যেখানে যুদ্ধের বিকল্প ছিল না

যেখানে যুদ্ধের বিকল্প ছিল না

বৃষ্টি পড়ছে, একটানা মৌমাছির গুনগুন স্বরে। আটচালা টিনের ঘর। উঠোনটা উদোম। বাড়িগুলো একটার সাথে আরেকটা খানিক ছাড়া ছাড়া, আড়ি করে সরে থাকার মতো। বাড়ির পেছনে পুষ্করিণী। পুষ্করিণীর ওপর দিয়ে চিকন রাস্তা মাঠের সাথে মিশে গেছে। বাড়িটা মাঠের দিকে পিঠ ঠেকিয়ে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে ডানে বাঁয়ে দুটো চারচালা টিকের ঘর, মাঝখান দিয়ে হেলেদুলে পাড়ার পথ গিয়ে ঠেকেছে গাঁয়ের মূল সড়কে। ওই সড়কের দিকে চোখ দুটো আটকে রেখে দাঁড়িয়ে আছে কুটুম। বৃষ্টির গতি একটু বেড়েছে বৈ কমেনি। বাবার পুরানো মাথালটা মাথায় চড়িয়ে পা দুটো গুটিসুটি মেরে নিমগাছটার তলে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। রাস্তায় যত দূর দৃষ্টি যায়, বৃষ্টির দাপাদাপি ছাড়া কোনো পথচারীর দেখা মেলে না। মাঝে মাঝে কয়েকটি হাঁস এ-পুকুর থেকে ও-পুকুর জায়গা বদল করে। কুটুম দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে গাছের মতো নড়চড়হীন ধড়ে পরিণত হয়। দাদি ঘরের এক কোণায় বসে থেকে অস্পষ্ট স্বরে আল্লাহর নাম জপে। এক আল্লাহ আর এই বাড়ির লোকগুলো ছাড়া আর কেউ তার কথার মর্ম উদ্ধার করতে পারে না। দাদির চোখের পলক ওঠা-নামার দিকে একভাবে তাকিয়ে বৃষ্টি পড়ার শব্দটা মন দিয়ে শুনলে কোথায় যেন একটা তালের সন্ধান মেলে।

মা সানোয়ারা রান্নাঘরে। নড়াচড়া যা করার একমাত্র সেই করে। একবার চুলার দিকে মন দেয়, একবার কুটুমকে দেখার চেষ্টা করে। চাল ক’টা কোনোমতে ফুটলেই চলে। কাড়া-আকাড়া যাই হোক পেটে চারটে পড়লেই একটু নিশ্চিন্তে থাকা যায়। ভেজা খড়ি চুলোর মুখে সেঁটে দিয়ে ফুঁসেদে ফুঁসেদে আগুনের তেজ বাড়ানোর চেষ্টা চালায়। ধোঁয়ার কিছুটা সে গেলে, বাকিটা বাইরে গোল পাকিয়ে গোল পাকিয়ে রান্নাঘরের চারপাশে মেঘের মতো অস্পষ্ট করে তোলে। সানোয়ারা কাশে। একটানা বৃষ্টির মাঝে তার কাশিটা শুনে আঁচ করা যায়, জীবন এখনো আছে এই মৃত্যুপুরীর কোথাও কোথাও। সানোয়ারা তাই কাশি না পেলেও মাঝে মাঝে কাশে। কুটুমকে অভয় দিতে চায় কাশির শব্দ করে।

 বাইরে কুটুম শক্ত পাহারায় আছে। কোনো খবর হলেই ছুটে এসে মাকে বলবে; অথবা ওখানে দাঁড়িয়েই একটা চিৎকার দেবে, এরপর ছুটে যাবে দাদির ঘরে। ওইটুকু শরীর দিয়ে দাদির মেরুদণ্ডহীন অসাড় দেহটা তুলে ধরার চেষ্টা করবে।

 ‘ও কুটু, মাজা জ্বলি গেল তো, এত আড়ি করি তুলিস নি, বুউন আমার। আঁটো করি ধর না একটু!”

 ‘ওই বুড়ি, কুটু বুলবি নি বুলছি। কুটুম বল, না হলি তোকে একিনে এভাবেই রেখি চলি যাব। তারপর যমরা আলি টের পাবি, জ্বলা কাকে বলে!’ কুটুমের হুমকিতে কাজ হয়। এরপর বুড়ি একটা শব্দও উচ্চারণ করে না। খানিক পরে হয়ত সানোয়ারা এসে হাত লাগায়।

আজ এখনো ওদের কোনো খবর নেই। প্রতিদিন যে খবর আসে, তাও না। অধিকাংশ সময় দেখা যায়, খবর হলেও সেটা থাকে গুজব। কিন্তু এমন এক গুজব যে, এটা নিয়ে দুদণ্ড ভাববার অবকাশ থাকে না। প্রাণের মায়া নাবালক-সাবালক বৃদ্ধ সকলেরই আছে। কেবল মেয়ে ও মায়েদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও একটি জিনিস হারানোর ভয়, পুরুষ মানুষের সে ভয় নেই। কুটুমের প্রাণ কিংবা শরীরের মায়া বুঝে ওঠার বয়স এখনো হয়নি। এখনই যা ও বুঝে গেছে, সেটা হলো দায়িত্ব। এইটুকুন বয়সে মা আর দাদির দায়িত্ব তার কাঁধে। সে এটা বোঝে। ছেলেটা মায়ের ভাষায় টো টো কোম্পানির ম্যানেজার। হঠাৎ হঠাৎ উদয়, নেয়ে খেয়ে উধাও। স্বামী লোকটা আরও হতচ্ছাড়া। সে মাঝে-মধ্যে আসে। নাওয়া কিংবা খাওয়ার জন্যে নয়; পেটাতে, সানোয়ারার ওপরে কিছু একটা ছুতো খাড়া করে কিংবা কোনো ছুতো না পেয়ে রাগটা আরো দ্বিগুণ করে চড়াও হয়। আবার কোনো কোনো দিন মারধর নেই, কারও সঙ্গে কোনো কথা নেই; বাড়ির পেছনের পুকুরপাড়ে বিভোর হয়ে বসে থাকে। কি যেন ভাবে! সানোয়ারা সাহস করে এগিয়ে গিয়ে কাছ থেকে দেখে, ভীষণ সরল মনে হয় লোকটাকে। শিশুর মতো নিষ্পাপ চাহুনি দিয়ে প্রকৃতি দেখে। গত বিশ বছর সংসারটা টিকিয়ে রাখার কারণ শুধু এইটুকুই। কত করে সানোয়ারার মা-বাবা, ভাই-বোনেরা বলেছে মফেদুলকে। ছেড়ে দিতে। সানোয়ারা শোনেনি। এখানে না থাকার মতো বহু কারণ তারা জানে, গ্রাম থেকে দেশ হয়েছে সেসব কারণ। কিন্তু থাকার পেছনে এই ছোট্ট কারণটি সানোয়ারার ভেতরে কোথাও কে যেন বন্দি করে রেখেছে। তার সাধ্য নেই কাউকে আলগা করে দেখায় সেটা।

মা কুটুম? সানোয়ারা রান্নাঘর থেকে মেয়েকে ডাকে।

কী মা?’ মেয়ে জোর গলায় উত্তর দেয়।

‘তুই যা। খেলগা। সাঁঝ হয়ি আসলু। আজ আর খবর হবে বুলি ঠেকচি না।

‘আর একটু থাকি মা।’ কুটুম বলে।

.

যেদিন খবর হয়। ওরা তিনটে মানুষ, গাঁয়ের আরও কয়েক ঘর মানুষ, ছুটে যায় ধড়ফড় করে। কেউ কেউ খেতে খেতে খাবার ফেলে, কেউ পায়খানা থেকে কাজ অসমাপ্ত রেখে, যে যেখানে থাকে সেখান থেকেই দল ভারি করে। পশ্চিমের ব্যাঙগাড়ি মাঠের বাঁশবাগানে বাঁশের পাতা জড়ো করাই আছে। গাঁয়ের একদল ছেলে-ছোকরার দায়িত্ব বাঁশঝাড়ে পাতাগুলো একত্র করা, ঝোঁপঝাড়গুলো মেরামত করা। এ দলের লিডার হলো মুকুল, কুটুমের বড়টা। বাড়ি থেকে প্রায় আড়াই কিলো দূরে এই গুপ্তস্থানে আশ্রয় নেয় গায়ের সকলেই। ওরা এসে দেখে, শুধু উদোম বাড়িঘর আর বেওয়ারিশবেশে ঘুরে বেড়ানো পোষা প্রাণীদের। পালাবার সময় গরুর গলার দড়িটা খুলে দিয়ে আসতে হয় মনে করে, যাতে ওরা মনে করে, লোকজন পালিয়েছে একেবারেই। লুকিয়েছে টের পেলে আবার অসুবিধা আছে। কেউ একজন ক্লিয়ার সংকেত দিলে তবেই ওরা বাড়ির পথ ধরে। জীবনবাজি রেখে সংকেত পাঠানোও মুকুলের দলের কাজ। বাড়ি ফিরে ওরা দেখে, কারো উঠোনে গুলিবিদ্ধ গাই গরুটা পড়ে আছে, পাশে বাছুরটা দুধ টেনে টেনে একশেষ। পা দুটো ওর জমে আসা রক্তে চ্যাট চ্যাট করছে। রান্নাঘর, ঘরের জিনিস ছড়ানো-ছিটানো। মাটির বাসনকোসন সব ভাঙা। আগের দিন থেকে আগুন দেয়া শুরু করেছে। যাওয়ার সময় ঘর পুড়িয়ে গেছে আকলির মা আর সবুরের বাপের। নিজেদের ভেতর কে একজন লুকিয়ে থাকার ঘটনাটা ক্যাম্পে ফাঁস করে এসেছে। এটা টের পেয়ে মুকুলরা এবার জায়গা বদল করেছে। এবার তাদের গন্তব্য পূব দিকের জলা মাঠ। কিন্তু তাতেও আর নিশ্চিত থাকা যাচ্ছে না। ঘরেই যখন চোখ গজিয়েছে তখন ঘর লুকিয়ে লাভ কী! তাই তো গেল সপ্তাহ থেকে মানুষ কমতে শুরু করেছে। আদ্দেক মানুষ বর্ডার টপকে ভারতের তেহট্টিতে তাঁবু গেড়েছে। প্রতিদিন দলে দলে অন্যরাও যোগ হচ্ছে।

সেদিন আঁধার নেমে এলে কুটুম ফিরে আসে।

 ‘মা, আব্বাকে দ্যাকি আলাম।’ কুটুম বলে।

কার সাথ? জেনে লাভ নেই তবুও জানতে চায় সানোয়ারা।

 ‘হাবু চাচা।

‘আয় খেয়ি নে। দিনটা তুই পাহারা দিলি, রাতটা আমার।

মা মেয়ে খেতে বসে।

 ‘প্যাট জ্বলে রে। প্যাট পুড়ি গেল মাবুদ। এত মানুষ মরে, আমার কতা মাবুদ তোর মনে পড়ে না?’ ঘর থেকে দাদি একটানা প্রলাপ বকে।

 মরণ চাওয়া না ঢঙ! একুনি বল, আযাব আসছি, ওমনি পুঙার কাপুড় তুলি আগে আগে দৌডুবে!’ সানোয়ারা কুটুমকে শুনিয়ে বলে। কুটুম মিটমিট করে হাসে। হাসে সানোয়ারাও।

মফেদুল হাবুকে নিয়ে অন্ধকার জলাশয়ের পাশে বসে।

 ‘ভাই, সবাই যুদ্ধে যাচ্ছি, আমিও আজ রাতে যোগ দেব। তুমি যাবা না?’ হাবু জানতে চায়।

 ‘কোন যুদ্ধ? কিসির যুদ্ধ?’ মফেদুল পাল্টা প্রশ্ন করে। এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় হাবু।

ক্যান, দ্যাশ বাঁচানুর যুদ্ধ। হাবু উত্তর করে।

 কার দ্যাশ? আমার কুনো দ্যাশ নেই। কারু কুনো দ্যাশ নেই।

 হুম, তুমি বুললি আর আমি শুনলাম! তুমার চৌদ্দগুষ্ঠির বাস একিনে। আর তুমি বুলচু তুমার দ্যাশ নেই!

বাস থাকলিই কি দ্যাশ হয় রে হাবু। এই যে গরু-ছাগলগুলান একিনে বাস করে। ইদির দ্যাশ কুনটা বল তো?

হাবু চুপ থাকে।

 ‘এটা যদি তুই জানলিই তো তোর নাম হাবু হবে কেনে! খালি ছুটি বেড়াতি মন চায় রে হাবু। পালি বেড়াই, কেনে জানিস? মনের জ্বালায়। বউ মেরি বেঁচি থাকার স্বাদ মিটাই। আমি যে আছি, এটা সানু ছাড়া আর কে ভালো মতো জানে ক? মাগি কি এমনি এমনি জানে মনে করছিস?

 ‘তুমার এসব কথা আমার ভাল্লাগে না মফে ভাই। আমি এভাবে পালি বেড়ানুর চেয়ি যুদ্ধ করাকেই খাঁটি মনে করি। মরবু যকুন বীরের মতোন মরি। নিজির দেশে নিজি চাকর হবু না মফে ভাই। তোমার মতো জ্ঞানী না হতি পারি, এইটুকু আমি বুঝি। দ্যাশটার জন্যে না হোক, তুমার এই পানা পুকুরটার জন্যি, সানু ভাবির জন্যি, কুটুমপাখির জন্যি যুদ্ধ করা উচিত। তুমার ছেলিটা স্বাধীন দ্যাশে বড় হবি। আর কী চাও তুমি?

‘তুই একুন যা হাবু। এসব মায়ার কথা শুনলি আমার ধজক জ্বলে। মানুষ যে যুদ্ধ মারামারি-বিবাদ–এগুলান করে, কার জন্যি বুলতি পারিস? নিজির জন্যি? দ্যাশের জন্যি? সব মিছা, দুনিয়ার মায়া। একা মানুষের আবার দ্যাশ কিসের রে? মাটির তলে কুনো বাউন্ডারি আছে! কুনো বানচোতে এটা বোঝে না।

 মফেদুল রেগে যায়। তার বউ সানুও যে এটা বোঝে না, সেটা তার মনে পড়ে যায়। পুকুরের ওপর থেকে কটা ঢোলকুমড়োর ডাল ভেঙে বাড়ির দিকে ধেয়ে যায়।

.

তিন দিনে গ্রাম প্রায় ফাঁকা। সানোয়ারা আর কুটুমও চলে যাবে। গতকাল মুকুল ওর দাদিকে রাখতে গেছে। কাল আবার এসে মা আর বোনকে নিয়ে যাবে। একটা রাত কোনোমতে পার করা। মফেদুল খানিক আগে এসেছে। চলে যাচ্ছে যে, সেটা সানোয়ারা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেছে তাকে। কোনো উত্তর করেনি।

 ‘আপনিও চলেন’সানোয়ারা সাহস করে বলেছিল একবার।

 ‘আমাকে নিয়ে তোদের ভাবতি হবে না। তেড়ে উঠে জানিয়ে দিয়েছে মফেদুল।

 ‘নিজের কথা ভাব। আমার কথা আমাকে ভাবতি দে।

‘শুধু নিজির কথা ভাবলি আমার চলবি? আমার সংসার আছে না? ছেলি-মেয়ি, তুমার ব্যারাম মা, হাঁস-মুরগি? আমার আর একা হওয়ার জো আছে?

 ‘তোর সংসার? একদিন আমার মা বুলিল এই কথা। একদিন তার মায়, একদিন তার মায়, একদিন তার মায়!’ নিজের কথায় নিজেই হো হো করে হাসতে থাকে। মফেদুল। মফেদুলকে কেমন ভিন গাঁয়ের মানুষ মনে হয় সানোয়ারার। হাসতে হাসতে বদনাটা হাতে নিয়ে বাইরে বের হয়ে যায় মফে। বাজ্জি সেরে একেবারে গোসল করে ফিরছে। বদনাটা রেখে লুঙ্গিটা পাল্টে আবার চলে যাবে। বাড়ির ভেতর থেকে ধস্তাধস্তির শব্দ আসে। সানোয়ারা আর কুটুমের চাপা গেফুানি। কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে মফেদুলের বিষয়টা আন্দাজ করতে। বদনাটা ফেলে বাড়ির পেছন দিকে দৌড় দেয় সে। দম বন্ধ করে সোজা এক দৌড় দিলেই ভারত। দম টেনে ধরে মফেদুল। পানা পুকুরের ওপরে আসতেই সানোয়ারার চিৎকার–’আল্লারে!’ গুলির শব্দ। শব্দটা মফেদুলের বাল্যসঙ্গী পুকুরটার ভেতর থেকেও উঠে আসে। পুকুরের জলটা কেঁপে ওঠে। পেছন দিকে ঘোরে সে। দম বন্ধ রেখেই বাড়ির ভেতর ছুটে যায়। অকেজো কোদালটা উঠোনের এক কোণায় পড়ে ছিল, তুলে নিয়ে আচমকা বসিয়ে দেয় দু-তিনজনের কাঁধ বরাবর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওদের চারজন টপাটপ পড়ে যায়। চারজনের ভেতর মফেদুলের দূর-সম্পর্কের এক খালুও ছিল। মফেদুল অত দেখেনি, যেভাবে দম বন্ধ করে এসেছিল ওইভাবেই দম বন্ধ করে বেরিয়ে যায়। মা-মেয়ে ছেঁড়া কাপড়ে জড়াজড়ি করে পড়ে আছে। রক্তের পোশাকে আর ওদের আলাদা করে চেনার উপায় নেই। মফেদুল একবারও তাকাইনি সেদিকটাই। ঝড়ের বেগে গেছে। ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এসেছে। দমটা আর একটু ধরে নাক বরাবর দৌড় দিলেই সীমান্ত। মফেদুল কী জানি কী ভেবে ডান দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। ওদিকটাই দ্বিগুণ দূরত্বে ক্যাম্প গেড়েছে মুক্তিসেনারা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *