যে মেয়েটি মোহময়ী হতে চেয়েছিল

যে মেয়েটি মোহময়ী হতে চেয়েছিল

দুটি মানবদরদী রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক বোমাবাজির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল কাশীনাথের বাবার প্রাচীন হারকিউলিস সাইকেলটি। ব্রেক কষার মুহূর্তে একটা বোমা ফেটেছিল তাঁর গায়ে। হাসপাতালে যখন নেয়া হল, তখন তিনি মৃত। ময়নাতদন্তের জন্য পুরো বডি দরকার, তাই খোজাখুঁজি করে নয়ানজুলিতে পাওয়া গিয়েছিল তার বাঁ হাত ও বাঁ পায়ের অংশ। পায়েতে তখনও স্যান্ডাকের জুতোটা আটকে ছিল।

এরপর দুটি মানবদরদী দলই দাবি করল হত্যাকারীর শাস্তি চাই। কিন্তু হত্যাকারীকে পাওয়া গেল না, ওরা বলল পরিবারকে ক্ষতি পূরণ দিতে হবে। ওরা বলল পরিবারের একজনকে চাকরি দিতে হবে। রাস্তা অবরোধ হল, যা হয় আর কী, মন্ত্রী এসে জানালেন চাকরি দেয়া হবে। কিন্তু চার বছর হয়ে গেল, কিছুই হয়নি, যদি জানতে চান।

অনাথ কাশীনাথের দিকে মদতের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল উত্তম চোংদার। উত্তম তখন হাটখোলায় নতুন মার্কেট-কমপ্লেক্স এ ওষুধের দোকান দিয়েছে। ওই দোকানের কর্মচারী করে নিল কাশীনাথকে। কাশীনাথ তখন সবে বি কম পরীক্ষা দিয়েছে। ওর বাবা ছিল পালিশ মিস্ত্রি। হাবড়ার একটা ফার্নিচারের দোকানে কাজ করত। কাশীনাথ ওর বাবার কাজ শেখেনি। ওর ইচ্ছে ছিল চাকরি করা ভদ্রলোক হবে।

ও ওষুধের দোকানে চাকরি পেল। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে রাত সাড়ে দশটা। দুপুরে একটা থেকে চারটে বন্ধ। তখন বাড়ি গিয়ে খাওয়া দাওয়া। এর মধ্যেই অন্য কাজও কিছু করতে হয়, যেমন বিকেল পাঁচটায় খাটাল থেকে গোরুর দুধ কিনে চোংদার বাড়ি পৌঁছে দেয়া, চোংদারের চার বছরের মেয়ের বেলা এগারোটার সময় কিন্ডারগার্টেন ইস্কুল ছুটি হলে বাড়ি পৌঁছে দেয়া এইসব।

কাশীনাথের ইচ্ছে ছিল পি এস সি, এস এস সি, স্কুল সার্ভিস কমিশন ইত্যাদি পরীক্ষা দেবে। কমপিটিশন সাকসেস-টাকসেস কিনেছিল, খোলার সময় পায়নি।

কাশীনাথের একটা ভাই আছে। ফিটের ব্যারাম। মানে মৃগী রোগ। আগে টোটকা চলছিল, কাশীনাথ এখন ডাক্তার দেখিয়েছে। উত্তম চোংদার বিনে পয়সায় গার্ডিনাল সাপ্লাই করে যায়। কাশীনাথের বোনের বয়েস বারো। খুব মাথা ঘোরে। উত্তম চোংদার মাঝে মাঝে টনিকের শিশি দেয়, পয়সা লাগে না। পুজোর সময় নতুন জামা দেয় উত্তম, ওষুধের দোকানের মধ্যে একটা ডাক্তারের চেম্বার আছে, এম বি বি এস ডাক্তার বসিয়েছে, ওখানে একটা টিভি সেটও রাখা আছে। রবিবার দোকান বন্ধ। মাঝে মধ্যে কোনও রবিবারে ভি সি পি ভাড়া করে ‘ব্লু’ দেখা হয়, উত্তমের বন্ধুবান্ধব থাকে। কাশীনাথকেও থাকতে দেয়। কাশীকে মোটর সাইকেল চালানো শিখিয়ে দিয়েছে। এমনি ভাবেই কাশীনাথের বিস্বাদ জীবনে নিমক যুক্ত করছে উত্তম। কাশীনাথ কখনও নিমকহারামি করতে পারবে না।

সোনালি গড়াই কুড়ি বছরের যুবতী মেয়ে। কিন্তু ছেলেরা ওকে নিমাই নাম দিয়েছে, সোনালি সেটা জানে। কোথাও যৌবন শব্দ চোখে পড়লে সোনালি চোখ সরিয়ে নেয়। টিভিতে যখন মেয়েরা বুক কাঁপিয়ে নাচে, কিংবা নানা ছলে বুক দেখায়, সোনালির গা জ্বলে যায়। কলেজে পড়ে ও। শালোয়ার-কামিজ পরে না আর। ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে দুটো ছেলে ম্যানচেস্টার সমাসের ব্যাসবাক্য ভেঙে ছিল—যে উওম্যানের চেস্ট ম্যানের ন্যায়। সোনালির নিজের মা নেই। একটা সৎ মা আছে। ওর বাবা সকাল আটটা বারোর ট্রেনে কলকাতা যায়, রাত ন’টায় ফেরে। ওর বাবা কি জানে ও কেন শালোয়ার-কামিজ পরে না? সোনালির নিজের মা অনেক দিন আগে মরে গেছে। সৎমাটা কেমন যেন। শোবার আগে পায়ে আলতা দেয়, কপালে দলা করে সিঁদুর মাখে, সোনালিকে কোনওদিন লিপস্টিক কিনে দেয় না, কোনওদিন ময়েশ্চারাইজার কিনে দেয় না। কোনওদিন ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যায়নি। পাশের বাড়ির মাসিমা হোমিওপ্যাথির ওষুধ দেয়। একটা মোটা বই থাকে টেবিলের উপরে, চশমা পরে, মাঝে মাঝে বই দ্যাখে, আর ওষুধ দেয়। পাঁচ টাকা করে নেয়। একদিন লজ্জার মাথা খেয়ে ওই মাসিমার কাছে গিয়েছিল সোনালি। বলেছিল মাসিমা, আমার স্বাস্থ্যটা ভাল করে দিন না। মাসিমা বলেছিলেন—এমনিতে তো স্বাস্থ্য তোমার ভালই, হাত পা তো বেশ মোটাসোটা….

সোনালি বলেছিল—না, সেটা বলছি না, বলে মাথা নিচু করে ছিল।

মাসিমা বলেছিল, বুঝেছি, বুঝেছি। তারপর চোখে চশমা লাগিয়ে বইটা খুলে ছিল।

মেন্‌স ঠিক মতো হয়?

হয়।

শুরু হয়েছিল কবে?

সেবেন থেকে।

মাসিমা কয়েকটা পুরিয়া বানিয়ে একটা খামে ভরে সোনালির মাথায় হাত রেখে বলেছিল, চিন্তা কোরো না, যখন বিয়ে হবে, ঠিক হয়ে যাবে।

ওই ওষুধ খেয়েছিল সোনালি, কিচ্ছু হয়নি। যখন বিয়ে হবে ঠিক হয়ে যাবে বলে দিলেই হল? বিয়েটা হবে কী করে? কে করবে? কলেজের দু-একটি মেয়ে মেয়েদের পত্রিকা রাখে। ওগুলোতে মাঝে মাঝে মোহময়ী হয়ে ওঠার কথা পড়েছে সোনালি। ‘পুরুষের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠুন’ পড়েছে। পুরুষের চোখে নারীদেহ নামে একটা লেখায় যতসব মান্যগণ্য বিখ্যাত মানুষেরা তাদের মনের কথা বলে দিয়েছে। কিছুদিন পরে আর একটা সংখ্যা বেরোয়, স্তন সংখ্যা। সোনালি কিনে নেয়।

সোনালি টিউশনি করে। ক্লাস ফোরের দুটো মেয়ে। ওদের অঙ্ক করতে দিয়ে বইটা খোলে। লুকিয়ে লুকিয়ে একটু একটু পড়ে। কান লাল হয়, তেষ্টা পায়। চোখে পড়ে খাজুরাহোর পাথরমূর্তির ছবির তলায় লেখা স্তনই নারীর সম্পদ। তারপর একটা বিজ্ঞাপন। স্তন সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য গ্লান্ডিনার।

উত্তম চোংদারের ওষুধের দোকানের নাম নবজীবন ফার্মেসি৷ দোকানটার সামনে একবার দাঁড়াল সোনালি। দোকানে তখন কয়েকজন খদ্দের ছিল। সোনালি সরে গেল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখল দোকান ফাঁকা হয়েছে। তবু যেতে পারছেনা। বাজারের মধ্যে যে-ওষুধের দোকানটা, ওখানে একটা বুড়ো লোক থাকে। বরং ওখান থেকে কেনাই ভাল। কিন্তু ওখানে বড্ড ভিড় থাকে। তা ছাড়া মুখও চেনা। ওদের পাড়াতেই থাকতেন। ওর বড় লজ্জা করে।

সোনালি রেডি হয়। একটু স্মার্ট হবার জন্য নিশ্বাস নেয়। রেডি সেডি গো। শো করে যেন উড়ে নবজীবনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। গ্লান্ডিনার কত দাম?

সামনের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ছিল কাশীনাথ। ভিতরে একটা টেবিলে বসেছিল উত্তম। ওখানেই ক্যাশ। কাশীনাথ আলমারি খুলে ভাইলটা বার করে। ভাইলের গায়ের দাম দেখে বলল, সত্তর টাকা।

সোনালি টিউশনির পনেরো দিনের মুজুরি। সোনালি ব্যাগ থেকে একটা একশো টাকার নোট বার করে বলল, দিন।

ভিতর থেকে উত্তম চোংদার সোনালিকে দেখল। দেখে বলল, মালিশ করতে হবে কিন্তু। ভাল করে মালিশ করতে হয় জানেন তো। সোনালির কান লাল হয়ে গেল।

উত্তম কাউন্টারের দিকে এগিয়ে এল। বলল, হাবড়া চৈতন্য কলেজে পড়েন না?

সোনালি কোনও জবাব দিল না।

উত্তম প্যাকেটটা একটা কাগজে মুড়ে দিয়ে বলল, বছর খানেক ধরে ইউজ করলে উপকার হয়। গাছ-গাছড়া আজও কথা বলে।

সোনালিদের বাড়িটা গোবরডাঙা স্টেশন থেকে একটু ভিতরের দিকেই। মরা যমুনা নদীটা সামনেই। এখনও জোয়ার ভাঁটা খেলে। ওখানে ছোটবেলায় স্নান করেছে সোনালি। এখনও মাঝে মাঝে করতে ইচ্ছে হয়। অনেক মেয়ে-বউরা স্নান করে যমুনার জলে, স্নান করে ভেজা কাপড়ের উপর গামছা ঢাকা দিয়ে বাড়ি ফেরে। সোনালির বোনটা, মানে সৎবোনটা, সিক্স এ পড়ে। ও নদী নেয়ে এলে ফ্রকের উপর গামছা ঢাকা দেয়। সোনালিদের বাড়িতে একটা টিউবওয়েল আছে। ওখানেই স্নান করে। ওর গামছা ঢাকা দিয়ে ঘরে না গেলেও চলে। ওর একদিন ইচ্ছে করল নদীতে নাইবে। নদীতে স্নান করে ঘরে ফিরছিল, পাকা রাস্তা দিয়ে একটুখানি হাঁটতে হয়, তোয়ালে ঢাকা দিয়েছিল বুকের উপরে। ওই রাস্তা দিয়েই বাইক চালিয়ে যাচ্ছিল উত্তম চোংদার। সোনালিকে দেখে ব্রেক কষল। বলল, ওঃ লুকিং সো বিউটিফুল। আসবেন, আর একটা দিয়ে দেব। সোনালিদের বাড়ির চারিদিকে আকাশ। আর কাছেই একটা নদী। ওদের ঘরটা গাছের ছায়ায় ঢাকা, ঘর তো নয়, কুটির। সৎমায়ের ঝি, সোনালি যেন রূপকথার মেয়ে হয়ে গেল। মায়া-সরোবরে নেয়ে এসেছে যেন। বাইকের টিক টিক এখনও শোনা যাচ্ছে, পক্ষীরাজ ঘোড়া। দর্পণে মুখ দেখতে চাইল সোনালি। ড্রেসিংটেবিলটা মায়ের ঘরে।

সোনালিদের একটা ঘর পাকা, আর একটা ঘরে এখনও টালির চাল। টালির ঘরে সোনালি থাকে, একটা টেবিলে ওর ভারতীয় দর্শন, ইউরোপের ইতিহাস, জুলিয়াস সিজার, আর কী করে মোহময়ী হয়ে উঠবেন। ওর সঙ্গে শোয় ওর সৎ বোন, সৎ ভাই। বাবা-মা অন্য ঘরে। ওর ভাইবোনরা শুয়ে পড়লে, সোনালি পড়ার টেবিলে বসে থাকে, তারপর রাত নিশুতি হলে, ও অন্ধকারে একা একা নিজের বুকে আয়ুর্বেদ মালিশ করে।

সোনালি একদিন নবজীবন ফার্মেসিতে গেল। তখন বিকেল। কাশীনাথ গিয়েছিল খাটালে। দুধ আনতে। উত্তম চোংদার একা দোকানে, এবং ডাক্তারের চেম্বারটাও ফাঁকা। সোনালির পদক্ষেপ সেদিন কী স্মার্ট, সোজা দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। উত্তম উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, আইব্বাস, এসে গেছেন। কথা আছে, এ ঘরে চলুন। ডাক্তারের চেম্বারে গিয়েই বলেছিল, এই তেল মেসেজ করার একটা নিয়ম আছে।

গর্ভপাত করার কয়েকটা নিয়ম আছে। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে ভ্রুণহত্যার কৌশলও পালটাচ্ছে। শুধু ভ্রুণহত্যাই বলি কেন, সভ্যতা যত এগিয়েছে হত্যা ব্যাপারটাও তত সহজ ও সাবলীল হয়েছে। আগে ঘাতককে কাছে আসতে হত। তিরধনুকের পর দূর থেকেও হত্যা সম্ভব হল। বন্দুকে আরও দূর থেকে মেরে ফেলা যায়, কামানে আরও দূর থেকে, এখন ঘরে বসে, স্যান্ডুইচ খেতে খেতে, কমিকস দেখতে দেখতে, হাসতে হাসতে একটা বোতাম টিপে দিলেই হল। গর্ভপাতের জন্য আগে জরায়ুতে শেকড় বা কোনও সরু ডাল প্রবিষ্ট করে দেয়া হত। জরায়ু বাইরের কোনও পদার্থ সহ্য করতে পারে না, সে নিজের মাংসপেশি সংকোচন করে বাইরের জিনিসটাকে ঠেলে বার করে দিতে চায়। যত্নে রাখা ভ্রুণটিও বেরিয়ে যায় তখন। প্রচণ্ড কষ্ট হয় এতে গর্ভধারিণীর। রক্তপাতও হয়। জরায়ুতে নুনজলও ঢুকিয়ে মারা হয় ভ্রুণটিকে, যে ভাবে শিঙি মাছ মাগুর মাছকে নুন মাখিয়ে মারা হয়। নারকেল কোরাবার মতো করে ছোট ভ্রুণটিকে জরায়ুর আধার থেকে চেঁচে কুচি কুচি করে ফেলার মতো যন্ত্রপাতিও এই সভ্যতা দিয়েছে—ডায়লেটেশন অ্যান্ড কিউরেটিং মেশিন। ওই কুচিকুচি ভ্রুণশরীরটিকে জরায়ুর আধার থেকে বাইরে বের করে আনবার জন্য রয়েছে সাকসান মেশিন।

নবজীবনের ডাক্তারের ফাঁকা চেম্বারে এই রবিবার একটা সুন্দর ছিমছাম কিউট বাক্স এসেছে। ওই বাক্সে পুরো প্যাকেজটাই আছে। ডায়লেটেশন অ্যান্ড কিউরেটিং মেশিন উইথ সাকসান। নবজীবন ফার্মেসি রবিবার বন্ধ থাকে। আজ রবিবার। বাইরে তালা ঝুলছে। ভিতরে রয়েছে হেলাবটতলার মাতৃমঙ্গল ক্লিনিকের ডাক্তার গণপতি মণ্ডল। হাবড়া অশোকনগর গোবরডাঙা অঞ্চলের রেলস্টেশনে, বাসটার্মিনাসে, বাজারের পেচ্ছাপখানায় এই ডা. মণ্ডলের টাইপরা গোঁপওলা ছবি দেখতে পাওয়া যায়। আর আছে সোনালি।

উত্তম চোংদার আর কাশীনাথ নবজীবনের ভিতরে বসে আছে। সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ, নবজীবনের ভিতরে টিউব লাইটের আলো। এখন বেলা এগারোটা। ঘরের ভিতর প্রচুর ধোঁয়া, কাশীনাথ ও উত্তম সিগারেট খেয়ে চলেছে। ইলেকট্রনিক দেয়াল ঘড়িটার কাঁটা নড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে, পাশের চেম্বার থেকে গণপতি মণ্ডলের গলা শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে—কোনও ভয় নেই, পনেরো মিনিটের ব্যাপার। মেয়েটার ভয়-পাওয়া কাতর কণ্ঠ মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে, কিন্তু কী বলছে বোঝা যাচ্ছে না। গণপতি মণ্ডল একবার বাইরে এলেন। বললেন, ও কাশীনাথবাবুকে একটু ডাকছে।

কাশীনাথ ঘরের পর্দা সরিয়ে উঁকি দিতেই তুলোর বান্ডিল থেকে এক মুঠো তুলো খামচে নিয়ে সোনালি ওর দুই উরুর মাঝখানে ফেলে দিল। আড়াল করতে চাইছে ও, একটু আড়াল। কাশীনাথের চোখের দিকে চাইল। কাশীনাথ ওর চোখের ভাষা পড়তে পারল। কাশীনাথ ঘাড় নাড়ল। এবং মনে মনে বলল, কথা দিচ্ছি দু’বছর পরে। সোনালি মৃদু হাসল। আবার কী যেন বলছে চোখ। কাশীনাথ বলল, কোনও ভয় নেই, আমি পাশের ঘরেই আছি। সোনালি হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। গণপতি মণ্ডল বলল, আবার কান্না? সাউন্ড বাইরে যাচ্ছে, বলেই এক দলা তুলো সোনালির মুখের মধ্যে পুরে দিল, ঠেসে দিল। কাশীনাথকে বলল, বাইরে যান।

গণপতি মণ্ডল টিউবে লুব্রিকেটিং জেলি মাখাতে মাখাতে সোনালিকে জিজ্ঞাসা করল, একচুয়ালি ফাঁসিয়েছে কে? কাশীনাথ?

সোনালি মাথা ঝাঁকাল।

উত্তমবাবু?

সোনালি চুপ।

নাকি দু’জনেই কাজ করেছে?

সোনালির চোখে জল। মুখের আওয়াজ শুষে নিচ্ছে তুলোর দলা।

গণপতি মণ্ডল টিউবের মাথায় কিউরেটিং-এর যন্ত্রটা বসিয়ে দিল। ওটাই ধারালো দাঁতে ভ্রুণটা চাঁচবে। বাইরে থেকে ওই দাঁতের শক্তি বাড়ানো কমানো যায়, সরানো যায়, নড়ানো যায়। গণপতি মণ্ডল যন্ত্র বসানো টিউবটাকে ঠেলে দিলেন। দুর্গা দুর্গা।

পাশের বন্ধ ঘরে চুপচাপ বসে থাকা উত্তম দুটো ধূপকাঠি জ্বালিয়ে মাকালীর ছবির ফ্রেমে গুঁজে দিল। কাশীনাথ এসে টুলে বসল। উত্তম কাশীনাথকে বলল, তোকে এত করে বললাম, ওকে বিয়েটা করে নে, মাইনে বাড়িয়ে দিতাম, শুনলি না।

লোকে বলে আমি উত্তমদার চামচে। আমিও তাই মনে করি। উত্তমদা তখন আমাকে ডেকে চাকরিটা না দিলে না খেয়ে মরে যেতাম। উত্তমদা বলেছে একটা প্যাথলজিকাল ক্লিনিক করে দেবে। উত্তমদা এখন পার্টি করে। টাকা দেয়, পার্টির লোক আসে, আড্ডা মারে, থানাতেও খুব খাতির, ওসির সঙ্গে মাল খায়।

উত্তমদাই আমাকে প্রথম মাল খাইয়েছে, প্রথম ব্লু দেখিয়েছে, সোনালিকে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকিয়ে আমাকে যেতে বলেছিল একদিন। বলেছিল, যা, একসপেরিয়েনস করে আয়। আমি যাইনি। আমার খুব ভয়।

উত্তমদা আমাকে দিয়ে বোতলটোতল আনায়, আমি এনে দি। গেলাসেও ঢেলে দি, আমাকে খেতে বলে। প্রথম প্রথম খেতাম না, এখন মাঝে মধ্যে একটু খাই। না খেলে আমার ভয় করে। উত্তমদা আমার সঙ্গে হার্গিস মালিকের মতো ব্যবহার করেনি, বন্ধুর মতো। ওর মেয়ের জন্মদিনের সব বাজার-টাজারের দায়িত্ব ছিল আমার উপর। উত্তমদা বউ আর শালি নিয়ে দিঘা গেল। পুরো দোকানটা আমিই দেখলাম। আমাকে এতটা বিশ্বাস করে। তাই আমি উত্তমদার কোনও কথা ফেলতে পারি না, কিছু করতে বললে না করতে পারি না। একবারই না করেছিলাম—যখন ফেঁসে যাবার পর উত্তমদা আমাকে বলেছিল, ওকে বিয়ে কর, মাইনে বাড়িয়ে দেব।

কেন করব আমি, ওর পেটে উত্তমদার বাচ্চা, আর আমাকে বলছে বিয়ে করো। আমি বলেছিলাম, তা হয় না উত্তমদা। বিয়ে করার ছ-সাত মাসের মধ্যে বাচ্চা হয়ে গেলে সবাই ভাববে বিয়ের আগেই আমি…।

বেশ করেছিস বিয়ের আগে করেছিস। ভাবলে তোর কী যায় আসে!

আমি তো করিনি উত্তমদা।

করিসনি তো করিসনি। তা এখন বিয়েটা করে নে।

কিন্তু বাচ্চাটা তো আমাকে বাবা ডাকবে। সারাটা জীবন।

ডাকুক।

না। ক্ষমা করে দিও উত্তমদা।

তা হলে অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।

এই বলে অনেকক্ষণ চুপচাপ ছিল উত্তমদা। তারপর বলল, আমি এখন পুরো অফ হয়ে যেতে পারি, কিন্তু কী সব জিনেটিক টেস্ট-ফেস্ট হচ্ছে আজকাল। ওটাকে অফ করে দিতে হবে। তুই আমাকে মদত করবি তো?

আমি বলেছিলাম, করব।

করছি তো, আমি তো মদত করছি। মদত না করে কী করব? ডাক্তারখানা বন্ধ হয়ে গেলে আমার যে ভাত বন্ধ হয়ে যাবে।

আমি শালা উত্তম চোংদার, বুদ্ধু বনে গেলাম। কেন যে ফাঁসলাম। ঘরেতে শালা পারফেক্ট ফ্যামিলি প্ল্যানিং করছি, একটা মেয়ে, চার বছর বয়েস হল—এখনও ফারদার বউয়ের পেট বাধাইনি, এখানেই গড়বড় হয়ে গেল।

ওকে জাস্ট বিনে পয়সায় ভাইলগুলো দিচ্ছিলাম। ওর খুব শখ হয়েছিল যৌবনবতী হবে। ভিটামিন ক্যাপসুলও দিচ্ছিলাম, পয়সা তেমন নিতাম না। ওকে বললাম, নিজে নিজে মালিশ করে লাভ হয় না। অন্যহাতে করাতে হয়, যত করাবে তত ভাল হবে। তাতেই টোপ গিলে ফেলল মেয়েটা, তো আমি কী করব?

পরপর ক’মাস ধরে রোববারের খবর কাগজে দেখছিলাম সব বিখ্যাত বিখ্যাত লোকদের কেচ্ছা বেরুচ্ছে। সবারই কত সেক্স লাইফ। আমিও কম কীসে? আমারও তো ইচ্ছে হতে পারে। আমিই বা এক বউকে নিয়ে পড়ে থাকব কেন? অনেককে ভোগ করো—এটাই তো পৌরুষ। মরদের লক্ষণ। রোববারের কাগজেই তো বক্স করে লিখেছে বহুগামিতা পুরুষের পক্ষে স্বাভাবিক।

কাশীনাথটাকে বললাম, বিয়েটা কর, খরচা আমার, শালা সেয়ানা আছে। সিধে ডিনাই করল। কেসটা মিটে যাক, ওকে হাটিয়ে দেব। একের নম্বরের নিমকহারাম।।

উত্তম চোদার কাশীনাথকে বলল, অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, যা-না, একবার ওঘরে, কী হচ্ছে দেখে আয়, তুই তো কখনও পুরো মেয়ে দেখিসনি।

কাশীনাথ বলল, ধুস!

উত্তম বলল, ফালতু ফালতু কত খরচা হয়ে গেল। গণপতি মণ্ডল একগাদা টাকা চেয়ে বসেছে।

গণপতি মণ্ডল হন্তদন্ত হয়ে পাশের ঘরে এল। এসেই বলল, স্যালাইন আছে, স্যালাইন, একটা বোতল বার করুন এক্ষুনি।

উত্তম বলল, কেন, স্যালাইন কী হবে?

দরকার, দরকার। স্যালাইনের সঙ্গে টিউব-নিডলও বার করুন।

উত্তমের চোখের দিকে তাকাল কাশীনাথ। চোখে সম্মতি পেল। সঙ্গে সঙ্গেই কাশীনাথ শোকেশ থেকে একটা স্যালাইন বার করল। গণপতি মণ্ডল ওটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পাশের ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে গেল। উত্তমও পিছন পিছন গেল। উত্তম ও ঘরে গেল বলে কাশীনাথও। গণপতি মণ্ডল মেয়েটার মুখের ভিতর থেকে তুলোর দলাটা বার করে নিল। মেয়েটা এখন যতটা জোরে কাতরাতে পারছে, সেই আওয়াজ বেশি দূরগামী হবে না। মেয়েটার দুই উরুতে রক্ত। যোনিমুখে রক্ত, রবার ক্লথে রস রক্ত ফেনা।

মাছি এসে গেছে।

গণপতি মণ্ডল ঘামছে। বলল, ফিটাসটা এমন আঁকড়ে ধরেছিল ইউটেরাসটাকে, যেন মায়ের কোল। স্ক্রাপ করতে গিয়ে ইউটেরাসটা ফুটো হয়ে গেছে।

তা হলে কী হবে!

ভিতরে ব্লিডিং হচ্ছে। কেস খারাপ।

গণপতি মণ্ডল মেয়েটির নাড়িতে আঙুল রাখে। চোখ বোজে। মেয়েটার জড়ানো কথা শোনা যায়, আমাকে বাঁচান, আর কখনও চাইব না। একটা মাছি গরিব স্তনবৃন্তের উপরে চুপচাপ বসে যায়, গণপতি মণ্ডল বলে—এখন এই অবস্থায় হাসপাতালেও যাওয়া যায় না। সবার হাতকড়া পড়বে। ডাইসিনিন ইনজেকশন আছে, ডাইসিনিন?

কাশীনাথ জানে ওটা নেই। ইশ, কেন নেই? ডাইসিনিনটা থাকলে কি মেয়েটা ঠিক হয়ে যেত। তা হলে ক্রোমোস্ট্যাট? গণপতি জিজ্ঞেস করে।

আছে। আছে। কাশীনাথ শোকেশ খুলে ছোঁ মেরে নিয়ে আসে৷ গণপতি ইনজেকশনটা দ্রুত পুশ করে। মেয়েটার কষ্টের শব্দ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে, কিন্তু চোখ খোলা। চোখ কথা বলছে, বাঁচাও, প্লিজ বাঁচাও।।

উত্তম বলে, আপনার উপর বিশ্বাস ছিল গণপতিবাবু।

গণপতি বলে, শালার ফিটাসটা এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছিল ইউটেরাসটাকে। আমি কী করব, একটু জোর পড়ে গিয়েছিল চাঁচতে গিয়ে।

কী হবে যদি… উত্তম আর কিছু বলতে পারে না।

ডেকাড্রনও দেওয়া হল। মেয়েটা চোখ বুজল।

সারাটা ঘরে নিস্তব্ধতা। একটা ছোট ফ্যান ঘুরে যাচ্ছে। গণপতির একটা হাত মেয়েটার হাতের কবজি ধরে আছে। একটু পরেই গণপতি দু’হাতে মেয়েটার বুকে চাপ দিতে থাকল, তারপর নাড়ি দেখল, চোখের পাতা তুলে চোখ দেখল, তারপর বলল, সরি।

উত্তম চিৎকার করে উঠল, শুয়োরের বাচ্চা কোথাকার।

গণপতি আর একবার মিনমিন করে বলল, এমনভাবে খামছে ধরেছিল ফিটাসটা…। গণপতি বেসিনে লাল সাবানে হাত ধুয়ে পকেট থেকে কয়েকশো টাকা বার করে টেবিলে রাখল। বলল, যে টাকাটা অ্যাডভানস নিয়েছিলাম সেটা ফেরত দিচ্ছি।

উত্তম বলল, এসব নখরামি ছেড়ে বলুন এখন কী করব?

গণপতি বলল, আমাকে ফাঁসাবেন না। আমি ডিনাই করব। আবার সাবান ঘষতে লাগল হাতে। আমি ফেঁসে গেলে আপনাকেও ফাঁসাব আমি।

কাশীনাথ বলল, উত্তমদা, আমি তো কিছু করিনি, আমিও কি ফেঁসে যাব?

গণপতি বলল, যাতে কাউকে না ফাঁসতে হয়, সেই ব্যবস্থা করলেই তো হয়। কোনও চিহ্ন রেখো না।

কাশীনাথ তখন চিহ্ন লোপাট করছে। তুলো দিয়ে মুছে নিল উরুতে লেগে থাকা রক্ত। যোনি মুখে জমাট বাঁধা কালচে রক্ত, এই প্রথম কোনও যোনি স্পর্শ করল কাশীনাথ, মৃতমানুষের। উত্তমদা কিছু বলছে না, তাকিয়ে আছে শুধু, ওতেই বুঝতে পারছে কাশীনাথ, উত্তমদা বলছে, আমি তোর প্রভু, কাশীনাথ তুলো দিয়ে রবার ক্লথের রসরক্ত কাঁচিয়ে পরিষ্কার করে। উত্তম দু’হাতে মুখ ঢাকে। কাশীনাথ সমস্ত রক্তমাখা তুলো একসঙ্গে জমা করে কয়েক ফোটা স্পিরিট ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন নিভে গেলে কালো ছাইগুলোকে একটা নিরীহ ঠোঙায় ভরে ফেলে।

উত্তম চোংদার ওষুধের একটা খালি পেটি বার করে আনে। বলে এটায় ঢোকাতে হবে। কাশীনাথ ওটাকে দেখে। বলে ওটায় তো কোম্পানির নাম লেখা, কনসাইনমেন্ট নম্বর লেখা, ফেঁসে যাবে তো। নাকে অক্সিজেন ফিট করে দেবার পর বড়লোক রোগী যেভাবে নার্সিংহোমের নার্সকে থ্যাংককিউ বলে, সেরকম ভাবেই বলল, থ্যাংকিউ। কাশীনাথ একটা মিনারেল ওয়াটারের খালি পেটি নিয়ে এল। যাবতীয় নম্বরটম্বর ছিঁড়ে ফেলল, বলল—এটায়।

উত্তম বলল, ঢুকবে না। একটা করাত ছিল না ঘরে, করাত, —পারবি?

কাশী ওর প্রভুর দিকে তাকিয়ে বলল, পারব।

কাশীনাথ, ভিতু কাশীনাথ, নিজে হাতে কোনওদিন মুরগিও কাটেনি৷ হাতে করাত তুলে নিল। মেয়েটার মুখের দিকে তাকাল না, ভুল করে উচ্চাভিলাষী হতে যাওয়া বুকের দিকেও নয়, শুধু গলাটার দিকে তাকিয়ে ওখানে করাতটা চালাতে লাগল। হচ্ছে, আলগা হচ্ছে, এই প্রভু, পারলাম। চেয়ারে বসে থাকা উত্তমের দিকে তাকাল কাশীনাথ। কাশীনাথ দেখল উত্তমদার মাথাটা ঝুলে গেছে, চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছে উত্তমদা। কাশীনাথ দৌড়ে গিয়ে উত্তমকে ধরে ফেলল। উত্তম অজ্ঞান হয়ে গেছে। কাশীনাথ উত্তমকে শুইয়ে দেয় মেঝেতে। জলের ঝাপটা দেয় চোখে মুখে। উত্তম একটু পরে চোখ খোলে। বলে—হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গেল কাশী। তা হলে একটু মানুষ আমি এখনও আছি বল?

কাশী কি তা হলে একটুও মানুষ নেই এখন?

কাশী আবার কাজে লেগে গেল। নিপুণ ভাবে করাত দিয়ে হাঁটুর তলা থেকে পা দুটো কেটে ফেলল। পাঁচ টুকরা সোনালি নামের মেয়েকে আলাদা আলাদা পলিথিনে ঢুকিয়ে পলিথিনের মুখ বেঁধে বাক্সটার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। দুটো ইটও রাখল বাক্সটার ভিতরে। অয়েল ক্লথটাও বাক্সটার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। ফিনাইল জল দিয়ে ভাল করে মুছে নিল মেঝে। সব পরিষ্কার। পেশেন্ট দেখার বিছানা এখন শুধু বিছানা হয়েই পড়ে আছে। এবার একটা দড়ি দিয়ে বাঁধতে লাগল, তারপর দড়িটার শেষ প্রান্তদুটোকে ফাঁস লাগিয়ে একটা ফুল তৈরি করল, কোনও প্রেজেনটেসনের প্যাকেট যে ভাবে বেঁধে দেয়। তারপর দু’হাত ঝেড়ে উত্তমকে বলল, নিন। যেন উপহার।

উত্তম বাক্সটার দিকে তাকাল। কাশীনাথের দিকে, তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, এত বেলা হয়ে গেছে। এবার বাড়ি চল।

কাশীনাথ শেষ বারের মতো দেখে নিল কোনও চিহ্ন পড়ে আছে কি না।

উত্তম বলল, রাত দশটায় এখানে আসিস। আমিও আসব। বাক্সটা যমুনার জলে ফেলে দেব।

কাশী ঘরে গেল। ওর মা বলল, এত দেরি হল কেন?

কাশী বলল, দরকারি কাজ ছিল একটা।

ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট টিভিতে সানন্দা ক্যুইজ দেখল, খেতে বসল, কিন্তু একটু পরেই ভাতের থালার মধ্যেই বমি করে ফেলল কাশীনাথ।

রাত্রি দশটাতেই নবজীবন ফার্মেসির সামনে পৌঁছে গেল কাশীনাথ। উত্তমও এসেছে মোটর বাইকে। ওরা তালা খুলে ভিতরে ঢুকল। আলো জ্বালাল। দেখল বাক্সটা পড়ে আছে। আর দেখল। একটা লাল পিঁপড়ের লাইন বাক্সটার ভিতরে যাচ্ছে।

উত্তম বলল, কাশী, তুই আমাকে মদত করলি, জিন্দেগীতে ভুলব না। লাস্ট স্টেজেও তুই আমাকে বাঁচিয়ে দে। একটা মোটর সাইকেলে এত বড় বাক্স আর দু’জন ধরবে না। আমায় সবাই চেনে। বরং তুই যা। মোটর বাইকটার পিছনে বাক্সটা বেঁধে দেব। তুই অর্জুনপুরে যমুনার কাঠের ব্রিজটাতে চলে যাবি, ফেলে দিবি, দশ মিনিটের ব্যাপার। পারবি না?

কাশীনাথ মোটর বাইকের গিয়ার পালটায়। ঘটঘট ঘটঘট। হাতের একসেলারেটারে স্পিড বাড়ায়। পৃথিবী টলছে। ও এখন স্বাধীন। ওর সামনে এখন ওর প্রভু নেই। ঘটঘট ঘটঘট। এই দেহ নিয়ে এখন যেখানে খুশি চলে যেতে পারে। ও স্বাধীন। ও কাশীনাথ। কাশীনাথ শিবের আর এক নাম। ওর পিছনে বাক্সবন্দি সতী। ও এখন দক্ষযজ্ঞ বাঁধাতে পারে, ও এখন প্রলয় নাচন নাচতে পারে। আই লাভ ইউ সোনালি, তোমাকে ভাল বেসেছিলাম। কাউকে বলতে পারিনি, নিজেকেও নয়। সোনালি তুমি কেন মোহময়ী হতে চেয়েছিলে? ঘটঘট ঘটঘট। তীব্র হেডলাইট। আমি বাক্স খুলে একটা একটা করে অঙ্গ ছুড়ে দেব। পা-দুটো ছুড়ে দিলাম নবজীবন ফার্মেসীতে। মোহময়ী হতে চাওয়া করুণ বুকজোড়াকে ছুড়ে দিলাম গ্লান্ডিনার কোম্পানিতে। মুণ্ডুটা ছুড়ে দিলাম থানায়। সব তীর্থক্ষেত্র হয়ে ওঠো, পীঠস্থান।

কাশীনাথ অর্জুনপুরের দিকে যাচ্ছে না। একদম অন্যদিকে। অন্য রাস্তায়। কাশীনাথ থানার সামনে এসে থামল। গাছে জোনাকি। কাশীনাথ থানার ভিতরে গেল। পুলিশের জামা পরে একজন তখন আধুনিক রমণীদের রমণীয় পত্রিকার একটা পুরনো সংখ্যা পড়ছে। স্তন সংখ্যা। কাশীনাথ ওখানে দাঁড়াল।

কী চাই?

উত্তর নেই।

কী চাই এখানে?

কাশীনাথ চুপ।

বলবেন তো কী চাই?

কাশীনাথ কিছু না বলে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। চোখ ফেটে জল বেরুল। কাশীনাথ দু’হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়ল, আর তখন নিজেকে মানুষ মনে হতে লাগল, স্বাভাবিক মনে হতে লাগল।

পরদিন খবর কাগজে বেরুল অস্বাভাবিক যৌন মানসিকতার শিকার হল একটি তরুণী। মানবদরদী প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলি বলল অপরাধীর শাস্তি চাই। আর রমণীয় পত্রিকাটি বিজ্ঞাপনে জানাল পরবর্তী সংখ্যার কভার স্টোরি— ‘অস্বাভাবিক যৌন মনস্তত্ত্ব।’

পরিকথা, ডিসেম্বর ১৯৯৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *