যেখানে বাঘের ভয় – দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

যেখানে বাঘের ভয় – দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

‘১৯৮৫ সালে ডেভিড হান্ট নামে একজন ব্রিটিশ বার্ড-ওয়াচিং ট্যুর গাইড এখানে বাঘের আক্রমণে মারা গিয়েছিলেন।’

অরণ্যের কথায় বুকের ভিতরে একটা চিনচিনে অনুভূতি বেজে উঠল। এই গাঢ় সবুজে আমরা কী পথ হারাতে চলেছি? পাখি আবিষ্কারের আনন্দের ঘোরে খবরটা মাথায় জানান দিতে স্নায়ুগুলো দেরি করে ফেলেছে? ক্যামেরার ডিসপ্লেতে গ্রিন-বি-ইটার পাখিটার স্থিরচিত্রটা আমার হাতের কম্পনে কেঁপে গেল। একঝলক পাখিটার কমলা মাথা, ছোট্ট গোল চোখের তলা দিয়ে সুন্দর কালো কাজল-টানার মতো দাগ আর সবুজ পালকগুলো দেখে উদবেগ কমাতে চেষ্টা করলাম। ছবি পিছিয়ে পিছিয়ে চোখ বোলালাম পিড কিংফিশার, স্টোকবিলড কিংফিশার, রোজরিংড প্যারাকেট, গ্রেহেডেড ফিশিং ইগল ইত্যাদি একের পর এক পাখির ছবিতে। ধিকালা-ফরেস্ট-লজ থেকে আমরা খুব দূরে চলে আসিনি। নিশ্চিত। আমরা আমাদের গাইড পরেশ পোখরিয়ালের সাথে ঘাস বনে ঢুকেছিলাম এখানকার ট্যুরিজম প্যাকেজের নিয়ম মেনে। হঠাৎ তিনি আমাদের জিপ ঘুরিয়ে নিয়ে এলেন এই রামগঙ্গা নদীর দিকে। প্রথমটায় একটা খটকা চমকের আবহ থাকলেও এখানে বিস্ময় অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য মাছরাঙা হয়ে। নদী-জঙ্গল-পাখির অপূর্ব ফ্রেমে সেই যে চোখ জুড়াল, আর ফিরে প্রশ্ন করিনি। কেন তিনি আমাদের ট্যুর প্রোগ্রাম বদলালেন? একের পর এক পাখি আবিষ্কারের নেশায় পিছন পিছন হেঁটেছি, আবার জিপে ফিরে এসেছি। অদ্ভুত মানুষ, গোটা জঙ্গলটা যেন তাঁর নখ-দর্পণে। তিনি বোধহয় বলতে চাইছিলেন,—চেনা পথে অচেনা কিছু অপেক্ষায় থাকে না, তার জন্য পথ হারাতে হয়। তাই কী ইচ্ছা করে আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন?

আমরা পরস্পরের হাত শক্ত করে চেপে ধরলাম। অরণ্য সম্পদকে নিয়ে আমরা তিনজন। পরপর দু-বছর ভরতপুর, মানস হয়ে পাখির নেশায় এবার জিম করবেট ন্যাশনাল পার্কে। ওয়েবসাইট ঘেঁটে জেনেছিলাম এখানে প্রায় পাঁচশো পঁচাশি রকমের পাখি আছে। সেইসব মজা এখন হিমেল স্রোত হয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা করে দিচ্ছে।

আমরা কতটা বিপদাগ্রস্ত?

‘এটা কোর এরিয়া। এখানে বাঘ আসে।’ একটু আগে মিস্টার পোখরিয়াল হিন্দিতে বোঝাচ্ছিলেন। পথ চলতে চলতে নানান গল্পের ফাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন, ‘ভয় নেই, আমি তাদের গতিবিধিতে ওয়াকিবহাল।’

‘লোকটাকে বিশ্বাস করাটাই ভুল হয়েছে।’ সম্পদ চিৎকার করে উঠল। ‘ভ্যাগাবণ্ড পাগলা টাইপের লোক নিশ্চয়। নিজেও মরবে, আমাদেরও মারবে। নদী থেকে জল আনতে গিয়ে আর ফেরার নামটি নেই। কুমিরে টেনে নিয়ে গেল নাকি?’

সম্পদের রাগ ও বিরক্তিটা অমূলক নয়। এই জায়গাটায় আমরা গত চল্লিশ মিনিট ধরে জিপের ভেতর ঠায় দাঁড়িয়ে আছি অপেক্ষায়। ‘চল তবে নদীর দিকে একটু পিছিয়ে গিয়ে ডেকে আনি।’ ভরসা নিয়ে প্রস্তাব দিলাম।

‘এখানে জিপ থেকে জঙ্গলে নামাটা কী ঠিক হবে?’

‘কিন্তু কী করা যাবে, বিকেল হয়ে এল, এভাবে তো রাত কাটানো যাবে না। হয়তো সেই মানুষটা জল আনতে গিয়ে জলে-জঙ্গলে মজে গেছে।’

বাধ্য হয়েই তিনজনে যে পথে এতটা এসেছিলাম, মোটামুটি সরলরেখায় সে পথ ধরেই নদীর দিকে ফিরতে লাগলাম। কিছুটা হাঁটার পর মনে হল পিছন-পিছন যেন ভারি কিছু গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। ঝটকা দিয়ে পিছন ফিরলাম। কিছু দেখতে পেলাম না। এই অভয়ারণ্যে হিংস্র জানোয়ারের অভাব নেই। তিন জনে তিন দিকে নজর রেখে সন্তর্পণে এগোতে লাগলাম। নদীর দূরত্ব বেশি নয়, তবুও সে পথ-ই যেন ফুরোতে চাইছিল না। অবশেষে যখন জলের কাছে পৌঁছোলাম তখন থেকেই আমরা এক ভয়ানক ভয়-পাতালের অন্ধকারে তলিয়ে যেতে লাগলাম।

জলের পাশে বড়ো পাথরটাতে আমি-ই প্রথম আবিষ্কার করলাম চাপচাপ রক্তের ছোপগুলো। তিনজনে থম মেরে পরস্পরের দিকে চেয়ে রইলাম। তারপর এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগলাম যদি বডিটার কোনো চিহ্ন দেখা যায়।

সম্পদ হঠাৎ কাঁদোকাঁদো স্বরে বলে উঠল, ‘তাকে নিয়ে গেছে। আমরাও জঙ্গলে ফেঁসে গেছি। চল জিপের দিকে দৌড়োই।’

রুদ্ধশ্বাস একটা দৌড়ের শেষে জিপে উঠে হাঁপাতে লাগলাম। এই জিপ অল্পবিস্তর আগুপিছু হয়তো করতে পারব। কিন্তু এখান থেকে ফেরার পথ অচেনা। কোনদিকেই বা যাব! যদি অন্য কোনো ট্যুরিস্ট গ্রূপ বা বনরক্ষী বাহিনী এসে উদ্ধার করে তাহলে বাঁচোয়া। কিন্তু আমরা হয়তো একেবারেই অপ্রচলিত অবস্থানে। এ রাস্তায় আদৌ কারো চলে আসার সম্ভাবনা আছে তো?

এদিকে আমাদের যিনি নিয়ে এসেছেন সেই মিস্টার পোখরিয়ালের মুখটা মনে পড়ে গেল। এত পুঙ্খানুপুঙ্খ জঙ্গল চেনা সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে এ কী হল! রামনগর ফরেস্ট অফিসে গিয়ে লজ বুকিং করার সময় আলাপ হয়েছিল তাঁর সাথে। প্রথম আলাপেই বেশ জমে উঠেছিল হৃদ্যতা। ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারেন, বুঝতে পারেন স্পষ্ট। আমরা তাঁর মায়ের দেশের লোক। মিস্টার পোখরিয়ালের আদি মামার বাড়ি ছিল কোচবিহার থেকে রসিকবিল যাওয়ার রাস্তায়। পরে দাদু-মামারা ব্যাবসাসূত্রে দেরাদুনে চলে আসেন। সেখানে থাকতে থাকতেই তাঁর বাবার সাথে যোগাযোগ।

আমরা তো কোচবিহার শহরের ছেলে। শুনে হইহই করে বললেন, ‘আপনারা তো পাখির এক স্বর্গরাজ্য থেকেই এসেছেন। আমি একবার মাত্র গিয়েছিলাম রসিকবিলে, দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এই যে আমার জীবজন্তু প্রেম সেটা মায়ের থেকেই পাওয়া।’

পশুপাখি, বনজঙ্গল নিয়ে গভীর জ্ঞান যে এদের প্রতি তার ভালোবাসারই দান তা বোঝা যাচ্ছিল। কথায় কথায় বলছিলেন, ‘পৃথিবীর সবকিছুই যে মানুষের ভোগের জন্যে নয়—একথাটা মানুষ যে কবে বুঝবে! দেখুন, মানুষের তৈরি নিয়ম ভাঙলে তার কতরকম শাস্তি আছে, অথচ মানুষ যে বারবার প্রকৃতির নিয়ম ভাঙে—তার বেলা?’

এরপর শালের জঙ্গলের রূপ দেখতে দেখতে ধাঙ্গাদি এনট্রি-গেট থেকে ধিকালা ফরেস্ট লজ একসাথে চলেছিলাম। যাত্রাপথে তিনি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে কট্টরভাবে আইন প্রয়োগ করা কতটা জরুরি তাই নিয়ে লম্বা বক্তব্য রেখেছিলেন। বলেছিলেন, করবেট সাহেবের আত্মার আশীর্বাদে এখানে বাঘের ওপর চোরাশিকারিদের আক্রমণ কিছুটা কম। তবে আমি খবর পেয়েছি তাদের লোভের থাবার ছাপ এখানকার মাটিতেও পড়ছে। এরা প্রথমে কাছের গ্রামগুলোতে ঘাঁটি গেড়ে কমদামে অলংকার বেচার ব্যবসায় পসার বানায়। আর তলে তলে বাঘের গতিবিধির খবর রাখে তারপর ফাঁদ পাতে ঠিক ঠিক জায়গায়। অনেক রকমের ট্রাপ আছে—বক্স ট্রাপ, পিট ট্রাপ। ফাঁদ পাতা ছাড়াও অর্গানোফসফেট টাইপের বিষ দিয়েও এরা বাঘকে টার্গেট করে। বাঘ যদি কোনো বড়ো শিকার পুরোটা না-খেতে পেরে আধখাওয়া রেখে যায়, সেই মরা শিকারে বা মড়িতে এরা এই বিষ মিশিয়ে দেয়।’

আমি কাগজে-পড়া তথ্যের ভিত্তিতে আলোচনায় যোগ দিলাম, ‘মুরগির পেটে বিষ ঢুকিয়ে বন্যপ্রাণীকে খাইয়ে মারার খবরও তো দেখেছি।’

‘সেটা সাধারণত বনসংলগ্ন গ্রামবাসীরা করে থাকে। কোনও হিংস্র প্রাণীর উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে কিংবা বারবার গবাদি- পশু তুলে নিয়ে যাওয়ার ক্ষোভে। আসলে জঙ্গল ক্রমশ কমে আসছে। জন্তুজানোয়ারদের জন্য বাঁচার রসদ বড়ো অপ্রতুল—তাই এত ঘনঘন ম্যান-অ্যানিম্যাল কনফ্লিক্ট।’

জেনেছিলাম তিনি এই জঙ্গলে সেভ টাইগার প্রোজেক্টের অন্যতম কনজারভেশন স্পেশালিস্ট হিসেবে কাজ করছেন বছর পাঁচেক হল। তাঁর গাইডে জঙ্গলসাফারির প্রস্তাবটা সানন্দে গ্রহণ করা ছাড়া আর কি-ই বা করার ছিল! লাঞ্চের পর একেবারে দুপুর-দুপুর ফরেস্টগার্ডের জংলা পোশাক পরে পিক-আপ করতে চলে এসেছিলেন।

‘আমি এইমাত্র যেন সরসর আওয়াজ শুনতে পেলাম।’

অরণ্যের চিৎকারে মনে মনে পোখরিয়ালের স্মৃতিচারণ থামিয়ে চারপাশের পরিবেশে অনুসন্ধানী চোখে তাকালাম। জঙ্গলের কিছু নিজস্ব আওয়াজ আছে। সেগুলো একটানা বাজতে বাজতে হঠাৎ যেন নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। কয়েকটা ত্রস্ত খুরের আওয়াজ পেলাম যেন। কোনো হরিণের পাল বোধহয় কিছুর উপস্থিতি টের পেয়ে পালাচ্ছে?

আমি বাকিদের সাহস জোগাতে মানস অভয়ারণ্যের ট্রেকিংয়ের গল্প তুললাম। বললাম, ‘সেবারও তো নিজেরাই হারিয়েছিলাম, আবার ফিরেও এসেছিলাম। মানসে কী কোনও ভয় ছিল না। চল, আমরা নিজেদের মতো করে জিপ চালিয়ে ফেরার রাস্তা খুঁজে দেখি।’

স্টার্ট দিয়ে উঁচুনীচু রাস্তায় কিছুটা এগোনোর পর জিপটা ঝাঁকুনি দিয়ে থামল। আমিই টেনশনে ব্রেকে পা চেপেছিলাম। রাস্তার একপাশে সবুজ ছোপছোপ জ্যাকেট পরা দেহটা উপুড় হয়ে পড়েছিল।

অরণ্য ককিয়ে উঠল, ‘তার মানে বাঘ কাছাকাছি কোথাও আছে। গাড়িতে স্পিড তোল জুবিন!’

‘মৃত মানুষটাকে এভাবে অসম্মানিত হতে দেব! তা হয় না। মিস্টার পোখরিয়ালের একটা সৎকারের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করব না?’

আমার কথায় বাকি দুজন ভিজে স্বরে বলল, ‘কী করতে চাস? এই মুহূর্তে জিপ থেকে নামা মানে মরণকে ডেকে আনা।’

‘বডিটা কেবল চটপট জিপে তুলে নেব। তিনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিলেন। আমরা যদি ফিরতে পারি তাঁকে নিয়েই ফিরব।’

অনেক দ্বিধা নিয়ে আমরা মাটিতে পা রাখলাম। আগু-পিছু চোখ রাখতে রাখতে উপুড় হয়ে পড়ে-থাকা পূর্ণাঙ্গ শরীরটার কাছে এলাম। প্রাণভয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেহটা জিপের ভেতর ছুড়ে ফেললাম। তারপর কালবিলম্ব না-করে তিনজনেই লাফিয়ে জিপে উঠে পড়লাম। তারপর মরা-মানুষটার দিকে ফিরে তাকিয়ে থমকে গেলাম। এর ওপর তো বাঘের হামলা হয়নি। বরং এ শরীরে কোথাও কোনো ক্ষতচিহ্ন নেই। আর এ কার বডি? এ তো পরেশ পোখরিয়াল নয়! অন্য কোনো ফরেস্টগার্ডের? পোচাররা খুন করেছে? গুলির ক্ষত বা রক্ত সেটাই বা কোথায়?

‘বিপদে পড়ে নির্বোধের মতো আমরা এসব কী শুরু করেছি!’

এই নতুন সমস্যা ডেকে আনায় বাকি দুজন আমাকে দোষারোপ করতে করতে থেমে গেল। বডিটা ফেলে দেবার বন্দোবস্ত করতে হবে। চটপট তিনজনে বডিটা তুলেও ধপ করে নামিয়ে নিলাম। জুলজুলে তিন জোড়া চোখ ঝোপের মধ্যে থেকে আমাদের গাড়িটার দিকে চেয়ে আছে।

‘এই শেয়ালগুলোকে মৃতদেহ ফেলে ডেকে আনা কী ঠিক হবে? এদের পিছন পিছন মাংসের গন্ধে যদি আরও কিছু আসে?’

‘জিপটা স্টার্ট করে জুবিন। ধীরে ধীরে সন্ধে হয়ে আসছে।’

কথা থামিয়ে আমি ড্রাইভিংয়ে মন দিলাম। এমন পথে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা একেবারেই নেই। শিক্ষানবিশের মতো করে টলমল করে চলা যাকে বলে তেমনি করেই চলেছিলাম। একটা অদ্ভুত অস্বস্তি হচ্ছিল ভেতরে। মনে হচ্ছিল আরও গহিন জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছি না তো। মিস্টার পোখরিয়ালকে কী বাঘে আক্রমণ করল? এই লোকটাকে বা কারা, কীভাবে মেরে ফেলে দিয়ে গেল?

ভাবতে ভাবতে জিপটা স্লো হতে হতে আবার থেমে গেল। সামনে রাস্তাটা ফুরিয়ে গেছে। আরেকটু পরেই ঘন ঘাসের জঙ্গল। এই খোলা মাঠের নীচের মাটি কেমন নরম আন্দাজ নেই। এ ঘাসের ওপর হাতির পাল ঘোরাঘুরি করে। এই সময় একপাশে কিছু চিতল হরিণ চরে বেড়াচ্ছে। দূরে দেখতে পেলাম আকাশে লাল আভা। সূর্য এই গোলার্ধ থেকে বিদায় নিতে চলেছে।

‘এই বার কী হবে? কোন দিকে ফেরার রাস্তা? সঙ্গের এই বডিটার কী সদগতি করা হবে?’

সম্পদের এতগুলো প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে একসাথে ছিল না। একটু ভেবে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। আচমকা কিছু বাঁদর চিৎকার করে এডাল থেকে ওডালে লাফিয়ে পালাল।

‘আমি একটা চিতাকে গাছে উঠতে দেখলাম যেন!’ অরণ্য ভয়ার্তভাবে বলল।

‘কই, কোন গাছে?’ ঘাড় তুলে এগাছ-ওগাছ তাকিয়ে দেখলাম। কিছু দেখতে পেলাম না।

আমি আশ্বাস দিয়ে বললাম, ‘চিতা এ জঙ্গলের হিলি এরিয়াতে দেখা যায়। আমরা সমতলে। কদাচিৎ যে আসে না—এমন নয়।’ বলতে বলতে স্বর মৃদু হয়ে এল আমার, আলোর বেলা শেষ হতে চলেছে, ফিসফিস করে বললাম, ‘এই অরণ্যে সূর্যাস্তের পর জিপ-সাফারি নিষিদ্ধ। আমরা সেই বারণ করা সময়ে ঢুকে পড়লাম।’

সূর্য ডুবতেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল। একটা গা-ছমছমে পরিবেশ। আজব সব ডাকের শব্দ—এক ভয়-ধরানো হরবোলা যেন রে রে করে আমাদের আতঙ্কের মধ্যে ঠেলে দিল।

এবার জিপটা কী ঘুরিয়ে নেব! হয়তো পিছন দিকের রাস্তাটাই ফেরার ছিল। আমরা ভুল করে এগিয়ে এসেছি ফরেস্ট-লজ থেকে আরও দূরে।

জিপটা ঘোরানোর জন্য একটু প্রশস্ত জায়গা খুঁজছিলাম। কিছু ডাইনে ঘুরিয়ে ব্যাক-গিয়ারে পিছনে করলাম। ঠিক যেন নিয়ন্ত্রণ হল না। একটু বেশিই পিছিয়ে জিপটা পিছন দিকে গড়াতে লাগল। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আনাড়ি হাতে স্টিয়ারিং ও পায়ের ব্রেক, অ্যাক্সেলেটরে উলটোপালটা চাপাচাপি করে আরও গন্ডগোল করলাম। জিপটা কিছুটা নিজের মতো গড়িয়ে প্রায় আকাশের দিকে মুখ তুলে নরম কিছুতে বসে গেল। এরপর কয়েকবার লম্বা দম নিয়ে গাড়িটা ভোঁসভোঁস আওয়াজ ছাড়ল—শেষে সব চুপচাপ। সকলের প্রায় উলটে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তড়িঘড়ি জিপ থেকে লাফিয়ে নামলাম। এখন কী হবে? কোথাও কিছু নেই। শুধু গভীর জঙ্গল। আর তার মধ্যে কোনো একটা বিপজ্জনক বিন্দুতে আমরা তিনজন।

‘যে করে হোক জিপটাকে ঠেলে তুলতেই হবে।’

একবার প্রত্যেকে মোবাইলটা হাতে তুলে দেখে আবার পকেটে ভরলাম। সময় দেখার জন্য? কে জানে। ফের বার করলাম। কল করার চেষ্টা করলাম বারবার। যদি দৈব কৃপায় একটা কল লেগে যায়। কাউকে জানানো যায় আমাদের বিপদের কথা। যে যার ফোন থেকে বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলাম। না, কল হওয়া সম্ভব নয়। এখানে কোনো নেটওয়ার্কের সার্ভিস নেই।

জিপটাকে কয়েক দফা ব্যর্থ ঠেলাঠেলির পর ক্লান্ত নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে মনে হল—এই জঙ্গল আমাদের গ্রাস করার জন্য-ই নিমন্ত্রণ করে এনেছে। পরমুহূর্তে-ই অনুভব করলাম বিশ্বাসটা কতটা সত্যি। আঁধারে কোথাও বার্কিং ডিয়ার ডেকে উঠল সাবধান করতে। এরপর অকস্মাৎ একরকম চাঞ্চল্য পরিবেশ। আমি শুকনো গলায় ফিসফিস করে বললাম, ‘এটা বাঘ আসার সংকেত।’

আমরা দৌড়ে জিপে উঠলাম। সেই দোলায় জিপটা আরও কিছুটা পিছনে গড়িয়ে নালার মতো জায়গায় নেমে গেল। ওপরে আমাদের ফেলে-আসা রাস্তার ওপর দিয়ে কিছু একটা দৌড়ে গেল। সেটার হলুদ চোখ স্পষ্ট দেখতে পেলাম। সে ইচ্ছা করলে আমাদের খাদ্য বানাতে পারে। কিন্তু আবার চারপাশ এত নিশ্চুপ লাগছে কেন? শিকারের পিছনে ধাওয়া করে চলে গেল? না পাশে কোথাও ওত পেতে অপেক্ষা করছে? পাশের জনকে ছুঁয়ে বুঝতে পারলাম—সে কাঁপছে।

‘অরণ্য! এ কী করছিস!’

বলতে বলতে অরণ্য এই নালা থেকে হামা দিয়ে উঠে আমাদের ফেলে-আসা রাস্তা ধরে উলটো দিকে দৌড়োতে শুরু করল।

‘ও নিজেকে সহজতম শিকার বানিয়ে তুলেছে!’

আমরা জিপ থেকে চেঁচাতে লাগলাম ফিরে আসার জন্য। কিন্তু অরণ্য আতঙ্কে পাগল হয়ে গেছে। আমি সম্পদকে নিয়ে ওকে ধরে আনার জন্য নীচের নালার পাশ দিয়ে সমান্তরাল দৌড়োতে চেষ্টা করলাম। টর্চের আলোয় দেখতে পেলাম অরণ্য কিছুটা দৌড়েই হাঁপিয়ে গিয়েছে। সে থমকে দাঁড়িয়ে। কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমি দ্রুত পা চালিয়ে যেতে গিয়ে শুকনো পাতার মধ্যে নরম কিছুতে পা হড়কে আছাড় খেলাম। টর্চের আলোতে দেখলাম আমার জুতো ও প্যান্টের নীচেটায় কিছুটা রক্ত লেগে রয়েছে। আলোটা আরেকটু সরিয়ে বুঝলাম এটা পাতা চাপা একটা বড়ো বুনো শুয়োরের আধ-খাওয়া অংশ। মিস্টার পোখরিয়াল অর্ধেক খাওয়া শিকার ‘মড়ি’র কথা বলেছিলেন।

‘অর্থাৎ বাঘটা ভরপেটে কাছাকাছি কোথাও বিশ্রাম নিচ্ছে। বাকিটা খেয়ে শেষ করতে এখানে ফিরে আসবে!’

‘তার মানে আমরা একদম নাগালের মধ্যে। যেকোনো সময় যেকোনো দিক থেকে হামলা হতে পারে।’ সম্পদ করুণ চোখ তুলে আমার মুখের দিকে তাকাল। সামনে কিছুটা দূরত্ব রেখে অরণ্য থম মেরে রয়েছে। ঠিক ওর পায়ের কাছে গড়াগড়ি খাচ্ছে গাছের পাতা চুঁইয়ে পড়া এতটুকু চাঁদের আলো।

‘দৌড়ে পালিয়ে পার পাব না। জিপটাকে তুলতে পারলে হয়তো বা…’

বলতে গিয়ে কথা আটকে গেল ওর। ওটাকে তোলার চান্সও তো আমাদের বেঁচে ফেরার মতোই ক্ষীণ। আমি অরণ্যকে ধরে আনার জন্য এগোচ্ছিলাম। ছেলেটা এমন বিস্ফোরিত চোখে কী দেখছে? আমি সেদিকে টর্চ ফেলতেই বুঝতে পারলাম। একটা বড়ো শঙ্খচূড় যেতে যেতে হঠাৎ থেমে—দিক পালটে অরণ্যের দিকে আসার উদ্যোগ নিচ্ছে। আলো ফেলতেই সে লেজের ওপর ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চাইল যেন। আমরা কিছুটা পিছিয়ে এলাম। বুক কাঁপছিল, নিশ্বাস বন্ধ করে হাতের আলোটা স্থির রাখার চেষ্টা করে গেলাম। এক, দুই, তিন…বাইশ, তেইশ…সাপটা আস্তে আস্তে মাথা নামিয়ে দিক বদলাল। সাময়িক হাঁপ ছেড়ে হনহন করে জিপের দিকে চললাম। আমি ড্রাইভারের সিটে, বাকি দুজন নালায় পা ডুবিয়ে পিছনে। এখান থেকে চাঁদটা দেখা যাচ্ছে। মনে হল, উপরে আকাশে শুক্লপক্ষের উদযাপন চলছে। এখানে আমাদের আসন্ন মৃত্যুর কৃষ্ণছায়া ক্রমশ গ্রাস করতে চাইছে।

‘জোর লাগাকে!’ অরণ্য আর সম্পদ প্রাণপণ জোরে ঠেলার চেষ্টা করছিল। আমি দাঁত চিপে লাথি মারছিলাম অ্যাক্সিলারেটরে। জিপটা সচল হয়ে সামান্য ওঠার উপক্রম করতেই আমরা হইহই করে উঠলাম।

আর সেই মুহূর্তেই আওয়াজটা আমাদের সব হইচই একলহমায় মুছে দিল। আওয়াজটার পরে-পরেই তার শরীরটা প্রকট হল। সাদা আর বাদামি-হলুদের ডোরাকাটা রাজকীয় প্রাণীটা। চাঁদের আলোর আভায় নিজেকে স্পষ্ট করে দেখাল। সে আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েছে। প্রথমে দুলকি চালে ও পরে গতি বাড়িয়ে জিপের সামনেটায় গলা তুলে কিছু মালুম করার ভঙ্গি করল। তারপর জিপের ধাতব বডিটায় সজোরে থাবার আঘাত করল। সম্পদ আর অরণ্যের অবস্থানের দিকে ফিরে তাকানোর অবকাশ ছিল না। আমি জিপের যেদিকে বাঘটা, তার উলটোদিকে যতটা পারা যায় নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইলাম। বাঘটা সামনের দুটো পা জিপের ওপর তুলে উঠে আসতে চাইছে। চোখের সামনে তিনটে সহজ শিকার। আমি দম বন্ধ করে নিজেকে পিছনে সিটের দিকে গড়িয়ে নিয়ে চলেছিলাম। পড়ে গেলাম জঙ্গল থেকে তুলে নেওয়া অপরিচিত মানুষটার মৃত ঠাণ্ডা দেহটার ওপর। যেন নিজের আগামী অবস্থাটার আভাস করে নিলাম। বাঘটা আরেকবার আওয়াজ তুলে নিজেকে পুরোটা জিপের ওপর তুলে নিতে চাইল। আমি শেষবারের মতো লাফিয়ে নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইলাম জিপের অন্যদিকে। পারলাম না। অপরিচিতের মৃতদেহটা আমাকে জড়িয়ে নিল যেন। বাঘটা ঠিক আমার ওপরে। সে হামলার জন্য ঝাঁপ দিল বলে। আমি একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে নিজেকে ঝাঁকালাম। হাতে শক্ত কিছু একটা ঠেকল। মৃতদেহটার প্যান্টের ভিতর পকেট ও কোমরের মধ্যে গোঁজা একটা ৩২ বোর পিস্তল। আমি কী টিপলাম, কোথায় লক্ষ করে চালালাম কিছু মনে নই। শুধু একটা তীব্র আওয়াজ আর তার প্রতিধ্বনি এই জঙ্গলের গোটা নিস্তব্ধটাকে ফালাফালা করে দিল। বাঘটা দৌড়ে লুকিয়ে পড়ল সামনের ঘাসবনের আড়ালে। হয়তো এই অপ্রত্যাশিত হঠাৎ শকটা সামলে আবার ফিরে আসার জন্যে।

‘অরণ্য! সম্পদ!’

প্রথম ডাকে সাড়া পেলাম। বুঝলাম ওর দেহটা পাশে ঠেলে আমাকে টেনে তোলার চেষ্টা করছে। আমি ঘাড় তুলে সামনের একজোড়া আলোর রেখার দিকে আঙুল তুলে বললাম, ‘ওই দেখ। কারা যেন আসছে।’

আমরা ‘হেল্প, হেল্প’ বলে চিৎকার করতে করতে পাগলের মতো সেই আলোর দিকে ছুটতে লাগলাম। জিপটা আমাদের কাছে এসে থামল। আমি আর নিজেকে সোজা রাখতে পারলাম না। সামনে লুটিয়ে পড়লাম।

‘উঠিয়ে, আপ-লোক খুদকো ইয়ে ক্যায়া খতরনাক মুশিবত বে ডাল দিয়া।’

চোখ মেলে দেখলাম মিস্টার পরেশ পোখরিয়ালকে। তার কনুইয়ের ওপর থেকে কাঁধ পর্যন্ত ব্যাণ্ডেজে মোড়া। অরণ্য আর সম্পদ আমাদের এই অবস্থার জন্য দায়ী করে মিস্টার পোখরিয়ালের ওপর সমস্ত ক্ষোভ, হতাশা, ভয় উগরে দিচ্ছিল।

জানলাম, চোরাশিকারিদের একটা গ্যাংয়ের কিছু লোক কয়েক সপ্তাহ আগে পোখরিয়ালের তৎপরতায় ধরা পড়ে। আজ সেই দলের লোক আবার ঢুকেছিল পোচিংয়ের উদ্দেশ্যে। মিস্টার পোখরিয়ালকে রামগঙ্গা নদীতে একা অন্যমনস্ক দেখে চপার দিয়ে আঘাত করে প্রতিশোধের নেশায়।

‘আমি আঘাত পেয়ে সেন্সলেস হয়ে পড়ি। নেয়ারেস্ট ফরেস্ট-গার্ড পোস্ট থেকে বোধহয় আওয়াজটা পেয়েছিল। তারা আমায় উদ্ধার করে বাঁচিয়েছে। জ্ঞান ফিরলে আমি ওদের আপনাদের কথা জানাই। বলি, আমার সাথে ট্যুরিস্ট ছিল। ওরা আপনাদের জিপ খুঁজে পায়নি। তারপর থেকে আমরা ঘুরে চলেছি। এখন ফায়ারিংয়ের আওয়াজ পেয়ে এদিকে এসে আপনাদের পেলাম। ঈশ্বর মঙ্গলময়।’

‘লেকিন ইয়ে ফায়ারিং?’ গার্ড চারজন ও মিস্টার পোখরিয়াল একই প্রশ্ন নিয়ে তাকাল আমাদের দিকে।

আমরা ক্লান্তি ও অবসন্নতায় জড়ানো গলায় বললাম, ‘পিস্তলের গুলি। রক্ত দেখে আপনি বাঘের পেটে গেছেন ভেবে জিপ নিয়ে নিজেরা ফেরার চেষ্টা করি। তারপর রাস্তা গুলিয়ে যায়। পথে একটা মৃতদেহকে আপনার দেহ ধরে নিয়ে জিপে তুলে নিই…।’

‘ডেড বডি?’

মিস্টার পোখরিয়াল একরাশ বিস্ময় নিয়ে গার্ডদের সঙ্গে আমাদের জিপের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। ‘এ তো কুখ্যাত পোচার। একে কে মারল?’ এরপর তিনি নিজেদের জোরালো সার্চলাইটটা সামনে ধরে বডির নাক-মুখ পরীক্ষা করে বললেন, ‘স্নেক বাইট। প্রোবাবলি কিং কোবরা।’

‘আমাদের বোধহয় তাহার দর্শনও হয়েছে।’ আমি বলতে যাচ্ছিলাম।

দেহটা সার্চ করে তার পকেট থেকে প্যাকেটের মোড়কে Themix 500 নাম মার্ক করা কয়েকটা ওষুধের ফাইল বেরোল। মিস্টার পোখরিয়াল সেগুলো দেখিয়ে বলল, এই লোকটা মড়িতে বিষ মিশিয়ে বাঘ মারার টার্গেট নিয়েছিল। নিজেই বিষের ছোবল খেয়ে গেছে। কিন্তু যদি ও মড়িতে বিষ মিশিয়ে থাকে, তবে বাঘটা খেয়ে মারা যাবে।

মিস্টার পোখরিয়াল উদবিগ্ন ও উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আরও একটাকে আমরা বাঁচাতে পারলাম না।’

‘আমরা মড়িটা দেখেছি, ওইদিকে।’ মৃত্যুর দরজা থেকে আবার জীবনের সান্নিধ্য ফিরে পেয়ে উৎসাহ পাচ্ছিলাম। সবাই মিলে বুনো শুয়োরের অবশিষ্টাংশটা ধরাধরি করে তুলে একটা বস্তায় ভরে নেওয়া হল। পোচারের মৃতদেহটা সঙ্গে নেওয়া হল পোস্টমর্টমে পাঠানোর জন্য।

আপাতত আমরা যাত্রা শুরু করেছি। চলেছি ধিকালা-ফরেস্ট লজের দিকে। আমি বলে চলেছি আমাদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। বাঘের মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্তটা। লাকিলি পিস্তলটা না-পেয়ে গেলে!

মিস্টার পোখরিয়াল শুনতে শুনতে আমাদের সবার পিঠ চাপড়ে সাহসের প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন, ‘আপনারা নিজেরা ফাইট করে বাঁচলেন। আর বাঁচালেনও—বিষ খাওয়ার হাত থেকে, আমাদের এক গর্বের সম্পদকে।’ বলতে বলতে হঠাৎ বললেন, ‘আরে ওই দ্যাখো।’

আমরা একসাথে পিছন ফিরে দেখলাম বাঘিনিটাকে। আমাদের জিপের থেকে কিছুটা দূরে। চাঁদের আলোয় দুটো বাচ্চা নিয়ে খেলছে।

মিস্টার পোখরিয়াল বললেন, প্রার্থনা করি, ওর চলার পথে কোনো বিষ-মাখানা খাবার বা ফাঁদ যেন কোনোদিন না-থাকে।

আমরা এগিয়ে চললাম। বাঘিনিটা জিপটাকে যেতে দেখে একটা গম্ভীর হুংকার ছাড়ল। কে জানে বাঘেদের ভাষায় ধন্যবাদ বলল কি না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *