দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি ; বেলা দ্বিপ্রহর ; হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হতেছে প্রখর । জনশূন্য পল্লিপথে ধূলি উড়ে যায় মধ্যাহ্ন-বাতাসে ; স্নিগ্ধ অশত্থের ছায় ক্লান্ত বৃদ্ধা ভিখারিণী জীর্ণ বস্ত্র পাতি ঘুমায়ে পড়েছে ; যেন রৌদ্রময়ী রাতি ঝাঁ ঝাঁ করে চারি দিকে নিস্তব্ধ নিঃঝুম — শুধু মোর ঘরে নাহি বিশ্রামের ঘুম । গিয়েছে আশ্বিন — পূজার ছুটির শেষে ফিরে যেতে হবে আজি বহুদূরদেশে সেই কর্মস্থানে । ভৃত্যগণ ব্যস্ত হয়ে বাঁধিছে জিনিসপত্র দড়াদড়ি লয়ে , হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি এ-ঘরে ও-ঘরে । ঘরের গৃহিণী , চক্ষু ছলছল করে , ব্যথিছে বক্ষের কাছে পাষাণের ভার , তবুও সময় তার নাহি কাঁদিবার একদণ্ড তরে ; বিদায়ের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে ফিরে ; যথেষ্ট না হয় মনে যত বাড়ে বোঝা । আমি বলি , ‘ এ কী কাণ্ড! এত ঘট এত পট হাঁড়ি সরা ভাণ্ড বোতল বিছানা বাক্স রাজ্যের বোঝাই কী করিব লয়ে কিছু এর রেখে যাই কিছু লই সাথে । ' সে কথায় কর্ণপাত নাহি করে কোনো জন । ' কী জানি দৈবাৎ এটা ওটা আবশ্যক যদি হয় শেষে তখন কোথায় পাবে বিভুঁই বিদেশে ? সোনামুগ সরু চাল সুপারি ও পান ; ও হাঁড়িতে ঢাকা আছে দুই-চারিখান গুড়ের পাটালি ; কিছু ঝুনা নারিকেল ; দুই ভাণ্ড ভালো রাই-সরিষার তেল ; আমসত্ত্ব আমচুর ; সের দুই দুধ — এই-সব শিশি কৌটা ওষুধবিষুধ । মিষ্টান্ন রহিল কিছু হাঁড়ির ভিতরে , মাথা খাও , ভুলিয়ো না , খেয়ো মনে করে । ' বুঝিনু যুক্তির কথা বৃথা বাক্যব্যয় । বোঝাই হইল উঁচু পর্বতের ন্যায় । তাকানু ঘড়ির পানে , তার পরে ফিরে চাহিনু প্রিয়ার মুখে ; কহিলাম ধীরে , ‘ তবে আসি ' । অমনি ফিরায়ে মুখখানি নতশিরে চক্ষু- ' পরে বস্ত্রাঞ্চল টানি অমঙ্গল অশ্রুজল করিল গোপন । বাহিরে দ্বারের কাছে বসি অন্যমন কন্যা মোর চারি বছরের । এতক্ষণ অন্য দিনে হয়ে যেত স্নান সমাপন , দুটি অন্ন মুখে না তুলিতে আঁখিপাতা মুদিয়া আসিত ঘুমে ; আজি তার মাতা দেখে নাই তারে ; এত বেলা হয়ে যায় নাই স্নানাহার । এতক্ষণ ছায়াপ্রায় ফিরিতেছিল সে মোর কাছে কাছে ঘেঁষে , চাহিয়া দেখিতেছিল মৌন নির্নিমেষে বিদায়ের আয়োজন । শ্রান্তদেহে এবে বাহিরের দ্বারপ্রান্তে কী জানি কী ভেবে চুপিচাপি বসে ছিল । কহিনু যখন ‘ মা গো , আসি ' সে কহিল বিষণ্ন-নয়ন ম্লান মুখে , ‘ যেতে আমি দিব না তোমায় । ' যেখানে আছিল বসে রহিল সেথায় , ধরিল না বাহু মোর , রুধিল না দ্বার , শুধু নিজ হৃদয়ের স্নেহ-অধিকার প্রচারিল — ‘ যেতে আমি দিব না তোমায় ' । তবুও সময় হল শেষ , তবু হায় যেতে দিতে হল । ওরে মোর মূঢ় মেয়ে , কে রে তুই , কোথা হতে কী শকতি পেয়ে কহিলি এমন কথা , এত স্পর্ধাভরে — ‘ যেতে আমি দিব না তোমায় ' ? চরাচরে কাহারে রাখিবি ধরে দুটি ছোটো হাতে গরবিনী , সংগ্রাম করিবি কার সাথে বসি গৃহদ্বারপ্রান্তে শ্রান্ত ক্ষুদ্র দেহ শুধু লয়ে ওইটুকু বুকভরা স্নেহ । ব্যথিত হৃদয় হতে বহু ভয়ে লাজে মর্মের প্রার্থনা শুধু ব্যক্ত করা সাজে এ জগতে , শুধু বলে রাখা ' যেতে দিতে ইচ্ছা নাহি ' । হেন কথা কে পারে বলিতে ‘ যেতে নাহি দিব ' ! শুনি তোর শিশুমুখে স্নেহের প্রবল গর্ববাণী , সকৌতুকে হাসিয়া সংসার টেনে নিয়ে গেল মোরে , তুই শুধু পরাভূত চোখে জল ভরে দুয়ারে রহিলি বসে ছবির মতন , আমি দেখে চলে এনু মুছিয়া নয়ন । চলিতে চলিতে পথে হেরি দুই ধারে শরতের শস্যক্ষেত্র নত শস্যভারে রৌদ্র পোহাইছে । তরুশ্রেণী উদাসীন রাজপথপাশে , চেয়ে আছে সারাদিন আপন ছায়ার পানে । বহে খরবেগ শরতের ভরা গঙ্গা । শুভ্র খণ্ডমেঘ মাতৃদুগ্ধ পরিতৃপ্ত সুখনিদ্রারত সদ্যোজাত সুকুমার গোবৎসের মতো নীলাম্বরে শুয়ে । দীপ্ত রৌদ্রে অনাবৃত যুগ-যুগান্তরক্লান্ত দিগন্তবিস্তৃত ধরণীর পানে চেয়ে ফেলিনু নিশ্বাস । কী গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ , সমস্ত পৃথিবী । চলিতেছি যতদূর শুনিতেছি একমাত্র মর্মান্তিক সুর ‘ যেতে আমি দিব না তোমায় ' । ধরণীর প্রান্ত হতে নীলাভ্রের সর্বপ্রান্ততীর ধ্বনিতেছে চিরকাল অনাদ্যন্ত রবে , ‘ যেতে নাহি দিব । যেতে নাহি দিব । ' সবে কহে ‘ যেতে নাহি দিব ' । তৃণ ক্ষুদ্র অতি তারেও বাঁধিয়া বক্ষে মাতা বসুমতী কহিছেন প্রাণপণে ‘ যেতে নাহি দিব ' । আয়ুক্ষীণ দীপমুখে শিখা নিব-নিব , আঁধারের গ্রাস হতে কে টানিছে তারে কহিতেছে শত বার ' যেতে দিব না রে ' । এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত ছেয়ে সব চেয়ে পুরাতন কথা , সব চেয়ে গভীর ক্রন্দন — ‘ যেতে নাহি দিব ' । হায় , তবু যেতে দিতে হয় , তবু চলে যায় । চলিতেছে এমনি অনাদি কাল হতে । প্রলয়সমুদ্রবাহী সৃজনের স্রোতে প্রসারিত-ব্যগ্র-বাহু জ্বলন্ত-আঁখিতে ‘ দিব না দিব না যেতে ' ডাকিতে ডাকিতে হু হু করে তীব্রবেগে চলে যায় সবে পূর্ণ করি বিশ্বতট আর্ত কলরবে । সম্মুখ-ঊর্মিরে ডাকে পশ্চাতের ঢেউ ‘ দিব না দিব না যেতে ' — নাহি শুনে কেউ নাহি কোনো সাড়া । চারি দিক হতে আজি অবিশ্রাম কর্ণে মোর উঠিতেছে বাজি সেই বিশ্ব-মর্মভেদী করুণ ক্রন্দন মোর কন্যাকণ্ঠস্বরে ; শিশুর মতন বিশ্বের অবোধ বাণী । চিরকাল ধরে যাহা পায় তাই সে হারায় , তবু তো রে শিথিল হল না মুষ্টি , তবু অবিরত সেই চারি বৎসরের কন্যাটির মতো অক্ষুণ্ন প্রেমের গর্বে কহিছে সে ডাকি ‘ যেতে নাহি দিব ' । ম্লান মুখ , অশ্রু-আঁখি , দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে টুটিছে গরব , তবু প্রেম কিছুতে না মানে পরাভব , তবু বিদ্রোহের ভাবে রুদ্ধ কণ্ঠে কয় ‘ যেতে নাহি দিব ' । যত বার পরাজয় তত বার কহে , ‘ আমি ভালোবাসি যারে সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে । আমার আকাঙ্ক্ষা-সম এমন আকুল , এমন সকল-বাড়া , এমন অকূল , এমন প্রবল বিশ্বে কিছু আছে আর! ' এত বলি দর্পভরে করে সে প্রচার ‘ যেতে নাহি দিব ' । তখনি দেখিতে পায় , শুষ্ক তুচ্ছ ধূলি-সম উড়ে চলে যায় একটি নিশ্বাসে তার আদরের ধন ; অশ্রুজলে ভেসে যায় দুইটি নয়ন , ছিন্নমূল তরু-সম পড়ে পৃথ্বীতলে হতগর্ব নতশির । তবু প্রেম বলে , ‘ সত্যভঙ্গ হবে না বিধির । আমি তাঁর পেয়েছি স্বাক্ষর-দেওয়া মহা অঙ্গীকার চির-অধিকার-লিপি । ' — তাই স্ফীত বুকে সর্বশক্তি মরণের মুখের সম্মুখে দাঁড়াইয়া সুকুমার ক্ষীণ তনুলতা বলে , ‘ মৃত্যু তুমি নাই । — হেন গর্বকথা! মৃত্যু হাসে বসি । মরণপীড়িত সেই চিরজীবী প্রেম আচ্ছন্ন করেছে এই অনন্ত সংসার , বিষণ্ন নয়ন- ' পরে অশ্রুবাষ্প-সম , ব্যাকুল আশঙ্কাভরে চির-কম্পমান । আশাহীন শ্রান্ত আশা টানিয়া রেখেছে এক বিষাদ-কুয়াশা বিশ্বময় । আজি যেন পড়িছে নয়নে — দুখানি অবোধ বাহু বিফল বাঁধনে জড়ায়ে পড়িয়া আছে নিখিলেরে ঘিরে , স্তব্ধ সকাতর । চঞ্চল স্রোতের নীরে পড়ে আছে একখানি অচঞ্চল ছায়া — অশ্রুবৃষ্টিভরা কোন্ মেঘের সে মায়া । তাই আজি শুনিতেছি তরুরক মর্মরে এত ব্যাকুলতা ; অলস ঔদাস্যভরে মধ্যাহ্নের তপ্ত বায়ু মিছে খেলা করে শুষ্ক পত্র লয়ে ; বেলা ধীরে যায় চলে ছায়া দীর্ঘতর করি অশত্থের তলে । মেঠো সুরে কাঁদে যেন অনন্তের বাঁশি বিশ্বের প্রান্তর-মাঝে ; শুনিয়া উদাসী বসুন্ধরা বসিয়া আছেন এলোচুলে দূরব্যাপী শস্যক্ষেত্রে জাহ্নবীর কূলে একখানি রৌদ্রপীত হিরণ্য-অঞ্চল বক্ষে টানি দিয়া ; স্থির নয়নযুগল দূর নীলাম্বরে মগ্ন ; মুখে নাহি বাণী । দেখিলাম তাঁর সেই ম্লান মুখখানি সেই দ্বারপ্রান্তে লীন , স্তব্ধ মর্মাহত মোর চারি বৎসরের কন্যাটির মতো ।