রং
শিবরাম চক্রবর্তী একবার তাঁর এক গল্পে রং ফলানোর বিষয়ে কিছু আলোচনা করেছিলেন। শিব্রামীয় পানরীতির অমোঘ ব্যবহারে রং শব্দটি বাংলা ইংরেজি দুই দিক থেকে এসেছিল। বাংলা রং, মানে বর্ণ, রং ফলানো মানে সোজা কথায় বাড়িয়ে বলা আর ইংরেজি রং অর্থাৎ Wrong মানে ভুল।
ইংরেজি ব্যাপারে এবার যাচ্ছি না, শুধু হাতের কাছে এসে গেছে যখন ব্যাপারটা একটু ছুঁয়ে থাকি।
রাইট ভ্রাতৃদ্বয়, অরভিল এবং উইলবার রাইট, প্রথম এরোপ্লেন চালিয়েছিলেন। এরোপ্লেন বিষয়ক এক খণ্ডকাব্যে বিখ্যাত রসিক কবি অগডেন ন্যাস লিখেছিলেন, ‘টু রাইটস মেক এ রং’, (Two rights make a wrong); ন্যাস সাহেব উচ্চারণের মিলের জন্যে একটুও বানানের তফাত মানেননি। রাইট নামের বানানের প্রথমে যে ডবলিউ আছে সেটাকে উপেক্ষা করেছেন। সে যাহোক, দুই রাইট মিলে একটা রং বানিয়েছে, বিমান সম্পর্কে কবির এই তির্যক উক্তিটি চমৎকার।
বাংলা রঙের ব্যাপারে রসায়ন বিজ্ঞানী পরশুরাম ছিলেন প্রথম শ্রেণীর বোদ্ধা। তাঁর অসংখ্য গল্পে রঙের, বিশেষ করে গাত্রবর্ণের, তিনি অতুলনীয় বিশ্লেষণ করেছেন। ধুস্তরীমায়া অর্থাৎ দুই বুড়োর রূপকথা গল্পের নায়ক উদ্ধব পাল নিজের জন্যে মেয়ে দেখতে গিয়ে রাজকুমারী স্পন্দচ্ছন্দাকে জিজ্ঞাসা করেছন, ‘অত ফরসা কী করে হলেন ?’
রাজকুমারী যখন বললেন যে তাঁর গায়ের রং-ই ওই রকম, উদ্ধব সশব্দে হেসে বললেন, ‘ওগো চণ্ডপণ্ডা পদীরানী, রঙের ব্যাপারে আমাকে ঠকাতে পারবে না, ওই হল আমার ব্যবসা। তুমি এক কোট আস্তরের উপরে তিন কোট পেন্ট চড়িয়েছ—হবক্স জিঙ্ক, একটু পিউরি আর একটু মেটে সিঁদুর। তা লাগিয়েছ বেশ করেছ, কিন্তু জমির আদত রংটি কেমন ?’
তাঁর অন্য এক গল্পে পরশুরাম এক আত্মাভিমানী বাঙালি কালো মেয়ের কথা লিখেছেন, যার আগে নাম ছিল শ্যামা। ম্যাট্রিক দেবার সময় নিজেই নাম বদলে তমিস্রা করে, কারণ তার কালো রং সে শ্যামবর্ণ বলে চালাতে চায় না।
এই সূত্রে আমার নিজের কথাও একটু বলি। আমার মা বলেন আমার গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, কিন্তু আসলে তা নয়। আমার কৃষ্ণ ত্বক মাতৃস্নেহের তারল্যে কিছুটা ঝকঝকে মনে হত স্বৰ্গতা জননীর দৃষ্টিতে। গায়ের রং নিয়ে এ বয়েসে আমার দুঃখ নেই। বাঙালি পুরুষের গায়ের রং শুধু বিয়ের রাতে কন্যাপক্ষের মহিলামহলে সামান্য আলোচ্য-বিষয়। তবে দু’-একটা অসুবিধে আজও আছে। কলকাতায় নবাগত অনেক দক্ষিণ ভারতীয় ভদ্রলোক রাস্তাঘাটে আমাকে পেলে তামিল ভাষায় কথা বলে কিছু জানতে চান। এ রকম অভিজ্ঞতা আমার বেশ দু’-চারবার হয়েছে।
আরেকটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল বিদেশ যেতে গিয়ে। আমাদের গরিব দেশের পাসপোর্টে চোখের বর্ণ চুলের বর্ণ ইত্যাদি উল্লেখ করতে হয় কিন্তু সুসভ্য শ্বেতাঙ্গ কোনও কোনও দেশে যেতে গেলে ভিসার দরখাস্তে গায়ের রং কীরকম তাও জানাতে হয়। আমার গায়ের রং কালো, অবশ্যই কালো কিন্তু আমি কৃষ্ণাঙ্গ নই, ব্ল্যাক বলতে যা বোঝায় আমি সে জাতের নই। আমি সাদা বা কালো নই, আমি ভারতীয় কিংবা বড়জোর বাঙালি। কিন্তু গায়ের রং তো ইন্ডিয়ান বা বেঙ্গলি লেখা যাবে না। উদ্ধার করেছিলেন ভিসা অফিসার নিজেই, ফর্মের ওই জায়গাটা ফাঁকা রেখেছিলাম, তিনি নির্দ্বিধায় লিখে দিলেন, ‘হুইটিস’, মানে গমের মতো। সেই থেকে নিজের গায়ের রং সম্পর্কে আমার ধারণা বদলে গেছে, যখনই কোথাও লালচে গমের দানা চোখে পড়ে নিজের গায়ের চামড়ার দিকে তাকাই, সেই সাহেব ভিসা অফিসারের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আসে।
গায়ের রং মোটামুটি পাকা ব্যাপার। সাহেব-মেমরা অনেক সময় সমুদ্রতীরে যান গায়ের চামড়া রোদে পুড়িয়ে ট্যান করার জন্যে কিন্তু জনপদে ফিরে এসে তাঁরা আবার তাঁদের দুঃখের শ্বেতবর্ণ ফিরে পান। আমাদের কালো রং অনেক সময় অসুখ-বিসুখে, রোদ্দুরে ঘুরে, রাত জেগে বা অন্য কোনও কারণে আরও কালো হয়ে যায়, চেনাশোনা লোক পথে-ঘাটে দেখা হলে বলে, ‘কী হল এত কালো হলে কী করে ?’ পার্থক্যটা অবশ্য ভূত-চতুর্দশীর অন্ধকার আর শ্যামাপুজোর অমাবস্যার রাত্রির চেয়েও কম, তবু পরিচিত চোখে ধরা পড়ে। এদিকে গ্রামের লোক কলকাতায় এলে কলকাতার কলের জলে তাদের গায়ের রং চিকেশাভাব ধারণ করে, মাজা রঙের মেয়ে গৌরাঙ্গী হয়ে ওঠে। আবার গ্রামে ফিরে গেলে কয়েকদিনের মধ্যে যে-কে সেই।
হকার্স কর্নারে দেখেছি রং উঠে যাওয়া সদ্য কাচা নতুন শাড়ি হাতে স্থূলাঙ্গিনী মহিলা চেঁচাচ্ছেন, ‘আপনি বলেছিলেন না পাকা রং, এই আপনার পাকা রং ?’ প্রিন্টেড শাড়ির লাল ফুল, নীল পাতা, সবুজ পাখি—রং মেখে প্রায় একাকার হয়ে গেছে, সেই শাড়িটা দোকানদারের মুখের সামনে মেলে ধরেন ভদ্রমহিলা, কিন্তু দোকানদার নির্বিকার। শুধু নির্বিকার না, পাশের তাক থেকে আবার প্রিন্টেড শাড়ি নামাচ্ছেন আর বলছেন, ‘মাসিমা, যা হবার হয়েছে, এবার এই রামপুরের প্রিন্ট নিয়ে যান, এবার সত্যিই পাকা জিনিস দিচ্ছি।’
এর চেয়েও মারাত্মক গল্পের সেই দোকানদার। অনুরূপ পরিস্থিতিতে সে নাকি উলটো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘রংটা উঠে কী হল ?’ কেনা-দিদি জবাব দিয়েছিলেন, ‘উঠে গিয়ে লাগল অন্য কাপড়ে। ‘দোকানদার এবার আশ্বস্ত হলেন, ‘ও তা হলে এক সঙ্গে কেচেছিলেন। বাকি কাপড়গুলো কী ছিল ?’ কেনা-দিদি এই প্রশ্নে খেপে গেলেন, ‘আপনার চাদরের নীল রং লেগে গেছে সাদা তোয়ালেতে, বিছানার চাদরে, কর্তার গেঞ্জিতে, ছেলের পাজামায়।’ এবার দোকানদার স্মিত হেসে বললেন, ‘কেনা-দিদি, এবার দেখবেন রংটা কত পাতা। ওই তোয়ালে, চাদর, পায়জামা থেকে জন্মেও ওই নীল রং উঠবে না। ব্লিচিং পাউডার দিয়ে সেদ্ধ করলেও না।’
এ গল্প বানানো গল্প, কিন্তু যেকোনও মহৎ সাহিত্যের মতো এর বিষয়বস্তু সত্যি; পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছেন যাঁর সাদা কাপড়ে কখনও পাকা দাগ পড়েনি অন্য কোনও কাপড়ের কাঁচা রঙের ? এবং সে রং আর ওঠেনি।
কাঁচা রঙের ব্যাপারটা আরও একটু পরিচ্ছন্ন করা যেতে পারে আমার নিজেরই একটি ঘটনায়। আমার পরমারাধ্যা পত্নীঠাকুরানি একবার আমাকে একটি কলকাপেড়ে সাদা শাড়ি কিনে আনতে বলেছিলেন। এসব কঠিন কাজ সাধারণত তিনি নিজেই করেন, কিন্তু বোধহয় এই অসামান্য জিনিসটা বাজারে পাননি। আমিও পেলাম না, কিন্তু শততম একাদশ বিপণিতে এক বিক্রেতা একটি আশ্চর্য কথা বললেন, ‘ফিকে নীল অথবা ফিকে হলদে রঙের কলকাপাড়ের শাড়ি নিয়ে যান স্যার। এক ধোপেই সাদা হয়ে যাবে।’
রঙের গল্প শেষ করার আগে আরও একটা ক্ষমা চাওয়ার মতো ব্যাপার আছে।
কিছুদিন আগে এক ফোটোগ্রাফারের সঙ্গে কিছু খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। আমাদের পোষা মেনি বিড়াল গান্ধারী তিনটে বাচ্চা দিয়েছিল। গান্ধারী নিজে আগাগোড়া সাদা আর বাচ্চা তিনটে হয়েছে চমৎকার সাদাকালো। ফোটোগ্রাফার ভদ্রলোক পুরো এক রিল ছবি তুললেন আমাদের বাড়িতে। ফোটোগুলো ডেভেলপ করে আর প্রিন্ট করে এক ছুটির দিন নিয়ে এলেন। চমৎকার ঝকঝকে সব ছবি উঠেছে বিড়ালছানা ও তাদের মা সমেত বাড়ির সকলের। তবে অর্ধেকের বেশি ছবিই বেড়াল ছানাদের।
ফোটোগ্রাফার ভদ্রলোক রঙিন ছবি তুলেছিলেন এবং রঙিন ছবির খরচটাই আমার কাছে চেয়েছিলেন কিন্তু আমি তাঁকে অর্ধেক টাকা দিয়েছিলাম। সাদা-কালো বেড়াল ছানার রঙিন ফটো দিয়ে কী হবে, যদি তিনি তুলে থাকেন সেটা তাঁর বোকামি, তার মাশুল আমি দেব কেন ? সেই ফোটোগ্রাফার ভদ্রলোক আর আমাদের বাড়ি আসেন না। এখন মনে হচ্ছে পুরো টাকাটা দিয়ে দিলেই হত।
রং সম্পর্কে শেষ কথা বলেছিলেন এক অনিদ্রা রোগী। নানা রকম ঘুমের ট্যাবলেট তাঁর মাথার কাছে সাজানো. একটা, দুটো বড়িতে তাঁর ঘুম আসে না, অন্তত তিন-চারটে লাগে। বিভিন্ন ট্যাবলেট বিভিন্ন আকারের সাদা-কালো-হলদে ইত্যাদি বিভিন্ন রঙের।
একই হোটেলে আমার পাশের বেড়ে ছিলেন ভদ্রলোক। দেখলাম একেক রঙের একটা করে ট্যাবলেট নিয়ে তিন-চার রকম ট্যাবলেট একসঙ্গে জল দিয়ে খেয়ে ফেললেন। আমি বললাম, ‘এটা কী করলেন ?’ অনিদ্রা রোগী মৃদু হেসে বললেন, ‘নানা রঙের ঘুমের ওষুধ মিলিয়ে খাই রঙিন স্বপ্ন দেখব বলে।’