাকবে না। প্রথমাকেই যা করার করতে হবে…

সিনচান। পিজিং

সাধারণ সময়ে দিল্লি থেকে সিনচানে যাওয়ার অনেক ফ্লাইট আছে। দেশটির সঙ্গে ভারতের ব্যবসার সম্পর্ক এতটাই দৃঢ় যে যাতায়াত লেগেই থাকে। স্বৈরতান্ত্রিক লি ‘লোহার পর্দা’ দিয়ে কিছু প্রদেশে আমজনতা ও মিডিয়ার প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন। সেগুলো বাদ দিলে বেড়াতে যাওয়ার পক্ষেও সিনচান আদর্শ দেশ। প্রতিদিন পিজিং যাওয়ার একাধিক ফ্লাইট আছে। বা বলা ভালো, থাকে।

এখন একটিও নেই। আন্তর্জাতিক আকাশ এখন বিমানশূন্য। কারণ এক দেশ থেকে অন্য দেশে যারা যাচ্ছে, তারাই নোভিড ভাইরাসটি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

গণ বিমান পরিবহন বন্ধ হলেও মিলিটারি বিমান ও ভোগ্যপণ্যের বিমান চলাচল বন্ধ হয়নি। নোভিড প্রোটোকল মেনে সে সব ফ্লাইট, কম হলেও চলছে। সেই রকম একটি কার্গোতে উঠে বসল মারিয়া ডিসুজা। পেশায় সে সেবিকা, শ্বসনতন্ত্র নিয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ আছে।

অল্প সময়ের মধ্যে এর বেশি কিছু ভেবে উঠতে পারেনি প্রথমা। কেন সে অন্য দেশে উড়ে যাচ্ছে, এর একটা ব্যাখ্যা তো চাই। আর, যে-কোনও জায়গায় এই সময়ে ঢুকতে হলে হেল্‌থ কেয়ার ওয়ার্কার হওয়া ছাড়া গতি ছিল না। ডাক্তারের পরিচয় নেওয়াটা রিস্কি হয়ে যেত। অন্য ডাক্তারের মুখোমুখি হলে ফাঁকি ধরা পড়ে যেত। ফিজিয়োথেরাপিস্ট আর নার্সের মধ্যে দ্বিতীয়টি বেছে নেয় সে। যেটুকু সময় পেয়েছে, এক নার্সের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। কিছু গড়বড় হলে ভাষা না জানার অভিনয় করবে। বলবে যে সে কলকাতার মেয়ে। বাংলা আর ইংরিজি ছাড়া অন্য ভাষা জানে না।

সকাল সাড়ে বারোটায় কার্গোর পেটে ঢুকেই ঘুমিয়ে পড়েছিল মারিয়া। সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভাঙতে জানল যে পিজিং এয়ারপোর্ট এসে গেছে। এবারে নামতে হবে।

মারিয়ার কাছে একটি বড় ব্যাকপ্যাক ছাড়া কোনও লাগেজ নেই। সেটি পিপিই, স্যানিটাইজার, মাস্কে ঠাসা। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া তার কাছে কিছু নেই। সাড়ে পাঁচটার সময় পিজিং এয়ারপোর্টে নামার পরে কেউ নিতে না এলে মারিয়া কী করবে, সে জানে না।

সে রকম কিছু অবশ্য হল না। প্লেন থেকে নামার পরে তার লালা রস পরীক্ষা হল না, যেটা বিদেশিদের জন্যে বাধ্যতামূলক। কেউ তার টিকিট, পাসপোর্ট বা ভিসা দেখতে চাইল না। একটি কমবয়সি, পাথুরে মুখের ফৌজি ছেলে এসে ইংরিজিতে বলল, ‘মারিয়া? কাম উইথ মি।’

ছেলেটির সঙ্গে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে মারিয়া দেখল সেনাবাহিনীর পতাকা লাগানো একটি ছোট্ট চারচাকা দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেটায় উঠতেই ছেলেটি চালকের আসনে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল।

শুনশান ফাঁকা রাস্তায় কোনও কথা হল না। কুড়ি মিনিটের মাথায় প্রধান সড়ক ছেড়ে একটি গলিতে ঢুকে সামান্য এদিক সেদিক গিয়ে বিশাল বড় একটি বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়াল গাড়ি। মারিয়া আন্দাজ করল এই প্রাসাদের সিংহদুয়ার প্রধান সড়কের ওপরে অবস্থিত। এটা খিড়কির দরজা। কেউ যাতে সন্দেহ না করে তাই পিছন দিয়ে ঢুকবে সে।

ছেলেটি পিছন ফিরে বলল, ‘আপনার লালারস পরীক্ষা হবে। স্যাম্পল নেওয়ার পরে আপনি একটি ঘরে একা থাকবেন। রিপোর্ট নেগেটিভ এলে জেনারেলের সঙ্গে আপনার দেখা হবে।’

বিনয়ের সঙ্গে মারিয়া জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার পরিচয়?’

‘আমি স্টিফেন চাও। সিনচান মিলিটারির একজন নার্স। আমার সামনে নার্সের অভিনয় করলে কিছু মনে করব না,’ পাথুরে মুখে পাতলা হাসি ফুটে ওঠে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মারিয়া। এই জাতীয় মিশনে পরিচয় গোপন থাকা হল বেঁচে থাকার অন্যতম শর্ত। সেটা একজন জেনে যাওয়া মানে সবাই জেনে যাওয়া। অস্বস্তি চেপে রেখে মারিয়া বলল, ‘কী করে জানলে?’

সোয়াব দিয়ে নাক আর মুখের লালারস নিয়ে টেস্ট টিউবে ঢুকিয়ে স্টিফেন বলল, ‘আমাকে বলেছেন আমার বস্‌। তাঁকে বলেছেন তোমার বস। তুমি গাড়ি থেকে নেমে ওই দরজা খুলে ঢুকে যাও। বাঁদিকের প্রথম কেবিনে তোমার বিশ্রামের সব সরঞ্জাম আছে। আর এই নাও…’

স্টিফেনের হাতে একটি বেসিক ফোন। সেটা বাড়িয়ে ও বলল, ‘লোকাল থেকে ইন্টারন্যাশনাল—সব রকম কল ও মেসেজ করা যাবে। গোটা দুনিয়ার কেউ ট্রেস করতে পারবে না। তোমার বসের সঙ্গে কথা বলে নাও। আমি পরে আসব।’

গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল মারিয়া।

এই হলঘরের মধ্যে অজস্র খুপরি খুপরি কেবিন রয়েছে। তার মধ্যে বাঁদিকের প্রথম কেবিনে ঢুকে মারিয়া দেখল একটা হসপিটাল বেড ও একটি চেয়ার রয়েছে। নোভিড রোগীর চিকিৎসার জন্যে যা যা প্রয়োজন, সবই আছে। অর্থাৎ এই কেবিনগুলো হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার হয়। এসি চলছে বলে আবহাওয়া মনোরম। আবার ঘুমিয়ে পড়ল মারিয়া। ফোনে হাত দেওয়া একদম উচিত হবে না।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল কে জানে! দরজায় খট খট শুনে সেটা খুলে দিতে স্টিফেন বলল, ‘তুমি নোভিড নেগেটিভ। কাজেই মাস্ক পরার দরকার নেই। আমার সঙ্গে এসো।’

মোবাইলে সময় দেখে মারিয়া বলল, ‘মাত্র এক ঘণ্টায় টেস্ট হয়ে গেল? এটা কী টেস্ট?’

‘এটা শুধুমাত্র আমরা জানি। বাকি পৃথিবী পরে জানবে। আর কথা নয়। এসো।’ গটগট করে হেঁটে ঘর থেকে বেরিয়ে প্রাসাদের পিছনের রাস্তায় পড়ল স্টিফেন। পঞ্চাশ মিটার যাওয়ার পরে আর একটি দরজা খুলে বলল, ‘ঢুকে পড়ো।’

দরজা ঠেলে মারিয়া ঢুকলেও এবার আর স্টিফেন ঢুকল না। মারিয়া দেখল তার সামনে অপূর্ব সুন্দরী একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গায়ের রং পীত বর্ণ এবং মুখে হালকা মঙ্গোলয়েড ছাপ।

‘হ্যালো, আমার নাম ফ্রিদা,’ হাত নাড়ল মেয়েটি।

সোশাল ডিসটান্সিং-এর কারণে করমর্দন এখন বন্ধ। ভারতে নমস্কার প্রথা চালু হয়েছে। তবে হাত নাড়াও ভালো অভ্যাস। হাত নেড়ে মারিয়া বলল, ‘হাই, আমি মারিয়া।’

‘এসো।’ ঘরের পর ঘর পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ফ্রিদা। পিছু পিছু যাচ্ছে মারিয়া। অবশেষে মাঝারি মাপের একটি ঘরে ঢুকে ফ্রিদা বলল, ‘বোসো।’

এটা একটা অফিস। বড় একটি টেবিলের এক প্রান্তে বসে রয়েছেন চ্যাং। এঁর ছবি দেখেছে মারিয়া। তার সামনে বসে ফ্রিদা বলল, ‘এই যে, মারিয়া এসে গেছে।’

ইশারায় বসতে বলে চ্যাং কথা শুরু করলেন, ‘তোমার কাজটা শক্ত। প্রথমে লিয়ের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। বলতে হবে যে তুমি ফ্রিদাকে চেনো। এবং ফ্রিদা কোথায় আছে জানো। আপাতত এইটুকুই। কারণ ফ্রিদা কোথায় আছে জানার পরে লি কী করবে, তার ওপরে নির্ভর করছে পরের পদক্ষেপ।’

‘আমি কি কয়েকটি প্রশ্ন করতে পারি?’ জিজ্ঞাসা করল মারিয়া।

‘অবশ্যই।’ বললেন চ্যাং। এক মহিলা এসে মারিয়ার সামনে চিনা খাদ্যের সম্ভার সাজিয়ে, বাকিদের চায়ের কাপ দিয়ে নিজেও এক কাপ চা নিয়ে বসলেন। মারিয়া আন্দাজ করল ইনি চ্যাং-এর স্ত্রী।

‘ইন্ডিয়া থেকে কাউকে আনতে হল কেন?’ সে যে লি-কে সরিয়ে দিতে এসেছে, সরাসরি কথাটা বলল না মারিয়া।

‘মাননীয় বীরেন্দ্র মেহতাকে আমি শুভানুধ্যায়ী বলে মনে করি। কাজেই বিদেশ থেকে সাহায্য চাওয়ার কথা মাথায় আসতেই আমি ওঁকে ফোন করি। তবে তুমি বোধহয় জিজ্ঞাসা করছ এখানকার কোনও মেয়েকে ব্যবহার করছি না কেন। এর উত্তর হল, এই মুহূর্তে দেশের যা পরিস্থিতি, কাউকে বিশ্বাস করা শক্ত। তা ছাড়া মেডিকেল ইমার্জেন্সি উপলক্ষ্যে কিছু বিদেশি স্বাস্থ্যকর্মী এসেছেন, এটা এসটাব্লিশ করা আমার পক্ষে সোজা। যদিও তোমাকে হুয়ান বা তার কাছাকাছি যেতেই দেওয়া হবে না। তোমার গতিবিধি পিজিং হাসপাতালেই সীমাবদ্ধ থাকবে।’

‘ওঁর সঙ্গে হঠাৎ কী ভাবে দেখা হবে? এটা তো আমার হাতের বাইরে।’ নুডল উইথ থিক গ্রেভি খাচ্ছে মারিয়া।

‘উনি পিজিং হাসপাতাল ভিজিট করতে আসছেন আগামিকাল। সেই সময়ের জন্যে তুমি ওখানকার সেবিকা।’

‘আমাকে কি ওঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গতার অভিনয় করতে হবে?’ জেনেশুনেই প্রশ্নটা করল মারিয়া। নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিতে সে পছন্দ করে না।

‘না। তুমি শুধু ওঁকে সময় বুঝে জানিয়ে দেবে যে ফ্রিদা রয়েছে পিজিং হাসপাতালের পাশের মিরামাও জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত একটি গোপন কেবিনে। বাকিটা ওঁর ওপরে। উনি একা বা সৈন্যদের সঙ্গে সেখানে গেলে ভালো। তোমার আর কিছু করার নেই। তবে আমি চাইব যে তুমি সঙ্গে যাও। ফ্রিদা একা কতটা কী করতে পারবে…’

‘আমার অস্ত্র চাই।’ প্যানকেক দিয়ে পিজিং ডাক খাচ্ছে মারিয়া।

‘কীরকম অস্ত্র?’

‘আগ্নেয়াস্ত্র নয়। অন্য কিছু।’

মৃদু হাসি খেলে গেল চ্যাং-এর মুখে। ‘তুমি বুদ্ধিমতী। সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র থাকলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। তবে তুমি তো সেবিকা। ইমার্জেন্সি ট্রেতে নানান ইনস্ট্রুমেন্টস থাকে। সেখান থেকে কিছু ব্যবহার করতে পারবে না।’

সিজার বা স্ক্যালপেল ব্যবহার করতে হবে। বুঝে গেল মারিয়া। সে বলল, ‘জঙ্গল থেকে ফিরব কী করে?’

‘ফ্রিদা তোমাকে নিয়ে আসবে। ওখানে স্টিফেন গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে। ও তোমাদের দুজনকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবে। সেখানে শ্যামলদেশের একটা কার্গো অপেক্ষা করবে। সেটায় উঠে পড়বে।’

‘এর মধ্যে শ্যামলদেশও আছে?’ খাওয়া শেষ করে বলল মারিয়া।

‘হ্যাঁ। ভারত আর শ্যামলদেশ আমার বন্ধু।’

‘মিরামাও জঙ্গল সম্পর্কে জানতে চাই। ছোট না বড়, সমতল না উঁচু-নিচু, গাছে ভর্তি না ফাঁকা ফাঁকা, কেউ থাকে না থাকে না, বিপজ্জনক পশু আছে না নেই।’

‘তুমি অনেকক্ষণ জার্নি করে এসেছ। পেটে দানাপানি পড়েছে, এখন খুব ঘুম পাবে। এখানকার একটি ঘরে ঘণ্টা তিনেক ঘুমিয়ে নাও। তারপরে ফ্রিদা তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবে। আমাকে আর তুমি দেখতে পাবে না। ঠিক আছে?’ চেয়ার থেকে উঠে বেরিয়ে গেলেন চ্যাং ও তাঁর স্ত্রী। এক কর্মচারী এসে বাসন নিয়ে যাচ্ছে।

ফ্রিদা বলল, ‘আমার সঙ্গে এসো।’

মিরামাও জঙ্গল। পিজিং।

পাহাড়, টিলা, ঢিবি আর খানাখন্দে ভর্তি ঘন জঙ্গল। জিংকো গাছ, প্যাগোডা গাছ, পাইন, অ্যাস্পেন আর বার্চ ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে লম্বা হওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতেছে। আর রয়েছে উইপিং উইলো। ঝাঁকড়া লতা ওপর থেকে নেমে হাঁটার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। তারই মধ্য দিয়ে হাঁটছেন লি। পিছুপিছু হাঁটছে মারিয়া। একজন দেহরক্ষী পিছন পিছন আসছে। তার হাতে ‘টাইপ নাইন্টি ফাইভ অটোম্যাটিক রাইফেল।’

মারিয়া ভাবছে। গতকাল ভরা পেটে তিন ঘণ্টা ঘুমোনোর পরে খুব ফ্রেশ লাগছিল। ফ্রিদার সঙ্গে প্রায় চার ঘণ্টা আলোচনা হয়েছে। মারিয়া জেনেছে ফ্রিদার ব্যাকগ্রাউন্ড। সে এখন কী চায়, কেন চায়, কীভাবে চায়। ফ্রিদার ব্যক্তিগত শোক আর চ্যাং-এর রাষ্ট্র প্রধানের প্রতি ক্রোধ এক জায়গায় মিলেছে। দুজনে পরস্পরকে সাহায্য করছে।

মারিয়াও বলেছে নিজের প্রকৃত পরিচয়। তবে কোন বিভাগে কাজ করে বলেনি। শুধু কেজো তথ্য সরবরাহ করেছে। সম্পর্ক কিছুটা সহজ হওয়ার পরে ফ্রিদা শিখিয়েছে নার্সিং-এর প্রাথমিক কয়েকটা কাজ আর টার্মিনোলজি। মারিয়াকে সেবিকা হতে হবে না। সেবিকার অভিনয় করতে হবে। তার জন্যে ওইটুকুই যথেষ্ট।

পিজিং হাসপাতালে লিয়ের মুভমেন্ট কী হবে, সেটা ডিটেলে বুঝিয়েছে ফ্রিদা। উনি যখন ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ড থেকে সার্জিকাল ওয়ার্ডে যাবেন, তখন আই সি ইউ থেকে বেরিয়ে লিয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে মারিয়াকে ইংরিজিতে বলতে হবে, ‘আমি জানি ফ্রিদা কোথায়। আপনাকে একা আসতে হবে।’ লি ছাড়া ওখানকার কেউ যে ইংরিজি জানে না, এটা ফ্রিদা কমফার্ম করল।

এইটুকুই। আর কিছু জানে না ফ্রিদা। বাকিটা মারিয়ার দায়িত্ব। সে যদি কোনও দেহরক্ষী ছাড়া লিকে মিরামাওয়ের জঙ্গলে আনতে পারে, তা হলে খুব ভালো। কেউ সঙ্গে থাকলে তাকে সরিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও ফ্রিদার। মারিয়ার একমাত্র কাজ লিকে এলিমিনেট করে বাংলো এবং জঙ্গল থেকে পালানো।

কাল রাতে শুয়ে পড়ার আগে ওরা দুজনে মিলে জঙ্গলটা ঘুরে গেছে। বাংলোটাও দেখে নিয়েছে। জঙ্গলের মাটি শুকনো পাতায় ভরে আছে। মিরামাও জঙ্গলে নাকি প্রায়ই ছোটখাট দাবানল হয়।

আজ সকাল থেকেই কাজের জায়গায় মজুত মারিয়া। আশ্চর্যের বিষয় হল, কেউ তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করছে না। এর একটা বড় কারণ হল সবাই মুখে মাস্ক, মাথায় ক্যাপ আর হাতে গ্লাভস পরে আছে। এই হাসপাতালে নোভিড রোগী ভর্তি করা হয় না। তাই সুরক্ষার বিষয় কিছুটা ঢিলেঢালা।

নির্দিষ্ট সময়ে লি এলেন। গাড়ি থেকে নামলেন। অল্প কয়েকজন দেহরক্ষী নিয়ে ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডে ঢুকলেন। মারিয়া খুশি হল। বেশি লোক থাকা মানে বিপদ।

লি এসেছেন বলে এখানে আলাদা কোনও উত্তেজনা নেই। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। তার মধ্যেই নির্দিষ্ট সময়ে করিডোরে দেখা হয়ে গেল লিয়ের সঙ্গে। তাঁর পিছনে তখন দুজন দেহরক্ষী। অভিবাদন জানিয়ে মারিয়া বেশ জোরে তার বক্তব্য পেশ করল।

লি দাঁড়িয়ে পড়লেন। উত্তেজিত হয়ে সিনচানি ভাষায় দেহরক্ষীদের কিছু বললেন। মুহূর্তের মধ্যে দেহরক্ষী দুজন বন্দুক ঠেকাল মারিয়ার মাথায়। মারিয়া একটুও শঙ্কিত না হয়ে, ভয় না পেয়ে, কনফিডেন্সের সঙ্গে বলল, ‘যত বেশি লোককে এর মধ্যে জড়াবেন ততই মেয়েটা বিপদে পড়বে। আপনার খুব কাছের লোক ওর এই কিডন্যাপিং-এর জন্যে দায়ী।’

লি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মারিয়ার দিকে। তাঁর ইশারায় দেহরক্ষীরা বন্দুক নামিয়ে সরে গেল।

লি নিচু গলায় বললে, ‘তুমি কে?’

নিজের আই কার্ড বাড়িয়ে মারিয়া বলল, ‘এটাই আসল পরিচয়। আমি মিথ্যে বলছি না। কিন্তু ফ্রিদা আমার সোশাল মিডিয়ার বন্ধু। ইনবক্সে কথা হতো। বিদেশি বলেই ভরসা করেছে। আজ আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আছে জানার পরে এইটুকু বলতে বলেছে। এর বাইরে আমি কিছু জানি না। বিশ্বাস করুন…’

মারিয়া কাঁদতে গিয়ে কান্না চাপছে। ঠোঁট ফুলে উঠেছে অভিমানে, গাল লাল, চোখের কোণে অশ্রুকণা ভেসে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল…

মারিয়ার কাঁধে লিয়ের হাতের চাপ। ‘ঘাবড়িও না। আমি তো আছি।’

এটা গুরুজনের স্নেহস্পর্শ নয়। এটা ‘ব্যাড টাচ।’ এতে কাম গন্ধ আছে। ইশারা আছে। ‘তুমি রাজি?—এই প্রশ্ন আছে।

এক পা এগোতে গিয়ে পিছয়ে আসে মারিয়া। দৃষ্টি দিয়ে নিজেকে সমর্পণ করে বলে, ‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করলাম। এবার আপনার দয়া।’

একটি কমবয়সি মেয়েকে জয় করে আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে লিয়ের। তিনি বললেন, ‘চলো। তোমার বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করে আসি।’

‘আপনারও তো বান্ধবী।’ ফিচেল হাসল মারিয়া। ‘ও আজ আমার মতো সেবিকার এপ্রন পরে আছে। যাতে যাওয়ার সময় ওকে কেউ সন্দেহ না করে।’

লি আর মারিয়া হাসপাতাল বিল্ডিং থেকে বেরিয়েছেন। পিছন পিছন দৌড়ে আসছে একাধিক দেহরক্ষী। হাতে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। লি ইশারায় একজনকে আসতে বললেন।

রাতে এই রাস্তা দিয়ে গিয়েছিল মারিয়া। অন্ধকারে ভালো করে কিছু দেখতে পায়নি। এখন, দিনের বেলায় চিনতে অসুবিধে হচ্ছে। তবে জান্তব ইনস্টিংক্ট দিয়ে সে বোঝার চেষ্টা করছে, বাংলো কোন দিকে। গোল রাস্তা, প্যাঁচানো রাস্তা, গোলকধাঁধার মতো রাস্তা পেরিয়ে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গায় এসেছে ওরা। সামনেই বাংলো।

লি এগিয়ে যাচ্ছেন বাংলোর দিকে। মারিয়া পিছন ফিরে দেখল, রক্ষীকে আর দেখা যাচ্ছে না।

লি বাংলোর দরজা খুলে ঢুকে পড়লেন। মারিয়া সন্তর্পণে বাংলোর পিছন দিকে গেল। এখানে কী একটা আওয়াজ হচ্ছে ঝুপ ঝুপ করে।

প্রায় পঁচিশ মিটার যাওয়ার পরে মারিয়া দৃশ্যটা দেখতে পেল। বড় একটা ট্রাক থেকে একের পর এক লাশ ফেলা হচ্ছে মাটিতে। যারা ফেলছে, তারা সবাই পিপিই পরে আছে। যাদের বডি ফেলছে, তাদের পরনে হাসপাতালের রোগীর পোশাক। আন্দাজ করতে অসুবিধে হয় না, এরা সবাই নোভিড রোগী। মারা যাওয়ার পরে মৃতের সংখ্যা গোপন রাখবে বলে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে এখানে ফেলে যাওয়া হচ্ছে। এ জিনিস ইন্ডিয়াতেও হয়েছে।

মারিয়া গুনল। অন্তত একশো মৃতদেহ ফেলার পরে মৃতের স্তূপের ওপরে ঢালা হল গ্যাসোলিন বা ওই জাতীয় কোনও তরল।

প্রমাদ গুনল মারিয়া। জঙ্গলের মতো সহজ-দাহ্য এলাকায় আগুন লাগানো খুব খারাপ। শুকনো পাতায় এক্ষুনি আগুন ধরে ছড়িয়ে পড়বে সারা বনে। শুরু হবে দাবানল। হাওয়া এদিকেই বইছে। ওরা না হয় ট্রাক চালিয়ে পালাবে। তার কী হবে?

উল্টো দিকে দৌড়োয় মারিয়া। পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়েছে ওরা। ওদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র আছে। ওরা গুলি করছে।

মারিয়া দৌড়োয়। তার কানের পাশ দিয়ে সাঁই-সুঁই করে বেরিয়ে যায় গুলি। একটু পরে আর কোনও আওয়াজ নেই। জঙ্গলের এই এক সুবিধে। গাদাগাদা গাছের কারণে এলাকা বুলেট প্রুফ!

বুলেট প্রুফ হলেও জঙ্গল মোটেই ফায়ার প্রুফ নয়। চড় চড় আওয়াজ করে দাবানলের লেলিহান শিখা এদিকেই আসছে। মারিয়া দৌড়োয়। ওই তো! সামনেই বাংলো!

বাংলোর কাছে পৌঁছে মারিয়া দেখল লি আর ফ্রিদা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে চিৎকার করে বলল, ‘তাড়াতাড়ি চলুন। বনে আগুন লেগেছে।’

ফ্রিদা তার দিকে এগিয়ে এল।

এইবার মারিয়া দেখতে পেল লিয়ের হাতে সিনচানের বিখ্যাত সেমি অটোম্যাটিক হ্যান্ড গান, কিউ এস জেড নাইন্টি টু। সেটি ফ্রিদার মাথায় তাক করা। ফ্রিদা ভয়ের চোটে থরথর করে কাঁপছে।

লি বললেন, ‘আমার কাছে খবর ছিল যে তুইঘুর কুত্তিটা চ্যাং-এর সঙ্গে লটঘট করছে। বুড়োকে পছন্দ নয় বলে জোয়ানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। আমি সুযোগের আশায় বসেছিলাম। আজ আমার স্বপ্ন সফল হল। টিভিতে কান্নাকাটি করে পাবলিকের সিমপ্যাথি অনেকটা নিজের দিকে ঘুরিয়েছি। এবার তারা যদি জানতে পারে যে চ্যাং আমাকে খুন করার চেষ্টা করছে, তা হলেই কেল্লা ফতে!’

‘সেটা কি ভাবে প্রমাণ হবে মিস্টার প্রেসিডেন্ট?’ কাশতে কাশতে বলল মারিয়া। আগুন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। তারও আগে আসছে ধোঁয়া। খুব কাশি পাচ্ছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে।

‘ফ্রিদাকে আমি এখনই মেরে দেব। তারপরে তোকে নিয়ে যাব আমাদের জেলে। দু-দিন আমাদের আর্মির ছেলেদের ট্রেনিং-এ থাকলেই শিখে যাবি মিডিয়ার সামনে কী বলতে হবে।’

‘কী বলতে হবে?’ আরও এক পা এগোয় মারিয়া। ধোঁয়ার কারণে দৃশ্যমানতা এখন শূন্যের কাছাকাছি। সব কিছু ধূসর। আগুন এত কাছে চলে এসেছে যে গরম লাগছে। এরপরে ছ্যাঁকা লাগবে।

‘তুই বলবি যে লি, লোবোসোনারো আর ইমরোজকে মারার জন্যে আমি ইন্ডিয়া থেকে এসেছি। আমার সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন চ্যাং। ব্যস! এইটুকু বললেই…’ বাকি কথা শেষ হল না লিয়ের। মারিয়ার এপ্রনের পকেট থেকে স্ক্যালপেল বেরোল সাপের মতো। আর সেটা লিয়ের বাঁ ঘাড়ের ক্যারোটিড আর্টারি কাটল মিলি সেকেন্ডের মধ্যে। আগ্নেয়াস্ত্রর ট্রিগারে চাপ দেওয়ার ক্ষমতা চলে গেল লিয়ের। প্রবল ব্যথায় তিনি কাতরাচ্ছেন, হাত দিয়ে রক্তের ঝরনা বন্ধ করার চেষ্টা করছেন, নিজের রক্ত দেখে আঁতকে উঠছেন, মৃত্যু নিশ্চিত জেনে নেতিয়ে পড়ছেন।

‘একে এখানে রেখে গেলে চলবে না।’ বলল ফ্রিদা। কিউ এস জেড নাইন্টি টু লিয়ের হাত থেকে কেড়ে লোকটাকে কাঁধে তুলে দৌড়োচ্ছে সে, ‘আগুনে পুড়ে মরে গেলে কেউ জানবেন না যে মরেছে। যে করেই হোক, একে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।’

মারিয়া একবারের জন্যেও জিজ্ঞাসা করল না, তার কী হবে! টাইপ নাইন্টি ফাইভ অটোম্যাটিক রাইফেলধারী সেই দেহরক্ষী আশেপাশেই আছে। বাকি দেহরক্ষীরা জঙ্গলের বাইরে অপেক্ষা করছে। এর মধ্যে থেকে সে পালাবে কী করে?

আগুন এখন ঘাড়ে শ্বাস ফেলছে। ছোটার গতি বেড়ে গেছে আগের থেকে। আবার সেই গোলকধাঁধার মতো রাস্তা, প্যাঁচানো রাস্তা, গোল রাস্তা পেরিয়ে জঙ্গলের প্রান্তে উপস্থিত হল তিনজনে। লিয়ের লাশ মাটিতে ফেলে দিয়ে ফ্রিদা বলল, ‘আমি আর পারছি না।’

মুহূর্তের মধ্যে লিয়ের পোশাকে আগুন লেগে গেল।

কালো ধোঁয়া, চাপ চাপ ধোঁয়া, অন্ধকার, হলুদ আর নীল আগুনের ঝলকের মধ্যে দিয়ে দৌড়োচ্ছে দুজন। ওরা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটা জ্বলন্ত লাশ।

হাসপাতালের সামনে চলে এসেছেন চ্যাং। ধমক দিচ্ছেন দেহরক্ষীদের। কেন তারা লিকে জঙ্গলে একা যেতে দিয়েছে। যে দেহরক্ষী সঙ্গে গিয়েছিল, সে এর মধ্যেই ফেরত চলে এসেছে। তার দম আটকে আসছে। মাটিতে বসে খকখক করে কাশছে সে।

চ্যাং জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখলেন। ধোঁয়া আর আগুনের বেড়াজাল পেরিয়ে বেরিয়ে আসছে দুজন মেয়ে। ওরা বয়ে আনছে লিয়ের লাশ। তাঁর গায়ে আগুন লেগে গেছে। দুটি মেয়ের এপ্রনেও আগুন লেগেছে। ধোঁয়া আর ঝুলকালিতে কাউকে চেনা যাচ্ছে না।

ওদের মধ্যে একটা মেয়ে আগুনে জ্বলতে জ্বলতে পড়ে গেল মাটিতে। অন্য মেয়েটি লিয়ের লাশ ফেলে দিয়েছে। সে-ও মাটিতে বসে পড়েছে। ক্রমাগত ঘাসের ওপরে শুয়ে পাশ ফিরছে আগুন নেভানোর জন্যে। হাসপাতালের কর্মীরা কম্বল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে মেয়েটির কাছে। স্ট্রেচার নিয়ে ছুটে আসছে অন্য কর্মী। জল ঢেলে দেওয়া হচ্ছে মৃত প্রেসিডেন্ট লি আর একটি মৃত মেয়ের শরীরে। ওরা কেউ নড়ছে না।

কে মারা গেল? ফ্রিদা? না মারিয়া?

মারিয়া না ফ্রিদা?

এই দোলাচলের মধ্যে চ্যাং-এর মোবাইল বেজে উঠেছে। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল, ‘ইন্ডিয়ান প্রাইম মিনিস্টার বীরেন্দ্র মেহতা কলিং…’

কী উত্তর দেবে চ্যাং? এদিকে ফোন না ধরলেই নয়। কাঁপা হাতে সবুজ বোতাম স্পর্শ করল।

‘আমাদের মেয়েটি কেমন আছে?’ প্রশ্ন করেছেন রঞ্জিত। চ্যাং চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

সময় বয়ে যাচ্ছে…

.

-সমাপ্ত-

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *