রং বদলায় – সঙ্কর্ষণ রায়
জিপে জয়ন্তী পাহাড়ের জোয়াই শহর থেকে শিলচরের দিকে যাচ্ছি। চেড়াই বেয়ে ওঠার পরে উতরাই দিয়ে নেমে যেতে শুরু করেছি। শিলং থেকে জোয়াই পর্যন্ত পাইনবনের মধ্য দিয়ে এসেছি। জোয়াই থেকে শিলচরের পথে এই উতরাইয়ের মধ্যে বনের চেহারা বদলাতে শুরু করেছে। পাইন গাছের জায়গা নিয়েছে বড়ো আকারের লাম্পাতি ও পানিসাজ। তাদের ফাঁকে-ফাঁকে আছে বাঁশগাছ, ফার্ন ও অর্কিড।
একটি সরু উপত্যকার মধ্যে এই বন যেখানে খূব ঘন হয়ে উঠেছে, সেখানে একজন খাসিয়া বুড়ি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত তুলে আমার জিপ থামাল। গাড়ি থেকে নেমে আমি বুড়িকে প্রশ্ন করি, ‘কী ব্যাপার, আমার জিপ থামালে কেন? কী চাও তুমি?’
‘আমার ছেলেকে চাই,’ বুড়ি ব্যাকুল স্বরে বলল, ‘এই বনের মধ্যে আমার ছেলে হারিয়ে গিয়েছে। দু’দিন আগে ওই ঝরনার ধারে গিয়েছিল সে, সেখান থেকে সে উধাও হয়ে গিয়েছে।’
বলে, সে তার ডান হাতটা তুলে রাস্তার ধারের ঝরনাটিকে দেখাল।
‘তোমরা থাক কোথায়?’ আমি প্রশ্ন করি।
‘এখানেই,’ বুড়ি জবাব দিল, ‘এখানে এই বনের মধ্যে আমার ছেলের সঙ্গে ক্যাম্প করে আছি। এখানে আমার ছেলে জড়িবুটি, শ্যাওলা, আগাছা ইত্যাদির নমুনা তুলছে। পিলিংয়ে ওদের ল্যাবরেটরি আছে, এইসব নমুনা সেখানে নিয়ে গিয়ে সে পরীক্ষা করবে।’
‘এমনও তো হতে পারে যে, তোমার ছেলে নমুনাগুলি নিয়ে সোজা শিলং চলে গিয়েছে….।’
‘না-না, কক্ষনো না। আমাকে না বলে সে কোথাও যাবে না। তা ছাড়া যেখানেই যাক, তার স্কুটারে চেপে যাবে। স্কুটার তো তাঁবুর বারান্দাতেই রয়ে গিয়েছে। এই বনের মধ্যেই আছে সে—ওকে খুঁজে বের কর…।’
‘বনের মধ্যে আমি পাথর খুঁজছি, মানুষ খোঁজা তো আমার কাজ নয়।
‘পাথর খোঁজার সঙ্গে ওকেও খুঁজতে পার, কেননা ও পাথরের কাছাকাছি ছিল। চল, তোমাকে জায়গাটা দেখিয়ে দিচ্ছি।’
বলে বুড়ি, আমাকে হাত ধরে জিপ থেকে নামাল, তারপর টেনে নিয়ে চলল গাছপালার আড়ালে চাপা-পড়া ঝরনাটির দিকে।
ঝরনার ধারে যেখানে সবুজ শ্যাওলা ধূসর রঙের পাথরকে সরের মতো ছেয়ে ফেলেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে সে বলল, ‘এখানেই ছিল সে। আমি ওকে ছুরি দিয়ে শ্যাওলা কেটে তুলতে দেখেছি। সে আমাকে বলেছিল যে, এই পাথরের স্তূপ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ সেন্টিমিটার অন্তর-অন্তর শ্যাওলার নমুনা তুলে নিয়ে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করবে।’
‘কেন?’ আমি প্রশ্ন করি, ‘কী করে শ্যাওলা পরীক্ষা করে?’
‘ওই শ্যাওলার মধ্যে নাকি নতুন ধরনের ব্যাকটিরিয়া আছে। এই ব্যাকটিরিয়াকে সে চিনে নিতে চায়। পরশু দিন ওর সঙ্গে এখানে এসেছিলাম, আমার ইচ্ছে ছিল ওকে ওর কাজে সাহায্য করি। কিন্তু ও বলল যে, একাই ওর কাজ করবে। তারপর আমাকে ফেরত পাঠিয়ে দিল ক্যাম্পে, কিন্তু ফিরে এল না…।’ বলতে বলতে বুড়ির বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
ঝরনার কাছে গিয়ে শ্যাওলা-ধরা পাথরের স্তূপ ও লতাঝোপের মধ্যে তন্নতন্ন করে খুঁজি আমি। পাথরের পর পাথর, ফার্ন, অর্কিড. ঘাস ও ঘাসফুলের পাশাপাশি রড়োডেনড্রনের গুচ্ছ চোখে পড়ে। কিন্তু জনপ্রাণীর কোনো চিহ্ন নেই। আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, একটা টিকটিকি বা গিরগিটিও নেই, পোকামাকড়, পিঁপড়েও দেখছি না, সবার ওপরে নেই কোনো পাখি।
হঠাৎ মনে এল রবীন্দ্রনাথের একটি গানের প্রথম পঙক্তি: বনে যদি ফুটল কুসুম, নেই কেন সেই পাখি?’
সত্যিই তো, বনে এত ফুল ফুটেছে, কিন্তু পাখি নেই কেন? পোকামাকড়, টিকটিকি, কাঠবিড়ালি, এরাই বা কোথায়? এমন তো হওয়ার কথা নয়। বনের মধ্যে গাছপালার সঙ্গে পশুপাখি, কীটপতঙ্গের সহাবস্থান তো স্বাভাবিক ব্যাপার। তারা সব গেল কোথায়? গেলই বা কেন?
তারা নেই বলে কী বুড়ির ছেলেও নেই?
বুড়ির দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, ‘এখানে ঠিক কোথায় ছিল তোমার ছেলে? মানে কোথায় সে শ্যাওলা তুলছিল?’
‘এই তো এখানে,’ বলে বুড়ি রড়োাডেনড্রনের গুচ্ছের পাশে একটি পাথরের চাতালের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
‘এই তো লাল ফুলের পাশে কাল পাথর, তার সামনেই…,’ বলতে বলতে বুড়ির মুখের কথা মুখেই থেকে যায়, হঠাৎ তার ছোটো-ছোটো চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে ওঠে।
‘দেখেছ বাছা,’ বুড়ি রূদ্ধশ্বাসে বলে ওঠে, ‘এখানে লাল ফুল কীরকম বেগুনি হয়ে উঠেছে, ফুলের রং বদলাচ্ছে। কিন্তু ফুলের কী রং বদলায়?’
প্রশ্নটা বিঁধে যায় আমার মনের মধ্যে। ফুল ফোটে, বাতাসে গন্ধ বিলয়, ঝরে পড়ে, কিন্তু তার রং কী বদলায়?
রং বদলানো উচিত নয়, কিন্তু তবু যে রং বদলাচ্ছে তা তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমার চোখের সামনে।
‘কী রকম ভুতুড়ে ব্যাপার দেখেছ তো,’ বুড়ির গলার স্বর কেঁপে ওঠে, ‘ফুলের রং বদলায়, সঙ্গে-সঙ্গে আমার ছেলে অদৃশ্য হয়। নিশ্চয়ই কোনো ডাইনির কীর্তি এটা।’
‘ঠিক বলেছ,’ আমি বললাম, ‘তবে এ-ডাইনি হচ্ছে বিষাক্ত গ্যাস। সালফার ডায়োক্সাইড নামে এক ধরনের বিষাক্ত গ্যাস আছে, গন্ধক পুড়ে তার সৃষ্টি। সালফার ডায়োক্সাইড ফুলের রং বদলাতে পারে লাল ফুল তার ছোঁয়ায় ক্রমে-ক্রমে সাদা হয়ে উঠতে পারে। এই গ্যাসের উগ্র গন্ধ সইতে পারেনি। এখানকার পশুপাখি, পোকামাকড়, তোমার ছেলেও হয়তো। আচ্ছা তোমার ছেলের নাম যেন কী?’
‘থ্যাঙ্ক ইউ।’
‘হঠাৎ থ্যাঙ্কস জানাবার কী হল। তোমার ছেলের নাম জানতে চাইছি বলে আমাকে থ্যাঙ্কস জানাচ্ছ তুমি?’
‘না না, আমার ছেলের নামই থ্যাঙ্ক ইউ। বাছা, তুমি কি বলতে চাও-যে, গন্ধক পুড়ে তৈরি হওয়া গ্যাস থ্যাঙ্ক ইউকে অদৃশ্য করে দিয়েছে?’
‘না না, তা নয়। আমার মনে হচ্ছে, গন্ধকের গ্যাস সইতে না পেরে পালিয়েছে থ্যাঙ্ক ইউ।’
‘পালাল কোথায়?’ গ্যাস সইতে পারেনি তো ক্যাম্পে চলে এলেই পারত।’
‘ক্যাম্প পর্যন্ত যেতে পারেনি হয়তো।’
‘তবে কি পড়ে গিয়েছে নীচের খাদের মধ্যে,’ আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে বুড়ি।
‘চেঁচিও না,’ আমি বললাম, ‘দেখছি সে গেল কোথায়। তোমার ছেলেকে দেখার আগে দেখা দরকার গ্যাস এখনও আছে কী না!’
চোখে দেখার আগে গন্ধেই টের পাই যে, গ্যাস আছে। চোখেও দেখি তাকে। সাদা ধোঁয়ার মতো বেরিয়ে আসছে পাথরের স্তর ভেদ করে।
সালফার ডায়োক্সাইডের উৎস তা হলে এই পাথর। পাথরের মধ্যে চাপা-থাকা গন্ধক পুড়ে সালফার ডায়োক্সাইডের সৃষ্টি, পাথরের ফাটল দিয়ে তা বেরিয়ে আসছে।
সালফার ডায়োক্সাইড বেরিয়ে আসছে, কাজেই পাথরের কাছে ঘেঁষতে পারি না। কিন্তু একটু তফাতে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পাথরটাকে চিনতে পারি। বেলেপাথর। বেলেপাথরের স্তরের নীচে কয়লার স্তরের আভাস পাই। এ-অঞ্চলে কয়লার মধ্যে গন্ধক আছে। গন্ধক আছে পাইরাইট রূপে। অর্থাৎ পাইরাইট গন্ধকযুক্ত খনিজ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কয়লার স্তরের মধ্যে গন্ধক পুড়ছে কী করে? পাইরাইট পুড়ছে, তাই গন্ধক পুড়ছে। কিন্তু পাইরাইট নিজের থেকে পুড়তে পারে না। অতএব ধরে নিতে হয় যে, কয়লা পুড়ছে। কয়লার স্তরের সঙ্গে-সঙ্গে পাইরাইট পুড়ছে, পাইরাইটের গন্ধক পুড়ে সালফার ডায়োক্সাইড সৃষ্টি হচ্ছে।
কিন্তু কয়লা পুড়ছে কী করে? কয়লার স্তরের মধ্যে কি স্বতঃস্ফূর্ত দহন চলছে? এ-প্রশ্নের জবাবের চেয়ে অবশ্য থ্যাঙ্ক ইউকে খুঁজে বের করা অনেক বেশি জরুরি। কোথায় থ্যাঙ্ক ইউ? ঝোপেঝাড়ে, পাথরের স্তূপগুলির আনাচে-কানাচে বিস্তর খোঁজাখুঁজি ঝরনাতলার খাদের নীচে নেমেও দেখি। কিন্তু কোথাও কোনো চিহ্ন নেই তার। চিৎকার করে ডাকি, ‘থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ।’
উত্তরে শুধু প্রতিধবনি ফিরে আসে, থ্যাঙ্ক ইউ।
হঠাৎ বুড়ি উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ নেই, কিন্তু তার নিশ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ আমার কানে আসছে। মনে হচ্ছে থ্যাঙ্ক ইউ ঘুমিয়ে পড়েছে। কাছেই কোথাও ঘুমিয়ে আছে সে।’
বুড়ির পাশে এসে দাঁড়িয়ে নিশ্বাস-প্রশ্বাস শুধু নয়, চাপা একটা গোঙানির মতো আওয়াজও আমার কানে এল।
এই শব্দ অনুসরণ করে রড়োাডেনড্রনের গুচ্ছের পাশে একটা গুহার সামনে এসে দাঁড়াই। বুড়ি বলল, ‘এই গুহার মধ্যেই সে আছে বলে মনে হচ্ছে। চলো, ভেতরে ঢুকি।’
‘না,’ বুড়ির হাত ধরে আমি বললাম, ”সালফার ডায়োক্লাইডের গন্ধ এখানেও পাচ্ছি, এর মধ্যে ঢোকা নিরাপদ নয়।”
‘কিন্তু থ্যাঙ্ক ইউ যে ঢুকে পড়েছে!’
‘একটু অপেক্ষা করো বুড়িমা। জোয়াই থেকে গ্যাস-মাস্ক নিয়ে আসি, তারপর ঢুকব এর মধ্যে।’
জোয়াই থেকে গ্যাস-মাস্ক ছাড়া আমার এক ডাক্তার বন্ধুকে নিয়ে আসি। গ্যাস-মাস্ক মুখে দিয়ে আমরা দুজনে ঢুকে পড়ি গুহার মধ্যে।
আন্দাজে ভুল করেনি বুড়ি, ওই গুহার মধ্যেই ছিল থ্যাঙ্ক ইউ। কিন্তু ঘুমিয়ে নয়, অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল গুহার বেলেপাথরের মেঝের ওপরে।
থ্যাঙ্ক ইউয়ের জ্ঞান ফেরার পরে তাকে আমি প্রশ্ন করি, ‘তুমি কী সালফার ডায়োক্সাইড থেকে বাঁচার জন্য গুহার মধ্যে ঢুকেছিলে?’
‘না,’ মৃদুমন্দ হাসতে হাসতে জবাব দিল থ্যাঙ্ক ইউ, ‘গুহার মধ্যেও গ্যাস আছে, কাজেই গ্যাস থেকে বাঁচার জন্য গুহার মধ্যে ঢুকিনি। রড়োাডেনড্রন ফুলের মতো পাথরের গায়ে গজানো শ্যাওলারও রং বদলেছে সালফার ডায়োক্সাইডের ছোঁয়া লেগে। ওই গুহার মধ্যে শ্যাওলার মধ্যে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ব্যাকটিরিয়া আছে বলে আমার ধারণা।’
থ্যাঙ্ক ইউয়ের ধারণা যে ভুল নয়, তার প্রমাণ তাদের শিলংয়ের ল্যাবরেটরিতে পায় সে। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ব্যাকটিরিয়া আবিষ্কার করে যে সালফার ডায়োক্সাইড গ্যাসের প্রভাবে রং-বদলানো শ্যাওলার মধ্যে। এ এক অদ্ভুত ধরনের ব্যাকটিরিয়া, যার খাদ্য গন্ধক। কয়লাকে গন্ধকযুক্ত করার জন্য কাজে লাগানো হতে থাকে এই ব্যাকটিরিয়া।