যে সব বঙ্গেত জন্মি
বাঙালি মুসলমানেরা একটি শ্রেণী কয়েক শো বছর ধ’রে ভুগেছে, এমনকি এখনো ভুগছে, একটি দুষ্ট রোগে। এতো বেশি দিন ধ’রে রোগে ভোগার ইতিহাস পৃথিবীতে বেশি নেই। ওই শ্রেণীটি মোটামুটিভাবে সমাজের ওপরের শ্রেণীর। দালাল, সুবিধাবাদী, স্বার্থপরায়ণ, দেশের সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু মানুষে গ’ড়ে উঠেছিলো বাঙালি মুসলমানের ওই শ্রেণীটি। তারা যে-রোগে ভুগেছে, সে-রোগের নাম দিতে পারি ‘নিজেদের- সম্পর্কে-ভুল-ধারণা’। আত্মভ্রমরোগে অসুস্থ বাঙালি মুসলমান। বাঙালি মুসলমান বাঙালি, এ-দেশেরই মানুষ তারা। তারা ঘোড়া ছুটিয়ে, তলোয়ার ঘুরিয়ে, মারমার কাটকাট শব্দ ক’রে কোনো রোদে-পোড়া মরুভূমি থেকে আসে নি। মাতাপিতামহক্রমে তাদের বঙ্গেত বসতি। বাঙলার পলিমাটিতেই তাদের জন্ম। বাঙলার গাছের ছায়া, আকাশের মেঘ, সবুজ সোনালি ধানের খেতের স্নেহআদরেই লালিত তাদের জীবন চিরকাল। কিন্তু পলিমাটির এ- বদ্বীপে সব সময়ই আগাছার মতো উল্লাসে জন্ম নিয়েছে একগোত্র সুবিধাবাদী মানুষ। দালালি তাদের এনে দিতো শক্তি আর সম্পদ। সমাজের উঁচু শ্রেণীটিই সাধারণত ভরা থাকে কাতারে কাতারে দালাল আর সুবিধাবাদীতে। চিরকালই ছিলো, আজো আছে। ওই শ্রেণীটি বাঙলাকে মেনে নিতে পারে নি তাদের দেশ হিশেবে, মাতৃভাষা হিশেবে মেনে নিতে পারে নি বাঙলাকে। বাঙলার পাতার কুটিরে শুয়ে তারা স্বপ্ন দেখেছে ইরানতুরানের। মরুভূমি ভেসে উঠেছে চোখে। কখনো আরবিকে, কখনো ফারসিকে, আবার কখনো উর্দূকে মনে করেছে নিজেদের ভাষা ব’লে। ভুগেছে মানসিক অসুখে; আর নানাভাবে শত্রুতা করেছে বাঙলার সাথে।
বাঙলার সাথে বাঙালি মুসলমানের এ-শ্রেণীটির শত্রুতা শুরু হয়ে গিয়েছিলো মধ্যযুগেই। কিন্তু বিশাল বাঙালি মুসলমানেরা ভুলেও ভাবে নি বাঙলা ছাড়া আর কোনো ভাষা আছে তাদের। এ-ভাষাতেই তো তারা প্রথম মাকে মা, বাবাকে বাবা (হায়, ‘বাবা’ শব্দটি বাঙলা নয়, তুর্কি!) বলেছে। সুখে উল্লাস প্রকাশ করছে বাঙলা ভাষায়, তাদের বেদনার কাতরতা নীল হয়ে ঝরেছে বাঙলা ভাষায়। কিন্তু উঁচু শ্রেণীটি তাদের শেখাতে চায় অন্য কথা। এতে সতেরো শতকেই আগুনের মতো জ্ব’লে উঠেছিলেন একজন কবি। আবদুল হাকিম। নুরনামা কাব্যে তিনি তীব্র ভাষায় তিরস্কার করেছেন বাঙলা বিদ্বেষীদের :
যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ ত্যাগি কেন বিদেশ ন যায়।
মাতাপিতামহক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মান হিত অতি।।
কী তীব্র তীক্ষ আক্রমণ শত্রুদের প্রতি, আর মমতা আপন ভাষার প্রতি!
উনিশশতকের দ্বিতীয় ভাগে এসে দেখা যায় ‘যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী’, তারা শুধু মুসলমান নয়। একগোত্র হিন্দুও যোগ দিয়েছে তাদের সাথে। মুসলমান বাঙালিরা প্রথম স্বপ্ন দেখতো আরবি ফারসি উর্দুর, পরে লেখাপড়া শিখে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে ইংরজিরও। হিন্দু বাঙালির একটি শ্রেণী–শিক্ষিত, সুবিধাবাদী, পরগাছা শ্রেণীটি স্বপ্ন দেখতে শুরু করে ইংরেজির। তার ফলে আমাদের সমাজে সব সময়ই একটি শ্রেণী পাওয়া গেছে যারা কোনো বিদেশি ভাষার দাস। তারা ধনী, সুবিধাবাদী, দালাল। শোষণে আর শাসনে সব সময়ই উৎসাহী। এখনকার বাঙলাদেশে এ- শ্রেণীটির তৎপরতা চোখে পড়ে খুব। তারা বাঙলার সম্পদ অনেকটা লুট ক’রে বিলাসে জীবন কাটায়। বাঙলা ভাষাকে অবহেলা ক’রে দাস হয়ে থাকে ইংরেজির। দুটি সাম্রাজ্যবাদ বাঙলায় দুবার দালাল সৃষ্টি করেছে। মধ্যপ্রাচ্যীয় সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্টি করে একবার, বিলেতি সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্টি করে আরেকবার। ওই সাম্রাজ্যবাদের দালালেরাই সব সময় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে বাঙলা ও বাঙলা ভাষার শত্রুরূপে। তারা বিদেশ ও বিদেশি ভাষার ভৃত্য।
বাঙলার সাথে বাঙালি মুসলমানের ওই শ্রেণীটির শত্রুতা বেশ ক্ষতি করেছে বাঙালি মুসলমানের। অনেক শক্তি, অনেক রক্ত অপচয় হয়েছে কলহে, ক্রোধে; আর প্রতিবাদে আর সংঘর্ষে। ধীরেধীরে এ-সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে বাঙালির, বাঙালি মুসলমানের, ভাষা বাঙলা। সত্যটা ছিলো শুরু থেকেই, কিন্তু তা মেনে নিতে চ’লে যায় দীর্ঘ সময়। ওই কলহে বিশশতকের কয়েক দশক ধ’রে বাঙলাবিরোধী শ্রেণীটি উর্দুকে গণ্য করেছে তাদের ভাষা ব’লে। কিন্তু বাঙলাপন্থীরা নানাভাবে দেখিয়েছেন যে বাঙলাই বাঙালির ভাষা। বাঙালি মুসলমান বাঙালি। বাঙালির ভাষা বাঙালা। হামেদ আলি লিখেছিলেন :
আমাদের পূর্বপুরুষগণ আরব, পারস্য, আফগানিস্থান, অথবা তাতারের অধিবাসীই হউন আর এতদ্দেশীয় হিন্দুই হউন, আমরা এক্ষণে বাঙ্গালী, আমাদের মাতৃভাষা বাঙ্গালা। তাহাঁরা (বাঙলার শত্রুরা) বাঙ্গালার বাঁশবন ও আম্রকাননের মধ্যস্থিত পর্ণকুটীরে নিদ্রা যাইয়াও এখনও বোগদাদ, বোখারা, কাবুল, কান্দাহারের স্বপ্ন দেখিয়া থাকেন। কেহ কেহ আবার বাঙ্গালার পরিবর্তে উর্দুকে মাতৃভাষা করিবার মোহে বিভোর। দুর্বল ব্যক্তিরা যেমন অলৌকিক স্বপ্ন দর্শন করে, অধঃপতিত জাতিও তেমনি অস্বাভাবিক খেয়াল আঁটিয়া থাকে।
বিশশতকের শুরুর দিকে (১৩১৬) আমাদের একটি শ্রেণীর অদ্ভুত পাগলামোর কথা বলেছিলেন হামেদ আলী। আর বিশশতকের মাঝামাঝি একটি অদ্ভুত দেশ, পাকিস্তান, আঁটে অস্বাভাবিক খেয়াল। সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত বাঙলাদেশ অন্তর্ভুক্ত ছিলো অদ্ভুত পাকিস্তানের। বাঙালিকে, বাঙলাকে বিনষ্ট করাই ছিলো পাকিস্তানি শাসকদের উদ্দেশ্য।
পাকিস্তান ছিলো একটি মধ্যযুগীয় প্রগতিবিরোধী দেশ। সেখানে ক্ষমতা দখল করতো দেশের অধিবাসীদের থেকে বিচ্ছিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল মানুষেরা; আর বড়োবড়ো শরীরের সেনাপতিরা। অস্ত্র আর চক্রান্ত ছিলো সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার পাকিস্তানে। পাকিস্তানের সিংহাসন যারা দখল করেছিলো, শুরু থেকেই তাদের মনে হয়েছিলো পাকিস্তান টিকবে না। তাদের ভয় ছিলো বাঙালিদের। তাই শুরু থেকে পাকিস্তান চক্রান্ত করে বাঙলা ও বাঙালির বিরুদ্ধে। চারদিক থেকে পাকিস্তানি শাসকেরা আক্রমণ করে বাঙলা ভাষাকে। কখনো তারা বাঙলা ভাষার লিপি বদলাতে চায়। বাঙলা বর্ণমালার বদলে চাপিয়ে দিতে চায় ইংরেজি, আরবি অক্ষর। কখনো বানান সহজ করার নামে চক্রান্ত করে বাঙলার বিরুদ্ধে। কখনো বাঙলা ভাষাকে পৌত্তলিক নাম দিয়ে বাঙালি মুসলমানকে বিমুখ ক’রে তুলতে চায়। এবং রাষ্ট্রভাষার নামে উর্দুকে চাপিয়ে দিতে চায় বাঙালির ওপর। বাঙালিরা যদি গ্রহণ করতো উর্দুকে, মেনে নিতো পাকিস্তানি চাপ, তাহলে বাঙলা ভাষা এগোতো অবলুপ্তির দিকে। কিন্তু বাঙালি তা হ’তে দেয় নি।
পাকিস্তানের জন্মের এক মাস আগেই স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় বাঙলার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রস্তাব করে, যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। এতেই সূচনা ঘটে একটি আন্দোলনের। ওই আন্দোলনের প্রথম বড়ো পরিণতি উনিশশো বায়ান্নোর বিদ্রোহ; এবং পরম পরিণতি একাত্তরের স্বাধীনতা। সাতচল্লিশে ভারত ভেঙে দুটি দেশের উদ্ভব ঘটে। তার একটি পাকিস্তান। পাকিস্তানে যার প্রতাপ ছিলো নিরঙ্কুশ, তার নাম মুহম্মদ আলি জিন্না। জিন্নাই পাকিস্তানে প্রথম বাঙলার সাথে শত্রুতা শুরু করে। আর তাকে অনুসরণ করে অন্যরা। পাকিস্তানের শুরু থেকেই আন্দোলন শুরু হয়ে যায় বাঙলার পক্ষে, বাঙলাদেশে। ১৯৪৮-এ জিন্না ঢাকা এসে ঘোষণা করে যে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনো ভাষা নয়’। প্রতিবাদ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। তারা দাবি করে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিশেবে বাঙলাকে স্বীকৃতি দেয়ার।
একটি জাতির ভাষা শুধু পরস্পরের সাথে কথা বলার মাধ্যম নয়। ভাষা জড়িত তার অস্তিত্বের সাথে। ওই ভাষাটিকে কেড়ে নিলে বা পর্যুদস্ত করা হ’লে জাতিটির অস্তিত্বও বিনাশের মুখোমুখি হয়। পাকিস্তানের শুরুতে বাঙালির অবস্থাও হয়েছিলো অমন। তাই তাদের প্রতিবাদ করতে হয়েছে, গ’ড়ে তুলতে হয়েছে আন্দোলন। এ-আন্দোলনে ছাত্ররাই নেয় সক্রিয় ভূমিকা। বাঙলা ভাষার লেখকেরা কাজ করেন আন্দোলনের মূলে। তাঁরা দেখিয়ে দেন বাঙলা রাষ্ট্রভাষা না হ’লে কীভাবে পর্যুদস্ত হয়ে যাবে বাঙালি। তাঁদের বাণী গ্রহণ ক’রে প্রতিরোধে উদ্যত হয় ছাত্ররা ও অন্যরা।
তবে বাঙলার সাথে চক্রান্ত করেছে বহু বাঙালিও। খাজা নাজিমুদ্দিন, নূরুল আমিন, ফজলুর রহমান নানাভাবে বাঙলার বিরুদ্ধে কাজ করে। এবং ১৯৫২-র ৮ই ফাল্গুনে, ২১-এ ফেব্রুয়ারিতে, বৃহস্পতিবারে, ঢাকার রাজপথে ঝ’রে পড়ে ছাত্রদের রক্ত। তাদের অপরাধ তারা বাঙলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিশেবে চেয়েছিলো। রক্তে লাল হয়ে ওঠে বাঙলাদেশ। সেদিনই বোঝা যায় পৃথিবীতে একটি নতুন স্বাধীন দেশের জন্ম আসন্ন। উনিশ বছর পরই জন্ম নেয় সে-দেশটি। বাঙলাদেশই সে-অনন্য দেশ পৃথিবীর, যার জন্মের মূলে কাজ করেছে ভাষা। আছে আরো একটি বিস্ময়কর ব্যাপার। বাঙলাদেশই সম্ভবত একমাত্র দেশ, যার নাম ভাষার নামে। বাঙলা-দেশ। ভাষা বাঙলা, দেশও বাঙলা। পৃথিবীর একটিমাত্র দেশের রাষ্ট্রভাষা বাঙলা। সেটা এই দুঃখিনী নষ্টভ্রষ্ট অপরাজেয় বাঙলাদেশ।