যে-হাত প্রেমের উচ্ছন্নে টেনে তোলে

মাটিতে শাল বা শিশুকাঠের গুঁড়ি পুঁতে তাকে পাকিয়ে-পাকিয়ে চারতলা পর্যন্ত উঠে গেছে বাঁশের রেলিং আর কঞ্চির ধাপ দেওয়া কাঠের সিঁড়ি, এতই সরু যে, একজন যদি নামতে থাকে তাহলে তাকে জায়গা দেবার জন্য রেলিং-এ হেলে দাঁড়াতে হবে । তা সত্ত্বেও স্পর্শ বাঁচানো কঠিন । স্হান সংকুলানের জন্য দুই পাক ওঠার পর একতলা, তারপর দুইপাক উঠে দুতলা, এইভাবে পাক খেয়ে চারতলা পর্যন্ত টালির চালের তৈরি কাঠের বাড়ি । অর্থাৎ সিঁড়িটা কেবল সরু নয়, তা বেশ প্যাঁচালো । প্রতিটি তলার সিঁড়ির মুখে বাঁদিকে একটা ঘর আর ডান দিক খোলা, কাঠর সরু করিডরে যাবার জন্য ; করিডরের একদিকে কাঠের ঘরের সারি, আরেকদিকে খোলা বারান্দা । বারান্দা থেকে ভেতরের উঠোন দেখতে পাওয়া যায় । ঘরগুলোর মেঝেও কাঠের । ঘরে-ঘরে দুটি জানালা ; শিকগুলো কাঠের । জানালাগুলো বিশাল, দরজার মাপেই । ঘরগুলো বারো বাই আট হবে । গ্রাউন্ড ফ্লোর বা একতলা ছাড়া ওপরের তলাগুলোয় আসবাব কম ; প্যাঁচানো সিঁড়ি দিয়ে আসবাব ওপরে ওঠানো কঠিন । বিছানা বলতে, মাটিতে খড়ের আঁটি বিছিয়ে তার ওপর চাদর পাতা । ঘরভাড়া মাথাপ্রতি মাসে একটাকা, যা সংগ্রহ করতে সামন্তের পেয়াদা আসে মাসের এক তারিখে । পাড়াটার নাম ঠমেল — তার রূপ সম্পূর্ণ বদলে গেছে এখন ।

অমন গুঁড়ি পুঁতে-পুঁতে, পঞ্চাশ মিটার বাই একশো মিটার জুড়ে একটা আয়তাকার উঠোন ঘিরে জনপ্রাসাদ । এই প্রাসাদের মূল দরোজা একটিই এবং সেটি সদাসর্বদা খোলা ; দশ ফিট উঁচু চার ফিট চওড়া কাঠের ফ্রেমে কাঠর ক্ষয়াটে জনপ্রাসাদের সিংদরোজা । কতজন থাকতেন ওই বাড়িটিতে অনুমান করা যেত সকালবেলায়, যখন উঠোনে জড়ো হতেন অনেকে প্রাতঃকৃত্য সারার জন্য, স্নানের জন্য । এই জনপ্রাসাদের সবাই প্রত্যেকদিন স্নান করতেন না বলে সুবিধা । প্রাতঃকৃত্য বলা হলেও সবাই সকালেই যেতেন না, অভ্যাসমতো যেতেন । প্রতিদিন স্নান করার ব্যাপারটা আমিও বাদ দিয়েছিলুম । ওই কুটিরপ্রাসাদে গরিব নেপালি আর নেওয়ারি পরিবার যেমন থাকতেন তেমনই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ঘর ভাড়া করে থাকতেন হিপির দল, নেপালি কবি-লেখক-শিল্পী, আর ভারত থেকে আসা আমাদের মতন উচ্ছন্নাকাঙ্খীরা । গ্রাউন্ডফ্লোরে, দু-তিন ঘরের ফ্ল্যাটে থাকতেন মধ্যবিত্তরা । একজন নেপালি অভিনেত্রীও থাকতেন ।

আমি ষাটের দশকের কথা বলছি, যে-সময়ে ফান ফুড ফ্রিডাম ফ্রিক-আউট এবং ফাকিং-এর উদ্দেশ্যে তরুণ-তরুণী আমেরিকা ইউরোপ জাপানে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ছেন । ইউরোপ-আমেরিকার যুবক-যুবতীরা লন্ডন বা অ্যামস্টারডাম হয়ে বাসে ট্রেনে আর হিচহাইক করে তুরস্ক ইরান আফগানিস্তান পাকিস্তান ভারতবর্ষ হয়ে শেষ গন্তব্য নেপাল । লণ্ডন আর অ্যামস্টারডম ছিল স্বাধঃপতিতদের জড়ো হবার ঘাঁটি । ভারত-পাকিস্তানের যে গেট দিয়ে তাঁরা আসতেন, তার নাম ছিল গন্দাসিংওয়ালা । তখনও ওয়াগার গেট হয়নি । পাকিস্তানের সঙ্গে এখনকার মতন বোমাবুমির সম্পর্কও হয়নি, চিনের যুদ্ধ সত্তেও । সেই যাত্রাপথের নাম ছিল শামুক-গতির হিপি ট্রেইল । সে যাত্রাপথ ছিল যথেচ্ছাচার ও মহানন্দে সময় কাটাবার সহজ উত্তরণ । সে সময়ে ইউরোপ আমেরিকার যুবক-যুবতীরা চাইলেই চাকরি পেতেন অথচ বাড়ি ছেড়ে দলে-দলে বেরিয়ে পড়তেন । এখন চাকরি পাওয়া কঠিন, তবুও কেউ সেভাবে বেরিয়ে পড়েন না ; কারণ পৃথিবীটা হয়ে গেছে ঝগড়াটে, খেঁকুরে, লোভী, জোচ্চোর ও মতলববাজ । শান্তির কোনো ট্রেইল আর নেই , দেশগুলোও অশান্ত । পৃথিবীর অত্যন্ত ধনী এলাকাগুলোই কেবল শান্তিতে রয়েছে ।

ফ্রিকিং আউট হবার জন্যেই কাঠমাণ্ডুতে জড়ো হতেন হিপি-হিপিনিরা, নেপালে চরস গাঁজা ভাঙ ইত্যাদি পথেঘাটে পাওয়া যেত । ১৯৮০ সালের পর আমেরিকার চাপে প্রতিটি দেশে আইন করে ভেষজ মাদকসহ সব মাদক নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে । আমেরিকার বিজ্ঞানীরাই ভেষজ থেকে রসায়ন বের করে মাদককে কড়া আর বাজারু করে দিয়েছে । আর ওই রসায়নেই ড্রাগ অ্যাডিক্ট নামক জীবদের জন্ম । হুন্দু সাধু-সন্ন্যাসীরা এখনও ভেষজের ধোঁয়া ফুঁকে চলেছেন কিন্তু কেউই অ্যাডিক্ট হন না ।

হিপিরা বেরিয়ে পড়ার পথে আফগানিস্তান থেকে আনতেন উচ্চমানের চরস বা হ্যাশিশ আর পাকিস্তান থেকে গাঁজাপাতার গুঁড়ো যাকে পাকিস্তানিরা বলতেন গরদা । নেপালি গাঁজার সঙ্গে হ্যাশিশ আর গরদা মিশিয়ে তৈরি হতো এক ধরনের ডেডলি মাদক । হিন্দু বা বৌদ্ধ, যে-কোনো মন্দির-চত্বরে গেলে দেখা যেত বৃদ্ধ মাদকসেবীরা গোল হয়ে বসে ছিলিম টানছেন । তাঁদের পাশে বসে পড়লেই হল । একখানা ফ্রি, লম্বা টান দেবার জন্য । আর হিপি-হিপিনিরা তো ছিলই দিলদরিয়া ; চাইলে নিজেদেরই বিলিয়ে দেবার জন্য তৈরি । কোনো হিপিনির সঙ্গে শুতে চাইলে সে কয়েকটা টান দেবার পর বলত, ঠিক আছে, চলো আমার ঘরে । স্বয়ম্ভূনাথ মন্দিরকে হিপিরা বলত মাংকি টেমপল আর ওই বৌদ্ধমন্দির ঘিরেই ছিল তাদের জমায়েত, নেশা করে নির্বাণপ্রাপ্তির প্রাঙ্গণ।

স্হানীয় তরুণ কবিরা পছন্দ করতেন কান্ট্রি লিকার, বিশেষত রাকসি এবং জাঁড়, যা খাওয়া হতো মাংসের আচার দিয়ে । অনেক সময়ে মোষের কাঁচা মাংস চটকে-চটকে তৈরি করা কাচিলা দিয়ে । রাকসির গন্ধ অত্যন্ত ঝাঁঝালো । বহুদূর পর্যন্ত যেত তার নিশি ডাক । এই কবি-লেখকরা স্হানীয় সংবাদপত্রে আমাদের সম্পর্কে লিখে অনেককিছু সহজলভ্য করে দিয়েছিলেন । প্রায়ই নিমন্ত্রণ আসত কবিদের রাকসি-পান আড্ডায় কবিতাপাঠের জন্য ।

আমিও ওই জনপ্রাসাদটিতে থাকতুম । জুটেছিলুম গিয়ে বন্ধু চিত্রকর বন্ধু করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ের ডাকে । করুণা আর চিত্রকর অনিল করঞ্জাই গিয়েছিল বেনারস থেকে । হিপিরা ভারতে এসে উঠত বেনারসে । সেই সুবাদে করুণা হয়ে উঠেছিল ওদের গাইড, এবং দরকার পড়লে স্লি-ইন পার্টনার । বেনারসের ওই সময়ের জীবন নিয়ে আমি একটা স্কোপোফিলিক উপন্যাস লিখেছিলুম, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ নামে ; নেট সার্চ করলে পাওয়া যাবে । ‘তাইম’ পত্রিকায় আমার ফোটো বেরিয়েছিল বলে, আর আমার সঙ্গে বিটনিক কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ও ফেরলিংঘেট্টির পরিচয় আছে, এবং বিটনিকদের পত্রিকায় আমার কবিতা প্রকাশিত হবার দৌলতে আমার নাম জানতেন হবি-কবি হিপি-হিপিনিরা । সেকারণে মাদকের ও যৌনতার একটি বিভাময় হ্যালো ওনারা গড়ে দিয়েছিলেন আমার মাথাকে ঘিরে । জীবন হয়ে উঠেছিল অবাধ ও সীমালঙ্ঘনময় ।

আমার সবচেয়ে বেশি সমস্যা হতো মাদকের নেশা করে রাতের বেলায় ওই প্যাঁচালো সিঁড়ি বেয়ে নিজেদের ঘরে যাওয়া । যদিও একটা ঘরেই ছিলুম আমরা কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারে বেরোতুম একা-একা । আমি রাতে ফিরে প্রায়ই গুলিয়ে ফেলতুম । আমরা ছিলুম দোতলায় । কতবার ঘোরার পর দোতলায় যাব তা খেয়াল রাখতে পারতুম না । প্রত্যেকদিন বাঁ দিকের কারোর ঘরের কাছে পৌঁছে টের পেতুম যে, এটা নয়, নিচে বা ওপরে গিয়ে ডান দিকে যেতে হবে । কারও-কারও দরজায় ঝোলানো থাকত পরদা, বেশ নোংরা, মনে হতো যে পরদাতেই হাত পোঁছে ভাড়াটেরা । ঘটনাক্রমে কোনো হিপি বা হিপিনির ঘরে ঢুকে পড়লে অবশ্য তাদের বিছানায় নেশাগ্রস্ত শরীর এলিয়ে দেয়া যেত ভোর পর্যন্ত ।

মদ খেলে লোকে টলতে থাকে । ভেষজের নেশায় যা ঘটে তাকে বোধ হয় বলা উচিত ভাসতে থাকা বা উড়তে থাকা । ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া ফালি কাগজের মতন ।

একদিন রাতে ফিরে সিঁড়ির পাক গুলিয়ে ওপরে গেলুম, টের না পেয়ে নিমে এলুম, আরও কয়েকবার অমন ওঠা-নামা করার পর উঠছি, একটা বাঁদিকের ঘর থেকে পরদার মাঝ দিয়ে স্বাস্হ্যবতী নারীর ডান হাত বেরিয়ে এল, সবুজ কাঁচের চুড়ি, লাল রঙের ব্লাউজের হাতা, এক হ্যাঁচকায় ভেতরে টেনে মহিলা নেপালি টানের হিন্দিতে বললেন, “রোজই তো দেখি দরজা অব্দি আসো, ফিরে যাও কেন ?”

( ‘বহুস্বর’ পত্রিকার বইমেলা ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত )

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *