1 of 2

যে জন জানে

যে জন জানে

হাওড়া থেকে ট্রেন ছাড়ার পর এই নিয়ে অন্তত বিশবার হাতে ধরা ‘নর্তকীয় অপমৃত্যু’ বইটার পাতা থেকে চোখ সরিয়ে উলটোদিকে বসে থাকা লোকটার দিকে তাকাল অসমঞ্জ।

একটু ভুরু কোঁচকাল ও। এভাবে কেউ যদি এত কাছ থেকে কাউকে খুঁটিয়ে নজরবন্দি করে রাখে তা হলে অস্বস্তি হওয়ারই কথা—তার ওপর লোকটার ঠোঁটে লেগে আছে একচিলতে সবজান্তা বিজ্ঞের হাসি। এই জরিপ এবং অদ্ভুত হাসিতে অসমঞ্জের অস্বস্তি আরও দশগুণ বেড়ে গেল। জোর করে লোকটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বইয়ের পাতায় নজরটাকে স্ক্রু দিয়ে এঁটে দিতে চাইল। লাস্যময়ী নর্তকী লিজা কীভাবে অন্ধকার বলরুমে রহস্যজনকভাবে ছুরির আঘাতে মারা গেল সেই ধাঁধার মধ্যেই জোর করে ডুবিয়ে দিতে চাইল নিজেকে।

কিন্তু গল্পটা একটু বুদ্ধিজীবীদের ঢঙে লেখা। প্রথম দু-তিনটে পরিচ্ছেদ নানান বিক্ষিপ্ত ঘটনার ঘনঘটায় ভরা। তারপর লেখক ধীরে-ধীরে বিশ্লেষণের এক-একটা ধাপে পা রেখে এগিয়ে গেছেন শেষ পরিচ্ছেদের বৈজ্ঞানিক সমাধানে। পড়তে-পড়তে বেখেয়ালে এড়িয়ে গেছে এমন দু-একটা সূত্র মিলিয়ে নিতে দুবার অসমঞ্জকে ফিরে আসতে হল পিছনদিকের পাতায়। ঠিক তারপরই ও টের পেল, নিহত নর্তকীর কথা মোটেই ও আর ভাবছে না—বরং উলটোদিকে বসে থাকা অদ্ভুত লোকটার অদ্ভুত মুখটাই বারবার ভেসে উঠছে ওর চোখের সামনে। বিচিত্র পাবলিক তো, ভাবল ও।

অবশ্য লোকটার চেহারায় আঙুল তুলে দেখানো যায় এমন কোনও বিশেষত্ব নেই। কিন্তু তার চোখের চাউনিটাই ভয় পাইয়ে দিয়েছে অসমঞ্জকে। এই চাউনি যেন চিৎকার করে বলছে, আমি সবার গোপন খবর জানি। পাতলা ঠোঁটের কোণটা সামান্য বেঁকে গিয়ে শক্তভাবে বন্ধ হয়েছে, তার ওপর লোকটা লুকোনো কোনও রসিকতায় তারিয়ে-তারিয়ে মিটিমিটি হাসছে। রিমলেস চশমার কাচের পিছনে চোখ দুটো জ্বলছে অদ্ভুতভাবে—কিন্তু তা হয়তো জানলা দিয়ে ঠিকরে আসা আলোর ছটায়।

লোকটার পেশা আন্দাজ করার চেষ্টা করল অসমঞ্জ। পরনে সাধারণ আধময়লা চেক শার্ট আর কালো ঢোলা প্যান্ট। বয়েস হয়তো চল্লিশ-বিয়াল্লিশ হবে।

বিনা কারণেই কাশল অসমঞ্জ, সিটে নড়েচড়ে আরাম করে বসল। হাতের রহস্য উপন্যাসটাকে মুখের কাছে আড়াল করে ধরল। কিন্তু এতে লাভ হল না একটুও। অসমঞ্জের মনে হল, লোকটা যেন ওর কায়দাকানুন সবই ধরে ফেলেছে এবং তাতে বেশ মজা পেয়েছে। ও উশখুশ করতে চাইল, কিন্তু তক্ষুনি আবার ভাবল, এতে হয়তো একরকম লোকটারই জিৎ হবে। সুতরাং নানান ভাবনায় অসমঞ্জ এত বেশি নাজেহাল হয়ে উঠল যে, হাতের বইয়ে মন দেওয়াটা ওর পক্ষে নিছক অসম্ভব হয়ে উঠল।

দিনটা ছুটির দিন। ফলে ট্রেনে এমনিতেই বেশি ভিড় নেই, এবং এই কামরাটার একটা অংশে অসমঞ্জ এবং সেই বিচিত্র ব্যক্তি একা-একা পরস্পরের মুখোমুখি বসে। ইতিমধ্যে গোটাকয়েক স্টেশন পেরিয়ে এলেও তৃতীয় কোনও যাত্রী ওদের সঙ্গে এসে বসেনি। ফলে এক অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা রাজকীয়ভাবে বজায় থেকেছে। অসমঞ্জ ইচ্ছে করলে এই সিট ছেড়ে উঠে পড়তে পারে, চলে যেতে পারে পাশের খুপরিতে। কিন্তু সেটা হবে নিছক হেরে যাওয়া। অতএব ‘নর্তকীর অপমৃত্যু’ চোখের কাছ থেকে নামিয়ে লোকটার সঙ্গে নজর-মোলাকাত করল অসমঞ্জ।

‘একঘেয়ে লাগছে?’ লোকটা জিগ্যেস করল।

‘তা একটু লাগছে—’ কিছুটা স্বস্তি আর অনিচ্ছা নিয়ে উত্তর দিল অসমঞ্জ। তারপর আরও বলল, ‘বই-টই কিছু পড়বেন?’

অ্যাটাচি কেস থেকে ‘তৃতীয় ব্যক্তি’ বইটা বের করে অনেক আশা নিয়ে সামনে বাড়িয়ে দিল ও।

বইটার নাম একপলক দেখে নিয়ে মাথা নাড়ল লোকটা। বলল, ‘নাঃ, ধন্যবাদ…। আসলে ডিটেকটিভ গল্প আমি একেবারেই পড়ি না। ওগুলো এত খেলো…আপনার কী মনে হয়?’

‘হ্যাঁ, মানে, ক্যারেক্টার বিল্ডিং কিংবা ভ্যালুজের ব্যাপার-ট্যাপারগুলো ওসব বইতে খুব একটা ভালো থাকে না। কিন্তু ট্রেনে সময় কাটাতে হলে…।’

অসমঞ্জকে বাধা দিয়ে লোকটা বলে উঠল, ‘না, না, আমি কিন্তু ঠিক তা বলতে চাইনি। ওসব ভ্যালুজ-ট্যালুজের কথা আমি বলছি না। আসলে গল্পের খুনিগুলো এত বোকা যে, ওদের কাণ্ডকারখানা পড়তে গেলে আমার ঘুম পায়।’

‘সে বলতে পারি না, তবে সত্যিকারের খুনিদের চেয়ে ওদের বুদ্ধি, হাতযশ, ঢের-ঢের বেশি।’ অসমঞ্জ উত্তর দিল।

‘সত্যিকারের খুনিদের মধ্যে যারা ধরা পড়ে…। হ্যাঁ, তাদের চেয়ে গল্পের খুনিদের বুদ্ধি বেশি, মানছি—’ অসমঞ্জের কথা শুধরে দিয়ে বলল লোকটা।

‘তবে অনেক খুনি আবার ধরা পড়ার আগে বেশ চালাকির খেলা দেখিয়েছে।’ অসমঞ্জ প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, ‘যেমন রংগা, বিল্লা, রমন রাঘব। তারপর বিদেশিদের মধ্যে ক্রিপেন, ইয়র্কশায়ার রিপার—।’

‘হুঃ—ওদের কাজকর্মের ছিরি আর বলবেন না—’ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল লোকটা, ‘বাচ্চাছেলের মতো অগোছালো খুনের জন্যে হাজারোরকম সাজসরঞ্জাম চাই, গাদা-গাদা মিথ্যে কথা বলা—যতসব ফালতু ব্যাপার।’

‘যাঃ—কী যে বলেন। আপনি এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন খুন করে পুলিশকে ফাঁকি দেওয়াটা বাদামের খোসা ছাড়ানোর মতো সোজা!’

মিটিমিটি হাসি কিছুটা প্রশস্ত হল। বলল, ‘হতে পারে—কে জানে।’

মন্তব্যের ভাব সম্প্রসারণের অপেক্ষায় রইল অসমঞ্জ, কিন্তু রহস্যময় মানুষটার কাছ থেকে কোনও ব্যাখ্যা ভেসে এল না। সিটে গা এলিয়ে কামরার কাঠের তৈরি ছাদের দিকে তাকিয়ে কী এক গোপন রসিকতায় খুশি-খুশি হয়ে উঠল সে। মনে হল, এই আলোচনাকে সে কোনও গুরুত্বই দিচ্ছে না, এবং এ নিয়ে কথাবার্তা চালানোর আগ্রহ তার ফুরিয়ে গেছে।

অসমঞ্জ হঠাৎই খেয়াল করল, ও লোকটার হাত দুটো খুঁটিয়ে দেখছে। হাতের রং ফরসা, আর আঙুলগুলো অস্বাভাবিকরকম সরু এবং লম্বা। সেগুলো এখন তার হাঁটুর ওপরে হালকা ছন্দে বাজনা বাজাচ্ছে।

অসমঞ্জ অন্যমনস্কভাবে হাতের বইটার পাতা ওলটাল। তারপর আরও একবার বইটা নামিয়ে রেখে বলল, ‘ঠিক আছে, এতই যখন সোজা, বলুন, আপনি হলে কীভাবে খুন করতেন?’

‘আমি?’ প্রতি-প্রশ্ন করল লোকটা। চশমার কাচে আলো পড়ে তার চোখের দৃষ্টি শূন্য মনে হল। কিন্তু গলার স্বরে বোঝা গেল সে যেন মজা পেয়েছে। লোকটা হেসে বলল, ‘আমার কথা আলাদা। খুন করতে গেলে আমাকে দুবার ভাবতে হবে না।’

‘কেন?’

‘কারণ, একটা গোপন কায়দা আমার জানা আছে।’

‘তাই নাকি?’ অস্ফুটে বললেও অসমঞ্জের স্বরে ব্যঙ্গ চাপা রইল না।

‘নিশ্চয়ই। সে আর কঠিন কী!’

‘সেটাই যে ঠিক কায়দা তা জানলেন কেমন করে? আপনি নিশ্চয়ই আর যাচাই করে দেখেননি?’

লোকটা থেমে-থেমে জবাব দিল, ‘যাচাই করে দেখার দরকার নেই। আমার পদ্ধতির মধ্যে এতটুকু ফাঁক কোথাও নেই। সেটাই হল সেই কায়দার আসল মজা।’

‘বলা অনেক সহজ,’ ছোট্ট করে মন্তব্য করল অসমঞ্জ, ‘কিন্তু আপনার সেই নিখুঁত পদ্ধতিটা কী, একটু বলবেন?’

‘কী করে ভাবলেন মুখের কথা ফেলতে না ফেলতেই সেটা আমি আপনাকে শিখিয়ে দেব?’

ধীরে-ধীরে চোখের নজর অসমঞ্জের ওপর নিয়ে এল লোকটা: ‘তা ছাড়া এভাবে শিখিয়ে দেওয়াটা বিপজ্জনক হতে পারে। আপনাকে দেখে অবশ্য নিরীহ বলেই মনে হচ্ছে—কিন্তু বিল্লার চেহারাও নিরীহ ছিল। অন্য লোকদের জীবন-মরণের পাক্কা মালিক হয়ে বসলে তাকে আর বিশ্বাস করা যায় না।’

অবাক হয়ে অসমঞ্জ বলল, ‘যাঃ, কী যে বলেন! কাউকে খুন করার কথা আমি ভাবতে যাব কোন দুঃখে?’

‘ভাববেন…ঠিক ভাববেন,’ লোকটা বলল, ‘পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়ার মতো নিখুঁত অস্ত্র হাতে পেলে যে-কেউই খুন করার কথা ভাববে। খুনকে ঘিরে আমাদের দেশের আইন এত নিয়মকানুনের ফ্যাঁকড়া লাগিয়ে রেখেছে কেন বলতে পারেন? কারণ খুনটা যে-কেউ করতে পারে, এটা দু-বেলা ভাত খাওয়ার মতোই ন্যাচারাল।’

‘কিন্তু এ তো আপনার কল্পনা!’ প্রতিবাদ করল অসমঞ্জ।

‘আপনার তাই মনে হচ্ছে? অবশ্য বেশিরভাগ লোকই এই কথা বলবে। কিন্তু তা হলেও আমি তাদের বিশ্বাস করি না। অন্তত যেখানে ক্যারাসল নাইট্রেট যে-কোনও ওষুধের দোকানে কিনতে পাওয়া যায়।’

‘কী নাইট্রেট?’ তীক্ষ্নস্বরে জানতে চাইল অসমঞ্জ।

‘হুঁ—। আপনি ভাবছেন আমি বোধহয় বেফাঁস কিছু বলে ফেললাম। উহুঁ, আসলে ওই জিনিসটার সঙ্গে আরও দু-একটা জিনিস মেশাতে হয়—সবগুলোই যেখানে-সেখানে সস্তায় পাওয়া যায়। মাত্র চল্লিশ টাকা খরচ করলে আপনি এ-দেশের গোটা মন্ত্রিসভাকে সাফ করে দিতে পারেন। অবশ্য সবাইকে একসঙ্গে সরিয়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না—সবাই যদি একই দিনে ঘুমের মধ্যে হার্টফেল করে মারা যায় তা হলে লোকে সন্দেহ করতে পারে।’

‘ঘুমের মধ্যে হার্টফেল? কেন?’

‘কারণ ঘটনা এইভাবেই ঘটে। জলের সঙ্গে বিষটা মিশিয়ে দেওয়ার পর সেটা খেয়ে কেউ যদি ঘুমোয় তা হলে সেটাই হবে তার লাস্ট ঘুম। আসলে ঘুমন্ত অবস্থাতেই বিষটা কাজ শুরু করে। এই কেমিক্যাল রিয়্যাকশনটা এত সহজ যে, কোনও পরীক্ষাতেই ধরা পড়ে না। ফলে ডাক্তাররা ভাবে হার্টফেল।’

অস্বস্তিভরে লোকটাকে দেখল অসমঞ্জ। হাসিটা ওর পছন্দ হল না। কিছুটা উপহার এবং অহঙ্কার মেশানো হাসি।

‘জানেন, এই যে কাগজে প্রায়ই দেখা যায়, ঘুমন্ত অবস্থায় কেউ-না-কেউ হার্টফেল করেছে, ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত…’ একটা সিগারেট পকেট থেকে বের করে তাতে আগুন ধরাল লোকটা। খুব ধীরে আয়েস করে টান দিল ‘এইরকম স্বাভাবিক মৃত্যু সবসময়েই আমাদের নজরে পড়ছে। সুতরাং, খুনের পথ হিসেবে এই পদ্ধতিটা বেছে নেওয়া খুবই স্বাভাবিক—যদি অবশ্য সব ওষুধ ঠিক-ঠিক মতো মিশিয়ে আসল জিনিসটা তৈরি করা যায়। আর সেটা শিখে গেলে তখন লোভহয় বারবার যাচাই করে দেখতে। এ-লোভের হাত থেকে কারও নিস্তার নেই। যদি শুনি যে, এই ওষুধে তৈরির ফরমুলা আপনার জানা আছে, তা হলে আপনার মতো কোনও নিরীহ সাধুপুরুষকেও আমি আর বিশ্বাস করব না।’

লম্বা সরু আঙুলগুলো আবার বাজনা বাজাতে লাগল হাঁটুর ওপরে।

কিছুটা অপমানিত হয়েই শ্লেষের খোঁচা ছুড়ে দিল অসমঞ্জ ‘কিন্তু আপনার বেলা? কাউকেই যদি বিশ্বাস না করবেন তা হলে নিজের বেলায়…।’

‘ঠিকই বলেছেন,’ নির্লজ্জভাবে উত্তর দিল লোকটা, ‘আমি নিজেকেও বিশ্বাস করি না। কিন্তু একবার জেনে যখন ফেলেছি তখন সেটাকে তো আর অজানা করা যায় না! ব্যাপারটা হয়তো ঠিক নয়—কিন্তু আমার তো কিছু করার নেই। তবে জেনে রাখুন, ঘুমের মধ্যে হার্টফেল আমি করছি না। আরে, বর্ধমান এসে গেছে দেখছি। চলি, নামতে হবে—একটু কাজ আছে।’

চটপট উঠে পড়ে জামাকাপড় ঝেড়ে নিল লোকটা। সিগারেটটা মেঝেতে ফেলে পা দিয়ে পিষে নিভিয়ে দিল। চশমাটা চোখ থেকে খুলে রুমাল বের করে কাচ দুটো মুছে নিল।

ট্রেন ক্রমে গতি কমিয়ে স্টেশনে এসে থামল। চশমা চোখে লাগিয়ে মুচকি হেসে ছোট্ট করে ‘চলি—’ বলল সে। তারপর নেমে পড়ল ট্রেন থেকে।

বাইরে তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে।

মাথা ঝুঁকিয়ে স্টেশনের চাঞ্চল্য ও কোলাহলকে উপেক্ষা করে দ্রুতপায়ে হাঁটতে শুরু করল লোকটা। জানলা দিয়ে যতদূর দেখা যায় লোকটাকে দেখল অসমঞ্জ।

‘পাগল, না আর কিছু—’ মনে-মনে ভাবল ও, ‘যাক, এবার একটু একা-একা জিরিয়ে নেওয়া যাবে…।’

‘নর্তকীর অপমৃত্যু’-তে আবার ফিরে এল অসমঞ্জ, কিন্তু বারেবারেই ওর মনোযোগ বিগড়ে যেতে লাগল।

ওই বিষটার কী যেন নাম বলল লোকটা? কীসের নাইট্রেট যেন?

শত চেষ্টা করেও নামটা মনে করতে পারল না ও।

পরদিন বিকেলে খবরটা নজরে পড়ল অসমঞ্জের। সকালে ভালো করে কাগজ পড়ে ওঠার সময় পায়নি। বিকেলের দিকে তিন নম্বর পৃষ্ঠার অপাংক্তেয় খবরটায় হঠাৎই চোখ পড়ে গেল ওর। ‘নিদ্রিত অবস্থায়’ শব্দ দুটো প্রথমে ও দেখতে পায়। তখনই ছোট হরফের হেডিংটা ওর মনোযোগ টেনে নেয়। নইলে গোটা খবরটাই হয়তো ওর চোখ এড়িয়ে যেত।

নিদ্রিত অবস্থায় ব্যবসায়ীর মৃত্যু

৭ আগস্ট, বর্ধমান: আজ রাতে কমল বিশ্বাস (৫৫) নামে জনৈক ব্যবসায়ী নিদ্রিত অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করে। ঘটনাটি অস্বাভাবিক ও বিচিত্র সন্দেহ করে ব্যবসায়ীর স্ত্রী সুলেখাদেবী পুলিশের দ্বারস্থ হন। তাঁর বক্তব্য, স্বামীর কাছ থেকে কোনও যন্ত্রণার শব্দ তিনি শোনেননি বা কোনও অস্থিরতা তাঁর চোখে পড়েনি। এ ছাড়া, আগে ভদ্রলোকের কখনও হৃদরোগের লক্ষণ দেখা যায়নি। কিন্তু পুলিশি পরীক্ষায় জানা গেছে, এ-মৃত্যু স্বাভাবিক হৃদরোগে মৃত্যু। যদিও এরকম সাধারণত দেখা যায় না। ভদ্রলোকের পরিবারবর্গ ও তাঁদের পারিবারিক ডাক্তার এ-অভিমত মানতে রাজি হননি, তাঁরা…।

‘এ তো অদ্ভুত কাকতালীয় দেখছি,’ ভাবল অসমঞ্জ, ‘বর্ধমানেই ঘটল ঘটনাটা। ট্রেনে আমার সঙ্গী সেই রহস্যময় ভদ্রলোক খবরটা পেলে হয়তো কৌতূহলী হতেন—যদি অবশ্য উনি এখনও বর্ধমানে থেকে থাকেন।’

যদি একবার কোনও বিশেষ জিনিসের দিকে কারও মনোযোগ পড়ে, তা হলে সেটা ধীরে-ধীরে মাথার ভেতরে গেড়ে বসে। তখন রাস্তাঘাটে খবরের কাগজে শুধু ওই জিনিসটাই চোখে পড়ে সবার আগে। অসমঞ্জেরও ঠিক তাই হল। রাতদিন শুধু ওর চোখে পড়তে লাগল ‘ঘুমের মধ্যে’ হার্টফেল করে মৃত্যুর ঘটনা। ও অবাক হয়ে ভাবল, ‘ভারতবর্ষে এত লোক ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে হার্টফেল করে মারা যায়! আশ্চর্য, আগে তো কখনও খেয়াল করিনি!’

সকাল-বিকেল-সন্ধ্যা-রাত্রি এই একটা জিনিস মায়াবী পিশাচের মতো অসমঞ্জকে অনুসরণ করে চলল। ঘটনা পরম্পরা বারবার সেই একই: ‘ঘুমন্ত অবস্থায় মৃত্যু, মৃতদেহ আবিষ্কার, সন্দেহ, পুলিশি তদন্ত, ময়না তদন্ত এবং ফলাফল, যথারীতি স্বাভাবিক মৃত্য।’ ডাক্তারি মতে, হার্টফেল করে মৃত্যু। ব্যস, সব শেষ। সুতরাং, ঘুমোতে যাওয়ার আগে এক গ্লাস জল খাওয়ার যে-অভ্যেস অসমঞ্জের ছিল, সেটা শিগগিরই ছেড়ে দিল ও। আর সেই নাম-ভুলে-যাওয়া জিনিসের নাইট্রেটের নামটা দিন-রাত মনে করার চেষ্টা করতে লাগল।

খবরের কাগজের প্রতিটি পৃষ্ঠা রোজই তন্নতন্ন করে পড়ে অসমঞ্জ—যদি কোনওরকমে একটা সপ্তাহ হার্টফেলের খবর ছাড়াই পার হয়ে যায়। সেরকম হলে একইসঙ্গে ও স্বস্তি পায়, আবার হতাশও হয়।

একদিন ওর নজরে পড়ল, জনৈক প্রৌঢ় বিজ্ঞানী ঘুমের মধ্যে হার্টফেল করে মারা গেছেন। বিজ্ঞানীর স্ত্রী পূর্ণ যুবতী এবং একজন যুবকের সঙ্গে অবৈধ প্রেমে জড়িয়ে ছিল। সুতরাং পুলিশ সন্দেহ করতে শুরু করল। কাঠগড়ায় তুলল বউটিকে। কিন্তু প্রমাণের অভাবে আর ডাক্তারি রিপোর্টের জোরে সে ছাড়া পেয়ে গেল। ঘরে বসে-বসে হাত কামড়াতে লাগল অসমঞ্জ। নাইট্রেট। নাইট্রেট। কীসের যেন নাইট্রেট? আপ্রাণ চেষ্টায় ট্রেনের আগন্তুকের বলা নামটা মনে করতে চাইল ও। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ল না।

এর পরের ঘটনা ঘটল একবারে অসমঞ্জের নিজের পাড়ায়। রামতনু চন্দ্র নামে ষাট বছরের এক বৃদ্ধকে তার বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। এ ছাড়া তার বিছানার পাশে একটা ছোট টেবিলে আধগ্লাস জলও পাওয়া গেল। বাড়িতে বুড়ো ছাড়া তার এক অল্পবয়েসি ভাইপো থাকত। সে-ই ছিল বুড়োর তিনকুলে একমাত্র আত্মীয়। বুড়ো মারা যেতে ছেলেটাই খবর দিল পুলিশকে। তার জেঠু নাকি এভাবে হার্টফেল করে মারা যেতে পারে না। তার হার্ট নাকি রেসের ঘোড়ার মতো তেজি ছিল ইত্যাদি-ইত্যাদি। কিন্তু পুলিশি তদন্তের রিপোর্ট বেরোল সেই একই। আর জানা গেল, বুড়ো মারা যাওয়ায় তার ভাইপো বুড়োর রেখে যাওয়া প্রায় দেড়লাখ টাকার সম্পত্তির মালিক হয়েছে।

অসমঞ্জ সবই বুঝল, কিন্তু ওর হাত-পা বাঁধা। কোনও প্রমাণ নেই। ও এও বুঝল, কোন দুঃসাহসে ওই ভাইপো নিজেই পুলিশে খবর দিয়েছিল। কারণ, সে আগে থেকেই জানত, পুলিশ কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না। তার জেঠুর কপালে ‘হার্টফেল করে স্বাভাবিক মৃত্যু’-ই লেখা আছে।

সেইদিন সন্ধেবেলায় বরাবরের অভ্যেসমতো পায়চারি করতে বেরোল অসমঞ্জ। নিতান্তই কৌতূহল ওকে টেনে নিয়ে গেল রামতনু চন্দ্রের বাড়ির দিকে। বাড়ির বন্ধ জানলাগুলোর দিকে তাকিয়ে ও যখন উঁকিঝুঁকি মারছে, ঠিক তখনই বাগানের দিকের দরজা খুলে একটা লোক বেরিয়ে এল। রাস্তার আলোয় তক্ষুনি তাকে চিনে ফেলল অসমঞ্জ।

‘এই যে—’ ডেকে উঠল ও।

‘আরে, কী ব্যাপার, আপনি?’ লোকটা হালকা চালে বলল, ‘অকুস্থল পরীক্ষা করতে এসেছেন? তা কী পেলেন বলুন?’

‘না, না।—ওসব কিছু না,’ বিব্রত হয়ে বলল অসমঞ্জ, ‘রামতনুবাবুকে আমি চিনতাম না। খুব অদ্ভুতভাবে আবার আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, তাই না?’

‘হ্যাঁ, যা বলেছেন। আপনি বুঝি কাছেই থাকেন?’

‘হ্যাঁ—’ উত্তর দিল অসমঞ্জ। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল, এ-কথা না বললেই ভালো হত। ও পালটা প্রশ্ন করল, ‘আপনিও কাছাকাছি থাকেন নাকি?’

‘না, না।’ জবাব দিল লোকটা, ‘আমি এখানে একটু নিজের কাজে এসেছিলাম।’

‘আগেরবার যখন আমাদের দেখা হয়েছিল, তখন আপনি কী কাজে যেন বর্ধমান যাচ্ছিলেন।’

ওরা এখন পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করেছে। অসমঞ্জ আনমনাভাবেই নিজের বাড়ির পথ ধরেছে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমতা-আমতা করে বলল লোকটা, ‘হ্যাঁ। কাজের ব্যাপারে আমাকে বহু জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়। কখন যে কোথায় আমার ডাক পড়বে তা আমি নিজেও জানি না।’

‘আপনি যখন বর্ধমানে ছিলেন তখনই তো ওখানকার এক ব্যবসায়ী ঘুমের ঘোরে হার্টফেল করে মারা গেল, তাই না? অসতর্কভাবে মন্তব্য ছুড়ে দিল অসমঞ্জ।

হ্যাঁ। বড় আশ্চর্য কোইনসিডেন।’ চকচকে কাচের পিছন থেকে আড়চোখে ওর আপাদমস্তক দেখে নিল লোকটা ‘ওই ব্যবসায়ী বউ তো এখন বিরাট বড়লোক। দেখতে শুনতেও ভালো—স্বামীর চেয়ে বয়েস অনেক কম ছিল।’

ওরা অসমঞ্জের বাড়ির দরজার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল।

‘এই আমার বাড়ি। আসুন, এক কাপ করে চা খাওয়া যাক।’ প্রস্তাবটা দিয়েই অসমঞ্জের আবার মনে হল কাজটা ও ঠিক করল না।

লোকটা কিন্তু ওর প্রস্তাবে সঙ্গে-সঙ্গে সাড়া দিল। ওরা দুজনে বাড়িতে ঢুকে বসবার ঘরে গুছিয়ে বসল।

অসমঞ্জ সংসারে একা। সুতরাং চা ও নিজেই তৈরি করে নিয়ে এল। তারপর চিনি নাড়তে-নাড়তে বলল, ‘আজকাল ঘুমের ঘোরে হার্টফেল করাটা খুব কমন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ একটু ইতস্তত করে ও আরও বলল, ‘বিশেষ করে ট্রেনে আপনার সঙ্গে ওই বিষয়ে কথা হওয়ার পর থেকে জিনিসটা আমার আকছারই চোখে পড়ছে—’ সপ্রতিভভাবে একটু হাসল ও: ‘জানেন, আমি ভাবছিলাম…কেউ হয়তো আপনার সেই ওষুধটার নাম জেনে ফেলেছে, তারপর…। কী যেন নাম ওষুধটার?’

লোকটা প্রশ্নটাকে কোনওরকম আমল না দিয়ে সরাসরি এড়িয়ে গেল। বলল, ‘না, না। আমি ছাড়া ওই কেমিক্যালটার কথা আর কেউ জানে না। অন্য কী একটা ওষুধের খোঁজ করতে-করতে নেহাতই ঘটনাচক্রে আমি ওই কেমিক্যালটার খবর পেয়ে গিয়েছিলাম। দেশের নানান জায়গায় সবাই একসঙ্গে একই ওষুধ আবিষ্কার করে বসে আছে, এ-কথা বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু এসব ব্যাপার থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কত সহজে আর নিশ্চিন্তে কাউকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়।’

‘আপনি তা হলে একজন কম্পাউন্ডার?’ লোকটার কথা থেকে পাওয়া কয়েকটা বিশেষ শব্দের ওপর ভরসা করে অনুমানে ঢিল ছুড়ে দিল অসমঞ্জ।

না, কম্পাউন্ডার ঠিক নই—আমি হলাম গিয়ে সর্বঘটে কাঁঠালি কলা— সব কাজই একটু-আধটু জানি।’ একটু থেমে তারপর: ‘ওঃ, আমার পরিচয়টাই আপনাকে দেওয়া হয়নি।’ হাসল সে: ‘আমার নাম শরণ গুপ্ত—।’

‘আমি অসমঞ্জ দত্ত। দেখছেনই তো—ব্যাচেলার। শিগগিরই যে বিবাহিত হয়ে পড়ব এমন সম্ভাবনা বিশেষ নেই। ছোটখাটো চাকরি করি। আর পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে এই ছোট্ট বাড়িটায় মাথা গুঁজে রয়েছি।’

‘ভালো আছেন মশাই। বিয়ে-থা যখন করেননি তখন ভাগ্যবানই বলতে হবে—’ হাসল শরণ গুপ্ত: ‘নাঃ, আপনার ওই নাইট্রেটের দরকার পড়বে বলে মনে হয় না। যদি ফাটকা আর মেয়েছেলের রোগ থেকে দূরে থাকতে পারেন, তা হলে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, সারা জীবনে ওই অদ্ভুত দাওয়াই আপনার কখনও দরকার হবে না।’

মুখ ফিরিয়ে আড়চোখে হাসল সে। আলো পড়ে চকচকে হয়ে উঠল চশমার কাচ। মুখের ভাঁজগুলো যেন আরও স্পষ্ট হল। ট্রেনের কামরার চেয়ে এখন তাকে আরও বেশি বয়স্ক বলে মনে হচ্ছে।

‘না, সাহায্যের জন্যে আপনার কাছে আমাকে ছুটতে হবে না,’ ঠাট্টার সুরে বলল অসমঞ্জ, ‘তা ছাড়া, আপনাকে দরকার পড়লেই বা খুঁজে পাচ্ছি কোথায়!’

‘আমাকে খুঁজে বের করতে হবে না,’ শরণ গুপ্ত বলল, ‘আমিই আপনাকে খুঁজে নেব। ও আমার অভ্যেস আছে।’ দাঁত দেখিয়ে হাসল সে: ‘আচ্ছা, তা হলে চলি। চায়ের জন্যে ধন্যবাদ। আর কখনও আমাদের দেখা হবে বলে মনে হয় না, তবে ভাগ্য আর নিয়তির কথা কে বলতে পারে, বলুন।’

শরণ গুপ্ত বেরিয়ে গেলে চেয়ারে বসে গা এলিয়ে দিল অসমঞ্জ। টেবিলে রাখা নিজের আধখাওয়া জলের গ্লাসে চুমুক দেওয়ার আগে মনটা একবার খচখচ করে উঠল। মনে পড়ল রামতনু চন্দ্রের কথা।

গ্লাসের জলটা অসমঞ্জের জিভে কেমন যেন বিস্বাদ ঠেকল। জলের রংটাও কি একটু অন্যরকম ঠেকছে? রামতনু চন্দ্রের বাড়িতে কী করছিল শরণ গুপ্ত?

সব মিলিয়ে ব্যাপারটা রহস্যময়। শরণ গুপ্তের আগমন, তারপর ওই…ওই নাইট্রেটের কথা। ইস, কীসের নাইট্রেট যেন? নামটা জিভের ডগায় এসে আটকে যাচ্ছে।

‘আমাকে খুঁজে বের করতে হবে না। আমিই আপনাকে খুঁজে নেব।’ এ-কথা বলে আসলে কী বলতে চাইছে শরণ গুপ্ত? এ তো বড় অদ্ভুত ব্যাপার। সত্যিই কি মারণ-ভোমরার খবর গুপ্ত জানে? নাঃ, পুরো ব্যাপারটা নেহাতই পাগলামো। নইলে কোন বিশ্বাসে সমস্ত গুপ্তকথা সে অসমঞ্জকে বলে দেয়? অসমঞ্জ যদি এখন পুলিশে গিয়ে সব ফাঁস করে দেয় তা হলেই তো শরণ গুপ্ত ফাঁসিতে চড়বে। অসমঞ্জের বেঁচে থাকাটাই এখন তার পক্ষে বিপজ্জনক।

গ্লাসের জলটা।

যতই ভাবতে লাগল ততই সন্দেহটা জোরদার হতে লাগল অসমঞ্জের মনে। গ্লাসের জলটার স্বাদ-বর্ণ-গন্ধ যেন আর স্বাভাবিক নেই। শরণ গুপ্তের সঙ্গে কথা বলতে-বলতে কি সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল অসমঞ্জ? আর সেই সুযোগে…নাঃ, আর কোনও সন্দেহ নেই। হিসেব অনুযায়ী এখন অসমঞ্জের ঘুম পাওয়ার কথা, তারপর ঘুমের ঘোরে হার্ট অ্যাটাকে…উঁহু, এসবই হয়তো অসমঞ্জের কল্পনা। কিন্তু একটা ঘুম-ঘুম ভাব সত্যিই যেন টের পাচ্ছে ও…।

অসমঞ্জের কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমে উঠল।

মিনিটকুড়ি পরে তেঁতুল আর গরম জল খেয়ে বারচারেক বমি করে অবসন্ন শরীরে বিছানায় গা এলিয়ে দিল অসমঞ্জ। সারা দেহ থরথর করে কাঁপছে। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছে ও। নইলে আজকের ঘুমই ওর কালঘুম হত।

শরণ গুপ্তের চিন্তা মন থেকে কিছুতেই তাড়াতে পারছে না অসমঞ্জ। সেই সঙ্গে শরীরের কাঁপুনিটাকেও। মনের দিক থেকে ভীষণ ভেঙে পড়েছে ও। এবার থেকে জল খাওয়ার সময় ও খুব সাবধান হবে। ওর ভয় আর অস্বস্তি আরও তীক্ষ্ন হল।

গ্লাসের বিষাক্ত জলের ঘটনাটা অসমঞ্জকে ভীষণ দুর্বল করে দিল। রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় বারবার চারপাশে সতর্ক চোখে তাকায় ও। অচেনা লোক দেখলে দরজা খোলে না। সবসময়ে যেন একটা আতঙ্ক আশঙ্কা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে ওকে। এমন সময় ঘটল আর-একটা নতুন ঘটনা।

অসমঞ্জের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরের এক এলাকায় একজন শিল্পপতি হার্ট অ্যাটাকে মারা গেল। যথারীতি ঘুমের ঘোরে। কিন্তু এবারে সামান্য হেরফের আছে। মাঝরাতে ভদ্রলোকের যন্ত্রণার চিৎকার শুনতে পেয়েছে তার স্ত্রী ও মেয়ে। এবং তাদের মতো ব্যাপারটা রীতিমতো অস্বাভাবিক। যদিও ভদ্রলোকের বড়ছেলের মত অন্যরকম। কেন যে অন্যরকম তা অসমঞ্জ এখন ভালোই আন্দাজ করতে পারছে। সুতরাং ব্যাপারটা আদালতে ওঠার পর শুনানি দেখতে সেখানে গেল ও।

রায় বেরোল, দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু। তাতে অসমঞ্জ অবাক হল না। কিন্তু কোর্ট ছেড়ে বাইরের রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই একটা দৃশ্য ওকে ভীষণ অবাক করে দিল। আধময়লা চেক শার্ট ও ঢোলা কালো প্যান্ট। খুব চেনা মুখ। শরণ নাইট্রেট গুপ্ত। সে একটা ট্যাক্সি থামিয়ে তাতে উঠতে যাচ্ছে।

পিছন থেকে ছুটে গিয়ে শরণ গুপ্তের ওপরে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল অসমঞ্জ।

‘মিস্টার গুপ্ত।’ হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল ও। সাংঘাতিক জোরে তার কাঁধ খামচে ধরল।

‘কী ব্যাপার, আপনি?’ ঘুরে তাকাল গুপ্ত। চোখে-মুখে বিরক্তি: ‘কোর্টে গিয়েছিলেন নাকি?’ অসমঞ্জের হাতটা কাঁধ থেকে ছাড়িয়ে নিল সে। স্বাভাবিক হয়ে হাসল। তারপর বলল, ‘বলুন স্যার, আপনার জন্যে কী করতে পারি?’

‘এসব আপনার কীর্তি, মিস্টার গুপ্ত। সব আপনার কীর্তি।’ অসমঞ্জ প্রায় চিৎকার করে উঠল, ‘সেদিন আপনি আমাকে খুন করতে চেয়েছিলেন।’

‘খুন? বলছেন কী? আপনাকে কেন খুন করতে যাব।’

‘আপনাকে ফাঁসি যেতে হবে।’ ভয়ংকর স্বরে গর্জে উঠল অসমঞ্জ।

চারিদিকে লোকজনের ভিড় বাড়তে শুরু করেছিল। এবার একজন পুলিশ অফিসার ভিড় হটিয়ে সামনে এগিয়ে এল। অসমঞ্জকে ঠেলে সামান্য সরিয়ে দিল। বলল, ‘কী হয়েছে? ঝঞ্ঝাট কীসের?’

শরণ গুপ্ত নিজের রগে আঙুলের টোকা মেরে অসমঞ্জের দিকে দেখিয়ে ইশারা করল। বলল, ‘না, না, কিছু হয়নি। আমি কোর্টে ঢুকেছি বলে এই ভদ্রলোক একটু আপত্তি করেছিলেন। তাতে আমি কার্ড দেখাই। তখন হঠাৎই উনি খেপে গিয়ে আমাকে অ্যাটাক করলেন। দয়া করে ওঁর ওপরে একটু নজর রাখবেন…।’

‘ঠিক বলেছেন…’ একজন পথচারী বলে উঠল।

‘এই লোকটা—এই লোকটা আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছে!’ অসমঞ্জ বলল।

পুলিশ অফিসার বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ল। বলল, ‘ঠিক, আছে, আমি দেখছি। কোর্টের ভেতরটা যা গরম তাতে মাথা গরম হওয়াটা তেমন আশ্চর্যের নয়…।’

‘এই লোকটাকে ছাড়বেন না।’ চিৎকার করে উঠল অসমঞ্জ, ‘এই লোকটা—শরণ গুপ্ত—এ জলের গেলাসে বিষ মিশিয়ে বহু লোককে খুন করেছে। আমি ওকে ছাড়ব না।’

পুলিশ অফিসার শরণ গুপ্তের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করল। তারপর বলল, ‘আপনি যান, আমি দেখছি—’ অসমঞ্জের কাছে এসে হাত চেপে ধরল অফিসার: ‘শুধু-শুধু কেন মাথা গরম করছেন? ওই ভদ্রলোকের নাম শরণ গুপ্ত নয়। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে—।’

‘তাই নাকি?’ খানিকটা অবাক হল অসমঞ্জ। বিভ্রান্ত হল। জানতে চাইল, ‘আসল কী নাম ভদ্রলোকের?’

‘ওসব বাদ দিন।’ হাত নেড়ে অফিসার বলল, ‘এবারে ঠান্ডা মাথায় চলুন দেখি।’

ততক্ষণে অন্য একটা ট্যাক্সি ডেকে শরণ গুপ্ত অদৃশ্য হয়ে গেছে।

চারপাশে তাকিয়ে দর্শকদের কৌতুকভরা উজ্জ্বল মুখগুলো দেখল অসমঞ্জ। তারপর বলল, ‘হ্যাঁ, আমারই একটু ভুল হয়েছে। চলুন, থানায় চলুন, সব আপনাকে খুলে বলব…।’

শিথিল পায়ে যখন অসমঞ্জ থানার বাইরে বেরিয়ে গেল, তখন পুলিশ অফিসারটি একজন সার্জেন্টের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী দাস, কী বুঝলে?’

সার্জেন্ট দাস হাসল, বলল, ‘বদ্ধ পাগল। জলের গেলাসে বিষ মিশিয়ে ঘুমের ঘোরে হার্টফেল করিয়ে মারছে। আজব কায়দা বটে!’

‘হুম—’ বলল অফিসার, ‘যাক, লোকটার নাম-ঠিকানা তো রইল—দরকার হলে আরও খোঁজখবর করা যাবে।’

সে-বছর শীতটা খুব জাঁকিয়ে বসল শহরতলির ওপর। নতুন তৈরি হওয়া অভ্যেসমতো আদালতে শুনানি দেখতে গিয়েছিল অসমঞ্জ। শীতের ছুঁচ যেন সরাসরি হাড়ে এসে বিঁধছে। পথের ওপর কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছে। আর শান্ত নদীর ওপর কুয়াশার পাহাড় মেঘের মিনারের মতো জমাট বেঁধে স্থির।

কোর্টে তেমন ভিড় হয়নি। পুরোনো আমলের মলিন ঘর। অকালসন্ধ্যার অন্ধকার এড়াতে ঘরের হলদে আলো জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। শীতের প্রকোপ রুখতে সকলেই মুড়িসুরি দিয়ে রয়েছে। একটু দূরের লোককে ঠিকমতো ঠাহর করা যাচ্ছে না। অসমঞ্জের শরীরটা ঠান্ডায় যেন কাহিল হয়ে পড়েছে। সমস্ত হাড়গুলো কনকন করছে। হয়তো এখুনি জ্বর আসবে।

অতিকষ্টে চোখ মেলে কোর্টরুমের এক কোণে একটা চেনা মুখ নজরে পড়ল অসমঞ্জের। আপনা থেকেই ওর হাত চাদরের নীচে, প্যান্টের পকেটে চলে গেল। মোটা শক্তপোক্ত একটা জিনিসের ওপর চেপে বসল হাতের আঙুল। খানিকটা ভরসা পেল ও। শরণ গুপ্তের সঙ্গে রাস্তায় সেদিন গোলমাল হওয়ার পর থেকেই এই অস্ত্রটা ও সবসময় কাছে-কাছে রাখছে। না, রিভলভার নয়—রিভলভার জোগাড় করা মুশকিল, আর অসমঞ্জ সেসব চালাতেও জানে না। তার চেয়ে এই লোহার পাইপের ছোট্ট টুকরোটা অনেক কাজের। সেটাকে ছদ্মবেশ পরানোর জন্য কাপড়ে জড়িয়ে বেশ একটা জুতসই অস্ত্র তৈরি করেছে ও। এটা এখন ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী।

বরাবরের মতোই অনিবার্য রায় শোনানো হল। দর্শকরা ভিড় করে বেরিয়ে আসতে লাগল কোর্টের বাইরে। অসমঞ্জ তাড়াহুড়ো করতে চাইল, কারণ, সেই লোকটাকে ভিড়ে হারিয়ে ফেললে চলবে না। তাই কনুই দিয়ে ভিড় ঠেলে ও এগোতে লাগল।

দরজার বাইরে বেরিয়েই ও শিকারের প্রায় নাগাল পেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু একটা মোটাসোটা লোক মাঝপথে এসে গিয়ে সব বানচাল করে দিল। অসমঞ্জ মোটা লোকটার কাঁধে ভর করে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল সামনে।

চারপাশ থেকে বিরক্তিকর অস্ফুট মন্তব্য ভেসে এল। অসমঞ্জের শিকার ঘুরে তাকাল পিছনে। রিমলেস চশমার কাচ চকচক করে উঠল পড়ন্ত আলোয়। কিন্তু অসমঞ্জকে সে চিনতে পারল না। সামনে পা ফেলে এগিয়ে গেল।

অসমঞ্জ চুপিসাড়ে লোকটাকে অনুসরণ করল। লোকটা বেশ চটপট পা ফেলে এগিয়ে চলেছে। একবারের জন্যও পিছনে তাকাচ্ছে না। কুয়াশা আরও ঘন হয়ে উঠেছে। চার-পাঁচ গজ সামনে নজর চলে না।

তৎপর শ্বাপদের মতো তাকে অনুসরণ করে চলল অসমঞ্জ। কোথায় চলেছে লোকটা? বাড়ির পথে? সামনের বড়রাস্তায় বাস ধরবে? কই, না তো। ওই তো সে বাঁক নিচ্ছে ডানদিকের সরু গলিটায়।

কুয়াশায় বলতে গেলে অন্ধ হয়ে গেল অসমঞ্জ। নিছক পায়ের শব্দ শুনে এগিয়ে যেতে লাগল ও। নিস্তব্ধ পথে শুধু দু-জোড়া পায়ের শব্দ কেমন বিচিত্র ফাঁপা প্রতিধ্বনি তুলছে। শিকার ও শিকারি। বহু খুনের বোঝা মাথায় নিয়ে ওই লোকটা এখন সমাজের শত্রু। আইন তাকে সাজা দিতে পারবে না। সুতরাং অসমঞ্জের মতো কোনও দায়িত্বশীল নাগরিককেই সেই ভার নিতে হবে। ভয়ে পিছিয়ে গেলে চলবে না।

অল্প-অল্প ঠান্ডা বাতাস এসে পরশ বুলিয়ে দিল অসমঞ্জের চোখে-মুখে। ওরা কি তা হলে নদীর দিকে এগিয়ে চলেছে?

হঠাৎই চারপাশের বাড়ি-ঘর অদৃশ্য হয়ে গিয়ে খানিকটা ফাঁকা জায়গা প্রকাশিত হয়ে পড়ল। কাছেই চোখে পড়ছে বিবর্ণ ঝাপসা একটা রাস্তার আলো। অসমঞ্জের সামনে পায়ের শব্দ থমকাল। নিঃশব্দে এগিয়ে চলা অসমঞ্জ দেখতে পেল লোকটা ঠিক আলোটার নীচেই থমকে দাঁড়িয়েছে। পকেট থেকে একটা নোটবই বের করে কী যেন খুঁটিয়ে দেখছে।

ঠিক পাঁচ পা এগোতেই লোকটার একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে পড়ল অসমঞ্জ। পকেট থেকে বের করে নিল কাপড়ে জড়ানো পাইপের টুকরোটা।

লোকটা মুখ তুলে তাকাল। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। লোহার পাইপটা সর্বশক্তিতে তার মাথায় বসিয়ে দিয়েছে অসমঞ্জ। একবার। দুবার। তিনবার।

দাঁতে দাঁত চেপে অসমঞ্জ বলল, ‘শয়তান, এবার তোকে পেয়েছি।’

অসমঞ্জর আশঙ্কাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হল। সর্দি জ্বরে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল ও। দিনসাতেক পর যখন শরীরে আবার জোর ফিরে পেল, তখন আবহাওয়ার অনেক উন্নতি হয়েছে। তাজা মিষ্টি বাতাস বসন্তের ইঙ্গিত বয়ে নিয়ে আসছে। সুতরাং দুর্বলতা পুরোপুরি না কাটলেও সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়ে পড়ল অসমঞ্জ। একটা পাক্ষিক পত্রিকা কিনে পায়ে-পায়ে গিয়ে বসল পাড়ার একটা চায়ের দোকানে। চায়ের কাপ সামনে নিয়ে পত্রিকার পাতায় চোখ বোলাতে লাগল।

হঠাৎই পাশের টেবিলের কথাবার্তার একটা টুকরো কানে এল অসমঞ্জের। ভীষণভাবে চমকে উঠল ও। যে-শব্দটা ওর কানে এসেছে সেটা ‘নাইট্রেট…’।

পাশের টেবিলের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাল। এক তরুণ ও এক প্রৌঢ়। একজনের কাঁধে ক্যামেরা ও কিটব্যাগ। অন্যজনের হাতে ভাঁজ করা একটা খবরের কাগজ। তরুণ তখন কথা বলছে।

‘…অ্যাকসিডেন্ট, সুইসাইড, মার্ডার, পিকিউলিয়ারভাবে মারা যাওয়ার কেস—এসব মিত্তিরদা যেরকম পারত, আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আমার তো দাদা বেশ অসুবিধেই হচ্ছে।’

প্রৌঢ় বলল, ‘শোনো, চক্রবর্তী, মন দিয়ে চেষ্টা করো। এত অল্পে হাল ছেড়ে দিলে রিপোর্টারদের চলে না। আরে বিজন মিত্তির ছিল বিজন মিত্তির! ওরকম দুঁদে ক্রাইম রিপোর্টার ভারতবর্ষে খুব কম জন্মেছে—।’

‘কী অদ্ভুতভাবেই না মিত্তিরদা মারা গেল। যে-লোকটা ঘুমের ঘোরে হার্টফেল করে সেদিন মারা গিয়েছিল, তার মামলার হিয়ারিং-এর পর মিত্তিরদা যাচ্ছিল লোকটার বিধবা স্ত্রীকে ইনটারভিউ করতে। এমন সময় কেউ পেছন থেকে এসে মিত্তিরদার মাথায় ডান্ডা মারে। হয়তো এ-পাড়ারই কোনও গুন্ডা-টুন্ডা পুরোনো রাগ মিটিয়েছে। পাড়াটা তো বিশেষ ভালো নয়। তা ছাড়া ক্রাইম রিপোর্টিং করতে গিয়ে মিত্তিরদা যেসব রিস্ক নিত—।’

‘মিত্তির দারুণ মজার পাবলিক ছিল। একটু আগেই তোমাকে যা বলছিলাম। ওর সেই ক্যারাসল নাইট্রেট নিয়ে নিখুঁত খুনের গপ্পো। একখানা মাস্টারপিস।’

অসমঞ্জের গোটা শরীর কেঁপে উঠল। এই ‘ক্যারাসল’ শব্দটাই এতদিন ওর সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছে। এক অদ্ভুত আচ্ছন্নভাবে ওর চোখ দুটো কেমন ঝাপসা হয়ে এল। মাথাটা যেন ভীষণভাবে দুলে উঠল।

‘…তোমার দিকে গম্ভীর চোখে তাকিয়ে নিট গপ্পোটা ফেঁদে বসবে…’ প্রৌঢ় সাংবাদিক তখনও বলে চলেছে, ‘তোমার মনেও হবে না যে, ক্যারাসল নাইট্রেট নামে আসলে কোনও বিষ নেই। পুরো কেসটাই ঢপের চপ। বেশিরভাগ সময়ে এই গল্পটা ও শোনাত ট্রেনে—ফাঁকা কামরায় কোনও লোককে একা পেলে। তার ওপর, তার হাতে যদি কোনও ক্রাইম নভেল থাকে তা হলে তো তার আর রক্ষে নেই। বিজন মিত্তিরের ক্যারাসল নাইট্রেটের গপ্পো তাকে শুনতেই হবে। আর, আশ্চর্য কী জানো, চক্রবর্তী? অনেকে ওর ওই গল্প বিশ্বাসও করে ফেলত। একবার তো একটা লোক মিত্তিরকে টাকা অফার করেছিল ওই বিষ—।’

হঠাৎই অস্ফুটে চেঁচিয়ে উঠল তরুণ সাংবাদিক। দ্বিতীয়জনও কথা থামিয়ে চমকে ঘুরে তাকাল।

কারণ, পাশের টেবিলে অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়েছে অসমঞ্জ দত্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *