যেমন তেমনি! (অর্থাৎ, চতুর পালিত পুত্রের বিদ্যা প্রকাশ!!)
প্রথম পরিচ্ছেদ
আমি যে দিবস পুলিস বিভাগে প্রথম নিযুক্ত হই, কৰ্ম্মকাৰ্য্য শিখিবার নিমিত্ত সেইদিবসেই আমাকে **** বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের নিকট প্রেরণ করা হয়। বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় একজন বহুদর্শী পুরাতন কৰ্ম্মচারী, সহরের মধ্যে তাঁহার বেশ নাম-ডাক আছে। কাজ-কর্ম্মে তাঁহার যশ যথেষ্ট হইয়াছে, ও তিনি অনেক অসাধ্যও সাধন করিয়াছেন। পুলিস বিভাগে কিরূপে কর্ম্মকার্য্য করিতে হইবে, কোন্ পন্থা অবলম্বন করিয়া অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে হইবে, সর্ব্বসাধারণের সহিত সৰ্ব্বদা কিরূপ ব্যবহার করিতে হইবে, এই সকল উপদেশ আমি তাঁহারই নিকট সৰ্ব্বপ্ৰথম প্রাপ্ত হই; এবং তাঁহারই নিকট পুলিসের কর্ম্মকার্য্য শিক্ষা করি বলিয়াই, তাঁহাকে আমি “গুরু” বলিয়া মানিয়া থাকি।
যতদিবস তিনি এই বিভাগে কর্ম্ম করিতেন, ততদিবস তিনি আমাকে শিষ্য বলিয়া স্নেহ করিতেন, এবং যখন যে স্থানে যে অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইতেন, দূরে থাকিলেও আমার সাহায্য লইবার নিমিত্ত তিনি আমাকে ডাকাইয়া লইতেন। যে অনুসন্ধানে আমি একাকী নিযুক্ত হইতাম, তাহার ভিতর যদি ঘটনাচক্রের কোনরূপ গোলযোগ বাধিত তাহা হইলে তাঁহারই সহিত পরামর্শ করিয়া সেই গোলযোগ হইতে উত্তীর্ণ হইতাম।
এখন আর তিনি পুলিস বিভাগে নাই, বহুদিবস হইল, পেন্সন লইয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিয়াছেন, এবং জীবনের অবশিষ্টাংশ সেইস্থানে বসিয়া সুখে অতিবাহিত করিতেছেন। সুতরাং পরামর্শের আবশ্যক হইলে, হঠাৎ তাঁহার সাহায্য পাইবার আর কোনরূপ সম্ভাবনা নাই।
যাহা হউক, প্রায় ১৫ বৎসর অতীত হইল, একদিবস প্রাতঃকালে ছয়টার সময় আমি থানায় বসিয়া আছি, এমন সময় বন্দ্যোপ্যাধ্যায় মহাশয়ের নিকট হইতে একখানি পত্র পাইলাম; তাহাতে লেখা ছিল :— “একটি ভয়ানক মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিবার নির্মিত নিযুক্ত হইয়াছি। মোকদ্দমার অবস্থা যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে এই অনুসন্ধান শেষ করা একজনের কর্ম্ম নহে। আশা করি, পত্র পাইবামাত্র পত্রবাহক সমভিব্যাহারে তুমি এখানে আসিবে, এবং আমায় সাহায্য করিতে প্রবৃত্ত হইবে। আমি ঘটনাস্থানে তোমার অপেক্ষা করিব। পত্রবাহক সেইস্থান চেনে, সে অনায়াসে তোমাকে ঘটনাস্থান দেখাইয়া দিতে পারিবে।”
একে সরকারী কার্য্য, তাহাতে গুরুর আদেশ, সুতরাং কালবিলম্ব না করিয়া সেই পত্রবাহক সমভিব্যাহারে থানা হইতে বহির্গত হইলাম। পথে একখানি গাড়িভাড়া করিয়া যত শীঘ্র পারি, ঘটনাস্থলে গিয়া উপস্থিত হইলাম।
কোথায় যে ঘটনাস্থল, তাহা আমি স্পষ্ট করিয়া বলিব না। কিন্তু এইমাত্র বলিব যে, বিডন স্ট্রীট হইতে সেইস্থান বহুদূর নহে, ইহাতে যে পাঠকগণ জানেন, তাঁহারা বুঝিয়া লইবেন। অপরে যদি বুঝিতে না পারেন, তাহা হইলে তাঁহারা আমাদিগকে ক্ষমা করিবেন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় আমার পূর্ব্বেই সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। তিনি আমাকে দেখিবামাত্র কহিলেন, “আসিয়াছ, ভাল হইয়াছে। পূর্ব্বে ঐ গৃহের অবস্থা স্বচক্ষে দেখিয়া আইস, তাহার পর যাহা কিছু জানিতে পারিয়াছি, তাহা তোমাকে বলিব।” এই বলিয়া সম্মুখস্থিত একটি গৃহ আমাকে দেখাইয়া দিলেন।
কলিকাতা সহরের ভিতর হইলেও, পল্লীগ্রামে যেরূপ অধিকাংশ বাড়ী দেখিতে পাওয়া যায়, ইহা সেই প্রকারের একটি পাকা বা ইষ্টকনির্ম্মিত একতলা বাড়ী। সেই বাড়ীর ভিতর একটি ভিন্ন গৃহ নাই। গৃহটি বেশ বৃহৎ, এবং পরিসর; তাহার সম্মুখে একটি বারান্দা বা দরদালান। সেই গৃহের চতুঃষ্পার্শ্বেই অনাবৃত ভূমিখণ্ড আছে, সেই ভূমিখণ্ড ইষ্টক প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত।
গৃহের দক্ষিণে প্রাচীরের গাত্রে কেবল একটিমাত্র দ্বার আছে। সেই দ্বারের দুইপার্শ্বে দুইটি জানালা, পশ্চিমদিকের প্রাচীরে কেবল একটিমাত্র দ্বার ভিন্ন আর কিছুই নাই, এবং উত্তরে তিনটি, এবং পূর্ব্বে একটি জানালা আছে, দরজা নাই। জানালাগুলি সমস্তই বিলক্ষণ পরিসর, এমনকি দ্বারের প্রায় সম আয়তনবিশিষ্ট বলিলেও হয়। উক্ত জানালাগুলি স্থূল লৌহ গরাদিয়া দ্বারা সংবদ্ধ।
গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, উহার দুইপার্শ্বে অর্থাৎ গৃহের পূর্ব্ব এবং পশ্চিম অংশে দুইখানি পালঙ্ক। একখানি বহু পুরাতন, এবং তাহার উপরিস্থিত বিছানাপত্র নিতান্ত অপরিষ্কার। অপরখানি নিতান্ত জীর্ণ নহে, এবং তদুপরি যে বিছানা আছে, তাহা পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন দুই পালঙ্কের মধ্যস্থলে যে স্থান আছে, তাহার উত্তরাংশে কয়েকটি কাষ্ঠনির্ম্মিত আমারি, সিন্ধুক, এবং বাক্স সারি সারি সাজান আছে। সেই সকল আমারি প্রভৃতির পূর্ব্ব দিকে, অথচ সেই বহু পুরাতন পালঙ্কের নিকট লোহার একটি সিন্ধুক আছে। আরও দেখিলাম, কাষ্ঠনির্ম্মিত আলমারি প্রভৃতি সমস্তই ভগ্নাবস্থায় রহিয়াছে, এবং তাহার মধ্যস্থিত দ্রব্যাদি সেই গৃহের ভিতর ছড়ান আছে। লোহার সিন্ধুক ভাঙ্গা নহে—খোলা; কিন্তু তাহার চাবি সেই স্থানে দেখিতে পাওয়া যাইতেছে না। উহার ভিতরেও যে সকল দ্রব্যাদি ছিল, তাহার অধিকাংশই মেজের উপর গড়াগড়ি যাইতেছে। সিন্ধুকের ভিতরস্থিত কাপড়ের কতক অংশ সিন্ধুকের ভিতর রহিয়াছে, কতক বাহিরে রহিয়াছে; সেই কাপড় রাশির উপর একটি ক্লক ঘড়ী পড়িয়া রহিয়াছে, ক্লকটি দেখিয়া বোধ হয়, উহা বহু পুরাতন নহে, উহার বার্নিস এখনও নষ্ট হইয়া যায় নাই। ক্লকটি কিন্তু চলিতেছে না, বন্ধ আছে। দেখিয়া বোধ হয়, চলিতে চলিতে হঠাৎ পড়িয়া যাওয়ায় বন্ধ হইয়া গিয়াছে।
জানালাগুলি উত্তমরূপে দেখিলাম, কিন্তু তাহার ভিতর দিয়া লোক-যাতায়াতের কোনরূপ চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না। পশ্চিমদিগের দ্বারের অর্গল অস্ত্র-ব্যবহারে উন্মুক্ত করা হইয়াছে বোধ হইল; কিন্তু সম্মুখ দরজার কোনস্থানে কোনরূপ চিহ্ন লক্ষিত হইল না।
যখন আমি গৃহের ভিতর প্রবেশ করি, সেই সময় গৃহের সম্মুখে দালানের উপর জনৈক প্রহরীর পাহারা ছিল। গৃহের অবস্থা দেখিয়া যখন আমি বহির্গত হইতেছিলাম, সেই সময়ে সেই প্রহরী আমার সম্মুখে আসিয়া আমার হস্তে দুইখানি নূতন সাদা রুমাল, এবং একটি ছোট শিশি প্রদান করিয়া কহিল, “এই তিনটি দ্রব্যও সেই গৃহের ভিতর পাওয়া যায়, এখন আমার জিম্মায় রহিয়াছে।” আরও কহিল, “এই শিশিটি এবং একখানি রুমাল ছিল, ছিল, পরিষ্কার বিছানার উপর, এবং এই রুমালখানি— সেই অপরিষ্কার বিছানার উপর।”
রুমাল দুইখানি হস্তে লইয়া উত্তমরূপে দেখিলাম। দেখিলাম, দুইখানিই সম্পূর্ণ নূতন, কোনস্থানে কোনরূপ চিহ্ন নাই। কিন্তু উহা হইতে এখনও এক প্রকার বিকট দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে, সেই গন্ধ আমার নাসিকার ভিতর প্রবিষ্ট হইবামাত্র আমার মস্তক ঘুরিয়া উঠিল। আমি তখনই উহা প্রহরীর হস্তে প্রদান করিয়া কহিলাম, “দূরে ইহাদিগকে এখন রাখিয়া দেও।” প্রহরী তাহাই করিল।
শিশিটি পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম, উহার ভিতর এখনও এক প্রকার তরল পদার্থের অতি সামান্য অবশেষ রহিয়াছে। ছাপান অক্ষরে উহার গাত্রে ইংরাজী অক্ষরে লেখা আছে “ক্লোরাফরম।” কিন্তু উহা যে কোন ডাক্তারখানা হইতে আনীত, বা কাহার নিমিত্ত বিক্রীত হইয়াছে, তাহার কিছুমাত্র লেখা নাই। শিশিটি না খুলিয়া উহা যেরূপ অবস্থায় ছিল, সেইরূপ অবস্থাতেই সেই প্রহরীর হস্তে প্রদান করিয়া আমি গৃহের বাহিরে আসিলাম। পরিশেষে বাড়ীর চতুর্দ্দিক একবার উত্তমরূপে দেখিলাম, কোনস্থানে সন্দেহ সূচক কোন দ্রব্যই দেখিতে পাইলাম না। বিশেষ মনঃসংযোগ করিয়া সেই বাটীর চতুৰ্দ্দিকে বেষ্টিত সেই ইষ্টক নির্ম্মিত প্রাচীরের উপরিভাগ ক্রমে ক্রমে সমস্তই দেখিলাম, কিন্তু কোনস্থানে কোন লোকের পদচিহ্ন বা অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয় অপর কিছুই দেখিতে পাইলাম না। বাড়ীর প্রাঙ্গণের কোনস্থানই উত্তমরূপে দেখিতে বাকী রাখিলাম না। কিন্তু সে দেখায় কোন ফলই পাইলাম না; এমন কোন বিষয়ই চক্ষুতে পড়িল না যে, এই অনুসন্ধান উপলক্ষে অভাবপক্ষে সেইদিকে একবার দৃষ্টিনিক্ষেপ করি। যাহা হউক, এইরূপে সমস্ত স্থান দেখিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের নিকট গিয়া উপবেশন করিলাম।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
উক্ত বাটীর প্রাঙ্গণের মধ্যে একস্থানে বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বসিয়াছিলেন, সেইস্থানে আরও কয়েকজন ইংরাজ এবং দেশীয় কৰ্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন। বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় আমাকে তাঁহার নিকট বসিতে কহিলেন, আমি সেইস্থানে উপবেশন করিলে, তিনি কহিতে লাগিলেন :—
“অদ্য প্রত্যূষে ৫টার সময় আমি সংবাদ পাই যে, এই বাড়ীর একটি স্ত্রীলোক, এবং একটি পুরুষ অচৈতন্য অবস্থায় তাহাদিগের গৃহের ভিতর পড়িয়া রহিয়াছে, ও তাহাদিগের গৃহস্থিত সিন্ধুক বাক্স প্রভৃতি সমস্ত দ্রব্যই ভগ্নাবস্থায় আছে। এই সংবাদ পাইয়া আমি আর কালবিলম্ব করিতে পারিলাম না, দ্রুতপদে ঘটনাস্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, বাড়ীর সদর দরজা খোলা। গৃহের দরজা দুইটিই খোলা, জিনিসপত্র এখন যেরূপ অবস্থায় দেখিলে, সেইরূপ অবস্থাতেই পড়িয়া আছে। গৃহের ভিতর যে দুইখানি পালঙ্ক দেখিয়াছ, তাহার একখানিতে একটি প্রবীণা স্ত্রীলোক, অপরখানিতে একটি অষ্টাদশ বৎসর বয়স্ক যুবক অচৈতন্য অবস্থায় পড়িয়া আছে। যুবকের নিকট ক্লোরাফরমের একটি শিশি পাইলাম। আরও দেখিলাম, দুইজনের মস্তকের নিকট দুইখানি সাদা রুমাল রহিয়াছে, বুঝিলাম, উহাতেও ক্লোরাফরম মিশ্রিত। এই সকল অবস্থা দেখিয়া কালবিলম্ব না করিয়া প্রথমেই, উহাদিগকে মেডিকেল কলেজে পাঠাইয়া দিলাম। তাহারা এখনও মরে নাই, সেইস্থানে চিকিৎসাধীনে আছে, কিন্তু এখন জ্ঞানশূন্য। সুতরাং তাহাদিগের নিকট হইতে এখন কোন কথা জানিবার উপায় নাই। উহাদিগকে হাসপাতালে পাঠাইয়া পরিশেষে অনুসন্ধানে এইমাত্র জানিতে পারিলাম, যে, উহাদিগের একটি পরিচারিকা আছে, তাহার নাম যাহাই হউক, হরর মা বলিয়া সে সকলের নিকট পরিচিত। সে এই বাড়ীতে থাকে না, তাহার পৃথক্ বাসা আছে, সকাল-বৈকাল দুইবেলা আসিয়া আবশ্যক কার্য্য সমাপন করিয়া যায়। কল্য সন্ধ্যার পর যখন সে আপনার কার্য্য সমাপন করিয়া গমন করিয়াছিল, তখন বৃদ্ধা তাহার গৃহের সম্মুখে দালানে বসিয়াছিল, যুবক সেই সময়ে বাড়ীতে ছিল না। অদ্য প্রাতঃকালে যখন সে আপনার কার্য্যে আগমন করে, তখন সে প্রথমেই দেখিতে পায়, বাড়ীর সদর দরজা খোলা, গৃহের দরজা খোলা, দ্রব্যাদির অবস্থা এইরূপ এবং বৃদ্ধা ও যুবক অচৈতন্য অবস্থায় আপন-আপন বিছানার উপর পড়িয়া আছে। এই অবস্থা দেখিয়া সে গোলযোগ করিয়া উঠে, তাহাতে দুই একজন করিয়া পাড়ার অনেকেই আসিয়া উপস্থিত হয়। তৎপরে পাড়ার লোকের উপদেশ অনুযায়ী হরর মা থানায় গিয়া এই সংবাদ প্রদান করে। সংবাদ প্রাপ্তিমাত্র প্রথমেই আমি আগমন করি, এবং যাহা স্বচক্ষে দর্শন করি, তাহা পূর্ব্বেই তোমাকে বলিয়াছি।
“হরর মা এবং পাড়ার অপরাপর লোকদিগের নিকট হইতে আরও অবগত হইতে পারিয়াছি, সেই বৃদ্ধার নাম ভব। সে গোপাল বোসের বিধবা স্ত্রী। গোপাল বোস এই স্থানের একজন পুরাতন অধিবাসী ছিলেন; হাটখোলায় তাঁহার একখানি “ভূষিমালের” দোকান ছিল। তিনি যতদিবস জীবীত ছিলেন, সেই দোকানের উপস্বত্ব হইতেই স্বচ্ছন্দে দিনপাত করিতেন। পরিবারের মধ্যে তাঁহার স্ত্রী এই ভব ভিন্ন অপর আর কেহই ছিল না। এরূপ শুনা যায়, তিনি তাঁহার মৃত্যুকালে ভবর পরিধেয় অলঙ্কার প্রভৃতি ব্যতিরেকে নগদ অর্থও অনেক রাখিয়া গিয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর হইতেই সেই দোকান উঠিয়া যায়, কিন্তু সঞ্চিত অর্থ হইতেই ভব এতদিবস বিনাক্লেশে দিনযাপন করিয়া আসিতেছেন। হিন্দু বিধবার সতত আচরণীয় ব্রতনিয়ম প্রভৃতি সেই অর্থের দ্বারাই তিনি এ কাল পর্য্যন্ত সমাপন করিয়া আসিতেছিলেন। আমার বোধ হয়, সোণা ও রূপার অলঙ্কার প্রভৃতি বন্ধক রাখিয়া সুদ প্রভৃতিতে যে অর্থ তিনি প্রাপ্ত হইতেন, তাহার কিয়দংশের দ্বারাই তাঁহার বর্তমান সংসার খরচ নির্ব্বাহ হইত, অধিকন্তু মাস মাস কিছু জমাও হইত। বৃদ্ধার বয়ঃক্রম ক্রমে অধিক হইয়া আসিতেছে, তাঁহার বয়ঃক্রম এখন বোধ হয়, ৫৫ বৎসরের কম হইবে না।
“যুবকের নাম রসিকলাল ঘোষ তাহার বয়ঃক্রম এখন অষ্টাদশ বৎসরের কম হইবে বলিয়া বোধ হয় না। রসিকলাল যে কে, কাহার পুত্র, তাহা পাড়ার অপর কেহই বলিতে পারেন না। কিন্তু বৃদ্ধা যে নিশ্চয়ই বলিতে পারেন, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। রসিকলালকে উত্তমরূপে না জানিলেও, পাড়ার কেহই কিন্তু তাহার বিপক্ষে কোন কথা বলেন না, বরং সকলেই কহেন, রসিক বড় ভাল ছোকরা, তাহার স্বভাব চরিত্র উত্তম। প্রায় দশ বৎসর পূর্ব্বে যখন রসিকের বয়ঃক্রম আট বৎসর ছিল, সেই সময় হইতে সকলেই রসিককে এইস্থানে দেখিতে পাইতেছেন। বৃদ্ধাই তাহাকে লালন-পালন করিয়া এত বড়টি করিয়াছে, লেখাপড়া শিখাইবার নিমিত্ত বৃদ্ধা বিশেষ যত্নও করিয়াছিল। কিন্তু সে ভালরূপ লেখাপড়া শিখিয়া উঠিতে পারে নাই, বৃদ্ধার আর কেহই নাই। বিশেষ সে রসিককে প্রাণের সহিত ভালবাসে, একদণ্ডের নিমিত্তও কোনরূপে তাহাকে চক্ষুর অন্তরাল করিতে চাহে না। তাহার ইচ্ছা সে যতদিবস বাঁচিবে, এইরূপেই তাহাকে প্রতিপালন করিবে। মৃত্যুকালে তাহার যাহা কিছু আছে, সমস্তই রসিকের হস্তে অর্পণ করিয়া যাইবে। যাঁহারা জানেন না, তাঁহাদিগের মধ্যে কেহই বলিতে পারে না, যে রসিক তাহার পুত্র নহে। মাতা-পুত্রকে যেরূপভাবে সৰ্ব্বদা দেখিয়া থাকেন, বৃদ্ধাও সেইরূপে রসিককে স্নেহচক্ষে দেখেন। রসিকের আহার না হইলে, বৃদ্ধার আহার হয় না, রসিক শয়ন না করিলে, বৃদ্ধার নিদ্রা আসে না। যদি রসিক কোনদিবস অসুস্থ হয়, তাহা হইলে বৃদ্ধা যে কিরূপ কষ্ট অনুভব করিয়া থাকেন, তাহা যিনি দেখিয়াছেন, তিনিই বুঝিতে পারেন। সম্প্রতি রসিকের বিবাহ দিবার নিমিত্ত বৃদ্ধা একেবারে ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন, একটি সুপাত্রীর অনুসন্ধানের নিমিত্ত তিনি যে কত লোকের তোষামোদ করিতেছেন, তাহা কে বলিবে?
“যে দুইজন এখন অচৈতন্য অবস্থায় হাসপাতালে পড়িয়া আছেন, তাহাদিগের অবস্থা ত এই। এই দুইজন ব্যতীত বাড়ীতে অপর কেহই থাকেন না, অপর লোকের মধ্যে হরর মা। সে রাত্রিদিন যদিও এই বাড়ীতে থাকে না, তথাপি সে অনেকদিবস পর্য্যন্ত এই বাড়ীতে কর্ম্ম করিতেছে। তাহার চরিত্র সম্বন্ধে কোন দোষের বিষয় এ পর্য্যন্ত কেহই বলিতে পারেন না।
“গৃহের অবস্থা দেখিয়া বিলক্ষণ বোধ হইতেছে, বৃদ্ধার যাহা কিছু সংস্থান ছিল, তাহার সমস্তই অপহৃত হইয়া গিয়াছে। কিন্তু তাহার কি ছিল, তাহার মধ্যে কি আছে এবং কোন্ কোন্ দ্রব্যই যে অপহৃত হইয়াছে, তাহা যে পৰ্য্যন্ত বৃদ্ধা অচৈতন্য অবস্থায় থাকে, সেই পর্য্যন্ত স্থির হইতে পারে না। কিন্তু এরূপ বিষ প্রয়োগের উদ্দেশ্য যে চুরি তাহাতে আর কিছুমাত্র ভ্রম নাই।”
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের কথা শুনিয়া স্থির-অন্তঃকরণে কিছুক্ষণ আমি সেইস্থানে বসিয়া রহিলাম। পরিশেষে তাঁহাকে কহিলাম, “বৃদ্ধার গৃহ হইতে অনেক টাকার দ্রব্যাদি যে অপহৃত হইয়াছে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু এই দুরূহকার্য্য কাহার দ্বারা সম্পন্ন হইল? বৃদ্ধা এখন অচৈতন্য অবস্থায় হাসপাতালে আছে, তাহা ত দেখিতে পাইতেছি। আবার ইহাও বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে, তিনি ব্যতীত অপহৃত দ্রব্যের তালিকা প্রদানে আর কেহই সমর্থ নহেন। কিন্তু যখন আপনি প্রথম এখানে আগমন করেন, সেই সময়ে যদি তাঁহাকে মৃতাবস্থায় প্রাপ্ত হইতেন, বা ঈশ্বর না করুন, এখনও যদি এইরূপ অচৈতন্য অবস্থায় তিনি ইহজীবন পরিত্যাগ করেন, তাহা হইলে কি আমাদের অনুসন্ধান বন্ধ করিতে হইবে?
আমার কথা শুনিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় কহিলেন, “ অনুসন্ধান বন্ধ হইতে পারে না, তুমি যাহা কহিতেছ, তাহা যথার্থ। বৃদ্ধা মরিয়া গিয়াছে, এই বিবেচনা করিয়াই, এখন আমাদিগের অনুসন্ধান করা কর্ত্তব্য। দেখ দেখি, হরর মা, পাড়া প্রতিবেশী প্রভৃতি লোকদিগের নিকট হইতে বৃদ্ধার অপহৃত দ্রব্যাদির কতদূর তালিকা প্রস্তুত করিতে পার।”
বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের কথা শুনিয়া সেইস্থানে অপরাপর যে সকল কর্ম্মচারী ছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে একজন ইংরাজ কৰ্ম্মচারী কহিলেন, “কি কি দ্রব্য চুরি হইয়াছে, তাহার তালিকা প্রস্তুত হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। কিন্তু চোর কি প্রকারে বাড়ীর ভিতর আগমন করিল, কিরূপে গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল, এবং কোন্ সময়েই বা এই ভয়ানক কাণ্ড সম্পাদন করিয়া প্রস্থান করিল, আমার বিবেচনায় তাহাও অগ্রে স্থির করা কর্ত্তব্য।”
বন্দ্যোপাধ্যায়। অবশ্য সে সকল বিষয় স্থির করিবার উপায় কিছুমাত্র নাই, অবস্থা দেখিয়া অনুমানে যতদূর স্থির হইতে পরে। আপনার বিবেচনায় চোর কিরূপে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল?
ইংরাজ-কৰ্ম্মচারী। সদর দরজার অবস্থা দেখিয়া এমন কিছুই বুঝিতে পারা যায় না, যাহাতে অনুমান করা যাইতে পারে, সেই দরজা ভাঙ্গিয়া বা বাহির হইতে কোনরূপে দরজা খুলিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়াছে। আমার বোধ হয়, প্রাচীর উল্লঙ্ঘন করিয়া প্রবেশ করিয়া থাকিবে।
আমি। সমস্ত প্রাচীর আমি উত্তমরূপে দেখিয়াছি; কিন্তু উহার কোনস্থানে কোনরূপ চিহ্ন নাই, যাহা দেখিলে অনুমান করা যাইতে পারে যে, অপহরণকারী সেইস্থান দিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়াছে।
বন্দ্যোপাধ্যায়। হয় ত হইতে পারে, বাহির হইতে দরজা ভাঙ্গিয়া বা খুলিয়া কেহই ভিতরে আইসে নাই। অথবা প্রাচীর উল্লঙ্ঘন করিয়াও কেহ বাড়ীর ভিতর প্রবিষ্ট হয় নাই, কোন ব্যক্তি ভিতর হইতে দরজা খুলিয়া দিয়া থাকিবে। নিয়মিত সময়ে সদর দরজা বন্ধ হইবার অগ্রে কোন ব্যক্তি অনায়াসেই বাড়ীর ভিতর কোন না কোন স্থানে লুক্কায়িত থাকিতে পারে। অথবা দৈবক্রমে সদর দরজা বন্ধ করিতে ভুলিয়া গিয়া থাকিবে। অথবা এরূপ কোন অবস্থা ঘটিয়াছিল, যাহা এখন আমরা অনুমান করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। কিন্তু কত রাত্রিতে এই ঘটনা ঘটিয়াছে বলিয়া বোধ হয়?
ইংরাজ-কর্ম্মচারী। আমার বোধ হয়, রাত্রি বারটা কি একটার সময়।
আমি। আমার বিবেচনায় ভোর চারিটা হইতে পাঁচটার মধ্যে।
বন্দ্যোপাধ্যায়। রাত্রি সাড়ে দশটার সময় এই ঘটনা ঘটিয়াছে। আপনারা এরূপ বিভিন্ন বিভিন্ন সময়ের অনুমান কিরূপে করিতেছেন?
ইংরাজ-কর্ম্মচারী। আমার অনুমান করিবার বিশেষ কোন কারণ নাই। কিন্তু এতদ্দেশীয় মনুষ্যগণের রীতি-নীতি একাল পৰ্য্যন্ত আমি যতদূর শিক্ষা করিয়াছি, তাহাতে আমার বিশ্বাস এরূপ ঘটনা বারটা কি একটার সময়ে হওয়াই সম্ভাব কারণ এতদ্দেশীয় লোকদিগের আহার ও শয়ন করিতে প্রায় রাত্রি ১০/১১ টা অতিবাহিত হইয়া যায়। তাহার পর প্রথমে যেরূপভাবে নিদ্রা আসিয়া উপস্থিত হয়, সেরূপ গাঢ়নিদ্রায় শেষ রাত্রিতে অনেকেই অভিভূত থাকেন না। অতি সামান্য শব্দে শেষ রাত্রির নিদ্রা ভাঙ্গিয়া যায়, কিন্তু প্রথম নিদ্রা সহজে ভঙ্গ হয় না। প্রগাঢ় নিদ্রায় যে সময়ে সকলে অচেতন থাকে, দস্যুতস্করের পক্ষে সেই সময় বড় সুবিধাজনক। একাল পৰ্য্যন্ত আমি যত সিঁদচুরি প্রভৃতির অনুসন্ধান করিয়াছি, তাহার অধিকাংশ স্থানেই আমি দেখিতে পাইয়াছি, সেই সময়কেই চোরেরা প্রশস্ত মনে করিয়াছে।
বন্দ্যোপাধ্যায়। আপনি যে অনুমান করিয়াছেন, তাহা নিতান্ত অযুক্তি-সঙ্গত নহে। বর্তমান স্থলে যদি আমি বিশেষরূপ জানিতে না পারিতাম, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আমি আপনার মতের অনুমোদন করিতাম। কিন্তু ইহা প্রাতে ৪/৫টার সময় হইয়াছে, একথা আমি কোন রূপেই বলিতাম না।
ইংরাজ-কর্ম্মচারী। এরূপ বিশেষ অবস্থা আপনি কি জানিতে পারিয়াছেন যে, আপনি একেবারে স্থির-নিশ্চয় করিতেছেন, এই ঘটনা রাত্রি দশটা বাজিয়া ত্রিশ মিনিটের সময় ঘটিয়াছে? মিনিটের পর যে কয়েক সেকেণ্ড হইয়াছিল, তাহাও বোধ হয়, আপনি বলিতে পারেন?
বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন পারিব না, তাহাও বোধ হয় পারি। আপনার ন্যায় স্থূলদৃষ্টিতে অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলে, একথা বলা সহজ নহে স্বীকার করি। কিন্তু যদি আপনার সূক্ষ্মদৃষ্টি থাকিত, গৃহের সমস্ত অবস্থা যদি আপনি বিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখিতেন, তাহা হইলে আপনাকে নিশ্চয়ই আমার মতে মত দিতে হইত।
ইংরাজ কৰ্ম্মচারী। আপনি এত রাগ করিতেছেন কেন? ভাল, বুঝাইয়া দিউন না, বুঝিতে পারিলে আমি কোন কথা বলিব না, চুপ করিয়া আপনার কথাই মানিয়া লইব।
বন্দ্যোপাধ্যায়। (আমাকে লক্ষ্য করিয়া) কি হে! তুমি ত অনেকক্ষণ পৰ্যন্ত গৃহের অবস্থা উত্তমরূপে দৃষ্টি করিয়াছ। তবে তুমিই বা কি প্রকারে বলিতেছ, প্রাতঃকাল চারি বা পাঁচটার সময় এই ঘটনা ঘটিয়াছে?
আমি। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা আমি সম্পূর্ণরূপে বুঝিতে পারিয়াছি, কিন্তু একই বস্তু দেখিয়া ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতিবিশিষ্ট লোকের ভিন্ন ভিন্ন অনুমান আসিয়া উপস্থিত হয়। আপনি ইংরাজ কৰ্ম্মচারীকে যাহা বলিতে চাহেন, তাহা বলিতে পারেন। আপনার কথা শুনিয়া যদি আমার মতের পরিবর্তন হয়, ভালই, নচেৎ আমার অনুমানের কারণ পরিশেষে আপনাকে কহিব।
বন্দ্যোপাধ্যায়। (ইংরাজ কৰ্ম্মচারীর প্রতি) আপনি গৃহের ভিতরের অবস্থা উত্তমরূপে দেখিয়াছেন ত?
ইংরাজ-কর্ম্মচারী। দেখিয়াছি।
বন্দ্যোপাধ্যায়। গৃহের ভিতর একটি ক্লকঘড়ী আছে দেখিয়াছেন?
ইংরাজ কর্ম্মচারী। দেখিয়াছি, কতকগুলি কাপড়ের উপর উহা পড়িয়া রহিয়াছে।
বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই ঘড়ী দেখিয়া আপনার কি অনুমান হয়, উহা কি নিতান্ত পুরাতন?
ইংরাজ-কর্ম্মচারী। নিতান্ত পুরাতন বলিয়া বোধ হয় না, তবে একেবারে নূতনও নহে।
বন্দ্যোপাধ্যায়। যেরূপ অবস্থায় এখন ঘড়িটি পড়িয়া আছে, তাহাতে উহা চলিতেছে বলিয়া বোধ হয়?
ইংরাজ-কর্ম্মচারী। না, বন্ধ হইয়া আছে।
বন্দ্যোপাধ্যায়। আমার বোধ হয়, সেইস্থানের কোন বাক্স বা সিন্ধুকের উপর সেই ঘড়ীটি রাখা ছিল। দশগুণ অসাবধানতার সহিত বাক্স, পেট্রা প্রভৃতি খুলিবার সময় সেই ঘড়ীটি পড়িয়া গিয়াছে, এবং যে অবস্থায় পড়িয়াছে সেই অবস্থায় বন্ধ হইয়া আছে। কি বলেন, একথা আপনি স্বীকার করেন কি না?
ইংরাজ-কর্ম্মচারী। আপনার একথা আমি মানি। আমারও বিশ্বাস, ঘড়ীটি পড়িয়াই বন্ধ হইয়া গিয়াছে।
বন্দ্যোপাধ্যায়। যদি আমার একথা আপনার মনের সহিত মিলিয়া যায়, তাহা হইলে এখন পুনরায় গমন করিয়া দেখিয়া আসুন—কত বাজিয়া সেই ঘড়ী বন্ধ হইয়া আছে। যে সময়ে উহা পড়িয়া গিয়াছে, সেই সময়েই যে উহা বন্ধ হইয়াছে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। আর যে সময়ে উহা পড়িয়া গিয়াছে, সেই সময়ে যে দস্যুগণ গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল, তাহারও কোন সংশয় নাই। আমি যখন প্রথমে গৃহের ভিতর প্রবেশ করি, সেই সময়েই ঘড়ীর এইরূপ অবস্থা দেখিয়া, সেইস্থানেই আমি উহাকে সোজা করিয়া বসাই, এবং চালাইয়া দেখি। প্রায় এক মিনিট কাল সেই ঘড়ী চলিলে যেরূপ অবস্থায় পড়িয়াছিল, সেইরূপ অবস্থায় পুনরায় আমি ইহা রাখিয়া দেই। এখন সেই ঘড়ী দেখিলেই আপনি বেশ বুঝিতে পারিবেন, দশটা বাজিয়া প্রায় একত্রিশ মিনিট হইয়া বন্ধ হইয়া আছে। এখন আপনি বুঝিতে পারিলেন, আমি কি প্রকারে অনুমান করিলাম যে, রাত্রি সাড়ে দশটার সময় এই ঘটনা ঘটিয়াছে? ইংরাজ কৰ্ম্মচারী। বুঝিয়াছি; আমার অনুমানে ভ্রম হইয়াছে। আরও বুঝিয়াছি, আপনি ঠিক অনুমান করিতে সমর্থ হইয়াছেন। আপনার যদি এতদূর সূক্ষ্মদৃষ্টি না থাকিবে, তাহা হইলেই বা আপনার নাম এতদুর প্রচারিত হইবে কেন?
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের কথা শুনিয়া আমি কোন কথাই কহিলাম, না, চুপ করিয়া সেইস্থানে বসিয়া রহিলাম। আমার এইরূপ অবস্থা দেখিয়া তিনি কহিলেন, “তুমি এ সম্বন্ধে কোন কথা বলিতেছে না কেন? আমার অনুমান প্রকৃত বলিয়া কি তোমার ধারণা হইতেছে না?”
আমি। না মহাশয়! আমি আপনার মতের অনুমোদন করিতে পারিতেছি না। যে সকল সিন্ধুক, বাক্স, ভগ্নাবস্থায় এখনও গৃহের ভিতর রহিয়াছে, তাহারা গৃহের উত্তর অংশে দেওয়ালের কোলে যে সারি সারি সাজান ছিল, তাহাতে কি কোন সন্দেহ আছে?
বন্দ্যোপাধ্যায়। না তাহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।
আমি। যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে উহাদিগের প্রত্যেকের খুলিবার মুখ অর্থাৎ সম্মুখভাগ কোনদিকে থাকা সম্ভব বলিয়া বোধ হয়?
বন্দ্যোপাধ্যায়। মেজের দিকে বা দক্ষিণ মুখ করিয়া রাখাই সম্ভব, যে মুখে এখন রাখা আছে।
আমি। উহাদিগের মধ্যে যদি কোনটার উপর এই ঘড়ী স্থাপিত থাকিত, তাহা হইলে তাহার সম্মুখভাগই বা কোনদিকে থাকা উচিত?
বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্মুখে, অর্থাৎ যে দিকে সিন্ধুক বাক্সের সম্মুখ, ঘড়ীর সম্মুখও সেইদিকে থাকিবে।
আমি। সম্মুখ হইতে যদি সিন্ধুক বা বাক্সের ডালা খোলা যায়, তাহা হইলে তাহার উপরিস্থিত ঘড়ি উপুড় হইয়া সম্মুখে, না চিৎ হইয়া পশ্চাতে, পড়ার অধিক সম্ভাবনা?
বন্দ্যোপাধ্যায়। সেরূপ অবস্থায় বাক্স প্রভৃতির পশ্চাদ্দিকে পড়ারই সম্ভাবনা অধিক। কিন্তু যদি কেহ সেই সিন্ধুক বা বাক্স ভাঙ্গিবার পূৰ্ব্বে সেই ঘড়ী হাতে উঠাইয়া সম্মুখে ফেলিয়া দেয়। তাহা হইলে বৰ্ত্তমান অবস্থায় কি উহা পড়িতে পারে না?
আমি। তাহা পারে, কিন্তু এরূপে হইলে আপনি যেরূপ বলিতেছেন, সেরূপ হইতে পারে না; অর্থাৎ সিন্ধুকবাক্স ভাঙ্গিবার সময় আপনা হইতেই উহা সম্মুখদিকে কোনরূপেই পড়িতে পারে না। যাহা হউক, মিথ্যা বাক্বিতণ্ডা করিয়া সময় নষ্ট করা অপেক্ষা আমি যাহা বুঝিয়াছি তাহা এখন আপনাদিগের নিকট বলা কর্তব্য। ঘড়ীর যেরূপ অবস্থা আপনি বর্ণন করিলেন, সেইরূপ অবস্থা আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি, এবং আপনারই মত আমরাও প্রথম অনুমান হইয়াছিল, এই ঘটনা রাত্রি সাড়ে দশটার সময় সম্পন্ন হইয়াছে। কিন্তু পরিশেষে দেখিলাম, আমার সেই অনুমান ঠিক নহে। কেন ঠিক নহে, তাহাও এখন আমি আপনাদিগকে বলিব না, অৰ্দ্ধঘণ্টা পরে সমস্ত বলিব। এখন আপনারা এক কৰ্ম্ম করুন, যে ঘড়ীটি লইয়া আমাদিগের মধ্যে এত গণ্ডগোল উপস্থিত হইয়াছে, সেই ঘড়ীটি বাহিরে আনিয়া একস্থানে স্থাপন করুন ও চালাইয়া দিউন। অর্দ্ধঘণ্টা চলিবার পর অর্থাৎ এখন ঘড়ীর সাড়ে দশটার দাগে কাঁটা রহিয়াছে দেখা যাইতেছে, সেই কাঁটা যখন ঘুরিয়া এগারটার উপর আসিবে, এবং ঠং ঠং করিয়া এগারটা বাজিয়া যাইবে, তখন আমার মনের কথা আপনাদিগের নিকট প্রকাশ করিব। সেই সময় বলিলে সকলে যেমন সহজে বুঝিতে পারিবেন, এখন তত সহজে কেহই বুঝিতে পারিবেন না। কিন্তু আমার এক নিবেদন—এই ঘড়ীর কাঁটার উপর আপনারা বিশেষ দৃষ্টি রাখিবেন! এগারটার ঘরে কাঁটা আসিলে সেই সময়ে ঠিক এগারটা বাজে, কি অপর কিছু বাজে, তাহা আপনারা বিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিবেন। ইত্যবসরে আমি মালের তালিকা যতদূর পারি, প্রস্তুত করিবার চেষ্টা দেখি।
বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় আমাকে উত্তমরূপে জানিতেন, সুতরাং আমার কথা শুনিয়া তিনি তৎক্ষণাৎ আবরণ প্রস্তাবিত কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইলেন। গৃহ হইতে সেই ঘড়ী আনাইয়া তাঁহার নিজের সম্মুখে স্থাপিত করিলেন, চালাইয়া দিলে টক্ টক্ করিয়া ঘড়ী চলিতে লাগিল।
আমিও অপহৃত দ্রব্যের যতদূর তালিকা প্রস্তুত করিতে পারি, তাহা করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। হরর মা, এবং প্রতিবেশীবর্গকে জিজ্ঞাসা করিয়া একটি তালিকা আরম্ভ করিলাম। যিনি যে সকল দ্রব্য পূর্ব্বে বৃদ্ধার গৃহে দেখিয়াছিলেন, তিনি তাহাই বলিয়া দিতে লাগিলেন। ক্রমে অৰ্দ্ধঘণ্টা অতীত হইয়া গেল।
অর্দ্ধঘণ্টা পরে বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় আমাকে ডাকাইলেন এবং কহিলেন, “এখন দেখিতেছি, তোমার অনুমান সত্য। কিন্তু তুমি যে বলিয়াছিলে, চারিটা হইতে পাঁচটার ভিতর এই ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহা নহে। পাঁচটা হইতে ছয়টার মধ্যে এই ঘটনা ঘটিয়া থাকিবে।”
ইংরাজ কর্ম্মচারী। আপনাদিগের কথা ত আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। এই বুঝিলাম, সাড়ে দশটার সময় এই ঘটনা ঘটিয়াছে। আবার বলিতেছেন, পাঁচটা হইতে ছয়টার মধ্যে এই ঘটনা সম্পাদিত হইয়াছে, ইহার কোন কথা আমি বিশ্বাস করি?
বন্দ্যোপাধ্যায়। পূর্ব্বে আমি যেরূপ বুঝিয়াছিলাম আপনাকে সেইরূপই বুঝাইয়াছিলাম। এখন আবার যেরূপ বুঝিতেছি, সেইরূপই আপনাকে বলিতেছি। ঘড়ীর কাঁটা উল্টাদিকে ঘুরাইয়া দিলে, অর্থাৎ ঘড়ীর বড় কাঁটাটা ধরিয়া নীচু হইতে উপরদিকে দিয়া দক্ষিণ হইতে বামভাগে পাঁচ ছয়বার ঘুরাইয়া দিলে সহজেই লোকের চক্ষুতে ধূলি প্রদান করা যাইতে পারে, অথচ পূৰ্ব্বে যে কয়েক ঘণ্টা বাজিয়া গিয়াছে, তাহার কিছুমাত্র ব্যতিক্রম হয় না। এখন আমার বোধ হইতেছে, অনুসন্ধানকারীগণকে প্রতারিত করিবার মানসে অপরাধকারী সেই উপায় অবলম্বন করিয়াছে, পলাইবার সময় ঘড়ীর কাঁটাকে উল্টা করিয়া ঘুরাইয়া সাড়ে দশটার চিহ্নের উপর রাখিয়া গিয়াছে। ইহা নিতান্ত সামান্য চোরের কৰ্ম্ম নহে। কিন্তু তুমি ইহা বুঝিতে পারিলে কিরূপে?
আমি। আপনি যেরূপ বুঝিয়াছিলেন, আমিও প্রথমে সেইরূপ বুঝিয়াছিলাম। কিন্তু যখন স্মরণ হইল, রাত্রি সাড়ে দশটা হইতে যে ব্যক্তি ক্লোরাফরমের গুণে অচেতন হয়, তাঁহার পক্ষে প্রাতঃকাল ছয়টা পৰ্য্যন্ত বাঁচিয়া থাকা অসম্ভব। সম্ভব অসম্ভব যদিও আমি তাহা ঠিক জানি না, কারণ আমি ডাক্তারী বিদ্যা কখনও অধ্যয়ন করি নাই। কিন্তু আমার মনে যে ভাবের উদয় হইয়াছিল, আমি তাহারই অনুসরণ করিলাম। ঘড়ীর ভিতরে যে কাঁটাটি একটু উপরের দিকে উঠাইয়া ধরিলে ঘড়ীটি বাজিতে থাকে, তাহাই একবার উঠাইয়া ধরিলাম; দেখিলাম, ঠং ঠং করিয়া পাঁচটা বাজিয়া গেল। তখন আমার মনে বেশ বিশ্বাস হইল, এই ঘটনা চারিটা বাজিবার পর এবং পাঁচটা বাজিবার পূর্ব্বেই সম্পন্ন হইয়াছে। আরও ভাবিলাম, ঘড়ীর কাঁটা ধরিয়া উল্টাদিকে কয়েকবার শীঘ্র শীঘ্র ঘুরাইয়া দেওয়া নিতান্ত সহজ। কারণ সেই বিষয়ে অপর কাহারও জানিবার সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু যদি পূৰ্ব্বকথিত কাঁটা উঠাইয়া এক এক করিয়া এগারটা, বারটা, একটা, দুইটা, তিনটা, চারিটা এত বাজাইয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে সেই শব্দ নিকটবর্তী কোন লোকের শ্রবণ-পথে আকৃষ্ট হইতে পরে, অথচ এত বড় একটি ভয়ানক কার্য্য সম্পাদনের পর সেইরূপভাবে এইস্থানে দাঁড়াইয়া ঘড়ী বাজান নিতান্ত সহজ কর্ম্ম নহে, কারণ সেই সময় মনের প্রায় স্থিরতা থাকে না। অধিকন্তু শীঘ্র শীঘ্র গৃহ পরিত্যাগ করিয়া গমন করিবার চেষ্টা চোরমাত্রেই করিয়া থাকে। এই মহাশয়! আমার সময়-নিরূপণের কারণ। এই নিমিত্তই আমি বলিতেছিলাম, এই ঘটনা রাত্রি চারিটা ও পাঁচটার ভিতর সম্পন্ন হইয়াছে।
দেখিলাম, আমার কথা শুনিয়া সকলেই পরিশেষে আমার মতে অনুমোদন করিলেন।
সেই সময় বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় আরও কহিলেন, “এত হ’ল, কিন্তু চোর কি প্রকারে গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল?”
ইংরাজ-কর্ম্মচারী। পশ্চিমদিগের দরজা দিয়া প্রবেশ করিয়াছে। দেখিতে পাইতেছেন না, উহাতে অস্ত্রের চিহ্ন এখনও পর্য্যন্ত বর্ত্তমান আছে।
বন্দ্যোপাধ্যায়। তোমার কি বোধ হয়?
আমি। আমার বোধ হয়, সেই দরজা দিয়া কোন চোর গৃহের মধ্যে প্রবেশ করে নাই, বা গৃহের দক্ষিণ দিকের অর্থাৎ সম্মুখের দরজা দিয়া বহির্গত হইয়াও যায় নাই।
বন্দ্যোপাধ্যায়। তোমার এরূপ অনুমানের কারণ কি?
আমি। কারণ বিশেষ কিছুই নয়। পশ্চিমদিগের দরজার গাত্রে যদিচ অস্ত্রের দাগ দৃষ্টিগোচর হইতেছে সত্য, কিন্তু আমার বিবেচনায় সেই দাগ বাহির হইতে হয় নাই, ভিতর হইতে হইয়াছে। সুতরাং সেই দরজা দিয়া কোন লোক যে গৃহের ভিতর প্রবেশ করে নাই, ইহা স্থির। দরজার বহির্ভাগ যদি আপনারা বিশেষরূপে দর্শন করেন, তাহা হইলে স্পষ্টই বুঝিতে পারিবেন, সেই দরজা সর্ব্বদা খোলা হইত না, প্রায়ই বন্ধ থাকিত। এবং ইহাও দেখিতে পাইবেন, উহাতে ঊর্ণনাভের পুরাতন সূত্র সকল এখনও বর্ত্তমান আছে। সেই দরজার ভিতর দিয়া কোন লোক গৃহের ভিতর প্রবেশ বা গৃহ হইতে বহির্গত হইলে, সেই সূত্ররাশি নিশ্চয়ই যে বিচ্ছিন্ন হইত, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।
বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি তোমার অনুমানের সম্পূর্ণরূপ পোষকতা করি। কিন্তু তোমার বিবেচনায় চোর কি রূপে গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল?
আমি। আমার বিবেচনায় চোর সম্মুখের দরজা দিয়া প্রবেশ করিয়াছে। কিন্তু গৃহের ভিতরস্থিত সেই বৃদ্ধা বা যুবকের মধ্যে কেহ দরজা যে খুলিয়া দিয়াছে, তাহা যখন সহজে অনুমান করিতে পারি না, তখন হয় উহাদিগের শয়ন করিবার পূর্ব্বে চোর গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া লুকাইয়াছিল, এবং সময়-মত আপন কার্য্যসাধন করিয়া চলিয়া গিয়াছে, নতুবা অনবধানতাবশতঃ রাত্রিকালে গৃহের দরজা খোলাই ছিল, সুযোগ পাইয়া সেই মুক্তপথে চোর প্রবেশ করিয়াছিল।
আমার কথা শুনিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় চুপ করিয়া রহিলেন। তাঁহার যে কি অনুমান, তাহার কিছুমাত্র আভাষ আমাদিগকে প্রদান করিলেন না।
পুলিসের প্রয়োজনীয় কাৰ্য্য সকল তখন সম্পন্ন হইতে লাগিল। পরের মুখে শুনিয়া যতদূর হইতে পারে, সেইখানে মালের একটি তালিকা প্রস্তুত হইল। হরর মা সম্বন্ধে কোনরূপ অনুসন্ধান বাকি থাকিল না; কোন্ কোন্ স্থানে তাহার যাতায়াত, কোন্ কোন্ ব্যক্তির সহিত তাহার আলাপ পরিচয়, সেই সমস্ত লোকের মধ্যে কোনরূপ কুচরিত্রের লোক আছে কি না, প্রভৃতি তাহার সম্বন্ধে যাহা কিছু অনুসন্ধানের প্রয়োজন, তাহার সমস্তই শেষ হইল।
বৃদ্ধার বাড়ীতে কোন্ কোন্ ব্যক্তির যাতায়াত আছে, তাহাদিগের মধ্যে কে কি চরিত্রের লোক, তাহাও বিশেষরূপে দেখা হইল।
এইরূপভাবে চুরি করা যে সকল চোরের ব্যবসা, কলিকাতার সর্ব্বস্থানের সেই সকল জানিত চোরের ভিতর উত্তমরূপে অনুসন্ধান হইল, কিন্তু কোন ফলই ফলিল না।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পূর্ব্বরূপ অনুসন্ধান করিতে করিতে ক্রমে দুইদিবস অতীত হইয়া গেল, কিন্তু কাৰ্য্যে কিছুই হইল না। তৃতীয়দিবসে বৃদ্ধা ভব, এবং রসিকলাল ঘোষ উভয়েই সম্পূর্ণরূপ আরোগ্যলাভ করিয়া হাসপাতাল হইতে বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। উহাদিগকে দেখিয়া আমাদিগের মনে সাহস হইল। ভাবিলাম, ইহাদিগের নিকট হইতে এখন অনেক কথা জানিতে পারিব, সুতরাং মোকদ্দমার অনুসন্ধানেও বিশেষ সুবিধা হইবে। দোষী ব্যক্তি ধরা পড়িলেও পড়িতে পারিবে, এবং অপহৃত দ্রব্যের অনুসন্ধান হইলেও হইতে পারিবে। কিন্তু যখন তাহাদিগের সমস্ত কথা উত্তমরূপে শুনিলাম, তখন আমাদিগের সে আশা দূর হইল।
তাহাদিগের নিকট হইতে জানিতে পারিলাম, যে দিবস এই ঘটনা ঘটিয়াছিল, সেইদিবস সন্ধ্যার পর চাকরাণী হরর মা বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া ভবর সম্মুখেই গমন করে।
সেই সময় রসিকলাল বাহিরে ছিলেন, রাত্রি প্রায় সাড়ে দশটার সময় তিনি প্রত্যাগমন করিয়া আহারাদি পূর্ব্বক শয়ন করেন, এবং দেখিতে দেখিতে নিদ্রিত হইয়া পড়েন।
রসিকলাল নিদ্রিত হইবার অনেকক্ষণ পরে, ভব আপনার হস্তে দরজা বন্ধ করেন, এবং যে দরজা পূর্ব্ব হইতে বন্ধ ছিল, তাহাও নিজহস্তে পরীক্ষা করিয়া শয়ন করেন। রাত্রি দুই প্রহরের পর ভব নিদ্রিত হন, তাহার পর তার যে কি অবস্থা ঘটিয়াছিল, তাহা তাঁহারা কিছুই অবগত নহেন। পরিশেষে যখন তাঁহাদিগের চৈতন্য হয়, তখন তাঁহারা বুঝিতে পারেন যে, তাঁহারা হাসপাতালে রহিয়াছেন। ইহা ব্যতীত ইঁহারা আর কিছুই বলিতে পারেন না, কোন লোকের উপর তাঁহাদিগের সন্দেহ হয় না; এবং সম্প্রতি কোন অপরিচিত লোক তাঁহাদিগের বাড়ীতে আগমন করে নাই।
যে সকল দ্রব্য চুরি গিয়াছে, ভবর কথামত তাহার আর একটি তালিকা প্রস্তুত করিলাম। এখন সকলেই জানিতে পারিলেন, অলঙ্কার নগদ প্রভৃতিতে প্রায় ছয় হাজার টাকা ভবর গৃহ হইতে অপহৃত হইয়াছে।
লোহার সিন্ধুকের চাবি একটি কাষ্ঠ সিন্ধুকের ভিতর ছিল, তাহাতে কাপড় ভিন্ন অপর আর কোন দ্রব্য থাকিত না। সেই বাক্স যদিও ভগ্নাবস্থায় পাওয়া যায়, তথাপি তাহার মধ্যস্থিত কোন দ্রব্য অপহৃত হয় নাই, কেবল লোহার সিন্ধুকের চাবি পাওয়া গেল না।
এই সকল অবস্থা দেখিয়া এবং শ্রবণ করিয়া আমরা কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না, এমন সময়, একখানি বেনামা পত্র ডাকে আসিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের হস্তে পড়িল। তিনি সেই পত্র উত্তমরূপে পাঠ করিয়া, পরিশেষে আমার হস্তে প্রদান করিলেন, আমিও সেই পত্র পাঠ করিলাম। উহাতে লেখা ছিল : “ভব এবং রসিককে বিষ খাওয়াইয়া তাহাদিগের গৃহ হইতে যে সকল দ্রব্য অপহরণ করা হইয়াছে, তাহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত আপনারা বিশেষ ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন, ইহা আমি কয়েকদিবস হইতে দেখিতেছি। কিন্তু যখন আমি তৎসম্বন্ধে কোন কথা জানিতে পারিয়াছি, তখন আমার কর্তব্য সেই কথা আপনাদিগকে বলিয়া দেওয়া। কারণ আপনারা সেই অবস্থা জানিতে পারিলে, আমার বোধ হয়—অথবা বোধ কেন নিশ্চয়ই আপনাদিগের কষ্টের লাঘব হইবে। কিন্তু আপনাদিগের যে সুযশ শুনিতে পাই, কেহ আপনাদিগকে কোনরূপ সংবাদ প্রদান করিলে তাহাকে লইয়া আপনারা সর্ব্বদা যেরূপ টানাটানি করিয়া থাকেন, তাহাতে আপনাদিগকে কোনরূপ সংবাদ প্রদান করিতে গিয়া কে আপনার নাম প্রকাশ করিতে সাহসী হয়? সুতরাং আমি আমার নিজের নাম গোপন করিলাম। ইচ্ছা হয়, আমার কথায় বিশ্বাস করিবেন, ইচ্ছা না হয়, বিশ্বাস করিবেন না; কারণ ইহাতে আমার কোনরূপ ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। একবার আপনারা দেখিবেন, ভবর মৃত্যুর পর যে তাহার উত্তরাধিকারী হইবে, সেই অতুলের সহিত ইহার কোনরূপ সংস্রব আছে কি না? অতুলের নিকট হইতে যদি প্রকৃত কথা বাহির করিতে পারেন, তাহা হইলেই আপনাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে। অতুলের বাসস্থান ঘোড়াবাগান। একটু অনুসন্ধানেই তাহাকে বাহির করিতে পারিবেন। ইতি
পত্রপাঠ করা সম্পন্ন হইলে বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই পত্র সম্বন্ধে তোমার কি বিবেচনা হয়?
আমি। আমার বোধ হইতেছে, এ পত্রের কথা প্রকৃত হইলেও হইতে পারে।
বন্দ্যোপাধ্যায়। কি কারণে তুমি এই পত্রের কথা বিশ্বাস করিতেছ?
আমি। এই পত্রের কথা বিশ্বাস করিবার আমার কয়েকটি কারণ আছে। প্রথমতঃ অতুল যদি প্রকৃতই ভবর উত্তরাধিকারী হয়, তাহা হইলে অতুলের দ্বারা এই কার্য সম্পন্ন হওয়া নিতান্ত অসম্ভব নহে। কারণ সে বেশ বুঝিতে পারিতেছে, ভবর যাহা কিছু আছে, তাহার সমস্তই সে রসিককে দিয়া যাইবে, তাহার আর কিছুমাত্র ভ্রম নাই। দ্বিতীয়তঃ—ঘোড়াবাগানের এক অতুলকে আমি জানি, সে কোন ডাক্তারখানায় কম্পাউণ্ডারের কর্ম্ম করেন। সেই যদি এই অতুল হয়, তাহা হইলে তাহার দ্বারা ক্লোরাফরম সংগ্রহ করা নিতান্ত সহজ; কিন্তু অপরের পক্ষে সেরূপ সহজ নহে। তৃতীয়তঃ—আমাদিগের দেশে যে সকল চোর সর্ব্বদা দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাদিগের মধ্যে অনেকেই অশিক্ষিত। ক্লোরাফরম যে কি, ও তাহার গুণই বা কি তাহা তাহাদিগের বোধ হয়, কেহই অবগত নহে। এ সকল চুরি হয় শিক্ষিত লোকের দ্বারা সম্পন্ন হইতে পারে, না হয়, তাহাদিগের সহিত ডাক্তারখানার সংস্রব আছে, তাহাদিগের দ্বারাই সম্পন্ন হয়। অপর কাহারও দ্বারা এরূপ কার্য্য হওয়া একেবারেই অসম্ভব।
বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি তোমার যুক্তির পোষকতা করি, কিন্তু তোমার মতের অনুমোদন করি না। এ পত্র আমি বিশ্বাস করি না, আমার বিশ্বাস এই পত্রের মূলে সত্যের লেশমাত্র নাই। অতুলের সহিত কাহারও মনান্তর আছে, সেই তাহাকে বিপদগ্রস্ত করিবার মানসে এই শত্রুতাসাধন করিয়াছে। কিন্তু তুমি যে অতুলের কথা বলিতেছ, সেই যদি এই অতুল হয়, তাহা হইলে একটু সন্দেহের কারণ হয় বটে। যাহা হউক, এ সম্বন্ধে একবার উত্তমরূপে দেখা উচিত।
বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের কথা শুনিয়া প্রথমে ভবর সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তাহাকে জিজ্ঞাসা করায় জানিতে পারিলাম যে, বাস্তবিকই অতুল ভবর দূর সম্পর্কে উত্তরাধিকারী। যদি ভব তাঁহার বিষয় অপর কাহাকেও প্রদান না করিয়া যায়, তাহা হইলে পরিশেষে সমস্তই অতুলের হইবে।
ভবর নিকট হইতে এই অবস্থা জানিতে পারিয়া, ঘোড়াবাগানে গমন করিলাম, সন্ধানে অতুলকেও পাইলাম। পূর্ব্বে যাহা আমার পূর্ব্বপরিচিত, যে ডাক্তারখানায় কম্পাউণ্ডারের কর্ম্ম করে, এ সেই অতুল। অতুল আমাকে দেখিবামাত্র কহিল, “এখানে কি নিমিত্ত আপনার আগমন হইয়াছে?”
উত্তরে আমাকে হঠাৎ একটি মিথ্যা কথা বলিতে হইল; অনুসন্ধানের সময় এরূপ মিথ্যা কথা বাধ্য হইয়া আমাদিগকে প্রায়ই বলিতে হয়। ইহা যেন আমাদিগের একরূপ কর্তব্য কর্ম্মে পরিগণিত হইয়াছে। ঈশ্বর যে আর কতদিবস পরে এই পাপ হইতে মুক্ত করিবেন, তাহা তিনিই বলিতে পারেন। আমি কহিলাম, “তোমার মনিবের সহিত আমার সাক্ষাৎ করিবার বিশেষ প্রয়োজন আছে।”
আমার কথা শুনিয়া সে তাহার মনিবকে সংবাদ প্রদান করিল। সংবাদ পাইবামাত্র ডাক্তার আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
যে ডাক্তারখানায় আমি এই অনুসন্ধান করিতে গমন করিয়াছিলাম, তাহা এখন একটি পুরাতন ঔষধালয় হইলেও সেই সময়ে কিন্তু নিতান্ত নূতন ঔষধালয় ছিল। এই সন্ধানের দুই বৎসর পূর্ব্বে এই ঔষধালয় প্রথম স্থাপিত হয়।
ডাক্তারের নিকট আমি আমার মনে কথা গোপন করিলাম, এবং কহিলাম, “এই ঔষধালয় সৃষ্ট হওয়ার পর আপনি কয় শিশি ক্লোরাফরম খরিদ করেন, তাহার কয় শিশি বিক্রয় হইয়াছে, এবং কয় শিশিই বা এখনও মজুত আছে, তাহার একটি হিসাবের প্রয়োজন।”
আমার কথা শুনিয়া ডাক্তারবাবু নিজেই খাতাপত্র দেখিতে আরম্ভ করিলেন, এবং পরিশেষে কহিলেন, “কেবল দুইশিশিমাত্র ক্লোরাফরম খরিদ করা হয়, তাহা আমার বেশ স্মরণ আছে, এবং কাগজেও তাহাই পাইতেছি। দুই শিশির মধ্যে একশিশি বিক্রয় করা হয়, অপর আর এক শিশি বোধ হয়, মজুতই আছে।”
ডাক্তারবাবুর কথা শুনিয়া মজুত শিশিটি একবার দেখিতে চাহিলাম। ডাক্তারবাবু সেই শিশিটি আনিবার নিমিত্ত অতুলকে বলিলেন।
প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা পরে অতুল ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “কই মহাশয়! অনুসন্ধানে ক্লোরাফরমের শিশি আর ত পাইতেছি না!”
অতুলের উপর পূর্ব্বেই আমার কিঞ্চিৎ সন্দেহ হইয়াছিল, এই কথা শুনিয়া সেই সন্দেহ আরও বদ্ধমূল হইল। কিন্তু তাহাকে স্পষ্ট করিয়া কোন কথা না বলিয়া সেইস্থান হইতে তাহাকে সঙ্গে করিয়া আপনস্থানে গেলাম, এবং বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়কে আদ্যোপান্ত সমস্ত কথা কহিলাম। দেখিলাম, অতঃপর তিনিও ক্রমে আমার অনুমান সম্পূর্ণ করিলেন, এবং অতুলকে লইয়া অনেকরূপ জিজ্ঞাসাবাদ করিতে লাগিলেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
অতুলকে যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, সে স্থিরভাবে তাহার উত্তর প্রদান করিতে লাগিল। তাহার কথা যিনিই শ্রবণ করিতে লাগিলেন, তিনিই কহিলেন, এরূপ অবস্থায় অতুলের উপর কোনরূপ সন্দেহ হইতে পারে না, তথাপি আমরা অতুলকে ছাড়িতে পারিলাম না। ডাক্তারখানা হইতে যখন একশিশি ক্লোরাফরম চুরি গিয়াছে, তখন অতুলকে কি প্রকারে পরিত্যাগ করিতে পারি? অতুলকে লইয়া যথেষ্ট অনুসন্ধান হইল, তাহার বাসা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অন্বেষণ করা হইল। তাহার দেশের বাড়ী গৃহ প্রভৃতি উত্তমরূপে খানা-তল্লাসী হইতে বাকি থাকিল না, কিন্তু অপহৃত কোন দ্রব্য পাওয়া গেল না।
অতুলের নিকট হইতে কোন দ্রব্য পাওয়া যাইতেছে না, অথচ ছাড়িয়া দিতেও পারিতেছি না। তাহাকে লইয়া একরূপ বিপদেই পড়িলাম। কেহ কহিলেন, ইহারই দ্বারা এই কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছে; কেহ কহিলেন, ইহার দ্বারা হয় নাই, ক্লোরাফরমের শিশি অন্য কোন রূপ গোলযোগ হইয়া গিয়াছে; আমাদিগের মধ্যে এইরূপ মতভেদ হইতে লাগিল।
ক্রমে এইরূপে পাঁচদিবস অতীত হইয়া গেল। ষষ্ঠ দিবসে দেখিলাম, একটি লোক আসিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়কে কি বলিয়া গেল। তিনি আমাকে ডাকাইয়া কহিলেন, যে সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া অতুলের বিরুদ্ধে আমরা অনুসন্ধান করিতেছি, সেই অপরাধে অতুল অপরাধী নহে। তাহাকে এখনই ছাড়িয়া দেও, সেই ক্লোরাফরমের শিশি অপহৃত হয় নাই। অতুলের পূর্ব্বে যে ব্যক্তি সেই ডাক্তারখানায় কর্ম্ম করিত, সেই শিশি বিক্রয় করে। কিন্তু ভ্রমক্রমেই হউক, বা ইচ্ছা করিয়াই হউক, সে সেই টাকা খাতায় জমা দেয় নাই। যাঁহার নিকট সেই উহা বিক্রয় করে, তাঁহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইয়াছে, এবং সেই পুরাতন কম্পাউণ্ডার আমার নিকট সকল কথা স্বীকার করিয়াছে। এখন বুঝিতে পারিতেছি, অতুল কোন দোষে দোষী নহে, এই কয়েকদিবস পর্য্যন্ত তাহাকে মিথ্যা কষ্ট সহ্য করিতে হইয়াছে।
বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের কথা শুনিয়া সেই মুহূর্তেই অতুলকে ছাড়িয়া দিলাম। অতুল হাসিতে হাসিতে আমাদিগকে সহস্র গালিবর্ষণ করিয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিল। বিনাদোষে একজন লোককে নিরর্থক কষ্ট দিয়াছি বলিয়া, আমার মনেও কষ্ট হইতে লাগিল। আমার হৃদয় এখন যেরূপ কঠিন হইয়াছে, তখন সেইরূপ কঠিন হইয়াছিল না বলিয়াই বোধ হয়, কষ্ট হইল।
অতুল চলিয়া যাইবার পর আমার মনে কয়েকটি চিন্তার উদয় হইল।
১ম চিন্তা—ভবর যে সকল দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে বলিয়া অভিযোগ হইয়াছে, উহা প্রকৃতই অপহৃত হইয়াছে কি না? এই বিষয় অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত চিন্তা করিলাম। ভব মিথ্যা অভিযোগ করিয়াছে, ইহা আপনার মনকে বুঝাইবার নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিলাম। কিন্তু সে কথা মন আমার কোনরূপেই বুঝিল না।
দ্বিতীয় চিন্তা—যদি প্রকৃতই চুরি হইয়া থাকে, তাহ হইলে কাহার দ্বারা এই কাৰ্য সম্পন্ন হইল? বাহিরের কোন চোর আসিয়া এই কার্য্য করিয়া গেল, কি রসিকের সহায়তায় এই কাৰ্য্য হইল?
তৃতীয় চিন্তা—রসিকের সহায়তায় এ কার্য্য কিরূপে সম্পন্ন হইবে? যদি রসিকের সহায়তায় এই কাৰ্য্য হয়, তাহা হইলে সেই বা অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া থাকিবে কেন? আর ডাক্তারই বা কেন বলিবে, ক্লোরাফরমেই রসিককে অজ্ঞান করিয়াছিল?
চতুর্থ চিন্তা—যদি রসিকের দ্বারা বা তাহার সহায়তায় এই কার্য্য সম্পন্ন না হইয়া থাকে, তাহা হইলে বাহিরের লোক ভিতরে আসিল কি প্রকারে?
পঞ্চম চিন্তা—যে দরজায় অস্ত্রের চিহ্ন দৃষ্টিগোচর হইতেছে, সেই দরজা দিয়াই যদি অপহরণকারী গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া থাকে, তাহা হইলে উহার বহির্ভাগের পুরাতন ঊর্ণজাল ছিন্ন হইল না কেন?
ষষ্ঠ চিন্তা—সেই দরজায় যে সকল চিহ্ন দৃষ্টিগোচর হইতেছে, তাহা যে বাহির হইতে হইয়াছে, তাহা ত বোধ হইতেছে না। ভিতর হইতে যদি অস্ত্রের চিহ্ন হইয়া থাকে, তাহা হইলে দস্যুগণ ভিতরে আসিবে কি প্রকারে?
সপ্তম চিন্তা—গৃহের সম্মুখ দরজা যদি ভিতর হইতে না খুলিয়া দেওয়া হইবে, তাহা হইলেই বা দস্যুগণ প্রবেশ করিবে কিরূপে?
অষ্টম চিন্তা—যে সিন্ধুকের ভিতর লোহার সিন্ধুকের চাবি ছিল, সেই সিন্ধুক কেবল চাবির নিমিত্তই ভাঙিয়াছে বলিয়া বোধ হইতেছে। কারণ তাহার মধ্যে মূল্যবান কোন দ্রব্য থাকিত না। অথচ বস্ত্রাদি যাহা কিছু ছিল, তাহার একখানিও অপহৃত হয় নাই।
নবম চিন্তা—গৃহের লোক না হইলে দস্যুগণকে এই চাবির সন্ধান আর কে প্রদান করিতে পারে?
দশম চিন্তা—গৃহের ভিতরে যে দুইজন ছিলেন, তাহার মধ্যে বৃদ্ধা ভব কি নিমিত্ত নিজের দ্রব্য অপরের দ্বারা অপহরণ করাইবে?
একাদশ চিন্তা—গৃহের ভিতরস্থিত অপর ব্যক্তি রসিক। সেই গৃহের সমস্ত অবস্থা জানে, কিন্তু সেই বা অপরের দ্বারা চুরি করাইবে কেন? সে বেশ জানে, ভবর মৃত্যুর পর সবই তাহার, এখনও তাহার কোন কষ্ট নাই। তাহার মনে যাহা উদয় হইতেছে, ভবর পয়সায় সে তাহাই করিতেছে। তাহার বিবাহের নিমিত্ত ভব বিশেষরূপ চেষ্টা করিতেছে। এরূপ অবস্থায় রসিকই বা চুরি করিবে কেন?
যাহা হউক, যে দিবস অতুলকে ছাড়িয়া দিলাম, সেইদিবস দেখিলাম, বন্দোপ্যাধ্যায় মহাশয় এবং সেই ইংরাজ—কৰ্ম্মচারী ভবর বাড়ীতে পুনরায় গমন করিতেছেন। কি নিমিত্ত তাঁহারা যে পুনরায় গমন করিতেছেন, তাহা কিন্তু আমি কিছুই বুঝিতে পারিলাম না; তাঁহারও ভাঙ্গিয়া চুরিয়া আমাকে কোন কথা বলিলেন না, কিন্তু আমাকে ডাকিয়া তাঁহাদিগের সঙ্গে লইলেন। আমিও বিনাবাক্য-ব্যয় তাঁহাদিগের পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলাম।
বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় এবং ইংরাজ-কর্মচারী উভয়েই ভিতর প্রবেশ করিয়া উপবেশন করিলেন। রসিকও ভবকে সম্মুখে ডাকিয়া তাহাদিগকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। যে সকল কথা তাহাদিগকে বার বার জিজ্ঞাসা করা হইয়াছে, যে সকথা অনেকবার অনেকরূপে লিখিয়া লওয়া হইয়াছে, সেই সকল পুরাতন কথা আবার তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া লিখিয়া লইতে আরম্ভ করিলেন। যে সকল বিষয় অনেকবার শ্রবণ করিয়াছি, যাহা অনেকবার লিখিয়াও লইয়াছি, সেই সকল বিষয় শ্রবণ করিতে আমার আর ভাল লাগিল না। কিন্তু পুরাতন ও বহুদর্শী কৰ্ম্মচারীগণ যাহা করিতেছেন, তাহার কোনরূপ প্রতিবাদ করিতেও আমি সাহসী হইলাম না। ভাবিলাম, ইহাদিগের কোনরূপ গূঢ় অভিসন্ধি না থাকিলে ইঁহারা পুনরায় এরূপ কার্য্যে কেন প্রবৃত্ত হইবেন?
উঁহারা যখন পূর্ব্বোক্তরূপে কথোপকথন করিতে লাগিলেন, আমি তখন সেই গৃহের ভিতর বসিয়া বসিয়াই এদিক ওদিক চতুৰ্দ্দিক দেখিতে লাগিলাম। কি দেখিতেছি, তাহার স্থির নাই, কোনদিকে বিশেষ লক্ষ্য নাই; তথাপি দেখিতে লাগিলাম।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
সেই গৃহ মধ্যে দেখিতে দেখিতে একটি চিঠির ফাইল আমার দৃষ্টিপথে পড়িল। দেখিলাম, দেওয়ালের এক কোণে একটি পেরেকের উপর উহা ঝুলিতেছে। সেইস্থান হইতে ফাইলটি আপনার নিকটে আনিলাম, ও উহাতে যে সকল কাগজপত্র ছিল, তাহা এক এক করিয়া পড়িতে লাগিল।
সেই ফাইলের কাগজগুলি যে কেন পড়িতে লাগিলাম, তাহার কারণ অন্যের জানা পরের কথা, আমি নিজেই জানিতে পারিলাম না। কৌতূহল পরবশ হইয়াই হউক বা অভ্যাসের দোষেই হউক, আমি কিন্তু উহা পাঠ করিতে লাগিলাম।
উহার ভিতর অনেক পত্র ছিল, এক এক করিয়া প্রায় সমস্তগুলিই মোটামুটি দেখিয়া লইলাম। কোনখানি বৃদ্ধা ভবর নামে, কোনখানি রসিকের নামে, কোনখানি বা অপর আর কাহারও নামে।
যখন আমি এইরূপভাবে সেই পত্রগুলি পাঠ করিতে লাগিলাম, তখন সেই ইংরাজ-কর্ম্মচারী আমার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া একটু হাসিলেন ও কহিলেন, “তোমার বিবেচনায় কি এই স্থির হইয়াছে যে, যাহারা এই দস্যুবৃত্তিতে পরিলিপ্ত, তাহারা অগ্রে পত্র লিখিয়া, পরিশেষে এই অসমসাহসিক কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছে? নতুবা এত আগ্রহের সহিত এই পত্রগুলি তুমি পাঠ করিতেছ কেন? অনাবশ্যক কর্ম্মে মিথ্যা সময় নষ্ট না করিয়া ইহারা পুনরায় যাহা বলিতেছে, আমার মতে তাহা শ্রবণ করা তোমার কর্তব্য।”
ইংরাজ-কর্মচারীর কথায় আমি কোনরূপ উত্তর প্রদান করিলাম না। কিন্তু বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় কহিলেন, “এদিকের কার্য্য আমরা করিতেছি, ও যাহা করে, তাহা উহাকে করিতে দেও। ইহারা এখন যাহা বলিতেছে, তাহা শুনিয়া যাহা করিতে হয়, তাহা আমরাই করিব। উহাকে সে বিষয় দেখিতে হইবে না।”
বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের কথা শুনিয়া ইংরাজ-কর্মচারী আর কোন কথা কহিলেন না। আমিও যে কার্যে নিযুক্ত ছিলাম, তাহাই আপন ইচ্ছামত দেখিতে লাগিলাম।
এক এক করিয়া অনেক পত্র পড়িলাম, কিন্তু উহার একখানির মধ্যেও আমার আবশ্যক কোন কথা দেখিতে পাইলাম না। পরিশেষে একখানি পত্রের উপর আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল, মনে যেন কেমন একরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। সেই পত্রখানি একবার দুইবার করিয়া চারি পাঁচবার পড়িলাম। কিন্তু পরিশেষে বুঝিলাম, এই মোকদ্দমার সহিত এই পত্রের কোনরূপ সংস্রব নাই। এই ভাবিয়া পত্রখানি যে স্থানে ছিল, সেইস্থানে রাখিয়া দিলাম।
সেই পত্রখানি চারি পাঁচবার আমাকে পড়িতে দেখিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় কহিলেন, “এত মনঃসংযোগ করিয়া তুমি যে পত্রখানি পড়িতেছিলে, দেখি উহাতে কি লেখা আছে।” এই বলিয়া পত্রখানি নিজহস্তে গ্রহণ করিয়া পাঠ করিলেন। সেই পত্রে লেখা ছিল,
“কল্যাণবরেষু—
তোমার কথার কেন এরূপ গোলযোগ হইল? আমরা কয়জনেই তোমার অপেক্ষায় বাগানে প্রায় সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত করিলাম। কিন্তু যখন দেখিলাম, তুমি আসিলেও না, বা কোনরূপ সংবাদও পাঠাইয়া দিলে না, তখন কাজেই পরদিবস প্রাতঃকালে আমাদিগকে সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া আসিতে হইল। কি অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহার সমস্ত ব্যাপার, হয়—পত্রযোগে আমাকে লিখিবে, না হয়, সময়মত একদিবসের নিমিত্ত আসিয়া বলিয়া যাইবে। তোমার সহিত সাক্ষাৎ হওয়ার পর যেরূপ বন্দোবস্ত হইবে, সেইরূপভাবে কার্য্য করিব। ইতি তারিখ।
আশীর্ব্বাদকারী
তারণচন্দ্র ঘোষ”
এই পত্রপাঠ করিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই পত্র পাঠ করিয়া তোমার মনে কোনরূপ সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছিল কি?”
আমি। হাঁ, কিন্তু পরে সে সন্দেহ দূর হইয়াছে।
বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথমে কি সন্দেহ উদয় হইয়াছিল?
আমি। আমার মনে এই সন্দেহ উদয় হইয়াছিল যে, রসিক, তারণচন্দ্র প্রভৃতি কয়েকজন লোকের সহিত পরামর্শ করিয়া এইরূপ করিবার অভিসন্ধি করিয়াছিল, এবং চুরি করিবার নিমিত্তই উহারা সকলে আসিয়া বাগানে রসিকের অপেক্ষায় বসিয়া ছিল। কিন্তু কাৰ্য্যগতিকে রসিক তাহাদিগের নিকট গমন করিয়া কোনরূপ সংবাদ প্রদান করিতে পারে নাই। সুতরাং সমস্ত রাত্রি তাহাদিগকে বাগানের ভিতর বসিয়া থাকিতে হয়, ও সঙ্কল্পিত কার্য শেষ করিতে না পারিয়া পরদিবস প্রাতঃকালে তাহারা সেইস্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক প্রস্থান করে। পত্রপাঠ করিয়া প্রথমে আমার মনে এই প্রকার সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হয়। আরও আমার মনে হয়, এই ঘটনার পর আর একটি দিন স্থির হয়, ও সেইদিবসেই উহারা এই কার্য্য সম্পন্ন করে।
বন্দ্যোপাধ্যায়। তোমার মনে যে সন্দেহ প্রথমে উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা নিতান্ত অযুক্তি-যুক্ত নহে। কিন্তু পরিশেষে সে সন্দেহ দূর হইল কিসে?
আমি। যখন আমি সেই পত্রের তারিখ দেখিলাম, তখন আমার সেই সন্দেহ দূর হইল। দেখিলাম, চুরির প্রায় দেড়বৎসর পূর্ব্বে যে পত্র লেখা হইয়াছে, সেই পত্রের সহিত বর্তমান চুরির যে কোনরূপ সংস্রব আছে, তাহা আমার মনে লয় না। সুতরাং পত্রের তারিখ দেখিয়া আমার সেই সন্দেহ দূর হইয়াছে।
বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় আমার কথা শুনিয়া আর আমাকে কিছু বলিলেন না। রসিকলাল সেইস্থানেই উপস্থিত ছিল। তাহার হস্তে সেই পত্রখানি প্রদান করিয়া কহিলেন, “এই পত্রখানি পড় দেখি রসিকলাল!”
পত্রখানি হস্তে লইয়া রসিকলাল পাঠ করিতে আরম্ভ করিল, কিন্তু তাহা সুস্পষ্টরূপে পাঠ করিতে পারিল না। কথা যেন জড়াইয়া বাহির হইতে লাগিল। তাহার অবস্থা দেখিয়া সকলেই মনে করিতে লাগিলেন, রসিকলালের অন্তরে যেন পাপ আছে।
পত্রপাঠ শেষ হইলে বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই পত্রলেখক তারণচন্দ্র কে?” প্রথমে একটু ইতস্ততঃ করিয়া পরিশেষে রসিকলাল উত্তর দিল, “তারণচন্দ্র তাহার খুড়া।”
“এ পত্রের অর্থ কি?”
“অর্থ আর কিছুই নহে, যে দিবস তাঁহারা আসিয়া বাগানে আমার অপেক্ষায় বসিয়া ছিলেন, সেইদিবস থিয়েটার দেখিতে যাওয়ার কথা ছিল, আরও কথা ছিল, আমি গিয়া তাঁহাদিগের সহিত মিলিত হইলে সকলে একসঙ্গে গমন করিব। কিন্তু হঠাৎ আমার একটু অসুখবোধ হওয়ায়, আমি সে সময় তাঁহাদিগের নিকট যাইতে পারি নাই, বা অপর কাহারও দ্বারা সংবাদ পাঠাইতেও সমর্থ হই নাই। কাজেই তাঁহারা আমার অপেক্ষায় বসিয়া বসিয়া সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত করিয়াছিলেন, এবং পরিশেষে বাড়ী গিয়া আমাকে এই পত্র লিখিয়াছিলেন।”
“তুমিই যেন যাইতে পারিলে না, বা অপর কাহারও দ্বারা সংবাদ পাঠাইতে সমর্থ হইলে না, কিন্তু তাঁহাদিগের মধ্যে কেহ না কেহ আসিয়া অনায়াসেই সংবাদ লইয়া যাইতে পারিত। আর থিয়েটার দেখা কিছু এমন দুষ্কৰ্ম্ম নহে যে, তাঁহারা তোমার বাড়ীতে না আসিয়া তোমার অপেক্ষায় চোরের মত বাগানের ভিতর বসিয়াছিলেন?”
“আপন যাহা বলিতেছেন, তাহা প্রকৃত; কিন্তু তাঁহাদিগের মধ্যে কেহই আমার বাড়ী জানিতেন না বলিয়া পূর্ব্বের বন্দোবস্ত মত তাঁহারা বাগানের ভিতর বসিয়াছিলেন, তাঁহারা চোর নহেন। সকলেই সম্ভ্রান্তবংশীয় ও আমার আত্মীয়; সুতরাং তাঁহাদিগের দ্বারা কোনরূপ অনিষ্টের আশঙ্কা করা যাইতে পারে না। বিশেষ এ ঘটনা আজিকার নহে; বহুদিবসের।”
অষ্টম পরিচ্ছেদ
রসিকের কথাগুলি আমরা বিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিলাম। তাহার কথায় যদিও আমার কতক বিশ্বাস হইল; কিন্তু বুঝিলাম, বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় তাহার কথা একেবারে বিশ্বাস করেন নাই। তখন তিনি ক্রমে রসিককে নানাকথা জিজ্ঞাসা করিয়া তাহার খুড়ার বাসস্থান কোথায়, তাঁহার সঙ্গে আর কে কে আসিয়াছিল, তাহাদিগের বা বাড়ী কোথায় প্রভৃতি সমস্ত ব্যাপার জানিয়া লইলেন। সেই সকল বিষয়ে এরূপভাবে রসিককে প্রশ্ন করিলেন, যাহাতে রসিক কিছুমাত্রই বুঝিতে পারিল না যে, পুলিসের সন্দেহ এতক্ষণ পরে তাহাদিগের উপর পতিত হইয়াছে।
রসিক ও ভবকে তাহাদিগের বাড়ীতে রাখিয়া সময়মত আমরা সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। পথে আসিয়া দ্রুতগামী একখানি গাড়ী ভাড়া করিয়া তারণচন্দ্রের গ্রামাভিমুখে চলিলাম। সেই গ্রাম হাবড়া হইতে বহুদূরে নহে, কয়েক ক্রোশের মধ্যেই স্থাপিত।
গ্রামে গমন করিয়া তারণকে তাহার বাড়ীতেই পাইলাম। প্রথমে কোন কথা না বলিয়া উহাকে একেবারে বন্ধু করিলাম। তারণ নিতান্ত বিস্মিতের ন্যায় জিজ্ঞাসা করিল, “কেন মহাশয় কি হইয়াছে, হঠাৎ আমাকে এরূপে বন্ধন করিতেছেন কেন?”
“কেন বন্ধন করিতেছি, তাহা তুমি জিজ্ঞাসা করিতেছ? কলিকাতায় কি কার্য্য করিয়া আসিয়াছ, তাহা তোমার স্মরণ নাই? তোমার সমস্ত মন্ত্রণা বিফল হইয়াছে, রসিক সকল কথা বলিয়া দিয়াছে। বুঝিতেই ত পারিতেছ, রসিক যদি সকল কথা না বলিয়া দিবে, তাহা হইলে আমরা তোমার নাম কি প্রকারে জানিতে পারিব? এবং তোমার বাসা কিরূপে সন্ধান করিয়া লইব?”
আমাদিগের কথা শুনিয়া তারণচন্দ্র একেবারে যেন মৃত হইয়া পড়িল। কিয়ৎক্ষণ তাহার শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হইল, কোনরূপ যেমন তেমনি বানিষ্পত্তি না করিয়া সেইস্থানেই বসিয়া পড়িল।
তারণের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমাদিগের মনে আরও সাহস হইল। তখন পুনরায় তাহাকে কহিলাম, “দেখ তারণ! যখন সমস্ত কথা প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে, তখন তুমি আমাদিগকে আর মিথ্যা কষ্ট দিও না। অপহৃত দ্রব্যাদি সমস্ত এখনই আমাদিগের সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত কর। নতুবা তোমার অদৃষ্টে যে কিরূপ দুঃখ আছে, তাহা আমি এখন কল্পনা করিয়াও ভাবিতে পারিতেছি না।” আমাদিগের কথা শুনিয়া তারণচন্দ্র প্রথম প্রথম দুই একবার বলিল, “আমি ইহার কিছুই জানি না, রসিক মিথ্যা করিয়া আমার নাম বলিয়া দিয়াছে।” পরিশেষে কিন্তু ইচ্ছা করিয়া হউক, বা অনিচ্ছাসত্ত্বেই হউক, তারণকে সকল কথা বলিতে হইল; তাহার সঙ্গে অপর কোন্ কোন্ ব্যক্তি ছিল, তাহাদিগের নামও করিয়া দিতে হইল। আর অপহৃত দ্রব্যাদি যাহা যেখানে রাখিয়াছিল, এক এক করিয়া তাহার সমস্তই বাহির করিয়া দিতে হইল। সেই সকল দ্রব্যের অধিকাংশই গ্রামের বাহিরে ময়দানের মধ্যে প্রোথিত করিয়া রাখা হইয়াছিল। অপরাপর আসামীগণকে ধৃত করিয়া এবং অপহৃত সমস্ত দ্রব্য সঙ্গে লইয়া আমরা কলিকাতায় আসিলাম। আমাদিগের কার্য্য দেখিয়া ঊর্দ্ধতন-কৰ্ম্মচারীরা, এবং পাড়াপ্রতিবেশী সকলে যেমন সন্তুষ্ট হইলেন, রসিকের মুখে তেমনি ভয় ও বিষাদের ছায়া পড়িল।
রসিক প্রথমে সমস্ত কথা অস্বীকার করিল। কিন্তু পরিশেষে কহিল, “আমি কি করিব? খুড়া মহাশয়ের কুপরামর্শে পড়িয়াই আমি এই কার্য্য করিয়াছি। এই কার্য্য সম্পন্ন করিবার নিমিত্ত প্রায় দুই বৎসর হইতে আমরা ক্রমাগত চেষ্টা করিয়া আসিতেছি। কিন্তু এই বৃদ্ধার সাবধানতার নিমিত্ত কোনরূপেই কৃতকার্য্য হইতে পারিতেছি না। যে যে রাত্রিতে চুরি করিবার বন্দোবস্ত হইয়াছে, যখন যখন আমি আমার শয্যা ত্যাগ করিবার বাসনা করিয়াছি, তখনই বৃদ্ধা জাগরিতা হইয়াছে; অমনি আমাদিগের কার্যে ব্যাঘাতও পড়িয়াছে। যখন দেখিলাম কোনরূপেই আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে পারিলাম না, তখন বাধ্য হইয়া আমাদিগকে এই শেষ উপায় উদ্ভাবন করিতে হইল। এই নিমিত্তই এই তৃতীয় সংখ্যক আসামীকে আমাদিগের দলে প্রবিষ্ট করাইতে হয়। ইনি ডাক্তারখানায় কর্ম্ম করেন, সুতরাং ইহার দ্বারা সহজেই ক্লোরাফরমের সংগ্রহ হইল। যখন দেখিলাম, বৃদ্ধা অচেতনবৎ নিদ্রিত হইয়া পড়িয়াছে। তখন শিশি হইতে কিয়ৎ পরিমাণ ক্লোরফরম লইয়া একখানি পূৰ্ব্বসঞ্চিত রুমালে ঢালিয়া বৃদ্ধার নাসিকার নিকট রাখিলাম; ক্রমে বৃদ্ধা অজ্ঞান হইয়া পড়িল। তখন আমি গৃহের দরজা খুলিয়া যেখানে সকলে আমার অপেক্ষায় বসিয়াছিল, সেইস্থানে গমন করিলাম। আমার নিকট সমস্ত অবস্থা শুনিয়া উহারা আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল। যে স্থানে লোহার সিন্ধুকের চাবি থাকিত, তাহা আমি জানিতাম; সেই বাক্স আমি উহাদিগকে দেখাইয়া দিলাম। পরিশেষে উহাদিগের সাধ্যমত সমস্ত দ্রব্য বাহির করিয়া প্রস্থান করিল। অপর রুমালখানিতে অতি সামান্যমাত্র ক্লোরাফরম ঢালিয়া আমার নিকটে ফেলিয়া রাখিলাম, ইচ্ছা—যাহাতে আমারও সামান্য নেশা হয়। কারণ আমি ও ভব যদি একই ভাবে পড়িয়া থাকি, তাহা হইলে আমার উপর সন্দেহ হইবে না। আমার যতটা নেশা হইয়াছিল বলিয়া আপনারা স্থির করিয়াছিলেন, বাস্তবিক ততটা নেশা আমার হইয়াছিল না।”
“উহারা চুরি করিলে তোমার কি লাভ ছিল?”
“আমাদিগের মধ্যে এই বন্দোবস্ত ছিল, যে পর্য্যন্ত গোলযোগ না মিটিবে, ততদিবস পর্যন্ত সমস্ত দ্রব্যই লুক্কায়িত থাকিবে। গোলযোগ মিটিয়া গেলে, আমরা সকলে মিলিয়া উহা বণ্টন করিয়া লইব। আমি লইব অৰ্দ্ধেক, এক-চতুর্থাংশ লইবেন খুড়া মহাশয়, অবশিষ্ট অপর কয়েকজনের মধ্যে বিভক্ত হইবে।”
“যাহা হউক, কত রাত্রিতে এই কার্য্য তোমরা করিয়াছিলে?”
“প্রাতঃকাল চারিটা হইতে পাঁচটার মধ্যে।”
“গৃহের ঘড়ীর অবস্থা সেরূপ হইয়াছিল কেন?”
“তাহার কারণ ছিল। পাড়ার দুই একজন লোক সাড়ে দশটার সময় ভবর সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিল; তাহাদিগের উপর সন্দেহ পড়িবে, এবং আমাদের উপর একেবারে পড়িবে না বলিয়া, ঘড়ীর কাঁটা ঘুরাইয়া সেইরূপে রাখিয়াছিলাম।”
“সেই সময় পাড়ার কোন লোক যে এখানে আসিয়াছিল, একথা ত তোমরা কেহই এ পৰ্য্যন্ত বল নাই।”
“ভয়েতে কেহ বলে নাই, কিম্বা ভুলিয়া গিয়া থাকিবে।”
ভব সেই স্থানে উপস্থিত ছিল, সে তখন কহিল, “রসিক যাহা বলিল, তাহা সত্য; একথা আমার মনেই ছিল না।”
“গৃহের পশ্চিমদিকের দরজায় অস্ত্রের চিহ্ন ছিল কেন?”
“বাহিরের লোক অস্ত্রদ্বারা সেই দরজা খুলিয়া গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াছে, ইহাই সাধারণকে দেখাইবার নিমিত্ত।” এইরূপে অনুসন্ধান শেষ করিয়া আসামীগণকে মাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করা হইল। সেইস্থান হইতে মোকদ্দমা দায়রায় গেল। দায়রায় জুরির বিচারে রসিক, তারণ, এবং অপর দুই ব্যক্তি রসময় ও প্রিয়নাথ, সকলেই সাত সাত বৎসরের নিমিত্ত কারাগারে প্রেরিত হইল। বৃদ্ধা তাঁহার সমস্ত দ্রব্য সামগ্রী লইয়া আপনার গৃহে প্রস্থান করিল। রসিক যেমন করিল, তাহার ফলও তেমনি পাইল!
[ ভাদ্র, ১৩০১]