যেভাবে গল্প তৈরি হয়
বিখ্যাত ব্যক্তিদের, বিশেষ করে মহাপুরুষদের বিষয়ে অনেক অবিশ্বাস্য ও অলৌকিক গল্প শোনা যায়।
এই গল্পগুলি অবাস্তব হলেও সংশ্লিষ্ট চরিত্রগুলোর সঙ্গে মানানসই। কোনও একটি ক্ষীণ সূত্র ধরে কাহিনীগুলি জনমানসে পল্লবিত হয়ে অতিরঞ্জিত আকারে প্রচার পেয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহোদয় সম্পর্কে দুটি গল্পের কথা উল্লেখ করা যায়।
দুটি গল্পই বিখ্যাত। একটি হল রঙ্গমঞ্চে অভিনয় দেখে দর্শকাসন থেকে উত্তেজিত বিদ্যাসাগরের চটি নিক্ষেপ। আর দ্বিতীয়টি হল, মায়ের বার্তা পেয়ে ঝড়-বাদলের অন্ধকার রাতে উত্তাল দামোদর নদী সাঁতরিয়ে বিদ্যাসাগরের মাতৃসমীপে গমন।
জনসাধারণের খুব প্রিয় এই গল্প দুটি এবং এ রকম বেশ আরও কয়েকটি আছে।
কিন্তু এসব কাহিনীর যে কোনওরকম বাস্তব ভিত্তি নেই, গবেষকরা বিশেষ করে ইন্দ্র মিত্র তাঁর ‘করুণাসাগর বিদ্যাসাগর’ গ্রন্থে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখিয়েছেন।
বিদ্যাসাগর কেন? আমাদের চোখের সামনে জলজ্যান্ত উদাহরণ ঋত্বিক ঘটক কিংবা শক্তি চট্টোপাধ্যায়। কত চমকপ্রদ কাহিনী এই দুই ব্যক্তিত্বের সঙ্গে জড়িত।
অল্পকাল আগে প্রয়াত শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কথাই বলি। এ রকম বর্ণময়, উজ্বল চরিত্রের মানুষ জগৎ-সংসারে বিরল। সাধারণ মানুষ বোধহয় কবিদের এ রকম ঝলমলে, গোলমেলে দেখতেই ভালবাসেন।
শক্তি সম্পর্কে সত্যি-মিথ্যে মেশানো কত গল্পকাহিনী বাজারে। একা এক ডবল-ডেকারে করে অতিক্রান্ত মধ্যরাতে গলির মধ্যে স্বগৃহে ফেরা, থানায় বড়বাবুকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করা, মন্ত্রীকে প্রশ্ন করা, ‘কি এখনও বাংলা খাচ্ছে কি না?’—এই সব অলীক গল্প লোকের মুখে মুখে এখনও ফেরে।
তবে বিশেষ ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু হিসেবে আমি হলফ করে বলতে পারি, এই কাহিনীগুলি আসল ঘটনার ধারে কাছেও যায় না। আসল ঘটনাগুলি কম রোমাঞ্চকর ছিল না, তবু জনসাধারণ গল্পগুলি তাদের মনের মতো করে রচনা করে নিয়েছে।
এইভাবে গল্প রচনা করার একটা আশ্চর্য উদাহরণ সম্প্রতি চোখে পড়ল।
আজ কিছুদিন হল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী নিয়ে আমাদের দেশে খুব আদিখ্যেতা চলেছে। মহাত্মা গান্ধী, কায়েদে আজম জিন্না, নেতাজি সুভাষ, পণ্ডিত নেহরু—ইত্যাদি তদানীন্তন নেতাদের বিষয়ে নানারকম গল্পগাথা প্রচারিত হচ্ছে। এতদিন পরে তার আর সত্যতা যাচাই করা সম্ভব নয়।
এরই মধ্যে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে একটি বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিকে।
প্রতিবেদক বুধনি মাঝিন নাম্নী এক সাঁওতাল রমণীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর প্রসঙ্গে।
উনিশশো ঊনষাট সালের আটই ডিসেম্বর তারিখে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের পাঞ্চেত বাঁধ উদ্বোধন করতে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নেহরু।
এই চল্লিশ বছরের পুরনো ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে, ‘জওহরলালকে বিয়ে করার জন্যে বিতাড়িত বুধনি’, শিরোনামে প্রতিবেদক একটি রোমাঞ্চকর ও লাগসই আলোচনা করেছেন। যার মধ্যে জওহরলাল চরিত্রের মহিমা প্রস্ফুটিত।
প্রতিবেদক যা বলেছেন তার সংক্ষিপ্তসার এইরকম—
নেহরু বাঁধ উদ্বোধন করতে এসে সমবেত জনতার মধ্যে তরুণী বুধনি মাঝিনকে দেখতে পান। তখন নেহরু নিজে বাঁধ উদ্বোধন না করে বুধনিকে এই মহৎ কর্ম সম্পাদন করার জন্যে ভিড়ের মধ্যে থেকে মঞ্চে ডেকে আনেন।
নেহরুর অনুরোধে বুধনি বাঁধ উদ্বোধন করেন, সুইচ টিপে ড্যামের দরজা খুলে দেন। তারপরে সাঁওতালি ভাষায় বুধনি মাঝিন একটি ছোট সাঁওতালি বক্তৃতাও করেন।
এরপর বুধনি মাঝিকে অভিভূত জওহরলাল নেহরু তাঁর গলার সোনার হার খুলে পরিয়ে দেন। এবং সেটাই হল বুধনির কাল। পরপুরুষের কণ্ঠহার গলায় পরায় তাকে সমাজ থেকে নির্বাসন দেওয়া হয়। গত চল্লিশ বছর নির্বাসিতার জীবনযাপন করছেন পাঞ্চেত বাঁধের উদ্বোধনকারিণী শ্ৰীমতী বুধনি মাঝিন।
জনৈকা আদিবাসী রমণী ও প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে গঠিত এই প্রতিবেদনটি এক অর্থে অসাধারণ, কিন্তু অনেকটাই মিথ্যা।
সত্য ঘটনা হল, বুধনিকে জনতার মধ্য থেকে নেহরু ডেকে আনেননি, তাঁকে ডিভিসি কর্তৃপক্ষ এই কাজের জন্যে মনোনীত করেছিলেন কয়েকমাস আগে থেকেই। তাঁকে রীতিমতো রিহার্সাল দেওয়ানো হয় নিয়মিতভাবে এবং তার সংক্ষিপ্ত সাঁওতালি ভাষণটিও পাখিপড়া করে শেখানো হয়। সবচেয়ে বড় কথা হল, নেহরু তাঁকে নিজের গলার সোনার হার খুলে পরাননি, এই উপলক্ষে একটি রুপোর হাঁসুলি ডিভিসি কর্তৃপক্ষ বুধনির জন্যে বানিয়েছিলেন, সেটাই নেহরু তাকে দেন।
আর সমাজ থেকে নির্বাসন? সে গল্প একেবারেই আলাদা।