যেতে চাইলে যেতে দেব না

যেতে চাইলে যেতে দেব না

অভীক ঘরের ভিতরে পা রাখতেই বাইরের বেঞ্চে বসে থাকা তন্ময় তালুকদার একবার ভুরু তুলে তাকাল৷ তবে নামধাম কিছুই জিজ্ঞেস করল না৷ গত একমাসে অভীককে প্রায় দু-দিন অন্তর আসতে দেখেছে তন্ময়৷ পরিচিত মুখ৷ ভুরু নামিয়ে নিয়ে বলল, ‘ভিতরে আছেন, আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছেন৷’

সকাল দশটায় আসার কথা ছিল অভীকের৷ আপাতত ঘড়িতে দশটা দশ বাজছে৷ তন্ময় জানে ম্যাডাম আপাতত ঘণ্টাখানেক আর ঘর থেকে বেরোবেন না৷ অভীকের কেসটা নিয়ে একটু বেশি আগ্রহী তিনি৷ একটু আগেই কড়া নির্দেশ দিয়ে গেছেন, ‘শোনো, মিস্টার রায় আসছে৷ আপাতত দু-ঘণ্টা যে ক্লায়েন্টই আসুক, বাড়ি পাঠিয়ে দিও…’

‘কিন্তু ম্যাম, শেখর শাসমলের অ্যাপয়েন্টমেন্টটা…’

‘পোস্টপোন করো৷ আই ডোন্ট অয়ান্ট টু সি এনিওয়ান এলস নাও…’

তন্ময় আর কিছু বলেনি৷ ইদানীং ম্যাডামের মেজাজটা সর্বক্ষণই তিরিক্ষি হয়ে থাকে৷

অভীক তার দিকে চেয়ে একটা সৌজন্যের হাসি হেসে ভিতরে ঢুকে গেল৷ তন্ময় একবার উঁকি মেরে দেখল ঘরের ভিতর৷ কিন্তু অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়ল না৷ দরজাটা নিজে থেকে আঁটসাঁট হয়ে বন্ধ হয়ে গেল৷

ঘরের ভিতর ঢুকে একটু এগিয়ে এল অভীক৷ একদিকে জমাট অন্ধকারের মধ্যে ক্ষীণ একটা নীলচে আলো জ্বলে উঠেছে৷ সেই আলোতে একটা মাঝবয়সী মানুষের অবয়ব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷ ঘরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেশ কিছুটা কম করা আছে৷ একটা শিরশিরে ভাব খেলে গেল অভীকের বুকের মধ্যে দিয়ে৷ ওর মনের ভিতরে কে যেন বলে দিল মিস গাঙ্গুলি এখন গভীর কোনও ধ্যানে নিবিষ্ট হয়েছেন৷ গুনগুন করে কী যেন বলে চলেছেন একটানা৷

সে কোনও শব্দ না করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল৷ এবং বসতেই যেন মিস গাঙ্গুলির শরীরে প্রাণ সঞ্চার হল৷ চোখ মেলে একগাল হেসে টেবিলের উপরে রাখা ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিলেন তিনি৷

‘এই যে, এসে গেছ… ডাকোনি কেন বল তো?’

সুরেলা কণ্ঠস্বর৷ ফাঁকা ঘরে যেন আরও মোহময় শোনাচ্ছে গলার আওয়াজটা৷ অভীক একটু লাজুক হাসি হাসে, ‘আসলে ভাবলাম আপনি কোনও সাধনা-টাধনা করছেন হয়তো…’

মিস গাঙ্গুলি মুখ বেঁকালেন, ‘আচ্ছা, তুমি কি আমাকে তান্ত্রিক ফান্ত্রিক গোছের কিছু ভাব নাকি?’

‘না… ঠিক তা নয়…’

‘তা নয় আবার কী? শোনো, এই চারপাশে যা দেখছ তার সবই দেখনদারি৷ ক্লায়েন্টের কাছ থেকে দু-পয়সা বেশি খিঁচে নেওয়ার ছক৷ আসলে…’

বাকি কথাগুলো বলতে বলতে চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন মিস গাঙ্গুলি৷ অভীক বাকি ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে নিল৷ পেছনের দেওয়ালে একগাদা ছবি ঝুলছে, তার মধ্যে গোটাতিনেক বিদেশে তোলা৷ কিছু একটা পুরস্কার হাতে দাঁড়িয়ে আছেন মিস গাঙ্গুলি, হাসি মুখ৷ পাশেই সেই সঙ্গে হাজব্যান্ডের সঙ্গে ছবি৷ সেগুলো থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল অভীক৷

‘আসলে আমার কিছু অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা আছে৷ সাধারণ মানুষের যেমন পাঁচটা ইন্দ্রিয়, আমার তার থেকে একটা অদৃশ্য ইন্দ্রিয় বেশি৷ আর সেটা আছে বলেই এই তোমাদের মতো মানুষকে সাহায্য করতে পারি… অবশ্য…’

মিস গাঙ্গুলির লাস্যময় মুখের দিকে চোখ ফেরাল অভীক, ‘কী?’

‘তোমাকে সাহায্য করার আর একটা উদ্দেশ্য আছে আমার, শুধু টাকাপয়সা ছাড়াও…’

‘জানি…’ উপরে নীচে মাথা নাড়ায় অভীক, ‘লাবণ্য বারবার বলত আপনার কথা৷ ওর সঙ্গে আপনার বন্ধুত্বটা…’

‘উঁহু…’ একটু যেন রুষ্ট হন মিস গাঙ্গুলি, ‘লাবণ্যর কথা বাদ দাও এখন৷ তোমার চোখদুটো…’

‘আমার চোখ৷’

‘হ্যাঁ…’ আচমকাই অভীকের দিকে এগিয়ে আসেন তিনি, ‘চোখের দু’পাশে কালি পড়ে গেছে, বুঝতেই পারি রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয় না, তাও কী অদ্ভুত মায়া আছে চোখে…’

অভীক খাবি খায়৷ কী বলবে ঠিক বুঝে পায় না৷ একটু যেন লজ্জার রেশও দেখা যায় তার থুতনির কাছে৷ সেটা আন্দাজ করেই মিস গাঙ্গুলি দ্রুত ফিরে যান তাঁর চেয়ারে৷ গলার মধ্যে একটা ভারীক্কি ভাব এনে বলেন, ‘আচ্ছা বাদ দাও ওসব৷ আজই কিন্তু ফাইনাল সিটিং, তোমার যা কথা বলার আজই বলে নাও৷ দেন মুভ অন করো…’

অভীক টেবিলের উপরে দুটো হাত রাখে৷ প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটা চেক এগিয়ে দেয় মিস গাঙ্গুলির দিকে৷ পার্সটা খুলতে গিয়ে একদিকের ফ্ল্যাপে লাবণ্যর ছবিটা চোখে পড়ে যায়৷ এখনও একইরকম ভাবে চেয়ে আছে অভীকের দিকে৷ এখনও কী জীবন্ত লাগছে চোখদুটো… ঠিক প্রথমদিন যেমন দেখেছিল… তারপর থেকে যতবার ওই চোখের দিকে চেয়েছে বুকের ভিতরে অজান্তেই একটা শুকনো পাতার ঝড় উঠেছে.. আর আজ শত চেষ্টা করেও আর ফিরে পাবে না ওই চোখদুটোকে…

ঘৃণাভরে চেকটার দিকে চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নেন মিস গাঙ্গুলি, ‘ইটস নট অ্যাবাউট মানি অভীক৷ এভাবে বারবার সিয়ান্সে যাওয়াটা আমাকে শারীরিকভাবে শেষ করে দিচ্ছে… শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে আমার… যে কোনও সময়ে আমি মারাও যেতে পারি৷ তাও কেবল তোমার জন্য গত সপ্তাহে দু-বার সিয়ান্সে গেছি… প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড…’

‘আপনি বুঝতে পারছেন না৷ আমার অনেক কথা বলার আছে ওকে, এভাবে ও চলে গিয়ে…’

অভীকের চোয়াল বুকের উপরে ঝুলে আসে৷ মিস গাঙ্গুলির গলার স্বর একটু নরম হয়, উঠে এসে অভীকের পিঠে একটা হাত রাখেন তিনি, ‘দেখো, এই পৃথিবীতে তুমি একমাত্র মানুষ নও যে স্ত্রীকে হারিয়েছ৷ আমার কাছে সারাদিন থাকলে দেখবে এমন অনেকে আমার কাছে আসে যাদের অবস্থা আরও খারাপ৷ আমি কেন তাদের হেল্প করি জানো? টু হেল্প দেম মুভ অন…’ গাঙ্গুলির হাত পিঠে থেকে মাথায় উঠে আসে, ‘শেষ কথাটুকুনি বলে নেওয়া৷ এটা জেনে নেওয়া যে তাদের প্রিয়জন শান্তিতে আছে… তুমিও আজ সেটুকু জেনে নাও লাবণ্যর থেকে, কেমন?’

অভীক কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকে৷ তারপর উপর নীচে মাথা দোলায়৷ মিস গাঙ্গুলি চেয়ারে ফিরে যান৷

একটু আগে মিস গাঙ্গুলি যেভাবে ওর পিঠে হাত রেখেছিলেন; অভীক কোনও কারণে দুঃখ পেলে বা দুশ্চিন্তায় থাকলে ঠিক সেইভাবেই হাত রাখত লাবণ্য৷ ঠিক ওভাবেই হাতটা পিঠ থেকে মাথায় উঠত৷ অথচ এখন সেই অনুভূতিটার বদলে অস্বস্তি চেপে ধরেছিল অভীককে৷ হয়তো মানুষটা বদলে গেছে বলেই৷

হ্যাঁ, ওরকম মায়ের মতোই কিছু একটা ছিল লাব্যণ্যের মধ্যে৷ মাত্র মাসচারেক চুটিয়ে প্রেম করার পরেই অভীকের মনে হয়েছিল—নাঃ, এই মেয়েটার সঙ্গে বিয়ে না করলেই চলছে না৷ মন দিয়ে ভেবে দেখেছিল অভীক, বিয়ে মেলা ঝামেলার ব্যাপার… হুটহাট বন্ধুদের সঙ্গে হুইস্কির বোতল নিয়ে বসা যাবে না, রাতবিরেতে পুরোনো বান্ধবীর ফোন রিসিভ করা যাবে না, সব থেকে বড়ো কথা ছোটোখাটো আধপাকানো প্রেমের সুতোগুলো একধাক্কায় কচুকাটা হবে… কিন্তু না, সেসব নিয়ে আর আফসোস হয়নি অভীকের…

লাবণ্য ভারী চৌকশ মেয়ে৷ অভীকের ধ্যাদ্ধেরে টু-বিএইচকে ফ্ল্যাটটা এমন যত্ন করে সাজিয়েছিল যে প্রথমদিন অভীক নিজেই ভুল ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েছে ভেবেছিল৷ সমস্ত দায়-দায়িত্ব তার ঘাড়ে তুলে দিয়েছিল অভীক৷ এমনকি বেপথে গেলে নিজেকে ধমকধামক দেওয়ার জগদ্দলটাও৷ কেবল লাবণ্যর একটা ব্যাপার পছন্দ ছিল না অভীকের…

মেয়েটা ভয়ংকর রকম কুসংস্কারাচ্ছন্ন৷ তাবিচ, কবচ, জ্যোতিষ, ঝাড়ফুঁকে তার অগাধ বিশ্বাস৷ তবে সে ছোটোবেলা থেকেই ওরকম নয়৷ কলেজ লাইফে লাবণ্যর বেস্টফ্রেন্ড ছিল ওর ক্লাসমেট অপলা গাঙ্গুলি৷ মহিলার নাকি কিছু অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা আছে৷ তন্ত্র-মন্ত্র করেন, টাকার বিনিময়ে সদ্যমৃত আত্মাদেরও নামিয়ে আনেন, তিনি নিজেই হন মিডিয়াম৷ এই অপলা গাঙ্গুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব করে বা বলা ভালো তার পাল্লায় পড়েই লাবণ্যর মাথাটা খারাপ হয়৷

মিস গাঙ্গুলির সঙ্গে অভীকের আলাপ হয় ওদের বিয়েতে৷ বিয়েতে এসেই অভীককে কানে কানে বলেছিলেন ওদের বিয়েতে নাকি কীসব যোগ আছে৷ বিয়ে বেশিদিন নাও টিকতে পারে৷ সেই থেকেই অভীকের একটা চাপা রাগ রয়ে গেছে মিস গাঙ্গুলির উপরে৷ খুব একটা কথাবার্তা ইচ্ছা করেই বলে না মহিলার সঙ্গে৷ বাড়িতে এলে দুটো ছেঁদো কথা বলে এড়িয়ে যেত৷ এমনকি তাকে বাড়ি অবধি ছাড়তেও যেত না৷ লাবণ্য নিজেই গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসত৷ এবং ছাড়তে গিয়েই ঘটল ঘটনাটা… লাবণ্যই চালাচ্ছিল গাড়িটা৷ কখন সামনে পাঞ্জাব লড়িটা সামনে এসে পড়েছে খেয়াল করেনি…

মিস গাঙ্গুলি এতক্ষণে নিভিয়ে দিয়েছেন ঘরের আলো৷ সেই ক্ষীণ নীলচে আলোটা এসে পড়ছে তাঁর সমস্ত মুখে… নীল চোখে অভীকের দিকে চেয়ে আছেন তিনি৷ ক্রমশ নিভে এল সেটাও৷ ড্রয়ার থেকে বের করে একটা লম্বাটে বিদঘুটে চেহারার মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলেন তিনি৷ তারপর চোখ তুলে তাকালেন অভীকের দিকে৷ দু-হাত বাড়িয়ে অভীকের দুটো হাত চেপে ধরলেন…

‘অভীক, শুনতে পাচ্ছ আমার কথা?’

‘পাচ্ছি…’

‘আমি একটু একটু করে ঘুমিয়ে পড়ব৷ তুমি একমনে ভাবতে থাকো লাবণ্যর কথা৷ ওকে প্রথমবার দেখার কথা, শেষবার দেখার কথা… তোমাদের একসঙ্গে কাটানো সব থেকে প্রিয় মুহূর্তগুলো…’

মিস গাঙ্গুলির গলার আওয়াজ যেন দূরে মিলিয়ে আসে৷ কী যেন আছে সেই নরম গলার স্বরে, কোথায় যেন ভাসিয়ে নিয়ে যায়৷ নাকি ওর নিজের মনের ভিতরেই স্পষ্ট হয়ে গেঁথে আছে স্মৃতিগুলো? সব স্মৃতি কি এত সহজে ভোলো যায়?

* * *

সমুদ্রের ধার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দুটো মানুষ৷ জমাট ফেনা এসে মাঝে মাঝে ছুঁয়ে যাচ্ছে ওদের পা৷ খানিক দূরে কয়েকটা নুলিয়া ছেলে বুকের উপরে মোটা টায়ার চেপে ধরে লাফিয়ে পড়ছে সমুদ্রের উপরে৷ চকচকে রোদ খেলে যাচ্ছে ওদের পিঠে৷ মুহূর্তে জল মেখে উঠে আসছে উপরে৷

শোঁ শোঁ করে জোলো হাওয়া ভেসে আসছে নোনা জলের স্পর্শ মেখে৷ সেই হাওয়াতেই লাবণ্যের চুল উড়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে৷ ওর গায়ে একটা হালকা আকাশি রঙের টিশার্ট৷ কালো সানগ্লাসটা মাথার উপরে তোলা৷ দুপুর পেরিয়ে গেছে৷ ফলে আর দরকার পড়ছে না ওটার৷

নুলিয়া ছেলেগুলোর দিক থেকে লাবণ্যের মুখের দিকে চোখ ফেরায় অভীক৷ বালির দিকে চেয়ে একমনে হাঁটছে সে৷ তার কাঁধে আলতো করে একটা হাত রাখে অভীক, ‘এই কী হল তোমার? এত কী ভাবছ?’

লাবণ্য মুখ ফেরায় না, ‘তোমার জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে জানো?’

 ‘আমার জন্য৷ কীসের?’

‘ঝোঁকের মাথায় হুট করে বিয়েটা করে ফেললে, এবার যদি সব সত্যি হয়ে যায়?’

অভীকের মুখটা ব্যাজার হয়ে গেল, ‘উফ! আবার ওইসব আজগুবি চিন্তাভাবনা শুরু করেছ৷ আর ঝোঁকের মাথায় মানেটা কী?’

‘আজগুবি নয়, বিশ্বাস করো৷ পলা যা বলেছে সব সত্যি হয়েছে এখন অবধি৷ তোমার সঙ্গে আমার প্রেম হবে সেটাও ও আগেই বলেছিল…’

‘হ্যাঁ, এলেন আমার নস্ট্রাডামুসের ভগ্নীপতি, শোনো, আমাদের ব্যাচে আমার থেকে বেটার ছেলে আর ছিল না, তোমার রুচিবোধ যে আছে সেটা ও জানত, ফলে ওটা গেস করা এমন কিছু বীরত্বের কাজ না৷’

‘মানে৷ তুমি আমাকে ছেলেধরা বললে! ভালো ছেলে দেখলাম আর অমনি ছিপ বাড়িয়ে দিলাম!’ লাবণ্য গর্জন করে ওঠে৷

‘আজ্ঞে না এই মাছ জল থেকেই লাফাতে লাফাতে এসে তোমার হাড়ির ভিতর ঢুকেছে ভাজা হবে বলে…’

‘ধুর তুমি ইয়ার্কি মেরো না তো৷ কত লোককে হেল্প করে ও৷ কত সন্তান হারা বাবা-মা মানুষ ওর চেম্বার থেকে হাসি মুখ নিয়ে ফিরে যায়…’

অভীক কী যেন ভাবে, তারপর লাবণ্যর কপাল থেকে চশমাটা খুলে নিয়ে বলে, ‘শোনো, মিস গাঙ্গুলির এই ভূত নামানোর ব্যাপারটা না; এই সানগ্লাসটার মতো৷ কিছুক্ষণের জন্য আমাদের চোখের সামনে একটা কালো পরদা টেনে দেয়৷ আমাদের মনে হয় সত্যি রোদ নেই৷ চোখটাও আরাম পায়৷ তবে সেটা সত্যি নয়৷ এদিকে সানগ্লাসটা যে শুধু রোদ ঢাকে তা তো নয়, আমাদের সামনে সব কিছুকেই কালো করে দেয়৷ ফলে রোদ যখন নেই তখন এটা পরে থাকার মানে হয় না…’

আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল লাবণ্য, অভীক থামিয়ে দেয় তাকে, ভুরু কুঁচকে তার চোখের দিকে চেয়ে বলে, ‘এই দাঁড়াও দাঁড়াও… কী যেন আছে তোমার চোখে?’

‘কী?’ ডাগর চোখ তুলে তাকায় লাবণ্য৷ তাও ভুরু কুঁচকে যায়৷

‘ছিপ…’

রাগতে গিয়েও হেসে ফেলে লাবণ্য৷ একটা হাতে অভীকের হাতটা ধরে ফেলে৷ তারপর আবার হাঁটতে থাকে বালির উপর দিয়ে…

একটু পরে আর একটু গাঢ় হয়ে আসে সন্ধেটা৷ নুলিয়া ছেলেগুলো সরে পড়ে কোথায়৷ যেন সমুদ্রের বুকেই লুকিয়ে পড়ে৷ তার বদলে বিচটা ভরে যায় আইসক্রিমের স্টল, বেলুনওয়ালা, লণ্ঠনওয়ালা আর সন্ধেবেলা ঘুরতে আসা টুরিস্টের সমাগমে৷

ফেরিওয়ালার থেকে একটা হলদে আলোর লণ্ঠন কেনে লাবণ্য৷ সেটা হাতে নিয়ে বিচের উপরেই একচিলতে ফাঁকা জায়গা খুঁজে নেয় ওরা৷ ছোটো একটা শিশু নারকেল গাছের গুঁড়ির উপরে ঠেস দিয়ে বসে৷ একটু দূরেই একটা টুরিস্ট পার্টির ব্লুটুথ স্পিকারে গান বাজছে৷ স্পিকারটাকে ঘিরে লোক জড়ো হয়েছে৷ হাততালি পড়ছে থেকে থেকে৷ গলা মেলাচ্ছে কেউ কেউ৷ মায়াবী লাগছে পরিবেশটা…. ‘তুমি থেকে থেকে আমার দিকে তাকাচ্ছ কেন বলতো?’

অভীক হেসে ফেলে, ‘কী জানি, কেমন অচেনা লাগছে তোমাকে…’

‘মানে?’

‘মানে আমার সেই কলেজে পড়া ছটফটে ভালোমানুষ বান্ধবী বলে আর মনে হচ্ছে না…’

‘হলে ভালো হত?’ লাবণ্যের গলায় কৌতূহল, ‘বা যদি ধরো আমি বান্ধবী হয়েই আজীবন রয়ে যেতাম?’

হঠাৎ কী যেন ভেবে সিরিয়াস হয়ে যায় অভীক, চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে চাপা গলায় বলে, ‘একটা সিক্রেট বলছি তোমাকে, কাউকে বোলো না কখনও৷’

‘বেশ৷ বলো৷’

‘যশ চোপড়ার সিনেমা কিংবা সুনীল গাঙ্গুলির উপন্যাস যাই বলুক না কেন, কাউকে ভালোবাসলে সব থেকে কঠিন কাজ—তাকে আদৌ ভালোবাসি কি না বোঝা৷’

‘সে কী! তাহলে লোকে বুঝবে কী করে?’

অভীক কাঁধ ঝাঁকায়, ‘বোঝার উপায় নেই৷ কারও সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগলে, ভাইবস ম্যাচ করলেই তার সঙ্গে সময় কাটাতে ভালো লাগে আমাদের৷ সেটা ভালোবাসা হতেও পারে নাও হতে পারে, বোঝার উপায় নেই৷ তবে…’

‘তবে কী?’

অভীক বাঁকা হাসি হাসে, ‘একটাই প্রসেস আছে৷ ছোটোবেলায় আমরা উত্তর দেখে গোঁজামিলে অঙ্ক মেলাতাম৷ মনে আছে? এও সেই জিনিস৷ তোমার জীবনের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে সে থাকলে কেমন হবে সেটা ভেবো না, চোখ বুজে ভাবো সে না থাকলে কেমন হবে৷ তোমার প্রথম চাকরি পাওয়া, প্রথম লাইভ পারফরমেন্স, বুড়ো বয়সে প্রথম দাঁত পড়ে যাওয়া, জীবন যখন একটু একটু করে জানাবে সে শেষ হয়ে আসছে তখন কার হাতটা পিঠের উপরে চাও তুমি…’

‘তারপর?’

‘ভাবলাম, তারপর খুব কষ্ট হল, জানো, ভয়ও লাগল হেব্বি৷ মনে হল একটা মিনিংলেস লাইফ কাটবে৷ বোরিং, ভাটের জীবন শালা৷’

বালির উপরেই মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল লাবণ্য৷ তার চোখ দুটো আকাশের দিকে স্থির হয়ে আছে৷ থমথমে গলায় প্রশ্ন করে, ‘আর যদি সত্যি না কাটাতে পারো?’

‘উঁহ… আবার তুমি ওই ভণ্ডটার…’

‘চুপ… শোনো…’

‘কী?’

‘যদি সত্যি তেমন হয় তাহলে পলাকে গিয়ে বলবে তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাও৷ আমার অনেক কিছু বলার থাকবে তোমাকে… অনেক গোপন কথা…’

‘এসব কী বলছ তুমি… ধুর…’

‘প্রমিস করো প্লিজ… অনেক কিছু বলার থাকবে আমার তোমাকে…’

‘এখন বলতে কী সমস্যা তোমার?’

‘উঁহু, তখনই বলব৷ ওটা আমার সিক্রেট৷’

‘বেশ…’

গানের আওয়াজ এখন বেড়ে উঠেছে আরও৷ ওদের কথা আর শোনা যায় না৷ লাবণ্যের পাশেই বালির উপরে শুয়ে পড়ে অভীক৷ আকাশের বুকে টিমটাম করে জ্বলতে থাকা তারাগুলোর দিকে চেয়ে থাকে দু-জনে৷ দূরে কারও ব্লটুথ স্পিকারে গানের সুর বাজতে থাকে,

‘ওরে নয়নেতে নয়ন দিয়ে রাখব তারে৷

চলে গেলে, চলে গেলে যেতে দেবো না,’

* * *

‘আমাদের সঙ্গে কেউ আছেন?’

ধরা গলায় প্রশ্ন করে অভীক৷ টেবিলের পায়ার দিক থেকে চাপা কম্পনের শব্দ আসছে৷ মোমবাতির শিখাটাও অস্থির হয়ে উঠেছে৷ অথচ বদ্ধ ঘরের কোথাও কোনও হাওয়া নেই৷ ঘরের তাপমাত্রা নিজে থেকেই একধাপ বেড়ে উঠেছে৷

আচমকা টেবিলের উপরে নুয়ে পড়া মাথাটা তুলে তাকালেন মিস গাঙ্গুলি৷ চোখদুটো স্থির হয়ে গেছে৷ একটানা তিনি তাকিয়ে আছেন অভীকের দিকে৷ ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি ঝুলছে৷ যেন ভিতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো বদলে কেবল আগের খোলটা রেখে গেছে কেউ…

‘কেউ কি…’

‘আছি…’ চেনা গলা ভেসে আসে, তাও গলাটা চিনতে পারে না অভীক৷ হাড় হিম করা গম্ভীর গলা৷ গলকণ্ঠটা ওঠানামা করে অভীকের৷

‘কেমন আছো লাবণ্য?’ কাঁপা গলায় সে ডাকে৷

‘আমি লাবণ্য নই…’ আবার সেইরকম গুরুগম্ভীর গলা৷ হাসির রেখাটা আর একটু বড় হয়৷

‘তাহলে কে তুমি?’

‘আমি মঞ্জুলিকা…’ ঘর কাঁপিয়ে কথাটা বলেই খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে ওঠে লাবণ্য৷ অভীক প্রায় চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিল৷

‘এই তোমার মনে আছে তুমি ভুলভুলাইয়া দেখেও ভয় পেয়েছিলে… উফ কী ভীতু রে বাবা! এই এই…’ হঠাৎ কী যেন দেখে গর্জে ওঠে লাবণ্য, ‘তুমি পলার হাত ধরে বসে আছো কেন? ছাড়ো বলছি…’

‘কিন্তু প্ল্যানচেটে তো হাত ধরে বসাই নিয়ম…’ অভীক অবাক হয়ে বলে৷

‘ইয়ার্কি? মোমবাতি জ্বেলে, হাত ধরে লোকে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করে, প্ল্যানচেট না…’

‘ডিনার! তো খাবার দাবার কোথায়?’

‘আমার মাথাটাই খাবে তোমরা দু-জন মিলে৷ আর শোনো, সবাই তোমার মতো হ্যাংলা নয়৷ ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে লোকে খাবার না, চুমু খায়…’

অভীক কী যেন ভেবে বলে, ‘আচ্ছা এখন চুমু খেলে সেটা কি তোমাকে খাওয়া হবে না মিস গাঙ্গুলিকে? নাকি নেক্রোফিলিয়া?’

‘ঘাড় ভেঙে দেব হতভাগা…’ গর্জে ওঠে লাবণ্য, ‘আর শোনো, তুমি এই ঘন ঘন পলার কাছে আসবে না৷ তোমাকে নিয়ে ওর গতিক ভালো নয়৷’

‘আহা…’ ভেংচি কাটে অভীক, ‘পলাকে আমি চোখ বুজে বিশ্বাস করি, নাও, এবার তুমি চোখ বুজতেই বিশ্বাসের নমুনা দিচ্ছে৷ আগেই বলেছিলাম এই জ্যোতিষী, তান্ত্রিক ফান্ত্রিকগুলো এক নম্বরের ধাপ্পাবাজ…’

‘ফলে তো গেল; গেলাম তো আমি মরে৷’

থুতনিতে হাত ঘষছিল অভীক, মুখ তুলে বলল, ‘কিন্তু ওর কাছে না এলে তোমার সঙ্গে কথা বলব কী করে?’

‘সে আমি জানি না৷ অন্য মিডিয়াম খোঁজো…’

‘কিন্তু তুমি এতটা শিওর হচ্ছ কী করে?’

রাগত চোখে অভীকের দিকে তাকায় লাবণ্য, ‘ওর মাথার ভিতরে আমি আছি না তুমি? এই…’

মুখ তুলে তাকায় অভীক, ‘কী?’

‘ছবিগুলো দাও না…’

ব্যাগ খুলে একটা খাম থেকে কয়েকটা ছবি বের করে মিস গাঙ্গুলির দিকে এগিয়ে দেয় অভীক৷ হাতে করে ধরে সেগুলো চোখের সামনে তুলে ধরেন তিনি৷ স্থির চোখে সেইভাবেই চেয়ে থাকেন৷

লাবণ্যর একটা হাত অভীকের কাঁধে, অন্য হাতে হাত গালদুটো টিপে রেখেছে৷ কোনওটায় খামচে ধরে রেখেছে চুলগুলো, কোনওটায় ঘুমন্ত লাবণ্যের কপালে গাধা লিখে দিচ্ছে অভীক… দেড় বছরের সুখস্মৃতি…

‘আমাদের আর এইভাবে ছবি তোলা হবে না, তাই না?’ এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে তার চোখ দিয়ে৷

‘না হোক, এগুলো তো আছে, এগুলো দেখতে দেখতেই কেটে যাবে…’ ছবিগুলো টেবিলে নামিয়ে রাখেন মিস গাঙ্গুলি, ‘একটা সত্যি কথা বলবে?’

‘কী?’

‘তোমার এখনও আফশোস হয় না?’

অভীক দু-দিকে মাথা নাড়ে৷

‘হয়তো আজই আমাদের শেষ কথা হচ্ছে, জানি না কতদিন এভাবে আসতে পারব৷ এটা জেনেও হয় না?’

‘না…’

‘কেন?’

কথাটার আর উত্তর দেয় না অভীক৷ বরঞ্চ একবার চারপাশটা দেখে নেয়৷ মিস গাঙ্গুলির মুখটা লাল হয়ে উঠেছে৷ বোঝা যাচ্ছে শারীরিক কষ্ট শুরু হয়েছে তার৷ সে একটু থেমে বলে, ‘তোমার কী যেন বলার ছিল আমাকে…’

‘হ্যাঁ৷ আমাকে একবার একটা প্রমাণ দিতে পারবে? জাস্ট একবার…’

‘কীসের প্রমাণ?’

‘যেটা প্রমিস করেছিলে৷ মৃত্যুর পরেও ভালোবাসবে আমাকে৷ সবসময়?’ অভীক উত্তর দেয় না৷ ভাবুক দেখায় তাকে৷

‘সারাজীবন তোমার উপরে নজর রাখতে পারব না৷ রাখতে চাইও না৷ শুধু যাবার আগে একটু শান্তি নিয়ে যেতে চাই, যেটা আমার ছিল সেটা আমারই থাকবে…. আমি চলে গেলেও আমাকে যেতে দেবে না, তোমার মনের ভিতর থেকে…’ আচমকাই দ্রুত উত্তর দেয় অভীক, ‘বেশ, দেব, পরের দিন দেব৷ আজ…’ নিজের নাক দিয়ে যে রক্ত বের হচ্ছে সেটা বুঝতে পারে লাবণ্য৷ তার মাথাটা দ্রুত নেমে আসে টেবিলে রাখা ছবিগুলোর উপরে৷ টেবিলে পড়ে চোট লাগার আসেই একটা হাত বাড়িয়ে মাথাটা ধরে নেয় অভীক৷ উদ্বিগ্ন গলায় বলে, ‘মিস গাঙ্গুলি…’

সাড়া আসে না৷ টেবিল থেকে জলের বোতল নিয়ে হালকা জলের ছিটে দেয় মহিলার মুখে৷ মিনিটখানেক পরে ধীরেসুস্থে চোখ মেলে তাকান তিনি৷ দুটো হাত মুখের উপরে এনে চুল সরিয়ে দেন৷ অভীকের মায়াভরা চোখদুটোর দিকে চেয়ে একটা নরম হাসি হাসেন, ‘হল কথা?’

‘আপনার শরীর ঠিক লাগছে তো?’

‘ওই আর কী…’ কাষ্ঠহাসি হাসেন তিনি, ‘তোমার জন্য ওটুকু সহ্য করে নেওয়া যায়৷’

অভীক মিস গাঙ্গুলির মাথাটা হাতের উপরে নেয়৷

মহিলা নিজেই টেবিল থেকে রুমাল তুলে নাক থেকে বেরিয়ে আসা রক্তটা মুছে নেন৷ ‘আপনাকে আর একদিন ডিস্টার্ব করব আমি৷ একটা শেষ কথা বলার আছে ওকে৷’

উপরে নীচে মাথা নাড়ালেন মিস গাঙ্গুলি, ‘বেশ, নেক্সট উইক এসো…’

অভীকের মনে হয় মিস অপলা গাঙ্গুলি ওকে স্নেহ করেন৷ নিজের শরীরের এতটা ক্ষতি করেও ওর মনের কষ্ট যেভাবেই হোক দূর করতে চান৷ মনটা নরম হয়ে আসে ওর…

‘বেশ, আমি সোমবার আসব আবার…’

চেকটা আর একবার এগিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় অভীক৷ বাইরে বসে থাকা লোকটা একবার ডাক দেয় ওকে, ‘দাদা, উনি কি…’

কথাটায় কান দেয় না সে৷

* * *

বারবার ঘড়ি দেখছিল অভীক৷ লাবণ্যর ফোনটা নট রিচেবল বলছে৷ সেই দেড় ঘণ্টা আগে বেরিয়েছে গাড়ি নিয়ে৷ এতক্ষণ তো ফিরে আসার কথা৷ অস্থির লাগছে তার৷ মিস গাঙ্গুলির ফোনটাও বাজছে না৷ মনটা কু ডাকতে থাকে অভীকের৷ ঘড়ির কাঁটা একঘেয়ে ছন্দে এগিয়ে চলেছে, টিক-টিক, টিক-

এমন সময়ে বেজে ওঠে ফোনটা৷ আননোন নম্বর৷ দ্রুত রিসিভ করে সেটা কানে দেয় অভীক৷ ওপাশ থেকে অপরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘হ্যালো… স্যার আপনার বাড়ির লোকের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, আমি স্পট থেকে বলছি৷ আপনি প্লিজ তাড়াতাড়ি চলে আসুন… গাড়িটা…’

‘ওয়াট ডু ইউ মিন৷’ চিৎকার করে ওঠে অভীক, ‘গাড়িটা… আমার স্ত্রী চালাচ্ছিল গাড়িটা…’

‘সরি স্যার…’ ওপাশের মানুষটার গলা কেঁপে যায়, ‘সঙ্গে যিনি ছিলেন তাঁর চোট অল্প… তবে আপনার স্ত্রী আর বেঁচে নেই৷ স্পট ডেথ…’ মুহূর্তে অভীকের মনে পড়ে যায় দেড়টা বছর৷ এই মানুষটা তো হাতের কাছেই ছিল এতদিন৷ ভীষণ বাস্তব হয়ে৷ চাইলেই তাকে স্পর্শ করা যেত৷ রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে তার চাদরের দাগ বসে যাওয়া ঘুমন্ত মুখটা দেখা যেত, সন্ধেয় যখন ব্যালকনিতে ঝুলন্ত দোলনাটায় দোল খেত সে, অভীক অফিস থেকে ফিরে ওকে না জানিয়েই অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকত ওর দুলন্ত চুলগুলোর দিকে৷ যেন বারবার আকাশের দিকে উড়ে যেতে গিয়ে আবার ফিরে আসছে ওর দিকে৷ দোলনাটা ফাঁকা পড়ে থাকবে? চাইলেই আর গলার আওয়াজটা শুনতে পাবে না?

অভীক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল কি না মনে নেই৷ কেবল মনে পড়েছিল একটা দিনের কথা৷ একটা গলন্ত সন্ধের কথা৷ কলেজ ছুটির পর অনেকক্ষণ কলেজের লাগোয়া মাঠে বসেছিল ওরা৷ সিমেন্টের বেঞ্চের উপরে ভাঙা ইটের টুকরো দিয়ে নিজের নাম লিখছিল লাবণ্য৷ য-ফলাটা না দিয়েই ইটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলেছিল, ‘দেখ ভাই, রূপ দেখে প্রেম করতে চাইছিস, করব৷ আমারও তেমন আপত্তি নেই৷ কিন্তু আমার বাড়ির লোক বলে আমি নাকি পাগল-ছাগল মানুষ৷ সামলাতে পারবি তো?’

‘আমি রূপ দেখে…’

‘আঃ… সেকেন্ড পার্টটা ইম্পরট্যান্ট…’

‘পারব৷’

লাবণ্য কাঁধ ঝাঁকিয়েছিল, ‘কী জানি, মুখ দেখে মনে হচ্ছে না পারবি বলে৷ আচ্ছা যদি এরকম হয় আমার আর ভালো লাগল না তোর সঙ্গে?’

 ‘বললাম না, আমার মাথার ঠিক নেই৷ একদিন মনে হল আর ভালো লাগছে না? চলে যেতে চাইলে?’

‘যেতে দেব না…’

সেদিন ঠিক কী ভেবে কথাটা বলেছিল অভীক সে নিজেও জানে না৷ কিন্তু আজ? আজ কি আটকে রাখতে পারবে? হয়তো আজকে চিরকালের মতো চলেই গেছে লাবণ্য৷ সব ধরাছোঁয়ার বাইরে…

* * *

‘ম্যাডাম… ম্যাডাম, শুনছেন?’ তন্ময় তালুকদারের গলাটা কানে আসতে একটু একটু করে হুঁশ ফিরল মিস গাঙ্গুলির৷ চোখ মেলে তাকিয়ে চারপাশটা ঠাহর করতে পারলেন তিনি৷ কোমরে ভর দিয়ে উঠে বসলেন৷

অভিরূপের মুখ থেকে দুশ্চিন্তার মেঘ কাটল৷ ঘড়ির দিকে একবার চেয়ে দেখে বলল, ‘কতক্ষণ এভাবে পড়ে আছেন বলুন তো?’

‘কী করে জানব বলো? দোষ তো তোমার৷’

‘আমার! কী দোষ?’

‘কতদিন তোমাকে বলেছি আমার ঘরে আয়না রাখবে না৷ আয়না স্পিরিচুয়ালিটি রিফ্লেক্ট করে৷ আমার শরীরের পক্ষে ওটা খারাপ…’

তালুকদার জিভ কাটে৷ আজ সকালেই ভুল করে একটা ক্যালেন্ডার রেখে গেছিল ম্যামের ঘরে৷ সেটার সঙ্গে যে ছোটো একটা আয়না লাগানো ছিল মনেই ছিল না৷

‘শরীর খুব খারাপ লাগছে?’ সে উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করে৷

মিস গাঙ্গুলি কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় দরজার কাছে পায়ের আওয়াজ শুনে মুখ তুলে তাকালেন৷ অভীক এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়৷

একটু অবাক হল তালুকদার৷ লোকটা অন্যদিন আসে উদভ্রান্তের মতো৷ চোখমুখ দেখে ঝড় পালানো কাক মনে হয়৷ আজ রীতিমতো সাজগোজ করে এসেছে৷ হালকা পারফিউমের গন্ধ আসছে৷ পায়ের জুতোটার উপরেও নতুন পালিশ চেপেছে৷

‘আসুন… ম্যামের একটু শরীর খারাপ লাগছিল আসলে…’ এগোতে এগোতে বলে সে৷

‘সেকি! কী হয়েছে ওনার?’ অভীক দ্রুত কাছে এগিয়ে আসে৷

‘আরে তেমন কিছু না, জাস্ট একটু…’ কথাটা বলেই তালুকদারকে নির্দেশ দেন তিনি, ‘এই তুমি এসো এখন, আপাতত কাউকে আসতে দিও না এখানে৷’

তালুকদার বেরিয়ে যেতে দরজাটা আবার শক্ত হয়ে বন্ধ হয়ে যায়৷ মুখে হাত চাপা দিয়ে একবার কাশেন মিস গাঙ্গুলি৷ তারপর মুখে হাসি এনে বলেন, ‘চলো, আর দেরি করে লাভ কী…’

‘আপনার শরীর…’

‘ঠিক আছি আমি৷ তুমি একবার কথা বলে নাও ওর সঙ্গে… শেষবারের মতো…’ এবার হাসে অভীক৷ ঘরের নিভু নিভু আলোয় ভারী মায়াবী দেখাচ্ছে তার মুখটা৷ সেদিকে চেয়ে মিস গাঙ্গুলির কেমন যেন ঘোর লাগে৷ সদ্য স্ত্রীকে হারানো মিস্টার রায় নয়, কলেজে পড়া এক স্বপ্নালু যুবক এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে৷ দীর্ঘ, ঋজু চেহারা, যত্ন করে আঁচড়ানো চুল৷ আজ অভিসারের সাজে তার সামনে এসেছে অভীক৷

মনের ভিতরে চেপে বসতে থাকা ঘোরটা কাটানোর জন্যে বললেন, ‘একি দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বসো না…’

‘উঁহু, আমি না৷ আপনি বসুন…’ গলার স্বরে যেন মুগ্ধতা ঝরে পড়ছে৷

‘তোমার কী হয়েছে বলো তো?’ অবাক হয়ে চেয়ারে বসতে বসতে প্রশ্ন করেন তিনি৷

অভীক তাঁর দিকে এগিয়ে আসে, স্থির চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে মুখের দিকে৷ যেন চোখ দুটো মিস গাঙ্গুলির চোখে হারিয়ে গেছে তার৷

‘আরে… দেরি করছ কেন বলো তো? শুরু করি?’

‘কী শুরু করবেন?’

‘কী আবার? সিয়ান্স৷ লাবণ্যর সঙ্গে…’

‘লাবণ্য!’ যেন আকাশ থেকে পড়ে অভীক, ‘আজ ওর সঙ্গে তো দরকার নেই আমার৷ দরকার আপনার সঙ্গে৷’

‘আমার সঙ্গে!’ এবার মিস গাঙ্গুলির ভয় লাগতে শুরু করেছে৷ ছেলেটার মধ্যে কিছু যেন বদলে গেছে৷

‘কোনও মৃত মানুষের সঙ্গে কথা বলতে আসিনি আমি আজ৷ আজ আপনার সঙ্গে দরকার আমার… একবার তাকান তো এদিকে…’

আচমকাই অপলার চেয়ারটাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় অভীক৷ তারপর ওর পায়ের কাছে বসে পড়ে, ‘আপনাকে একটা কথা বলার আছে আমার৷’

‘কী কথা?’

আরও কাছে এগিয়ে আসে অভীক, মুখটা ভীষণ অস্পষ্ট হয়ে গেছে তার, ‘আমি এর মধ্যে ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে…’

‘সত্যি বলছ তুমি? নাকি…’ থমথমে গলায় বলে অপলা৷

একদম সত্যি… লাবণ্যের থেকে অনেক বেশি৷’

কী যেন একটা আবেশে স্তব্ধ হয়ে যায় অপলা৷ তার চুলগুলো অজান্তেই কানের পাশ থেকে সরে মুখের সামনে এসে পড়ে৷ ঠোঁটদুটো কেঁপে ওঠে তিরতির করে… ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে এগিয়ে চলে…. ঠান্ডা ঘরের ভিতরে ঘন গভীর কিছু মুহূর্ত মহাসমুদ্রের জলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকে৷

আচমকাই অভীকের কাঁধে দুটো শক্ত পায়ের লাথি এসে পড়ে, ঘর কাঁপিয়ে একটা চিৎকার শোনা যায়, ‘শালা বউদিবাজ কোথাকার…’

‘একি তুমি কোথা থেকে এলে৷ আমরা তো প্ল্যানচেট করিনি এখনও…’ লাবণ্যর গলা পেয়ে ভড়কে গেছে অভীক৷ মাটির উপরে চিত হয়ে পড়ে কোনওরকমে সামলে নিতে নিতে বলে সে৷

‘প্ল্যানচেট চুলোর দুয়োরে গেছে৷ তোমার লজ্জা করে না? বলেছিলাম চিরকাল আমাকে ভালোবাসবে তার প্রমাণ দিতে আর তুমি কি না…’

উঠে বসে ঘাড় চুলকায় অভীক৷ তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে ব্যাজার মুখ করে ফলে, ‘ওসব প্রমাণ-টমান দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷’

‘তাহলে বলেছিলে কেন?’ খ্যাপা সিংহীর মতো গর্জন করে লাবণ্য৷

এবার অভীকের মুখে একটা মিচকে শয়তানের হাসি খেলে যায়, সামনে ঝুঁকে ফিশফিশে গলায় সে বলে, ‘তোমাকে প্রমাণ দেওয়া সম্ভব নয় যে তোমাকে মরার পরেও ভালোবাসব, কারণ তুমি মরোইনি৷’

‘মানে?’ একটা মিশ্র অনুভূতি খেলে যায় মিস গাঙ্গুলির মুখে৷

‘মানে পরে বুঝবে৷ আগে বলো প্ল্যানচেট না করা সত্ত্বেও তুমি হাজির হলে কী করে?’

এবার একটু থতমত দেখায় মিস গাঙ্গুলিকে৷ কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারেন না তিনি, ‘তাই তো…’

গলা তুলে কার উদ্দেশ্যে যেন হাঁক পাড়ে অভীক, ‘ডাক্তার তালুকদার, একবার ভিতরে আসুন তো…’

দরজা খুলে সটান ঘরে ঢোকে তালুকদার৷ তার মুখেও মিচকে হাসি৷ অভীকের চোখের ইশারায় ক্যালেন্ডারের আয়নাটা মিস গাঙ্গুলির মুখের সামনে তুলে ধরে সে৷ চোখ সরিয়ে নিতে গিয়েও থেমে যান তিনি… জবুথবু হয়ে তাকিয়ে থাকেন আয়নায় ফুটে ওঠা মানুষটার মুখের দিকে৷ এ মুখ তো তার চেনা… লাবণ্য রায়… এগিয়ে এসে স্ত্রীর দু-কাঁধে দুটো হাত রেখে বলতে থাকে অভীক, ‘সেদিন মিস গাঙ্গুলিকে বাড়ি দিয়ে আসার সময় তুমি গাড়ি চালাচ্ছিলে না৷ চালাচ্ছিলেন মিস গাঙ্গুলি৷ অ্যাক্সিডেন্টে তিনি মারা যান, তোমার মাথায় মাইনর চোট লাগে৷ ছোটো থেকেই তুমি মানসিকভাবে সুস্থ নও, কাছের বান্ধবীকে রক্তাক্ত অবস্থায় মারা যেতে দেখেছ নিজের চোখের সামনে, তার উপরে কাজ করেছে মিস গাঙ্গুলির প্রফেসি, এবং সেটার উপরে তোমার অন্ধবিশ্বাস৷ হসপিটাল থেকে আমাকে জানায় শরীরে চোট না লাগলেও তোমার মনের উপর প্রভাব পড়েছে অ্যাক্সিডেন্টে৷ তুমি নিজেকে মিস গাঙ্গুলি ভাবতে শুরু করেছ…’ একটু থেমে স্ত্রীর মাথার চুল এলোমেলো করে দেয় অভীক, আয়নাটা সরিয়ে নেয় মুখের সামনে থেকে৷

‘তোমরা কী বলছ এসব…’

‘আমি পড়ি মুশকিলে৷ তুমি বাড়িতে থাকতে চাও না, মিস গাঙ্গুলির অফিসে চলে আসো বারবার৷ তাঁর লাইফটা নিজের লাইফ মনে করো৷ এমনকি গলার আওয়াজটা পর্যন্ত তাঁর মতো নকল করতে থাকো… ডাক্তার বলেন যে সিভিয়ার ট্রমার ফলে আইডেন্টিটা ডিসঅর্ডারে ভুগছ তুমি…’

‘কিন্তু তাহলে এত প্ল্যানচেট করে…’

তালুকদার অভীকের মুখ থেকে কথা কেড়ে নেয়, ‘প্ল্যানচেটটাও আমাদের প্ল্যানেরই অংশ মিস রায়৷ অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে আপনি দুটো আইডেন্টিটি ক্যারি করতে থাকেন৷ যার মধ্যে মিস গাঙ্গুলি আইডেন্টিটিটা ডমিন্যান্ট৷ আমাদের এমন কিছু করতে হত যাতে সাবকন্সাসে থাকা লাবণ্য রায়ের আইডেন্টিটিটা এগিয়ে আসে৷’

‘তার জন্যেই…’

‘তার জন্যেই আজ তুমি পলাকে প্রপোজ করলে…’ অভীকের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে বলে লাবণ্য৷

বড়ো করে নিঃশ্বাস নেয় অভীক, ‘যাই বলো, বিবাহিত মহিলাদের মনে বান্ধবীর রক্তাক্ত মৃত্যু, প্রফেসি, ট্রমার থেকে বড়ো অনুভূতি হল পজেশন৷ ওর থেকে বড়ো শক আর কিছু দেওয়া যেত না…’

‘শাট আপ… আর একটা কথা বললে তোমার মুখে আমি মরার খুলি ছুড়ে মারব…’

অভীক গর্জে ওঠে, ‘তা তো এখন মারবেই৷ আমি শালা আগেই বলেছিলাম ওইসব প্ল্যানঞ্চেট ফ্যাঞ্চেট সব বুজরুকি… করো, আরও বিশ্বাস করো…’

চেয়ার থেকে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে যায় লাবণ্য৷ বাইরের বারান্দাটায় একঝাঁক দুপুরের রোদ এসে পড়েছে এখন৷ তারই একদিকে দাঁড়িয়ে একমনে সিগারেটে টান দিচ্ছেন ডাক্তার তালুকদার৷ লাবণ্যকে বেরিয়ে আসতে দেখে নরম গলায় প্রশ্ন করলেন তিনি, ‘বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে নিন একবার৷ রোগ-টোগ সেরে গেছে একদম…’

‘উনি…’ অভীকের দিকে ফিরে প্রশ্ন করে লাবণ্য৷

‘তোমার ডাক্তার৷ আমার বন্ধু৷ ওর আন্ডারেই চিকিৎসা চলছিল তোমার… এই ক-দিনে কম্পাউন্ডার ভেবে কী না কী বলে গেছো ওকে…’

শরীরটা ঝিমিয়ে আসছিল লাবণ্যর৷ মাথার ভিতরে ঝিমঝিম একটা ব্যথা ধরে রয়েছে৷ তাও ভারী ঠান্ডা লাগছে মাথাটা৷ এগিয়ে এসে অভীকের একটা হাত চেপে ধরে সে, ‘ধুর, আমার আর ভালো লাগছে না৷ বাড়ি চলো৷’

 ‘সেই ভালো, দোলনাটা কতদিন ফাঁকা পড়ে আছে তোমার জন্য…’

সিগারেটটা ফেলার জন্য বারান্দার জানলাটা খুলে দেন ডাক্তার তালুকদার৷ সেটা খুলতেই বাইরের জমজমাট দুপুরের কলকাতা শহর স্পষ্ট হয়ে ওঠে৷ ঠেলা রিক্সার উপরে ঘুমন্ত চালককে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে লাল কাপড়ে ঢাকা ফুচকার গাড়ি, উঁচু ফ্ল্যাটগুলোর বারান্দায় শুকোতে দেওয়া শাড়ি আর ট্রাউজার, অ্যান্টেনার পাশে এসে বসা পায়রা আর পাতিকাক, ভীষণ চেনা একটা শহর৷ পাশে দাঁড়ানো মানুষটার মতোই৷

সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে সামনে এগোতে যাচ্ছিল লাবণ্য৷ অভীক হাত ধরে থামিয়ে দেয়, তারপর চাপা গলায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, ‘আমার একটা প্রশ্ন রয়ে গেল যে…’

‘কী প্রশ্ন?’ ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে লাবণ্য৷

‘সেই যে তুমি একবার বলেছিলে, আমার মুখ দেখে মনে হয় না আমি তোমাকে আটকে রাখতে পারব বলে, আজও তাই মনে হয়?’

লাবণ্য কী যেন ভেবে একটু হেসে ফেলে, তারপর বলে, ‘এখন কী করে বলব বলো? তোমার মুখটা ভালো করে দেখাই হয়নি এখনও৷ আরও বছর পঞ্চাশেক ভালো করে দেখি, তারপর বলা যাবে…’

অভীকের মুখ আর দেখা যায় না৷ লাবণ্যর কাঁধে একটা হাত রেখে হাঁটতে শুরু করেছে সে৷ ফাঁকা সিঁড়ির দিক থেকে তাদের চাপা হাসির শব্দ ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *