রংলাল

রংলাল

অনেক কাঠ-খড় পোড়াইয়া সুদূর মিথিলায় একটি চাকুরি জুটিল। মনিব একজন কুঠিয়াল সাহেব।

ভাবিলাম, না, এ ধুতি-চাদরের কর্ম নয়, হ্যাট-কোট সিগারেট-চুরুটে জায়গাটাতে প্রথম হইতে জাঁকিয়া বসিতে হইবে, ওদিকে এখনও এসবের কদর আছে শোনা যায়। স্ত্রী সুটকেসে একজোড়া ধুতি দিতেছিলেন, প্রবলভাবে নিবারণ করিয়া বলিলাম, “না না, ওসব বাতিল; আমার জীবন থেকে ও-যুগই চলে গেছে বলে জেনো।

স্ত্রী বলিলেন, “বুঝি না বাপু, কি মন্দ যুগটাই ছিল এমন?”

বলিলাম, “আমি তাকে সত্য ত্রেতা যুগ বলে মেনে নিতেও রাজী আছি, পবিত্র খদ্দর, দায়িত্বহীন জীবন, অর্থমথমের বালাই নেই; কিন্তু আপাতত পায়জামা, স্লীপিং সুট আর হাফ- সার্ট দিতে যেন ভুলো না। পাইপ দুটো দেওয়া হয়েছে তো? গেলিসটা?”

টাইয়ে গেরো কষিয়া হ্যাটটা মাথায় চাপাইয়া লইলাম। চাকর আসিয়া খবর দিল, ট্যাক্সি হাজির।

গন্তব্য স্টেশনে ট্রেন পৌঁছিল পরের দিন প্রায় তিনটার সময়। গেটের কাছে বৃদ্ধ স্টেশন-মাস্টার, আগে একটি সেলাম করিয়া টিকিটের জন্য হাত পাতিলেন, তাঁহাকে কৃতার্থ করিয়া বাহিরে আসিলাম।

এইখানে আমার সম্ভ্রমে প্রথম আঘাত লাগিল! চিঠিটা বোধ হয় সময়ে পৌঁছায়নি, কুঠির দিক হইতে কোনো রকম যানবাহনের বন্দোবস্ত নাই। একটি মাত্র ভাড়াটে এক্কা একটি বাদামগাছতলায় দাঁড়াইয়া আছে। চালক বোধ হয় আমায় দেখিয়াই, তাহার কঙ্কালসার ঘোড়াটাকে সাধ্যমত আমার হ্যাট-কোটের উপযোগী করিয়া তুলিবার জন্য প্রবলবেগে ডলাই-মলাই শুরু করিয়া দিয়াছে। কঞ্চি আর ধনুকাকৃতি বাঁশের গাড়ি, স্প্রিঙের নামগন্ধ নাই, ফুট তিনেক উঁচু, গজকয়েক লম্বা। মনটা দমিয়া গেলেও উপায়ান্তর না দেখিয়া ভাড়া করা গেল। ‘একমান’ শুকনা ঘাসের উপর একটা ছিন্ন মলিন চট বিছাইয়া গদগদ হইয়া বলিল, “বইঠল যাও”, অর্থাৎ বসিতে আজ্ঞা হোক!

সন্দিগ্ধভাবে একবার প্রশ্ন করিলাম, “কুঠি যেতে হবে, পারবে তো?”

“আধ ঘণ্টার বেশি লাগবে না। বুঝতে পারবেন না, মোটরে বসে আছি কি

এক্কায়!”—বলিয়া গদির নীচে আরও দুইটি ঘাস দিয়া উপর হইতে ঠুকিয়া-ঠাকিয়া দিল। ঘোড়ার পিঠে একটা চাপড় মারিয়া বলিল, “চল্, নয়া বড়াবাবুর কাছে বকশিশ মিলবে।”

একটু রুক্ষস্বরে কহিলাম, “বড়বাবু নেহি, ছোটা সাহেব কহো।”

পাঁচটা নাগাদ এক্ক। আসিয়া বাসার সামনে দাঁড়াইল। দেখিলাম, এটি আমার সাহেবত্বের দ্বিতীয় প্রতিবন্ধক। ছেঁচা বেড়ার ঘর, খড়ের ছাউনির উপর কুমড়াগাছ ভরিয়া গিয়াছে। বেড়ায় ঝিঙে। সামনে একটা চাতালের উপর তুলসীগাছ, তাহার গোড়ায় একটা ভাঙা টবে মনসা। আমার পূর্বতন “বড়বাবু” মহিম রায় বাড়িটাকে এমন মারাত্মক রকম বাঙালী-মার্কা করিয়া গিয়াছেন যে, এখনে টুপি-প্যান্টালুনের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখা একটা রীতিমতো সমস্যা হইয়া দাঁড়ায় বুঝি।

এক্কার চারিদিকে শীঘ্রই একটু ভিড় জমিয়া গেল—কুঠির দুই-একজন আমলা, দুই- তিনটা পিওন, গ্রামের ইতর-ভদ্র কয়েকজন লোক। আমি বেশ একটু অস্বস্তিতে পড়িয়া গেলাম। মনে হইল, যেন এই জীর্ণ এক্কাগাড়ি আর সামনের ওই বাড়ি—এই দুইটাতে চক্রান্ত করিয়া আমার পোশাকসুদ্ধ আমাকে সকলের সামনে পরম দ্রষ্টব্যরূপে তুলিয়া ধরিয়াছে। সকলের লম্বা সেলাম আর নির্বাক সশ্রদ্ধ ভাবটাতে মনের সঙ্কোচটা একটু কাটাইয়া নামিতে যাইব, এমন সময় একটা বেশ বলিষ্ঠ গোছের দেশী কুকুর সবার পায়ের মধ্য হইতে সামান্য একটু আগাইয়া আসিয়া ঠিক আমার সামনেটিতে মুখ উঁচু করিয়া দাঁড়াইল। সমস্ত শরীরটা রাঙা, ডান চোখের চারিদিকে একটা গোল সাদা দাগ, এক দিকের কানটা খাড়া, অন্য দিকেরটা ঝোলা, দেখিতে হইয়াছে—যেন একটি মাত্র চশমাপরা একটা অতি বখাটে ছোকরা তাহার টুপিটা লক্ষ্মৌয়ী কায়দায় বাঁকা করিয়া পরিয়াছে। দাঁড়াইয়া, যে দিকের কানটা খাড়া, সেই দিকের ঘাড়টা অল্প একটু উঁচু করিয়া পরম অভিনিবেশের সহিত আমায় নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। অন্য কুকুর হইলে বোধ হয় ডাকিয়া পাড়া মাথায় করিত, এ একেবারে সে দিক দিয়াও গেল না, শুধু একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল মাত্র।

হোক কুকুর, কিন্তু ভাবটা এতই মানুষের অনুরূপ যে, আমি সেলামে সমীহে যে সঙ্কোচটা কাটাইয়া উঠিতেছিলাম, তাহা হঠাৎ দ্বিগুণ বর্ধিত হইয়া আমায় একেবারে অভিভূত করিয়া ফেলিল। মনে হইল, যেন হ্যাট-কোটধারী কালো সাহেব আমি সকলের দৃষ্টি এড়াইয়া শেষ পর্যন্ত এক মহা বিচক্ষণ সমালোচকের হাতে পড়িয়া গিয়াছি। আর সকলে সম্মান করুক, কিন্তু এই একটি জীব ততক্ষণ আমার অপরূপত্বটুকু সমস্ত অন্তর দিয়া উপভোগ করিয়া লইতেছে।

নামিতে গিয়া পায়ে প্যান্টালুন আটকাইয়া একটু পড়-পড় হইলাম। কয়েকজন ব্যস্তভাবে আগাইয়া আসিল, কুকুরটা এক পা পিছাইয়া গিয়া মুখটা অন্য দিকে ফিরাইয়া লইয়া হুফ করিয়া একটা হ্রস্ব আওয়াজ করিল। স্পষ্ট যেন বলিল, হুঁ, এই তো সাহেব, তার আবার—! যদি কথা কহিয়া বলিত, এর চেয়ে স্পষ্ট করিয়া বুঝিতাম না।

একমানটাকে আনা পাঁচেক ভাড়া দিলেই যথেষ্ট হইত, একটা টাকা বাহির করিয়া দিলাম। কেন দিলাম যে স্পষ্ট বলিতে পারি না, তবে ওই বেয়াড়া কুকুরটার কাছে সাহেবী চালটা বজায় রাখা নিতান্ত দরকার, বোধ হয় আবছা আবছা এই রকম একটা কথা মনে হইয়াছিল।

একমান একেবারে তিন-চারটা সেলাম করিয়া অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানাইল। চারিদিকের মৃদু গুঞ্জনে বুঝিলাম, আর সবার কাছেও সাহেবিয়ানাটা দ্রুত অনুমোদিত হইয়া উঠিতেছে। কিন্তু কুকুরটা কোথায়—যাহার জন্য এত? দেখি ভিড় হইতে সরিয়া কয়েক গজ দূরে, একমানটা যেখানে একটা ইটের উপর টাকাটা বারংবার বাজাইয়া যাচাই করিতেছে, কুকুরটা পাশে জুটিয়া উঁচু কানের দিকে মাথাটা ঈষৎ তুলিয়া সেই রকম স্থির দৃষ্টিতে দাঁড়াইয়া আছে। মুখে হাসি। অন্য কুকুর হইলে বলা চলিত, জিভ বাহির করিয়া মাথা দুলাইয়া একটু একটু হাঁপাইতেছে, কিন্তু এর সম্বন্ধে আর আমার সন্দেহ রহিল না যে, ওটা কুটিল হাসি—অর্থ হইতেছে, কেমন হে, ঠিক আছে তো? বোকারামকে খুব ঠকানো গেল, হিঃ—হিঃ—”

স্বীকার করি, আমার মনের ভুল; কিন্তু তখন এর চেয়ে সরল সত্য সেখানে আর কিছু ছিল না।

.

বাসায় আসিয়া উঠিলাম। উঠানের মাঝখানে একটা চট-মোড়া তেলচিটে ডেক- চেয়ার, দেখিয়াই মনে হইল, মহিমবাবু ইহাতে আটহাতি কাপড় পরিয়া থেলো হুঁকায় তামাক টানিতেন। পাশে একটি চৌকি—রোদ বৃষ্টিতে মাঝখানটি বাঁকিয়া গিয়াছে, একটা পায়া নাই, সেখানে তিনখানা ইটের ঠেকনা দেওয়া। আমি বসিতে আগন্তুকদের কয়েকজন চৌকির উপর বসিল। ইহারা আমলা।

একটু পরিচয়াদি হইল। খুব বৃদ্ধগোছের একজন অগ্রণী হইলেন, “উনি পেশকার সাহেব, ইনি হাজিরনবিস, ইনি তহশীলদার, ইনি হচ্ছেন এক্‌মন্টবাবু (অ্যাকাউন্টেন্ট)।”

“হুজুরের কোনো রকম কষ্ট হয় নি তো পথে?”

অপর একজন বৃদ্ধের পরিচয় দিলেন, “আর ইনি দেওয়ানজী লালা রামকিষণলাল; সবচেয়ে প্রাচীন লোক এখানে।”

দেওয়ানজী দত্তলেশহীন মুখে হাসিয়া সেলাম করিয়া বলিলেন, “সব হুজুরকা মেহেরবানি।”

তাঁহার প্রাচীনত্বে আমার কি মেহেরবানি থাকিতে পারে বুঝিতে না পারিলেও বলিলাম, “বড় আনন্দের বিষয়।”

একটু চুপচাপ রহিল। দেওয়ানজী গলা পরিষ্কার করিয়া কি একটা বলিবেন, এমন সময় একজন পিওন একটা মাঝবয়সী কালো তেলচুকচুকে লোককে সামনে হাজির করল। দেওয়ানজী বলিলেন, “হুজুরের ‘টইলু’ (চাকর), নাম লোটনা। নে, সাহেবের সব গোছগাছ করে ফেল; খবরদার যেন কোনো রকম কষ্ট না হয়, তা হলে—”

চাকর পাইয়া মনটা একটু প্রফুল্ল হইল, কিন্তু দেখি লোটনার পাশে সেই কুকুরটা দাঁড়াইয়া,.. বুঝিলাম পিওনের সঙ্গে সঙ্গে সেও লোটনাকে ডাকিয়া আনিতে গিয়াছিল। দেওয়ানজীর কথা শেষ হইলে একটু সামনে আসিয়া লোটনার মুখের দিকে ঘাড়টা বাঁকাইয়া চাহিল, জিব বাহির করা, ডান চোখটা একটু টেপা; ভাবটা যেন, এর কথাই তোকে জানাতে গিয়েছিলাম—কেমন ঠেকছে?

একটু পরেই সবাই উঠিয়া গেলে লোট্‌না খুব লম্বা একটা সেলাম করিয়া বলিল, “হাম লৈহট্টি থাকছিল—তিন বরষ”—বলিয়া একটা সেলাম করিয়া দত্ত বিকশিত করিয়া দাঁড়াইল।

প্রথম এ রকম অদ্ভুত আত্মপরিচয়ে একটু রাগ হইল। তা ছাড়া সাহেবের সামনে ওরকম হাসির মানে কি? একটা ধমক দিয়া চৈতন্যসঞ্চার করিতে যাইতেছিলাম, সঙ্গে সঙ্গে মনে হইল—না, এ-ই এখন আশা-ভরসা, খুশি রাখাই ভালো। তাহা ছাড়া আমার হিন্দির পুঁজি যে রকম, ওর বাংলা জ্ঞানে অনেকটা সামলাইয়া লইব। আশ্চর্য হইয়া বলিলাম, “তিন বছর নৈহাটি ছিলি? তাই বলি, যেন চেনা-চেনা মুখ। আমার বাড়ি সেরামপুর কিনা—”

লোটনা হাতজোড় করিয়া কৃতার্থ হইয়া বলিল, “হাম সিরামপুর খুব জানে, হুঁয়ামে আদালত থেকে আমার মাসির ছেইলার জেহল হইয়াছিল।”

এই ইতিহাসপ্রসিদ্ধ জায়গা সম্বন্ধে আরও একটা এমন নূতন তথ্য পাইয়া অধিকতর বিস্মিত হইয়া বলিলাম, “সত্যি নাকি? সেরামপুর আদালত থেকেই জেলের হুকুম হয়েছিল? তবে তো দেখছি—”

লোটনা আনন্দে হাত কচলাইতে লাগিল।

চাবির রিঙটা প্যান্টালুনের পকেট হইতে বাহির করিয়া দিয়া বলিলাম, “যা, সুটকেসটা নিয়ে আয় তো—চামড়ার বাক্স।”

লোটনা সুটকেসটা আনিয়া চৌকির উপর রাখিল।

ডালাটা খুলিতেই কুকুরটা সরিয়া আসিয়া চৌকির উপর দুইটি পা তুলিয়া দিয়া দাঁড়াইল; আড়চোেখ দেখিলাম, দুইটি কানই খাড়া করিয়া গভীর কৌতূহলের সহিত বাক্সের ভিতর দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া রহিয়াছে। ভ্যালা বিপদ তো!

লোটনা পরিচয় দিল, বলিল, “ওর নাম রংলাল আছে; সাধু ভালা আদমিদের কুছভি বোলে না, চোরদের খুব পহছাতে আছে।”

ব্যাটা উজবুক কোথাকার! মনের রাগ মনে চাপিয়া বলিলাম, “আচ্ছা, তুই যা, দু বালতি জল তুলে নিয়ে আয় দিকিন। চা করতে জানিস?”

লোট্‌না হাসিয়া বলিল, “লৈহট্টিমে আমার চায়েরভি দোকান ছিল। একটাকায় ষোড়হো আনা নফা থাকত।”

ক্ষুদ্র ডাকাত! বিস্মিত ভাবে একবার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলাম, “আচ্ছা, আয় জল নিয়ে, বাতলে দিচ্ছি; সে দরের চা করলে চলবে না।”

সুটকেস হইতে পায়জামা, তোয়ালে, খাটো শার্ট, হালকা চটি, সাবান প্রভৃতি বাহির করিলাম। লোটনা যতক্ষণে জল লইয়া আসিল, আমি ততক্ষণে ধড়াচূড়া ছাড়িয়া ঢিলা পায়জামা শার্ট ঘাসের চটি পরিয়া তৈয়ার হইয়া গিয়াছি। এইবার হাত-মুখ ধুইয়া লওয়া, চাটুকু হইলে চা পান করিয়া সাহেবের সহিত একটু দেখা করিয়া আসা। তাহা হইলে এক প্রস্থ কাজ শেষ হইয়া যায়।

রংলাল চাকরটার সঙ্গে ইঁদারায় গিয়াছিল। ঘুরিয়া আসিয়া একটু যেন অবাক হইয়া দরজার কাছে দাঁড়াইল। ভঙ্গীটা ভাষায় প্রকাশ করিলে দাঁড়ায়, এ আবার কি রূপ! একটু পরে আমার পায়ের কাছে আসিয়া নাসিকা কুঞ্চিত করিয়া আঘ্রাণ লইতে লাগিল।

চাকরটা ধমক দিয়া বলিল, “খবরদার, মালিক হ্যায়!”

আমি একেবারে এতটুকু হইয়া গেলাম। কথাটা ঠিক এই রকম দাঁড়াইল যেন, হ্যাঁ, আমার বহিরাবরণে, বিশেষ করিয়া মিনিটে মিনিটে তাহা পরিবর্তিত করায়, এমন কিছু আছে বটে যাহাতে অন্য কিছু বলিয়া সন্দেহ হইবারই কথা, তবে আসলে আমি এদের মনিব আমি মাঝখানে অসহায়ভাবে পড়িয়া আছি, ইহারা দুইজনে এখন যেটুকু দাঁড় করায়।

কুকুরটা কথাটা ভালো করিয়া যাচাই করিবার জন্য চৌকির ওই কোণটার উপর গিয়া দাঁড়াইল। একবার ঘাড় বাঁকাইয়া দেখিল, তাহার পর হঠাৎ যেন চিনিতে পারিয়া কৌতুকরসে পরিপ্লুত হইয়া দুই সারি দত্ত বিকশিত করিয়া বাহিরের দিকে ছুটিয়া গেল।

যাক, আপদ গেল। উঠিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া বেশ ভালো করিয়া হাতমুখ ধুইয়া লইলাম, একটি টাটকা চুরুট ধরাইলাম, তাহার পর চৌকির উপর সাহেবী কায়দায় পা ছড়াইয়া ডেচেয়ারটায় গা ঢালিয়া দিলাম। লোটনা চায়ের যোগাড় করিতে লাগিল।

চায়ের সুমিষ্ট প্রত্যাশার সঙ্গে এবং নবীনতম পদমর্যাদার উপলব্ধিতে মনটি বেশ একটি আত্মতৃপ্তিতে মজিয়া আসিতেছে, এমন সময় দোরগোড়ায় নজর করিতেই দেখি, সারবন্দী একেবারে পাঁচ-পাঁচটি কুকুর, মাঝেরটি রংলাল।

বোধ হয় যে, এইমাত্র আসিয়াছে। কিন্তু তাহাদের তদগতভাবে দাঁড়াইবার ভঙ্গীতে আমার যেন মনে হইল, তাহারা অনেকক্ষণ আসিয়া আমায় নিঃশব্দে পর্যবেক্ষণ করিতেছে। একটি কুকুর মাদী, রংলাল যেন তাহার বান্ধবীকে এক আজগুবী চিজ দেখাইয়া তাহার মনোরঞ্জন করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে, আমার ঘাড়ের উপর দিয়া খাতির জমাইয়া লওয়া গোছের।

আমি মুখ তুলিয়া চাহিতেই সবগুলার মধ্যে একটা চঞ্চলতা পড়িয়া গেল। রংলাল মাদীটার ঘাড়ের কাছটা দাঁত দিয়া চুলকাইবার ভান করিয়া বোধ হয় কানে কানে কি বলিল, পাশের কুকুরটা হঠাৎ ঘুরিয়া আসিয়া সেখানটাতে জিজ্ঞাসুভাবে মুখ তুলিয়া দাঁড়াইল, তাহার পর এ ওর ল্যাজে একটা কামড় দিল; ও তাহার পা-টা ধরিয়া একটা ঝাঁকানি দিল এবং এইভাবে জড়াজড়ি করিতে করিতে সামনের জমিটাতে গিয়া লুটাপুটি গড়াগড়ি শুরু করিয়া দিল, সঙ্গে সঙ্গে হিঃ—হাঃ—ওফ্ প্রভৃতি নানা রকম অস্পষ্ট চাপা আওয়াজ।

ব্যাপারটা হাসিয়া খুন হইয়া যাইবার মতো এত কাছাকাছি যে, আমি কোনোমতেই নিজের সহজ ভাবটি রক্ষা করিতে পারিলাম না। আমায় উঠিতেই হইল, ট্রাঙ্ক হইতে আয়নাটা বাহির করিয়া, যতটা সম্ভব পোশাকের ছায়া ফেলিয়া মনের দ্বিধাটা মিটাইতে চেষ্টা করিলাম। এতই হাস্যকর একটা কিছু হইয়া দাঁড়াইয়াছে, যাহাতে শুধু কথায় কথায় নয়, নিতান্ত বাস্তবরূপে কুকুর-বিড়ালের পর্যন্ত হাসিয়া পেটে খিল ধরিয়া যায়?

চায়ের স্বাদ পাওয়া গেল না। স্ত্রীর উপরও একটু রাগ হইল, না হয় করিয়াছিলামই একটু বারণ, দিয়া দিলেই হইত কাপড়জোড়াটা, সময় আছে, অসময় আছে। আর কি যে আমার এমন বাধ্য তিনি! ঢের দেখা গেল।

.

চাকরি বেশ চলিতেছে। সাহেব সদয়, আমলারা বেশ অনুগত, ছোট সাহেব নামটাও চালাইয়া লইয়াছি; কিন্তু জীবন দুর্বহ হইয়া উঠিয়াছে।

কুকুরটার উপর দিয়া অনেক পরীক্ষা করা গেল। প্রথমটা এক কোণে চেন দিয়া বাঁধিয়া রাখা গেল, যাহাতে আমায় যখন তখন দেখিতে না পারে। তাহাতে সদাসর্বদা পাড়ার নানা জাতীয় কুকুর তাহার কুশল-সমাচারের জন্য এত উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল যে, ক্রমাগত কাজকর্ম ছড়িয়া তাহাদের পিছন লাগিয়া থাকার চেয়ে রংলালকে মুক্ত করিয়া তাহাদের নিশ্চিন্ত করাই সমীচীন বলিয়া মনে হইল।

এক এক করিয়া দুই তিনজনকে দান করিয়া দিলাম। যাহাকেই দান কর, তিন- চারদিনের মধ্যে তাহার বাড়ি হইতে চেনটা হারাইয়া যায়, তাহার পর রংলাল ফিরিয়া আসে। এই করিয়া প্রায় দুইটি টাকা ওই দিক দিয়া দণ্ড দিলাম।

মুশকিল এই যে, খোলাখুলি মারধোর করিতে পারি না। বাহ্যত তাহার অপরাধটা কি? দিব্য কাছে কাছে থাকে কামড়াটে নয়, কিছু নয়, নিমকহালাল কুকুরকে তাড়না করিবার কোনো ন্যায়সঙ্গত কারণই নাই; তবুও যখন বাড়িতে কেহ নাই, অথচ কুকুরটা একটা কান নামাইয়া, আর একটা কান খাড়া করিয়া পরম দার্শনিকের মতো আমায় অবলোকন করিতেছে, তাহাকে তাড়া যে না করিয়াছি এমন নয়। প্রথমটা উপেক্ষা করিয়াছি, আছে তো আছে, সামান্য একটা কুকুর তো! চাহিয়াও দেখি নাই। ক্রমে এমন একটা অস্বস্তি মনে খচখচ করিতে থাকে যে, একবার চাহিতেই হয়, তাহার পর থাকিয়া থাকিয়া ক্রমাগতই চাহিতে হয় এবং যদিও অপলক দৃষ্টিতে আমায় নিরীক্ষণ করা ভিন্ন তাহার কোনও দোষই থাকে না, তথাপি আমার মাথায় ক্রমশ যেন আগুন ধরিয়া উঠিতে থাকে, হাতের কাছে যাহা পাই, তাহা লইয়াই উঠি। খুন চাপিয়া যায়, ক্ষতিবৃদ্ধি-জ্ঞান থাকে না।

নিজেকেও বদলাইয়া দেখা গিয়াছে। হাফপ্যান্ট পরিয়া দেখিয়াছি, অর্থাৎ বিলাতী পোশাক অর্ধেক বলি দিয়া ফল হয় নাই। লুঙ্গি পরিয়া দেখিয়াছি, তাহাতে রংলাল পাড়ার তাবৎ কুকুরকে ডাকিয়া আনিয়া এমন সমারোহের সহিত আপ্যায়িত করিয়াছে যে, লুঙ্গিটা সেই দিনই সাহেবের খানসামা করিম শেখকে দান করিয়া দিয়াছি।

বাকি ছিল ধুতি-চাদরের পরীক্ষা। প্রাণের জ্বালায় ধরিতামও; কিন্তু হায় রে! এদিকে যে নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারিয়া বসিয়া আছি। ‘ছোট সাহেব’ নামটা এমন সাংঘাতিকভাবে ছড়াইয়া পড়িয়াছে যে, এখানে ধুতি-পাঞ্জাবি পাম্পশু আর আমায় এ জন্মে পরিতে হইবে না।

চারিদিকে নিরাশ হইয়া অবশেষে খোশামোদ ধরিয়াছি—ডাহা হীন খোশামোদ। কাছে ডাকিয়া আদর করি, “আয় রংলাল, ব্যাটা আয়, চ্যু-চ্যু। শুনছিস লোটনা? কুকুরটাকে মাঝে মাঝে একটু করে নাইয়ে দিস। জানিস তো কি করে নাওয়াতে হয় কুকুরকে?”

লোটনা বিজ্ঞভাবে হাসিয়া বলে, “লৈহট্টমে আমার একটা কুকুর থাকছিল, গঙ্গাজলে চান করতে গিয়ে ডুবে গেল।”

মনে মনে আশান্বিত হইয়া বলিলাম, “হ্যাঁ, তোর জানা আছে তা হলে, রোজ চান করাবি, বাড়িতে নয়, পুকুরে নিয়ে গিয়ে। বড্ড উঁচুদরের কুকুর, টের পাওয়া যাচ্ছে কিনা।”

কিছুই ফল হয় না। সেই সূতীক্ষ্ণ দৃষ্টি, সেই ব্যঙ্গ ভাবে এক কান নামানো, বেড়াইতে বাহির হইলে পাড়ার যত কুকুর জড় করিয়া সেই পিছু পিছু অনুসরণ—কিছুরই এতটুকু ব্যতিক্রম হয় নাই।

এসব অত্যাচারের উপর আবার খরচের জন্য মনস্তাপ আছে। রোজ মাংসের বন্দোবস্ত করিয়াছি, রাত্রে ভাতের সঙ্গে আধসের দুধ। সাক্ষাৎ আমারই বশীভূত হইবে বলিয়া, অন্তরে অন্তরে দগ্ধ হইলেও, নিজের হাতে খাওয়াই। এদিকে কয়েকদিন হইতে মাদীটাকে রোজ ডাকিয়া আনে; মাংস দুধ আর একটু বাড়াইয়া দিয়াছি, তাহাতে সন্তুষ্ট রাখিলে, রংলাল শীঘ্র বশ মানিবে এই আশায়।

আশা কতটা সফলতার পথে জানি না, তবে ঘাড় নীচু করিয়া খাইতে খাইতে রংলাল যেভাবে সঙ্গিনীর দিকে এক-একবার তাহার সেই মারাত্মক হাসির ভঙ্গীতে আড়চোখে চায়, তাহাতে যেন মনে হয় স্পষ্ট বলিতেছে, বোকারামকে ঠকাইয়া চলিতেছে মন্দ নয়, কি বল গো?

পূজার ছুটিতে পনরো দিনের ছুটি পাইয়া বাড়ি আসিয়াছি। স্ত্রী দেখিয়াই বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “এ কি, একেবারে যে আধখানা হয়ে গেছ! অথচ শুনি, এমন ভালো জায়গা, পশ্চিম—”

তাহা হইলে শরীরটাও ভাঙিয়াছে! আশ্চর্য কি? যা অশান্তি!

উত্তর করিলাম, “বিরহটা সবার ধাতে সয় না!”

স্ত্রী রাগিয়া বলিলেন, “রঙ্গ রাখ; এ যেন কুনজরে পড়ার লক্ষণ, শরীর যেন কালি মেরে গেছে!”

একটু চুপ করিলেন বটে, কিন্তু মনের কথাটা আর চাপিয়া রাখিতে পারিলেন না; বলিলেন, “লোকে বলে, জায়গাটা কামিখ্যের নাকি খুব কাছে? ওখানে নাকি ভেড়া-টেড়া করে?”

বলিলাম, “এই তো আমারই ওপর ঝুঁকেছিল, যখন দেখলে—ভেড়া হয়েই গেছি এখান থেকে, তখন ভাবলে—আর মরা ভেড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা কেন?”

তাঁহার মনের অবস্থার হিসাবে তামাশাটা বোধ হয় খুবই অসাময়িক হইল। মুখ ভার করিয়া কহিলেন, “আচ্ছা, হয়েছে, থাক। তোমার কিন্তু আর ওখানে যাওয়া হবে না। বলিয়া পোশাক-পরিচ্ছদ জিনিসপত্র গুছাইয়া এমন দৃঢ়তার সহিত বাক্সে ভরিয়া চাবি দিতে লাগিলেন, যেন এ বিষয়ে একেবারে চরম নিষ্পত্তি হইয়া গেল।

ছুটির প্রথম দিকটা ভালোই কাটিল। রংলালও নাই, প্যান্ট-কোটও বাক্সের ভিতর, কটা দিন ধুতি-চাদরের মধ্যে শরীরটাকে মুক্তি দিয়া এবং লোটনার বাংলার হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া যেন হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম।

ক্রমেই ছুটি ফুরাইয়া আসিতে লাগিল, কর্মস্থানের রংলালময় ছবিগুলি চোখের সামনে স্পষ্টতর হইয়া মনটাকে ভারাক্রান্ত করিয়া তুলিতে লাগিল। কি ভাবিলাম জানি না, একদিন স্ত্রীর কাছে কথাটা হঠাৎ প্রকাশ করিয়া ফেলিলাম, হাসিচ্ছলেই বলিলাম, “সেখানে একটা ভারি মজা হয়েছে, কুকুর যে এত মানুষের মতো লক্ষ্য করতে পারে জানতাম না, অন্তত রঙচঙ দেখলে তোমার মনে হতেই হবে, সে খুব বিবেচকের মতো তোমার কার্যকলাপ লক্ষ্য করছে।

কাহিনীটা আগাগোড়া বলিয়া গেলাম।

হাসিচ্ছলে আরম্ভ করিলাম বটে, কিন্তু ব্যাপারটা মূলত আমার কাছে লঘু ছিল না বলিয়াই হোক আর যে জন্যই হোক, বর্ণনাটা বেশ স্পষ্ট এবং একটানা হইল না। বাক্যে বাক্যে জড়াজড়ি করিয়া শুধু এইটুকুই স্পষ্ট করিয়া দিল যে, এর মধ্যে কোথায় যেন আমার একটু দুর্বলতা আছে, যা আমি গোপন করিতে চাহি।

স্ত্রী শোনার সময় কোথাও একটু হাসিলেন না, শোনার শেষে আরও গম্ভীর হইয়া গেলেন এবং মাথা নাড়িয়া প্রশ্ন করিলেন, “ওটা বুঝি তোমার কুকুর হল?”

আমি আশ্চর্য হইয়া বলিলাম, “এতক্ষণ ধরে তবে শুনলে কি? দেশী কুকুর, গায়ের রঙ রাঙা বলে—”

স্ত্রী বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “থামো বাপু, কুকুর তো কখনও কেউ দেখে নি! অমন একদৃষ্টে চাউনি কুকুরের?”

“সেইটিই তো বুঝতে পারি না; তবে আর তোমায়—”

“বুদ্ধি কি তোমার রেখেছে যে বুঝবে? না তোমরা পার এসব ব্যাপার বুঝতে? এ তো স্পষ্ট, কোনো খারাপ মেয়েমানুষ কুকুরের বেশ ধরে—”

আমি কুসংস্কারের দৌড় দেখিয়া একেবারে স্তম্ভিত হইয়া গেলাম। কহিলাম, “সর্বনাশ! একটা জলজ্যান্ত কুকুর, দিনরাত হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি করে বেড়াচ্ছে, দিনের আলোর মতো স্পষ্ট, আর তুমি কিনা—”

“যত স্পষ্ট তত সর্বনাশের গোড়া! তোমরা যখন এসব কিছু বোঝ না, তখন চুপ করে থাক। বিশ্বাস না হয়, এক্ষুনি তাঁতী-বউকে ডেকে পাঠাচ্ছি, তার মুখেই শোন। চন্দোরের মাও বোঝে, কিছু কিছু লক্ষণ মিলিয়ে ঠিক বলে দেবে কোন মেয়েছেলে কোথায় থাকে। আমার অদৃষ্টে শেষ পর্যন্ত যে কি আছে! মা মঙ্গলচণ্ডী যে—”

বাড়াবাড়ির সম্ভাবনা দেখিয়া আমি বলিলাম, “থাক, আর ওদের ডেকে কাজ নেই; কিন্তু খারাপ মেয়েমানুষই যদি হত কুকুরটা, অন্তত—”

স্ত্রী হাত উঁচাইয়া বলিলেন, “থাক, যে বোঝে না, তার সঙ্গে আর বৃথা তক্ক করতে চাই না। মোট কথা, তোমার আর ওখানে যাওয়া হবে না। আমি জানি, জায়গাটি কামিখ্যের একেবারে কাছে, তুমি আমায় ঢুকিয়ে ভেতরে ভেতরে এই সব—”

রাগ হইয়া পড়িল। বিশেষ করিয়া উহার এই কামাখ্যা-বাতিকে তো আমার প্রাণান্ত পরিচ্ছেদ হইয়াছে। সেবার বম্বে বেড়াইতে গেলাম, অসুখের টেলিগ্রাম দিয়া পৌঁছিবার পরদিনই আনাইয়া লইলেন। আসিয়া শুনিলাম টের পাইয়াছেন জায়গাটা কামাখ্যার কাছাকাছি। দিল্লি লাহোর কামাখ্যা হইতে বেশি দূর নয় বলিয়া এ পর্যন্ত পূজার ছুটিতে বেড়াইতে যাওয়া হইল না। রেঙ্গুন কামাখ্যা ওঁর মতে দুইটা পাশাপাশি স্টেশন। দুই দিন উপবাস করিয়া পড়িয়া রহিলেন, তিনশো টাকার অমন চাকরিটা লওয়া হইল না। আমার যাওয়ার কথা হইলে কামাখ্যা আবার রানাঘাট কৃষ্ণনগর পর্যন্ত ঠেলিয়া আসে, এর চেয়ে আর বিপদ কি আছে? মা জানকীর দেশ বলিয়া এ ক্ষেত্রে কোনো রকমে পরিত্রাণ পাইয়াছিলাম, কিন্তু মনের সন্দেহ আর কতদিন চাপা থাকিবে?

বিরক্তির সহিত বলিলাম, “কামিখ্যে তো তোমার চারদিকেই—দেখ তো কাণ্ড! একটা কুকুর চেয়ে থাকে বলে আমায় চাকরি ছাড়তে হবে? এমন জানলে কোন মুখ্য তোমায় বলতে যেত—”

প্রথম একরাশ প্রশ্ন বর্ষিত হইল। “প্রাণের চেয়ে কি চাকরি বড়? শাক ভাত খাইয়া লোকের দিন চলে না? দেশের যে সকল লোক বিদেশে চাকরি করে না, তাহাদের স্ত্রী-পুত্র কি বাঁচিয়া নাই?”

প্রশ্নগুলি ক্রমে ব্যক্তিগত রূপ ধারণ করিল—এই মাস চারেকেই জায়গাটার উপর এতটা টান হইল কেন আমার? কুকুরটাকে উপরে উপরে দেখিতে পারি না, অথচ তাহার দুধ মাংস বরাদ্দ করিবার কারণ কি? যদি কথাটা সোজাই ছিল তো এতদিন লুকাইবার কি কারণ ছিল? সেই বলিলাম, অথচ আসিয়াই বলি নাই কেন?

দেখিলাম হাতে আঁচল উঠিয়াছে, চোখের পাপড়িগুলি একটু ঘনঘন উঠানামা করিতেছে। বুঝিতে বাকি রহিল না, এবারে অশ্রুস্রোতে যে সব প্রশ্ন নামিবে, সেগুলি হইবে যেমন উত্তপ্ত, তেমনই বেগবান। আপাতত চাকরিসমস্যার চেয়ে সেটা গুরুতর হইবে বুঝিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িলাম।

রাত্রে আহার করিবার সময় দেখিলাম, ভাবটা প্রসন্ন। চাকরির কথাটা তুলিব তুলিব করিয়া প্রয়োজনারূপ শক্তি সঞ্চয় করিতেছি। বলিলেন, “একটা মস্ত বড় সুখবর আছে, কি খাওয়াবে বল?

বলিলাম, “ভেড়ার মাংস খাও তো লোক ডাকি, গা থেকে কেটে দিক।”

রাগিতে গিয়া হাসিয়া বলিলেন, “খালি তামাশা! আজ তাঁতীগিন্নি বুড়িকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। সব শুনে কি বললে বল তো?”

“শেকল গড়াতে।”

“শুনেই বললে, কুকুর না হাতি! কোনো মেম-পত্নী; দিশি কোনো কু-মেয়েমানুষ হলে ও-পোশাকের দিকে ঘেঁষত না। বললাম, তবু ভালো। মা মঙ্গলচণ্ডীর কাছে তক্ষুনি পাঁচসিকে মানত করে তুলে রাখলাম।”

“তাঁতী-বউয়ের কি বিদায় হল?”

“ওরা গরিব মানুষ ডাকলে আপনজন আসে, ভালো পরামর্শ-আশটা দেয়। দোব আর কি? উলটে বরং বললে, ও পাপ কেরেস্তানী পোশাক আর বাড়িতে রেখো না। বার করে দিলাম। বুড়ো মানুষ বয়সের ভারে নুয়ে গেছে তবু সেই পেল্লাই গাঁঠরি ঘাড়ে করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে গেল। শুনে অবধি এমন হয়েছিল, আদাড়ে জিনিসগুলো সরিয়ে হাড়ে যেন বাতাস লাগল। ও কি, হাত গুটোচ্ছ যে! তাঁতীবউয়ের কল্যাণে চাকরি রয়ে গেল, কোথায় খুশি হয়ে দুটি খাবে, না—। মাছের ডালনাটা আর একটু দিই, বস।”

রাগে-বিরক্তিতে সে রাত্রে আর কথা কহিলাম না, কেননা মুখ খুলিলেই একটু বাড়াবাড়ি হইয়া যাইত। অন্তরাল হইতে একবার কানে গেল, স্ত্রী ঝিকে সঙ্গোপনে বলিতেছেন, “দেখছিস তো! ঠিক মিলে যাচ্ছে; তাঁতীবউ বলেছিল, ও পোশাকের ওপর কুদৃষ্টির জন্যে একটা টান পড়ে গেছে, একচোট ভয়ঙ্কর চটবেই, দেখেছিস তো রাগের বহর?”

দুঃখও হইল, ন্যায়সঙ্গত রাগের এমন কদর্থ, এতটা অমর্যাদা পূর্বে কাহারও ভাগ্যে ঘটিয়াছে কি না জানি না। আমি যত চটিতেছি, উহারা দিব্য বসিয়া ততই লক্ষণ মিলাইতেছে।

পরের দিন কিন্তু ব্যাপারটা আমার কাছে অন্য ভাবে দেখা দিল। ভাবিলাম, যাক, সমস্ত ব্যাপারটা গোটা ত্রিশ-চল্লিশ টাকার উপর দিয়া যদি শেষ হয় তো মন্দের ভালো। এখন আমায় বাধ্য হইয়া ধুতি-চাদর-পরিহিত হইয়া কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইতে হইবে। নিজের ইচ্ছায় কোট-প্যান্ট ছাড়া হইত না, এতে একটা সান্ত্বনাও রহিল, আর ওদিকে রংলাল—সমস্যাও মিটিল। দুঃখ রহিল, ‘ছোটাসাহেব’ আবার ‘বড়া বাবু’ হইতে চলিলেন। তাহা হউক, মোহটা অনেক কাটিয়া আসিয়াছিল, বাকিটুকু কাটিতে দেরি হইবে না।

বাকি থাকে—হঠাৎ এ পরিবর্তনের জন্য সাহেবকে এবং অনাগত আমলাবৃন্দকে একটা অজুহাত দেখানো, অন্তত জিজ্ঞাসা করিলে একটা সমীচীন উত্তর দেওয়া। একটি বেশ সভ্য এবং সুসঙ্গত মিথ্যা রচনায় ব্যাপৃত রহিলাম।

.

কুঠির টমটম হইতে নামিয়া দেখিলাম, অভ্যর্থনার জন্য কয়েকজন আমলা প্রাঙ্গণে উপস্থিত রহিয়াছেন। সেলাম, প্রতি-সেলাম, কুশল-প্রশ্নাদি হইল। লক্ষ্য করিলাম লালা রামকিষাণ সেলাম না করিয়া করজোড়ে প্রণাম করিলেন। মুখে একটি তৃপ্ত হাসি।

সকলের নয়নে এবং অধর-কোণে একটি প্রশ্ন নাচিয়া বেড়াইতেছিল, আগুসার হইয়া আমি নিজেই সবার কৌতূহল মিটাইয়া দিলাম। বলিলাম, “হ্যাঁ, আর সবই তো কুশল, তবে গাড়ি থেকে আমার সুটকেসটা কাল রাত্রে চুরি হয়ে গেছে, পোশাক-পরিচ্ছদ যা কিছু সব তাইতেই ছিল। এই দেখুন না, ভাগ্যিস এক সেট কাপড়-চোপড় এনেছিলাম!”

চারদিক থেকে সহানুভূতির একটি মৃদু কলরব উঠিল। লালা রামকিষণ একেবারে চক্ষু বিস্তারিত করিয়া বলিলেন, “তাই নাকি? ভারি জুলুম তো!”

বেশ বোঝা গেল, সকলেই ভিতরে ভিতরে খুশি এবং আমার ক্ষতিতে লালা রামকিষাণের আনন্দটা সকলের চেয়ে অধিক বলিয়াই তাঁহার এত আড়ম্বরের সহিত সহানুভূতি দেখানো দরকার হইয়া পড়িল। ইহার পরে যে কথাবার্তা হইল, তাহার মধ্যে মর্যাদার ব্যবধান রক্ষা করিয়াও এমন একটি নিগূঢ় আত্মীয়তার সুর ছিল যে, তাঁতী-বউয়ের উপর আমার আক্রোশটা ধুইয়া মুছিয়া গেল। বুঝিলাম, বিদেশে ‘ছোটা সাহেব’ হইয়া একলা একলা থাকার চেয়ে ‘বড় বাবু’ হইয়া সবার হৃদয়ের সান্নিধ্য লাভ করা সমধিক ভাগ্যের কথা।

কোঁচানো চাদরের হাওয়া খাইতে খাইতে চেয়ারে বসিয়া গল্প করিতেছি, রংলাল হাজির। দূরে দাঁড়াইয়া প্রথমে দুইটা কান খাড়া করিয়া পরে একটা কান নামাইয়া মাথাটা কাত করিয়া শতপ্রকারে লক্ষ্য করিতে লাগিল। আমিও অল্প অল্প হাসিতে হাসিতে দেখিতে লাগিলাম, কি করে! ক্ষণেক পরে বলিলাম, “কি রে, রংলাল, চিনতে পারিস না?”

আওয়াজ শুনিতে যা দেরি, রংলাল ছুটিয়া আসিয়া একেবারে কোলে লাফাইয়া হাঁটুতে থাবা তুলিয়া আদর খাইয়া, আমার জামা-কাপড় চাটিয়া-চুটিয়া এক কাণ্ড করিয়া তুলিল।

অনেক দিন পরে দেখার জন্যই এই স্নেহের উপদ্রব; কিন্তু আমার মনে হইল, কোট- প্যান্টালুন-মুক্ত বলিয়াই কুকুরটা এতদিনে এই প্রথম তাহার নির্মল পশুহৃদয়ের সমস্ত প্রীতি দিয়া অভিষেক করিয়া লইল।

আমার ঘাড় হইতে মেম-পত্নী না হউক, সাহেব-ভূত যে নামিয়া গিয়াছে তাহাতে আর সন্দেহ নাই। ওঝা গিরির যশ খানিকটা তাঁতী-বউকে দিতে হয় বটে, কিন্তু অধিকাংশই যে রংলালের প্রাপ্য, সে কথা আর কেহ না জানিলেও আমি মর্মে মর্মে জানি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *