রংমহলের রংমশাল

রংমহলের রংমশাল

প্রথম দৃশ্য

[মেঘলা আকাশ, দুপুরবেলাতেও চারিদিক ছায়ামায়াময়৷ গাঁয়ের প্রান্তে পাঠশালার একচালা৷ পাঠশালার পরেই ধুধু করছে তেপান্তর মাঠ৷ মাঠের একধার দিয়ে বন-শ্যামলতায় বোনা জরির পাড়ের মতো বয়ে যাচ্ছে সুন্দরী নদী ]

ছেলের দল পাততাড়ি বগলে করে গান গাইতে গাইতে আসছে-

গান

পাঁচ দুকুনে দশটি গণ্ডা,
সেই হিসেবে দাও না মণ্ডা৷
দুয়ে পক্ষ, তিনে নেত্র,
ভুললে পরে পড়বে বেত্র,
গুরুমশাই বেজায় ষণ্ডা!

অমল৷ ওরে, সূয্যিঠাকুর আজ সকাল থেকেই ঘুমিয়ে পড়েছেন৷

কমল৷ তাই মেঘে মেঘে বুঝি তাঁর নাক-ডাকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে?

বিমল৷ ধেৎ, নাক কি কখনো অত জোরে ডাকতে পারে রে বোকা?

নির্মল৷ সূয্যিঠাকুরের নাসিকা কী বড়ো-যে-সে নাসিকা রে? বাবার মুখে শুনেছি সূয্যি নাকি আমাদের পৃথিবীর চেয়ে ঢের বড়ো! সূয্যিমামার নাক, বাজের মতন ডাক!

অমল৷ তোদের নাক-টাকের কথা এখন থো কর৷ শুনছিস না, আকাশ যেন আজ আয় আয় বলে ডাক দিচ্ছে? আজ কি আর শুকনো পড়ায় মন বসবে?

কমল৷ ঝিল-বিল যেন আজ শালুক ফুলের তালুক হয়ে উঠেছে!

বিমল৷ ঠান্ডা বাতাস মেখেছে কেয়া ফুলের আতর!

নির্মল৷ ময়ূর ডাকছে কেমন বন-কাঁপানো তালে তালে!

সকলে৷ ওরে, চল চল, আজ আর পাঠশালায় ঢোকা নয়, আজ আমরা বনবাদাড়ে যেখানে খুশি যাব, মাঠে-বাটে ছুটোছুটি-খেলা করব, নদীর ধারে গলা ছেড়ে গান গাইব!

গান

তেপান্তরের মন্তরে সব মন মেতেছে ভাই!
কে জানে তাই আমরা সবাই কী পেতে চাই!
মন মেতেছে ভাই!
ময়ূর নাচে পেখম তুলে,
ফড়িং নাচে ঘাসের ফুলে,
মেঘরা সেধে বলছে চলো, স্বপনদেশে যাই,
মন মেতেছে ভাই!
আকাশ ডাকে, বাতাস ডাকে, নদীর হাসি-ঢেউরা ডাকে,
ডাকছে ভ্রমর-মৌমাছিরা সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে!
পুথির পড়ায় ছুটি নিয়ে
চলরে ছুটি মাঠ পেরিয়ে,
দিঘির জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে পদ্মমুড়ি খাই!
মন মেতেছে ভাই!
অমল৷ হুঁ:, কিন্তু আমাদের মাথার উপরে কে আছেন জানিস?
কমল৷ হ্যাঁ, গুরুমশাই-
বিমল৷ আর তাঁর সমস্ত বেত-

নির্মল৷ কানুটি, গাঁট্টা!

অমল৷ (শিউরে উঠে) বাপরে, দরকার নেই আর মেঘের ডাকে সাড়া দিয়ে! চল গুটিগুটি পাঠশালায় ঢুকি, গুরুমশাই এক্ষুনি এসে পড়বেন!

কমল৷ এসে পড়বেন কী, ওই দেখ এসে পড়েছেন!

(সকলে সভয়ে গাঁয়ের পথের দিকে ফিরে তাকাল)

বিমল৷ কিন্তু উনি কি গুরুমশাই?

নির্মল৷ ওঁর মাথায় টিকি দুলছে না, হাতে বেত লকলক করছে না, কোমরে ভুঁড়ি হাঁসফাঁসিয়ে উঠছে না-উনি কি গুরুমশাই?

কমল৷ (দু-পা এগিয়ে গিয়ে) ওঁর গলায় দুলছে ফুলের মালা, হাতে রয়েছে শ্বেতপদ্ম আর বাঁশি, মুখে শুনি গানের তান আর দুটি পায়ে নাচের ছাঁদ! উনি তো গুরুমশাই নন! ওঁকে দেখে তো পেটের পিলে চমকে উঠছে না!

সকলে৷ তবে উনি কে, তবে উনি কে!

(নাচের ভঙ্গিতে গাইতে গাইতে কবির প্রবেশ)

গান

গানের মানুষ গান গেয়ে যাই-তাইরে না রে, তাইরে না রে!
কেউ শোনে আর কেউ শোনে না গাই তবু গান দ্বারে দ্বারে-
তাইরে না রে, তাইরে না রে!
ঝরনা এখন একলা ঝরে,
নিজের মনে গান সে ধরে,
বিজন বনের দোয়েল শ্যামা গান যে শোনায় বারে বারে-
তাইরে না রে, তাইরে না রে!
প্রজাপতি যে-সুর বোনে নীরব তানে, (তাইরে নানা!)
সেই রাগিণী শুনছি আমি প্রাণের কানে, (তাইরে নানা!)
শুনছি যত গাইছি তত
ফুটিয়ে মুকুল শত শত,
গানের ভেলা ভাসিয়ে চলি কান্না-হাসির পারাবারে-
তাইরে না রে, তাইরে না রে, তাইরে না রে, তাইরে না রে!

কমল৷ আপনি কে?

কবি৷ ‘আপনি’ বললে তো সাড়া দেব না ভাই, আমাকে ‘তুমি’ বলে ডাকো৷

কমল৷ তুমি কে ভাই?

কবি৷ গুরুমশাই!

অমল৷ তোমার মুখে নেই ধমক, তোমার হাতে নেই বেত, তুমি কীরকম গুরুমশাই?

কবি৷ ধমকের বদলে আমার মুখে আছে হাসি, আর বেতের বদলে হাতে আছে বাঁশি৷ আমি নতুন গুরুমশাই৷

বিমল৷ যখন হিতোপদেশ মুখস্থ হবে না, তখন তুমি আমাদের ধমক দেবে?

কবি৷ না, তখন আমি হাসব৷

নির্মল৷ যখন আঁক কষতে পারব না, তখন তো তুমি আমাদের বেত মারবে?

কবি৷ না, তখন আমি বাঁশি বাজাব৷

সকলে৷ আর পাঠশালায় না গিয়ে আমরা যখন পথে পথে টো টো করে খেলে বেড়াব?

কবি৷ (হেসে) তখন আমি তোমাদের খুব খুব খুব ভালোবাসব!

সকলে৷ (হাততালি দিয়ে নেচে উঠে) ওহো, কী মজা রে, কী মজা!

গান

সকলে-

আমাদের এই মজার গুরু!
হিতোপদেশ তুললে শিকেয় শাসায় নাকো কুঁচকে ভুরু!
আঁকের খাতা রাখলে মুড়ে
মারবে নাকো ঘুসি ছুড়ে,
বেতের ঠেলা নেইকো যখন হোক না শখের খেলা শুরু!

কমল৷ কিন্তু ভাই, তোমাকে তো আমরা গুরুমশাই বলে ডাকতে পারব না! ও-নামে ভয় হয়৷

কবি৷ আমাকে তো কেউ গুরুমশাই বলে ডাকে না ভাই!

অমল৷ তবে কী বলে ডাকে?

কবি৷ কবিঠাকুর৷

সকলে৷ (সুরে) কবিঠাকুর কবিঠাকুর? বেশ নাম! ও-নামে নেই গুরুগিরির হাঙ্গাম!

কবি৷ আচ্ছা ভাই, এখন বলো দিকি তোমরা কী খেলা খেলতে চাও?

সকলে৷ আজ আমরা বনবাদাড়ে যেখানে খুশি যাব, মাঠে-বাটে ছুটোছুটি-খেলা করব, নদীর ধারে গলা ছেড়ে গান গাইব!

কবি৷ (মাথা নেড়ে হাসতে হাসতে) বেশ, বেশ, তাই ভালো৷ তোমাদের পুরোনো গুরুমশাই আজ বাদলা পেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন, চলো, সেই ফাঁকে আমরা চুপিচুপি খানিক বেড়িয়ে আসি৷ কিন্তু কোনদিকে যাই বলো দেখি?

সকলে৷ তুমিই বলো কবিঠাকুর!

কবি৷ ওই যেখানে সবুজ বনের ঠান্ডা ছায়ায় সুন্দরী-নদীর জলবীণায় সুরের লহর দুলছে, যেখানে কেয়া-কদমের শুভ্র হাসির আসর বসেছে, সেখানে রোজ কারা আনাগোনা করে তোমরা তার খবর রাখো কী?

সকলে৷ (সাগ্রহে) কারা আনাগোনা করে, কারা আনাগোনা করে?

কবি৷ যাদের তোমরা চিনেও চেনো না, দেখেও দেখো না, তারা৷

সকলে৷ তারা কি বাঘ-ভাল্লুক?

কবি৷ না৷

সকলে৷ তারা কি ভূত-পেতনি?

কবি৷ না৷

সকলে৷ তবে?

কবি৷ আমার সঙ্গে দেখবে এসো৷

দ্বিতীয় দৃশ্য

[সুন্দরী নদীর ধারে বনভূমি, চারিদিকে ছোটো-বড়ো ফুলগাছের সামনে খানিকটা খোলা জমি৷ সবুজ ঘাসের বিছানায় অজস্র ফুল ছড়ানো৷

আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা ও চোখ-ধাঁধানো বিদ্যুতের ছটা আরও বেড়ে উঠেছে ]

(গাইতে গাইতে কবির প্রবেশ৷ পিছনে পিছনে আর সকলের আগমন)

কবির গান

বৃষ্টি আসে, বৃষ্টি আসে!
কোন সে সজল কাজললতার কাজল ঝরে নীলাকাশে!
দেখে ধরায় কালোয়-কালো,
লুকোতে চায় লাজুক আলো,
ফুলের ফুলুট বাজছে তবু লতাপাতায় শ্যামলা ঘাসে৷
ছায়াপরীর ঘুম ভাঙিয়ে বনে বনে, -বৃষ্টি আসে!
মায়াপুরী জাগিয়ে দিয়ে মনে মনে-বৃষ্টি আসে!
কদম-কেয়ার কেয়ারিতে
কাঁপন নাচে দেয়ার গীতে,
ঝিলমিলিয়ে বিজলিকে মেঘমহলে কে আজ হাসে!

ছেলেরা৷ (সকলে সকৌতুকে) ওরে, ওরে, বৃষ্টি এল রে বৃষ্টি এল! আজ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আমরা সবাই ঘর-পালানো খেলা খেলব৷

কবি৷ শোনো ছোট্ট বন্ধুরা! চলো, আমরা ওই ঝুপসি বট গাছের তলায় গিয়ে লুকিয়ে বসে থাকি গে৷

কমল৷ (সভয়ে) ওখানে দিনের বেলাতেই রাতের বাসা!

অমল৷ ওখানে যে অন্ধকারে চোখ চলবে না!

কবি৷ (সহাস্যে) ওরে ভাই, আজ যে আমাদের সবাইকে বাইরের চোখ বন্ধ করে ফেলতে হবে!

বিমল৷ তাহলে দেখব কেমন করে?

কবি৷ ওরে ভাই, আজ যে আমাদের সবাইকে মনের চোখ খুলে রাখতে হবে!

সকলে৷ (সবিস্ময়ে) মনের চোখ!

কবি৷ হ্যাঁ রে ভাই, হ্যাঁ৷ মন যাদের জ্যান্ত আর রঙিন, নয়ন মুদে তারা যা দেখতে পায়, বাইরের চোখে বড়ো বড়ো দূরবিন লাগিয়েও তা দেখা যায় না! মনের চোখে অন্ধকারও হয়ে ওঠে ‘সার্চ লাইটে’র মতো!

কমল৷ (সন্দিগ্ধ স্বরে) তুমি কি সত্যি বলছ কবিঠাকুর?

কবি৷ কবির কাছে কিছুই মিথ্যে নয় ভাই! চলো তবে, অন্ধকারে চুপ করে বসে থাকবে চলো, এখনই সেখানে রংমহলের রংমশাল জ্বলে উঠবে৷

[কবির পিছনে পিছনে এগিয়ে সবাই ধীরে ধীরে ঝুপসি বটগাছের অন্ধকারের ভিতরে মিলিয়ে গেল৷ খানিকক্ষণ জনপ্রাণীকে দেখা গেল না৷ আলো আরও ঝিমিয়ে পড়ল-ঝরতে লাগল বাদল ঝরনা৷ অন্ধকারের ভিতর থেকে ভেসে এল কবির বাঁশির মেঘমল্লার সুর৷

খোলা জমির উপরে নৃত্যচপল পায়ে ছুটে এল শরীরিণী বর্ষারানি, পরনে মেঘডুম্বুর শাড়ি, কাজলবরণ এলোচুলে জ্বলছে বিদুৎ চমক ]

বর্ষার গান

রুনুঝুনু রুনুঝুনু-ভুবনের খেলাঘরে,
রিমিঝিমি রিমিঝিমি-আলো-ছায়া খেলা করে৷
নূপুরের রুমুঝুমু, নীল ঘাসে খায় চুমু,
ছুটোছুটি করে মেঘ চপলার মালা পরে!
ছুঁয়ে আঁখিহাসিধারা চাতকেরা গানে সারা,
ঝুরুঝুরু ভিজে বায়ে যূথি-চাঁপা-বেলা ঝরে৷

[বর্ষার গান থামল, কিন্তু নাচ থামল না৷ একদল মেঘের প্রবেশ৷ বর্ষার চারিদিকে মণ্ডলাকারে ঘুরে ঢিমে তালে নাচতে নাচতে মেঘেরা গান ধরল৷ গান থামলেও তাদের নাচ থামল না৷ তারপর যে-তালে মেঘেরা নাচছে তার দ্বিগুণ দ্রুত-অর্থাৎ দুন তালে বিজলিবালা ঢুকে মেঘেদেরও বেড়ে নাচ-গান ধরল এবং তার গান যেই শেষ হল অমনি বজ্র গান গাইতে গাইতে ঢুকে বিজলিরই তালে তার পিছনে অনুসরণ করতে লাগল৷ তার পর ঝড়ের প্রবেশ, সে মণ্ডলে যোগ না দিয়েই গান ও এলোমেলো নাচ আরম্ভ করল| ]

গান

মেঘদল৷ তোম-তানানানা, বোম-বোম-বোম, ববম-ববম-বোম!

ধুমধড়াক্কা, পাইবে অক্কা ব্যোম-রবি-তারা-সোম!

(বিজলিবালার প্রবেশ)

বিজলি৷ আমি আজুলি বিজলিবালা,

আঁচলে আলোর ডালা,

পলকে পুলকে আঁকি আর ঢাকি মায়াছবি অনুপম৷

মেঘদল৷ তোম-তানানানা-প্রভৃতি

বজ্র৷ আমি মহা বাজ, ডাহা জাঁহাবাজ-চপলার দ্বারবান,

চিকুর-চমকে আমার ধমকে পেটে পিলে আনচান!

ঝড়৷ আমি শঙ্কর-কিঙ্কর,

ধিঙ্গি, ভয়ংকর!

ভোঁ-ভোঁ ছুটে ধরা ভেঙে-ভুঙে শিঙা বাজাই ভভম্ভম!

মেঘদল৷ তোম-তানানানা-প্রভৃতি

[সকলের প্রস্থান৷ কেউ কোথাও নেই-কেবল কবির বাঁশির রাগিণী শোনা যাচ্ছে৷ তার পর শোনা গেল বাঁশির সুরের তালে তালে নেপথ্যে নূপুরের ধ্বনি এবং তার পর ফুলকুমারীদের (যূথি, বেলা ও জর্দাগোলাপ) প্রবেশ ]

গান

ফুলকুমারীরা৷ মৌমাছি গো, ঘুমোও নাকি? প্রজাপতি, ওগো অলি
মিষ্টি তোদের গানের কথাই করছি যে ভাই বলাবলি!
আকাশ জুড়ে মেঘের ভেলা,
আয় না মোরা করব খেলা,
বসিয়ে নতুন রঙের মেলা ভরিয়ে তুলি কাননতুলি৷
(গাইতে গাইতে ভ্রমর, প্রজাপতি ও মৌমাছির প্রবেশ)
ফুলকুমারী, ফুলকুমারী!
আজ নেমেছে বাদলা ভারি,
পাখনা পাছে যায় ভিজে ভাই, ছেড়েছি তাই
কুঞ্জগলি!

[একদিকে দুঃখিতভাবে ভ্রমর প্রভৃতির এবং অন্যদিকে ফুলকুমারীদের প্রস্থান৷ অল্পক্ষণ কেউ কোথাও নেই-বাজছে কেবল কবির বাঁশিতে হাসিমাখা খেলার সুর| ]

(ব্যাং, গঙ্গাফড়িং ও শামুকের প্রবেশ)

কোরাস৷ গ্যাঙর-গ্যাঙর, তিড়িং-মিড়িং৷ আজকে যাব ক্যালকাটা

মার্কেটেতে কিনব মোরা তোপসে-ইলিশ আর বাটা৷

ফড়িং৷ ব্যাং-ভায়া গো! শামুক-খুড়ো! জোরসে লাগাও লম্ফ,

পাঞ্জাব-মেল ধরতে গেলে হবে যে বিলম্ব!

শামুক৷ কেমন করে হাঁটব জোরে, ফুটছে গায়ে চোরকাঁটা!

কোরাস৷ গ্যাঙর-গ্যাঙর-প্রভৃতি

ব্যাং৷ ফড়িং ভায়া, বড্ড খিধে, কোথায় মশা-মক্ষী!

শূন্য-পেটে মূর্ছা গেলে সামলাবে কে ঝক্কি?

শামুক৷ দৌড়ে গেছে দম বেরিয়ে, তেষ্টাতে বাপ প্রাণ টাটা!

কোরাস৷ গ্যাঙর-গ্যাঙর প্রভৃতি

[প্রত্যেকে তাদের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে প্রস্থান করল৷ আবার খানিকক্ষণ কারুকে দেখা গেল না, খালি শোনা গেল কবির বাঁশির আলাপ¯]

[নেপথ্যে বাঁ-দিক থেকে গানের সুরে শোনা গেলো ]

‘সাত-ভাই চম্পা, জাগো, জাগো, জাগো রে!’

[নেপথ্যে ডানদিক থেকে সম্মিলিত কন্ঠে শোনা গেলো]

‘কেন বোন পারুল, ডাকো, ডাকো, ডাকো রে?’

(একদিক থেকে পারুল ও আর একদিক থেকে সাত-ভাই চম্পাদের প্রবেশ)

গান

পারুল৷ এসেছে, রূপকথার এক রাজকুমার!
চাঁদিমা নিছনি যে চায় তার চুমার!
যেতে চায় আমায় নিয়ে
বলে যে, করবে বিয়ে!
শুনে তাই ভয় হয়েছে ভাই আমার!
সাত-ভাই-চম্পারা৷ ওরে বোন পারুলবালা!
রূপে তোর কানন আলা,
কুমারে ভয় কোরো না,
ধরি আয় বিয়ের পালা!
(রূপকথার রাজকুমারের প্রবেশ ও গান)
শোনো গো ফুলের মেয়ে! এসেছি মুখটি চেয়ে,
হাতে মোর হাতটি রাখো আজ তোমার!

[পারুলের লজ্জিত হাত দুখানি নিজের হাতে নিয়ে রূপকথার রাজকুমার মাঝখানে দাঁড়াল এবং তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে সাত-ভাই-চম্পাদের নাচ – গান ]

গান

বাদল-মাদল বাজিয়ে চল,
বনের ময়ূর নাচিয়ে চল!
কাজলা বেলায় মেঘলা খেলায়
ফুলের সভা সাজিয়ে চল! (সকলের প্রস্থান)

[বিজন বনে কবির বাঁশি এবার ধরল করুণ কান্নার সুর৷ অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে উঠল ]

(অতি-অলস নাচের ভঙ্গিতে ঝরাফুলের প্রবেশ)

গান

ঝরাফুল৷ ওগো, আমি ঝরাফুল ঝরে ঝরে পড়ি একলা ঘাসের কোলে,
দেখো, এখনও রয়েছে আতর আমার, রাঙিমা যায়নি জ্বলে৷
তবু চায় না আমায় কেহ,
মোর ভেঙেছে তরুর গেহ,
তাই বাদলের বায় করে হায়-হায় কেঁদে দূরে যায় চলে৷
ভিজে মেঘের অশ্রুনীরে,
ঝরে পরাগকেশর ধীরে,
আর জাগিব না আমি নবপ্রভাতের বিহগ-বীণার বোলে৷

(তৃণশয্যার উপরে দুই চোখ মুদে এলিয়ে শুয়ে পড়ল)

[চারিদিক নিবিড় তিমিরের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল-তখনও জেগে রইল কেবল কবির বাঁশির কন্না ]

তৃতীয় দৃশ্য

[পাঠশালার অভ্যন্তর ভাগ৷ একদিকে উচ্চাসনে গুরুমশায়ের স্থির মুর্তি�Í]

(বাইরের দরজা দিয়ে কবির প্রবেশ)

কবি৷ (বাইরের দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে) ওহে বন্ধুরা, তোমরা ভিতরে আসছ না কেন? ভয় নেই, পাঠশালায় আসনি বলে আজ গুরুমশাই তোমাদের কিছু বলবেন না!

কমল৷ (দরজার ভিতরে মাথা গলিয়ে ভয়ে ভয়ে) সত্যি বলছ কবিঠাকুর? গুরুমশাই আমাদের কিছু বলবেন না? আমাদের বেত মারবেন না?

কবি৷ (হেসে) না, গুরুমশাই আজ কথাও কইবেন না, বেতও তুলবেন না৷

(সকলে একে একে সংকুচিতভাবে ভিতরে এসে দাঁড়াল)

কমল৷ (চুপিচুপি, কবিকে) গুরুমশাই অমন চুপ করে আছেন কেন? উনি কি বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছেন?

কবি৷ কাছে গিয়েই দেখে এসো না৷

[ছেলেরা সন্তর্পণে গুরুমশাইয়ের কাছে গিয়ে তাঁকে দেখতে লাগল৷ খানিকক্ষণ পরে কমল সাহস করে গুরুমশাইয়ের গায়ে হাত দিল ]

কমল৷ (সবিস্ময়ে চেঁচিয়ে) কবিঠাকুর! এ যে পাথরের গা!

[আর সকলেও তাড়াতাড়ি গুরুমশাইয়ের দেহ স্পর্শ করল]

সকলে৷ কবিঠাকুর, এ তো মানুষ নয়, এ যে পাথরের মূর্তি!

কবি৷ (সহাস্যে) হ্যাঁ ভাই, তোমাদের গুরুমশাই আজ পাথরের মূর্তি হয়ে গিয়েছেন৷

সকলে৷ কী সর্বনাশ! কেন কবিঠাকুর, কেন?

কবি৷ তোমাদের গুরুমশাই বাইরেই কেবল চলা-ফেরা করতেন, ওঁর মনের ভিতরটা ছিল শুকনো পাথরের মতো৷ পৃথিবীতে এমনই চলন্ত পাথরের মূর্তিই আছে বেশি৷ তোমাদের মনের চোখ আজ খুলে গেছে বলেই গুরুমশাইয়ের আসল চেহারাখানা দেখতে পেলে! কিন্তু তোমাদের মানসচক্ষু আবার যদি অন্ধ হয়, গুরুমশাইও আবার জেগে উঠে বেত তুলে হুংকার দিতে থাকবেন!

সকলে৷ (সমস্বরে) না, না, আর আমরা মনের চোখ বন্ধ করব না!

কবি৷ তাহলে তোমাদের চোখের সামনে রংমহলের রংমশালের আলোও আর কোনোদিন নিববে না! দেহের চোখে দেখা যায় কেবল শুকনো পুথিপত্র আর পাথুরে-প্রাণ মানুষদের, কিন্তু মনের চোখে সরস আর সজীব হয়ে ওঠে সারা পৃথিবীর সমস্তই৷ ওই দেখো, বনভূমির সবাই আবার তোমাদের কাছে ফিরে আসছে, ওরা আর কখনো তোমাদের ছেড়ে চলে যাবে না!

(নানা দ্বার দিয়ে দ্বিতীয় দৃশ্যের সমস্ত পাত্র-পাত্রীর প্রবেশ৷

কবিকে মাঝখানে রেখে সকলে একসঙ্গে গান ধরল)

গান

গাইবে যখন কোকিল পাখি,
চর্মরোগের চশমা ফেলে খুলবে তখন মানস-আঁখি৷
দেখবে কোকিল সুরে সুরে
খেলছে কারা ভুবনপুরে,
স্বপ্ন হবে সত্য তখন, সত্য হবে মস্ত ফাঁকি!
দেখবে ধরায় মিথ্যে যারা
মনের মাঝে জ্যান্ত তারা,
কল্পলোকের গল্পে আছে এই জীবনের রঙিন রাখি!

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *