“যেমন আমড়া, কেবল আঁটি আর চামড়া”
“সেদিন কলকাতায় গেলাম। গাড়িতে যেতে যেতে দেখি সব জীবের নিম্ন দৃষ্টি—সব্বাইয়ের পেটের চিন্তা। সব পেটের জন্য দৌড়চ্ছে। সকলেরই মন কামিনী-কাঞ্চনে। তবে দু-একজন দেখলাম ঊর্ধ্বদৃষ্টি—ঈশ্বরের দিকে মন আছে।”
৭ সেপ্টেম্বর ১৮৮৩। একশ সতের বছর আগে ঠাকুর এই কথাগুলি বলছেন মাস্টারমশাইকে। মাস্টারমশাই উত্তরে বললেন : “আজকাল আরো পেটের চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে। ইংরেজদের অনুকরণ করতে গিয়ে মানুষের বিলাসের দিকে আরো মন হয়েছে তাই অভাব বেড়েছে।”
পেটের জন্য দৌড়াব, না ঈশ্বরের জন্য? বিচারশীল মানুষকে আগে বিচার করে ঠিক করে নিতে হবে। একবার এ-নৌকায়, একবার ও-নৌকায় পা রাখলে, কি দু-নৌকায় পা রাখলে চলবে না। নিজেকেই ভুগতে হবে। লোকদেখানো কোন কিছু ভাল নয়। নিজের সঙ্গে আগে একটা বোঝাপড়া হওয়া চাই। সাধনা মানে নিজের দশটা হাত বেরনো নয়। পা ঠেকালেই তামার ঘটি সোনার ঘটি হবে না। টুসকি মারলেই নোটের তাড়া পড়বে না। এমন কিছুই হবে না যাতে দেহসুখ, জাগতিক ভোগ একবারে ফলাও হয়ে যাবে। এমন কিছুই হবে না, যা ঢাক পিটিয়ে, লোক জড় করে দেখানো যায়। যেমন দশ বছর তেড়ে সাধন ভজন করে এই আমার দশতলা বাড়ি হয়েছে, কি তিনখানা গাড়ি হয়েছে, কি কন্দর্পের মতো শরীর হয়েছে। ঠাকুর কোন সংশয় না রেখেই বলছেন : “কি জান, প্রারব্ধ কর্মের ভোগ। যে ক-দিন ভোগ আছে দেহধারণ করতে হয়। একজন কানা গঙ্গাস্নান করলে। পাপ সব ঘুচে গেল। কিন্তু কানাচোখ আর ঘুচল না। পূর্বজন্মের কর্ম ছিল তাই ভোগ।” ঠাকুর আরো ব্যাখ্যা করছেন : “কি জান, সুখ-দুঃখ–দেহধারণের ধর্ম। কবিকঙ্কন চণ্ডীতে আছে যে, কালুবীর জেলে গিছল। তার বুকে পাষাণ দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু কালুবীর ভগবতীর বরপুত্র। দেহধারণ করলেই সুখ-দুঃখ ভোগ আছে। শ্ৰীমন্ত বড় ভক্ত। আর তার মা খুলনাকে ভগবতী কত ভালবাসতেন। সেই শ্রীমন্তের কত বিপদ। মশানে কাটতে নিয়ে গিছল। একজন কাঠুরে পরম ভক্ত, ভগবতীর দর্শন পেলে। তিনি কত ভালবাসলেন, কত কৃপা করলেন। কিন্তু তার কাঠুরের কাজ আর ঘুচল না। সেই কাঠ কেটে আবার খেতে হবে। কারাগারে চতুর্ভুজ শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী ভগবানের দর্শন পেলেন দেবকী। কিন্তু কারাগার ঘুচল না।”
পরিষ্কার কথা। জাগতিক কোন কিছুর আশা নিয়ে এ-পথে পা বাড়িও না। তিন দিনে তোমার নেশা ছুটে যাবে। ঠাকুর বলছেন : “জীবন যেন ডাল, জাঁতার ভিতর পড়েছে; পিষে যাবে। তবে যে কটি ডাল খুঁটি ধরে থাকে, তারা পিষে যায় না। তাই খুঁটি অর্থাৎ ঈশ্বরের শরণাগত হতে হয়। তাঁকে ডাক, তাঁর নাম কর, তবে মুক্তি। তা নাহলে কালরূপ জাঁতায় পিষে যাবে।” অর্থাৎ ঈশ্বরকে ধরব একটি কারণে, সংসার যেন আমাকে কলুর বলদ না করে ফেলে। উদয়াস্ত কেবল স্ত্রী-পুত্র পরিবারের চিন্তা—হা অন্ন, হা অন্ন। যেন আক্ষেপ করে গাইতে না হয়—
“লোহারি বাঁধনে বেঁধেছে সংসার
দাস-খত লিখে নিয়েছে হায়।
প্রাতঃকালে উঠি কতই কি যে করি
দারা পুত্র হলো সুখেরই ছল।”
ঠাকুর বলছেন : “দেখ, ‘এক কপ্নি কা বাস্তে’ যত কষ্ট। বিবাহ করে ছেলেপুলে হয়েছে, তাই চাকরি করতে হয়; সাধু কপ্নি লয়ে ব্যস্ত, সংসারী ব্যস্ত ভার্যা লয়ে। আবার বাড়ির সঙ্গে বনিবনাও নাই, তাই আলাদা বাসা করতে হয়েছে। চৈতন্যদেব নিতাইকে বলেছিলেন, ‘শুন শুন নিত্যানন্দ ভাই, সংসারী জীবের কভু গতি নাই।” ঠাকুর মাস্টারমশাইকে দেখিয়ে সহাস্যে বলছেন : “ইনিও আলাদা বাস করছেন। তুমি কে, না, আমি বিদেশিনী, আর তুমি কে, না, আমি বিরহিণী। বেশ মিল হবে। তবে তাঁর শরণাগত হলে আর ভয় নাই। তিনিই রক্ষা করবেন।” ঠাকুর বলছেন : “সংসারে জ্বালা তো দেখছ, ভোগ নিতে গেলেই জ্বালা। চিলের মুখে যতক্ষণ মাছ ছিল, ততক্ষণ ঝাঁকে ঝাঁকে কাক এসে তাকে জ্বালাতন করেছিল। সাধুসঙ্গে শান্তি হয়। জলে কুমির অনেকক্ষণ থাকে; এক একবার জলে ভাসে, নিঃশ্বাস লবার জন্য। তখন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।” ঠাকুর বিদ্যাসুন্দরের যাত্রা দেখে, যে ছোকরাটি বিদ্যার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তাঁর সঙ্গে আনন্দে অনেক ঈশ্বরীয় কথা বলছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ : “তোমার কি বিবাহ হয়েছে? ছেলেপুলে?”
বিদ্যা : “আজ্ঞা একটি কন্যা গত। আরো একটি সন্তান হয়েছে।”
শ্রীরামকৃষ্ণ : “এর মধ্যে হলো, গেল! তোমার এই কম বয়স। বলে—সাঁজ সকালে ভাতার মলো কাঁদব কত রাত। সংসারে সুখ তো দেখছ! যেমন আমড়া, কেবল আঁটি আর চামড়া। খেলে হয় অম্লশূল। যাত্রাওয়ালার কাজ করছ তা বেশ! কিন্তু বড় যন্ত্রণা! এখন কম বয়স, তাই গোলগাল চেহারা। তারপর সব তুবড়ে যাবে। যাত্রাওয়ালারা প্রায় ঐরকমই হয়। গাল তোবড়া, পেট মোটা, হাতে তাগা। আমি কেন বিদ্যাসুন্দর শুনলাম? দেখলাম—তাল, মান, গান বেশ। তারপর মা দেখিয়ে দিলেন যে নারায়ণই এই যাত্রাওয়ালাদের রূপ ধারণ করে যাত্রা করছেন।”
বিদ্যা হঠাৎ প্রশ্ন করছেন : “আজ্ঞা কাম আর কামনা তফাত কি?”
শ্রীরামকৃষ্ণ : “কাম যেন গাছের মূল, কামনা যেন ডালপালা। এই কাম, ক্রোধ, লোভ ইত্যাদি ছয় রিপু একেবারে তো যাবে না; তাই ঈশ্বরের দিকে মোড় ফিরিয়ে দিতে হবে। যদি কামনা করতে হয়, লোভ করতে হয়, তবে ঈশ্বরে ভক্তি কামনা করতে হয়, আর তাঁকে পাবার লোভ করতে হয়। যদি মদ অর্থাৎ মত্ততা করতে হয়, অহঙ্কার করতে হয়, তাহলে আমি ঈশ্বরের দাস, ঈশ্বরের সন্তান, এই বলে মত্ততা, অহঙ্কার করতে হয়। সব মন তাঁকে না দিলে তাঁকে দর্শন হয় না।”
এখন প্রশ্ন হলো—কেন ঈশ্বরমুখী হব? সংসারী জীব আমি। আমি তো চাইব—ধন, জন, মান। আজ্ঞে না। তুলসী বলেছেন—
“অর্থ অনর্থকরহি জগতে মাহী।
(এই সংসারে অর্থই অনর্থের মূল)
দেখহ মন সুখলেশো নাহি।।
(ওতে মনের লেশমাত্ৰ সুখ নেই)
যাকো ধন তাকো ভয় অধিক।
(যার বেশি ধন আছে তার বেশি ভয়)
ধন কারণ মারত পিতু লড়িক।।
(টাকার লোভে ছেলে বাপকে মারতে পারে)
ধনতে পতিহিঁ বিঘাতহি নারী।
(টাকার লোভে স্ত্রী স্বামীকে খুন করতে পারে)
ধনতে মিত্র শত্রুতা-কারী।।
(অর্থের জন্যে বন্ধু শত্রু হয়ে যায়)
ধনমদ নর অন্ধের জগ-কয়সে।
(রাতকানা জানে না তার চোখের রোগটা কি)
দেখ নমি নহি রতোঁ ধি জেসে।।
(রাতকানার মতোই অন্ধ ধনমদে মত্ত অন্ধ মানুষ)”
শেষে যোগ করলেন আবার ঠাকুর : “ভোগ করতে সকলে যায়; কিন্তু দুঃখ, অশান্তিই বেশি। সংসার যেন বিশালাক্ষীর দ, নৌকো দহে একবার পড়লে আর রক্ষা নাই। সেঁকুল কাঁটার মতো এক ছাড়ে তো আরেকটি জড়ায়। গোলকধাঁধায় একবার ঢুকলে বেরুনো মুশকিল। মানুষ যেন ঝলসাপোড়া হয়ে যায়।”
সাধনা করব একটি কারণে—কুমিরের হাত থেকে বাঁচার জন্যে। সংসার- সমুদ্রে কামক্রোধাদি কুমির আছে। ঠাকুর বলছেন : “বিবেক বৈরাগ্য লাভ করে সংসার করতে হয়। হলুদ গায়ে মেখে জলে নামলে কুমিরের ভয় থাকে না। বিবেক-বৈরাগ্য হলুদ। সদসৎ বিচারের নাম বিবেক। ঈশ্বর সৎ, নিত্যবস্তু। আর সব অসৎ, অনিত্য।”
এই বোধের সাধনাই সংসারীর সাধনা।