যোগিনী (হিপ্নটিক্ উপন্যাস)
উপক্রমণিকা
১লা জানুয়ারি।—বিলাতে বিজ্ঞানশাস্ত্রে শিক্ষিত হইয়া কলিকাতায় প্রফেসারি করিতেছি। বিজ্ঞান লইয়াই আমার জীবন–বিজ্ঞানর্চাই আমার অস্থিমজ্জায় মিশ্রিত—বিজ্ঞানই আমার আহার নিদ্রা বলিলে অত্যুক্তি হয় না।
কিন্তু তাই বলিয়া সাংসারিক ব্যাপারে যে আমার দৃষ্টি নাই—তাহা নহে। আমি বিলাত যাইবার পূর্ব্ব হইতেই ঊষার সহিত আমার বিবাহের কথা স্থির ছিল। ঊষার পিতাও একজন প্রবীণ ব্যারিষ্টার। শীঘ্রই আমাদের বিবাহ হইবে।
এই সময়ে আমার জীবনে এক অপূর্ব্ব ব্যাপার সংঘটিত হইল। আজ নববর্ষারম্ভের জন্য বন্ধু শশধরের বাটীতে আমার নিমন্ত্রণ হইয়াছে, অধিকন্তু বন্ধু নিমন্ত্রিতগণের জন্য এক নূতন আয়োজন করিয়াছেন। আমার বন্ধুবর শশধরবাবু সর্বদাই যোগশাস্ত্র, মেসমেরিজম, হিপ্নটিজম লইয়া থাকিতেন। সন্ন্যাসী, যোগী প্রভৃতি যতরূপ বজুরুকের তাঁহার বাড়ীতে অধিষ্ঠান। সম্প্রতি কোন্ এক যোগিনীপুঙ্গবা তাঁহার বাড়ীতে আসিয়াছেন। তিনি তাঁহাকে লইয়া বড়ই ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন। তাঁহার অত্যদ্ভুত ক্ষমতা দেখাইবার জন্য আজ রাত্রে অনেককে নিজের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ করিয়াছেন। ঊষা ও তাহার পিতাও তথায় উপস্থিত হইবেন, শুনিলাম।
ঊষার কথা শুনিয়া আমি শশধরের বাড়ীতে যাইতে ইচ্ছুক হইলাম, নতুবা হয় ত যাইতাম না। মেসমেরিজম প্রভৃতি বুজরুকীতে আমার ঐকান্তিকী ঘৃণা ছিল, এ সকলে আমার আদৌ বিশ্বাস ছিল না। আমি যথাসময়ে শশধরের বাটীতে উপস্থিত হইলাম। প্রবেশ করিয়াই সেই যোগিনীর প্রতি আমার দৃষ্টি পড়িল। এরূপ সুন্দরী স্ত্রীলোক আমি আর কখনও দেখি নাই। তাহার পার্শ্বে একটা ত্রিশূল পড়িয়া রহিয়াছে, গেরুয়া কাপড় ও আলখোল্লা পরা না থাকিলে আমি ইহাকে আরব্যোপন্যাসোক্তা বরাঙ্গী সাহাজাদী ব্যতীত অন্য কিছু মনে করিতে পারিতাম না। অথচ এই যোগিনীকে দেখিলে সহসা মনে ভীতির সঞ্চার হয়। কি জানি, তাঁহার চোখে কি আছে!
শশধর আমার সহিত যোগিনীর পরিচয় করিয়া দিয়াছিলেন। আমি দেখিলাম, আমার নাম বলিবামাত্র যোগিনী ঊষার দিকে তীক্ষ্ণনেত্রে একবার চাহিলেন, তাহাতেই আমি কতকটা অনুমান করিয়া লইতে পারিলাম যে, শশধর আমার সম্বন্ধে অনেক কথাই এই যোগিনীকে বলিয়াছে; এখন যোগিনী যোগবলের ভাণ করিয়া অবলীলাক্রমে বলিতে পারিবেন যে, আমার সহিত কোন্ সুন্দরীর বিবাহ স্থির হইয়া গিয়াছে; এবং সেই সুন্দরীর রূপের বর্ণনাও বেশ দিতে পারিবেন। আমার সম্বন্ধে তাহাকে শশধরের কোন্ কোন্ কথা বলা সম্ভব, তাহাই আমি মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম।
শশধর হাসিয়া যোগিনীকে বলিলেন, “ধীরেন্দ্রবাবু যোগ-টোগ বিশ্বাস করেন না—হাসিয়া উড়াইয়া দেন। বোধ হয়, যোগিনীদেবী আপনি ইহার বিশ্বাস জন্মাইয়া দিবেন।”
যোগিনী তাঁহার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি করিলেন। ধীরে ধীরে বলিলেন, “এ কথা ঠিক–ইনি বিশ্বাস করিতে পারেন, এমন কিছু এ পৰ্য্যন্ত দেখেন নাই।” বলিয়া আমার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “আপনি নিজেই দেখিতেছি, খুব ভাল পাত্র।”
আমি বিস্মিত হইয়া বলিলাম, “কিসের জন্য?”
যোগিনী বলিলেন, “এই বশীকরণের—আপনারা যাহাকে বলেন, মেস্মেরিজম।”
আমি বলিলাম, “মেমেরিজম কেবল দুর্বল লোকের উপর হয়, ইহাতে ইহার সত্যাসত্য নির্দ্ধারিত হইতে পারে না। যাহাদের মস্তিক দুর্ব্বল—মন দুর্ব্বল, তাহাদিগকেই কেবল মেসমেরিজম করা যায়।”
যোগিনী বলিলেন, “অনেকেই উপস্থিত আছেন। ইহার মধ্যে কাহার মস্তিষ্ক ও মন দুর্ব্বল নহে, তাহা বলুন। (ঊষাকে নির্দ্দেশ করিয়া) ইঁহাকে কি মনে করেন? শুনিলাম, ইঁহার নাম ঊষা।”
আমি বলিলাম, “হাঁ, ইহার সম্বন্ধে কিছু ঘটিলে আমি তাহা বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত আছি।” যোগিনী বলিলেন, “আমি জানি না, ইনি শীঘ্র বশীকরণে আসিবেন কি না। কাহাকেও বা শীঘ্র বশীভূত করা যায়—কাহাকেও বা বিলম্ব হয়। আপনি এ সম্বন্ধে কতদূর অবিশ্বাস করেন, বলিতে পারি না; তবে বোধ হয়, আপনি বিশ্বাস করেন যে, একজনকে সহজেই নিঃসংজ্ঞ করা যায়, আর সেই অবস্থায় তাহাকে দিয়া যাহা ইচ্ছা, তাহাই করা যাইতে পারে।”
আমি বলিলাম, “আমি কিছুই স্বীকার করি না, বিশ্বাসও করি না।”
যোগিনী কহিল, “আমি যাহা করিতে পারি, তাহাই বলিতেছি, আপনাদের বিজ্ঞানে কি বলে জানি না। ঐ ওদিকে মুখ করিয়া একটি বালিকা বসিয়া আছে। আমি ইচ্ছা করিতেছি যে, ঐ বালিকা এখনই আমাদের নিকটে আসুক।”
এই বলিয়া যোগিনী তাহার দুই হস্ত প্রসারিত করিয়া তরঙ্গায়িত ভাবে নিজের বুকের দিকে টানিলেন, অমনই সেই বালিকা সহসা চমকিত হইয়া ফিরিল, তৎপরে দ্রুতপদে আমাদের দিকে আসিল। তাহাকে আমরা যেভাবে ডাকিয়াছি, ঠিক সে সেইভাবে আমাদের দিকে চাহিতে লাগিল।
শশধর আনন্দে ও উৎসাহে আত্মহারার মত হইয়া আমাকে বলিল, “কি হে, এখন কি বল?” আমি কি বলি, তাহা প্রকাশ করিয়া বলিলাম না, মনে মনে বুঝিলাম আগে হইতেই এই বালিকার সহিত এইরূপ বন্দোবস্ত ছিল। যোগিনী আমার দিকে একদৃষ্টিতে চাহিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিলেন, “দেখিতেছি, ইহাতেও ইহার বিশ্বাস হয় নাই। আচ্ছা, এই ঊষা দেবীকে অজ্ঞান অবস্থায় আনিলে বোধ হয়, ইনি আর অবিশ্বাস করিবেন না।”
তিনি ঊষার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “আপনার ইহাতে আপত্তি আছে?”
ঊষা হাসিয়া বলিল, “বিন্দুমাত্র না।”
এই সময়ে সকলেই সেখানে আসিয়া সমবেত হইয়াছিলেন। ঊষা একখানি চেয়ারে বসিল। যোগিনী তাঁহার ত্রিশূলে ভর দিয়া ঋজুভাবে ঊষার সম্মুখে দাঁড়াইলেন।
সহসা যোগিনীর আকৃতির সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটিল। তাঁহার চক্ষু হইতে এক ভীষণ দীপ্তি নিঃসৃত হইতে লাগিল, তাঁহার দেহ যেন ফুলিয়া দ্বিগুণিত হইল—তাঁহাকে পূর্ণ যুবতী বলিয়া বোধ হইতে লাগিল।
তাঁহার দৃষ্টি আমার ভাল বলিয়া বোধ হইল না, তিনি যেভাবে ঊষার দিকে চাহিতেছিলেন, তাহাও আমি ভাল মনে করিলাম না, কিন্তু এখন কোন কথা বলা উচিত নহে বলিয়া নীরব রহিলাম।
যোগিনী ঊষার মুখের নিকটে দুই হস্ত প্রসারিত করিলেন, তাহার পর তাহার মস্তক হইতে নাভি পর্য্যন্ত হস্ত সঞ্চালন করিতে লাগিলেন। প্রথম তিনবার হস্ত সঞ্চালনের সময়ে আমি দেখিলাম, ঊষা হাসিতেছে—যেন একটা মজা হইতেছে ভাবিয়া আমোদ পাইতেছে! চতুর্থ বারে তাহার নেত্রপল্লব কাঁপিতে লাগিল; পঞ্চম বারে তাহার চক্ষু সজল হইয়া আসিল; ষষ্ঠ বারে তাহার চক্ষু অর্দ্ধনিমীলিত হইয়া আসিল; সপ্তম বারে তাহার চক্ষু সম্পূর্ণ মুদিত হইল। ধীরে ধীরে নিদ্রিত ব্যক্তির ন্যায় তাহার নিশ্বাস পড়িতে লাগিল।
একজন অপরকে যে এরূপ করিতে পারে, তাহা আমার বিশ্বাস ছিল না। ঊষা যে এই স্ত্রীলোকের সহিত যোগ করিয়া নিদ্রার ভাণ করিবে, তাহা কখনই সম্ভবপর নহে—তবে এ কি? আমি কিছুই ভাবিয়া স্থির করিতে পারিলাম না—মনে মনে অতিশয় বিচলিত হইলাম, অতিকষ্টে মনোভাব গোপন করিলাম।
যোগিনী বলিলেন, “এখন ইনি অজ্ঞান অবস্থায় আছেন।”
আমি বলিয়া উঠিলাম, “ইনি ঘুমাইতেছেন।”
যোগিনী মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “তাহা যদি হয়, ইহাকে জাগান।”
আমি ঊষার হাত ধরিয়া টানিলাম, তাহার কানের কাছে মুখ লইয়া উচ্চকণ্ঠে তাহাকে ডাকিলাম, কিন্তু তাহার কোন সাড়া-শব্দ নাই, মানুষ না মরিলে এমন হয় না।
প্রকৃতপক্ষে তাহার দেহ আমাদের সম্মুখে রহিয়াছে, দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গাদির কার্য্য হইতেছে, কিন্তু সে এ দেহে নাই, সে কোথায় গিয়াছে? কে বলিবে, কি ক্ষমতায় তাহার দেহ হইতে তাহার আত্মাকে পৃথক্ করিয়াছে? ইহা কি সম্ভব! অসম্ভব!! সম্পূর্ণ অসম্ভব!!!
যোগিনী বলিলেন, “মুগ্ধ অবস্থা দেখিলেন। এখন বাকী বশীকরণ—ঊষাদেবীর এই মুগ্ধ অবস্থায় বা ইহার পর জাগ্রত অবস্থায় আমি যাহা ইচ্ছা করিব, ইনি তাহাই করিতে বাধ্য হইবেন। ইহার প্রমাণ চাহেন কি?”
আমি সবেগে বলিয়া উঠিলাম, “নিশ্চয়ই।”
যোগিনী মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “হাঁ, ইহারও প্রমাণ পাইবেন।”
এই বলিয়া যোগিনী ঊষার কানে কানে নিম্নস্বরে কি বলিতে লাগিল। আমার চীৎকার ঊষা কিছুই শুনিতে পায় নাই—অথচ ইহার মৃদু কণ্ঠ শুনিতে পাইয়া ঊষা মাথা নাড়িল।
সহসা যোগিনী সবলে ভূমে নিজ হস্তস্থ ত্রিশূলের আঘাত করিয়া বলিলেন, “জাগ।” অমনই ঊষা চক্ষু মেলিল, তৎপরে চমকিত হইয়া উঠিয়া বসিল। আমি তাহার মুখ দেখিয়া বুঝিলাম, কি যে ঘাটিয়াছে, এখন সে জ্ঞান তাহার নাই।
আমি কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। বিশ্বাস করিব কি অবিশ্বাস করিব, তাহা স্থির করিতে পারিলাম না। প্রিয়বন্ধু শশধর এই সম্বন্ধে আমাকে কতকগুলা কি বলিলেন, আমার মন এতই বিচলিত হইয়াছিল যে, তাঁহার সেই সকল কথায় কান দেওয়া আমার পক্ষে দুঃসাধ্য হইল।
আমি গৃহে ফিরিতে উদ্যত হইলে যোগিনী আমার হাতে একখণ্ড কাগজ দিয়া বলিলেন, “আপনার সন্দেহ দূর করিবার জন্য আর একটি সামান্য প্রমাণ দিব। এই পত্র কাল সকালে দশটার সময় খুলিয়া পড়িবেন।”
বাড়ী ফিরিয়াছি—রাত্রি অনেক হইয়াছে, আজ আর অধিক লিখিবার ক্ষমতা নাই। যাহা কখনও বিশ্বাস করিতাম না, তাহাই কি অবশেষে বিশ্বাস করিতে হইবে? কি দুৰ্দ্দৈব! না কিছুতেই না—সহজে নয়—বিশেষ প্রমাণ ব্যতীত নয়ই।
যোগিনীর পত্র পকেটে রহিয়াছে; তাহার কথামত আগামী কল্য প্রাতে দশটার সময় খুলিতে হইবে। ভাল, তাহাই হইবে।
২রা জানুয়ারি।—আমি প্রকৃতই বড় বিস্মিত হইয়াছি। বোধ হয়, এতদিনে এই সকল বুজরুকি বিশ্বাস করিতে হইল। যাহা ঘটিয়াছে, তাহা প্রকৃতই অত্যাশ্চৰ্য্য।
আমি কলেজে যাইব বলিয়া প্রস্তুত হইতেছি—সাড়ে নয়টা বাজিয়াছে, এই সময়ে আমার ভৃত্য আসিয়া বলিল, “ঊষা দেবী আসিয়াছেন।”
আমি বিস্মিত হইয়া বলিলাম, “কে—কে?”
“ঊষা দেবী।”
“ঊষা—এখানে একাকী?”
“হাঁ—একাই আসিয়াছেন।”
এই অসময়ে একাকী ঊষা আমার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছে শুনিয়া আমি নিতান্ত বিস্মিত হইলাম। কখনও সে এরূপ করে না, নিশ্চয়ই কিছু ঘটিয়াছে, নতুবা সে কখনই এরূপভাবে আসিত না। আমি ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া তাহার নিকট ছুটিলাম।
দেখিলাম, ঊষা দ্বারের নিকটে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। তাহার মুখ বিশুষ্ক ম্লান, তাহার চোখ দুটি নিষ্প্রভ। সে আমাকে দেখিয়া বলিল, “আমাদের বিবাহ হইতে পারে না, তাহাই আপনাকে বলিতে আসিয়াছি।”
আমি এই অত্যদ্ভুত কথা শুনিয়া প্রকৃতই স্তম্ভিত হইলাম। সে কি! বিবাহ হইত পারে না, বিবাহের সমস্ত স্থির, এখন বিবাহ হইতে পারে না, সে কি! আমার মাথা ঘুরিয়া গেল, আমি কম্পিত হস্তে প্রাচীর ধরিলাম, বলিলাম, “ঊষা, সে কি–সে কি! বিবাহ হইতে পারে না?”
ঊষা আগেকার মত ধীরে ধীরে বলিল, “হাঁ, আমাদের বিবাহ হইতে পারে না। আমি সেই কথা বলিতে আসিয়াছি।”
আমি বলিয়া উঠিলাম, “কেন, কারণটা কি? কি জন্য আমার উপর রাগ করিয়াছ, অন্ততঃ ইহাও আমাকে বলিবে।”
“না, আমাদের বিবাহ হইতে পারে না।”
“কেন—কেহ কি তোমার কাছে আমার নামে কোন কুৎসা করিয়াছে? কি হইয়াছে— আমায় বল, খুব সম্ভব, আমি তোমার ভ্রম দূর করিতে পারিব।”
“না—বিবাহ হইতে পারে না।”
“বিবাহের সমস্ত স্থির, এখন বিবাহ হইতে পারে না—সে কি, তোমার পিতা কি একথা বলিয়াছেন? তুমি কি বলিতেছ, তাহা বুঝিতে পারিতেছি না; কেন—কি জন্য আমার উপরে রাগ করিয়াছ, বল।”
“না—আমাদের বিবাহ হইতে পারে না।”
এই বলিয়া ঊষা দ্রুতপদে তথা হইতে চলিয়া গেল। আমি কি করিব কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া স্তম্ভিতপ্রায় সেইখানে দাঁড়াইয়া রহিলাম। জীবনে আমার এরূপ অবস্থা আর কখনও হয় নাই।
সহসা ঘড়ীতে দশটা বাজিল। শুনিয়া আমার চমক হইল, দশটার সময় যোগিনীর সেই পত্ৰ খুলিবার কথা; সে পত্র আমার পকেটেই রহিয়াছে আমি সত্বর পত্রখানি খুলিয়া ফেলিলাম, তাহাতে পেন্সিলে লেখা :
“ধীরেন্দ্রনাথবাবু,
আপনি বিশিষ্ট প্রমাণ না পাইলে বিশ্বাস করিতে চাহেন না বলিয়া একটু কঠোর প্রমাণ দিতে বাধ্য হইলাম; এজন্য ক্ষমা করিবেন। আমি শশধরবাবুর নিকটে শুনিয়াছি যে, ঊষাদেবীর সহিত আপনার বিবাহ স্থির হইয়া গিয়াছে, সেইজন্য ভাবিলাম, কাল সকালে সাড়ে নয়টার সময় সে আমার কথামত আপনার নিকটে গিয়া যদি বিবাহ-ভঙ্গের কথা বলে, তাহা হইলে আপনি বিশ্বাস করিবেন। সে স্বেচ্ছায় কখনই এ কাজ করিবে না, তাহাই তাহার দ্বারা আমি এ কাজ করিয়া আপনার বিশ্বাস জন্মাইব, মনে মনে ইহা স্থির করিয়াছি। ইহার জন্য তাহার উপর রাগ করিবেন না। এ কাজ সে করিতেছে না, এ কথা তাহার মনেও থাকিবে না, তবে আপনি একটু কষ্ট পাইবেন, তাহার উপায় নাই। নতুবা এ সকল বিষয়ে আপনার বিশ্বাস উৎপাদন সম্ভব নহে।
যোগিনী।”
পত্র পাঠ করিয়া আমি রাগিতে পারিলাম না, বরং মনটা অনেকটা আশ্বস্ত হইল। তবে ঊষা কিছুই জানে না, একরূপ অজ্ঞান অবস্থায় এই যাদুকরীর প্ররোচনায় আসিয়া বিবাহ ভাঙ্গিবার কথা আমায় বলিয়াছে। তবে ইহাও সম্ভব!
আমি পূৰ্ব্বে ইহা কখনই বিশ্বাস করিতে পারিতাম না, কিন্তু এখন অবিশ্বাসের আর কোন কারণ নাই। তাহা হইলে এক ব্যক্তি আর এক ব্যক্তিকে দিয়া যাহা-ইচ্ছা-তাহাই করিতে পারে! কি ভয়ানক!
তাহার আত্মাকে তাহার দেহমধ্য হইতে দূর করিয়া দিয়া অপর একজন তাহার দেহ অধিকার করিয়া নিজ অভিমত কার্য্য করাইয়াছে। দূরে থাকিয়া ঊষাকে দিয়া যাহা ইচ্ছা, তাহাই করিয়াছে! এরূপ ভয়াবহ ব্যাপার যে সংসারে ঘটিতে পারে, তাহা আমার বিশ্বাস ছিল না; কিন্তু এখন আর অবিশ্বাসের কোন কারণ নাই।
তখনই ঊষার সহিত দেখা করা আমি নিতান্ত কর্তব্য মনে করিলাম। প্রকৃতই কি তাহার এ বিষয়ে কোন জ্ঞান নাই?
আমি ঊষাদের বাড়ীতে উপস্থিত হইবামাত্র ঊষা আমাকে দেখিয়া বিস্ময়ভরে বলিল, “অসময়ে যে! কালেজে যান নাই?”
“এই যাইতেছি। ঊষা তুমি কি একটু আগে বাহিরে গিয়াছিলে?”
সে অধিকতর বিস্মিতভাবে আমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, “কই না, কোথায়ও আমি যাই নাই।”
“কোথায়ও যাও নাই?”
“না—এই একটু আগে একখানা বই পড়িতে পড়িতে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম।”
“তাহার পর ঘুম ভাঙ্গিলে দেখিলে তুমি তখনও ঠিক সেইখানেই বসিয়া আছ?”
“হাঁ। কেন, আমি আবার কোথায় যাইব?”
“ঘুমাইয়া কি কোন স্বপ্ন দেখিয়াছিলে? বিশেষ কারণ আছে বলিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছি।”
“স্বপ্ন? কই না—কিছু মনে পড়ে না।”
আমি বুঝিলাম, ঊষার কোন কথা মনে নাই। সে যে আমার বাড়ীতে গিয়াছিল, তাহাও তাহার মনে নাই! তাহার বিশ্বাস, সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, আর কিছুই সে জানে না। বাড়ীর ভৃত্যদিগের নিকট অনুসন্ধান করিয়া জানিলাম যে, সাড়ে নয়টার একটু আগে ঊষা বাড়ী হইতে বাহির হইয়া গিয়াছিল, তাহার বাড়ী হইতে আমাদের বাড়ী বেশি দূর নহে, সুতরাং সে আমার বাড়ী হইতে ফিরিয়া আসিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। যাহা হউক, আমার আর অবিশ্বাস নাই। আর অবিশ্বাস করিব কি বলিয়া—আর অবিশ্বাসের কোন কারণ নাই। হায় রে হায়! ইহার নিকট আধুনিক বিজ্ঞান কিছুই নহে।
দূরে থাকিয়া একজন আর একজনের উপরে প্রভাব বিস্তার করিবে, ইহা যে সম্ভব, ইহা কে সহজে বিশ্বাস করিতে পারে? কিন্তু আমি চোখের উপরে এ দৃশ্য দেখিলাম, আর অবিশ্বাস করিব কিরূপে?
যখন ইহা বুজরুকী নহে, মিথ্যা বা জাল-জুয়াচুরি নহে, যখন ইহা অন্যান্য বিজ্ঞানের ন্যায় অবশ্যই সত্য—তখন আর অবিশ্বাস করিব কিরূপে? তখন এ বিষয় নিজে শিক্ষা করিয়া ইহাতে কতদূর কি করিতে পারা যায়, তাহা দেখিব না কেন?
হয়ত আমাকে সহসা এই সকল ভূতুড়ে কাণ্ডে বিশ্বাস করিতে দেখিয়া অনেকেই হাস্য-বিদ্রূপ করিবে। হয়ত কত লোকে কত কথা কহিবে, কিন্তু তাহাতে ক্ষতিবৃদ্ধি কি? যখন আমি ইহা নিজে সত্য বলিয়া জানিয়াছি, তখন আমি কেন না ইহা বিশেষরূপে পরীক্ষা করিয়া ছাড়িব?
যখন যোগিনী এই পর্য্যন্ত তাহার ক্ষমতা দেখাইয়াছে, তখন সে নিশ্চয়ই আরও ক্ষমতাসম্পন্না। আমি তাহার নিকট এই সকল শিক্ষা করিব, শিক্ষা করিয়া নিজে পরীক্ষা করিয়া দেখিব। ভাল কাজে লাগাইয়া হয়ত ইহাতে জগতের প্রভূত উপকার সাধন করিতে পারা যাইবে।
প্রিয়বন্ধু শশধর আমার কথা শুনিয়া আনন্দে বিহ্বল হইল। আমি যে তাহার দলে ভর্তি হইতেছি, এই সকল অবিশ্বাস্য বিশ্বাস করিয়াছি, তাহাতে সে অপরিমেয়’ আনন্দলাভ করিল; একমুখ হাসি হাসিয়া বলিল, “বাপু হে–আছে—আছে, আমাদের দেশে যা আছে, আর কোথাও তা নাই।”
৪ঠা জানুয়ারি।—আমি তাহার দলভুক্ত হইয়াছি শুনিয়া যোগিনী যে সন্তুষ্ট হইল না, এমন নহে; তবে সহজে সে তাহার মনের ভাব প্রকাশিত হইতে দিত না, কথা খুব কম কহিত—কিন্তু যখন কোন অদ্ভুত ব্যাপার সাধনের জন্য প্রস্তুত হইত, তখন সে আর এক অপূর্ব্ব ভিন্নমূৰ্ত্তি পরিগ্রহ করিত, তাহার চক্ষু দুটি হইতে নক্ষত্রের ন্যায় তীব্র দীপ্তি বিকীর্ণ হইত।
সে যে আমার উপর বিশেষ দৃষ্টি রাখিতেছে, তাহাও আমি বুঝিতে পারিলাম; দেখিতাম, সর্ব্বদাই সে আমার দিকে চাহিয়া আছে, কিন্তু আমি তাহার দিকে চাহিলে সে মুখ ফিরাইয়া লয়। তাহার ক্ষমতা সম্বন্ধে আমাদের অনেক কথাবার্তা হইল। যদি এই সকল কথায় বিজ্ঞানের কোন সম্পর্ক নাই, তাহা হইলেও এ সম্বন্ধে তাহার নিজের কি মত, তাহা বলা ভাল।
সে বলিল, “আপনি যাহা দেখিয়াছেন, তা সামান্য—কিছুই নহে। যখন ঊষা দেবী আপনার সঙ্গে দেখা করিয়াছিল, তখন তাহার উপর আমার কিছুমাত্র চেষ্টা ছিল না। আমি তাহার কথা তখন মনেও ভাবি নাই। যেমন ঘড়ীতে দম দিয়া দিলে, ঠিক সেই সময়ে ঘড়ী বাজিয়া উঠে, আমি তাহার চিত্তবৃত্তি সম্বন্ধে ঠিক তাহাই করিয়াছিলাম। কানে কানে তাহাকে সেইদিন সাড়ে নয়টার সময় আপনার সঙ্গে দেখা করিয়া বিবাহ ভঙ্গের কথা বলিতে বলিয়াছিলাম। ইহা বারঘণ্টা না হইয়া যদি চার ঘণ্টা পরে এইরূপ ঘটিবে, এমন কোন সময় নির্দ্দেশ করিতাম, তাহা হইলেও কাজ একই রূপ হইত—কোন পার্থক্য ঘটিত না।”
আমি অন্যমনস্কভাবে বলিলাম, “যদি আপনি আমাকে হত্যা করিতে বলিতেন?” যোগিনী কহিল,–”নিশ্চয়ই সে আপনাকে হত্যা করিত।”
“কি ভয়ানক ক্ষমতা?”
“হাঁ—প্রকৃতই ইহা ভয়ানক ক্ষমতা। আপনি এ সম্বন্ধে যত আলোচনা করিবেন, ততই ইহাকে অতি ভয়ানক ক্ষমতা বলিয়া বোধ হইবে।”
“আপনি বলিলেন, যাহা আমি দেখিয়াছি, যাহা ঊষা করিয়াছে, তাহা এই ক্ষমতার একটা নগণ্য প্রক্রিয়া মাত্র। এই ক্ষমতার চরম কি?”
“না শুনিলেই ভাল।”
আমি বলিলাম, “আমি যে কেবল কৌতূহলের বশবর্তী হইয়া এ কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি, তাহা নহে। ইহার কোন বৈজ্ঞানিক মীমাংসা হয় কিনা, তাহাই দেখিবার জন্য জিজ্ঞাসা করিতেছি।”
যোগিনী কিয়ৎক্ষণ নীরবে থাকিয়া বলিলেন, “বিজ্ঞানের ধার আমি ধারি না, মহাশয়! ইহার কোন বৈজ্ঞানিক মীমাংসা হইতে পারে কি না, তাহাও জানিবার জন্য আমি কিছুমাত্র ব্যগ্ৰ নহি।”
আমি বলিলাম, “আমি মনে করিতেছিলাম –
মধ্যপথে বাধা দিয়া যোগিনী স্মিতমুখে কহিলেন,–”যদি আপনি নিজে কিছু জানিতে চাহেন, তাহা হইলে আমি আনন্দের সহিত আপনার কথার উত্তর দিব। আপনি কি বলিতে চাহেন, এই ক্ষমতা কতদূর বৃদ্ধি করা যাইতে পারে, এই মাত্র?”
“হাঁ, তাহাই আমি জানিতে চাহি।”
“যদি উপযুক্ত পাত্র হয়, তাহা হইলে এই ক্ষমতায় অপরকে সম্পূর্ণ বশীকরণ করা যায়। তাহাকে দিয়া যাহা ইচ্ছা তাহাই করা যায়।”
“তাহার অজ্ঞাতসারে?”
“সব সময়ে নহে। কোন কোন স্থলে ঊষার ন্যায় সম্পূর্ণ অজ্ঞান অবস্থায় কাজ করিবে— জ্ঞান হইলে কিছু মনে থাকিবে না। অপর স্থলে জ্ঞান থাকিবে, কি করিতেছে জানিতে বুঝিতে পারিবে, কিন্তু অমত করিবার ক্ষমতা থাকিবে না। অনিচ্ছা সত্বেও বাধ্য হইয়া সজ্ঞানে করিতে হইবে।”
“তাহা হইলে তাহার আর কোন ক্ষমতা থাকিবে না? নিজের ইচ্ছাশক্তি সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হইয়া যাইবে?”
“হাঁ, অন্যের ইচ্ছাশক্তির দ্বারা তাহার ইচ্ছাশক্তি সম্পূর্ণরূপে বশীভূতা হইবে।”
“আপনি এ ক্ষমতা কখনও ব্যবহার করিয়াছেন?”
“অনেক বার।”
“আপনার ইচ্ছাশক্তি কি এতই প্রবল?”
“ঠিক তাহা নহে। অন্যের ইচ্ছাশক্তি আমার ইচ্ছাশক্তি হইতে প্রবল হইতে পারে, সে কথা নহে। আমার ইচ্ছাশক্তি অপরের মনে লিপ্ত করিয়া তাহার ইচ্ছাশক্তিকে আমার বশীকরণ করাই কথা হইতেছে। শরীরের অবস্থা বুঝিয়া আমারও এ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় বা হ্রাস হয়।”
“তাহা হইলে মোটের উপর আপনার আত্মাকে অপরের দেহে প্রেরণ করেন।”
“হাঁ, কতকটা তাহাই বটে।”
“তখন আপনার শরীরের কিরূপ অবস্থা হয়?”
“কিছু অবসন্নভাব থাকে মাত্র।”
“ইহাতে আপনার শরীরের স্বাস্থ্যের অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা কি নাই?’
“একটু আছে। এ কার্য্য করিতে গেলে দেহ হইতে নিজের আত্মাকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা উচিত নহে, দেহের সহিত আত্মার কিছু সম্বন্ধ রাখা চাই। একবার সম্পূর্ণরূপে বিছিন্ন হইলেও আত্মারা দেহে পুনরায় প্রবেশ করে, কিন্তু অনেক সময়ে কঠিন হইয়া পড়ে। এ বিষয় বৈজ্ঞানিক ভাবে ব্যাখ্যা করি, এ ক্ষমতা আমার নাই। আমি যাহা, জানি বা যাহা দেখিয়াছি, তাহাই আপনাকে বলিতেছি।”
অবসরে এই সকল বিষয়ের আলোচনা করিয়া আমি আপনার উপর আপনিই আশ্চর্যান্বিত হই। বিজ্ঞানশাস্ত্রে মহা পণ্ডিত বলিয়া আমি প্রখ্যাত, আর সেই মহা পণ্ডিত আমি কি না নীরবে একটা স্ত্রীলোকের ভুল কথা গম্ভীরভাবে বসিয়া বিশেষ মনোযোগের সহিত শুনিতেছি; এবং তাহার সহিত এ বিষয় লইয়া আলোচনা করিতেছি। সে বলিতেছে, সে ইচ্ছামত তাহার আত্মা অন্যের দেহে পাঠাইয়া তাহার দ্বারা যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে পারে, ইহা কি আমি বিশ্বাস করিয়াছি? না কখনই না—বিশেষ প্রমাণ-গুরুতর প্রমাণ না পাইলে আমি এই প্রলাপ কখনই বিশ্বাস করিতে পারিব না। তবে যদিও আমি এখন অবিশ্বাস করিতেছি, কিন্তু এ সম্বন্ধে বিদ্রূপ করা ছাড়িয়াছি। আজ সন্ধ্যার সময় যোগিনী আমাকে বশীকরণ বা মেসমেস্মেরাইজ করিবার চেষ্টা করিবে। যদি সে যথার্থই আমার উপর কিছু প্রভাব বিস্তার করিতে পারে, আমি তখন এ সম্বন্ধে নিজে পরীক্ষা ও অনুসন্ধান আরম্ভ করিব।
৬ই জানুয়ারি।—বোধ হয়, এক গুরুতর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান ও পরীক্ষা করিতে আমি সক্ষম হইব। নিজের ভিতর হইতে—মন হইতে—এই সকল বিষয় পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পারিলে, তাহাপেক্ষা সুবিধা কি? যদি যোগিনীর কথা প্রকৃতই সত্য হয়, তাহা হইলে আমি এক সময়ে ইহার বৈজ্ঞানিক অর্থের আবিষ্কর্তা হইতেও সক্ষম হইব।
গৃহমধ্যে শশধর ব্যতীত আর কেহ ছিল না। পূর্ব্বে ঊষা যেরূপ ভাবে যোগিনীর সম্মুখে বসিয়াছিল, আমিও সেইরূপ বসিয়াছি। যোগিনী আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া আমার মুখের উপর সেইরূপভাবে হাত চালাইতেছে। তাহার হাতের সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হইতেছে যেন, কি একটি উষ্ণ বাতাস আমার মুখের উপর দিয়া-সর্ব্বাঙ্গের উপর দিয়া—বহিয়া যাইতেছে।
আমি যোগিনীর মুখের দিকে চাহিয়া আছি। ক্রমে তাহার মুখ যেন ধীরে ধীরে তরল ধূমরাশির মধ্যে মিলাইয়া যাইতে লাগিল। অবশেষে সেই ধূমরাশির মধ্য হইতে কেবল তাহার দুই বৃহৎ চক্ষু আমার চক্ষুর দিকে জ্বলিতে লাগিল—কেবল আমি ইহাই দেখিতে লাগিলাম। ধীরে ধীরে ক্রমে ক্রমে সেই দুই বিশাল চক্ষু আরও দীপ্তিমান্—আরও প্রজ্জ্বোল—আরও বৃহৎ — আরও স্থির হইতে আরম্ভ করিল। সহসা উহা এত প্রকাণ্ড যেন, দুই বৃহৎ পুষ্করিণীতে পরিণত হইল। এখন আর অগ্নি নাই, চারিদিকে কেবল তাহার নীল জল ঢল ঢল্ করিতেছে! আর আমি সবেগে সেই পুষ্করিণীর জলে পতিত হইতেছি—কি ভয়ানক! আমার সর্ব্বাঙ্গ শিহরিয়া উঠল; ক্রমে মহাবেগে সেই জলে পতিত হইয়া দেখিলাম, সেই দুই পুষ্করিণী এক হইয়া এক বৃহৎ হ্রদে পরিণত হইয়াছে। আমি তাহারই অগাধ জলরাশির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হইয়াছি।
তাহার পর নিম্নে—নিম্নে—আরও নিম্নে ডুবিয়া চলিলাম, সবেগে অতল বারিগর্ভে পশিতেছি; নিম্নে—নিম্নে—আরও নিম্নে ডুবিয়া যাইতেছি। ক্ষণপরে আবার উপরে উঠিতে লাগিলাম। ক্রমে ক্রমে উঠিতেছি; প্রায় জলের উপর আসিয়াছি, চোখে আলো দেখিতেছি, এই সময়ে আমার কর্ণে বজ্রমন্ত্রে ধ্বনিত হইল, “জাগ।”
আমি চমকিত হইয়া জাগিলাম। দেখি, আমি সেই চেয়ারেই বসিয়া আছি। নিকটে ত্রিশূলদণ্ডে ভর দিয়া যোগিনী স্থিরনেত্রে আমার মুখ প্রতি চাহিয়া আছে—পার্শ্বে বন্ধুবর শশধর নিবিষ্টমনে তাহার নোটবুকে আমার এই নিদারুণ অবস্থা লিপিবদ্ধ করিতেছে।
আমার শরীরের কোন বিকৃতি বা অসুখ হয় নাই। আমার মনও উৎসাহে পূর্ণ হইয়া গিয়াছে! তাহা হইলে আশা আছে, এ সম্বন্ধে আমি নিজে এখন অনেক অনুসন্ধান করিতে পারিব, অনেক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করিতে সক্ষম হইব।
.
১০ই জানুয়ারি।—আমি এই বশীকরণ সম্বন্ধীয় নানা পুস্তক সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছি। ইংরাজী, সংস্কৃত ও বাঙ্গালায় এ সম্বন্ধে যে সকল পুস্তক লিখিত হইয়াছে, তাহা সমস্তই পাঠ করিতে আরম্ভ করিয়াছি।
কি কঠিন সমস্যা! পড়িয়া কিছুই পাই নাই, কেবলই ক্রিয়া আর ফল—কারণ কিছুই দেখান নাই—কারণই ইহার ঘোর রহস্য। এই এই ঘটে—কিন্তু কেন ঘটে, তাহার বিষয় কোথায়? আমি একখানা বড় খাতা করিয়া এ সম্বন্ধে নানাকথা লিখিয়া রাখিতে লাগিলাম। ইহাতে সহজেই কেবল কল্পনাশক্তি বিকসিত হয়। কোনমতেই ইহা হইতে দেওয়া হইবে না—কল্পনা বিজ্ঞানের শত্রু। অনুমান, ধারণা, এ সকল আমি গ্রাহ্য করিব না—আমি নিখুঁত সত্য চাই!
আমি এখন বুঝিয়াছি যে, মেসমেরিজম বা বশীকরণে নিঃসংজ্ঞ করা যায়; আমি ইহাও জানিয়াছি যে, এ অবস্থায় তাহাকে কোন হুকুম করিলে বা কোন কাজ করিতে বলিলে সে অজ্ঞান অবস্থায় তখন বা পরে সেই কাজ করিতে বাধ্য হয়; আমি আরও জানিয়াছি যে, আমি নিজে অপর কর্তৃক সহজেই মেস্মেরাইজড্ হইতে পারি, সুতরাং আমি এক্ষণে অনায়াসে নিজেই এ বিষয়ের বৈজ্ঞানিক আলোচনা করিতে পারিব।
আজ ঊষার পিতা বিবাহের সমস্তই পাকাপাকি করিয়া গেলেন। আর আমাদের বিবাহের বিলম্ব নাই!
.
১৫ই জানুয়ারি।—আজ আবার যোগিনী আমাকে মেসমেস্মেরাইজ করিয়াছে। পূর্ব্বে মেস্মেরাইজড্ হওয়ায় যে ভাব হইয়াছিল, আজও তাহাই হইয়াছিল। আজ পূৰ্ব্বাপেক্ষা আমি শীঘ্র অজ্ঞান হইয়াছিলাম। শশধর আমার গায়ের উত্তাপ, নিশ্বাস প্রশ্বাস প্রভৃতি সমস্তই তাহার নোট বইয়ে টুকিয়া লইয়াছিল।
.
১৬ই জানুয়ারি।—আজও আবার মেস্মেরাইজড্ হইয়াছি। শশধরের নোটবুকে সে বিবরণ আছে।
.
১৭ই জানুয়ারি।—আজ যোগিনী অন্যত্র যাওয়ায় মেসমেরিজম বন্ধ আছে। এরূপ বন্ধ থাকায় আমি একটু বিরক্তও হইলাম। এ ব্যাপার কতদূর পর্য্যন্ত চলিতে পারে, ইহাতে কি হয় না হয়, ইহা নিজে পরীক্ষা করিয়া দেখিবার জন্য আমি ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছি; এখন কেবল ইহাই দেখিয়াছি যে, ইহাতে ক্রমে ক্রমে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ জ্ঞানশূন্য হওয়া যায়।
ইহার পর দেখিতে হইবে, আরও অগ্রসর হইতে হইবে, আত্মার পরিবর্তন অথবা সম্পূর্ণ বশীকরণ; সে অবস্থায় আমি অন্যের হুকুম মত কার্য্য করিতে বাধ্য হইব; তাহার পর ইহার সম্পূর্ণ বিকাশ, সে অবস্থায় কতদূর ক্ষমতা হয়, তাহাই দেখিতে হইবে।
একটা স্ত্রীলোক আমার ন্যায় এমন এক প্রচণ্ড বৈজ্ঞানিককে লইয়া এরূপ লীলাখেলা করিতেছে, ইহাতে আমি মনে মনে আশ্চৰ্য্যান্বিত হইতে লাগিলাম; তবে বিজ্ঞানের জন্য সবই করা উচিত, ইহাতে লোকের মুখাপেক্ষী হওয়া বৃথা, কেহ যদি নিন্দা করে—কি করিব?
.
২০শে জানুয়ারি।—আমার পার্শ্বের বাড়ীতে বৃদ্ধ ডাক্তার করুণাকান্তবাবু থাকিতেন। তিনি আজ সকালে আসিয়া বলিলেন, “ধীরেন্দ্রবাবু শুনিতেছি, তুমি নাকি শশধরের যোগিনীর নিকটে মেসমেস্মেরাইজড্ হইতেছ?”
আমি বলিলাম, “হাঁ, কেন কি হইয়াছে? ব্যাপারটা কি দেখা উচিত নহে?”
তিনি বলিলেন, “আমি হইলে আজ হইতেই ইহা বন্ধ করিতাম। আমি তোমার অপেক্ষা বয়সে অনেক বড়, আমি তোমায় পরামর্শ দিতেছি, ঐ যোগিনীটার ত্রিসীমানায় যাইও না।”
“কেন?”
“আমি বিশেষ কারণে সব কথা খুলিয়া বলিতে পারিতেছি না। এই পৰ্য্যন্ত বলি, যোগিনী আমার উপরও এক হাত চালাইয়াছিল, ইহাতে তাহার উপর আমার বিশেষ ভক্তি জন্মায় নাই।” ইহাতে আমি সন্তুষ্ট হইলাম না। কেন তিনি এ কথা বলিতেছেন, তাহা তাঁহাকে নানা প্রশ্ন করিয়া জানিবার চেষ্টা পাইলাম, কিন্তু তিনি আমাকে কোন কথায়ই খুলিয়া বলিলেন না।
আমি তাঁহার এই বাজে কথায় যে এ পরীক্ষা ত্যাগ করিব, ইহা কখনই হইতে পারে না। ইহাতে বিজ্ঞান জগতের নানা নূতন তত্ত্বের আবিষ্কার সম্ভাবনা, সুতরাং আমি এ অবস্থায় যোগিনীকে কিছুতেই ত্যাগ করিতে পারি না। ডাক্তার বোধ হয়, কোন কারণে এই স্ত্রীলোকের উপর চটিয়াছেন—তাহাই এ কথা বলিতেছেন। তাঁহার যাহা খুসী বলুন—আমি বদ্ধপরিকর।
২৪সে জানুয়ারি।—মে মেস্মেরাইজড্ হইলাম।
২৫সে জানুয়ারি।—মে মেস্মেরাইজড্ হইলাম।
২৬সে জানুয়ারি।—আজও মেস্মেরাইজড্ হইলাম।
২৭সে জানুয়ারি।—আজও মেস্মেরাইজড্ হইলাম। বোধ হয়, এইরূপ পুনঃপুনঃ মেসমেরিজমে শরীর খারাপ হয়। ঊষা বলিতেছে, আমি ক্রমশঃ শীর্ণ হইয়া যাইতেছি, আমার চোখের কোণে কালী পড়িয়াছে। আমি নিজেও বুঝিতেছি যে, আমার স্নায়ুমণ্ডলী আর পূর্ব্বের ন্যায় সতেজ নাই। সামান্য শব্দ হইলে আমি চমকিত হইয়া উঠি, ছেলেদের পড়াইবার সময়ে কোন ছেলে কিছু বুঝিতে না পারিলে আমার সহসা প্রখর রাগ হইয়া উঠে।
ঊষা আমাকে এই মেসমেরিজম ছাড়িয়া দিতে পুনঃপুনঃ অনুরোধ করিতেছে, আমি কিন্তু ছাড়িতেছি না। আমি তাহাকে বুঝাইয়াছি, “আত্মার সহিত দেহের সম্বন্ধ বিচার,” নাম গ্রহণ করিয়া যখন আমার একখানা অভিনব পুস্তক বাহির হইবে, তখন জগতে ধন্য ধন্য পড়িয়া যাইবে। অগত্যা সে তাহাতেই নিরস্ত আছে।
এখন প্রত্যহ রাত্রেই মেস্মেরাইজড্ হইতেছি। পূর্ব্বের অপেক্ষা এখন শীঘ্রই বাহ্যজ্ঞান হারাই; কিন্তু এই অভিভূতকালে আমার মনের যে অবস্থা হয়, সেদিকে আমি বিশেষ লক্ষ্য রাখিতেছি।
শশধর দশ-বার দিনের জন্য দেশে যাইবে। তাহাতে আমি মেসমেরিজম বন্ধ রাখিব না। যোগিনী তাহার বাটীতেই থাকিবেন।
.
২রা ফ্রেব্রুয়ারী।—আমরা বিশেষ সাবধান হইতেছি। আমাদের উভয়ের এই সকল কাৰ্য্যে এক গোলযোগ উপস্থিত হইয়াছে! বিজ্ঞানচর্চায় নিবিষ্ট থাকিয়া আমি সম্পূর্ণরূপে ভুলিয়া গিয়াছিলাম যে, যোগিনী স্ত্রীলোক, তাহাতে রূপবতী যুবতী। এখন নিজে এ কথা লিখিয়া রাখিতে পারি, নতুবা প্রাণ থাকিতে এ কথা কাহাকেও বলিবার নয়। এই স্ত্রীলোক আমায় ভালবাসিয়াছে।
ব্যাপারটি এখন এরূপ গুরুতর অবস্থায় দাঁড়াইয়াছে যে, আমি ইহা আর নিজের কাছেও ঢাকিয়া রাখিতে পারি না। পূর্ব্বে যোগিনীর ভাব আমি একেবারে লক্ষ্য করি নাই, এখন তাহার ভাব-ভঙ্গি চাহনি কথাবার্তায় স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম, সে আমাকে ভালবাসিয়াছে—আমাকে চাহে—কি মুস্কিল!
কতবার মনকে প্রবোধ দিলাম যে, ইহা কেবল আমার ভ্রম, এ স্ত্রীলোক যোগিনী, সে কখনও এ কাজ করিতে পারে না। বিশেষতঃ সে জানে যে, আমি ঊষাকে প্রাণের সহিত ভালবাসি, তাহার সহিত আমার বিবাহ স্থির হইয়া গিয়াছে।
.
৪ঠা ফ্রেব্রুয়ারী।—শশধর চলিয়া গিয়াছে। কাল এক ভয়াবহ ব্যাপার ঘটিয়াছে। মেসমেরিজমের পর আমার জ্ঞান হইলে আমি দেখিলাম, আমি অন্য একটা প্রকোষ্ঠমধ্যে রহিয়াছি, তথায় গবাক্ষপার্শ্বে দুটি মশাল জ্বলিতেছে, একটি বৃহৎ ধুনচি হইতে ধুনার সুগন্ধ ধুম অত্যন্ত নিবিড় ভাবে উদ্গীর্ণ হইতেছে—ধূমে কক্ষ পূর্ণ হইয়া গিয়াছে।
ধূমাচ্ছন্ন হইয়া আমি যোগিনীকে ক্রোড়ে তুলিয়া লইয়াছি, সেই ধূমরাশির মধ্যে মশালের উজ্জ্বল আলোকে প্রতিফলিত হইয়া যোগিনীর চক্ষু অগ্নিখণ্ডবৎ উজ্জ্বল ভাবে জ্বলিতেছিল এবং তাহার মুখমণ্ডল অপূর্ব্ব সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করিয়াছিল। আমার হস্ত পাপিষ্ঠার কটি বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে! সে আমার চক্ষুঃপ্রতি দৃষ্টি স্থির করিয়া মৃদুমধুর হাসিতেছে! আরও ভয়ানক, যাহা বলিতে আমার কিছুমাত্র ইচ্ছা নাই, আমি তাহাকে সেই সকল প্রেমের কথা বলিবার জন্য ব্যাকুল হইতেছি!
ক্ষণপরে যোগিনী অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে বারংবার আমার মুখ চুম্বন করিল। ক্ষণকাল অর্দ্ধনিমিলীত স্থিরনেত্রে আমার চক্ষুঃপ্রতি চাহিয়া রহিল, ধীরে ধীরে আবার আমার জ্ঞান আচ্ছন্ন হইতে লাগিল, আমি হেলিয়া পড়িলাম, যোগিনী আমাকে নিজের ক্রোড়ে টানিয়া লইয়া, প্রসারিত হস্তে একখানা সুদীর্ঘ ছুরি ঊর্দ্ধে তুলিয়া ঊর্দ্ধমুখে অব্যক্তস্বরে কি এক মন্ত্রপাঠ করিতে লাগিল, আমি সে মন্ত্রের একটী বর্ণও বুঝিতে পারিলাম না–সেদিকে চাহিতে পারিলাম না- মনে হইতে লাগিল, বর্হিজগৎ হইতে আমি ক্রমশঃ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িতেছি; তথাপি স্বপ্নের মত আমার মনে হইতেছে, আমাকে নিস্পন্দ দেখিয়া, সহসা যোগিনী মন্ত্রপাঠ বন্ধ করিয়া আমাকে তাহার বক্ষের উপরে টানিয়া লইল। তৎক্ষণাৎ যেন আমার কতকটা সংজ্ঞা ফিরিয়া আসিল, আমি যোগিনীর হাত হইতে নিজেকে মুক্ত করিবার জন্য মনোমধ্যে অত্যন্ত ব্যাকুল হইতে লাগিলাম।
সেদিনকার প্রলোভন হইতে আপনাকে যদি মুক্ত করিতে না পারিতাম, তাহা হইলে এ জীবনে আর লোকালয়ে মুখ দেখাইতে পারিতাম না! আমার বিবাহ স্থির, আমি ঊষাকে প্ৰাণ দিয়া ভালবাসি, আর আমি এই কুহকিনীকে সপ্রেম সম্ভাষণ করিয়া প্রেমালাপ করিতেছিলাম।
আমার চেতনা আরও উন্মেষিত হইল, আমি তাহাকে সবলে ঠেলিয়া দিয়া তৎক্ষণাৎ সে স্থান পরিত্যাগ করিলাম। আর এক মুহূর্ত্ত তাহার নিকটে থাকিলে আমি কি করিতাম, জানি না, এমনই আমার মন তাহার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিল! কি ভয়ানক! এখনও মনে হইলে প্রাণ শিহরিয়া উঠে।
এখন আমি বুঝিলাম—বশীকরণ কি। ডাইনীর গল্পেও কতক বিশ্বাস হইতে লাগিল। কি করিব, কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। হয়ত আমার ভুল হইয়াছে, সে যোগিনী—এরূপ সে করিবে কেন? খুব সম্ভব, আমার অজ্ঞান অবস্থায় আমিই তাহাকে ক্রোড়ে বসাইয়াছিলাম! ছিঃ! ছিঃ! লজ্জায় মরিয়া যাইতে ইচ্ছা হইতেছে!
যাহা হউক, যতদিন বন্ধু শশধর না ফিরে, ততদিন আর এ কাজ নহে! ইহার নিকটে যাওয়াও উচিত নহে। বিশেষ কাজে ব্যস্ত থাকায় দিন-কতকের জন্য মেসমেরিজম বন্ধ রাখিবার কথা চাকরকে দিয়া যোগিনীকে বলিয়া পাঠাইলাম। চাকর ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “বাবুকে বলিস, যদি সময় হয় আসিবেন, আমি কোথায়ও যাইব না।”
আমি মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হইয়াছিলাম যে, কিছুতেই যোগিনীর কাছে আজ যাইব না। সন্ধ্যার পূর্ব্বে যদি কেহ বলিত যে, তুমি নিশ্চয়ই যাইবে, আমি তাহার কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিতাম; কিন্তু আমি অতি অপদার্থ, আমি ত কখনই এত দুৰ্ব্বলচিত্ত ছিলাম না। কিরূপে ইহা যে ঘটিল, আমি তাহা জানি না। আমি মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়াছিলাম, অথচ আমি যন্ত্রচালিতবৎ ঠিক সেই সময়ে অসঙ্কোচে যোগিনীর নিকট গিয়া উপস্থিত হইলাম।
বোধ হয়, ইহা অভ্যাসের দোষ—প্রত্যহ গিয়া গিয়া অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল, বোধ হয়, এই অভ্যাসের দোষে আমি আজও তাহার নিকট উপস্থিত হইলাম, অথবা হয় ত অহিফেনে যেমন মানুষের মৌতাত জন্মে, মেসমেরিজমেও তাহাই হয়।
আমি এইমাত্র জানি যে, আমি সন্ধ্যার পর বড়ই চঞ্চল ও অধীর হইয়া উঠিলাম। আমি পড়িতে বা লিখিতে পারিলাম না, কিছুতেই আমার মনকে স্থির করিতে পারিলাম না; তাহার পর আমি কি করিতেছি, জানিবার পূর্ব্বেই আমি ঊর্দ্ধশ্বাসে সেই যোগিনীর নিকটে ছুটিলাম।
আমি যে আজ আসিব না, ভৃত্য দ্বারা বলিয়া পাঠাইয়াছিলাম, আমাকে দেখিয়া সে সম্বন্ধে যোগিনী কোন কথা উত্থাপন করিলেন না; আমি কাল যাহা করিয়াছি এবং তাহার সম্বন্ধে যাহা বুঝিয়াছি, সে সম্বন্ধেও ভাব-ভঙ্গিতে কোন ভাব প্রকাশ করিলেন না—সেই পূর্ব্বের গম্ভীর ভাব। আমি মনে মনে ভাবিলাম, “আমি যাহা ভাবিয়াছি, তাহা আমার সম্পূর্ণ ভুল। এই মেমেরিজমের জন্য আমার মাথা খারাপ হইয়াছে, তাহাই যোগিনী সম্বন্ধে এরূপ অন্যায় ভাবিয়াছি। কি লজ্জার কথা! তাহাকে ক্রোড়ে টানিয়া লওয়ায় তিনিই না জানি, কি মনে করিয়াছেন!
.
১০ই ফেব্রুয়ারী।—না না, আমার ভুল হয় নাই। আমি সহস্র চেষ্টা করিয়াও আর আমার মনকে প্রবোধ দিতে অক্ষম। এখন আমি ধ্রুব নিশ্চিত বুঝিয়াছি, এই স্ত্রীলোক—এই কুহকিনী— এই নামেমাত্র যোগিনী—আমাকে চাহে। আমাকে গ্রাস করিতে চাহে—আমার দেহ মন প্রাণ প্রণয়ানুরাগ সৰ্ব্বস্ব চাহে, কি ভয়ানক—ভাবিতে প্রাণ শিহরিয়া উঠে! কিন্তু আর মনকে চাপা দিয়া রাখিবার উপায় নাই, ইহা ধ্রুব সত্য—ভয়াবহ সত্য!
আজ আমার মেসমেরিজমের পর জ্ঞান হইলে দেখিলাম, আমি তাহার হাত ধরিয়া রহিয়াছি। আমার প্রাণ তাহার জন্য পাগল হইয়া উঠিয়াছে, তাহাকে আদর করিতে, হৃদয়ে লইতে, প্রেমের কথা বলিতে প্রাণ উন্মত্ত হইয়া উঠিয়াছে! মান-সম্ভ্রম, চরিত্র-ভদ্রতা, ধৰ্ম্ম-কৰ্ম্ম আজ সমস্তই এক মুহূর্তে বিলোপ হয়!
এ সকলই আমি বুঝিতেছি, অথচ তাহাকে ছাড়িয়া যাইতে পারিতেছি না। এই কুহকিনী আমার হৃদয়ে পশুত্ব আনিয়া পাপ-প্রবৃত্তি উত্তেজিত করিতেছে, আমি ইহা বেশ বুঝিতেছি, অথচ ইহাকে ছাড়িয়া যাইতে পারিতেছি না। বুঝিতেছি, ইহার কাছে থাকিলে আমার সর্ব্বনাশ হইবে– সব বুঝিতেছি, কিন্তু তবু পলাইতে পারিতেছি না। সেদিন পলাইয়াছিলাম, আজ পলাইতে পারিলাম না। আজ তাহার হাতে হাত রাখিয়া বহুক্ষণ নানা কথা কহিলাম। এমন কি ঊষার কথাও হইল, সে আমার মুখের উপরে অম্লানবদনে ঊষার কত নিন্দা পর্য্যন্ত করিল, আমি তাহাতেও তাহাকে কিছু বলিলাম না। আমার কি ঘোরতর অধঃপতনই হইল!
যদিও আমি বুঝিলাম যে, আমি দিন দিন অতি দুৰ্ব্বল হইয়া পড়িতেছি, তথাপি হৃদয়ে তখনও কতকটা বল ছিল। যাহাতে আর এরূপ না ঘটে, আমি তাহাই করিব। যদি ইহার সহিত আঁটিয়া উঠিতে না পারি, ইহার নিকট হইতে অনায়াসে পলাইয়া আত্মরক্ষা করিতে পরিব। কাল হইতে এ সমস্তই বন্ধ করিব। আর না, আর কখনই না, আর নিমেষের জন্যও ইহার নিকটে যাইব না। আমার বিজ্ঞান চর্চ্চা, আমার আবিষ্কার আমার অনুসন্ধান ও পরীক্ষা সমস্ত অতল সমুদ্রগর্ভে নিমগ্ন হউক, আমি আর এই ভীষণ প্রলোভনের নিকটে যাইব না। ইহাতে আমি পাশুত্বপ্রাপ্ত হইব ব্যতীত আর কিছুই হইব না।
আমি আর কিছুতেই তাহার নিকট যাইব না—না—না—কখনই না।
.
১১ই ফ্রেব্রুয়ারী।—কিছুতেই আজ যোগিনীর কাছে যাইব না। এত বড় বিজ্ঞানচর্চ্চাটা নষ্ট হইবে, উপায় নাই। এই প্রলয়ঙ্করী স্ত্রীলোকের নিকটে আবার যদি আমি যাই, আমার সর্ব্বনাশ হইবে, আমি কখনই আর আত্মসংযম করিতে পারিব না।
কি ভয়ানক! আমার এ কি হইল? আমি কি পাগল হইয়া যাইতেছি? আমার উচিত, সুস্থচিত্তে, ধীরভাবে এই সকল বিষয় আলোচনা করা। যাহা হউক, যাহা ঘটিয়াছে, তাহাই প্রথমে এখানে লিখিয়া রাখি।
সন্ধ্যার পর প্রাণ নিতান্ত অধীর হওয়ায় আমি ঊষার সহিত দেখা করিতে তাহাদিগের বাড়ীতে গেলাম। তাহারা সকলেই বলিল যে, আমার চেহারা দিন দিন বড়ই খারাপ হইয়া যাইতেছে।
ঊষার পিতা দাবা খেলিতে অনুরোধ করিলেন, আমরা উভয়ে দাবা লইয়া বসিলাম, কিন্তু কিছুতেই মনঃস্থির করিতে পারিলাম না, সহসা খেলা বন্ধ করিয়া একটা বিশেষ কাজ আছে, এইরূপ কি একটা বলিয়া উন্মত্তের ন্যায় তাঁহাদের বাড়ী ত্যাগ করিলাম। তাহার পর কি হইল; স্বপ্নের ন্যায় অস্পষ্ট মনে আছে, যেন রাস্তার গ্যাসগুলি সরিয়া সরিয়া আমার দিকে আসিতেছে, সমস্তই অস্পষ্ট, অস্বাভাবিক, স্বপ্নবৎ।
ক্ষণপরে যেন সহসা যোগিনীকে দেখিলাম। যোগিনী আমাকে দেখিয়া মৃদুমধুর হাসিয়া জিজ্ঞাসিল, “আজ এত দেবী?”
তাহার পর কি হইয়াছে, কি বলিয়াছি, কখন বাড়ী ফিরিয়াছি, তাহা ভাল মনে নাই।
.
১২ই ফেব্রুয়ারী।—আজ মস্তিষ্ক আবার পরিষ্কৃত হইয়াছে, এখন আমার হৃদয় ও মনের স্বাভাবিক অবস্থা আসিয়াছে; রাত্রে কি ঘটিয়াছে, তাহা আমি এখন বেশ স্থিরচিত্তে বিবেচনা করিতে পারিতেছি।
পূৰ্ব্বে মনকে প্রবোধ দিয়াছিলাম, আমি যে যোগিনীর কাছে যাই ও যাইবার জন্য ব্যাকুল হই—তাহা অভ্যাসের দোষে—নিজ দুর্ব্বলতার জন্য। এখন এরূপ প্রবোধ-প্রয়োগ বৃথা!
ইহার ভিতর অভ্যাস ও দুর্ব্বলতা ছাড়া আরও একটা কিছু ভয়াবহ ব্যাপার আছে। আমি ঊষার পিতার সহিত যখন দাবা খেলিতেছিলাম, তখন কে যেন আমার গলায় দড়ী বাঁধিয়া টানিয়া এই যোগিনীর কাছে লইয়া আসিয়াছিল, এ দুৰ্ব্বলতা নহে—এ অভ্যাসমাত্র নহে।
কুহকিনী আমাকে হস্তগত করিয়াছে, আমি তাহার করকবলিত হইয়াছি। তাহাই যদি হয়, আমি এখনও সম্পূর্ণ আত্মহারা হই নাই, এখনও আমার বিবেচনাশক্তি আছে, এখন আমার কি করা উচিত তাহাই বিবেচনা করা কর্ত্তব্য।
কিন্তু আমি কি প্রকাণ্ড গাধা! আমি বিজ্ঞানের অনুসন্ধান ও পরিচর্য্যায় উন্মত্ত হইয়া জানিয়া-শুনিয়া বিস্তৃত ভয়াবহ কুহকজালে স্বেচ্ছায় গিয়া পড়িয়াছি।
সে নিজেই এ কথা বলিয়াছিল। সে নিজেই বলিয়াছিল যে, অপরকে তাহার দাসানুদাস করিতে পারে, অপরকে দিয়া সে যাহা ইচ্ছা করিতে পারে, এ ক্ষমতা সে অপরের প্রতি ন্যস্ত করিতে পারে। এখন আমার উপরে সেই ভয়াবহ ক্ষমতা সে লাভ করিয়াছে। এখন আমি এই মায়াবিনীর ক্রীড়নক—দাসানুদাস হইয়াছি। সে যখন ইচ্ছা করিবে, তখনই আমি তাহার নিকট ছুটিব, সে যাহা ইচ্ছা করিবে, আমি তাহাই করিতে বাধ্য হইব। কেবল ইহাই নহে—সে যাহা ইচ্ছা করিবে, আমি মনেও সেইরূপ করিতে বাধ্য হইব। যদ্যপি আমি তাহাকে ভয় করিতেছি, হৃদয়ের সহিত ঘৃণা করিতেছি, কিন্তু তবুও আমি তাহার ইচ্ছায় তাহাকে ভালবাসিতে বাধ্য হইব। আমি আর আমি নই।
তবে এখনও আমার জ্ঞান আছে, এখনও আমার অস্তিত্ব, বল, ইচ্ছা সম্পূর্ণ নষ্ট হয় নাই, এখনও সময় আছে, আমি প্রাণ দিয়াও আত্মসম্মান রক্ষা করিব। পারিব না কি?
.
১৫ই ফেব্রুয়ারী।—পূর্ব্বে যাহা বলিয়াছি—এখন স্থিরচিত্তে দিনের বেলায় তাহা ভাবিয়া দেখিয়া বুঝিতেছি যে, তাহার কোন কথা মিথ্যা নহে। এই স্ত্রীলোক আমাকে করকবলিত করিয়াছে।
তবে এখনও আমার বিবেচনাশক্তি আছে, আমি এখনও তাহাকে পরাভূত করিতে পারি। আমি মস্তিষ্কবিহীন জড়পদার্থ নহি। আমার সাহস, শক্তি, বুদ্ধি আছে। এই দানবীর যতই ক্ষমতা হউক না কেন, আমি তাহাকে পরাস্ত করিব, তাহার কুকার্য্যের প্রতিফল দিব। এতদ্ব্যতীত দ্বিতীয় উপায় নাই, নতুবা আমার কি অবস্থা হইবে, ভাবিলে প্রাণ শিহরিয়া উঠে।
স্থিরচিত্তে ভাবিয়া দেখি, এই স্ত্রীলোক তাহার সর্ব্বনেশে বশীকরণ বিদ্যার বশে আমার দেহের উপর আধিপত্য বিস্তার করিয়া আছে। যেমন কতকগুলি ভয়াবহ কীট অন্য প্রাণীর অঙ্গে আশ্রয় করিয়া তাহার দেহের রক্তশোষণ করিতে থাকে, সেইরূপ এই স্ত্রীলোক তাহার বীভৎস কীটরূপী আত্মাকে আমার দেহে সংযুক্ত করিয়া দিতে পারে, তাহার পরে আমার দেহের উপর সম্পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করিতে পারে এবং আমাকে দিয়া ইচ্ছামত যে কোন কার্য্য করাইয়া লইতে পারে। আমি এ অবস্থায় ক্ষমতাবিহীন, যন্ত্রচালিত পুত্তলিকা মাত্র, এ অবস্থায় আর কি করিতে পারি?
যে ক্ষমতার সহিত এখন আমার এই সংঘর্ষ উপস্থিত, সে সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না— সম্পূর্ণই অনভিজ্ঞ। তাহার উপর আমার যাহা হইয়াছে তাহা আমি কাহাকেও বলিতে পারি না। কালেজের কর্তারা শুনিয়া বলিবে, তাহাদের উন্মত্ত শিক্ষকের প্রয়োজন নাই।
ঊষা! প্রাণ থাকিতে এ কথা তাহাকে বলিতে পারিব না। আমাকে গোপনে একাকী এ কষ্ট সহ্য করিতে হইবে—এই মায়াবিনীর সহিত যুদ্ধ করিতে হইবে—ইহার সুদৃঢ় বন্ধন ছিন্ন করিয়া মুক্ত হইতে হইবে।
এই মায়াবিনী তাহার ক্ষমতা সম্বন্ধে যাহা যাহা বলিয়াছিল, তাহা সমস্ত স্মরণ করিয়া মনে মনে আলোচনা করিতে লাগিলাম। সে বলিয়াছিল, “যখন কোন ব্যক্তির উপর সম্পূর্ণ ক্ষমতা বিস্তার করা না যায় তখন সে কি করিতেছে, তাহা জানিতে পারে, তবে আদেশ অস্বীকার করিবার ক্ষমতা তাহার কখনই থাকে না। স্বজ্ঞানে—ইচ্ছা না থাকা সত্বেও–সেই আদেশ পালন করিতে বাধ্য হয়। কিন্তু যখন কাহারও প্রতি সম্পূর্ণ ক্ষমতা বিস্তার করা যায়, তখন আর কোন জ্ঞান থাকে সে সম্পূর্ণ নিঃসংজ্ঞ অবস্থায় কার্য্য করিতে থাকে।
ইহাতে আমি বুঝিলাম, সে এখনও আমার উপর সম্পূর্ণ ক্ষমতা বিস্তার করে নাই, কারণ এ পৰ্য্যন্ত আমি যাহা করিয়াছি, তাহা অনিচ্ছাসত্বেও কেবল করিয়াছি, কেবল শেষের দিন পূর্ণ জ্ঞান ছিল না—কতকটা অজ্ঞান অবস্থায় করিয়াছিলাম। হায়! আমার মত এ সংসারে আর কেহ কি এতখানি বিপন্ন হইয়াছে!
আর একজনের কথা সহসা মনে পড়িল। ডাক্তার করুণাকান্ত পূর্ব্বে আমাকে সাবধান করিয়াছিলেন; তাঁহার কথা যদি শুনিতাম তাহা হইলে এই কুহকিনী আমাকে এমন বিপদে ফেলিতে পারিত না। নিশ্চয়ই ডাক্তারবাবু ইহা বুঝিয়া পূৰ্ব্ব হইতে সাবধান করিয়া আমাকে রফা করিয়াছিলেন। আমি আজই তাঁহার সহিত দেখা করিব। তাঁহার কথা শুনি নাই বলিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিব। দেখি, তিনি যদি কোন ভাল পরামর্শ দিতে পারেন।
.
২০শে ফেব্রুয়ারী।—না—করুণাকান্ত বাবুকে কিছুই খুলিয়া বলিতে পারিলাম না। প্রথম দুই-একটা কথা বলায় তিনি এত বিস্মিত হইলেন যে আমি আর বেশীদূর অগ্রসর হইতে সাহস করিলাম না।
তবে কথায় কথায় বুঝিলাম যে, তিনি কখনও এই যোগিনী বশীকরণের ভিতরে আসেন নাই—তবে এই যোগিনীর ভাব-ভঙ্গি দেখিয়া ইহাকে চরিত্রহীনা বলিয়া জানিয়াছিলেন—এইমাত্র; তাহার জন্য তিনি ওই যোগিনীর কাছে যান নাই।
আমি মনে মনে ভাবিলাম, তিনি কি বাঁচাই বাঁচিয়া গিয়াছেন! নতুবা তাঁহারও আমার মত দুৰ্দ্দশা ঘটিত। আমি কি এ জীবনে এ মায়াবিনীর মায়াজাল ছিন্ন করিতে পারিব? আমি কি আর সেই পূর্ব্বের আমি হইতে পারিব?
এখন আমার কি করা উচিত? এখন আমি ছুটি পাইব না? ছুটি পাইলে পশ্চিমে বেড়াইতে যাইতাম, যোগিনীর নিকট হইতে পলাইতাম।
কিন্তু পশ্চিমে পলাইলেই কি ইহার হাত হইতে পরিত্রাণ পাইব? পশ্চিম হইতেও এই কুহকিনী আমাকে কি টানিয়া আনিতে পারিবে না? কতদূর পর্য্যন্ত ইহার ক্ষমতা, তাহা আমি জানি না; তবে আমি ইহার এই অলৌকিকী ক্ষমতার সহিত যুদ্ধ করিতে পারি, এই মাত্র—আর কি করিতে সক্ষম? আমি জানি, সন্ধ্যার পর ইহার নিকট যাইবার জন্য আমার দুর্দমনীয় ব্যাকুলতা জন্মিবে; তখন কিরূপে আমি আত্মসংযম করিব, কিরূপে মন হইতে এই উন্মত্ত ইচ্ছাকে দূর করিব?
যাহাতে কোনরূপে আমি এই ঘর হইতে বাহির হইতে না পারি আমি তাহাই করিব। আমি দরজার চাবী বন্ধ করিয়া চাবী জানালা দিয়া বাহিরে দূরে ফেলিয়া দিব, তাহা হইলে আমি কিছুতেই এ ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইতে পারিব না!
এ মন্দ যুক্তি নহে। তাহার পর কাল সকালে বাহির হইব কিরূপে—কালকের কথা কাল হইবে–প্রাণ থাকিতে এ যোগিনীর নিকটে আমি যাইব না।
.
২১ শে ফেব্রুয়ারী।—আমারই জয় হইয়াছে। কাল সন্ধ্যার পূর্ব্বেই আমি আহারাদি সমাধা করিয়া আমার ঘরের চাবী বন্ধ করিয়া চাবী জানালা দিয়া নিম্নে বাগানে ফেলিয়া দিয়াছিলাম। তাহার পর একখানা বই লইয়া পড়িতে বসিলাম। কখন সেই উন্মত্ত ব্যাকুলতা আসিবে তাহা ভাবিয়া সর্ব্বদাই আমার প্রাণ কাঁপিয়া উঠিতে লাগিল! কিন্তু সেরূপ সে ভাব আদৌ ঘটিল না। রাত্রে সুনিদ্রা হইল, কখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম জানি না।
বোধ হয়, যোগিনী বুঝিতে পারিয়াছে যে, আমি কি করিয়াছি, বুঝিয়া যে আর চেষ্টা করা বৃথা, তাহাই আর কোন চেষ্টা পায় নাই। যাহাই হউক তাহাকে হারাইয়া দিয়াছি—যখন একবার তাহাকে পরাস্ত করিতে পারিলাম তখন আবার কেন পারিব না?
সকালে চাবীটার জন্য একটু বিপদে পড়িলাম; তবে বাগানের একটা কোণে আমি কোন রকমে হঠাৎ চাবীটা ফেলিয়া দিয়াছি সে চাবী ঘরের ভিতরে ফেলিয়া দিলে আমি দরজা খুলিয়া বাহির হইতাম। তারপর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলাম, যদি আমাকে সমস্ত দরজা জানালার পেরেক মারিয়া বন্ধ করিয়া দিতে হয়—যদি পাঁচ-সাত জন বলবান লোককে আমায় ধরিয়া রাখিবার জন্য মাহিনা করিয়া রাখিতে হয়, আমি তাহাও করিব, কিছুতেই আর এই কুহকিনীর হাতে যাইব না।
ঊষার পিতা আমাকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছেন; সুতরাং আমি স্পন্দিত বক্ষে তাঁহার সহিত দেখা করিতে চলিলাম। অসময়ে এ আহ্বান কেন? না কোন কুসংবাদ নাই। আমার সর্ব্বদাই এখন ভয় হয়—মনে হয় সকলেই আমার শোচনীয় অবস্থার কথা জানিতে পারিয়াছে।
ঊষার পিতা বলিলেন, “আমি বিশেষ কাজে দিন-কতকের জন্য দেশে যাইতেছি—আজই রওনা হইব। ফিরিয়া আসিলে বিবাহ হইবে।”
ঊষার পিতা ক্ষণপরে চলিয়া গেলে আমি ঊষাকে বলিলাম, “তোমাকে একটা বিশেষ অনুরোধ করি, এই যোগিনীকে কখনও তোমায় ভুলেও মেস্মেরাইজ করিতে দিও না।”
ঊষা একটু বিস্মিতভাবে আমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, “সে কি? তুমিই সেদিন বলিতেছিলে যে, তুমি ইহার শেষ পর্যন্ত না দেখিয়া ক্ষান্ত হইবে না।”
আমি বলিলাম, “হাঁ বলিয়াছিলাম বটে, কিন্তু এখন আমার মতের পরিবর্তন ঘটিয়াছে।”
“তাহা হইলে তুমিও নিরস্ত হইবে?”
“নিশ্চয়ই।”
“যথার্থই আমি বড় খুসী হইলাম। তোমার চেহারা যে কত খারাপ হইয়া গিয়াছে, তাহা তুমি জান না; এ সব ভাল নয়।”
“এখন আমিও তাহাই বিবেচনা করিতেছি।”
“ইহাতে যোগিনীরও অনিষ্ট হইয়াছে। তোমাকে মেস্মেরাইজ করিতে গিয়া তিনিও পীড়িত
হইয়া পড়িয়াছেন।”
“তিনি পীড়িত হইয়াছেন।”
“হাঁ, কাল রাত্রি হইতে তাঁহার জ্বর হইয়াছে।”
ঊষা প্রতিশ্রুত হইল যে, সে আর কখনও মেসমেস্মেরাইজড্ হইবে না। যোগিনীর উপর তাহার বিসদৃশ ঘৃণা আছে। ইহা শুনিয়া আমি সন্তুষ্ট হইলাম, কিন্তু যোগিনীর পীড়ার কথা শুনিয়া আমি অধীর হইলাম।
তাহা হইলে কাল রাত্রে সে পীড়িতা ছিল, তাহাই হয় ত সে আমার উপর ক্ষমতা চালাইতে পারে নাই। সে নিজেই বলিয়াছে যে, স্বাস্থ্য ভগ্ন হইলে তাহার ক্ষমতারও হ্রাস হয়। বোধ হয়, এইজন্যই কাল আমি ইহার হাত হইতে রক্ষা পাইয়াছি। নিজের গৃহে সুনিদ্রা উপভোগ করিতে পারিয়াছি।
যাহাই হউক, আজ রাত্রেও আমি কাল রাত্রের ন্যায় দরজার চাবী বন্ধ করিয়া চাবী ফেলিয়া দিব, তাহা হইলে আমি আর কিছুতেই বাহির হইয়া তাহার নিকট যাইতে পারিব না।
আমি এই যোগিনীর ভয়ে বালকেরও অধম হইয়া পড়িয়াছি। একি শোচনীয় দুৰ্দ্দশা!
.
২৫ শে ফ্রেব্রুয়ারী।—কাল রাত্রেও কোন গোলযোগ ঘটে নাই! আমি একবারও যোগিনীর কাছে যাইবার জন্য কোনরূপ ব্যাকুলতা অনুভব করিলাম না। রাত্রে সুনিদ্রার পর প্রাতে উঠিয়া মালীকে চাবী দিতে বলিলে সে এমনই ভাবে আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল যে, আমি ভাবিলাম, এরূপ আর চাবি ফেলিলে ক্রমে আমার ভৃত্যগণ আমাকে পাগল স্থির করিবে।
যাহাই হউক, আমি বুঝিলাম যে, আমি এই সয়তানীর হাত হইতে ক্রমশ মুক্তিলাভ করিতেছি, তবে সে অসুস্থ হইয়াছে, সুস্থ হইলে সে যে কি করিবে, তাহা বলা যায় না। ভগবানকে মনে মনে ডাকিয়া বলিলাম, “প্রভো! ইহার হাত হইতে আত্মরক্ষা করিবার জন্য আমার হৃদয়ে উপযুক্ত বল দাও।”
আমি মনে মনে বুঝিলাম, এই স্ত্রীলোক যে ক্ষমতার চালনা করিতেছে, তাহা কোন এক প্রাকৃতিক শক্তি ব্যতীত আর কিছুই নহে। সে শক্তি পৈশাচিক বল বলিয়া বিশ্বাস করি না, তবে এই ক্ষোভ যে, ইহার মূলতত্ত্ব কেহ জানে না। হয় ত ইহার বিষয় সমস্ত পর্যালোচনা করিয়া আমি এই শক্তিকে দমনে রাখিবার উপায়ও আবিষ্কার করিতে পারিতাম; কিন্তু ক্ষুধার্ত্ত ব্যাঘ্রের থাবার নিম্নে পড়িয়া কেহ যে সেই ব্যাঘ্রকে বশে আনিতে চেষ্টা করে না। নিজের অব্যহতির জন্যই সকলে আগে চেষ্টা করে।
যাহাই হউক, আজ রাত্রে যে একটা কিছু ঘটিবে, ইহা আমার মন বলিতে লাগিল। আমি শুনিলাম, যোগিনী আরাম হইয়াছে। তবে দুর্ব্বল আছে; যে কারণেই হউক, আমার মনে হইল, আজ রাত্রে সে তাহার ক্ষমতা আমার উপর চালাইতে চেষ্টা পাইবে, সেইজন্য আমিও পূর্ব্বরূপ সাবধান থাকিবার জন্য অদ্য মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়া রহিলাম।
.
২৬শে ফেব্রুয়ারী।—না, ঈশ্বরের অনুগ্রহে কাল কিছু ঘটে নাই। আমি এবার আর সেই মালীকে ডাকিয়া চাবী দিতে বলিতে সাহস পাইলাম না। সেইজন্য রাত্রে চাবী বন্ধ করিয়া চাবীটা দরজার ফাক দিয়া বাহিরে ফেলিয়া দিয়াছিলাম। সকালে অপর ভৃত্য চাবী ভিতরে দিলে আমি বাহির হইয়া আসিলাম।
কিন্তু আমার এত সাবধান হইবার কোন আবশ্যকতা ছিল না। ঘরের মধ্যে কোন সময়েই যোগিনীর নিকট যাইবার জন্য আমার আদৌ কোন ব্যাকুলতা জন্মে নাই!
কয়দিন উপর্যুপরি আমি গৃহে আছি; যোগিনীর নিকট যাই নাই। নিশ্চয়ই আমার বিপদ কাটিয়া গিয়াছে! বিশেষতঃ দুই-এক দিনে শশধর ফিরিয়া আসিবে, সে আসিলে আমার তত ভয় থাকিবে না! তাহার সম্মুখে যোগিনী আর এরূপ কদর্য্য ব্যাপার সংঘটন করিতে সাহস করিবে না।
শশধরকে সকল কথা খুলিয়া বলা উচিত কি না, তাহাই আমি ভাবিতে লাগিলাম। শেষে স্থির করিলাম, “না তাহাকে বলিতে পারিব না; বলা উচিত নহে; সে হয়ত ভাবিবে, আমি উন্মত্ত হইয়াছি, না হয় আমি ঘোরতর মিথ্যাবাদী। যাহাই হউক, আমার মন এখন অনেক সুস্থ, শান্তিপূর্ণ। আমি বুঝিয়াছি যে, যোগিনীর ক্ষমতা আমার উপরে আর নাই, তাহা হইলে ভগবান আমাকে তাহার হাত হইতে রক্ষা করিয়াছেন। ইহা অপেক্ষা আমার বর্তমান জীবনে আর অধিক আনন্দ কি হইতে পারে?
আমার সকলই আছে, ধন আছে, মান আছে, যশঃ অছে, লোকে সংসারে যাহা চাহে, তাহার সমস্তই আমার আছে; বিবাহ করিয়া আমি পরম সুখী হইব, মনে মনে কত আশা ভরসা, এই সমস্তই আমার নষ্ট হইয়া যাইতেছিল—ভাবিলে প্রাণ শিহরিয়া উঠে। আমার সবই আছে, কেবল এক বিষয়েই আমার সর্ব্বনাশ সাধিত হইতেছে—সে কি ভয়াবহ বিষয়!
.
২৭শে ফেব্রুয়ারী।—আমি নিশ্চয়ই পাগল হইব। ইহাই দেখিতেছি আমার শেষ পরিণাম দাঁড়াইবে! পাগল হইতে আমার আর অধিক বিলম্ব নাই। শয়নকালে হাতের উপর মাথা রাখিলে স্পষ্ট বুঝিতে পারি, আমার মাথার ভিতরে দপ্ দপ্ করিতেছে। এক একবার আমার সর্ব্বাঙ্গ কম্পিত হইতেছে। কি ভয়ানক রাত্রিই আমি অতিবাহিত করিয়াছি! এখন আমার সন্তুষ্ট হইবারও যথেষ্ট কারণ আছে।
ভৃত্যদিগের নিকট হাস্যাস্পদ হইতেছি, বুঝিয়াও আমি রাত্রে চাবী বন্ধ করিয়া চাবী বাহিরে ফেলিয়া দিলাম। তখনও অধিক রাত্রি হয় নাই দেখিয়া আমি একখানা পুস্তক লইয়া পড়িতে আরম্ভ করিলাম।
সহসা কে যেন আমাকে সবলে ধরিল—সবলে টানিল, আমি শয্যা হইতে উঠিলাম। যে ভয়ঙ্করী শক্তি আমাকে গ্রাস করিল, তাহার বর্ণনা হয় না। আমি সবলে বিছানার চাদর বিছানা জড়াইয়া ধরিলাম, আমি কক্ষ প্রাচীর ধরিবার চেষ্টা পাইলাম; বোধ হয়, উন্মত্তের মত আমি একবার চীৎকার করিয়াও উঠিলাম। কিন্তু সকলই বৃথা, আশা নাই, শক্তি নাই, কে যেন সবলে আমায় টানিয়া লইয়া যাইতেছে। আমি যাইব, আমাকে যাইতে হইবে, কিছুতেই আত্মরক্ষা করিতে পারিলাম না! এই দৈবকী শক্তির হাত হইতে রক্ষা পাইবার কোন উপায় নাই—হায় আমার কি হইল!
প্রথমে আমি এই শক্তির বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইয়াছিলাম, কিন্তু এই শক্তি ক্রমে এত প্রবল হইল যে, আমি তাহার নিকট সম্পূর্ণ পরাভূত হইলাম।
সৌভাগ্যের বিষয়, কেহ আমার এ অবস্থা দেখিতেছিল না, নতুবা আমি যে কি করিতাম, তাহা বলিতে পারি না! কেবল যে ঘর হইতে বাহির হইবার জন্য আমি উন্মত্ত হইয়া উঠিয়াছিলাম, তাহা নহে। কিরূপে কি উপায়ে দরজা খুলিতে পারি, তাহার বিষয়ও বিশেষরূপ চিন্তা করিতে লাগিলাম।
একটা ছুরি আনিয়া, দরজা ফাঁক করিয়া চাবীটা টানিয়া আরেকবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। বহুকষ্টে অবশেষে চাবী হাতের নিকট আসিলে আমি ব্যগ্রহস্তে চাবী তুলিয়া লইয়া দরজা খুলিয়া ফেলিলাম। তাহার পর বাক্স হইতে আমার নিজের একখানা ফটো ছবি লইয়া তাহাতে ঠিকানা লিখিয়া পকেটে রাখিলাম, তখনই শশধরের বাড়ীর দিকে ছুটিলাম।
তাহার পর যাহা ঘটিল, তাহা আমার স্বপ্নের মত বোধ হইল। আমি স্পষ্ট বুঝিলাম, আমার দেহে দুইটি মনের কার্য্য হইতেছে। অপরের একটা মহা শক্তিশালী মন আমার দেহে অধিকার করিয়া তাহাকে দাসানুদাসের ন্যায় চালাইতেছে, আমার নিজের মন তাহার পার্শ্বে ভীতভাবে ক্ষীণতর শক্তিতে তাহার কার্য্যের প্রতিবন্ধক দিতে চেষ্টা পাইতেছে।
আমার নিজের মন নাই বলিলেই হয়, অপরের মন আমার দেহকে সম্পূর্ণ অধিকার করিয়াছে। আমি ইহা বেশ উপলব্ধি করিতেছি, কিন্তু কিরূপে পথ দিয়া গিয়া শশধরের বাটীতে প্রবেশ করিয়াছি, তাহা আমার কিছুমাত্র মনে নাই।
কিন্তু যোগিনীর কথা আমার ঠিক মনে আছে; দেখিলাম, সে খাটের উপর অর্দ্ধশায়িত অবস্থায় উপবিষ্ট আছে, একখানা কম্বলে তাহার অর্দ্ধাঙ্গ আবৃত, আমায় গৃহমধ্যে প্রবেশ করিতে দেখিয়া সে মৃদুহাস্যে উঠিয়া বসিল। আমি দেখিলাম, তাহার মুখ পাংশুবর্ণ হইয়া গিয়াছে, তাহার চক্ষু বসিয়া গিয়াছে, সে অনেক শীর্ণ হইয়া গিয়াছে।
সে দক্ষিণ হস্ত দিয়া তাহার সম্মুখস্থ একখানি চেয়ারে আমায় বসিতে বলিল। বলিতে লজ্জা করে, আমি তাহার সেই হাতখানি দুই হাতে ধরিয়া পুনঃপুনঃ তাহা চুম্বন করিলাম।
তখনও আমি তাহার হাত ছাড়িলাম না, তাহার পার্শ্বে বসিয়া তাহাকে আমার ছবিখানা দিলাম, তাহার পর কত কথাই কহিলাম, কত প্রেমের কথা, কত ভালবাসার কথা বলিলাম। তাহার অসুস্থতায় আমি কত দুঃখিত হইয়াছি, তাহার একটু সুস্থতায় আমি কতখানি আনন্দিত হইয়াছি। তাঁহাকে একদিন না দেখিতে পাইলে আমি পাগল হইয়া উঠি, এই রকম আরও কত রকম প্রেমের কথা বলিলাম।
সে তাহার সেই মৃদু মধুর হাসি হাসিতে লাগিল, একবার আমার মাথাটা তাহার বুকের কাছে লইয়া সযত্নে আমার কেশ সজ্জিত করিয়া দিল। আমার হৃদয় অতীব আনন্দে পূর্ণ হইয়া গেল, আমার সর্ব্বাঙ্গ বারংবার রোমাঞ্চিত হইল। আমি তাহার দাসানুদাস—তাহার ক্রীতদাস— তাহার খেলার পুত্তলি হইয়াছি, কিন্তু সে সময়ে আমি ইহাতে পরম আনন্দ উপলব্ধি করিতে লাগিলাম।
ভগবানের কৃপায় এই সময়ে সহসা আমার মনের পরিবর্তন ঘটিল। ভগবান্ যে নাই, এ কথা যে বলে, সে অন্ধ। আমি নরকস্থ হইতেছিলাম, আর এক মুহূৰ্ত্ত; এই সময়ে ভগবান্ আমার সহায় হইলেন। তিনিই আমাকে নরকের পথ হইতে ফিরাইয়া আনিলেন। তাহা হইলে এই পিশাচী, এই সয়তানীর পৈশাচিক শক্তির বিরুদ্ধে এক মহতী শক্তি উদিত হওয়ায় আমার হৃদয় আনন্দে পূর্ণ হইয়া গেল।
আমি তাহার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, তাহারও মুখের একটা পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে— তাহার মুখ পূর্ব্বে পাংশুবর্ণ ছিল—এক্ষণে ঠিক মৃতের মুখের ন্যায় হইয়াছে। তাহার সেই লীলাচঞ্চল চক্ষুদ্বয়ে সে দীপ্তি নাই—তাহার চক্ষুঃ এখন অৰ্দ্ধ নিমীলিত হইয়া আসিয়াছে। তাহার মুখে আর পূর্ব্বের সে দৃঢ় তেজঃপূর্ণ ভাব নাই! তাহার মুখ অতীব বিষণ্ণ। তাহার ভ্রূ কুঞ্চিত। তাহার মুখে ভীতির ভাব—সে কি করিবে কিছুই স্থির করিতে পারিতেছে না। তাহার মুখ দেখিয়া এই সকল আমি সুস্পষ্ট উপলব্ধি করিতে পারিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বুঝিলাম, ধীরে ধীরে তাহার শক্তি হইতে—তাহার হাত হইতে আমি মুক্ত হইতেছি। ক্রমে ক্রমে ধীরে ধীরে আমার নিজ মন নিজের অধিকার লাভ করিতেছে।
সে কাতরে বলিল, “ধীরেন্দ্র—ধীরেন্দ্রবাবু! আমার শরীরে যাহা সহে না, আমি তাহাই চেষ্টা করিয়াছি। আমি এখনও বড় দুর্ব্বল রহিয়াছি, আমার জ্বর এখনও যায় নাই। কিন্তু আমি তোমাকে না দেখে আর থাকিতে পারি না, আমায় ছেড়ে যেয়ো না। এখনই আমার এ দুর্ব্বলতা যাইবে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমি সুস্থ হইব। আমার ঐ কমণ্ডল আমার কাছে এনে দাও, প্রিয়তম, তুমি আমার—”
কিন্তু আমি এখন নিজের মধ্যে নিজেকে ফিরাইয়া পাইয়াছি। তাহার দুর্ব্বলতার জন্য আমি আমার স্বাধীনতা লাভ করিয়াছি! আমি আর তাহার অনুগত নই, তাহার উপর ক্রোধে আমার সৰ্ব্বাঙ্গ প্রকম্পিত হইতেছিল। অন্ততঃ আজ আমি তাহার সম্বন্ধে যাহা ভাবি, তাহা তাহার মুখের উপর বলিতে পারিব। তাহার প্রতি যেমন একটু পূর্ব্বে দুৰ্দ্দমনীয় ভালবাসায় হৃদয় পূর্ণ হইয়াছিল। এক্ষণে সেইরূপ ভয়াবহ ঘৃণায় আমার হৃদয় পূর্ণ হইল। আমি তাহার ত্রিশূল লইয়া তাহার বক্ষে বিদ্ধ করিতে ব্যাকুল হইলাম।
সে ভয়ে দুই হাতে বুক চাপিয়া শয্যায় সরিয়া বসিল, অর্দ্ধস্ফুট স্বরে বলিল, “ক—ম—ণ্ড–লু, ক—ম—ণ্ড–লু–”
আমি উন্মত্তের ন্যায় কমণ্ডলু তুলিয়া লইয়া জানালা দিয়া দূরে নিক্ষেপ করিলাম, তাহার পর আমার সেই ছবিখানি তাহার হস্ত হইতে কাড়িয়া লইয়া শতখণ্ডে ছিন্ন করিয়া আগুনে জ্বালাইয়া দিলাম।
ইহাকে আর কিছু বলা উচিত নহে ভাবিয়া, আমি বলিলাম, “এখন আমার শরীর বড় অসুস্থ অন্য সময়ে এ বিষয় আলোচনা করিব।”
এই বলিয়া অনেক কষ্টে তাহাকে বিদায় করিলাম। তাহাকে আমার কথা বলাও যাহা, আর বাজারে ঢাক বাজাইলেও তাহাই। লোকে শুনিলে কেহ আমার প্রতি সহানুভূতি, প্রকাশ করিবে না। আমি সকলের নিকট হাস্যাস্পদ হইব মাত্র।
১লা মার্চ।—কাল আর কিছুই ঘটে নাই, শাস্তিতেই নিদ্রা যাইতে পারিয়াছি। শশধর ফিরিয়া আসায় আমি অনেকটা নিৰ্ভয় হইয়াছি? তাহার সম্মুখে সে কখনই নির্লজ্জ হইয়া এতটা সাহস করিবে না। বিশেষতঃ আমি তাহাকে যাহা মুখের উপর বলিয়াছি, তাহাতে সে আমাকে ঘৃণা না করিয়া কখনই আর ভালবাসিতে পারিবে না। না—আমার বিশ্বাস, এবার আমি তাহার হাত হইতে রক্ষা পাইয়াছি, তবে তাহার প্রতিহিংসা! তাহার ঘৃণা! সে কি চুপ করিয়া থাকিবে—সে চুপ করিয়া থাকিবার পাত্রী নহে—সে আমাকে বিশেষরূপে জব্দ করিবার চেষ্টা পাইবে।
না—আমি ছায়া দেখিয়া ভয় পাইতেছি কেন? আমি তাহার কথা একেবারেই ভুলিয়া যাইব—তাহা হইলেই সকল গোলযোগ মিটিবে।
২রা মার্চ।—আমার শরীর মন মস্তিক—সমস্তই ঠিক পূৰ্ব্বাবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছে? আমার এখন বিশ্বাস হইয়াছে যে, আমি এই সয়তানীর হাত হইতে রক্ষা পাইয়াছি!
কিন্তু এখনও আমার সন্দেহ ও ভয় যায় নাই। সংবাদ পাইয়াছে। যোগিনী আরোগ্য প্রাপ্ত হইয়াছে। আবার পূর্ব্বের ন্যায় সবল হইয়াছে।
এখন সে কি করিবে?
৩রা মার্চ।—আমার ইচ্ছা, আমি এখান হইতে পলাইয়া যাই—প্রকৃতই এই স্ত্রীলোকের ভয়ে আমি সৰ্ব্বদা সশঙ্ক রহিয়াছি। কালেজের ছুটি হইলেই এখান হইতে পলাইব। আমার অনিচ্ছাসত্বেও আমি আবার তাহার সহিত দেখা করিয়াছি—কথা কহিয়াছি।
আমি প্রাতে আমার গৃহমধ্যে বসিয়া একখানা পুস্তক পাঠ করিতেছি, এই সময়ে আমার ভৃত্য গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল—তাহার পশ্চাতে একটা ঠক্ ঠক্ শব্দ হইল—সহসা আমার প্রাণ কাঁপিয়া উঠল—এ ত যোগিনীর সেই ত্রিশূলের শব্দ। আমি কি করিব স্থরি করিবার পূর্ব্বে সে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল।
আমি তাহাকে অভ্যর্থনা করিলাম না, কোন কিছু করিবার ক্ষমতা আমার ছিল না। আমি স্তম্ভিত প্রায় তাহার দিকে চাহিয়া রহিলাম।
সে নীরবে আমার দিকে চাহিল, কোন কথা কহিল না—কিন্তু সেরূপ ভীষণ দৃষ্টি আমি এ জীবনে আর কখনও দেখি নাই! মনে হইল, সে দৃষ্টি আমার হৃদয়ের অভ্যন্তর পর্য্যন্ত ভেদ করিয়া অগ্রসর হইতেছে।
সে বহুক্ষণ নীরবে থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিল, “যে দিন আমাদের শেষ দেখা-সাক্ষাৎ হইয়াছিল, সেদিন তোমার যেরূপ মনের ভাব ছিল, এখনও কি তাহাই আছে?”
আমি কম্পিতস্বরে বলিলাম, “বরাবরই আমার মনের ভাব এক রকম।”
যোগিনী বলিল, “ধীরেন্দ্রবাবু, আমাদের উভয়ের উভয়কে পরস্পর বুঝা ভাল–আমার সহিত যাহা-তাহা করা সহজ ও নিরাপদ নহে, তাহা বোধ হয়, তুমি এত দিনে বেশ বুঝিতে পারিয়াছ। তুমিই স্বেচ্ছায় আমার কাছে বশীকরণ শিক্ষা করিতে চাহিয়াছিলে, তুমিই প্রথমে আমাকে ভালবাসার কথা বলিয়া আমার মনঃপ্রাণ চুরি করিয়াছিলে—তুমিই স্বেচ্ছায় প্রেমের কথা লিখিয়া তোমার ছবি আমাকে উপহার দিয়াছিলে, তুমিই স্বেচ্ছায় আমাকে হৃদয় দিয়াছিলে, আবার তুমিই সে রাত্রে আমাকে যথেষ্ট অপমান করিয়াছ। যাহা কেহ কখনও আমাকে বলিতে সাহস করে নাই, তাহা তুমি আমাকে বলিয়াছ। বল যে, রাগের মাথায় হঠাৎ বলিয়া ফেলিয়াছিলে, আমি তাহা হইলে আর কিছুই মনে করিব না—সে সমস্তই ভুলিয়া যাইব। প্রিয়তম, বল—একবার বল, তুমি যাহা বলিয়াছিলে, তাহা তোমার মনের কথা নহে—তুমি যথার্থই আমাকে ভালবাস।”
আমি হৃদয় পাষাণে বাঁধিয়াছিলাম, আমি অতি দৃঢ়ভাবে বলিলাম, “যদি আমি কখনও তোমায় ভালবাসা দেখাইয়া থাকি, তাহা হইলে তুমি বেশ জান যে, তা সমস্তই তুমি আমাকে দিয়া করাইয়াছ। আমি স্বেচ্ছায় কিছুই করি নাই। সেদিন রাত্রে যাহা বলিয়াছি, তাহাই কেবল সত্য, তাহাই কেবল আমার নিজের কথা! আর সব তোমারই কাণ্ড।”
যোগিনী গম্ভীরকণ্ঠে কহিল, “হাঁ, আমি জানি, কেহ তোমার নিকট আমার বিরুদ্ধে অবশ্যই কিছু বলিয়াছিল। যাহা হউক তুমি জান যে, আমি এই মুহূর্ত্তে কুকুরের মত আবার তোমাকে আমার পদানত করিতে পারি। সেদিন যে দুর্ব্বলতা হইয়াছিল, আর তাহা হইতেছে না। সাবধান! তুমি জান না—তুমি কতদূর আমার মুঠার ভিতরে আসিয়াছ।”
আমি কোন উত্তর না দিয়া মুখ ফিরাইলাম। সে কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া কঠিনকণ্ঠে বলিল, “আমি তোমাকে আমার ভালবাসা, হৃদয়, দেহ, জীবন, যৌবন সমস্তই অযাচিত ভাবে দিতেছিলাম। তুমি সে সকলের প্রতি ঘৃণা করিয়াছ—উপেক্ষা করিয়াছ—দেখি তবে কত দূর হয়—তুমি হাসিতেছ—কিন্তু এমন একটা সময় আসিবে, যখন তুমি আর্তনাদ করিতে করিতে আমার শ্রীচরণে লুণ্ঠিত হইতে থাকিবে, তোমার অহঙ্কার সমূলে নিৰ্ম্মল হইবে, অধিক কি—তুমি কুকুরের মত আমার পদশব্দের অনুসরণ করিবে; তখন বুঝিবে, আমাকে প্রাণের সখারূপে পাইয়াও পরম শত্রুতে পরিণত করিয়া কি একটা ভয়াবহ ভুল করিয়াছ, আর সেই ভুলের পরিণামও কি ভয়ানক — সাবধান— সাবধান! “
কথা শেষ হইবার পূৰ্ব্বেই সে গৃহ হইতে বাহির হইয়া গেল। আমি স্তম্ভিত প্রায় তথায় দণ্ডায়মান থাকিয়া তাহার ত্রিশূলের সেই ঠক্ ঠক্ শব্দ শুনিতে লাগিলাম।
সে চলিয়া গেল বটে, কিন্তু আমার হৃদয়ে সে যেন কি এক বিষম গুরুভার ন্যস্ত করিয়া গেল। ভবিষ্যতে আমি কোন মহা ভয়াবহ বিপদে পড়িব, ইহাই মনে সৰ্ব্বদা উদিত হইতে লাগিল। আমি মনকে নানারূপে বুঝাইতে চেষ্টা পাইলাম, কিন্তু বৃথা। আমি কি করিব, কোথায় যাইব, আমার আত্মা, আমার দেহ আর আমার নাই; এই কুহকিনী—এই মায়াবিনী যখন ইচ্ছা আমার আত্মাকে আমার দেহ হইতে দূর করিয়া দিয়া আমার দেহ সম্পূর্ণ অধিকার করিয়া আমাকে দিয়া যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে পারে।
না—এ কথা কাহাকে খুলিয়া বলিতে না পারিলে আমি পাগল হইয়া যাইব; কিন্তু কাহাকে বলি? কোথায় যাই? কি করি? এ কি মুস্কিলেই পড়িলাম!
৪ঠা মার্চ।—না, বৃথা—বৃথা—মানুষে আমার আর কোন উপকার করিতে পারিবে না। এ মহা বিপদ হইতে উদ্ধার পাইবার জন্য আমাকে একটা মহা যুদ্ধ একাকীই করিতে হইবে।
দুইটি মাত্র পথ আমার সম্মুখে, এক আমি ঐ কুহকিনীর প্রেমপাত্র হইতে পারি। দ্বিতীয়, তাহার অপ্রিয়াচরণ করিয়া নীরবে তাহার অত্যাচার—তাহার দণ্ড সহ্য করা।
তাহা যাহাই হউক, সে আমাকে অসহ্য নরক যন্ত্রণা দিক, সে আমাকে উন্মত্ত করুক, সে আমাকে হত্যা করুক, আমি কখনই তাহার পদানত হইব না, কখনই না—কখনই না—কখনই না।
ঊষাকে যদি হারাই, তাহার জন্য যদি ঊষাকে হারাইতে হয়, এ জগৎ হইতে যদি আমার মান সম্ভ্রম সমস্ত নষ্ট হয়, তাহাও স্বীকার; ইহা অপেক্ষা সে আমাকে আর কি অধিক যন্ত্রণা দিবে?
আমি আমার সে যন্ত্রণা কাহাকেও এ জগতে বলিতে পারিব না, আমাকে—বৈজ্ঞানিক ধীরেন্দ্রনাথকে ডাকিনীতে পাইয়াছে, এ কথা শুনিলে সকলেই হাসিয়া উঠিবে, সম্ভবতঃ আমাকে পাগলা গারদে যাইতে হইবে। সুতরাং ভগবান্ ব্যতীত কেহ আমাকে রক্ষা করিতে পারিবে না— আমি কায়মনোবাক্যে তাঁহাকেই ডাকিতে লাগিলাম। হায়! দূরপ্রোথিতমূল বৃক্ষ আজ সামান্য ঝটিকায় ভাঙ্গিয়া পড়িল।
৬ই মার্চ।—কয়েক দিন কতকটা শান্তিতে আছি। কিন্তু এ শান্তির উপর বিশ্বাস কি? আমি জানি, আমি গভীর গহ্বরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিয়াছি—যে কোন মুহূর্ত্তে এই পিশাচী আমাকে এই গহ্বরে নিক্ষেপ করিতে পারে।
১০ই মার্চ।—জানি এই কুহকিনী যেরূপ বুদ্ধিমতী চতুরা—ভাবিয়া চিন্তিয়া আমার উপর একটা ঘোরতর কঠোর দণ্ড বিধান না করিয়া ছাড়িবে না। সে জানে, কালেজে আমার কত মান সম্ভ্রম, সে তাহাই ঠিক এইখানেই প্রথমে আমাকে আঘাত করিয়াছে। আমি বুঝিতেছি যে, আমার কালেজের চাকরী যাইবে—যায় যাক, আমি শেষ পর্য্যন্ত না দেখিয়া ছাড়িব না।
আজ কালেজে পড়াইবার সময় আমার পাঠ সম্বন্ধে যে কোন গোল ঘটিয়াছে, তাহা আমি বুঝিতে পারিলাম না, তবে নিমেষের জন্য একবার মাথা ঘুরিয়া উঠিয়াছিল—এই মাত্র। কিন্তু পাঠ শেষ হইলে একটা ছেলে আসিয়া খাতা দেখাইল; দেখিলাম, আমি যাহা বলিয়াছি, তাহা সমস্তই ভুল। সে শুনিতে ভুল করিয়াছে বলিয়া আমি তাহাকে বুঝাইয়া দিলাম, কিন্তু মনে মনে বুঝিলাম যে, প্রকৃতই মায়াবিনীর শক্তিতে অধ্যাপন কালে আমার মতিভ্রম ঘটিয়াছে। আর ছুটির বিলম্ব নাই, এই কয় দিন কোনরূপে মান সম্ভ্রম বজায় করিয়া যাইতে পরিলে যে হয়! তাহা কি আর হইবে?
২০শে মার্চ।—দশ দিন কাটিয়া গিয়াছে। আমার লজ্জার কাহিনী আর কি লিখিব? আমার মান সম্ভ্রম সকলই গিয়াছে। বোধ হয়, কেবল অভ্যাসের বলেই এই ডায়েরী আবার লিখিতে আরম্ভ করিয়াছি।
যাহা আমি ভয় করিয়াছিলাম, তাহা কাল ঘটিয়াছে। আমার চাকরী গিয়াছে। যদিও তাঁহারা বলিয়াছেন, “এ কেবল দিন কয়েকের জন্য, অত্যধিক পরিশ্রমে আপনার শরীর খারাপ হইয়া গিয়াছে, দিন কয়েক বিশ্রাম করিয়া সুস্থ হইলেই আবার আপনি কাজে যোগ দিবেন।”
যাহাই হউক, চাকরীটা গিয়াছে। আমি জানি, আমি আর সেই প্রখ্যাত লব্ধপ্রতিষ্ঠ বৈজ্ঞানিক ধীরেন্দ্রনাথ নাই! আমি আর সে নই, আমি জগতের সম্মুখে মান সম্ভ্রম সকলই হারাইয়াছি।
ব্যাপার এই;–আমার অধ্যাপনা ছেলেদের মধ্যে হাস্যজনক হইয়াছে। আমি পড়াইতে আরম্ভ করিলে কালেজ সুদ্ধ ছেলে বোধ হয়, সেইখানে আসিয়া জুটিত। পাগল প্রফেসার আজ কি মজা করে, তাহাই দেখিবার জন্য সকলের আগ্রহ সীমাতিক্রম করিয়া উঠিত, আমার লজ্জা ও অপমানের বিস্তৃত বর্ণনা করিতে আমি অপারক—সকলই সেই সয়তানীর কাজ?
এমন কোন কি হাস্যজনক-লজ্জাজনক বিষয় নাই, যাহা সে আমার মুখ দিয়া কালেজের মধ্যে ছেলেদের সম্মুখে বলাইতে বাধ্য না করিয়াছে।
আমি প্রথম বেশ পূর্ব্বের ন্যায় পড়াইতে আরম্ভ করিতাম, কিন্তু মনে মনে বুঝিতাম যে, শীঘ্রই মতিচ্ছন্ন ঘটিবে, তখন আমি কি বলিব, কি করিব, তাহা বিন্দুমাত্র আমার মনে থাকিবে না, আমি জানিতেও পারিব না।
তাহার পর যখন এই কুহকিনীর শক্তি আমার উপর সঞ্চারিত হইতেছে, আমি বুঝিতে পারিতাম, তখন প্রাণপণে সেই ভয়ঙ্করী শক্তির হাত হইতে মুক্ত হইবার জন্য চেষ্টা পাইতাম। আমার আপাদমস্তক ঘৰ্ম্মাক্ত হইয়া যাইত, আমি হস্ত মুষ্টিবদ্ধ করিয়া মুখটা বীভৎসরূপে বিকৃত করিতাম, ছেলেরা তাহাদের প্রফেসারের অঙ্গভঙ্গি দেখিয়া হো হো শব্দে হাসিয়া উঠিত।
তাহার পর আমি যাহা বলিতাম, তাহার বর্ণনা হয় না? অবোধ বালকের মত অকারণে হাসিয়া উঠিতাম, পাগলের ন্যায়, কত কথা বলিতাম, সময়ে সময়ে গান ধরিতাম, কখনও কখনও বা অন্যান্য প্রফেসারদিগের মস্তকে অজস্র গালিবর্ষণ করিতাম। তাহার পর মুহূর্তেই আমার মস্তিষ্ক আবার প্রকৃতিস্থ হইত, তখন আমি আবার ভাল ভাবেই পড়াইতে আরম্ভ করিতাম।
বলা বাহুল্য, আমার পাগলামী লইয়া ছাত্রেরা হাসতেছিল, কর্তৃপক্ষগণ গম্ভীর হইয়াছিলেন, আমাকে যে তাঁহারা অবসর দিবেন, ইহাতে আশ্চর্য্যের বিষয় কিছুই নাই। কালেজের মধ্যে সকলের সম্মুখে আমার পাগলামীতে তাঁহাদেরও লজ্জায় কাহারও নিকট মুখ দেখাইবার উপায় ছিল না। এ সমস্তই সেই যাদুকরীর কাজ।
কেবল হহাই নহে—আমার এই নির্জ্জন বাস আমার পক্ষে অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে। সকলেই আমাকে ছাড়িয়া গিয়াছে, আমার চাকরী গিয়াছে, আর কোন কাজ-কৰ্ম্ম নাই, আমি পাগল হইয়াছি ভাবিয়া, আমার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন আর কেহই আমার কাছে আসে না। আমি আমার নিজের ঘরে একাকী বসিয়া রাস্তার দিকে চাহিয়া থাকি। এই কলিকাতা সহরে, এই লোকাকীর্ণ স্থানে, এই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে, এই বিজ্ঞানচর্চ্চা ও আলোচনার স্থানে, আমি এক সয়তানীর কুহক মন্ত্রে উৎপীড়িত, লাঞ্ছিত পেষিত হইয়া যাইতেছি—আমাকে রক্ষা করিবার ক্ষমতা কাহারই নাই। এই শক্তি যে কি, তাহা বিজ্ঞানেও কিছু জানে না। এই সয়তানীর নামে নালিশ করিতে গেলে কোন বিচারপতিই আমার কথা কর্ণপাত করিবে না। পাগলের প্রলাপ ভাবিয়া আমাকে তাড়াইয়া দিবেন।
কোন চিকিৎসকই আমার এ রোগ বিশ্বাস করিবেন না। আমার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সকলেই স্থির করিয়া বসিয়াছেন, আমার মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে।
আমি মানুষ হইয়াও মনুষ্য-সমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছি। সেই নারীরাক্ষসী আমার এই দশা করিয়াছে; কিন্তু সাবধান, সব বিষয়েরই সীমা আছে, যখন কেহই আমাকে এই রাক্ষসীর হাত হইতে রক্ষা করিতে পারিবে না, তখন আমিই স্বয়ং তাহার ব্যবস্থা করিব।
কাল তাহার সহিত একবার আমার দেখা হইয়াছিল, বাড়ীর সম্মুখের পথিমধ্যে তাহার সহিত দেখা হইয়াছিল। তাহার পরম সৌভাগ্য যে, প্রকাশ্য পথে দেখা হইয়াছিল, কোন নির্জন স্থানে হয় নাই, তাহা হইলে আমি কি করিতাম বলা যায় না। তাহার গলা চাপিয়া তাহাকে নিদয়ভাবে যে হত্যা করিতাম না, এ বিষয় গুরুতর সন্দেহ আছে।
সে পরিহাস করিয়া কহিল, “কেমন মহাশয়, এখন জ্ঞানলাভ হইয়াছে কি? এখনও কি সে অহঙ্কারটুকু, সেই দর্পিত ভাবটুকু আছে।
আমি ঘৃণায় মুখ ফিরাইলাম, কোন উত্তর দিলাম না। সে এইবার না হাসিয়া গম্ভীরমুখে বলিল,”ও দেখিতেছি, স্ক্রুর পাটা আরও একটু বেশি করিয়া দিতে হইবে।”
এই বলিয়া সে সদর্প পাদক্ষেপে চলিয়া গেল। আর একটু সেখানে সে অপেক্ষা করিলে কি ঘটিত বলা যায় না। সাবধান, সুন্দরী! সাবধান! একদিন আমি তোমায় হাতে পাইয়াছিলাম, আরও এক দিন হাতে পাইব।
২৫শে মার্চ।—যাহা হউক, একটা ভাল হইয়াছে। আমার চাকরী যাওয়ায় আমি তাহার হাত হইতে উপস্থিত কতকটা রক্ষা পাইয়াছি; সে আমাকে আর উৎপীড়িত, লাঞ্ছিত করিতে পারিতেছে না। হতাশ হইবার কোন কারণ নেই। চারিদিক্ হইতেই আমার নিকট সহানুভূতিপূর্ণ পত্র আসিতেছে। বিজ্ঞানচর্চ্চা অত্যাধিক করায় আমার দেহ যে ভগ্ন হইয়াছে, ইহাই ভাবিয়া সকলেই আমার জন্য দুঃখিত। কালেজের কর্তৃপক্ষগণেরও আমার কার্য্যের বিশেষ প্রশংসা করিয়া লিখিয়াছেন,‘অত্যধিক’ পরিশ্রম বশতঃ স্বাস্থ্যভঙ্গ হইয়াছে, দিনকতক পশ্চিমে বেড়াইয়া আসিলেই আপনার শরীর সুস্থ হইবে। আমরা সকলেই আশা করিতেছি যে, ছুটির পর কালেজ খুলিলে আপনি কালেজে আসিতে সক্ষম হইবেন।”
এই দুঃখ—এই অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্যে এই সকল পত্রে আমার প্রাণে শান্তিদান করিল; আশা হইল, ভগবান্ আছেন, এখনও এই যাদুকরীর হাত হইতে আমি নিশ্চয়ই রক্ষা পাইব।
২৭শে মার্চ।—কোন একটা মহাকাণ্ড হইয়া গিয়াছে। ঊষাদের বাড়ীতে একটা চোর ঢুকিবার চেষ্টা করিয়াছিল, আমি এ সংবাদ পাইয়া সত্বর তাহাদের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। হাঁ, যথার্থই কাল রাত্রে জানালা ভাঙ্গিয়া চোর বাটীমধ্যে প্রবেশ করিবার চেষ্টা করিয়াছিল।
একটা জানালায় কোন প্রকার লৌহ যন্ত্র লাগাইয়া, কোন লোক জানালা ভাঙ্গিয়া গৃহ প্রবেশের চেষ্টা পাইয়াছিল। জানালায় যন্ত্রের দাগ স্পষ্ট দেখা যাইতেছে—সেই জানালার কতকটা অংশ ভাঙ্গিয়াও গিয়াছে।
পুলিসের পক্ষে চোর ধরা কঠিন হইবে না। এই জানালায় নতুন গ্রীণ রং দেওয়া হইয়াছিল, তাহা তখনও শুকায় নাই। জানালায় যে দাগ পড়িয়াছে, তাহাতে স্পষ্ট জানা যায় যে চোরের হাতে ও কাপড়ে এই রং লাগিয়া গিয়াছে। এ রং কাপড় হইতে সহজে তুলিয়া ফেলা যায় না, সুতরাং এই সূত্র ধরিয়া এ চোর ধরা পুলিসের পক্ষে নিতান্ত কঠিন হইবে না।
পরে বাড়ী ফিরিয়া আসিয়া যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার মাথা ঘুরিয়া গেল। আমি মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলাম। পাপিয়সী—সয়তানী—ডাকিনী—আমি তাহাকে কিছুতেই আমায় পরাস্ত করিতে দিব না। সে আমার চাকরি ঘুচাইয়াছে, এখন আমায় চোর বানাইতে চাহে! এ জগতে এমন কি কিছুই নাই, যাহা আমি করিতে পারি। কেবল কি—না—না- এ অবস্থায় সে কথা মনে হইলে প্রাণ শিহরিয়া উঠে।
আমি গৃহে ফিরিয়া বিছানার দিকে চাহিয়া বসিয়া পড়িলাম, আমি কখনও কাঁদি নাই, আজ বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল, কিছুতেই অশ্রু সম্বরণ করিতে পারিলাম না। আমি কি ভয়ানক কাজ করিয়াছি! কাল রাত্রে আমার গায়ে যে জামা ছিল, তাহার ডান হাতের আস্তীনটা গ্রীণ রঙে রঞ্জিত, রুমালখানাতেও গ্রীণ রঙের দাগ!
এই সেই রাক্ষসীর স্ক্রপের আর এক প্যাঁচ! সে আমাকে চোর বানাইয়াছিল, আদি গভীর রাত্রে ঊষার বাড়ীর জানালা ভাঙ্গিয়া প্রবেশ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলাম। কি ভয়ানক! কি সৰ্ব্বনাশ!
এবার না হয়, আমি চুরি করিতে পারি নাই, কিন্তু ভবিষ্যতে সে আমাকে কি করিবে, তাহা কে বলিতে পারে? আমার এ কথা ভাবিবারও সাহস নাই। হায় হতভাগিনী ঊষা! এখন আমার মৃত্যুই শ্রেয় আর এতদিন বাঁচিয়া থাকিলে সে আমাকে দিয়া কি যে ভয়াবহ লোমহর্ষণ ব্যাপার সংঘটন করিবে, তাহা কে বলিতে পারে।
হাঁ, এই তাহার স্তুপের পাক! আমার এখন তাহার কথা মনে হইল, সে বলিয়াছিল যে, সে আমার উপর কত ক্ষমতা ধরে, তাহা আমি এখনও বুঝিতে পারি নাই। এখন তাহার কথা কতদূর যে সত্য, তাহা বুঝিতে পারিতেছি,—সর্ব্বান্তঃকরণে বুঝিতে পারিতেছি।
সে বলিয়াছিল যে, অপরকে সজ্ঞান ও অজ্ঞান দুই অবস্থায়েই নিজের হুকুম মত কাজ করাইতে পারে। এত দিন আমি সজ্ঞান বা অর্দ্ধসংজ্ঞাহীন অবস্থায় তাহার ইচ্ছাশক্তিতে পৈশাচিক কাজ করিতে বাধ্য হইয়াছি; এখন বুঝিলাম, কাল রাত্রে যাহা করিয়াছি, তাহা সম্পূর্ণ অজ্ঞান অবস্থায় বাহির হইয়া গিয়া ঊষাদের বাড়ীর জানালা ভাঙ্গিবার চেষ্টা পাইয়াছিলাম। পরম সৌভাগ্য, ঊষা ও তাহার পিতা সেদিন বাড়ীতে ছিলেন না,—কেবল চাকরেরা ছিল, তাহারা রাত্রে কিছু জানিতে পারে নাই—সকালে উঠিয়া ভাঙ্গা জানালা দেখিয়াছিল।
আমি এই ভয়াবহ কাজ করিয়া রাত্রে বাড়ীতে ফিরিয়া আসিয়াছিলাম; জামা রুমাল বিছানার উপর ফেলিয়া পার্শ্ববর্তী ঘরে গিয়া হাত ধুইয়াছি। এত কাজ করিয়াছি; কিন্তু ইহার কিছুই আমার মনে নাই।
কেহ কি রাত্রে আমায় দেখিয়াছে? হয়ত কেহ আমাকে দেখিয়া থাকিবে, তাহার পর আমার সঙ্গে সঙ্গে আসিয়া আমার বাড়ীও দেখিয়া গিয়াছে। ইহাপেক্ষা আমার মৃত্যু শতবার শ্রেয়ঃ নয় কি? এ নরক যন্ত্রণা হইতে উদ্ধারের কি কোন উপায় নাই! আমার প্রাণে শান্তি নাই—মৰ্ম্মস্থানে চিতাকুণ্ড জ্বলিতেছে! সহ্য করিবার ক্ষমতা সীমা অতিক্রম করিয়াছে, আর নয়—জীবিত থাকিতে আমার রক্ষা নাই!
খুন অথবা আত্মহত্যা—একটা ব্যতীত আমার আর দ্বিতীয় পথ নাই! ঊষা—ঊষা—ঊষার জন্য আত্মহত্যা—করিতে প্রাণ চায় না, নতুবা আমার নিকট শত প্রকার অস্ত্র—অ্যাসিড রহিয়াছে, অনায়াসেই নিমিষে জীবনান্ত করিতে পারিতাম!
৩০শে মার্চ।—তিন দিন নিশ্চিন্ত আছি, শান্তিতে আছি। বিড়াল যেমন ইন্দুরকে লইয়া ক্রীড়াচ্ছলে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর করিয়া দেয়—এই রাক্ষসীও আমাকে লইয়া তাহাই করিতেছে। দুই দিন বিশ্রাম দেয়, তাহার পর আমাকে দিয়া একটা না-একটা-ভয়ানক কাণ্ড না ঘটাইয়া ছাড়ে না, যে দুইদিন মুক্ত থাকি, সে দুই দিনও শান্তি আমার পক্ষে দুর্লভ—ভবিষ্যতের চিন্তায় আমার প্রাণ সতত আকুল হইতে থাকে। আমার শরীর একেবারে ভাঙ্গিয়া গিয়াছে,—আমি আর সে আমি নাই।
সংবাদ পাইয়াছি, ঊষা ও ঊষার পিতা কাল ফিরিয়া আসিবেন। ইহাতে আমি সুখী হইব কি দুঃখিত হইব, তাহা আমি কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। এই পাপ স্থান হইতে তাহারা দূরে ছিল, ভালই ছিল–হয়ত তাহারা এখানে আসিলে এই রাক্ষসী তাহাদেরও অনিষ্ট করিবার চেষ্টা করিবে! যাহাই হউক, আমার এ অবস্থায় আমি কখনই ঊষাকে বিবাহ করিতে পারিব না, করা উচিতও নহে। আমি ভূতগ্রস্থ—উন্মত্ত,—আমি আমাতে নাই—আমার এ অবস্থায় বিবাহ করা মহা পাপ!
আজ আমাদের কালেজে একটা সভার অধিবেশন হইবে। আমি নিশ্চয়ই সভায় উপস্থিত হইব, সকলের সহিত কথাবার্তা কহিলেই তাঁহারা বুঝিতে পারিবেন যে, আমি প্রকৃতই উন্মত্ত হইয়া উঠি নাই; আর যদি না সভায় যাই, সকলেই ভাবিবে যে, আমার লোক-সমাজে যাইবার আর ক্ষমতা নাই।
এই সকল ভাবিয়া আমি সভায় উপস্থিত হওয়া নিতান্ত কর্তব্য মনে করিয়া সভায় চলিলাম। তথায় ডাক্তার করুণাকান্তবাবুর সঙ্গে দেখা হইল। তাঁহাকে বাড়ীতে একবার দেখা করিতে অনুরোধ করিয়া আমি সভাভঙ্গের পর গৃহে ফিরিলাম।
অনেকক্ষণ তাঁহার অপেক্ষায় বসিয়া রহিলাম। সময় কাটাইবার জন্য এই ডায়েরী লিখিতে লাগিলাম—সহসা বাহিরে কে কড়া নাড়িল; বোধ হয়, করুণাকান্তবাবু—আমি স্বয়ং দরজা খুলিয়া দিবার জন্য উঠিলাম।
৩১শে মার্চ।—কাল রাত্রে লিখিতে লিখিতে বন্ধ করিয়াছিলাম কেন? আমি দরজা খুলিয়া দিতে নিশ্চয়ই যাই নাই; কই, তাহা হইলে নিশ্চয় মনে হইত, কিছুই মনে হয় না। দেখিতেছি, আমার হাত খুব ফুলিয়াছে। কিসে গুরুতর আঘাত লাগিয়াছে; অথচ কিসে এমন আঘাত লাগিয়া ছিল, তাহা আমার কিছুই মনে নাই।
কিন্তু ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা হয় নাই কেন? এই ত ডায়েরীতে লেখা রহিয়াছে, তাঁহাকে দরজা খুলিয়া দিবার জন্য উঠিলাম। তবে কি—না—না—অসম্ভব! কিছুই মনে নাই। তবে কি রাক্ষসী কাল রাত্রে আমাকে দিয়া আবার কোন একটা ভয়াবহ লোমহর্ষণ ঘটনা ঘটাইয়াছে! না— আমি ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিব, তিনি প্রকৃত কাল রাত্রে আমার বাড়ীতে আসিয়াছিলেন কি না।
দ্বিপ্রহর।—না—আর সহ্য হয় না। সীমা অতিক্রম করিয়াছে, আমার এ জীবন রাখা বিড়ম্বনা মাত্র। তবে আমাকে যদি মরিতে হয়, তবে তাহাকেও সেই সঙ্গে যাইতে হইবে। আবার যে সে আর কাহাকে আমার মত বিপন্ন করিবে, তাহা আমি কিছুতেই হইতে দিব না।
আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম করিয়াছে; ভগবান্ জানেন, একটী পিপীলিকাকে হত্যা করিতে আমার প্রাণে দারুণ বেদনা বোধ হইত, আর এক্ষণে আমি কি হইয়াছি, তাহা বলিতে পারি না। বোধ হয়, আমার মত ভয়াবহ লোক জগতে আর দ্বিতীয় নাই, আমি যে কি না করিতে পারি, আমার যে কি অসাধ্য তাহা বলা যায় না! এই সময়ে তাহাকে যদি পাইতাম, তাহা হইলে পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করিতে করিতে তাহার গলা টিপিয়া তাহাকে হত্যা করিতাম। তাহার চক্ষু কপালে উঠিলে, তাহার জিহ্বা বিলম্বিত হইলে, তাহার নিশ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিলে, আমার প্রাণে কত যে আনন্দ হইত, তাহা অপরে কেহ বুঝিবে না।
তবুও আমি তাহাকে সাবধান করিয়া দিব। তাহাকে স্পষ্ট বুঝাইয়া দিব যে, আমার হাতেই তাহার ভীষণ পরিণাম আছে, তাহাতে নিরস্ত হয় ভালই, না হয়, যাহা হইবার তাহাই হইবে।
আমি ডাক্তার করুণাকান্তবাবুর সঙ্গে দেখা করিতে চলিলাম।
আমি বিস্মিত হইয়া দেখিলাম যে, তিনি শয্যায় শায়িত রহিয়াছেন। তিনি আমাকে দেখিয়া উঠিয়া বসিলেন, আমি তাঁহার মুখ দেখিয়া স্তম্ভিত হইলাম, আমার মাথা ঘুরিয়া গেল। তাঁহার মুখ নাক ফুলিয়াছে—স্থানে স্থানে ফাটিয়া গিয়াছে।
আমি স্পন্দিত হৃদয়ে বলিলাম, “ডাক্তার, এ কি হইয়াছে?”
তিনি অতিকষ্টে বলিলেন, “ধীরেন্দ্রবাবু, কয়েক দিন হইতে আমি ভাবিতেছিলাম যে, তুমি সম্পূর্ণ উন্মত্ত হইয়াছ; এখন বুঝিতেছি যে, আমি যাহা ভাবিয়াছিলাম, তাহা মিথ্যা নহে। তুমি কেবল উন্মত্ত হইয়াছ, তাহা নহে, তুমি বিপদজ্জনক ভয়ানক পাগল। যদি আমি তোমার উপর দয়া না করিতাম, তাহা হইলে তুমি এতক্ষণ পুলিসের হস্তে যাইতে।”
আমি বলিলাম, “তাহা হইলে, তাহা হইলে –”
“তাহা হইলে এই যে, আমি তোমার দরজা খুলিবামাত্র তুমি ব্যাঘ্রের ন্যায় আমাকে আক্রমণ করিয়াছিলে, দুই হস্তে আমার মুখে ঘুসি মারিয়াছিলে, আমি পড়িয়া গেলেও তুমি প্রহারে নিরস্ত হও নাই; তোমার প্রহারে আমি প্রায় অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিলাম। পরে কখন তুমি দরজা বন্ধ করিয়া ভিতরে চলিয়া গিয়াছিলে। তোমার নিজের হাত দেখিয়াও তুমি বুঝিতে পারিতেছ না?”
হাঁ। আমার হাতই ইহার যথেষ্ট প্রমাণ। আমি কি করিব, কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। যদিও তিনি আমাকে বদ্ধ পাগল স্থির করিয়াছেন, তবুও আমি ইহাকে সকল ব্যাপার খুলিয়া বলিব, আর উপায় কি?
আমি তাঁহার শষ্যার এক পার্শ্বে বসিয়া তাঁহাকে আদ্যোপান্ত সমস্ত কথাই বলিলাম। কম্পিত কণ্ঠে, স্পন্দিত দেহে সবেগে আমি সকল কথাই তাঁহাকে বলিলাম। আমি যে ভাবে বলিলাম, তাহাতে অতি সন্দিগ্ধচিত্ত লোকেরও বিশ্বাস না হইয়া যাইবার উপায় নাই। আমি ব্যাকুলভাবে বলিলাম, “সে আমাকে যেমন ঘৃণা করে, আপনাকেও তেমনি ঘৃণা করে। তাহাই কাল রাত্রে এক সঙ্গে দুইজনকেই সাজা দিয়াছে! সে তাহার পৈশাচিকী শক্তি বলে আমাকে দিয়া এই ভয়াবহ কাজ করিয়াছে। আপনার ক্ষত বিক্ষত মুখ আমার ক্ষত বিক্ষত আত্মার নিকট কিছুই নহে। আমি অহর্নিশ জ্বলিয়া পুড়িয়া মরিতেছি।”
তিনি আমার কথায় স্তম্ভিত হইলেন; আমার কথা বিশ্বাস করিয়া যে অতিশয় বিচলিত হইয়াছে, তাহাও আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম। তিনি মৃদুস্বরে বলিলেন, “হাঁ, সে একাজ করিতে পারে। তবে ইহাও কি সম্ভব যে, সে তোমার এমনই অবস্থা করিয়াছে! তুমি এখন কি করিতে চাও?”
আমি বলিয়া উঠিলাম, “যেমন করিয়া হউক, আমি তাহার এই সকল পৈশাচিকী শক্তি লোপ করিব। আমি সম্পূর্ণ ক্ষিপ্ত হইয়াছি, আমি আজ তাহাকে সম্পূর্ণ স্পষ্ট কথা বলিব, তাহাকে সাবধান হইতে বলিব, তাহাতে যদি সে নিরস্ত না হয়, তাহার পর যখন তাহার সহিত আমার দেখা হইবে, তখন সেই তাহার শেষ দিন।”
“পাগলের মত কিছু করিও না।”
পাগলের মত! পাগলের মতই বটে।” বলিয়া আমি উন্মত্তের ন্যায় নিজের বাড়ীর দিকে ছুটিলাম।
আজ আমার জীবনের ঘোরতর সমস্যা। আমি এখনই তাহার সহিত দেখা করিব। যাহা হউক, আজ অন্ততঃ একটা কাজ হইয়াছে—আমি আজ অন্ততঃ একজন লোককে আমার কথা বিশ্বাস করাইতে পারিয়াছি। যদি তাহাই ঘটে, যদি প্রকৃতই আমি ভয়াবহ কার্য্য করিতে বাধ্য হই, তাহা হইলে এই ডায়েরী থাকিল, ইহাতে সকলে জানিতে পারিবে, আমি কি জন্য এইরূপ লোমহর্ষণ কার্য্য করিতে বাধ্য হইয়াছি।
সন্ধ্যা।—আমি শশধরের বাড়ী আসিয়া দেখিলাম, সে যোগিনীর নিকট বসিয়া কথা কহিতেছে। শশধর নিজের কথায় নিজে মগ্ন, আমি ও সেই যোগিনী উভয়ে নীরবে বসিয়া রহিলাম—মধ্যে মধ্যে উভয়ে উভয়ের দিকে চাহিতে লাগিলাম।
আমি বুঝিলাম, সে আমাকে দেখিয়া মনে মনে মজা বোধ করিতেছে! আমি যে আজ এই কুহকিনীর সহিত একাকী কথা কহিবার সুবিধা পাইব, তাহা বোধ হইল না।
এই সময়ে সৌভাগ্যবশতঃ শশধরকে কে বাহিরে ডাকিল। শশধর উঠিয়া যাইবামাত্র, যোগিনী শ্লেষপূর্ণ মৃদু হাসিয়া বলিল, “কেমন—আর কাজকর্ম্ম নাই। বলি তোমার বন্ধু ডাক্তার কি রকম আছেন?”
আমি গৰ্জ্জিয়া বলিলাম, “সয়তানি, তোর শেষ হইয়া আসিয়াছে, আর আমি সহ্য করিতে পারি না।”
আমি সবেগে উঠিয়া, তাহার গলা ধরিয়া নিষ্ঠুরভাবে নাড়া দিয়া বলিলাম, “ভগবানের নামে শপথ করিয়া বলিতেছি, আর যদি তুই একবারও আমার উপর তোর ঐ পৈশাচিকী শক্তি ব্যবহার করিতে চেষ্টা পাস, তবে আমি নিৰ্দ্দয়ভাবে তোকে হত্যা করিব, কেহই তোকে রক্ষা করিতে পারিবে না। যাহাই আমার অদৃষ্টে ঘটুক, আমি তোর জীবন লইব। মানুষে যাহা সহ্য করিতে পারে, তাহার শেষ সীমায় আমি আসিয়াছি।”
যোগিনী অত্যন্ত সহজভাবে দুই হাতে আমার হাত ঠেলিয়া দিয়া খুব গর্জিয়া কহিল, “দূরে গিয়া দাঁড়াও, তোমার সঙ্গে এখনও আমার হিসাব মিটে নাই। আমি ভালবাসিতেও জানি, ঘুণা করিতেও জানি। তুমি আমার ভালবাসা পা দিয়া ঠেলিয়াছ, এখন আমার ঘৃণার একটু রসাস্বাদ কর। দেখিতেছি, তোমার অহঙ্কার ও তেজঃ নষ্ট করিবার জন্য আরও একটু শিক্ষা আবশ্যক। শুনিলাম, কাল ঊষা দেবী এখানে আসিতেছেন।”
আমি বজ্ররবে বলিলাম, “তাহার পবিত্র নাম তোর ঐ পাপ মুখে উচ্চারণ করিস্ না, যদি তুই তাহার কোন অনিষ্ট করিবার চেষ্টা করিস, তাহা হইলে—”
বাধা দিয়া পরিহাসে যোগিনী কহিল, “ঊষা দেবী এমন বীরকে যে স্বামীরূপে পাইবেন, ইহাতে তাঁহাকে সৌভাগ্যবতী বলা যায়।”
আমি বলিলাম, “বৃথা কথায় কাজ নাই। আমি তোকে বলিতে আসিয়াছি যে, তুই এবার আমার উপর কিছু করিলে সেই তোর শেষ।”
এই বলিয়া আমি সবেগে গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া গেলাম। সে আমার দিকে তীক্ষ্ণনেত্রে চাহিয়া রহিল, কিন্তু তাহার মুখ দেখিয়া আমি বুঝিলাম যে, সে এখন বেশ বুঝিয়াছে—সে নিরাপদ নহে।
১লা এপ্রেল।—ঊষা ও তাহার পিতা আসিয়াছেন। আমি তাঁহাদের সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিলাম। অনেকক্ষণ ঊষার নিকটে ছিলাম। সে আমাকে কত ভালবাসে! কিন্তু হায়, আমি কি তাহার ভালবাসার উপযুক্ত।
আমি জীর্ণ শীর্ণ মলিন হইয়া দিয়াছি বলিয়া, সে অনেক দুঃখ প্রকাশ করিল, আমাকে কত আদর যত্ন করিল। সে কি বুঝিবে, আমার মাথার উপরে কি বিপদের বজ্র গর্জ্জিতেছে? ভগবান্ করুন, সে যেন কখনও না জানিতে পারে যে, কি কারণে আমার এ দশা হইয়াছে।
তাহার কাছে আসিয়া, তাহার সহিত কথা কহিয়া আমার প্রাণ হইতে যেন সকল দুঃখ কষ্ট একেবারে দূর হইয়া গেল? আমি যেন পুনর্জীবন লাভ করিলাম। ঊষা আমার পার্শ্বে থাকিলে আমি এ জগতে কাহাকেই ভয় করি না। আমি বড় সুখে উৎসাহ পূর্ণ হৃদয়ে গৃহে ফিরিয়া আসিলাম।
২রা এপ্রেল।—যাহা ঘটিয়াছে, তাহা আমি বিশেষরূপে বর্ণন করিব। কিরূপে কি ঘটিয়াছিল, তাহাই বলিতেছি। এখনও সমস্ত আমার মনে স্পষ্টভাবে রহিয়াছে, জীবনে তাহা কখনও ভুলিব না, ভুলিতে পারিব না।
বেলা দ্বিপ্রহরে আমি একখানা পুস্তক পাঠ করিতেছি, সহসা আমার সেই ভাব হইল, আমি সম্পূর্ণ সংজ্ঞাহীন হইলাম।
যখন আমার জ্ঞান হইল, আমি দেখিলাম, আমি একটী সুসজ্জিত গৃহমধ্যে একখানা চেয়ারে বসিয়া আছি। এ ত আমার নিজের ঘর নহে; আমি যে আমার নিজের ঘরে বসিয়া পুস্তক পাঠ করিতেছিলাম, এ আমি কোথায় আসিয়াছি?
ঘরটী আমার বেশ পরিচিত বলিয়া বোধ হইল, অথচ প্রথমে ঘরটী চিনিতে পারিলাম না। সহসা আমার দৃষ্টি আমার একখানা ছবির উপরে পড়িল, তাহার পার্শ্বেই ঊষা ও তাহার পিতার ছবি। তখন আমার সহসা মনে পড়িল, আমি কোথায় আসিয়াছি; তখন বুঝিলাম, আমি ঊষার বসিবার ঘরে বসিয়া রহিয়াছি।
কেন আমি এখানে আসিয়াছি, আর কিরূপেই বা আসিলাম? আমার কিছুই জ্ঞান নাই? সহসা আমার চিত্তবৃত্তি লোপ পাইল। তবে কি কোন ভয়াবহ কার্য্য করিবার জন্য সেই রাক্ষসী আমাকে এখানে পাঠাইয়াছে? তবে কি তাহার অভীষ্টসিদ্ধ হইয়াছে?
আমার সর্ব্বশরীর থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। নিশ্চয়ই রাক্ষসীর ভয়াবহ অভীষ্টসিদ্ধ হইয়াছে, নতুবা আমার জ্ঞান হইত না। সে সময়ে আমার হৃদয়ের যন্ত্রণার বর্ণনা হয় না। হায়! আমি এতদিনে প্রকৃতই উন্মাদগ্রস্ত হইলাম।
আমি লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম, অমনই আমার ক্রোড় হইতে একটা শিশি গৃহতলে পড়িয়া গেল।
আমি স্পন্দিত হৃদয়ে সেটা তুলিয়া লইলাম। দেখি, তাহাতে লেখা সালফিউরিক অ্যাসিড। আমি ছিপি খুলিবামাত্র শিশির ভিতর হইতে ধূম নির্গত হইতে লাগিল। এরূপ আরক আমার গৃহে অনেক ছিল, এ শিশিটাও যে ছিল, তাহা আমি শিশি দেখিয়াই বুঝিতে পারিলাম। এ ভয়াবহ আরকসুদ্ধ শিশি আমি এখানে ঊষার গৃহে কেন কি জন্য আনিয়াছি? এই ভয়ানক অ্যাসিড কাহারও গায়ে ছড়াইয়া দিলে তাহার সৌন্দর্য্য নষ্ট হইয়া যায়, তাহা আমার অজ্ঞাত নহে। এখন এ কথা মনে হইবামাত্র আমার নিশ্বাস যেন রুদ্ধ হইয়া গেল। আমি কম্পিত হস্তে শিশিটী আলোর দিকে তুলিয়া ধরিলাম, আমি প্রাণের সহিত ভগবানকে বারংবার ধন্যবাদ দিলাম, দেখিলাম শিশিটী পূর্ণ আছে। তাহা হইলে ইহা আমি কাহারও উপরে এখনও কিছুমাত্র নিক্ষেপ করি নাই।
আমার প্রাণ কাঁপিয়া উঠিল। যদি ঊষা আমার অজ্ঞানাবস্থাকালে একটু আগে এখানে আসিত, তাহা হইলে নিশ্চয়ই সেই পিশাচী—সেই কুহকিনী—সেই রাক্ষসী আমার ভিতরে আসিয়া আমার হাত দিয়া এই ভয়াবহ আরক তাহার মুখে নিক্ষেপ করিত। তাহা হইলে কি ভয়াবহ লোমহর্ষণ ব্যাপারই না সংঘটিত হইত?
এই কথা মনে হইবামাত্র, আমার শরীরটা যেন ভাঙিয়া পড়িল, আমার সর্ব্বাঙ্গ থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। আমি আর মনুষ্য নাই, আমার সমস্ত মনুষ্যত্ব একেবারে নষ্ট হইয়া গিয়াছে!
সহসা ঊষার পদশব্দ শুনিয়া আমার সংজ্ঞা আসিল, ঊষা কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিলে আমি তাহার মুখের দিকে চাহিলাম। সে আমার এই শোচনীয় দশা দেখিয়া বিষণ্ণনেত্রে আমার দিকে চাহিল, চাহিয়া ধীরে ধীরে বলিল, “তোমার পশ্চিমে হাওয়া বদলাইতে যাওয়া উচিত, বাবাকে বলিয়া আমরাও তোমাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইব। সম্পূর্ণ বিশ্রাম তোমার প্রয়োজন; দেখিতেছি, তুমি নিতান্ত অসুস্থ হইয়াছ?”
আমি হাসিতে চেষ্টা করিয়া বলিলাম, “না এ কিছুই নহে হঠাৎ একটু অসুখ করিয়াছিল বটে, এখন আমি বেশ আছি।”
ঊষা কহিল, “তোমার নিকট এতক্ষণ আসিতে পারি নাই, অনেকক্ষণ একা থাকিতে হইয়াছে, আমার পুরাতন শিক্ষয়িত্রী আসিয়াছিলেন, তাঁহার সহিত কথা কহিতে একটু বিলম্ব হইয়া গিয়াছে। কিছুতেই তিনি উঠিতে চাহেন না, স্পষ্ট বিদায় করিতেও পারি না।”
“ভগবানকে ধন্যবাদ দিই যে, তিনি যান নাই, এতক্ষণ দেরি করিয়াছিলেন, ভগবানকে শত শত বার ধন্যবাদ।”
এই বলিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে আমি চেয়ার হইতে উঠিতে চেষ্টা করিলাম। ঊষা বিস্মিতভাবে আমার হাত ধরিয়া বলিল, “কেন, কি হইয়াছে? তিনি দেরি করিয়া গিয়াছেন বলিয়া কেন তুমি ভগবানকে এরূপভাবে ধন্যবাদ দিতেছ। আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না, তোমার হাতে এ শিশিটা কি?”
আমি সত্বর শিশিটা পকেটে রাখিয়া বলিলাম, “ও কিছু নয়। আমাকে এখনই যাইতে হইল। কোন গুরুতর কাজ আমার করিবার আছে।”
ঊষা ব্যাকুলভাবে বলিল, “কি হইয়াছে? তোমার এমন কঠোর ভাব আমি আর কখনও তো দেখি নাই। আমার আসিতে বিলম্ব হইয়াছে বলিয়া কি তুমি আমার উপরে রাগ করিয়াছে?”
“হাঁ, আমি রাগ করিয়াছি।”
“যদি রাগ করিয়া থাক, ক্ষমা কর।”
আমি ম্লানহাস্যের সহিত বলিলাম, “না—না–তোমার উপরে আমি কি কখনও রাগ করিতে পারি। তুমি আমার অবস্থা বুঝিবে না।”
ঊষা আদরে আমার হাত ধরিয়া স্পন্দিততার নেত্রে বলিল, “আমায় বলিবে না, তুমি এ সময়ে কি বলিবার জন্য আমার কাছে আসিয়াছিলে, তাহা ত আমাকে এখনও কিছু বল নাই?” আমি ব্যাকুলণ্ঠে বলিলাম, “ঊষা, আমি তোমায় একটা কথা বলিতে আসিয়াছিলাম। আমার বিরুদ্ধে তুমি যাহাই কেন শোন না, লোকে যতই ভয়াবহ বিষয় আমার সম্বন্ধে বলুক না বল, তুমি আমাকে বিশ্বাস করিবে—আমাকে ভালবাসিবে।”
“তাহা কি তুমি জান না?”
“তাহা আমি জানি। আমি যাহা করিব, আমি তোমারই জন্য করিব। আমি বাধ্য হইয়া ইহা করিতেছি। আর অন্য উপায় নাই।”
এই বলিয়া উন্মত্তের ন্যায় আমি সে স্থান ত্যাগ করিলাম।
আর ইতস্ততঃ করিবার সময় নাই! যতক্ষণ রাক্ষসী আমার কেবল অনিষ্ট করিবার চেষ্টা পাইতেছিল, ততক্ষণ আমি কি করিব, সে বিষয়ে ইতস্ততঃ করিতেছিলাম, কিন্তু আর ইতস্ততঃ করিবার সময় নাই। সে এখনও ঊষার সর্ব্বনাশ করিবার চেষ্টা করিতেছে, আর সময় নাই! আর ক্ষমা নাই, আর মাৰ্জ্জনা নাই! এখন আমার কর্ত্তব্য কি,—তাহা আর আমাকে কাহারও বলিয়া দিবার আবশ্যকতা নাই। আমার সঙ্গে কোন অস্ত্র নাই—অস্ত্রের প্রয়োজন কি, আমার শরীরে অসুরের বল আসিয়াছে। অবলীলাক্রমে আমি তাহাকে এ জগৎ হইতে বিদায় করিয়া দিতে পারিব। আর নয়,—আর এক মুহূর্ত্তও বিলম্ব নয়।
আমার সে সময়ে কোন জ্ঞান ছিল কি না, আমার তাহা বিন্দুমাত্র মনে পড়ে না। আমি যাহা করিতে যাইতেছি, তাহাতে আমার মন এত নিমগ্ন হইয়াছিল যে, আমি কিছুই দেখিতে পাইতেছিলাম না। পথে অনেক লোকের সহিত দেখা হইয়াছিল, অনেক পরিচিত লোক চোখের সম্মুখে পড়িয়াছিল, কিন্তু সুস্পষ্ট কিছুই মনে হয় না। সকলেই যে বিস্মিতভাবে আমার মুখের দিকে চাহিয়াছিল, তাহাও আমি কতক কতক বুঝিতেছিলাম, কিন্তু কিছুই পরিস্কার মনে নাই।
আমার মনে হয়, আমি যেরূপ দ্রুতপদে শশধরের বাড়ীর দিকে ছুটিতেছিলাম, শশধরও সেইরূপ আমার বাড়ীর দিকে ছুটিতেছিল, পথ মধ্যে আমাদের দুই জনের দেখা হয়, কিন্তু সে-ও কোন কথা কহিল না, আমিও না। উভয়েই অতি ব্যস্তভাবে দুইদিকে ছুটিলাম। ইহাও আমার মনে হয় মাত্র—পরিস্কার কিছুই মনে হয় না।
আজ জীবনের সকল দুঃখের অবসান করিব। আমার এ জীবনে আর কোন আশা ভরসা নাই, এ নরক-যন্ত্রণা সহ্য করা অপেক্ষা মৃত্যু সহস্র গুণে শ্রেয়ঃ।
আমি মনে মনে বেশ বুঝিয়াছি, ইহাতে আমারও জীবনের আশা নাই! বাঁচিয়া থাকিয়া আর ফল কি! বাঁচিয়া থাকিয়া এই সয়তানীর কবলে পড়িয়া এরূপ ভীষণ যন্ত্রণা সহ্য করা অপেক্ষা সহস্র গুণে মৃত্যু শ্রেয়ঃ—ফাঁসীতেই বা কি আসে যায়! বাঁচিয়া থাকিলে এই রাক্ষসী কেবল আমাকে নরক-যন্ত্রণা দিয়া নিরস্ত হইবে না—ঊষারও সর্ব্বনাশ করিবে। প্রাণ থাকিতে ইহা কখনও করিতে দিতে পারিব না। নিজেও আর সহ্য করিতে পারিব না।
আর এই সয়তানী বাঁচিয়া থাকিলে আমার মত আরও কতজনের সর্ব্বনাশ করিবে। জগতের হিতের জন্যও ইহাকে খুন করা, নির্ম্মম ভাবে হত্যা করা কৰ্ত্তব্য।
আমি যখন ঊর্দ্ধশ্বাসে শশধরের বাড়ীর দিকে ছুটিতেছিলাম, তখন এই সকল কথা জ্বলন্ত অগ্নিশিখার ন্যায় আমার চিত্তাকাশে উদিত হইতেছিল। প্রতিপদে আমার প্রতিজ্ঞা দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর হইয়া উঠিতেছিল, মন পাষাণে পরিণত হইয়া মনের হিংস্র, পাশব ভাব প্রদীপ্ত করিয়া তুলিতেছিল। আমার সে সকল বিষয়ে কোন জ্ঞান ছিল না, আমি এক্ষণে ক্ষিপ্ত রাক্ষস।
হাঁপাইতে হাঁপাইতে আমি শশধরের দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইলাম। দেখিলাম, তাহার বাড়ীর দ্বার রুদ্ধ!
আমি সবলে উন্মত্তের ন্যায় দ্বারে আঘাত করিতে লাগিলাম, তখন শশধরের জনৈক ভৃত্য আসিয়া দরজা খুলিয়া দিল। সে আমার মুখ দেখিয়া সভয়ে সরিয়া দাঁড়াইল।
আমি বজ্রগম্ভীর স্বরে বলিলাম, “যোগিনী কোথায়? আমি এখনই তাহার সহিত দেখা করিব।”
সে থতমত খাইয়া বলিল, “যোগিনী–যোগিনী—”
আমি গৰ্জ্জিয়া বলিলাম, “হাঁ, যোগিনী–যোগিনী—কানে শুনিতে পাইতেছ না—যোগিনীর সঙ্গে আমি এখনই দেখা করিতে চাই।”
সে আমায় বলিল, “তিনি—তিনি—”
আমি ক্রোধে উন্মত্তপ্রায় হইয়া তাহাকে আক্রমণ করিতে উদ্যত হইলাম। সে সভয়ে সরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “তিনি তিনি—মারা গিয়াছেন!”
আমি স্তম্ভিতভাবে বলিয়া উঠিলাম, “মারা গিয়াছে!”
তাহার পরেই আমার মনে হইল যে, ইহারা সকলে পরামর্শ করিয়া আমার হাত হইতে যোগিনীকে রক্ষা করিবার জন্য মিথ্যা কথা বলিতেছে! আমার তখন হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। আমি লম্ফ দিয়া সবলে তাহার কেশাকর্ষণ করিলাম। হুঙ্কার দিয়া উঠিলাম, “আমার সঙ্গে মিথ্যাকথা?”
সে অত্যন্ত ভয় পাইয়া বলিয়া উঠিল, “না হুজুর—না হুজুর,—দোহাই হুজুর।”
আমি গৰ্জ্জিয়া বলিলাম, “কোথায় যোগিনী?”
সে অতি কাতরে মিনতিস্বরে বলিল, “না বিশ্বাস হয়, দেখবেন আসুন।”
তখন আমি তাহার চুল ছাড়িয়া দিলাম, একটু সরিয়া দাঁড়াইয়া বিস্মিত ভাবে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলাম, “যোগিনী কোথায়?”
“তিনি খানিকটা আগে মারা গেছেন।”
“মারা গেছেন!”
“হাঁ হুজুর,—বিশ্বাস না হয়,আসুন দেখবেন।
১০ই এপ্রেল।—যথার্থই অবশেষে এই সয়তানী—এই রাক্ষসীর দিন শেষ হইয়াছে—পৃথিবী হইতে এক ভয়াবহ নারী দানবী দূর হইয়াছে! আর সে কাহারও অনিষ্ট করিতে পারিবে না।
হঠাৎ তাহার মৃত্যু হইয়াছে। এখন আমি বুঝিলাম, সহসা ঊষার প্রকোষ্ঠমধ্যে আমার কেন জ্ঞান হইয়াছিল। হঠাৎ তাহার মৃত্যু না হইলে সে কখনই আমার জ্ঞান হইতে দিত না—তাহার ভীষণ অভীষ্ট সিদ্ধ করিতে, আমাকে দিয়া ঊষার কমনীয় মুখে নিশ্চয়ই সেই অগ্নিসম সালফিউরিক অ্যাসিড নিক্ষেপ করাইয়া তাহার সৌন্দর্য্য নষ্ট না করাইয়া ছাড়িত না; সম্ভবতঃ তাহার জীবন পর্য্যন্ত গ্রহণ করিত! এইরূপে তাহার হঠাৎ মৃত্যু না হইলে, কি সৰ্ব্বনাশই না সংঘটিত হইত? এ কথা মনে হইবামাত্র আমার হৃদয় এমন সঘনে স্পন্দিত হইতে লাগিল যে, কেহ বিশ হাত তফাতে থাকিয়াও সে শব্দ শুনিতে পাইত, আমি চারিদিকে অন্ধকার দেখিলাম।
যাহা হউক এত দিনে এই সয়তানী এই পৃথিবী হইতে দূর হইয়াছে। সেই পর্য্যন্ত আমার আর কোন অশান্তি নাই! আমার যে পরিবর্তন ঘটিয়াছিল, আমার শরীর যেরূপ অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিল,—তাহা ধীরে ধীরে ক্রমে ক্রমে আগেকার মত স্বাভাবিক অবস্থা প্রাপ্ত হইতে লাগিল। এক সপ্তাহের মধ্যেই সকলে আমার দেহের, মনের আশ্চর্য্য পরিবর্তন দেখিয়া নিত্যন্ত বিস্মিত হইতে লাগিল।
১লা মে।—ঊষার সহিত আমার বিবাহ হইয়া গিয়াছে, আমি পৃথিবীর মধ্যে এখন সৰ্ব্বাপেক্ষা সুখী হইয়াছি। এক্ষেণে আমার মত সুখী সৌভাগ্যবান্ আর জগতে কে?
যাহারা আমাকে পূৰ্ব্বে উন্মত্ত হইয়া গিয়াছি বলিয়া স্থির করিয়াছিল, তাহারা আমাতে আর কোন উন্মত্ততার লক্ষণ না দেখিয়া—বিশেষতঃ আমার বিবাহ হওয়ায়, সকলেই তাহাদের পূৰ্ব্ব মতের পরিবর্ত্তন করিল। সকলেই আমার গৃহত্যাগ করিয়াছিল, এক্ষণে সকলেই একে একে আমার বাড়ীতে আসিয়া সমবেত হইল। সংসারের ভাবই এই! আজ যাহাকে লোকে মাথায় রাখিতেছে, কাল তাহাকে পদদলিত করিয়া থাকে।
১লা জুলাই।—আমি কালেজে আবার পড়াইতে আরম্ভ করিয়াছি। কর্তৃপক্ষগণ আমাকে বিশেষ সমাদরে অভ্যর্থনা করিয়া লইয়াছেন। ছেলেরাও খুব সন্তুষ্ট হইয়াছে। দিন দিন আমার মান সম্ভ্রম যশঃ বৃদ্ধি পাইতেছে! এক কুহকিনীর হস্তে পড়িয়া আমার কি দশা হইয়াছিল, তাহা ভাবিলে প্রাণ শিহরিয়া উঠে!
সময়ে সময়ে মনে হয়,—আমার যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা সত্য কি না, আমার আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব যাহা ভাবিয়াছিল, তাহাই ঠিক; কয়েক মাসের জন্য আমার একরূপ উন্মাদ রোগ জন্মিয়াছিল। সে ভয়াবহ রোগ আপনি হইয়াছিল, আপনি আরোগ্য হইয়া গিয়াছে।
আমি মনকে এ কথা শতবার বলিলেও মন ইহা বিশ্বাস করিতে চাহে না, কারণ আমি সজ্ঞানে দিব্যচক্ষে সেই পিশাচীর কার্য্যকলাপ দেখিয়াছি। সে অনায়াসে তাহার সম্মুখে আমাকে অজ্ঞান করিয়াছে—আবার জাগিতে বলিলে আমি জাগিয়া উঠিয়াছি। .
তাহার পর সে আমার কি দুদর্শা করিয়াছিল, তাহা এই ডায়েরীতে লিপিবদ্ধ করিয়াছি। এ সকল অপরে অবিশ্বাস করিতে পারে—বিজ্ঞানের বাহিরে বলিয়া হাসিতে পারে—কিন্তু আমি নিজে ইহা দেখিয়াছি, আমি নিজে ইহা উপলব্ধি করিয়াছি, আমি হাসিতে পারি না—অবিশ্বাসও করিতে পারি না।
তাহা হইলে এ রকম বশীকরণ সম্ভব। এক জনের দেহ হইতে তাহার আত্মাকে দূর করিয়া দিয়া, অথবা সেই আত্মাকে সম্পূর্ণ বশীভূত করিয়া তাহার দেহে নিজের আত্মা পাঠাইয়া দিয়া তাহাকে দিয়া যাহা ইচ্ছা করা যায়—ইহা অসম্ভব নহে—সম্পূর্ণ সম্ভব। চোখের উপর দেখিলাম, উপলব্ধি করিলাম, অসম্ভব বলি কি রূপে? এখনও আমাদের পুঁথিগত বিজ্ঞান শৈশব অবস্থায় আছে মাত্র।
এই শক্তি লাভ করিতে পারিলে না জানি জগতের কত উপকারই করিতে পারা যায়! আবার এই মহাশক্তির অপব্যবহার করিলে জগতের কি না সর্ব্বনাশ সংসাধিত হয়?
এইজন্য এ বিদ্যা জগৎ হইতে বিলুপ্ত হওয়া উচিত না বিস্তার হওয়া আবশ্যক, ইহা স্থির করা সমূহ কঠিন।