৪৪
বাইরে অন্ধকারে দরজার আড়ালে একটি মানুষ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল– হাবলু। কম সাহস না। মধুসূদনকে যমের মতো ভয় করে, তবু ছিল কাঠের পুতুলের মতো স্তব্ধ হয়ে। সেদিন মধুসূদনের কাছে তাড়া খাওয়ার পর থেকে জ্যাঠাইমার কাছে আসবার সুবিধে হয় নি, মনের ভিতর ছট্ফট্ করেছে। আজ এই সন্ধ্যাবেলায় আসা নিরাপদ ছিল না। কিন্তু ওকে বিছানায় শুইয়ে রেখে মা যখন ঘরকন্নার কাজে চলে গেছে এমন সময় কানে এল এসরাজের সুর। কী বাজছে জানত না, কে বাজাচ্ছে বুঝতে পারে নি, জ্যাঠাইমার ঘর থেকে আসছে এটা নিশ্চিত; জ্যাঠামশায় সেখানে নেই এই তার বিশ্বাস, কেননা, তাঁর সামনে কেউ বাজনা বাজাতে সাহস করবে এ কথা সে মনেই করতে পারে না। উপরের তলায় দরজার কাছে এসে জ্যাঠামশায়ের জুতোজোড়া দেখেই পালাবার উপক্রম করলে। কিন্তু যখন বাইরে থেকে চোখে পড়ল ওর জ্যাঠাইমা নিজে বাজাচ্ছেন, তখন কিছুতেই পালাতে পা সরল না। দরজার আড়ালে লুকিয়ে শুনতে লেগেছে। প্রথম থেকেই জ্যাঠাইমাকে ও জানে আশ্চর্য, আজ বিস্ময়ের অন্ত নেই। মধুসূদন চলে যেতেই মনের উচ্ছ্বাস আর ধরে রাখতে পারলে না– ঘরে ঢুকেই কুমুর কোলে গিয়ে বসে গলা জড়িয়ে ধরে কানের কাছে বললে, “জ্যাঠাইমা।”
কুমু তাকে বুকে চেপে ধরে বললে, “এ কী, তোমার হাত যে ঠাণ্ডা! বাদলার হাওয়া লাগিয়েছ বুঝি?”
হাবলু কোনো উত্তর করলে না, ভয় পেয়ে গেল। ভাবলে জ্যাঠাইমা এখনই বুঝি বিছানায় শুতে পাঠিয়ে দেবে। কুমু তাকে শালের মধ্যে ঢেকে নিয়ে নিজের দেহের তাপে গরম করে বললে, “এখনো শুতে যাও নি গোপাল?”
“তোমার বাজনা শুনতে এসেছিলুম। কেমন করে বাজাতে পারলে জ্যাঠাইমা?”
“তুমি যখন শিখবে তুমিও পারবে।”
“আমাকে শিখিয়ে দেবে?”
এমন সময় মোতির মা ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকেই বলে উঠল, “এই বুঝি দস্যি, এখানে লুকিয়ে বসে! আমি ওকে সাতরাজ্যি খুঁজে বেড়াচ্ছি। এ দিকে সন্ধ্যাবেলায় ঘরের বাইরে দু পা চলতে গা ছম্ ছম্ করে, জ্যাঠাইমার কাছে আসবার সময় ভয়ডর থাকে না। চল্ শুতে চল্।”
হাবলু কুমুকে আঁকড়ে ধরে রইল।
কুমু বললে, “আহা, থাক্-না আর-একটু।”
“এমন করে সাহস বেড়ে গেলে শেষকালে বিপদে পড়বে। ওকে শুইয়ে আমি এখনই আসছি।”
কুমুর বড়ো ইচ্ছে হল হাবলুকে কিছু দেয়, খাবার কিম্বা খেলার জিনিস। কিন্তু দেবার মতো কিছু নেই, তাই ওকে চুমো খেয়ে বললে, “আজ শুতে যাও, লক্ষ্মী ছেলে, কাল দুপুরবেলা তোমাকে বাজনা শোনাব।”
হাবলু করুণ মুখে উঠে মায়ের সঙ্গে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পরেই মোতির মা ফিরে এল। নবীনের ষড়যন্ত্রের কী ফল হল তাই জানবার জন্যে মন অস্থির হয়ে আছে। কুমুর কাছে বসেই চোখে পড়ল, তার হাতে সেই নীলার আংটি। বুঝলে যে কাজ হয়েছে। কথাটা উত্থাপন করবার উপলক্ষ স্বরূপ বললে, “দিদি, তোমার এই বাজনাটা পেলে কেমন করে?”
কুমু বললে, “দাদা পাঠিয়ে দিয়েছেন।”
“বড়োঠাকুর তোমাকে এনে দিলেন বুঝি?”
কমু সংক্ষেপে বললে, “হাঁ।”
মোতির মা কুমুর মুখের দিকে তাকিয়ে উল্লাস বা বিস্ময়ের চিহ্ন খুঁজে পেলে না।
“তোমার দাদার কথা কিছু বললেন কি?”
“না।”
“পরশু তিনি তো আসবেন, তাঁর কাছে তোমার যাবার কথা উঠল না?”
“না, দাদার কোনো কথা হয় নি।”
“তুমি নিজেই চাইলে না কেন দিদি?”
“আমি ওঁর কাছে আর যা-কিছু চাই নে কেন, এটা পারব না।”
“তোমার চাবার দরকার হবে না, তুমি অমনিই ওঁর কাছে চলে যেয়ো। বড়োঠাকুর কিছুই বলবেন না।”
মোতির মা এখনো একটা কথা সম্পূর্ণ বুঝতে পারে নি যে, মধুসূদনের অনুকূলতা কুমুর পক্ষে সংকট হয়ে উঠেছে; এর বদলে মধুসূদন যা চায় তা ইচ্ছে করলেও কুমু দিতে পারে না। ওর হৃদয় হয়ে গেছে দেউলে। এইজন্যেই মধূসূদনের কাছে দান গ্রহণ করে ঋণ বাড়াতে এত সংকোচ। কুমুর এমনও মনে হয়েছে যে, দাদা যদি আর কিছুদিন দেরি করে আসে তো সেও ভালো।
একটু অপেক্ষা করে থেকে মোতির মা বললে, “আজ মনে হল বড়োঠাকুরের মন যেন প্রসন্ন।”
সংশয়ব্যাকুল চোখে কুমু মোতির মার মুখে তাকিয়ে বললে, “এ প্রসন্নতা কেন ঠিক বুঝতে পারি নে, তাই আমার ভয় হয়; কী করতে হবে ভেবে পাই নে।”
কুমুর চিবুক ধরে মোতির মা বললে, “কিছুই করতে হবে না; এটুকু বুঝতে পারছ না, এতদিন উনি কেবল কারবার করে এসেছেন, তোমার মতো মেয়েকে কোনোদিন দেখেন নি। একটু একটু করে যতই চিনছেন ততই তোমার আদর বাড়ছে।”
“বেশি দেখলে বেশি চিনবেন, এমন কিছুই আমার মধ্যে নেই ভাই। আমি নিজেই দেখতে পাচ্ছি আমার ভিতরটা শূন্য। সেই ফাঁকটাই দিনে দিনে ধরা পড়বে। সেইজন্যেই হঠাৎ যখন দেখি উনি খুশি হয়েছেন, আমার মনে হয় উনি বুঝি ঠকেছেন। যেই সেটা ফাঁস হবে সে-ই আরো রেগে উঠবেন। সেই রাগটাই যে সত্য, তাই তাকে আমি তেমন ভয় করি নে।”
“তোমার দাম তুমি কী জান দিদি! যেদিন এদের বাড়িতে এসেছ, সেইদিনই তোমার পক্ষ থেকে যা দেওয়া হল, এরা সবাই মিলে তা শুধতে পারবে না। আমার কর্তাটি তো একেবারে মরিয়া, তোমার জন্যে সাগর লঙ্ঘন না করতে পারলে স্থির থাকতে পারছেন না। আমি যদি তোমাকে না ভালোবাসতুম তবে এই নিয়ে ওর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়ে যেত।”
কুমু হাসলে, বললে, “কত ভাগ্যে এমন দেবর পেয়েছি।”
“আর তোমার এই জা-টি বুঝি ভাগ্যস্থানের রাহু না কেতু।”
“তোমাদের একজনের নাম করলে আর-একজনের নাম করবার দরকার হয় না।”
মোতির মা ডান হাত দিয়ে কুমুর গলা জড়িয়ে ধরে বললে, “আমার একটা অনুরোধ আছে তোমার কাছে।”
“কী বলো।”
“আমার সঙ্গে তুমি “মনের কথা’ পাতাও!”
“সে বেশ কথা, ভাই! প্রথম থেকে মনে মনে পাতানো হয়েই গেছে।”
“তা হলে আমার কাছে কিছু চেপে রেখো না। আজ তুমি অমন মুখটি করে কেন আছ কিছুই বুঝতে পারছি নে।”
খানিকক্ষণ মোতির মার মুখের দিকে চেয়ে থেকে কুমু বললে, “ঠিক কথা বলব? নিজেকে আমার কেমন ভয় করছে।”
“সে কী কথা! নিজেকে কিসের ভয়?”
“আমি এতদিন নিজেকে যা মনে করতুম আজ হঠাৎ দেখছি তা নই। মনের মধ্যে সমস্ত গুছিয়ে নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েই এসেছিলুম। দাদারা যখন দ্বিধা করেছেন, আমি জোর করেই নতুন পথে পা বাড়িয়েছি। কিন্তু যে মানুষটা ভরসা করে বেরোল তাকে আজ কোথাও দেখতে পাচ্ছি নে।”
“তুমি ভালোবাসতে পারছ না। আচ্ছা, আমার কাছে লুকিয়ো না, সত্যি করে বলো, কাউকে কি ভালোবেসেছ? ভালোবাসা কাকে বলে তুমি কি জান?”
“যদি বলি জানি, তুমি হাসবে। সূর্য ওঠবার আগে যেমন আলো হয় আমার সমস্ত আকাশ ভরে ভালোবাসা তেমনি করেই জেগেছিল। কেবলই মনে হয়েছে সূর্য উঠল বলে। সেই সূর্যোদয়ের কল্পনা মাথায় করেই আমি বেরিয়েছি, তীর্থের জল নিয়ে– ফুলের সাজি সাজিয়ে। যে দেবতাকে এতদিন সমস্ত মন দিয়ে মেনে এসেছি, মনে হয়েছে তাঁর উৎসাহ পেলুম। যেমন করে অভিসারে বেরোয় তেমনি করেই বেরিয়েছি। অন্ধকার রাত্রিকে অন্ধকার বলে মনেই হয় নি, আজ আলোতে চোখ মেলে অন্তরেই বা কী দেখলুম, বাইরেই বা কী দেখছি! এখন বছরের পর বছর মূহূর্তের পর মূহূর্ত কাটবে কী করে?
“তুমি কি বড়োঠাকুরকে ভালোবাসতে পারবে না মনে কর?”
“পারতুম ভালোবাসতে। মনের মধ্যে এমন কিছু এনেছিলুম যাতে সবই পছন্দমত করে নেওয়া সহজ হত। গোড়াতেই সেইটেকে তোমার বড়োঠাকুর ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। আজ সব জিনিস কড়া হয়ে আমাকে বাজছে। আমার শরীরের উপরকার নরম ছালটাকে কে যেন ঘষড়ে তুলে দিল, তাই চারি দিকে সবই আমাকে লাগছে, কেবলই লাগছে, যা-কিছু ছুঁই তাতেই চমকে উঠি; এর পরে কড়া পড়ে গেলে কোনো একদিন হয়তো সয়ে যাবে, কিন্তু জীবনে কোনোদিন আর আনন্দ পাব না তো।”
“বলা যায় না ভাই।”
“খুব বলা যায়। আজ আমার মনে একটুমাত্র মোহ নেই। আমার জীবনটা একেবারে নির্লজ্জের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। নিজেকে একটু ভোলাবার মতো আড়াল কোথাও বাকি রইল না। মরণ ছাড়া মেয়েদের কি আর কোথাও নড়ে বসবার একটুও জায়গা নেই? তাদের সংসারটাকে নিষ্ঠুর বিধাতা এত আঁট করেই তৈরি করেছে?”
এতক্ষণ ধরে এমনতরো উত্তেজনার কথা কুমুর মুখে মোতির মা আর-কোনোদিন শোনে নি। বিশেষ করে আজ যেদিন বড়োঠাকুরকে ওরা কুমুর প্রতি এতটা প্রসন্ন করে এনেছে, সেইদিনই কুমুর এই তীব্র অধৈর্য দেখে মোতির মা ভয় পেয়ে গেল। বুঝলে লতার একেবারে গোড়ায় ঘা লেগেছে, উপর থেকে অনুগ্রহের জল ঢেলে মালী আর একে তাজা করে তুলতে পারবে না।
একটু পরে কুমু বলে উঠল, “জানি, স্বামীকে এই যে শ্রদ্ধার সঙ্গে আত্মসমর্পণ করতে পারছি নে এ আমার মহাপাপ। কিন্তু সে পাপেও আমার তেমন ভয় হচ্ছে না যেমন হচ্ছে শ্রদ্ধাহীন আত্মসমর্পণের গ্লানির কথা মনে করে।”
মোতির মা কোনো উত্তর না ভেবে পেয়ে হতবুদ্ধির মতো বসে রইল। একটু চুপ করে থেকে কুমু বললে, “তোমার কত ভাগ্যি ভাই, কত পুণ্যি করেছিলে, ঠাকুরপোকে এমন সমস্ত মনটা দিয়ে ভালোবাসতে পেরেছ। আগে মনে করতুম, ভালোবাসাই সহজ– সব স্ত্রী সব স্বামীকে আপনিই ভালোবাসে। আজ দেখতে পাচ্ছি ভালোবাসতে পারাটাই সব চেয়ে দুর্লভ, জন্মজন্মান্তরের সাধনায় ঘটে। আচ্ছা ভাই, সত্যি বলো সব স্ত্রীই কি স্বামীকে ভালোবাসে?
মোতির মা একটু হেসে বলল, “ভালো না বাসলেও ভালো স্ত্রী হওয়া যায়, নইলে সংসার চলবে কী করে?”
“সেই আশ্বাস দাও আমাকে। আর কিছু না হই ভালো স্ত্রী যেন হতে পারি। পুণ্য তাতেই বেশি, সেইটেই কঠিন সাধনা।”
“বাইরে থেকে তাতেও বাধা পড়ে।”
“অন্তর থেকে সে বাধা কাটিয়ে উঠতে পারা যায়। আমি পারব, আমি হার মানব না।”
“তুমি পারবে না তো কে পারবে?”
বৃষ্টি জোর করে চেপে এল। বাতাসে ল্যাম্পের আলো থেকে থেকে চকিত হয়ে ওঠে। দমকা হাওয়া যেন একটা ভিজে নিশাচর পাখির মতো পাখা ঝাপ্টে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। কুমুর শরীরটা মনটা শির্ শির্ করে উঠল। সে বললে, “আমার ঠাকুরের নামে আর জোর পাচ্ছি নে। মন্ত্র আবৃত্তি করে যাই, মনটা মুখ ফিরিয়ে থাকে, কিছুতে সাড়া দিতে চায় না। তাতেই সব চেয়ে ভয় হয়।”
বানানো কথায় মিথ্যে ভরসা দিতে মোতির মার ইচ্ছে হল না। কোনো উত্তর না করে সে কুমুকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরলে। এমন সময় বাইরে থেকে আওয়াজ পাওয়া গেল, “মেজোবউ।”
কুমু খুশি হয়ে উঠে বললে,”এসো, এসো ঠাকুরপো।”
“সন্ধ্যাবেলাকার ঘরের আলোটিকে ঘরে দেখতে পেলুম না, তাই খুঁজতে বেরিয়েছি।”
মোতির মা বললে, “হায় হায়, মণিহারা ফণী যাকে বলে।”
“কে মণি আর কে ফণী তা চক্র নাড়া দেখলেই বোঝা যায়, কী বল বউরানী।”
“আমাকে সাক্ষী মেনো না ঠাকুরপো।”
“জানি, তা হলে আমি ঠকব।”
“তা তোমার হারাধনকে তুমি উদ্ধার করে নিয়ে যাও, আমি ধরে রাখব না।”
“হরাধনের জন্যে ওঁর কোনো উৎসাহ নেই দিদি, ছুতো করে বউরানীর চরণ দর্শন করতে এসেছেন।”
“ছুতোর কি কোনো দরকার আছে? চরণ আপনি ধরা দিয়েছে। সব চেয়ে যা অসাধ্য তার সাধনা করবে কে? সে যখন আসে সহজেই আসে। পৃথিবীতে হাজার হাজার মানুষ আছে আমার চেয়ে যোগ্য, তবু অমন সুন্দর পা দুখানি আমিই পারলুম ছুঁতে, তারা তো পারলে না। নবীনের জন্ম সার্থক হয়ে গেল বিনামূল্যে।”
“আঃ, কী বল ঠাকুরপো, তার ঠিক নেই। তোমার এনসাইাক্লোপীডিয়া থেকে বুঝি–”
“অমন কথা বলতে পারবে না বউরানী। চরণ বলতে কী বোঝায় তা ওরা জানবে কী করে? ছাগলের খুরের মতো সরু সরু ঠেকোওয়ালা জুতোর মধ্যে লক্ষ্মীদের পা কড়া জেনানার মধ্যে ওরা বন্দী করে রেখেছে। সাইক্লোপীডিয়াওয়ালার সাধ্য কী পায়ের মহিমা বোঝে। লক্ষ্মণ চোদ্দটা বৎসর কেবল সীতার পায়ের দিকে তাকিয়েই নির্বাসন কাটিয়ে দিলেন, তার মানে আমাদের দেশের দেওররাই জানে। তা পায়ের উপর শাড়ি টেনে দিচ্ছ তো দাও। ভয় নেই তোমার, পদ্ম সন্ধেবেলায় মুদে থাকে বলে তো বরাবর মুদেই থাকে না– আবার তো পাপড়ি খোলে।”
“ভাই মনের কথা, এমনিতরো স্তব করেই বুঝি ঠাকুরপো তোমার মন ভুলিয়েছেন?”
“একটুও না দিদি, মিষ্টি কথার বাজে খরচ করবার লোক নন উনি।”
“স্তুতির বুঝি দরকার হয় না?”
“বউরানী, স্তুতির ক্ষুধা দেবীদের কিছুতেই মেটে না, দরকার খুব আছে। কিন্তু শিবের মতো আমি তো পঞ্চানন নই, এই একটিমাত্র মুখের স্তুতি পুরোনো হয়ে গেছে এতে উনি আর রস পাচ্ছেন না।”
এমন সময় মুরলী বেয়ারা এসে নবীনকে খবর দিলে, “কর্তা-মহারাজা বাইরের আপিসঘরে ডাক দিয়েছেন।”
শুনে নবীনের মন খারাপ হয়ে গেল। সে ভেবেছিল মধুসূদন আজ আপিস থেকে ফিরেই একেবারে সোজা তার শোবার ঘরে এসে উপস্থিত হবে। নৌকো বুঝি আবার ঠেকে গেল চড়ায়।
নবীন চলে গেলে মোতির মা আস্তে আস্তে বললে, “বড়োঠাকুর কিন্তু তোমাকে ভালোবাসেন সে কথা মনে রেখো।”
কুমু বললে, “সেইটেই তো আমার আশ্চর্য ঠেকে।”
“বল কী, তোমাকে ভালোবাসা আশ্চর্য কেন? উনি কি পাথরের?”
“আমি ওঁর যোগ্য না।”
“তুমি যাঁর যোগ্য নও সে পুরুষ কোথায় আছে?”
“ওঁর কতবড়ো শক্তি, কত সম্মান, কত পাকা বুদ্ধি, উনি কত মস্ত মানুষ। আামার মধ্যে উনি কতটুকু পেতে পারেন? আমি যে কী অসম্ভব কাঁচা, তা এখানে এসে দুদিনে বুঝতে পেরেছি। সেই জন্যেই যখন উনি ভালোবাসেন তখনই আমার সব চেয়ে বেশি ভয় করে। আমি নিজের মধ্যে যে কিছুই খুঁজে পাই নে। এতবড়ো ফাঁকি নিয়ে আমি ওঁর সেবা করব কী করে? কাল রাত্তিরে বসে বসে মনে হল আমি যেন বেয়ারিং লেফাফা, আমাকে দাম দিয়ে নিতে হয়েছে, খুলে ফেললেই ধরা পারবে যে ভিতরে চিঠিও নেই।”
“দিদি হাসালে। বড়োঠাকুরের মস্তবড়ো কারবার, কারবারি বুদ্ধিতে ওঁর সমান কেউ নেই, সব জানি । কিন্তু তুমি কি ওঁর কারবারের ম্যানেজারি করতে এসেছ যে, যোগ্যতা নেই বলে ভয় পাবে? বড়োঠাকুর যদি মনের কথা খোলসা করে বলেন তবে নিশ্চয় বলবেন, তিনিও তেমার যোগ্য নন।”
“সে কথা তিনি আমাকে বলেছিলেন।”
“বিশ্বাস হয় নি?”
“না। উলটে আমার ভয় হয়েছিল। মনে হয়েছিল আমার সম্বন্ধে ভুল করলেন, সে ভুল ধরা পড়বে।”
“কেন তোমার এমন মনে হল বলো দেখি?
“বলব? এই-যে আমার হঠাৎ বিয়ে হয়ে গেল, এ তো সমস্ত আমি নিজে ঘটিয়ে তুললুম– কিন্তু কী অদ্ভুত মোহে, কী ছেলেমানুষি করে! যা-কিছুতে আমাকে সেদিন ভুলিয়েছিল তার মধ্যে সমস্তই ছিল ফাঁকি। অথচ এমন দৃঢ় বিশ্বাস, এমন বিষম জেদ যে, সেদিন আমাকে কিছুতেই কেউ ঠেকাতে পারত না। দাদা তা নিশ্চিত জানতেন বলেই বৃথা বাধা দিলেন না; কিন্তু কত ভয় পেয়েছেন, কত উদ্বিগ্ন হয়েছেন, তা কি আমি বুঝতে পারি নি? বুঝতে পেরেও নিজের ঝোঁকটাকে একটুও সামালাই নি, এতবড়ো অবুঝ আমি। আজ থেকে চিরদিন আমি কেবলই কষ্ট পাব, কষ্ট দেব, আর প্রতিদিন মনে জানব এ সমস্তই আমার নিজের সৃষ্টি।”
মোতির মা কী যে বলবে কিছুই ভেবে পেলে না। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলে, “আচ্ছা দিদি, তুমি যে বিয়ে করতে মন স্থির করলে, কী ভেবে?”
“তখন নিশ্চিত জানতুম, স্বামী ভালোমন্দ যাই হোক-না কেন স্ত্রীর সতীত্বগৌরব প্রমাণের একটা উপলক্ষমাত্র। মনে একটুও সন্দেহ ছিল না যে, প্রজাপতি যাকেই স্বামী বলে ঠিক করে দিয়েছেন তাকেই ভালোবাসবই। ছেলেবেলা থেকে কেবল মাকে দেখেছি, পুরাণ পড়েছি, কথকতা শুনেছি, মনে হয়েছে শাস্ত্রের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে চলা খুব সহজ।
“দিদি, উনিশ বছরের কুমারীর জন্যে শাস্ত্র লেখা হয় নি।”
“আজ বুঝতে পেরেছি সংসারে ভালোবাসাটা উপরি-পাওনা। ওটাকে বাদ দিয়ে ধর্মকে আঁকড়ে ধরে সংসারসমুদ্রে ভাসতে হবে। ধর্ম যদি সরস হয়ে ফুল না দেয়, ফল না দেয়, অন্তত শুকনো হয়ে যেন ভাসিয়ে রাখে।”
মোতির মা নিজে বিশেষ কিছু না বলে কুমুকে দিয়ে কথা বলিয়ে নিতে লাগল।
৪৫
মধুসূদন আপিসে গিয়েই দেখলে খবর ভালো নয়। মাদ্রাজের এক বড়ো ব্যাঙ্ক ফেল করেছে, তাদের সঙ্গে এদের কারবার। তার পরে কানে এল যে, কোনো ডাইরেক্টরের তরফ থেকে কোনো কর্মচারী মধুসূদনের অজানিতে খাতাপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছে। এতদিন কেউ মধুসূদনকে সন্দেহ করতে সাহস করে নি, একজন যেই ধরিয়ে দিয়েছে অমনি যেন একটি মন্ত্রশক্তি ছুটে গেল। বড়ো কাজের ছোটো ত্রুটি ধরা সহজ, যারা মাতব্বর সেনাপতি তারা কত খুচরো হারের ভিতর দিয়ে মোটের উপর মস্ত করেই জেতে। মধুসূদন বরাবর তেমনি জিতেই এসেছে– তাই বেছে বেছে খুচরো হার কারো নজরেই পড়েনি। কিন্তু বেছে বেছে তারই একটা ফর্দ বানিয়ে সেটা সাধারণ লোকের নজরে তুললে তারা নিজের বুদ্ধির তারিফ করে বলে আমরা হলে এ ভুল করতুম না। কে তাদের বোঝাবে যে, নৌকো নিয়েই মধুসূদন পাড়ি দিয়েছে, নইলে পাড়ি দেওয়াই হত না, আসল কথাটা এই যে কূলে পৌঁছোল। আজ নৌকোটা ডাঙায় তুলে ফুটোগুলোর বিচার করবার বেলায়, যারা নিরাপদে এসেছে ঘাটে, তাদের গা শিউরে উঠেছে। এমনতরো টুকরো সমালোচনা নিয়ে আনাড়িদের ধাঁধা লাগানো সহজ। সাধারণত আনাড়িদের সুবিধে এই যে, তারা লাভ করতে চায়, বিচার করতে চায় না। কিন্তু যদি দৈবাৎ বিচার করতে বসে তবে মারত্মক হয়ে ওঠে। এই-সব বোকাদের উপর মধুসূদনের নিরতিশয় অবজ্ঞা-মিশ্রিত ক্রোধের উদয় হল। কিন্তু বোকাদের যেখানে প্রধান্য সেখানে তাদের সঙ্গে রফা করা ছাড়া গতি নেই। জীর্ণ মই মচ্ মচ্ করে, দোলে, ভাঙার ভয় দেখায়, যে ব্যক্তি উপরে চড়ে তাকে এই পায়ের তলার অবলম্বনটাকে বাঁচিয়ে চলতেই হয়। রাগ করে লাথি মারতে ইচ্ছে করে, তাতে মুশকিল আরো বাড়বারই কথা।
শাবকের বিপদের সম্ভাবনা দেখলে সিংহিনী নিজের আহারের লোভ ভুলে যায়, ব্যাবসা সম্বন্ধে মধুসূদনের সেইরকম মনের অবস্থা। এ যে তার নিজের সৃষ্টি; এর প্রতি তার যে দরদ সে প্রধানত টাকার দরদ নয়। যার রচনাশক্তি আছে, আপন রচনার মধ্যে সে নিজেকেই নিবিড় করে পায়, সেই পাওয়াটা যখন বিপন্ন হয়ে ওঠে তখন জীবনের আর-সমস্ত সুখদুঃখকামনা তুচ্ছ হয়ে যায়। কুমু মধুসূদনকে কিছুদিন থেকে প্রবল টানে টেনেছিল, সেটা হঠাৎ আলগা হয়ে গেল। জীবনে ভালোবাসার প্রয়োজনটা মধুসূদন প্রৌঢ় বয়সে খুব জোরের সঙ্গে অনুভব করেছিল। এই উপসর্গ যখন অকালে দেখা দেয় তখন উদ্দাম হয়েই ওঠে। মধুসূদনকে ধাক্কা কম লাগে নি, কিন্তু আজ তার বেদনা গেল কোথায়?
নবীন ঘরে আসতেই মধূসূদন জিজ্ঞাসা করলে, “আমার প্রাইভেট জমাখরচের খাতা বাইরের কোনো লোকের হাতে পড়েছে কি, জান?”
নবীন চমকে উঠল, বললে, “সে কী কথা?
“তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে খাতাঞ্জির ঘরে কেউ আনাগোনা করছে কি না।”
“রতিকান্ত বিশ্বাসী লোক, সে কি কখনো–”
“তার অজান্তে মুহুরিদের সঙ্গে কেউ কথা চালাচালি করছে বলে সন্দেহের কারণ ঘটেছে। খুব সাবধানে খবরটা জানা চাই কারা এর মধ্যে আছে।”
চাকর এসে খবর দিলে খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। মধুসূদন সে কথায় মন না দিয়ে নবীনকে বললে, “শীঘ্র আমার গাড়িটা তৈরি করে আনতে বলে দাও।”
নবীন বললে, “খেয়ে বেরোবে না? রাত হয়ে আসছে?
“বাইরেই খাব, কাজ আছে।”
নবীন মাথা হেঁট করে ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে এল। সে যে কৌশল করেছিল ফেঁসে গেল বুঝি।
হঠাৎ মধুসূদন নবীনকে ফিরে ডেকে বললে, “এই চিঠিখানা কুমুকে দিয়ে এসো।”
নবীন দেখলে বিপ্রদাসের চিঠি। বুঝলে এ চিঠি আজ সকালেই এসেছে, সন্ধেবেলায় নিজের হাতে কুমুকে দেবে বলে মধুসূদন রেখেছিল। এমনি করে প্রত্যেকবার মিলন উপলক্ষে একটা-কিছু অর্ঘ্য হাতে করে আনবার ইচ্ছে। আজ আপিসের কাজে হঠাৎ তুফান উঠে তার এই আদরের আয়োজনটুকু গেল ডুবে।
মাদ্রাজে যে ব্যাঙ্ক ফেল করেছে সেটার উপরে সাধারণের নিশ্চিত আস্থা ছিল। তার সঙ্গে ঘোষাল-কোম্পানির যে যোগ সে সম্বন্ধে অধ্যক্ষদের বা অংশীদারদের কারো মনে কিছুমাত্র সংশয় ছিল না। যেই কল বিগড়ে গেল অমনি অনেকেই বলাবলি করতে আরম্ভ করলে যে, আমরা গোড়া থেকেই ঠাউরেছিলুম, ইত্যাদি।
সাংঘাতিক আঘাতের সময় ব্যাবসাকে যখন একজোট হয়ে রক্ষার চেষ্টা দরকার, সেই সময়েই পরাজয়ের সম্বন্ধে দোষারোপ প্রবল হয়ে ওঠে এবং যাদের প্রতি কারো ঈর্ষা আছে তাদেরকে অপদস্থ করবার চেষ্টায় টলমলে ব্যাবসাকে কাত করে ফেলা হয়। সেইরকম চেষ্টা চলবে মধুসূদন তা বুঝেছিল। মাদ্রাজ-ব্যাঙ্কের বিপর্যয়ে ঘোষাল-কোম্পানির লোকসানের পরিমাণ যে কতটা দাঁড়াবে এখনো তা নিশ্চিত জানবার সময় হয় নি, কিন্তু মধুসূদনের প্রতিপত্তি নষ্ট করবার আয়োজনে এও যে একটা মসলা জোগাবে তাতে সন্দেহ ছিল না। যাই হোক, সময় খারাপ, এখন অন্য সব কথা ভুলে এইটেতেই মধুসূদনকে কোমর বাঁধতে হবে।
রাত্রে মধুসূদনের সঙ্গে আলাপ হবার পর নবীন ফিরে এসে দেখলে কুমুর সঙ্গে মোতির মার তখনো কথা চলছে। নবীন বললে, “বউরানী, তোমার দাদার চিঠি আছে।”
কুমু চমকে উঠে চিঠিখানা নিলে। খুলতে হাত কাঁপতে লাগল। ভয় হল হয়তো কিছু অপ্রিয় সংবাদ আছে। হয়তো এখন আসাই হবে না। খুব ধীরে ধীরে খাম খুলে পড়ে দেখলে। একটু চুপ করে রইল। মুখ দেখে মনে হল যেন কোথায় ব্যথা বেজেছে। নবীনকে বললে, “দাদা আজ বিকেলে তিনটের সময় কলকাতায় এসেছেন।”
“আজই এসেছেন। তাঁর তো–”
“লিখেছেন দুই-একদিন পরে আসবার কথা ছিল কিন্তু বিশেষ কারণে আগেই আসতে হল?”
কুমু আর কিছু বললে না। চিঠির শেষ দিকে ছিল, একটু সেরে উঠলেই বিপ্রদাস কুমুকে দেখতে আসবে, সেজন্যে কুমু যেন ব্যস্ত বা উদ্বিগ্ন না হয়। এই কথাটাই আগেকার চিঠিতেও ছিল। কেন, কী হয়েছে? কুমু কী অপরাধ করেছে? এ যেন একরকম স্পষ্ট করেই বলা, তুমি আমাদের বাড়িতে এসো না। ইচ্ছে করল মাটিতে লুটিয়ে পড়ে খানিকটা কেঁদে নেয়। কান্না চেপে পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে রইল।
নবীন বুঝলে চিঠির মধ্যে একটা কী কঠিন মার আছে। কুমুর মুখ দেখে করুণায় ওর মন ব্যথিত হয়ে উঠল। বললে, “বউরানী, তাঁর কাছে তো কালই তোমার যাওয়া চাই।”
“না, আমি যাব না।” যেমনি বলা অমনি আর থাকতে পারলে না, দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল।
মোতির মা কোনো প্রশ্ন না করে কুমুকে বুকের কাছে টেনে নিলে, কুমু রুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠল, “দাদা আমাকে যেতে বারণ করেছেন।”
নবীন বললে, “না না, বউরানী তুমি নিশ্চয় ভুল বুঝেছ।”
কুমু খুব জোরে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলে যে, সে একটুও ভুল বোঝে নি।
নবীন বললে, “তুমি কোথায় ভুল বুঝেছ বলব? বিপ্রদাসবাবু মনে করেছেন আমার দাদা তোমাকে তাঁদের ওখানে যেতে দিতে চাইবেন না। চেষ্টা করতে গিয়ে পাছে তোমাকে অপমানিত হতে হয়, পাছে তুমি কষ্ট পাও, সেইটে বাঁচাবার জন্যে তিনি নিজে থেকে তোমার রাস্তা সোজা করে দিয়েছেন।”
কুমু এক মুহূর্তে গভীর আরাম পেল। তার ভিজে চোখের পল্লব নবীনের মুখের দিকে তুলে স্নিগ্ধদৃষ্টিতে চুপ করে চেয়ে রইল। নবীনের কথাটা যে সম্পূর্ণ সত্য তাতে একটুও সন্দেহ রইল না। দাদার স্নেহকে ক্ষণকালের জন্যেও ভুল বুঝতে পেরেছে বলে নিজের উপর ধিক্কার হল। মনে খুব একটা জোর পেলে। এখনই দাদার কাছে ছুটে না গিয়ে দাদার আসার জন্যে সে অপেক্ষা করতে পারবে। সেই ভালো।
মোতির মা চিবুক ধরে কুমুর মুখ তুলে ধরে বললে, “বাস্ রে, দাদার কথার একটু আড় হাওয়া লাগলেই একেবারে অভিমানের সমুদ্র উথলে ওঠে।”
নবীন বললে, “বউরানী, কাল তা হলে তোমার যাবার আয়োজন করি গে।”
“না, তার দরকার নেই।”
“দরকার নেই তো কী? তোমার দরকার না থাকে তো আমার দরকার আছে বৈকি।”
“তোমার আবার কিসের দরকার?”
“বা! আমার দাদাকে তোমার দাদা যা-কিছু ঠাওরাবেন সেটা বুঝি অমনি সয়ে যেতে হবে! আমার দাদার পক্ষ নিয়ে আমি লড়ব। তোমার কাছে হার মানতে পারব না। কাল তোমাকে ওঁর কাছে যেতেই হচ্ছে।”
কুমু হাসতে লাগল।
“বউরানী, এ ঠাট্টার কথা নয়। আমাদের বাড়ির অপবাদে তোমার অগৌরব। এখন চোখে মুখে একটু জল দিয়ে এসো, খেতে যাবে। ম্যানেজার-সাহেবের ওখানে দাদার আজ নিমন্ত্রণ। আমার বিশ্বাস তিনি আজ বাড়ির ভিতরে শুতে আসবেন না, দেখলুম বাইরের কামরায় তাঁর বিছানা তৈরি।”
এই খবরটা পেয়ে কুমু মনে মনে আরাম পেলে, তার পরক্ষণেই এতটা আরাম পেলে বলে লজ্জা বোধ হল।
রাত্রে শোবার ঘরে মোতির মার সঙ্গে নবীনের ঐ কথাটা নিয়ে পরামর্শ চলল। মোতির মা বললে, “তুমি তো দিদিকে আশ্বাস দিলে। তার পরে?”
“তার পরে আবার কী? নবীনের যেমন কথা তেমনি কাজ। বউরানীকে যেতেই হবে, তার পরে যা হয় তা হবে।”
নতুন-গড়া রাজাদের পারিবারিক মর্যাদাবোধ খুবই উগ্র। এরা নিশ্চয় ঠিক করে আছেন যে, বিবাহ করে নববধূ তার পূর্ব-পদবীর চেয়ে অনেক উপরে উঠেছে। অতএব বাপের বাড়ি বলে কোনো বালাই আছে এ কথা একেবারে ভুলতে দেওয়াই সংগত। এ অবস্থায় দুই দিক রক্ষা করা যদি অসম্ভব হয় তবে একটা দিক তো রাখতেই হবে। সেই দিকটা যে কোন্টা তা নবীন মনে মনে পাকা করে রাখলে। যেখানে দাদার অধিকার চরম, সেখানে ও কোনোদিন দাদার সঙ্গে লড়াই বাধাতে সাহস করতে পারবে এ কথা আর কিছুদিন আগে নবীন স্বপ্নেও ভাবতে পারত না।
স্বামীস্ত্রীতে পরামর্শ করে স্থির হল যে, কাল সকালে কুমু একবার মাত্র বিপ্রদাসের সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্যে দেখা করে আসবে, এই প্রস্তাব মধুসূদনের কাছে করা হবে। যদি রাজি হয় এবং কুমুকে সেখানে পাঠানো যায় তা হলে তার পরে সেখান থেকে দু-চার দিনের মধ্যে তাকে না ফেরাবার সংগত কারণ বানানো শক্ত হবে না।
মধুসূদন বাড়ি ফিরল অনেক রাত্রে, সঙ্গে একরাশ কাগজপত্রের বোঝা। নবীন উঁকি মেরে দেখলে, মধুসূদন শুতে না গিয়ে চোখে চশমা এঁটে নীল পেনসিল হাতে আপিসঘরের ডেস্কে কোনো দলিলে বা দাগ দিচ্ছে, নোটবইয়ে বা নোট নিচ্ছে। নবীন সাহস করে ঘরে ঢুকেই বললে, “দাদা, আমি কি তোমার কোনো কাজ করে দিতে পারি?” মধুসূদন সংক্ষেপে বললে, “না।” ব্যাবসায় এই সংকটের অবস্থাটাকে মধুসূদন সম্পূর্ণ নিজে আয়ত্ত করে নিতে চায়, সবটা তার একার চোখে প্রত্যক্ষ হওয়া দরকার। এ কাজে অন্যের দৃষ্টির সহায়তা নিতে গেলে নিজেকে দুর্বল করা হবে।
নবীন কোনো কথা বলবার ছিদ্র না পেয়ে বেরিয়ে গেল। শীঘ্র যে সুযোগ পাওয়া যাবে এমন তো ভাবে বোধ হল না। নবীনের পণ, কাল সকালেই বউরানীকে রওনা করে দেবে। আজ রাত্রেই সম্মতি আদায় করা চাই।
খানিকক্ষণ বাদে নবীন একটা ল্যাম্প হাতে করে দাদার টেবিলের উপরে রেখে বললে, “তোমার আলো কম হচ্ছে।”
মধুসূদন অনুভব করলে, এই দ্বিতীয় ল্যাম্পে তার কাজের অনেকখানি সুবিধা হল। কিন্তু এই উপলক্ষেও কোনো কথার সূচনা হতে পারল না। আবার নবীনকে বেরিয়ে আসতে হল।
একটু পরেই মধুসূদনের অভ্যস্ত গুড়গুড়িতে তামাক সেজে তার চৌকির বাঁ পাশে বসিয়ে নলটা টেবিলের উপর আস্তে আস্তে তুলে রাখলে। মধুসূদন তখনই অনুভব করলে এটারও দরকার ছিল। ক্ষণকালের জন্যে পেনসিলটা রেখে তামাক টানতে লাগল।
এই অবকাশে নবীন কথা পাড়লে, “দাদা, শুতে যাবে না? অনেক রাত হয়েছে। বউরানী তোমার জন্যে হয়তো জেগে বসে আছেন।”
“জেগে বসে আছেন” কথাটা এক মুহূর্তে মধুসূদনের মনের ভিতরে গিয়ে লাগল। ঢেউয়ের উপর দিয়ে জাহাজ যখন টল্মল্ করতে করতে চলেছে, একটি ছোটো ডাঙার পাখি উড়ে এসে যেন মাস্তুলে বসল; ক্ষুব্ধ সমুদ্রের ভিতর ক্ষণকালের জন্যে মনে এনে দিলে শ্যামল দ্বীপের নিভৃত বনচ্ছায়ার ছবি। কিন্তু সে কথায় মন দেবার সময় নয়, জাহাজ চালাতে হবে।
মধুসূদন আপন মনের এইটুকু চাঞ্চল্যে ভীত হল। তখনই সেটা দমন করে বললে, “বড়োবউকে শুতে যেতে বলো, আজ আমি বাইরে শোব।”
“তাঁকে না-হয় এখানে ডেকে দিই” বলে নবীন গুড়গুড়ির কলকেটাতে ফুঁ দিতে লাগল।
মধুসূদন হঠাৎ ঝেঁকে উঠে বলে উঠল, “না না।”
নবীন তাতেও না দমে বললে, “তিনি যে তোমার কাছে দরবার করবেন বলে বসে আছেন।”
রুক্ষস্বরে মধুসূদন বললে, “এখন দরবারের সময় নেই।”
“তোমার তো সময় নেই দাদা, তাঁরও তো সময় কম।”
“কী, হয়েছে কী?”
“বিপ্রদাসবাবু আজ কলকাতায় এসেছেন খবর পাওয়া গেছে, তাই বউরানী কাল সকালে–”
“সকালে যেতে চান?”
“বেশিক্ষণের জন্যে না, একবার কেবল–”
মধুসূদন হাত ঝাঁকানি দিয়ে উঠে বললে, “তা যান-না, যান। বাস্, আর নয়, তুমি যাও।”
হুকুম আদায় করেই নবীন ঘর থেকে এক দৌড়। বাইরে আসতেই মধুসূদনের ডাক কানে এসে পৌঁছোল, “নবীন।”
ভয় লাগল আবার বুঝি দাদা হুকুম ফিরিয়ে নেয়। ঘরে এসে দাঁড়াতেই মদুসূদন বললে, “বড়োবউ এখন কিছুদিন তাঁর দাদার ওখানে গিয়েই থাকবেন, তুমি তার জোগাড় করে দিয়ো।”
নবীনের ভয় লাগল, দাদার এই প্রস্তাবে তার মুখে পাছে একটুও উৎসাহ প্রকাশ পায়। এমন-কী, সে একটু দ্বিধার ভাব দেখিয়ে মাথা চুলকোতে লাগল। বললে, “বউরানী গেলে বাড়িটা বড়ো খালি-খালি ঠেকবে।”
মধুসূদন কোনো উত্তর না করে গুড়গুড়ির নলটা নামিয়ে রেখে কাজে লেগে গেল। বুঝতে পারলে প্রলোভনের রাস্তা এখনো খোলা আছে– ও দিকে একেবারেই না।
নবীন আনন্দিত হয়ে চলে গেল। মধুসূদনের কাজ চলতে লাগল। কিন্তু কখন এই কাজের ধারার পাশ দিয়ে আর-একটা উলটো মানস-ধারা খুলে গেছে তা সে অনেকক্ষণ নিজেই বুঝতে পারে নি। এক সময়ে নীল পেনসিল প্রয়োজন শেষ না হতেই ছুটি নিল, গুড়গুড়ির নলটা উঠল মুখে। দিনের বেলায় মধুসূদনের মনটা কুমুর ভাবনা সম্বন্ধে যখন সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি নিয়েছিল, তখন আগেকার দিনের মতো নিজের ‘পরে নিজের একাধিপত্য ফিরে পেয়ে মধুসূদন খুব আনন্দিত হয়েছিল। কিন্তু যত রাত হচ্ছে ততই সন্দেহ হতে লাগল যে, শত্রু দুর্গ ছেড়ে পালায় নি। সুড়ঙ্গের ঘরে আছে গা ঢাকা দিয়ে।
বৃষ্টি থেমে গেছে, কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ বাগানের কোণে এক প্রাচীন সিসু গাছের উপরে আকাশে উঠে আর্দ্র পৃথিবীকে বিহ্বল করে দিয়েছে। হাওয়াটা ঠাণ্ডা, মধুসূদনের দেহটা বিছানার ভিতরে একটা গরম কোমল স্পর্শের জন্যে দাবি জানাতে আরম্ভ করেছে। নীল পেনসিলটা চেপে ধরে খাতাপত্রের উপর সে ঝুঁকে পড়ল কিন্তু মনের গভীর আকাশে একটা কথা ক্ষীণ অথচ স্পষ্ট আওয়াজে বাজছে, “বউরানী হয়তো এতক্ষণ জেগে বসে আছেন।”
মধুসূদন পণ করেছিল, একটা বিশেষ কাজ আজ রাত্রের মধ্যেই শেষ করে রাখবে। সেটা কাল সকালের মধ্যে সারতে পারলে যে খুব বেশি অসুবিধা হত তা নয়। কিন্তু পণ রক্ষা করা ওর ব্যাবসায়ের ধর্মনীতি। তার থেকে কোনো কারণে যদি ভ্রষ্ট হয় তবে নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না। এতদিন ধর্মকে খুব কঠিনভাবেই রক্ষা করেছে। তাঁর পুরস্কারও পেয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু ইদানীং দিনের মধুসূদনের সঙ্গে রাত্রের মধুসূদনের সুরের কিছু কিছু তফাত ঘটে আসছে– এক বীণায় দুই তারের মতো। যে দৃঢ় পণ করে ডেস্কের উপর ও ঝুঁকে পড়ে বসেছিল– রাত্রি যখন গভীর হয়ে এল, সেই পণের কোন্ একটা ফাঁকের ভিতর দিয়ে একটা উক্তি ভ্রমরের মতো ভন্ ভন্ করতে শুরু করলে, “বউরানী হয়তো জেগে বসে আছেন।”
উঠে পড়ল। বাতি না নিভিয়ে খাতাপত্র যেমন ছিল তেমনি ভাবেই রেখে চলল শোবার ঘরের দিকে। অন্তঃপুরে আঙিনা-ঘেরা যে বারান্দা দিয়ে তেতালার ঘরে যেতে হয় সেই বারান্দায় রেলিঙের ধারে শ্যামাসুন্দরী মেজের উপর বসে। চাঁদ তখন মধ্য-আকাশে, তার আলো এসে তাকে ঘিরেছে। তাকে দেখাচ্ছে যেন কোন্ এক গল্পের বইয়ের ছবির মতো। অর্থাৎ সে যেন প্রতিদিনের মানুষ নয়, অতিনিকটের অতিপরিচয়ের কঠোর আবরণ থেকে যেন একটা দূরত্বের মধ্যে বেরিয়ে এসেছে। সে জানত মধুসূদন এই পথ দিয়েই শোবার ঘরে যায়– সেই যাওয়ার দৃশ্যটা ওর কাছে অতি তীব্র বেদনার, সেইজন্যেই তার আকর্ষণটা এত প্রবল। কিন্তু শুধু হৃদয়টাকে ব্যর্থ বেদনায় বিদ্ধ করবার পাগলামিই যে এই প্রতীক্ষার মধ্যে আছে তা নয়, এর মধ্যে একটা প্রত্যাশাও আছে– যদি ক্ষণকালের মধ্যে একটা কিছু ঘটে যায়; অসম্ভব কখন সম্ভব হয়ে যাবে এই আশায় পথের ধারে জেগে থাকা।
মধুসূদন ওর দিকে একবার কটাক্ষ করে উপরে চলে গেল। শ্যামাসুন্দরী নিজের ভাগ্যের উপর রাগ করে রেলিং শক্ত করে ধরে তার উপরে মাথা ঠুকতে লাগল।
শোবার ঘরে গিয়ে মধুসূদন দেখে যে কুমু জেগে বসে নেই। ঘর অন্ধকার, নাবার ঘরের খোলা দরজা দিয়ে অল্প একটু আলো আসছে। মধুসূদন একবার ভাবল ফিরে চলে যাই, কিন্তু পারল না। গ্যাসের আলোটা জ্বালিয়ে দিলে। কুমু বিছানার মধ্যে মুড়িসুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে–আলো জ্বালাতেও ঘুম ভাঙল না। কুমুর এই আরামে ঘুমোনোর উপর ওর রাগ ধরল। অধৈর্যের সঙ্গে মশারি খুলে ধপ্ করে বিছানার উপর বসে পড়ল। খাটটা শব্দ করে কেঁপে উঠল।
কুমু চমকে উঠে বসল। আজ মধুসূদন আসবে না বলেই জানত। হঠাৎ তাকে দেখে মুখে এমন একটা ভাব এল যে, তাই দেখে মধুসূদনের বুকের ভিতর দিয়ে যেন একটা শেল বিঁধল। মাথায় রক্ত চড়ে গেল, বলে উঠল, “আমাকে কোনোমতেই সইতে পারছ না, না?”
এমনতরো প্রশ্নের কী উত্তর দেবে কুমু তা ভেবেই পেলে না। সত্যিই হঠাৎ মধুসূদনকে দেখে ওর বুক কেঁপে উঠেছিল আতঙ্কে। তখন ওর মনটা সতর্ক ছিল না। যে ভাবটাকে ও নিজের কাছেও সর্বদা চেপে রাখতে চায়, যার প্রবলতা নিজেও কুমু সম্পূর্ণ জানে না সে তখন হঠাৎ আত্মপ্রকাশ করেছিল।
মধুসূদন চিবিয়ে চিবিয়ে বললে, “দাদার কাছে যাবার জন্যে তোমার দরবার?”
কুমু এই মুহূর্তেই ওর পায়ে পড়তে প্রস্তুত হয়েছিল, কিন্তু ওর মুখে দাদার নাম শুনেই শক্ত হয়ে উঠল। বললে, “না।”
“তুমি যেতে চাও না?”
“না, আমি চাই নে।”
“নবীনকে আমার কাছে দরবার করতে পাঠাও নি?”
“না, পাঠাই নি।”
“দাদার কাছে যাবার ইচ্ছে তাকে তুমি জানাও নি?”
“আমি তাঁকে বলেছিলুম, দাদাকে দেখতে আমি যাব না।”
“কেন?”
“তা আমি বলতে পারি নে।”
“বলতে পার না? আবার তোমার সেই নুরনগরি চাল?”
“আমি যে নুরনগরেরই মেয়ে।”
“যাও, তাদের কাছেই যাও। যোগ্য নও তুমি এখানকার। অনুগ্রহ করেছিলেম, মর্যাদা বুঝলে না। এখন অনুতাপ করতে হবে।”
কুমু কাঠ হয়ে বসে রইল, কোনো উত্তর করলে না। কুমুর হাত ধরে অসহ্য একটা ঝাঁকানি দিয়ে মধুসূদন বললে, “মাপ চাইতেও জান না?”
“কিসের জন্যে?”
“তুমি যে আমার এ বিছানার উপরে শুতে পেরেছ তার জন্যে।”
কুমু তংক্ষণাৎ বিছানা থেকে উঠে পাশের ঘরে চলে গেল।
মধুসূদন বাইরের ঘরে যাবার পথে দেখলে শ্যামাসুন্দরী সেই বারান্দায় উপুড় হয়ে পড়ে। মধুসূদন পাশে এসে নিচু হয়ে তার হাত ধরে টেনে তোলবার চেষ্টা করে বললে, “কী করছ, শ্যামা?” অমনি শ্যামা উঠে বসে মধুসূদনের দুই পা বুকে জড়িয়ে ধরলে, গদ্গদ কণ্ঠে বললে, “আমাকে মেরে ফেলো তুমি।”
মধুসূদন তাকে হাত ধরে তুলে দাঁড় করালে, বললে, “ইস্, তোমার গা যে একেবারে ঠাণ্ডা হিম। চলো তোমাকে শুইয়ে দিয়ে আসি গে।” বলে তাকে নিজের শালের এক অংশে আবৃত করে ডান হাত দিয়ে সবলে চেপে ধরে শোবার ঘরে পৌঁছিয়ে দিয়ে এল। শ্যামা চুপি চুপি বললে, “একটু বসবে না?”
মধুসূদন বললে, “কাজ আছে।”
রাতের বেলা কোথা থেকে ভূত চেপে এতক্ষণ মধুসূদনের কাজ নষ্ট করে দেবার জোগাড় করেছে– আর নয়। কুমুর কাছ থেকে যে উপেক্ষা পেয়েছে তার ক্ষতিপূরণের ভাণ্ডার অন্য কোথাও জমা আছে এটুকু সে বুঝে নিলে। ভালোবাসার ভিতর দিয়ে মানুষ আপনার যে পরম মূল্য উপলব্ধি করে, আজ রাত্রে সেই অনুভব করবার প্রয়োজন মধুসূদনের ছিল। শ্যামাসুন্দরী সমস্ত জীবনমন দিয়ে ওর জন্যে অপেক্ষা করে আছে, সেই আশ্বাসটুকু পেয়ে মধুসূদন আজ রাত্রে কাজের জোর পেলে, যে অমর্যাদার কাঁটা ওর মনের মধ্যে বিঁধে আছে তার বেদনা অনেকটা কমিয়ে দিলে।
এ দিকে রাত্রে কুমু যে ধাক্কা পেলে তার মধ্যে ওর একটা সান্ত্বনা ছিল। যতবার মধুসূদন তাকে ভালোবাসা দেখিয়েছে, ততবারই কুমুর মনে একটা টানাটানি এসেছে; ভালোবাসার মূল্যেই এর প্রতিশোধ করা চাই এই কর্তব্যবোধে ওকে অত্যন্ত অস্থির করেছে। এ লড়াইয়ে কুমুর জেতবার কোনো আশা ছিল না। কিন্তু পরাভবটা কুশ্রী, সেটাকে কেবলই চাপা দেবার জন্যে এতদিন কুমু প্রাণপণে চেষ্টা করেছে। কাল রাত্রে সেই চাপা-দেওয়া পরাভবটা এক মুহূর্তে সম্পূর্ণ ধরা পড়ে গেল। কুমুর অসতর্ক অবস্থায় মধুসূদন স্পষ্ট করে দেখতে পেয়েছে যে কুমুর সমস্ত প্রকৃতি মধুসূদনের প্রকৃতির বিরুদ্ধ; এইটে নিশ্চিত জানা হয়ে গেল সে ভালো, তার পরে পরস্পরের যা কর্তব্য সেটা অকপটভাবে করা সম্ভব হবে। মধুসূদন ওকে কামনা করে, সেইখানেই সমস্যা; ক্ষোভের সঙ্গে ওকে যে বর্জন করতে চায় সেইখানেই সত্য। সত্যই মধুসূদনের বিছানায় শোবার অধিকার ওর নেই। শুয়ে ও কেবলই ফাঁকি দিচ্ছে। এ বাড়িতে ওর যে পদ সেটা বিড়ম্বনা।
আজ রাত্রে এই একটা প্রশ্ন বার বার কুমুর মনে উঠেছে– কুমুকে নিয়ে মধুসূদনের কেন এত নির্বন্ধ? ও তো কথায় কথায় নুরনগরি চালের প্রসঙ্গ তুলে কুমুকে খোঁটা দেয়, তার মানে কুমুর সঙ্গে ওদের একেবারে ধাতের তফাত, জাতের তফাত, কিন্তু মধুসূদন কেন তবে ওকে ভালোবাসা জানায়? একি কখনো সত্য ভালোবাসা হতে পারে? কুমুর নিশ্চয় বিশ্বাস, আজ মধুসূদন যাই মনে করুক-না কেন, কুমুকে দিয়ে কখনোই ওর মন ভরতে পারে না। যত শীঘ্র মধুসূদন তা বোঝে ততই সকল পক্ষের মঙ্গল।
নবীন কাল রাত্রে দাদার কাছ থেকে সম্মতি নিয়ে যত আনন্দ করে শুতে গেল, আজ সকালে তার আর বড়ো-কিছু বাকি রইল না। কাল রাত্রি তখন আড়াইটা। মধুসূদন কাজ শেষ করে তখনই নবীনকে ডেকে পাঠিয়েছিল। হুকুম এই যে, কুমুদিনীকে বিপ্রদাসের ওখানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, যতদিন মধুসূদন না আপনি ডেকে পাঠায় ততদিন ফিরে আসবার দরকার নেই। নবীন বুঝলে এটা নির্বাসনদণ্ড।
আঙিনা-ঘেরা চৌকো বারান্দার যে অংশে কাল রাত্রে মধুসূদনের সঙ্গে শ্যামার সাক্ষাৎ হয়েছিল, ঠিক তার বিপরীত দিকের বারান্দার সংলগ্ন নবীনের শোবার ঘর। তখন ওরা স্বামীস্ত্রী কুমুর সম্বন্ধেই আলোচনা করছিল। এমন সময় গলার শব্দ শুনে মোতির মা ঘরের দরজা খুলতেই জ্যোৎস্নার আলোতে মধুসূদনের সঙ্গে শ্যামার মিলনের ছবি দেখতে পেলে। বুঝতে পারলে কুমুর ভাগ্যের জালে এই রাত্রে নিঃশব্দে আর-একটা শক্ত গিঁঠ পড়ল।
নবীনকে মোতির মা বললে, “ঠিক এই সংকটের সময় কি দিদির চলে যাওয়া ভালো হচ্ছে?”
নবীন বললে, “এতদিন তো বউরানী ছিলেন না, কাণ্ডটা তো এতদূর কখনোই এগোয় নি। বউরানী আছেন বলে এটা ঘটেছে।”
“কী বল তুমি!”
“বউরানী যে ঘুমন্ত ক্ষুধাকে জাগিয়েছেন তার অন্ন জোগাতে পারেন নি, তাই সে অনর্থপাত করতে বসেছে। আমি তো বলি এই সময়টায় ওর দূরে থাকাই ভালো, তাতে আর-কিছু না হোক অন্তত উনি শান্তিতে থাকতে পারবেন।”
“তবে এটা কি এমনি ভাবেই চলবে?”
“যে আগুন নেবাবার কোনো উপায় নেই, সেটাকে আপনি জ্বলে ছাই হওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে দেখতে হবে।”
পরদিন সকালে হাবলু সমস্তক্ষণ কুমুর সঙ্গে সঙ্গে ফিরলে। গুরুমশাই যখন পড়ার জন্যে ওকে বাইরে ডেকে পাঠালে, ও কুমুর দিকে চাইলে। কুমু যদি যেতে বলত তো ও যেত, কিন্তু কুমু বেহারাকে বলে দিলে আজ হাবলুর ছুটি।
বধূ কিছুদিনের জন্যে বাপের বাড়ি যাচ্ছে সেই সুরটি আজ কুমুর যাত্রার সময় লাগল না। এ বাড়ি যেন ওকে আজ হারাতে বসেছে। যে পাখিকে খাঁচায় বন্দী করা হয়েছিল, আজ যেন দরজা একটু ফাঁক করতেই সে উড়ে পড়ল, আর যেন এ খাঁচায় সে ঢুকবে না।
নবীন বললে, “বউরানী, ফিরে আসতে দেরি কোরো না এই কথাটা সব মন দিয়ে বলতে পারলে বেঁচে যেতুম, কিন্তু মুখ দিয়ে বেরোল না। যাদের কাছে তোমার যথার্থ সম্মান সেইখানেই তুমি থাকো গে। কোনো কালে নবীনকে যদি কোনো কারণে দরকার হয় স্মরণ কোরো।”
মোতির মা নিজের হাতে তৈরি আমসত্ত্ব আচার প্রভৃতি একটা হাঁড়িতে সাজিয়ে পালকিতে তুলে দিলে। বিশেষ কিছু বললে না। কিন্তু মনে তার বেশ একটু আপত্তি ছিল। যতদিন বাধা ছিল স্থূল, যতদিন মধুসূদন কুমুকে বাহির থেকে অপমান করেছে, মোতির মার সমস্ত মন ততদিন ছিল কুমুর পক্ষে; কিন্তু যে বাধা সূক্ষ্ম, যা মর্মগত, বিশ্লেষণ করে যার সংজ্ঞা নির্ণয় করা কঠিন, তারই শক্তি যে প্রবলতম, এ কথাটা মোতির মার কাছে সহজ নয়। স্বামী যে মুহূর্তে প্রসন্ন হবে সেই মুহূর্তে অবিলম্বে স্ত্রী সেটাকে সৌভাগ্য বলে গণ্য করবে, মোতির মা এইটেকেই স্বাভাবিক বলে জানে। এর ব্যতিক্রমকে সে বাড়াবাড়ি মনে করে। এমন-কি, এখনো যে বউরানী সম্বন্ধে নবীনের দরদ আছে, এটাতে তার রাগ হয়। কুমুর প্রকৃতিগত বিতৃষ্ণা যে একান্ত অকৃত্রিম, এটা যে অহংকার নয়, এমন-কি, এইটে নিয়ে যে কুমুর নিজের সঙ্গে নিজের দুর্জয় বিরোধ, সাধারণত মেয়েদের পক্ষে এটা স্বীকার করে নেওয়া কঠিন। যে চীনে মেয়ে প্রথার অনুসরণে নিজের পা বিকৃত করতে আপত্তি করে নি, সে যদি শোনে জগতে এমন মেয়ে আছে যে আপনার এই পদসংকোচ-পীড়নকে স্বীকার করা অপমানজনক বলে মনে করে তবে নিশ্চয় সেই কুণ্ঠাকে সে হেসে উড়িয়ে দেয়, নিশ্চয় বলে ওটা ন্যাকামি। যেটা নিগূঢ়ভাবে স্বাভাবিক, সেইটিকেই সে জানে অস্বাভাবিক। মোতির মা একদিন কুমুর দুঃখে সব চেয়ে বেশি দুঃখ পেয়েছিল, বোধ করি সেইজন্যেই আজ তার মন এত কঠিন হতে আরম্ভ করেছে। প্রতিকূল ভাগ্য যখন বরদান করতে আসে, তখন তার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে যে মেয়ে অবিলম্বে সে বর গ্রহণ করতে না পারে, তাকে মমতা করা মোতির মার পক্ষে অসম্ভব– এমন-কি, মার্জনা করাও।