চতুর্থ পর্ব
সেই থার্ড ডিভিশন-এ ম্যাট্রিক পাস করা ছেলেটা অনেক কিছু করল। ক্যামেরা-র সামনে বিখ্যাত পরিচালক অভিনেতা- অভিনেত্রীর সঙ্গে অভিনয়। মঞ্চেও বিখ্যাত নির্দেশকের নির্দেশনায় অভিনয়। মঞ্চ-জগতের তারকাদের সঙ্গে আলাপ। আবার পাশাপাশি তিন দিক খোলা মঞ্চে যাত্রা কৌতুক নকশা— যা এখনও করছি। বহু বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে সেই সূত্রে। তারা আমার স্বপ্নের লোক ছিলেন। কিন্তু আমার প্রতিভা এবং ভাগ্য আর তাঁদের বদান্যতায় তাঁদের খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি।
ছবির জগতের তিন সেরা কমেডিয়ান ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, রবি ঘোষ আমার খুব কাছের হয়ে গেছিলেন। আমি আদতে ঢাকার ছেলে বলে ভানুদা মাঝে মাঝেই পিঠ চাপড়ে বলতেন, ”ঢাকার পোলারা কখনও হারে না, মাঝে মাঝে বাসায় আইস, ইলিশ মাছ খাওয়াইমু।” ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবিতে প্রথম আলাপের দিন থেকে আমার হৃদয় অধিকার করে নিয়েছিলেন ভানুদা। আর যখন তিনি খ্যাতির মধ্যগগনে তখন আমার খুব কাছের মানুষ। প্রায়ই আমাদের ছোট্ট বাড়িতে চলে আসতেন। আর বলতেন, আজ তর বউদির লগে ঝগড়া হইসে তর বাসায় খামু।” এমনই সরল মানুষ ছিলেন। বসুশ্রী সিনেমা হল ফিল্মস্টারদের আড্ডা ছিল। ভানুদা সেখানে তাস খেলতেন, বহু পরিচালকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতেন। আর বলতেন, ”এই পার্টটা আমার না দিয়া চিনুরে দাও।” ওর খুব আক্ষেপ ছিল, আমি সিরিয়াস রোল পাই না বলে।
খুব ভালো মানুষ ছিলেন অনুপকুমারও। আমায় প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। অনুপদা এমন একজন অভিনেতা ছিলেন, যিনি সব চরিত্রে ফিট করে যেতেন। খুব কম শট এনজি করতেন। সিনেমা, পেশাদারি মঞ্চ সবেতেই হিট। যে মানুষটি ‘চন্দ্রশেখর’-এ কানন দেবীর সঙ্গে অভিনয় করেছেন, তিনিই আবার ‘মন মানে না’-র মতো ছবিও করেছেন।
জহর রায় ছিলেন আমার স্বপ্নের কমেডিয়ান, কথার জাগলারি জহর রায়ের কাছে শেখার মতো ছিল। সত্যজিৎ রায়কে বলা সেই বিখ্যাত কথা সবাই জানেন— ”আপনাকে দাদা বলেই ডাকব। আমি এজে বড়ো হলেও, আপনি ইমেজে বড়ো।” কলেজ স্ট্রিটের যে মেসে থাকতেন, সেখানে নিজস্ব একটা লাইব্রেরি বানিয়েছিলেন। মারাত্মক পড়াশোনা ছিল, অসম্ভব পণ্ডিত মানুষ ছিলেন তো। নাটকের ছেলেদের কাছে জহরদার মেস আর লাইব্রেরি জনপ্রিয় ছিল। আইরিশ নাটক ‘আরসেনিক অ্যাজ দ্য ওল্ডলেস’-এর যে অনুবাদ করেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় তার হদিশ জহরদাই দিয়েছিলেন। বাংলা ছবিতে ভানুদা আর জহরদার জুটি লরেল হার্ডির জুটির মতোই। আমি আর রবিদা জুটি বেঁধে বেশ কিছু ছবি করলেও, ওদের মতো নাম করতে পারিনি। জহরদা রঙমহলে যতগুলো শো করেছেন, সব হাউসফুল। ব্যাপক মজার মানুষ ছিলেন। একবার রঙমহলে শো করতে ঢুকছেন। একটি ছেলে জিজ্ঞেস করল, ”কী জহরমামা? কেমন আছেন?” জহরদা একটু থেমে বললেন, ”আমি তোর মামা? বেশ, আমার দিদিকে জিজ্ঞেস কর, বলে দেবে।” এমনই প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন।
নবদ্বীপ হালদারের সঙ্গে কাজ করতে পারিনি বলে মনে চিরকাল দুঃখ থেকে যাবে। সমস্ত নকশার রেকর্ড সুপারহিট হত। পরবর্তীকালে তেমন জনপ্রিয়তা কেউ পায়নি। প্রসঙ্গত হরিধন মুখোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ছে। সত্যজিৎ রায়, তপন সিনহা, দীনেন গুপ্ত ছবিতে ঠিকঠাক ব্যবহার করেছিলেন ওঁকে। খুব সুন্দর গান গাইতেন হরিদা।
উৎপল দত্তের সঙ্গে প্রথম আলাপ তরুণ মজুমদারের ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ ছবি করার সময়। চরিত্রটা ছিল ড্রাইভারের। উৎপলদা কথায় কথায়, ”বাই ডু মানে মাই ডিয়ার” বলতেন। তা শ্যুটিংয়ের দিন আমি গাড়িতে বসে, আমায় হঠাৎ বললেন, বাই ডু, গাড়ি-টাড়ি চালাতে জানো তো?” আমি মাথা নেড়ে না বললাম। উনি হাত-পা ছুড়ে আঁতকে উঠলেন। সে কী শোরগোল। বললেন, ”সে কী? এই সিন হবে কী করে? ও তনুবাবু এ তো গাড়িই চালাতে জানে না।’ তরুণবাবু বললেন, ”গাড়ি চালাতে জানো না, তা আগে বলোনি কেন?” আমি বলাম, ”আপনি তো জিজ্ঞেস করেননি?” তনুবাবু হেসে সবাইকে আশ্বস্ত করলেন বিকল্প ব্যবস্থার কথা বলে। উৎপলবাবু নাছোড়। ওঁর ইনসিওরেন্স নেই, উনি পার্ট করবেন না। সে দেখার মতো ব্যাপার। উৎপলদা বাঘের মতো পায়চারি করছেন। শেষে বাজার থেকে মোটা মোটা দড়ি আনা হল। বোঝানো হল ওঁকে যে আশঙ্কার কিছু নেই, আমি শুধু স্টিয়ারিঙে হাত দিয়ে থাকব, গাড়ি টানা হবে দড়ি দিয়ে। তাও বারবার আমায় নানা কথা জিজ্ঞেস করেন। আমি অ্যাক্সিলেটারে হাত দিয়ে বলি এটা ব্রেক। শেষে সিন শুরু হল। উনি আমার পাশে বসে ডানদিকে কাটাও, ওদিকে ঘোরাও করতে করতে হঠাৎ আমি গাড়ি নিয়ে দড়াম করে সোজা গাছে ধাক্কা। সিন ওকে হল। কিন্তু উৎপল চিৎপাত হয়ে পড়ে চিৎকার করছেন। ”ডিরেক্টরকে ডাকো।” সে কী চিৎকার— একটু হলেই আমায় খুন করে ফেলত। ডাকো ওকে। আমি কি আর ওখানে থাকি? সিন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে আমি পগার পার। ঠিক করেছিলাম জীবনে আর উৎপল দত্তের ড্রাইভারের রোল করব না। এমনই কপাল কয়েক বছর পর ‘সম্রাট ও সুন্দরী’ ছবিতে ফের ওর ড্রাইভারের চরিত্রে রোল পেলাম। সিনের মাঝখানেই আমি পালিয়ে গেছিলাম। ফের মুখোমুখি হয়েছিলাম, ‘ছুটির-ফাঁদে’ ছবির আউটডোরে— ঘাটশিলায়। এখানে আর ড্রাইভার নয়। মহিলা বিশেষ করে অপর্ণা সেনের সঙ্গে বেশি মিশলে রেগে যেতেন মারাত্মক। বলতেন, ”সানরাইজ দেখতে যাওয়ার আর লোক পেলে না? আমাকেই তো ডাকতে পারতে।” তবে উৎপলদার মতো অত ডিসিপ্লিনড মানুষ আমি আমার জীবনে খুব কম দেখেছি। ওই লেভেলে অধ্যবসায় ও নিয়মানুবর্তিতা না থাকলে ওই মাপের শিল্পী হওয়াও যায় না।
অভিনেতা বলতে সবচেয়ে বেশি মেলামেশা করেছি রবি ঘোষের সঙ্গে। আমাকে দাদার মতো আগলে রাখতেন, রবিদার সময়জ্ঞান-আর চোখের expression শেখার মতো। আমার মনে হয়, উৎপলদার সঙ্গে দীর্ঘদিন অভিনয়ের ফলে রবিদা এত নিখুঁতভাবে এইসব আয়ত্ত করেছিলেন। একটা বিপদের কথা শুনে শান্তভাবে expression দিয়ে রবিদার ওই যে চমকে ওঠা— উফফ! অসাধারণ। এটা উৎপলদাও অসাধারণ করতেন। রবীন্দ্রসাহিত্য-সংগীতে রবিদার যে কী দারুণ চর্চা ছিল, তা অনেকেই জানে না। ‘গল্প হলেও সত্যি’-তে তপনদা ওঁকে দিয়ে গান গাইয়েছিলেন। আর গুপী বাঘা সিরিজে অনুপ ঘোষালের সঙ্গে রবিদার ঠেকা— তাও অনবদ্য।
‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর শুটিং শেষে আমরা অনুপ্রাণিত। উচ্ছ্বসিত। ঠিক হল বাচ্চাদের জন্য একটা ছবি তৈরি করা হবে। উমানাথ ভট্টাচার্য লিখবেন চিত্রনাট্য। আমার উপর ভরসা করতেন রবিদা। উমাদাকে বলতেন চিত্রনাট্য লেখার সময় চিনুকে একটু সঙ্গে নিও। আসলে রবিদার সঙ্গে আড্ডা প্রসঙ্গে একবার আমি আমার স্কুল জীবনের কথা বলেছিলাম— সেখানে বন্ধুবান্ধব-পণ্ডিতমশাই— একসঙ্গে পড়াশোনা— আড্ডা সবই উঠে এসেছিল। রবিদা খেয়াল করেছিলেন, আমার বিশ্লেষণ করার বিশেষ অসাধারণ ক্ষমতা। যা চিত্রনাট্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। লেখা হল ‘সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা’। লেখার ব্যাপারে রবিদা খুব অলস ছিলেন। বলেই খালাস। অভিজাত দম্পতি। সন্তানকে দেখাশোনা করার কেউ নেই। পরিচারিকার কাছে মানুষ— এটুকু বলেই রবিদার বক্তব্য, দম্পতির ক্ষেত্রে স্বামীর ভূমিকায় বুঝলি চিনু উৎপলদাকে মানাবে। আর হ্যাঁ বাচ্চাটাকে অপহরণের ক্ষেত্রে কোনও ডাকাতদল না, না তার থেকে বরং দুটো চোরই থাকুক। মজার মানুষ। চিনু সাধু আর আমি যুধিষ্ঠির। যেখানেই চুরি করতে চায় সেখানেই চুরি করার আগে কিছু খেয়ে নেয়। অর্থাৎ চুরির থেকে পেট পুজোয় উৎসাহ বেশি। রবিদা কোনও মতে গল্পের খেইটা ধরিয়ে দিয়ে আর নেই ধরেপাশে। নাও এবার ঠ্যালা সামলাও। উমাদা তো সব শুনেটুনে বললেন— ”রবি দারুণ জমে যাবে।” বলেই একটা বিড়ি ধরালেন। প্রথমদিকে গল্পে ডাকাদের কথা না থাকলেও পরে নিয়ে আসা হল ডাকাতদের। ঠিক হল, ডাকাতদের কাছ থেকে চোরেরা বাচ্চাটিকে চুরি করে নিয়ে যাবে তার আগে পরিচারিকাকে ঘুমের ওষুধ খাওয়াবে। যুধিষ্ঠিরের পূর্ব পরিচিতা এক আত্মীয়ের ভূমিকায় ঠিক হল জয়া অভিনয় করবে। জয়া আমাদের বোন। বাচ্চাটিকে চুরি করে জয়ার কাছে রাখা হবে। পরে অবশ্য দম্পতি বুঝতে পারলেন দু’জনের মধ্যেই দূরত্বই আজ বাচ্চা চুরির জন্য দায়ী। যাহোক সাধু-যুধিষ্ঠির বাচ্চাটিকে তার বাবা-মার হাতে তুলে দেয়। যেমন গল্প, তেমনই চিত্রনাট্য। ছবি তো দারুণ হিট হবেই। জয়াকে রবিদাই মুম্বইতে ফোন করে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। তখন ‘গুড্ডি’ মুক্তি পাওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছে। জয়া অভিনয় করতে রাজি হল। রবিদা বলল— ”টাকা দিতে পারব না রে। নিজেরা মিলে ছবিটা করছি।” জয়া বলল— ”দিতে হবে না। তবে আমি কারও বাড়িতে থাকব না। কোনও হোটেলে থাকব। ওই খরচাটা দিলেই হবে।” ‘গুড্ডি’ মুক্তি পাবে তাড়াতাড়ি। মুম্বই তো ভয়ানক পেশাদার জায়গা। কারওর বাড়িতে থেকে জয়া কেরিয়ারের শুরুতেই নিজের ইমেজ নষ্ট করতে চায়নি। ব্যাপারটা বুঝেছিলাম।
রবিদার বাড়ির আড্ডায় আসত শুভেন্দু, শমিত ভঞ্জ, তপেন চট্টোপাধ্যায়। মূলত রবিদার বাড়ির আড্ডা থেকেই জন্ম নিয়েছিল এই ছবি। ছবির প্রথম শো দেখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। দেখে খুব খুশি। কাছে ডাকলেন দু’জনকে। বললেন, ”তোমরা দু’জনেই ভালো অভিনয় করেছ। তবে সকলকে ছাপিয়ে গিয়েছে জয়া।” জয়াকে বলাতে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করল মানিকদাকে। এরই মধ্যে একদিন অমিতাভ বচ্চন এল কলকাতায়। জয়ার অন্য কোনও ছবির শুটিং উপলক্ষে। এলেন তেজী বচ্চনও। জয়ার বাংলা ছবি দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলে রবিদা ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে বিশেষ শো-এর ব্যবস্থা করল। আমাকে বলল ”তোকে কিন্তু ইন্টারপ্রিটরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। বাংলা ভালো বুঝতে না পারলে বুঝিয়ে বলতে হবে।” ছবি শুরু হল। আমার ইংরাজিটা খুব ভালো নয়। রবিদাকে সেকথা বলতেই বলল— ”ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।” বাঁদিকে অমিতাভ, ডানদিকে তেজী বচ্চন, মাঝখানে আমি। বুক কাঁপছে। হাঁটু ঠকঠক করছে। ইংরাজি বলতে হবে। টাইটেল কার্ড দেখানোর পর প্রথম সিন শুরু। আমি কায়দা করে ইংরাজিতে বোঝাতে যাব— অমিতাভ বলল— ”চিনুদা আই ক্যান ফলো বেঙ্গলি বাট আই ক্যান’ট স্পিক ফ্লুয়েন্টলি।” তেজী বচ্চনও বললেন— ”তোমাকে বোঝাতে হবে না। আমি বুঝতে পারছি বাংলা।” ব্যস। আমার যাবতীয় টেনশন উধাও। ছবিট দেখার পর অমিতাভ বলল— ”এটা আমি হিন্দিতে করতে চাই।” আমি বললাম— ”কোনও অসুবিধা হবে না। রবিদাকে বলব তোমাকে স্ক্রিপ্ট দিয়ে দেবে। জয়াকে বলে দেব। ব্যবস্থা হয়ে যাবে।” তবে কোনও কারণে ছবিটা হিন্দিতে হয়নি। ‘সাধু যুধিষ্ঠির কড়চা’-র কোনও ফিল্ম প্রিন্ট নেই। হারিয়ে গিয়েছে অথবা চুরি হয়ে গিয়েছে। একবার দূরদর্শনে দেখানো হয়েছিল। তারপর থেকে ছবিটা উধাও। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে বলেছিলেন, বাংলাদেশে পাওয়া যায়। কিন্তু আমি বাংলাদেশে গিয়ে খোঁজ করেছিলাম। কোথাও পাইনি। ছবিটা সেই আমলের সুপারহিট। এমন একটা ক্রেজ তৈরি হয়েছিল যে কোথাও চিন্ময়-রবিকে একসঙ্গে দেখলেই জনগণ বলত— ”কী চুরি করতে বেরিয়েছেন?” আমরা খুব উপভোগ করতাম।
রবিদার মূল্যায়ন করার ক্ষমতা আমার নেই। সেই স্পর্ধাও দেখাব না। তবু যদি বলতে হয়— উত্তমকুমারকে মাথায় রেখেও বলব রবিদা আমার হিরো। কমেডি অভিনয় থেকে সিরিয়াস চরিত্র, নাটক— থিয়েটার— সিনেমা ওর চারপাশে আমি কাউকে জায়গা দিতে চাই না। অনেক কিছু শিখেছি ওঁর কাছ থেকে। ভালো ব্যবহার। শব্দের সঠিক উচ্চারণ। বিভিন্ন জেলার উচ্চারণগত একটা বিষয় রয়েছে। রবিতা বলত— ”এ সব তো জানবি অবশ্যই। তবে সবার আগে জানতে হবে বুঝতে হবে চরিত্রটাকে। যে চরিত্রে তুই অভিনয় করবি। তার ভিতরে তোকে ঢুকতে হবে। চরিত্রের মধ্যে ঢুকতে না পারলে কিছু হবে না রে। শহর ও গ্রামের মানুষদের আচার আচরণও লক্ষ করবি। কিন্তু চরিত্রের মধ্যে ঢুকতে না পারলে কিছুই হবে না।” আসলে অভিনয়ের ব্যাকরণ বা প্রথাগত শিক্ষার দিকে রবিদার ঝোঁক ছিল না। আস্থাও কম ছিল। পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল মারাত্মক। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের ক্ষেত্রে থিয়েটারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাত রবিদা। প্রচুর সিনেমা দেখত। বই পড়ত। নিজেকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করে গিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ভানুদার কথা বলা যেতে পারে। আসলে রবিদা, ভানুদা, অনুপকুমার— অভিনয় তো সমৃদ্ধ হয়েছেই, অনুপ্রাণিত হয়েছি সকলের সংস্পর্শেই। আত্মজীবনীতে তাই বারে বারে চলে আসছে ওঁদের কথা। ওঁদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।
আমার প্রিয় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় বা ভানুদার কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় যে তিনি ছিলেন জনপ্রিয়। সেই জনপ্রিয়তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ভানুদার অভিনয়ের প্রধান গুণ সহজতা, সারল্য। জনগণেশের স্নায়ুস্পন্দন টের পেতেন ভানুদা। ওঁর অভিনয়ে সংলাপে বাঙাল ভাষার মান লক্ষ্যণীয়। ভানুদা বুঝতেন ওভাবে কথা বললেন দর্শক ভালোভাবে নেবেন। তাঁর জনপ্রিয়তার অন্যতম চাবিকাঠি ছিল ওই বাঙাল ভাষা। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ থেকে শুরু করে ‘গল্প হলেও সত্যি’ বা ‘হাটে বাজারে’— সংলাপে বাঙাল ভাষা থাকবেই। ভানুদার কথায়, ”প্রথমদিকে বাঙাল চরিত্র পেয়েছি। চুটিয়ে কথা বলেছি বাঙাল ভাষায়। কিন্তু যখন ঘটি চরিত্র পেতে শুরু করলাম তখন অসুবিধে হল। তবে তাতে আমল না দিয়ে বাড়িতে বেশি সময় দিলাম ডায়লগ বলায়। পড়তে পড়তে সবটাই আয়ত্বের মধ্যে চলে এল। তবে বাঙাল ভাষায় বলার ঝোঁকটা কাটতে প্রায় ছ’মাস সময় লেগেছিল।” ভানুদার জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা নিয়েছিল দেশভাগ। দেশভাগের পর যখন পূর্ববঙ্গীয়রা এদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লেন সেইসময় ভানুদা অভিনীত বিভিন্ন চরিত্রের মুখে বাঙাল ভাষার সংলাপ দর্শকমনে ভালোবাসার জন্ম দিয়েছিল। কারণ সদ্য নিজের দেশ-মাটি ছেড়ে আসা মানুষগুলো ভানুদার সংলাপের ভিতর নিজেদের ভাষার প্রতি তীব্র ভালোবাসার গন্ধ পেয়েছিল। সেই সময় প্রতিটা ছবিতে ভানুদার বাঙাল সংলাপ, আচার আচরণ, অভিব্যক্তি দর্শক মনে হিল্লোল জাগিয়ে তুলেছিল। ছবি সুপারহিট। একটাও মুখ থুবড়ে পড়েনি। তখন একটাই কথা লোকের মুখে শোনা গিয়েছে— ”ঢাকার বাঙাল অভিনয় করতেস, চল দেইখ্যা আসি।” ভানুদা অভিনীত চরিত্রের সঙ্গে দর্শকরা একাত্মতা অনুভব করেছিলেন। তাই জনপ্রিয় হতে খুব বেশিসময় লাগেনি ভানুদার। নিখুঁতভাবে বাঙাল ভাষায় সংলাপ বলার দক্ষতার সঙ্গে মিশেছিল ‘বডি ল্যাঙ্গোয়েজ’। রোগা পাতলা চেহারা। তড়িঘড়ি করে চলে যাওয়া, মাঝেমধ্যে তড়বড় করে কথা বলা। সবই ছিল যাকে বলে জনমনচিত্তহরণকারী। সেই সময় অন্য কোনও কমেডিয়ানের মধ্যে অমন সংলাপ বলার ক্ষমতা, ‘বডি ল্যাঙ্গোয়েজ’ ছিল না। জহর রায়ের মধ্যে কিছুটা দেখা গিয়েছিল। ভানুদার আরও একটা বড়ো গুণ হল চরিত্র নিয়ে সবসময় গভীরভাবে ভাবনা চিন্তা করতেন। কাটাছেঁড়া করতেন। তবে বিষয়টি কাউকে জানতে দিতেন না। যা করতেন সবই লুকিয়ে। বাড়িতে নিভৃতে চলত চরিত্র নিয়ে ভাবনাচিন্তা। চলত ক্রমাগত সংলাপ বলা। উচ্চারণকে স্পষ্ট করা, বিশ্লেষণ। প্রতিটি দৃশ্যে ভানুদার নীরব পাঠশালায় তিনিই ছিলেন শিক্ষক আবার তিনিই ছিলেন শিক্ষার্থী। প্রখর স্মৃতিশক্তি ছিল ভানুদার। যা পড়তেন, দেখতেন মনে রাখতেন। এক-দু’বার পড়েই সংলাপ ঠোঁটস্থ হয়ে যেত। ক্যামেরার সামনে সহজ চলাফেরা, সাধারণ অভিব্যক্তি, ন্যাচারাল অভিনয়— ভানুদাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। ভানুদার অভিনীত কোনও চরিত্রের মধ্যে জড়তা ছিল না। ওঁর অভিনয়ের কখনও খুঁত বের করতে পারেননি দর্শক। এছাড়া স্টুডিও পাড়ার যে কোনও মঙ্গলজনক কাজে ভানুদার উপস্থিতি ছিল সর্বাগ্রে। পাশাপাশি জুনিয়র আর্টিস্টের মধ্যে যাদের সম্ভাবনা ছিল, ভালো অভিনয় করত তাদের বড়ো পরিচালকদের কাছে পাঠাতেন। ভানুদার বাড়িতে খাওয়াদাওয়ার এলাহি একটা ব্যাপার ছিল। থাকতেন টালিগঞ্জ ব্রিজের কাছে। পছন্দ করতেন পদ্মার ইলিশ। ভোজনরসিক, উদার, দরদি মানুষ ছিলেন ভানুদা। ভানুদার মধ্যে আগলে রাখার একটা ব্যাপার ছিল। বিশেষত জুনিয়র আর্টিস্টদের ক্ষেত্রে এই আগলানোর ব্যাপারটা কাজ করতে বিরাট ভাবে। ‘ছেলে কার’ ছবিটি যখন পরে হিন্দিতে করা হয় তখন ভানুদা সেই ছবিতে অভিনয় করেন। অশোককুমার, মীনাকুমারী ও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে হিন্দিটা তেমন জুতসই ছিল না। হিন্দি ভালো বলতে পারতেন না। আরও একটি হিন্দি ছবি করেন। সম্ভবত ‘শহর থেকে দূরে।’ ভানুদা সেই ছবিতেও অভিনয় করেন। খুব সাফল্য পাননি।
এবারে আসব অনুপকুমারের কথায়। তরুণ মজুমদারের ছবির হিরো অনুপকুমারের ছিল থিয়েটারের অভিজ্ঞতা। ছোটোবেলা থেকে থিয়েটারের উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে নিবিষ্টমনে বাবার অভিনয় দেখতেন অনুপকুমার। আর বাবার সঙ্গে যাঁরা অভিনয় করতেন তাঁরা সমস্ত দিকপাল। অহীন্দ্র চৌধুরি, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। ধীরেন্দ্রনাথ দাসের ছেলে হওয়ার সুবাদে অনুপকুমারের বাড়িতেই ছিল নাট্যচর্চার পরিবেশ। তবে বাবা খুব মদ্যপান করতেন। এই যন্ত্রণাটা ওঁর মধ্যে ছিল। জীবনে কোনওদিন মদ স্পর্শ করেননি অনুপকুমার। অন্যদিকে বাবা বড়ো অভিনেতা— তাই নিয়ে একটা প্রচ্ছন্ন গর্ববোধও ছিল। অনুপকুমারের আরও বড়োগুণ বয়স বোঝা যেত না। ১৬ বছরের অনুপকুমারও যা, ২৪ বছরের অনুপকুমারও তাই। বয়সের সতেজতা, তারুণ্য, স্টেজের অভিজ্ঞতা, ক্যামেরার বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলকে নিপুণভাবে ব্যবহার করে সফল অভিনেতা হয়ে উঠেছিলেন অনুপকুমার। ওঁর ‘চন্দ্রশেখর’, ‘বাঁশের কেল্লা’ সিনেমাতে দেখেছি কী অসাধারণ রূপলাবণ্য অনুপকুমারের। ‘পলাতক’ ছবিটা আমি দেখেছি। অনুপকুমারের রূপ-গুণের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছিল ওই ছবিতে। ওঁর মধ্যে একটা ব্যাপার ছিল। কোনও কমেডিয়ানের সঙ্গে শেয়ার করলে তাঁকে ছাপিয়ে যাওয়ার একটা ব্যাপার থাকত। তবে আমার চোখে অনুপকুমার কমেডিয়ান নন, হিরো বা চরিত্রাভিনেতা। অনেকে বলেন বটে কমেডিয়ান— কিন্তু উনি কমেডিয়ান নন।
এই প্রসঙ্গে একটি বিখ্যাত ছবির কথা বলব— দীনেন গুপ্তের পরিচালনায় ‘বসন্ত বিলাপ’। আমি, রবিদা, সৌমিত্রদা, অনুপকুমার। অন্যদিকে অপর্ণা, সুমিত্রা, কাজল গুপ্ত, শিবানী। সেখানেও অনুপকুমারকে দেখেছি অন্য অভিনেতার মুখ চেপে ধরে বলতে— ‘আমি বলব আমি বলব।’ গোটা সিনটাকে একা নিয়ে নেওয়ার প্রবণতা অনুপকুমারের মধ্যে ছিল বিরাট ভাবে। কাউকে জমি ছাড়তেন না। তবে আমার মনে হয় এটা অনুপকুমার সচেতনভাবে নয়, অচেতনভাবেই করতেন। ‘বসন্তবিলাপ’-এ এমন দু’-তিন বার হতেই রবিদা বলেছিলেন— ”এটা অনুপ ঠিক করছে না।” আমি অনুপদার কাছে গেলাম। বললাম— ”অনুপদা ডায়লগটা বলতে দেবে তো। মুখ চেপে ধরলে কী করে হবে!” অনুপদা সঙ্গে সঙ্গে— ”তাই না, মুখ চেপে ধরেছি। আচ্ছা আর একটা টেক করো।” আর একটা ব্যাপার ছিল অনুপদার। উনি ভালো লিপ দিতে পারতেন না। গানের শুরুটা ভালোই করতেন কিন্তু তারপর খেই হারিয়ে ফেলতেন। ভানুদা আবার ভালো লিপ দিতেন। অনুপদার স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। জীবনে প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। নিজের সংসারের কথা না ভেবে অন্যের জন্য ভাবতেন বেশি। একটা সময় মৃণালদার সংসার চালানোর জন্য অনুপদা যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন। ভালো মানুষ ছিলেন। বড়োমনের মানুষ ছিলেন। বামঘেঁষা রাজনীতিতে বিশ্বাসী মানুষটি শেষদিকে সৌমিত্রদার সঙ্গে একযোগে ‘অভিনেতৃ সঙ্ঘ’র দায়িত্ব ভার সামলেছেন দক্ষতার সঙ্গে।
আবার ফিরব ‘বসন্ত বিলাপ’-এ। মজার ছবি। জমজমাট ছবি। অনেক মধুর স্মৃতি রয়েছে ছবিটিকে ঘিরে। দীনেন গুপ্তর-র প্রায় প্রতিটা ছবিতেই অনুপকুমার থাকতেন। ‘বসন্ত বিলাপ’-এও ছিলেন। কেবল ‘মর্জিনা-আবদাল্লা’ ছবিতে রবিদাকে নিয়েছিলেন দীনেন গুপ্ত। ‘হাটেবাজারে’ ছবির ক্যামেরাম্যান ছিলেন দীনেনদা। ওই ছবিতে আমি অভিনয় করেছিলাম। তখন দীনেনদা বলেছিলেন যে পরে যখন উনি ছবি করবেন তখন আমাকে নেবেন। সেইমতো ‘বসন্তবিলাপ’ ছবিতে আমি ডাক পেলাম। দীনেনদার হাত ধরেই আমি প্রথম তপন সিনহার পরিচালিত ছবির বাইরে পা রাখি। ‘নতুন পাতা’ ছবিতে শম্ভু মিত্রের সঙ্গে অভিনয় করি। ওখানে আমার শম্ভুদাকে খুব উন্নাসিক বলে মনে হয়েছিল। একটা মেকআপ রুম সবাই মিলে ব্যবহার করতাম। সেটা শম্ভুদার পছন্দ ছিল না। উনি বিরক্ত হতেন। তবে পরে আমার সঙ্গে শম্ভুদার ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
দীনেনদা আমাকে বললেন— ‘তোকে প্রতিদিন তিনশো টাকা করে দিলে অভিনয় করবি?” আমার তখন বাজারদর দিনে ১০০০/- টাকা, কিন্তু দীনেনদার ছবি। রবিদা, অনুপকুমার, সৌমিত্রদা রয়েছেন। রাজি হয়ে গেলাম। কেন? কারণ আমার মনে হয়েছিল, অথবা বলা ভালো দূরদৃষ্টিতে— বুঝতে পেরেছিলাম যে এই ছবিটা হিট হবে। সংলাপ মারকাটারি। ‘বসন্তবিলাপ’-এর মধ্য দিয়ে আমি বেঁচে থাকলেও থাকতে পারি দর্শকদের কাছে। তবে পরে দীনেনদা টাকা বাড়িয়ে ৫০০/- টাকা করেছিলেন। আউটডোর শুটিং হয়েছিল মেদিনীপুরে। চিত্রনাট্যে সৌমিত্র-অপর্ণা, রবি-কাজল, অনুপ-সুমিত্রাকে যেভাবে জায়গা দেওয়া হয়েছে, সেভাবে কি আমাকে এবং শিবানীকে জায়গা দেওয়া হয়েছে? আমি তো মার খেয়ে যাচ্ছি। একথা একদিন আউটডোরে দীনেনদাকে বলতেই বলল— ”কী বলতে চাইছিস বল তো?’ আমি বললাম— ”সিধু হল আমার অভিনীত চরিত্র অন্যদিকে আলো হল আমার নায়িকা। সিধু-আলোর কোনও প্রেম-দৃশ্য নেই ছবিতে।” দীনেনদা সব শুনলেন। বললেন— ”বেশ। কাল সকালে একটা ফাঁক রয়েছে। শটটা নেব। তুই একটা লাভ-সিন লিখে ফেল।” বলেই ক্লু দিলেন। ”গীতা দে তোর কাকিমা। তোকে সিনেমার টিকিট কাটতে পাঠিয়েছেন। এই সময় তোর সঙ্গে দেখা হবে বান্ধবী আলোর। এরপর থেকে তুই লিখবি।” দেরি না করে সেদিন রাতে বসেই লিখে ফেললাম বিখ্যাত সেই পুকুরপাড়ের দৃশ্য। বিখ্যাত সেই সংলাপ ”একবার বলো উত্তমকুমার”। কিন্তু শট দেওয়ার সময় শিবানীর কী অবস্থা। আমার দিকে তাকিয়েই হেসে ফেলে। আর বলে— ”রোগাপাতলা চেহারা, উত্তমকুমার না আরও কিছু।” শিবনা#কে তখন বোঝালাম— ”শিবানী যদি এই সিনটা ভালো করে না করতে পারি তাহলে তুই-ও থাকবি না, আমিও থাকব না। বেমালুম হাওয়া হয়ে যাব।” ও বুঝল। তারপর বলল— ”উত্তমকুমার।” এই সিকোয়েন্সটা না থাকলে আমি হারিয়ে যেতাম ‘বসন্ত বিলাপ’ থেকে। তবে ভাবিনি সংলাপটা সুপারহিট হবে। দর্শকগ্রাহ্য হলেই খুশি হতাম। তবে সমস্ত সংলাপকে হারিয়ে প্রথম সারিতে জায়গা করে নেবে তা ভাবতেও পারিনি। এখনও পর্যন্ত বাংলা ছবির সেরা সংলাপের মধ্যে ‘মাসিমা মালপো খামু’-র পরেই রয়েছে ‘একবার বলো উত্তমকুমার।’
এবারে আসব সৌমিত্রদার প্রসঙ্গে। অসাধারণ অভিনেতা। নাটক-সিনেমা— সর্বত্র সৌমিত্রদার অভিনয় ভাস্বর। ভালো আবৃত্তি করেন। সুপুরুষ। অভিনেতৃ সঙ্ঘের সভাপতি ছিলেন। একটা সংগঠন পরিচালনা করেছেন। কমার্শিয়াল ছবি বলো বা আর্ট ফিল্ম সৌমিত্র দু’ক্ষেত্রেই সফল। নাটকের ক্ষেত্রে ওঁর প্রথম প্রযোজনা ‘নামজীবন’। কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে— বিপরীতে ছিলেন লিলি চক্রবর্তী। বিদেশি নাটকের ছায়া অবলম্বনে এই নাটকটি দর্শক প্রশংসাধন্য হয়। সৌমিত্রদার অগাধ পাণ্ডিত্য, এত পড়াশোনা একজন মানুষের যে ভাবা যায় না! ভালো কবিতা লেখেন। সৌমিত্রদার মধ্যে একটা ‘লাইফ’ রয়েছে। প্রচণ্ড জীবনীশক্তি। আমাদের সময় তো দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। এখনও সেই দাপট অব্যাহত। উত্তমদাকে আমার কখনও সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি বলে মনে হয়নি। সৌমিত্রদা বরং সেই তুলনায় অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। সৌমিত্রদাকে ছোঁয়া যায়। সৌমিত্রদা এই সময়ের ছবিতেও সুন্দর অভিনয় করছেন। আমি দেখি ওঁর ছবি। বাদ দিই না নাটকও।
আমি বর্তমান সময়ের কোনও ছবিতে অভিনয় করতে চাই না। বলা ভালো ইচ্ছুক নই। কারণ বড়ো একঘেয়েমি। তাছাড়া সবাই যদি অভিনয় করে তাহলে পরিচালনার কাজ করবে কে? আমি পরিচালনায় বেশি উৎসাহী। চিত্রনাট্যে হাত পাকানো অনেক আগে থাকতেই শুরু হয়েছে। ‘তিলোত্তমা কলকাতা’ বলে আমি একটা চিত্রনাট্য লিখেছিলাম। বিভাসকে পাঠিয়েছিলাম। অশোকও পড়েছিল। দু’জনেই পড়ে বলেছিল— ”তুই লিখিস?” আমি রোগা বলে যেন লিখতে পারি না! বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মিশেছি। আর এই মেশার সূত্রেই এখান থেকে ওখান থেকে সংগ্রহ করেছি মণিমুক্তো। চিত্রনাট্য লেখার ক্ষেত্রে সেসবই কাজে লেগেছে। ‘প্রেমের ফাঁদে’ বলে আমি একটা ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলাম। পরিচালনাও আমার ছিল। কিন্তু ছবিটা ভালো চলেনি। ‘ডিং ডং’ আমার দ্বিতীয় পরিচালিত ছবি। মুক্তি পায়নি। পাবেও না। তবে অশোক ধানুকা এর ডিভিডি স্বত্ব কিনেছেন। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এর ডিভিডি বেরোলেও বেরোতে পারে। আর একটি ছবিও শুরু করেছিলাম। ‘একবার বলো উত্তমকুমার’। এই ছবির কাজও শুরু হয়ে মাঝপথেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আমি এখন সিরিয়াল বা টেলিফিল্ম করার কথা ভাবছি। ‘সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা’-র দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে সিরিয়াল বা টেলিফিল্ম বা ছবি। নাম হবে ‘সাধু ও যুধিষ্ঠির’। চিত্রনাট্য লেখার কাজ চলছে। প্রযোজকও পেয়ে যাব। কাস্টিং এখনও ঠিক হয়নি।
এখনকার টলিউডের সিনেমা নিয়ে বলতে গেলে বলব— সহজতা ও সারল্য খুব দরকার। যে সমস্ত ছবি মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষের কথা বলে সেই সমস্ত ছবি আমার প্রিয়। যেমন সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’। কিন্তু যে সমস্ত ছবি সবসময় সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির কথা বলে সেইসব ছবি আমার মনন-হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারে না। আমি জীবনে একটিই মাত্র পৌরাণিক ছবিতে অভিনয় করেছি। ‘দস্যু রত্নাকর’। ইতিহাসে ছিল কিনা জানি না। তবে ছবিতে প্রয়োজনে রত্নাকারের দু’জন সাকরেদকে নিয়ে আসা হয়েছিল। আমি ছিলাম একজন সাকরেদ। রবিদা ছিল অন্যজন। উড়িষ্যার একটি জঙ্গলে শুটিং হয়েছিল। ভালো হয়েছিল ছবিটা। আর একটা রবিদার সঙ্গে অমোঘস্মৃতি। ‘বসন্তবিলাপ’-এ একট গান ছিল ‘লেগেছে লেগেছে আগুন’— এখানে মান্না দে-র সঙ্গে ছিলাম রবিদা ও আমি। আমাদের সংলাপ ছিল। সংলাপের সময়’ আসছে। আমরা বলছি। মান্নাদা থামছেন। উফ সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা!
দু’টো ছবি ও একটি নাটকের কথা বলে আত্মজীবনী পর্বে ইতি টানব। ‘চারমূর্তি’, ‘ননীগোপালের বিয়ে’ এবং নাটক ‘অভিশপ্ত চম্বল’। চারমূর্তিতে আমি টেনিদা। ধ্রুপদী চরিত্র। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি। আর ‘ননীগোপালের বিয়ে’ ছবিতে আমার দ্বৈতচরিত্র। ‘ননী’ ও ‘খৈনি’। যদি টেনিদা না করতাম তাহলে ‘ননী’ ‘খৈনি’ হিসাবেই সকলে আমাকে চিনতেন। এই ছবি মুক্তির পর টের পেয়েছি খ্যাতির বিড়ম্বনা কাকে বলে! একটা কথা এখানে বলি— উত্তরবঙ্গে বিশেষত শিলিগুড়িতে উত্তমকুমারের ছবি রজতজয়ন্তী করত। পাশাপাশি যে কোনও বাংলা ছবি গেলে তা ফ্লপ করত। ব্যতিক্রম ছিল ‘ননীগোপালের বিয়ে’। যে সময় ‘ননীগোপালের বিয়ে’ শিলিগুড়িতে মুক্তি পেল, সেই সময় মুক্তি পেয়েছিল উত্তমদার একটি ছবি। নামটা মনে পড়ছে না। বিষ্ময়ের ব্যাপার এই যে, উত্তমদার ছবির থেকে আমার ছবি অনেক ভালো ব্যবসা দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, সেই প্রথমবার উত্তমকুমার কোনও ছবি রজতজয়ন্তীর মাইলফলককে স্পর্শ করল না। রজতজয়ন্তী পার করেছিল ‘ননীগোপালের বিয়ে’। এটা আমার কাছে দুরন্ত সাফল্য। তবে এই ঘটনায় উত্তমদা রাগ করেননি। উলটে বলেছিলেন— ”তোর ছবি তো আমার ছবির থেকে ভালো চলছে। ফাটিয়ে দিয়েছিস তো।” সেই সময় দেশে-বিদেশে বিশেষত আমেরিকায় প্রবাসী ভারতীয় তথা বাঙালিদের মধ্যে জনপ্রিয়তার নিরিখে আসবে—
১. গুপী গাইন বাঘা বাইন
২. ফেলুদার দুটো ছবি (সত্যজিৎ রায় নির্দেশিত)
৩. চারমূর্তি
৪. বসন্তবিলাপ
একটি নাটকের কথা না বললেই নয়। তরুণ ভাদুড়ির লেখা ‘অভিশপ্ত চম্বল’। জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশিত এই নাটকের কুশীলবরা হলেন— লিলি চক্রবর্তী, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, চিন্ময় রায়। এই নাটকে দেখেছিলাম জ্ঞানেশদার নির্দেশনা। দেখেছিলাম আর শিখেছিলাম।
এই সময়ের নাটক ভালো। তবে সিনেমায় অযথা চিৎকার, অ্যাকশন। ভালো লাগে না। দেখি না। দু’একটা ছবি বেশ ভালো। নতুন পরিচালকরা উঠে আসছেন। বুম্বা এখনও দাপিয়ে অভিনয় করছে। কতরকমের চরিত্র যে ও করল— প্রচণ্ড পরিশ্রমী, অধ্যবসায়ী ও উদার মানুষ আমাদের বুম্বা। কম কষ্ট করেনি জীবনে সফল হওয়ার জন্য। আমি, শমিত ভঞ্জ মিলে একটা নাটকের দল তৈরি করেছিলাম। নানা জায়গায় কল শো-এর জন্য যেতাম। বুম্বাও যেত। স্বল্প পারিশ্রমিকেও ও অভিনয় করত। বুদ্ধিমান ছেলে। আমার সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক। আরো বড়ো হোক জীবনে সেটাই চাইব। ভগবান ওর মঙ্গল করুন।
আমার পেশাদারি থিয়েটারে আসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো অবদান রবিদার। তখন সমরেশ বসুর লেখা ‘বিবর’ নাটকে জোর করে আমায় নামান রবিদাই। আমি আর জুঁই বিয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। রবিদা বলল, ”খরচ বাড়বে। একটা মান্থলি দরকার। নাটকটা কর।” ‘বিবর’ নাটক করার সময় পরিচালক রবি ঘোষকে পেলাম। বহুমুখী প্রতিভা কাকে বলে আর একবার দেখলাম চোখের সামনে। রংমহল-রঙ্গনা-স্টার-বিশ্বরূপায় রমরম করে চলত এই নাটক। তখন পেশাদারি মঞ্চের নাটকের জায়গাটাই একেবারে অন্যরকম। আমার পরিচালনায় ‘সুন্দরী লো সুন্দরী’ নাটক এরকম জনপ্রিয় হয়েছিল রঙ্গনায়। পরে নাটকটি অভিনীত হয় সারকারিনা, যোগেশ মাইম, বিজন থিয়েটারে।
আমি যখন প্রফেশনাল থিয়েটারে অভিনয় করতে আসি তখন কেবলমাত্র অভিনয়কে ভালোবেসে আসিনি। আর্থিক রোজগারের ব্যাপারটাও ছিল। জর্জ বার্নাড শ’র বিখ্যাত নাটক ‘মাই ফেয়ার লেডি’-র বাংলা ভাষান্তর করেন দেব সিংহ। রঙ্গনায় এক বছরের বেশি সময় ধরে চলেছিল ‘সুন্দরী লো সুন্দরী’। জুঁই-লিলি-আমি ফাটিয়ে অভিনয় করেছিলাম। নান্দীকারে থাকার সময় ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক’ বলে একটি নাটকে সেই ডিজাইনিংয়ে নতুনত্ব কিছু করেন অজিতেশদা। আমি ‘সুন্দরী লো সুন্দরী’ করার সময় মঞ্চে ‘ইমাজিনারি ওয়াল’ তৈরির চেষ্টা করেছিলাম। দর্শক-সমালোচকরা প্রশংসা করেছিলেন। সেইসময় অন্যকোনও থিয়েটারে এমন ধরনের সেট ডিজাইনিং হয়নি। অভিনব ও নতুনত্বও বটে।
এই নাটকের প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল— অজিতেশদার সঙ্গে সম্পর্কের বরফ গলেছিল কিন্তু এই নাটক করার সময়। আমি টেলিফোনে অজিতেশদাকে নাটকটি দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানাই। পরে কফিহাউসে গিয়ে দেখা করি। অজিতেশদা এলেন, তবে রঙ্গনায় নয়। আমরা তপন থিয়েটারে ‘সুন্দরী লো সুন্দরী’-র ডেট পেয়েছিলাম। নাটক দেখে তো উচ্ছ্বসিত। বললেন— ”হলটা খুব গরম। কিন্তু নাটকটা বেশ হয়েছে।” বুঝলাম বরফ গলেছে। আসলে নান্দীকার থেকে থিয়েটার ওয়ার্কশপে যোগ দেওয়াকে অজিতেশদা সমর্থন না করলেও পেশাদরি মঞ্চাভিনয়কে সমর্থন করেন। সিনেমায় অভিনয়কে সম্মান জানাতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। নাটকটির ২০০তম নাইটে ওঁকে আসতে বলি। অজিতেশদা এলেন। সকল কলাকুশলীদের সম্মান জানালেন। আমার হাতে তুলে দিলেন সেরা পরিচালকের সম্মান। বললেন— ”পেশাদারি মঞ্চে হালকা চালে গভীর নাটক”। সেদিন সিনেমা নিয়েও কথা হল। বললেন— দীনেন গুপ্তর একটি ছবির চিত্রনাট্য লিখেছি। দেখো তোমায় ডাকবে। ছবির নাম ‘নতুন পাতা’।
আবার চলে এল অজিতেশদার কথা। আসলে অজিতেশদাই তো আমার গুরু। পরে বিভাস-অশোক-দীপেন সেনগুপ্তদের কথাও বলতে হয়। আমি অভিনয় পরিচালনার ক্ষেত্রে ওদের কাছেও ঋণী। টলিউডের অনেক রথী-মহারথীদের সঙ্গে তরুণকুমার এসেছিলেন ‘সুন্দরী লো সুন্দরী’ দেখতে। বুড়োদাদের পাড়ায় এই নাটকের চর্চা হয়। বুড়োদার কানে গিয়েছিল সব। নাটক দেখে তো উচ্ছ্বসিত। জড়িয়ে ধরে আর কী! উত্তমকুমারকে আনার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ভিড় সামাল দেবে কে! ‘সুন্দরী লো সুন্দরী’ না দেখতে এলেও উত্তমকুমার অজিতেশের নাটক দেখতে গিয়েছিলেন। যেভাবে অজিতেশদার খ্যাতি আকাশ স্পর্শ করেছিল তাতে উত্তমকুমারের একবার দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল অজিতেশদার নাটক। দেখেছিলেন। আর অনুভব করেছিলেন মঞ্চে অজিতেশ কী বিরাট বিশাল ব্যক্তিত্ব। তবে কোন নাটক উত্তমদা দেখতে এসেছিলেন তা আজ আর মনে নেই। একটা কথা আমি এখানে বলব— শম্ভু মিত্রের অভিনয় দেখেছি। উৎপল দত্তের অভিনয়ও দেখেছি। ওঁরা অনেক ভালো অভিনেতা। কিন্তু অজিতেশদার মতো ভালো প্রশিক্ষক নন। কে জানে আমি অজিতেশদাকে বেশিই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তাই হয়তো ওঁর দোষ দেখতে পাই না। নান্দীকার যখন ছোটো হয়ে আসতে লাগল তখন অজিতেশদা ‘চার অধ্যায়’ মঞ্চস্থ করেন। ওদিকে শম্ভুদাও ‘চার অধ্যায়’ মঞ্চস্থ করেছেন। অজিতেশদাকে বললাম— ”আপনি শম্ভুদার চার অধ্যায় দেখেছেন।” বললেন— ”না, কেন বলো তো?” বললাম— ”দেখলে এটা মঞ্চস্থ করার পরিকল্পনা করতেন না। তৃপ্তি মিত্রের জায়গায় কাউকে রিপ্লেস করা যায় না। কী অভিনয়। মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়।” অজিতেশদা শুনলেন। বললেন— ”লোকে তো আমাদের ভালোই বলল।” আমি বললাম— ”ভেবে দেখুন কী করবেন।” দশটি শো হওয়ার পর ‘চার অধ্যায়’ আর অভিনীত হয়নি। অজিতেশদাও আর কখনও রবীন্দ্রনাটক গ্রুপে মঞ্চস্থ করেননি। একাকী করে থাকতে পারেন। আমার জানা নেই।
রঙ্গনায় যখন ‘সুন্দরী লো সুন্দরী’ চলছে তখন বিজন থিয়েটারে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত ও নির্দেশিত ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’ মঞ্চস্থ হয়। মূলত এটি কিন্তু যাত্রা। গ্রামগঞ্জ ও সমস্ত কোলিয়ারি বেল্টে তুমুল সাফল্য লাভের পর ভানুদা স্থির করেন, এটি তিনি প্রফেশনাল থিয়েটার হিসাবে দর্শকদের সামনে নিয়ে আসবেন। বিজন থিয়েটারে প্রতিদিনই শো হাউসফুল যেত। খবর পেতাম। গিয়ে দেখেও এসেছি। ভানুদা, বাসবী নন্দী, বিশ্বজিৎ (কয়েকটি শো) অভিনয় করেন। সেই সময় আরও একটি থিয়েটারে আমি অভিনয় করি। নায়িকা ছিল বাসবী নন্দী। নাম ‘জজসাহেব’। পরিচালনা শেখর চট্টোপাধ্যায়। এখানে একটা মজার ঘটনার কথা বলি— বিজন থিয়েটারে যখন ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’-এর সমস্ত শো হাউসফুল যাচ্ছে। তখন আমাদের শো হাউসফুল হচ্ছে না। ভানুদা রীতিমতো দর্শকদের ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দিতেন ‘সুন্দরী লো সুন্দরী’ ও ‘জজসাহেব’ দেখতে। বলতেন— ”সবাই আমার নাটকে কেন আসছেন? ওদিকে চিনু, শেখররা ভালো নাটক করছে যান না ওখানে। দেখে আসুন। ভালো লাগবে।” এভাবে আমাদের নাটকে বিনা শর্তে দর্শকাসন ভরিয়ে দিয়ে গিয়েছেন দরদী মানুষটি। যাই হোক, ‘সুন্দরী লো সুন্দরী’ নাটকটি কিনে নেন হরিদাসবাবু। ভালো লোক ছিলেন। যেদিন বেশি প্রফিট হত সেদিন বোনাস দিতেন সকলকে। থিয়েটার শুরুর তিন মাসের মাথায় আমার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এই আমি-লিলি-মীনাক্ষি গোস্বামী, শক্তি ঠাকুর, অসীমকুমার, গৌতম, রূপক মজুমদার ছাড়া আরও অনেক কুশীলব, টেকনিশিয়ান এই থিয়েটারটিকে ঘিরে প্রচুর টাকা উপার্জন করেন। আর্থিক দিকটাকে শক্তিশালী করতে এসেছিলাম প্রফেশনাল থিয়েটারের মঞ্চে— আমার সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছিল। অনেকে সেই সময় বলেছিল তোরা তো সব বিক্রি হয়ে গেলি রে হরিদাসবাবু কাছে। নিন্দুকদের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বলেছিলাম— নিজের এবং আরও অনেকের যদি স্থায়ী মাস মাইনের ব্যবস্থা করে দিতে পারি তাহলে বিক্রি হওয়ায় লাভ রয়েছে। ক্ষতি নেই। কারওর কথায় কখনও কান দিইনি। ফলে অভিনয়ের ক্ষিদে ছিল। সে টানে যখনই সুযোগ পেয়েছি নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
সমীর মজুমদারের পরিচালনায় সুপ্রিয়ার সঙ্গে থিয়েটার করি। নাম ‘কলঙ্ক’। দেবরাজ রায়ের পরিচালনায় থিয়েটার সেন্টারের নাটক ছিল ‘আগন্তুক’। নায়িকা ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত ‘গৃহপ্রবেশ’-এর নায়িকাও ছিলেন সাবিত্রী। সাবিত্রী, সাবিত্রী এবং সাবিত্রী। আমার স্বপ্নসুন্দরী। ড্রিমগার্ল। থিয়েটার ও সিনেমায় এমন তুখোড়, বুদ্ধিমতী অভিনেত্রী আমি আর কাউকে দেখিনি। অনেক অনেক কিছু শেখার আছে ওর থেকে। রঙ্গনায় গণেশদার নির্দেশনায় একটি নাটকে (‘বিয়ের ফুল’) সাবিত্রীর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাই। আমি ছিলাম হিরো। হিরোইন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। দুটো শো ছিল দুপুর ২টো থেকে সন্ধে ৬টা। আবার ৬টা সাড়ে ৬টা থেকে ৯টা। এই নাটকে অভিনয় করার সময় দেখেছিলাম গণেশদার নির্দেশনা ও সাবিত্রীর অভিনয়। দুর্দান্ত পারফরমেন্স। গণেশদার মধ্যে কোনও বসিং অ্যাটিটিউট ছিল না। খুব মোলায়েম বিনয়ী একজন ভদ্রলোক। ধরা যাক, ওঁর কোনও দৃশ্য পছন্দ হল না। রিহার্সালের সময় বলবেন— একটু এগিয়ে এসে বা সরে দাঁড়িয়ে বা ডায়লগটা বলার সময় গলাটা কাছে নামিয়ে আনলে হত না— আমি ওঁর পাশে বসে সব নিরীক্ষণ করতাম। বলতাম— ”আপনি তো বলতেই পারেন, এগিয়ে আসুন। ডায়লগ ঠিক করে বলুন।” উত্তরে উনি বলতেন— ”না, না ওভাবে বলাটা ঠিক হবে না। যদি মনে দুঃখ পায়।” এমন মানুষ ছিলেন গণেশদা। সহৃদয়, বন্ধুবৎসল, উদার, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন গণেশদার মিষ্টি ব্যবহারে সকলেই মুগ্ধ হতেন। খুব বেশিদিন থিয়েটার জগতে থাকেননি গণেশদা। যদি থাকতেন তাহলে থিয়েটারেরই ভালো হত। যাই হোক, ‘বিয়ের ফুল’ নাটকে আমি তো হিরো। সাবিত্রীকে দেখতাম ঠিক সময়ে শো-এ চলে আসত। কেউ দেরি করে এলেই জিজ্ঞাসা করত, কৈফিয়ত চাইত। নিয়মানুবর্তিতা, নিষ্ঠা, পরিশ্রমী, অধ্যবসায়ী। খেতে খুব ভালোবাসত। ভাত-শাক-ইলিশমাছ-কাঁটা দিয়ে তরকারি রান্না করে নিয়ে আসত। নিজে খেত। সকলকে খাওয়াত। ওর সঙ্গে অভিনয় করতে গিয়ে দেখেছি কখনও স্পেস ছাড়বে না। কম্প্রোমাইজ করবে না। চরিত্রের ভিতরে ঢুকতে ওর লাগত দু-তিন মিনিট। এত ডেডিকেটেড যে ভাবা যায় না। আপাত গ্রাম্য চরিত্র। ডায়লগও গ্রাম্য। কিন্তু সাবিত্রীর ডেলিভারি মারাত্মক। সেই ডেলিভারির সময় বোঝা যেত সংলাপের গভীরতা। প্রফেশনাল থিয়েটার, সিরিয়াস নাটক, সিনেমা— সর্বত্র সাবিত্রীর অভিনয় দেখে একটা কথাই মনে হয়েছে, বাংলাদেশে ওর তুলনীয় অভিনেত্রী খুব কম রয়েছে। তবু ওর স্বভাবের একটা খারাপ দিক রয়েছে। দীর্ঘ অভিনয় জীবনে সাবিত্রীর সঙ্গে অভিনয় করে মনে হয়েছে ও খুব স্বার্থপর। সহ অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে একটুও জায়গা ছাড়ে না। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর সময় নিজের অস্তিত্বটুকুর কথাই ভাবে। আশপাশে কে রয়েছে তা ভাবে না। স্টেজের ক্ষেত্রেও তাই। আচরণগত এই ত্রুটির জন্যই সাবিত্রীকে আমি ১০০-তে ৯০ নম্বর দিয়েছি। অভিনয়ের সময় সহ-অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে সাবিত্রী সাহায্য করেছে এটা আমি কখনও দেখিনি। আসলে ওকে ছাপিয়ে কেউ চলে যাক তা কখনই চাইত না সাবিত্রী। এমনকি উত্তমকুমারও ওকে সমীহ করে চলতেন। সাবিত্রীর সঙ্গে শুটিং থাকলে কোনও আড্ডা বা কথায় সময় নষ্ট করতেন না। আগে থাকতে নিজের অভিনয়াংশ পড়ে প্রস্তুত হয়ে থাকতেন। কারণ তিনি জানতেন অভিনয়াংশ পড়ে প্রস্তুত না হয়ে থাকলে সাবিত্রী একেবারে ছেলেখেলা করে রেখে দেবে। তবে এত বড়ো অভিনেত্রীর কী আর ছোটো মন হয়! আমার এখন মনে হয় সাবিত্রীর এই যে স্বার্থপরতা, জমি না ছাড়া, ইগো— বোধহয় জ্ঞানত ও কিছু করত না। কারণ ওর বড়ো মনের পরিচয়ও আমি পেয়েছি। ‘বিয়ের ফুল’ নাটকে আমি চাকর আর ও ঝি। একটা দৃশ্য ছিল— পূর্ববঙ্গ থেকে এবঙ্গে কোনওক্রমে চলে এসেছে সাবিত্রী। স্টেজে সে কথাই বলছে। সেই সময় আমি ঢুকব। বলব— ”ভয় কী আমি তো পাশে আছি।” কিন্তু উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ আমি অভিনয় দেখতে দেখতে স্টেজে ঢোকার কথা ভুলেই গেলাম। ওদিকে সাবিত্রীরও ডায়লগ শেষ— অপেক্ষা করছে আমার মঞ্চে প্রবেশের। হঠাৎ পিছন থেকে ধাক্কা। কেউ বলল, এবার তো তোমার এন্ট্রি। গুটি গুটি করে মঞ্চে গিয়ে কোনওরকমে ডায়লগ বলে দৃশ্যটা শেষ করি। কিন্তু জমেনি দৃশ্যটা। সাবিত্রীর রূপ দেখে কে! কথাই বলল না আমার সঙ্গে। বুঝলাম বিপদ। রক্ষে নেই। দ্বিতীয় দৃশ্য শুরুর আগে সাবিত্রীর পায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষমা চাইলাম। বললাম— ”ক্ষমা করে দাও।” বলল— ”কেন ওরকম করো। টাইমিং ঠিক না থাকলে কী করে কী হবে বলো তো! এমন আর কোরো না।” তারপরই বলল— ”ইলিশমাছ রয়েছে। কাঁটাচচ্চড়ি দিয়ে ভাত খাবে তো এসো।” এই হচ্ছে সাবিত্রী। কখনও উদার, কখনও কঠিন। অভিনয়ের স্বার্থে আপোস ওর স্বভাববিরুদ্ধ। ওর সঙ্গে আর একটি নাটকের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত ‘গৃহপ্রবেশ’।
প্রফেশনাল স্টেজে অনেক অভিনয় করেছি। রংমহলে টানা একবছর অভিনয় করেছি। নাটকের নাম ‘স্বীকারোক্তি’। উচ্ছ্বসিত প্রশংসা হয়েচিল অভিনয়ের। স্টারে অভিনয় করেছি। নাটকের নাম মনে নেই। বিশ্বরূপায় অভিনয় করিনি। তবে ওই সময় অর্পণা সেন, অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপঙ্কর দে কাঁপিয়ে দিয়েছিল বিশ্বরূপা। টানা দু’বছর ধরে চলেছিল ‘নীলকণ্ঠ’। দুর্দান্ত হিট। প্রচুর পয়সা উপার্জন করে নাটকটি।
এখানে আবার নান্দীকারের একটা নাটকের নাম বলতে ইচ্ছে করছে। অজিতেশদার পরিচালনায় ‘ফুল ফুটক না ফুটুক’। ভালো অভিনয় করেছিলাম। পরে খোকনদার (রুদ্রদার ডাক নাম) পরিচালনায় এই নাটকটিই মঞ্চস্থ হয়। অজিতেশদার ভালো লাগেনি। সেটা তিনি প্রকাশ্যে বলেওছিলেন। কিন্তু আমার আবার তা ভালো লাগেনি। আমি রুদ্রদা পরিচালিত ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক’ দেখেছিলাম। যথেষ্ট ভালো হয়েছিল। তখনই বুঝতে পেরেছিলাম তেলে জলে মিশ খাবে না। তই হল রুদ্রদা-কেয়া থেকে গেল নান্দীকারে, অজিতেশদা বেরিয়ে এসে নতুন দল গঠন করলেন নান্দীমুখ। নান্দীমুখের ‘পাপপুণ্য’ এবং অজিতেশদা ও রাধারমণদা মিলে আরও একটা নাটক করতেন— ‘নানা রঙের দিন’। ভালো হয়েছিল নাটকটা। সিনেমা কী পেশাদার মঞ্চ অভিনয়ের ক্ষেত্রে চিন্ময় রায় ‘নান্দীকারের ছেলে’ এই আপ্তবাক্যটি চিরকাল কাজে দিয়েছে। আমি যে থিয়েটার ওয়ার্কশপেও ছিলাম তা অতটা কিন্তু লোকের মনে ধরেনি। আসলে তখন নান্দীকার— অজিতেশদা বিরাট গ্ল্যামার। সেই ছোঁয়ায় মুগ্ধ হয়েছি। আলোয় আলোকিত হয়েছি। সম্মানিতও হয়েছি। এই স্ট্যাম্পটা গায়ে লেগে থাকুক আজীবন।