যোগ্যতা পরীক্ষা – ড. মেঘনাদ সাহা

যোগ্যতা পরীক্ষা – ড. মেঘনাদ সাহা

কোনো দেশে অতি বিচক্ষণ ও সর্বকার্যে দক্ষ একজন রাজা ছিলেন। অন্যান্য রাজাদের মতো তিনি অসার আমোদ-প্রমোদে বৃথা সময় নষ্ট করিতেন না। তাঁহার মন্ত্রীও তাহারই মতো অতি বুদ্ধিমান লোক ছিলেন। সুবিধা পাইলেই রাজা ও মন্ত্রী উভয়ে ঘুরিয়া ফিরিয়া সমস্ত কাজ নিজেদের চক্ষে পর্যবেক্ষণ করিতেন। মাঝে মাঝে গুপ্তচর নিয়োগ করিয়া প্রজারা তাঁহার শাসন সম্বন্ধে কীরূপ আলোচনা করে তাহার খোঁজ-খবর লইতেন।

অন্যান্য রাজাদের যেমন হইয়া থাকে, এই রাজারও নানাশ্রেণির ভৃত্য ছিল এবং তাহারা নিজ নিজ কাজের অনুযায়ী নানারূপ বেতন পাইত। প্রধানমন্ত্রী সকলের চেয়ে বেশি বেতন পাইতেন। সাধারণ কর্মচারীরা 50 হইতে 100 টাকা পর্যন্ত পাইত এবং সাধারণ ভৃত্যেরা—যাহারা ঘর পরিষ্কার, বাসন মাজা, জল তোলা এবং ফরমাইস খাটা ইত্যাদি কাজ করিত, তাহারা দশ হইতে বিশ টাকা পর্যন্ত মাসে বেতন পাইত।

একদিন রাজা মন্ত্রীর সহিত ছদ্মবেশে চাকরদের ঘরের নিকট দিয়া যাইতেছেন, এমন সময় শুনিতে পাইলেন, তাহারা খুব জটলা করিয়া রাজার কাজের আলোচনা করিতেছে। একজন বলিতেছে—দেখ ভাইসকল, মহারাজের কী ঘোর অবিচার। আমাদিগকে সমস্তদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া খাটিতে হয়, আর মহারাজা আমাদিগকে বেতন দেন মাত্র দশ হইতে পনেরো। আর কেরানিবাবুরা শুধু চেয়ারে বসিয়া কলম চালান, তাঁহারা আমাদের পাঁচ ছয় গুণ বেতন পান, আর বড়ো বড়ো কর্মচারীরা ত কিছুই করেন না। মন্ত্রী মহাশয় শুধু মহারাজের সাথে গল্প করেন এবং হুকুম জারি করেন ; আর তিনি যে কত হাজার টাকা বেতন পান, তাহা কেহ গনিয়া বলিতে পারে না। রাজা ও মন্ত্রী উভয়েই এই সমস্ত কথা শুনিলেন। কিন্তু তখন চাকরদের কিছু না বলিয়া পর দিন দরবারে তাহাদের কয়েকজনকে ডাকিয়া পাঠাইলেন তাহারা সকলে আসিলে পর মন্ত্রী বলিলেন—তোমরা কাল রাত্রে সকলে মিলিয়া আলোচনা করিতেছিলে যে, তোমরা সারাদিন প্রাণপাত পরিশ্রম কর ও মহারাজ তোমাদের তেমন বেতন দেন না। সেইজন্য মহারাজ তোমাদের দুঃখ দূর করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছেন। এই হেতু তোমাদের যোগ্যতা পরীক্ষা করিবার জন্য তিনি একটি সমস্যা উত্থাপন করিয়া তোমাদের প্রত্যেককে তাহা সমাধান করিতে দিয়াছেন। তাহা এই—রাজবাটীর সম্মুখে অতিশয় পুরাতন এবং উচ্চ তালগাছটি কত উঁচু তাহা বাহির করিতে হইবে। ইহার জন্য তোমাদিগকে তিন দিন সময় দেওয়া হইল।

ইহা শুনিয়া চাকরদের মধ্যে মহা ভয় উপস্থিত হইল। তাহারা সকলে মিলিয়া পরামর্শ করিতে লাগিল, কি করিয়া তালগাছের উচ্চতা মাপা যাইতে পারে। একজন বলিল—একটি খুব বড়ো মই তৈয়ারি করিয়া গাছের মাথায় চড়ি। তারপর সেখান হইতে সূতা ফেলিয়া তালগাছ কত উচু, তাহা বাহির করিতে পারিব। কিন্তু রাজবাটীর সূত্রধর বলিল যে, অতবড়ো মই তৈয়ারি করা সম্ভবপর নয়। তখন অন্য একজন ভৃত্য বলিল—আচ্ছা, এস আমরা ওই তালগাছের সমান উঁচু একটি মাটির দেওয়াল তৈয়ারি করি। কিন্তু হিসাব করিয়া দেখা গেল যে, এইরকম দেওয়াল প্রস্তুত করিতে অনেক বৎসর লাগিবে এবং অনেক হাজার টাকা লাগিবে। আর একজন বলিল—আমাদের মধ্যে কেহ কোমরে সূতা বাঁধিয়া তালগাছের উপরে উঠুক এবং সূতা কত লম্বা, তাহা মাপিয়া দেখিলেই তালগাছের উচ্চতা বাহির করা যাইবে। কিন্তু এমন উঁচু তালগাছে চড়িতে পারে এমন লোক পাওয়া গেল না। সুতরাং তালগাছ না কাটিয়া কীরূপে তাহার উচ্চতা বাহির করিতে পারা যাইবে, চাকরেরা তাহা কিছুতেই ঠিক করিতে পারিল না। তখন তাহারা রাজদণ্ডের ভয়ে অত্যন্ত ভীত হইয়া নির্দিষ্ট সময়ের প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। তিনদিন কাটিয়া গেলে মহারাজ তাহাদিগকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। ভয়ে ভয়ে তাহারা দরবারে উপস্থিত হইল। তখন প্রধানমন্ত্রী বলিলেন—তোমরা কী তালগাছের উচ্চতা নিরূপণ করিতে পারিলে? চাকরেরা ভয়ে ভয়ে বলিল, না মহাশয়, অনেক চেষ্টা করিয়াও তালগাছের উচ্চতা বাহির করিতে পারিলাম না। তখন মন্ত্রী মহাশয় একজন সাধারণ কর্মচারীকে ডাকিয়া বলিলেন—তুমি এই তালগাছটি কত উঁচু না কাটিয়া তাহা বলিয়া দিতে পার? সে খানিকক্ষণ ভাবিয়া বলিল—এই কাজ দুই রকমে হইতে পারে। যদি একজন খুব ভালো তীরন্দাজ পাওয়া যায়, তাহা হইলে তাহাকে ওই তালগাছের মাথা লক্ষ করিয়া একটি তীর ছুঁড়িতে হইবে। তীরের নীচের দিকে একটি শক্ত সূতা বাঁধা থাকিবে। তীরন্দাজ যদি ঠিক গাছের মাথায় তীর বিদ্ধ করিতে পারে, তাহা হইলে সূতা লম্বভাবে মাটি পর্যন্ত পৌঁছিবে এবং তখন ওই সুতা মাপিলেই গাছ কত উঁচু, তাহা বাহির করা যাইবে। কিন্তু সকলে বলিল, তালগাছের মাথায় তীর বিদ্ধ করিতে পারে, এমন সুদক্ষ তীরন্দাজ পাওয়া মুশকিল। তখন কর্মচারী বলিল—যদি শক্ত সূতা দিয়া একটি ঘুড়ি উড়ান যায়, এবং চেষ্টা করিয়া উক্ত ঘুড়িকে গাছের মাথায় আটকান যায়, তাহা হইতে সূতার দৈর্ঘ্য হইতে তালগাছের উচ্চতা বাহির করা যাইতে পারে। মন্ত্রী বলিলেন, তুমি ঘূড়ি গাছের মাথায় আটকাইতে পার? কর্মচারী বলিল, না হুজুর, কিন্তু যাহারা খুব ভালো ঘুড়ি উড়ায়, বোধ হয় তাহারা পারিবে। মন্ত্রী বলিলেন, আচ্ছা দেখা যাউক, ইহা অপেক্ষা সহজ উপায় আছে কিনা। তিনি তখন একজন বড়ো বিশিষ্ট কর্মচারীকে ডাকিলেন, এবং বলিলেন, আপনি কোনো সহজ উপায়ে এই তালগাছ কত উঁচু, তাহা বাহির করিতে পারেন কি? কর্মচারী বলিলেন, নিশ্চয়ই পারি, আমি অল্প সময়ের মধ্যেই গাছ কত উঁচু, তাহা মাপিয়া দিতেছি। তিনি তখন বাহিরে যাইয়া একটি প্রায় আট হাত লম্বা কাঠি সোজাভাবে (লম্বভাবে) মাটিতে পুঁতিলেন এবং একটি মাপকাঠি লইয়া কাঠির ছায়ার দৈর্ঘ্য মাপিলেন। দেখা গেল, ছায়ার দৈর্ঘ্য ছয় হাত এবং তখনই তালগাছের গোড়া হইতে সূতা ধরিয়া উহার ছায়া কত বড়ো, তাহা মাপিলেন। উহা দৈর্ঘ্যে হইল 120 হাত। তখন তিনি হিসাব করিলেন, ছয় হাত ছায়া যার, তার দৈর্ঘ্য যদি হয় আট হাত, তবে 120 হাত ছায়া যার তার দৈর্ঘ্য কত হইবে?

— 6 : 8 :: 120 : ক , ক =8 x 120 / 6 = 160  হাত।

এই সমস্ত করিতে প্রায় পনের মিনিট সময় লাগিল। তখন তিনি আসিয়া বলিলেন, গাছের উচ্চতা 160 হাত এবং যে প্রণালীতে উহা বাহির করিয়াছেন তাহাও সকলকে বুঝাইয়া দিলেন। রাজা ও মন্ত্রী ব্যতীত আর সকলেই তাঁহার তীক্ষ্ণবুদ্ধির পরিচয় পাইয়া চমৎকৃত হইল।

তখন রাজা মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন—মন্ত্রী, আপনি ইহা অপেক্ষা সহজে তালগাছ কত উঁচু, তাহা বাহির করিয়া দিতে পারেন কি? মন্ত্রী বলিলেন, Sextant (কোণ-মান) যন্ত্রের সাহায্যে ক্ষণিকের মধ্যেই গাছের বা যে-কোনো জিনিসের উচ্চতা বাহির করা যাইতে পারে। আমি এই যন্ত্রের কথা অবগত আছি, কিন্তু ব্যবহারে অভ্যস্ত নই, আপনার জরিপ বিভাগের কর্মচারীরা অতি সহজেই এই কার্য করিতে পারে।

রাজা তখন জরিপ বিভাগের প্রধান কর্মচারীকে ডাকাইলেন, এবং তিনি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই Sextant দিয়া গাছের উচ্চতা ঠিক মাপিয়া বাহির করিলেন।

সেদিন হইতে রাজবাড়ির ভৃত্যদের মধ্যে আর কাহারও কোনো অসন্তোষের ভাব রহিল না।

[*Sextant যন্ত্রের বর্ণনা যে-কোনো প্রাকৃতিক দর্শনের পুস্তকে পাওয়া যাইতে পারে। কিন্তু Sextant সাধারণত স্থলে ব্যবহার হয় না, সমুদ্রে সূর্য বা তাহার উচ্চতা মাপিবার জন্য ব্যবহৃত হয়। স্থলে যে যন্ত্র ব্যবহার হয় তাহার নাম Theodolite]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *