রংপুর
হরিদেবপুর
মন বলে, যাই। অনেকদিন স্বপ্নেও দেখেছি। ভাবতে ভাবতে চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় বৃদ্ধ ছুতোর মথুর কাকা। খোল-বাজিয়ে কানাইদার মিষ্টি গলার গান শুনতে পাই যেন। বৃদ্ধ আফসর দাদু এসে লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়ান। উতলা হয়ে ওঠে মন। মনে মনেই ফিরে যাই উত্তর বাংলার সেই লোক-না-জানা অজ্ঞাত গ্রামে, আমার জন্মভূমিতে।
উত্তরবঙ্গের রংপুর টাউন থেকে মাত্র বারো মাইল দূরে আমাদের ছোট্ট গ্রাম, হরিদেবপুর। তার কোল দিয়ে বিনুনির মতো এঁকে-বেঁকে চলে গেছে শঙ্খমারী নদী। ছোট্ট নদী-খোলা তরোয়ালের মতোই চকচকে ছোট্ট নদী। বর্ষাকালে সে কিন্তু আর ছোট্টটি থাকে না। অবাধ্য সন্তানের মতো উদ্দাম স্রোতে সে ভাসিয়ে দিয়ে যায় তার দুটি পাড়। ধান আর পাটগাছের গুঁড়িতে দিয়ে যায় তার পেলব মাটির স্পর্শ। আকারে ক্ষুদ্র পালতোলা নৌকোর-সারি ভেসে বেড়ায় দুরন্ত বালকদলের মতো। প্রতিদিন দল বেঁধে আমরা স্নান করতাম। পাড়ের ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়াতে কত না আনন্দ পেতাম সেদিন। সবচেয়ে ওস্তাদ ছিল পাড়ার নেপাল মামা। একাদিক্রমে তিন-শো বার ডুব দেওয়াই ছিল তাঁর স্নানের বিশেষত্ব। একহাতে নাক ধরে তাঁর ডুব শুরু হত–উঠে আসতেন জবাফুলের মতো টকটকে লাল চোখ-জোড়া নিয়ে। জ্বর তাঁর কিন্তু কোনোদিন হয়নি সেজন্যে।
আগেই বলেছি গ্রামটি খুব ছোটো। মোট কুড়ি-একুশ ঘর হিন্দু আমরা, আমাদের পাড়ার নাম কায়েত পাড়া। সামনে ও পেছনে মুসলমান পাড়া, নয়া পাড়া আর পাছ পাড়া–সব মিলে হরিদেবপুর।
গ্রামের নয়াবাড়ি অর্থাৎ ঘোষমশাইদের বাড়িতে গড়ে উঠেছিল একটি সমিতি–সৎসঙ্গের আদর্শে। বিপ্লবী যুগে এই সঙ্ঘের দান বড়ো কম নয়। পাড়ার সবার সুরেশকাকা ছিলেন আমারই কাকা। তিনি ছিলেন সমিতির নেতা। জ্ঞান হওয়ার পর দেখেছি প্রায়ই আমাদের বাড়ি সার্চ হত। পাটের গুদাম লন্ডভন্ড করে দিয়ে যেত পুলিশ!
কোনো একদিন সার্চ করতে এসে পুলিশ যাওয়ার বেলায় ধরে নিয়ে গেল সুরেশকাকা আর সামসুদ্দিনদাকে। সামসুদ্দিনদা পাছ পাড়ার বুড়ো আফসর দাদুর একমাত্র ছেলে। সেদিন আফসরদাদুকে দেখেছি তামাক খেতের আলের ওপর দাঁড়িয়ে এই বিপ্লবীদ্বয়কে বিদায় দিতে। বিদায় দিতে দেখেছি হাসিমুখে তাঁর প্রাণের ছেলে সামসুদ্দিনদাকে। তাঁরা জেলে গেলেন কিন্তু ফিরে এসেছিলেন পাঁচ বছর পর।
সেই বিপ্লবী সুরেশকাকা এবার সাতপুরুষের ভিটে ত্যাগ করে আসবার সময় আমাদের তকতকে উঠোনের মাটি মাথায় নিয়ে, চোখের জলে মাটি-মায়ের বুক ভিজিয়ে দিয়ে চলে এসেছেন এ প্রান্তে।
আমরা চলে যাচ্ছি এ খবর পেয়ে সামসুদ্দিনদার সত্তর বছরের বুড়ো বাবা আফসর দাদু লাঠিতে ভর দিয়ে পথের মাঝে সুরেশকাকার হাত ধরে বললেন, ‘দ্যাশ ছাড়ি তোরা কোটে যাওছেন দেবমশাই। তোরা চলি গেইলে আমরা গুলা কেমতি করি বাঁচিম। তোর চোখ পানি! কিন্তু বাস্তবের রূঢ় আঘাতে সেই স্নেহশীল বুড়ো মুসলমান প্রতিবেশীর আকুল আবেদন উপেক্ষা করেই স্বপ্ন দিয়ে গড়া সেই ছোট্ট গ্রামখানিকে ছেড়ে আসতে হয়েছে। আমাদের সবাকেই– সুরেশকাকাকেও।
জেল থেকে ফেরার মাস তিনেক পরে একদিন সন্ধ্যায় পল্লিমায়ের দুরন্ত ছেলে সামসুদ্দিনদা মায়ের ওই ছায়াঘন কোলের ওপরে ঘুমিয়ে পড়লেন চিরদিনের মতো। স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল আমাদের ছোট্ট গ্রামটি। মাঝিপাড়ার বাজার সেদিন বসেনি…খেতে সেদিন কেউ নিড়ানি দিতে যায়নি…। শঙ্খমারীর কোলের বড়োপুরোনো অশ্বত্থ গাছটার তলায় আজও তিনি ঘুমিয়ে আছেন।
গ্রামের প্রধান খেলা ছিল হাডু-ডু-ডু আর ফুটবল। কালাচাঁদের মাঠে খেলা হত। সেই রোমাঞ্চময় রক্তরাগোজ্জ্বল অপরাহ্নের কথা ভুলিনি আজও। আজও ভুলিনি খোঁড়া জসিমের খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাডু-ডু-ডু খেলার দম দেওয়া। মহানগরীর সাতমহল বাড়ি ডিঙিয়ে, কত শত নদ-নদী-প্রান্তর পেরিয়ে, কত সবুজ ধানের খেত মাড়িয়ে আজও ভেসে আসে সেই ‘হাডু-ডু ড’ ধ্বনি।
শঙ্খমারীর তীরে ছিল আর একটা অশ্বথ গাছ। ঘন পত্রাবৃত ডালগুলো কিছুটা ঝুলে পড়েছিল শঙ্খমারীর জলের ওপরে হুমড়ি খেয়ে–চলতি জলে বাধা দিত তার এক-একটি পাতা–এক-একটি পচে যাওয়া ডাল। স্রোত কাটার শব্দ ভেসে আসত নদীর ছায়াঘন কূল থেকে। এই ছায়াতে মাঝে মাঝেই উদয় হতেন এক সাধু। এসেই কুড়িয়ে আনা কাষ্ঠফলকে জ্বালিয়ে দিতেন আগুন। সারাগাঁয়ের হিন্দু-মুসলমান ভাগ্য-জিজ্ঞাসা নিয়ে জড়ো হত সেই ভয়াল অন্ধকার ঘেরা অশ্বথ গাছের নীচের আলোয়।
বকুলতলা আমাদের খেয়াঘাট। বৈকালিক ভ্রমণস্থলও বটে। ছেলে-বুড়ো সবাই বেড়াতে আসত সেখানে। কেনী ঝালো, নিতাই মন্ডল, জুয়েন খাঁ–এরা তাদের ছোট্ট ছোট্ট ডিঙি দিয়ে নামমাত্র পারানি নিয়ে পার করে দিত শঙ্খমারী। শহর ফেরত যারা, তারা খবর বহন করে আনত সমস্ত জগতের। সত্যি-মিথ্যে মেশানো খবর… সিঙ্গাপুর পতনের সাতদিন আগে আমরা খবর পেয়েছিলাম জাপান সিঙ্গাপুরে হেরে গেছে। ভজু করমজায়ীর দোকানটাই ছিল ছেলে-বুড়ো সবার আড্ডাস্থল। আকর্ষণ ছিল বইকী তার একটা। ভজু কিছুদিন হল শহর থেকে সওদা নিয়ে আসবার সময় একখানা করে খবরের কাগজ নিয়ে আসত। গ্রামের বিজয় ডাক্তার (হোমিয়োপ্যাথ) পড়তেন, আমরা সবাই শুনতাম। সে যেন একটি ছোটোখাটো সভা। ভজুর এতে কোনো আপত্তি হত না বরং তার দোকানের বিক্রি–সিগ্রেটটা, এটা-সেটা সেই সময়েই বেশি বিক্রি হত।
এই সেদিনের কথা। সেদিন খুব কুয়াশা পড়েছে সকাল থেকে। দেশি কথায় হাত পা সমস্ত ‘ট্যালকা হয়ে পড়েছিল। তবুও সন্ধ্যেবেলাটায় কিছুতেই বাড়িতে বসে সোয়াস্তি পেলাম না। চাদরটা জড়িয়ে নিয়ে গিয়ে উঠলাম সেই করমজায়ীর চালা ঘরটাতে। একে মেঘলা দিন তার ওপর একটা ঝাঁপ বন্ধ করে রাখায় ঘরটা আধার আধার হয়ে ছিল। ঘরে ঢুকে প্রথমে বিজয় ডাক্তারকে দেখতে পেলাম। ভজু করমজায়ী টাউন থেকে ফেরেনি তখনও, সবাই অপেক্ষা করছে তার জন্যে।
‘ভজুটি আছে না,কোন্টে গেইল?’–পাঁচপাড়ার তফি শেখ প্রশ্ন করে।
‘আরে নয় নয় বাহে, বেলা দুইট্যাৎ টাউনৎ গেইচে। এলায় ত ফিরবার কতা।’
‘আর ফিরোচে বাহে–আইজ আর’…কাজিমুদ্দিনের কথা শেষ না হতেই ঘরে ঢুকল ভজু। হাতে খবরের কাগজ, সওদাপত্র কিছুই নেই।
ডাক্তার আশ্চর্য হয়ে বললেন—’আরে এ ভজু, তুই সদাপত্তর কিছু করিসনি!’
ভজু কাগজটা এগিয়ে দিয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
ডাক্তার কাগজখানা খুলে বসলেন। আমি দূরে দাঁড়িয়ে আছি। ডাক্তার চুপ করে কাগজ খুলে বসেই রইলেন। সবাই জোরে জোরে পড়তে বলল।
‘আর কী পড়ব ভাই–আবার গন্ডগোল। ডাক্তার হতাশভাবে উত্তর দিলেন।
‘আরে বাহে, কেটে গন্ডগোল হইল কন কেনে।’–তফি শেখ বলে।
‘সান্তাহারে গাড়িতে বহুৎ হিন্দু নিহত হইছে।’–ভজু যোগ দিল।–টাউন থেকে সব । হিন্দু গাড়ি বোঝাই হয়ে হিন্দুস্থানে যাচ্ছে এবং তারাও যাবে, একথাই ভজু বলতে যাচ্ছিল।
ভজুর কথা শেষ না হতেই কাজিমুদ্দিনের গলা উঁচু হয়ে উঠল—’তোরা কেটে যাবি? হামরা কি তোর জান মারি ফেলছি?’
কাজিমুদ্দিনের মতো মুসলমান ছিল বলেই আজ বেঁচে আছি–নইলে সেদিন ভজুর দোকান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তফি শেখের মুখের চেহারা আজও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
আমার গাঁয়ের সাধারণ মানুষের গলায় ভাওয়াইয়া গানের সুর মনকে মাতিয়ে তুলত। কথা-প্রাণ বাংলা গান। ভাওয়াইয়া গানের বেলাও তাই। একটি গানের কথা স্পষ্ট মনে পড়ছে। দোতারা বাজিয়ে তাল দিয়ে দিয়ে গান গাইছে ভাবুক,
ও আমার সাধের দোতারা, তুই যেন আমার মান রাখিস,
আমি রুপো দিয়ে তোর কান বাঁধিয়ে দেব!
অল্প বয়সে দোতারার আকর্ষণে পাগল হয়ে সংসার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে ভাবুক। বাপ, ভাই, গ্রামের লোক কারুর কথাই সে কানে তোলেনি। গ্রামবাসীরা বিরোধী হয়ে দারোগাকে জানিয়ে দিয়ে তাকে হাতকড়া পর্যন্ত লাগিয়েছে। তবু সে দোতারা ছাড়েনি। সেই দোতারাকেই সে বলছে, ও আমার দোতারা, তুই যেন আমার মান রাখিস, আমি রুপো দিয়ে তোর কান বাঁধিয়ে দেব। অর্থাৎ সংসারে মোহগর্তে আর যেন তাকে প্রবেশ করতে না হয়, সে মান যেন তার থাকে। সত্যি কী উচ্চভাবের গান! আজ অবশ্য আমরা কমবেশি সবাই ভগ্ন-সংসার নিরুদ্দেশের পথের মানুষ। কিন্তু যেখানেই থাকি না কেন, আমার সোনার গ্রামখানি আমার চোখের সামনে।
পুজো এসে গেছে। আমাদের বারোয়ারি বাগানের বাঁধানো বেদি এবার খাঁ খাঁ করবে বিসর্জনের প্রদীপও জ্বলবে না। নদীর ঘাটে বিসর্জনের দিনের মেলায় সে কী কোলাহল হত! হিন্দু-মুসলমান সকলকে মিলনের রাখি পরিয়ে দেওয়া হত মেলায় প্রতি বছর। এবার হয়তো শুধু একটুকরো দক্ষিণা বাতাস বয়ে যাচ্ছে হু-হুঁ করে পল্লিমায়ের চাপা কান্নার সুরে। ধান মাড়াইয়ের স্বপ্নে কৃষকদের মন এবারও আনন্দে হয়তো ভরে উঠবে। কিন্তু মথুর কাকা আর কানাইদার মিষ্টি গলার কীর্তন আর এবারের কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোকে মহিমান্বিত করবে না। কালীপুজোর প্রসাদ বিলির আনন্দও আর উপভোগ করবে না কেউ। সব আনন্দই গেছে আমার গ্রামকে ছেড়ে। নইলে, পুজোয়, কালীপুজোয় যেসব থিয়েটার হত বারোয়ারি তলায়, সেগুলো তো এখানেই পেতে পারি–কিন্তু পল্লিমায়ের অদৃশ্য সেই স্নেহের টান তো পাব না আর।