3 of 3

যে বই তোমায় দেখায় ভয়, সে বইও পড়া উচিত

‘যে-বই তোমায় দেখায় ভয়, সেগুলো কোনো বই-ই নয়, সে-বই তুমি পড়বে না। যে-বই তোমায় অন্ধ করে, যে-বই তোমায় বন্ধ করে, সে-বই তুমি ধরবে না’— এই ছড়াটি চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে, শুনেছি, বাদ দেওয়া হয়েছে এ বছর। কারণ, অভিযোগ উঠেছে, এই ছড়ায় ধর্মগ্রন্থের কথা বলা হয়েছে। ধর্মগ্রন্থ পড়তে নিষেধ করা হয়েছে। বিজ্ঞানের বই যেহেতু আলো দেয়, জ্ঞান ছড়ায়, সুতরাং বিজ্ঞানের বই, ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য ইত্যাদি পড়তে বলা হয়েছে।

আমি কিন্তু মনে করি যে বই তোমায় অন্ধ করে, সে বইও তোমার পড়া উচিত। সব রকম বই-ই, এমন কী ধর্মের বইও, সবার, এমন কী শিশু-কিশোরদেরও, পড়া উচিত। তাদের জানা উচিত কোন ধর্ম কী বলে। জানা উচিত ধর্মের খুঁটিনাটি, ধর্মের আদ্যোপান্ত ইতিহাস। শুধু নিজের বাবা মা’র ধর্ম নয়, অন্যের ধর্ম সম্পর্কেও জানা উচিত। একই সঙ্গে ধর্মের বিকল্প বা বিপরীত মত সম্পর্কেও, যেমন, অস্তিত্ববাদ, যুক্তিবাদ, মানববাদ সম্পর্কেও জানতে হবে। তারপর এক সময় বয়স হলে, বুদ্ধি হলে মানুষ নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে কোনও ধর্ম সে আদৌ পালন করবে কি না, করলে কোন ধর্ম, অথবা কোন বিশ্বাস।

ধার্মিকেরা যতই বোঝাতে চাক ধর্মে এবং বিজ্ঞানে কোনও বিরোধ নেই, আসলে কিন্তু ধর্ম আর বিজ্ঞান দুটো সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী মতবাদ। একটিতে বিশ্বাস থাকলে আরেকটিতে বিশ্বাস থাকার কথা নয়। কিন্তু অনেকেই দুটোতেই বিশ্বাস করে বলে দাবি করে। বিবর্তনবাদে বিশ্বাস করলে ঠিক কী করে সৃষ্টিবাদে বিশ্বাস সম্ভব জানি না। কোনও কোনও বিজ্ঞানী বলেন, মস্তিষ্কের এক এক কোঠায় এক একটা বিশ্বাস ভরে রাখা হয়, তাতে দুই পরস্পরবিরোধী বিশ্বাসের মধ্যে কোনও সংঘর্ষ বাধে না।

ছোট বেলায় ইস্কুলের বর্ণ পরিচয় বইয়ে পড়তাম অ তে অজগর, আ তে আম, ও তে ওল। ওল খেয়ে দাও ছুট, গলা করে কুটকুট। এখন শুনছি ও তে ওড়না চাই লেখা হচ্ছে। ওড়না চাই, বোরখা চাই, হিজাব চাই- এসব একটি নির্দিষ্ট মতবাদের প্রচার। একটি গণতন্ত্রে সব ধরনের মতবাদের স্থান থাকা উচিত। কোনও একটি মত, সে মতটি সংখ্যাগরিষ্ঠের মত বলেই সেটিকে ইস্কুলের বইয়ে প্রাধান্য দিতে হবে- তা ঠিক নয়। ওড়না পরতে বলা হচ্ছে মেয়েদের, ছেলেদের নয়। বর্ণ পরিচয় বইটি কিন্তু ছেলে মেয়ে উভয়ে পড়ছে। প্রথম শ্রেণিতেই ছেলে মেয়েদের পড়তে হচ্ছে মেয়েদের ওড়নার কথা। মেয়েদের শরীর ঢেকে রাখার কথা। যৌনতার বোধ শুরু হওয়ার আগেই চালান করার চেষ্টা হচ্ছে যৌনবোধ এবং শরীর নিয়ে লজ্জা, সংকোচ এবং শঙ্কা। শিশুর জীবন থেকে শৈশব কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র ছাড়া এ আর কী?

মেয়েদের ওড়না পরার যেমন অধিকার আছে, ওড়না না পরারও অধিকার আছে। অক্ষর শেখাতে গিয়ে ওড়না পরতে চাওয়া শেখানো মানে শিশুদের মস্তিষ্কে ওড়না জিনিসটা ঢুকিয়ে দেওয়া, ওড়নাকে পোশাক হিসেবে উচ্চস্থানে বসানো, অথবা এটিকে বাধ্যতামূলক একটি পোশাকে পরিণত করা। হিজাব বা বোরখার বেলায়ও একই তত্ত্ব খাটে। কোনও একটি নিয়মকে ইস্কুলের বইয়ে তুলে ধরার অর্থ দাঁড়ায়— এই নিয়মটি শ্রেষ্ঠ নিয়ম, এই নিয়মের বাইরে যাওয়াটা অনুচিত। যারা ওড়না পরতে চায় না, তাদের কি তাহলে নিয়ম ভঙ্গকারীর দলে ফেলা হলো না? যে মেয়েরা ওড়না পরে না, তারা তো আসলে নিয়ম ভঙ্গকারী নয়, তারা ওড়না না পরার নিয়ম মানে। ওড়না পরা এবং ওড়না না পরা- দুটো নিয়মের মধ্যে ওড়না না পরার নিয়মটিকে যে কেউ বেছে নিতে পারে। এতে তাদের মান বা সম্মান সামান্যও বিঘ্নিত হওয়ার কথা নয়।

শিশুরা যা কিছু দেখে, যা কিছু শোনে, যা কিছু পড়ে, শেখে। জগতে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে- সেই সব মত সম্পর্কে প্রথম থেকেই শিশুদের শিক্ষা দেওয়া উচিত। শুধু একটি নির্দিষ্ট মতবাদ সম্পর্কে জানা এবং এক মতবাদকেই প্রাধান্য দেওয়া বা এর পক্ষেই গীত গাওয়া শিশুদের অধিকার পরিপন্থী। শিশুদের যদি শেখানো হয় কোনো মতবাদ, তাহলে সেই মতবাদের বিপরীত মত সম্পর্কেও তাদের জ্ঞান দিতে হবে। পুরুষতন্ত্র শেখালে চলবে না, পুরুষতন্ত্রের বিপরীত মত নারীবাদ সম্পর্কেও জানাতে হবে। তা না হলে সব কিছু জানার অধিকার থেকে শিশুদের বঞ্চিতই করা হবে। শিশুদের অধিকার লঙ্ঘন করার স্পর্ধা প্রাপ্তবয়স্ক কারোরই থাকা উচিত নয়।

ইস্কুলে শিশু-কিশোরদের ধর্মীয় মতবাদ শেখানোর জন্য মৌলবাদীরা চিৎকার করছে বেশ অনেকগুলো মাস বা বছর। কয়েক মাস আগে তাদের ৫ দফা দাবি এরকম ছিল। এক, অনতিবিলম্বে শিক্ষা সংস্কৃতির অনৈসলামিকরণ প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। দুই, পাঠ্যপুস্তকে ইসলামি ভাবধারা পুনঃস্থাপন করতে হবে। তিন, পাঠ্যপুস্তকে ইসলামি ভাবধারা মুছে ফেলার সাথে জড়িত মহল এবং প্রশ্নপত্রে ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে বিদ্বেষ ছড়ানোর সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চার, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণের ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে। পাঁচ, একই সাথে ধর্মহীন সেক্যুলার শিক্ষানীতি বাতিল করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেতনাসমৃদ্ধ শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে হবে এবং বর্তমান ধর্মহীন সেক্যুলার শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ বন্ধ করতে হবে।

মৌলবাদীদের দাবি মেনে ইসলামি ভাবধারা পুনঃস্থাপন করার উদ্যোগ নিচ্ছেন কি সরকার? যে ভাবধারা বিএনপি-জামায়াত আমলে ছিল, সেই ভাবধারা আওয়ামী লীগের আমলেও থাকবে এ নিয়ে আমার কোনও সংশয় নেই। দুই সরকারের মধ্যে অনেকে পার্থক্য দেখলেও আমি বিশেষ কিছু দেখি না। বাংলাদেশে যে সরকারই আসুক, থাকুক, তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, দেশকে কি মৌলবাদী দেশ নাকি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে তারা গড়ে তুলতে চান। মৌলবাদীদের আশকারা দেওয়ার কুফল আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। মৌলবাদ থেকে যে সন্ত্রাসী জন্ম নিচ্ছে, তারা দেশের প্রতিবাদী-প্রগতিবাদী কণ্ঠস্বরকে কী করে হত্যা করেছে আমরা দেখেছি, কী করে তারা বাধা হয়ে দাঁড়ায় মুক্তচিন্তার, কী করে সর্বনাশ করে সম্ভাবনার, দেখেছি।

তার চেয়ে সত্যিকার গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার কাজই চলুক না কেন। গণতন্ত্র শুধু ভোটের নির্বাচনে নয়, গণতন্ত্রকে থাকতে হবে সমাজে, সংসারে, সর্বত্র। গণতন্ত্র কায়েম হলেই নারী পুরুষের সমানাধিকার কায়েম হবে। গণতন্ত্রে সবাই সমান, গণতান্ত্রিক আইনে কেউ বৈষম্যের শিকার হয় না। সত্যিকার গণতন্ত্রে দরিদ্রের, নীচু জাতের, নারীর, সমকামীর, রূপান্তরকামীর অধিকার ধনী, উঁচু জাত, পুরুষের অধিকারের চেয়ে এক ফোঁটা কম নয়। সত্যিকার গণতন্ত্রে ঘুচিয়ে ফেলা হয় সব বৈষম্য। জাতের ভেদ থাকে না। গণতন্ত্রে সবাই আমরা হয়ে যাই এক জাত, মানুষ জাত।

নিজেকে মানুষ জাত ভাবলে ভিন্নধর্মী কাউকে, ভিন্ন লিঙ্গের কাউকে, ভিন্ন বর্ণের কাউকে, ভিন্ন দেশের-ভাষার-সংস্কৃতির কাউকে ভিন্ন কেউ বলে মনে হয় না। আমরা তো আসলেই আজ অবধি মানুষেরই জাত। ভালো-মন্দ, লোভী-নির্লোভ, দুশ্চরিত্র সত্চরিত্র, হিংস্র দয়ালু— সব মিলিয়েই মানুষ। আমরা কেউ কেউ চেষ্টা করে যাই যেন নিজেদের ধর্ষণ না করি, নিজেদের হত্যা না করি, নিজেদের না ভোগাই, নিজেদের নিজেরা না ঠকাই, যন্ত্রণা না দিই। আমরা যদি আমাদের সংশোধন না করি, সুস্থ না করি, কে করবে? আমাদের কে আছে আমরা ছাড়া?

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৫ জানুয়ারি, ২০১৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *