যুবরাজের চিঠি – বারীন্দ্রনাথ দাশ

যুবরাজের চিঠি – বারীন্দ্রনাথ দাশ

গৌড়ের অধিপতি মহারাজাধিরাজ শশাঙ্ক সে সময় উৎকলের দক্ষিণে পেঙ্গোদ রাজ্য জয় করতে গেছেন৷ ষোলো-শো সতেরো কি আঠারো খ্রিস্টাব্দের কথা৷ আজ থেকে এক হাজার তিন-শো ষাট বছর আগে৷ সঙ্গে গেছে সান্ধিবিগ্রহিক অর্থাৎ বিদেশ মন্ত্রী বুধস্বামী এবং মহাবলাধিকৃত অর্থাৎ প্রধান সেনাপতি রুদ্রবর্মণ৷ রাজধানী কর্ণসুবর্ণে রাজ্যশাসনের ভার দিয়ে গেছেন যুবরাজ মালদেবকে৷ তাঁর সহায়তা করার জন্যে আছেন মহামন্ত্রী অনন্তভট্ট এবং চক্রায়ুধ নামে এক তরুণ বলাধ্যক্ষ অর্থাৎ সেনাপতি৷

রাজধানীতে খবর এসেছে যে, পেঙ্গোদ রাজ্য বশ্যতা স্বীকার করেছে৷ মহারাজাধিরাজ শশাঙ্ক কর্ণসুবর্ণে ফেরার আগে কিছুদিন উৎকলে কাটাবেন৷ উৎকল সে সময় গৌড় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ৷

কর্ণসুবর্ণের অলিতে গলিতে শুরু হল আনন্দ উৎসব৷ রাজপথে সাজানো হল পুষ্পতোরণ৷ নতুন জামাকাপড় পরে অল্পবয়সিরা পথে পথে ঘুরে বেড়াতে লাগল৷ পুরনারীরা মন্দিরে মন্দিরে পুজো দিতে লাগল৷

বাংলার ইতিহাসে এই প্রথম একজন দিগ্বিজয়ী পরাক্রান্ত রাজার আবির্ভাব হয়েছে, যাঁকে মহারাজাধিরাজ বলে মেনে নিয়েছে বিভিন্ন সামন্তরাজ্য৷ গৌড় মগধ উৎকল নিয়ে তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য৷ একসময় কান্যকুব্জ অবধি পৌঁছে গিয়েছিল তাঁর বিজয় বাহিনী৷ উত্তরাপথের অধীশ্বর হর্ষবর্ধন ও কামরূপের অধিপতি ভাস্করবর্মা তাঁদের সমস্ত শক্তি দিয়েও শশাঙ্কের প্রতাপ একটুও খর্ব করতে পারেননি৷

রাজপথে ভিড় আর জয়ের উল্লাস৷ সেই ভিড়ের মধ্যে ছিল জয়ধর৷ সকাল থেকেই বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা শহর৷

একসময় আরক্ষাধিকরণের এক অশ্বারোহী নগররক্ষী তাকে এসে ধরল৷ জয়ধরের বাবা পূর্ণ মিত্র ছিল কর্ণসুবর্ণের আরক্ষাধিকৃত, অর্থাৎ পুলিশ কমিশনার৷ পুলিশের সদর দপ্তরকে তখন বলা হত আরক্ষাধিকরণ৷

সেই নগররক্ষী জয়ধরকে বলল, ‘আপনার বাবা আপনাকে এখনই একবার ওঁর সঙ্গে দেখা করতে বললেন৷ খুব জরুরি দরকার৷’

জয়ধর একটু বেজার হল৷ বেশ ফুর্তিতে ছিল বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে, এখন তাদের ছেড়ে দেখা করতে হবে বাবার সঙ্গে৷ সে বেশ বুদ্ধিমান ছেলে, পড়াশোনাও করেছে, কিন্তু কাজকর্ম করার দিকে বিশেষ ঝোঁক নেই৷ এজন্যে বাড়িতে দু-কথা শুনতে হয় প্রায়ই৷

বন্ধুরা বলল, ‘যাও, যাও গিয়ে দেখো কী ব্যাপার৷ হয়তো তোমার জন্যে একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে৷’

জয়ধর উত্তর দিল, ‘আজ এই ছুটির দিনে তো কোনো নতুন চাকরির জন্যে ডাক পড়বে না৷ হয়তো বাড়িতে কেউ এসেছে, হাটে গিয়ে তাদের জন্য কেনাকাটা করতে হবে৷ তোমরা আর আমার জন্যে অপেক্ষা কোরো না৷ কখন ফিরতে পারব তা তো জানি না৷ সন্ধ্যে বেলা কোথায় থাকবে তোমরা?’

‘ভদ্রবাহুর বাড়িতে এসো৷ সেখানেই পেয়ে যাবে৷’

আরক্ষাধিকৃত পূর্ণ মিত্র রাশভারী মেজাজের লোক৷ জয়ধর ঘরে ঢুকতেই প্রথমে তাকে এক প্রস্থ জ্ঞান দিল৷

‘তোমরা আজকালকার ছেলেরা কী হয়েছ বুঝি না৷ বড়ো হয়েছ, লেখাপড়া শিখেছ, কোথায় একটা চাকরি-বাকরি জোগাড় করে স্থির হয়ে বসবে, তা নয় সারাদিন বাইরে বাইরে ঘোরা, আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেড়ানো৷ এবার মহাবলাধিকৃত রুদ্রবর্মণ রাজধানীতে ফিরলে তাঁকে ধরে তোমায় বলাধিকরণে কোনো একটা কাজে ঢুকিয়ে দেব৷’

বলাধিকরণ হল সেনাদপ্তর৷

জয়ধর বলল, ‘বলাধিকরণেই যদি যাই, করণিক হতে পারব না৷ একেবারে সৈন্য হয়ে যোগ দেব৷’

‘সৈন্য হলে প্রথমে বাইরে কোথাও যেতে হবে৷ আরম্ভেই তো তোমায় রাজধানীতে রেখে দেবে না৷ আর তোমার মা তোমায় বাইরে যেতে দেবে না৷’

‘এসব তো পুরোনো কথা৷ সবসময় বলছেন৷ এসব শোনানোর জন্যেই কি আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন? আজ ছুটির দিন, বেশ ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে৷’

তোমার তো প্রত্যেক দিনই ছুটির দিন৷ যে কোনো কাজ . . . না, তাদের কাজের দিনই-বা কী আর ছুটির দিনই-বা কী৷

‘আজ কি কোনো বিশেষ দরকারে ডেকে পাঠিয়েছেন?’

‘শোনো কথা৷ আমি বাবা৷ তুমি ছেলে৷ তোমায় কেন ডেকে পাঠিয়েছি, তার জন্যে কি তোমার কাছেই কৈফিয়ত দিতে হবে? শোনো, আমি একজন লোক দিয়ে দিচ্ছি৷ সে তোমায় সঙ্গে করে নিয়ে যাবে রাজপ্রাসাদে৷ কুমারামাত্য মাধবশূর তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছে জরুরি দরকারে৷ যুবরাজ মানবদেব তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান৷’

কুমারামাত্য হল যুবরাজের প্রাইভেট সেক্রেটারি৷ মাধবশূর আর জয়ধর একসঙ্গে পড়াশোনা করেছে৷ মাধরশূরের বাবা হল মহারানির মামাতো ভাই৷ সুতরাং পড়াশুনা শেষ হতে না হতেই একলাফে কুমারামাত্য৷ এবং যুবরাজেরা রাজা হলে তাদের কুমারামাত্যেরা অনেক সময় ছোটোখাটো একটা মন্ত্রিত্ব পায়৷ অবশ্যি মাধবশূরের অনেক যোগ্যতা আছে৷ কিন্তু শুধু যোগ্যতা থাকলেই কি আর হয়? বাবা যদি রাজার শালা হয়, বড়ো চাকরি পাওয়ার অনেক সুবিধে৷

‘শোনো, তোমাকে একটা কথা বলে দিচ্ছি,’-বলল পূর্ণ মিত্র,-‘যদি যুবরাজ মানবদেবের নজরে পড়তে পারো, তাহলে ভালো একটা চাকরি পেতে কোনো অসুবিধে হবে না৷ এখন উনিই নিয়ে নিচ্ছেন রাজ্যশাসনের দায়িত্ব, মহারাজাধিরাজ তো মনে হয় দেশ জয় করার জন্যে বাইরে বাইরেই থাকবেন৷ আর শোনো, মাধবশূরের হাতে অনেক ক্ষমতা৷ তোমার পুরোনো সহপাঠী৷ সে যদি চায় তো তোমার জন্যে অনেক কিছু করে দিতে পারে৷’

রাজবাড়িতে ঢোকার অনেক ঝামেলা৷ প্রথমে একটা তোরণে গিয়ে দাঁড়াও৷ দৌবারিক তোমায় দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতরে যাবে, আবার ফিরে আসবে, তারপর সঙ্গে করে ভেতরে নিয়ে রেখে আসবে আরেকটি তোরণে৷ সেখানে আরেকজন দৌবারিক তোমার নাম আর কী জন্যে এসেছ সেটা জেনে নিয়ে তোমায় দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতরে চলে যাবে, আবার ফিরে এসে তোমায় ভেতরের আরেকটি তোরণে নিয়ে যাবে৷ এমনি করে যত বেশি বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে কাজ, তত বেশি তোরণ পেরোতে হবে৷ একেবারে কেন্দ্রে রাজবাড়ি৷ তাকে ঘিরে উঁচু দেওয়াল ঘেরা পরপর সাতটি অংশ৷ একেবারে ভেতরের অংশকে বলা হয় অভ্যন্তর পরিমণ্ডল৷ শুধু বিশেষ বিশেষ উৎসবের দিনে প্রজা সাধারণ ঢুকতে পারে প্রাসাদ পরিমণ্ডলে৷ অন্যান্য সময় নয়৷

আজও একটা উৎসবের দিন৷ সুতরাং দলে দলে লোক ঢুকছে আর বেরোচ্ছে৷ তবে এরকম একটা দিনে সবার গতিবিধি অবাধ হলেও, একেবারে প্রাসাদের ভেতরে ঢোকার ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি আছে৷ তাই জয়ধর অবাক হল যখন সঙ্গের লোকটি তাকে নিয়ে একেবারে ভেতরে চলে গেল৷ এদিক-ওদিক ঘুরে, ভেতরের একটি বাগান পেরিয়ে তাকে একজায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে রেখে, সে ঢুকে গেল একটি ঘরের ভিতর৷ বাইরে দ্বাররক্ষী পাহারা দিচ্ছে শূল হাতে৷ কিন্তু তাতে আটকাল না৷ একটু পরে সে ফিরে এসে জয়ধরকে ডাকল৷ জয়ধর ঘরে ঢুকল তার পেছন পেছন৷ তাকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে সে লোকটি বেরিয়ে চলে গেল৷

ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে কুমারামাত্য মাধবশূর৷

ওর আজকাল একটু মেজাজ হয়েছে বড়ো চাকরি করে বলে৷ দেখা হলে জয়ধর যদি অমায়িকভাবে হাসে, সে একটুখানি দাঁত বার করে মাত্র৷ জয়ধর যদি জিজ্ঞেস করে কেমন আছ, উত্তরে শুধু একটু মাথা নাড়ে৷

আজ কিন্তু খুব অমায়িকভাবে হাসল জয়ধরকে দেখে৷ বলল, ‘এসো, এসো! ভালো আছ ভাই?’

জয়ধর ভাবল,-এত অমায়িক, নিশ্চয়ই কোনো প্রয়োজন৷ একবার ভাবল, একটুখানি দাঁত বার করে শুধু মাথা নাড়বে৷ কিন্তু বাবার কথা মনে পড়ল৷ মাধবশূরের হাতে অনেক ক্ষমতা৷ সে ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করতে পারে৷

‘হ্যাঁ, ভালো আছি৷ তুমি ভালো আছ তো?’

‘রাজবাড়িতে চাকরি করলে কেউ ভালো থাকে? কত ঝঞ্ঝাট, কত দুর্ভাবনা, কত দুশ্চিন্তা, ভাবতে পারবে না৷ আজ ছুটির দিন৷ তোমরা বাইরে ফুর্তি করছ, হইহই করছ, সারা শহর টহল দিয়ে বেড়াচ্ছ৷ আর আমি? সেই সকাল থেকে এখানে পড়ে আছি নানা কাজের ঝঞ্ঝাট মাথায় নিয়ে৷’

‘ব্যাপার কী বলো তো? আমায় হঠাৎ ডেকে পাঠালে?’

‘হ্যাঁ, বলছি৷ একটা জরুরি দরকার আছে৷ কোনো একটা অত্যন্ত গোপনীয় কাজে একজন খুব বুদ্ধিমান বন্ধুর প্রয়োজন, যার উপর ভরসা করা যায়৷ যুবরাজ জিজ্ঞেস করলেন, চেনাশোনার মধ্যে আছে এরকম কেউ? বুদ্ধিমান লোক অনেক আছে, কিন্তু বুদ্ধিমান বন্ধু বেশি নেই৷ সবাইকে দিয়ে একাজ হবে না৷ এমন একজন কাউকে চাই যে অভিজাত পরিবারের ছেলে, অথচ তাকে উপর মহলে কেউ বিশেষ চেনে না৷ আমার মনে পড়ল তোমার কথা৷ যুবরাজ বললেন, তাকে নিয়ে এসো৷ তাই লোক পাঠালাম আরক্ষাধিকৃত পূর্ণ মিত্রের কাছে৷ তোমায় একটা কাজের ভার দেব৷ বলো, তুমি রাজি কি না৷’

‘পয়সাকড়ি কিছু পাওয়া যাবে? জয়ধর জিজ্ঞেস করল,-‘বাবার হাত আজকাল আর আগের মতো দরাজ নেই৷

মাধবশূর হাসল৷ বলল, ‘কাজটা যদি করে দিতে পার, তাহলে যুবরাজ মানবদেব তোমাকে তাঁর নিজের কাজে পাকাপাকিভাবে নিয়ে নেবেন৷ আর টাকাকড়ির কথা বলছ? সেজন্যে ভাবতে হবে না৷’

কিছুক্ষণের মধ্যেই জয়ধরকে হাজির করা হল যুবরাজ মানবদেবের সামনে৷ সেখানে আরও একজন বসেছিল যুবরাজের কাছে৷ তারও বয়েস বেশি নয়৷ তাকে দেখেই চিনতে পারল জয়দেব৷ সে রাজধানীর বলাধ্যক্ষ, চক্রায়ুধ৷

মানবদেবের সৌম্যসুন্দর চেহারা৷ মহারাজাধিরাজ শশাঙ্কের মতো রুক্ষ নয়৷ গলার আওয়াজ নরম, শান্ত৷ গুরুগম্ভীর নয় তার বাবার মতো, বলল, ‘বোসো৷’

‘জয়ধর’, বলে গেল মানবদেব, ‘একটা কাজের ভার দিচ্ছি তোমার উপর৷ খুব দায়িত্বপূর্ণ কাজ৷ রাজ্যের শান্তি, নিরাপত্তা, রাজপরিবারের সম্ভ্রম এবং আমার সম্মান নির্ভর করছে তার উপর৷’

‘মহারাজকুমার, এমন কী বিশেষ কাজ যেটা আপনার কোনো সুদক্ষ অনুচর পারত না?’

‘চুরি করতে হবে৷’

জয়ধর আকাশ থেকে পড়ল, ‘চুরি!’

‘হ্যাঁ, আমাদেরই এক মন্ত্রীর বাড়ি থেকে একটা জিনিস চুরি করে আনতে হবে৷’

‘আমি পারব না৷’

‘পারবে না?’

‘আমায় ভুল বুঝবেন না মহারাজকুমার৷ আমি বড়ো ঘরের ছেলে৷ বাবা পূর্ণ মিত্র কর্ণসুবর্ণের আরক্ষাধিকৃত৷ এ পর্যন্ত কোনো ভালো কাজ আমি জোগাড় করতে পারিনি৷ তাই বলে জীবনের প্রথম কাজটা হবে চুরি করার কাজ, সে হয় না৷ ধরা পড়লে বাবা কী বলবেন আমি জানি৷ ছিঃ জয়ধর, আমি নগরের আরক্ষাধিকৃত, আমার ছেলে হয়ে তুমি একাজ করতে গেলে?’

মানবদেব হেসে ফেলল একথা শুনে৷ তারপর আবার গম্ভীর হল, বলল, ‘জয়ধর, এই সংসারে আমাদের অনেকেই চোর কিংবা ডাকাত৷ গৃহস্থবাড়িতে চোর ধরা পড়লে তাকে আমরা শাস্তি দিই, নির্জন রাজপথে যে জোর করে পথিকের সর্বস্ব কেড়ে নেয় তাকে ডাকাত বলে নিন্দে করি৷ কিন্তু যে সামন্ত তার অধীশ্বর রাজার অনুপস্থিতিতে রাজ্যের খানিকটা দখল করে স্বাধীন রাজা হয়ে বসে, সে কি চোর নয়? যে পরাক্রান্ত রাজা প্রতিবেশী ছোটো রাজ্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটি দখল করে বসে, সে কি ডাকাত নয়?’

মানবদেবের কথা শুনে জয়ধর একটু অবাক হয়ে তাকাল৷ শশাঙ্কদেবের ছেলের মুখে এই কথা? মনে মনে ভাবল,-বাবাজি, এখন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে আছ, তাই মুখে এত বড়ো বড়ো কথা, নিজে যেদিন রাজা হয়ে বসবে, তুমিও তো তাই করবে৷ না করলে রাজ্য রক্ষা করতে পারবে না, আর ইতিহাস তোমায় অপদার্থ বলে গালাগালি দেবে৷

মুখে বলল, ‘কোনো রাজ্য চুরি করে ডাকাতি করে দখল করার কাজ দিন৷ চেষ্টা করে দেখতে পারি৷ মন্ত্রীবাড়ি ঢুকে কোনো জিনিস চুরি করতে পারব না৷’

‘জিনিসটা কিন্তু আমারই,’ বলল মানবদেব, ‘সেই মন্ত্রী চুরি করে নিয়ে গেছে৷’

‘তাহলে আমার বাবাকে বলুন৷ তিনি আরক্ষাধিকৃত৷ চোরাই মাল উদ্ধার করা তাঁরই অধীনস্থ চোরোদ্ধরনিকের কাজ৷’

‘ওদের কাউকে দিয়ে একাজ হবে না৷’

তখন বলাধ্যক্ষ চক্রায়ুধ বলল, ‘মহারাজকুমার, ওকে প্রথম থেকে ব্যাপারটা খুলে বলুন৷’

‘ও যদি রাজি না হয়, তাহলে এই গোপনীয় ব্যাপারটা ওকে বলে কী লাভ?’

জয়ধর মনে মনে ভাবল, ওর বাবা শুনলে কী বলবে৷ হতভাগা বোকা পাঁঠা, যুবরাজ সেধে তোকে একটা কাজ দিতে চাইছে, তুই নিলি না? এমন সুযোগ হেলায় হারালি? ব্যাটা গর্ধভ, একথা তোর মাথায় ঢুকল না যে, যুবরাজ তোকে একটা সাধারণ চোরের কাজ দেবে না৷

জয়ধর বলল, ‘আপনি বলছেন একাজের উপর নির্ভর করছে রাজ্যের শান্তি ও নিরাপত্তা?’

‘এবং রাজ পরিবারের সম্ভ্রম ও আমার সম্মান৷’

‘বেশ, দেশের জন্যে যদি হয়, আমি রাজি৷ বলুন কী করতে হবে৷’

একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল যুবরাজ মানবদেব৷ বলল, ‘তাহলে মনে দিয়ে শোনো৷’

ওদিকে তো পেঙ্গোদ রাজ্য জয় করে নিশ্চিন্ত হয়ে উৎকল পরিভ্রমণ করছেন মহারাজাধিরাজ৷ এদিকে দেশের সামনে একটা সংকট ঘনিয়ে আসছে৷ গুপ্তচর মারফত সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে যে থানেশ্বরে মহারাজ হর্ষবর্ধন সৈন্যসজ্জা করছেন৷ ওদিকে কামরূপে মহারাজ ভাস্করবর্মাও তৈরি হচ্ছেন৷ আয়োজন সম্পূর্ণ হলে দু-জনে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়বেন গৌড়দেশের উপর৷

এ নিয়ে মহামন্ত্রী অনন্তভট্ট খুব চিন্তিত৷ এক্ষুনি একটা খবর পাঠানো দরকার মহারাজাধিরাজ শশাঙ্কদেবের কাছে৷ কিন্তু একটা বিশেষ কারণে সে কাজটা আটকে আছে৷

রাজ্যের একজন বিশিষ্ট মন্ত্রী হল কাত্যায়ন৷ সে গোপনে এসে দেখা করেছে যুবরাজ মানবদেবের সঙ্গে৷ বলেছে, এখন কোনো খবর পাঠাতে পারবে না৷ তার আগে মহামন্ত্রী অনন্তভট্টকে সরিয়ে দিতে হবে৷

‘সেকী! মহামন্ত্রী অনন্তভট্ট রাজ্যের স্তম্ভ৷ মহারাজাধিরাজ তাঁকে শ্রদ্ধা করেন৷ গৌড় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা আর সাফল্যের পেছনে মহামন্ত্রীর অবদান অনেকখানি৷’

‘কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মার সঙ্গে তিনি গোপনে যোগাযোগ করছেন৷ ভাস্করবর্মা যদি গৌড়দেশ দখল করতে পারেন, তাহলে তাঁর সামন্ত হয়ে রাজসিংহাসনে বসবেন অনন্তভট্ট৷’

‘অসম্ভব৷ অনন্তভট্ট এরকম করতে পারেন না৷’

‘পারেন না, সে আমিও জানি’,-কাত্যায়ন হেসে বলল,-‘কিন্তু আমি প্রমাণ তৈরি করে দেব৷ আসল কথা, আমাকে মহামন্ত্রী করতে হবে৷’

‘জানেন, আপনাকে আমি বন্দি করে কারাগারে পাঠিয়ে দিতে পারি আপনার এই প্রস্তাবের জন্যে?’

‘চেষ্টা করে দেখুন৷ তবে তার আগে ভেবে দেখবেন, আপনিই কারারুদ্ধ হতে পারেন হয়তো৷’

যুবরাজ মানবদেব শান্ত প্রকৃতির লোক৷ কিন্তু কাত্যায়নের উদ্ধত কথা শুনে ভীষণ রেগে গেল৷ বলল,-‘আপনি এক্ষুনি চলে যান আমার চোখের সামনে থেকে৷ আর আপনার সম্বন্ধে যা ব্যবস্থা করার আজই করছি৷’

কাত্যায়ন নির্বিকার৷ আস্তে আস্তে বলল,-‘আচ্ছা, সম্প্রতি আপনার কি কিছু হারিয়েছে?’

মানবদেব থমকে গেল৷-‘হারিয়েছে? কী হারাবে?’

‘এই ধরুন, আপনার লেখা একটি চিঠি৷’

কয়েক মুহূর্ত মানবদেবের মুখে কোনো কথা সরল না৷ হ্যাঁ, তার লেখা একটি চিঠি হারিয়ে গেছে৷ কাল থেকে সেটি খুঁজে পাচ্ছে না৷ কিন্তু কাত্যায়ন কী করে জানল সে কথা?

এখন মনে পড়ল, কাল সে যখন চিঠি লিখে শেষ করল, তখন কাত্যায়ন তার কাছে এসেছিল৷ তার কাছে একটা জরুরি এবং গোপনীয় চিঠি এসেছিল, তারই উত্তর সে সবে লিখে শেষ করেছে, এমন সময় দেখা করতে এল কাত্যায়ন৷ মানবদেব চিঠি দুটো ভাঁজ করে একপাশে সরিয়ে রেখে তার সঙ্গে কিছু দরকারি কথাবার্তা বলল৷ কিছুক্ষণ পরে কাত্যায়ন চলে গেল৷

আর সঙ্গেসঙ্গে এসে পড়েছিল মহাক্ষপটলক, অর্থাৎ অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল৷ তার সঙ্গেও কিছু জরুরি কথা ছিল৷ সামনের বিরাট চারপায়া কাঠের ফলকের উপর রাখা ছিল অনেক দরকারি চিঠিপত্র৷ এজন্যে তখনও লক্ষ করেনি যে চিঠি দুটো নেই৷

মহাক্ষপটলক চলে যাওয়ার পর চিঠি দুটো খুঁজতে গিয়ে দেখে সেগুলো নেই৷ অন্যান্য চিঠিপত্রের মধ্যে অনেক খুঁজল, পেল না৷ একথা একবারও মনে হল না যে এদের কেউ নিয়েছে৷ একজন মন্ত্রী, আরেকজন মহাক্ষপটলক, এরা কেন নিতে যাবে যুবরাজের চিঠি৷ নিশ্চয়ই অন্যান্য চিঠিপত্রের মধ্যে মিশে গেছে৷

অনেক খুঁজল মানবদেব, কিন্তু পেল না৷ একটু দুর্ভাবনা হল৷

‘কোথায় সে চিঠি দুটো?’ মানবদেব এখন জিজ্ঞেস করল কাত্যায়নকে৷’

‘আমার কাছে৷’

মানবদেবের সারা মুখ রাগে লাল হয়ে গেল৷ ‘তার মানে, আপনিই আমায় না বলে ওগুলো নিয়েছেন?’

‘আমি জানতাম কার চিঠি এবং আপনি কী উত্তর দিচ্ছেন৷’

মানবদেবের ইচ্ছে হল কাত্যায়নকে তখনই বন্দি করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়৷ কিন্তু কোনো রকমে সামলে নিল নিজেকে৷ যে চিঠি এসেছে, সেটা গোপনীয় এবং জরুরি৷ আপাতত সে সম্বন্ধে কারও কিছু জানা ঠিক নয়৷ কিন্তু কাত্যায়নকে বন্দি করলে একটা হইচই হবে, চিঠির কথা জানাজানি হয়ে যাবে৷

মানবদেব শান্তভাবে বলল, ‘আপনি চিঠি দুটো ফিরিয়ে দিন কাত্যায়ন৷ আমি কথা দিচ্ছি, কেউ কিছু জানবে না৷ আপনাকে কোনোরকম শাস্তি দেওয়া হবে না৷’

কাত্যায়ন হাসল ‘শাস্তি কে কাকে দেয়? ওই চিঠি দুটো যদি মহারাজাধিরাজের হাতে পড়ে, তিনি কি খুশি হবেন?’

‘অখুশি হবে না৷ বড়ো জোর একথা বলতে পারেন, আমাকে না জানিয়ে তুমি নিজের দায়িত্বে উত্তর দিতে গেলে কেন? আমি বুঝিয়ে দিতে পারতাম, তিনি এখন রাজধানী থেকে অনেক দূরে, তাঁর ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে গেলে বড্ড দেরি হয়ে যেত৷ রাজ্যের স্বার্থের কথা ভেবে আমাকে নিজের দায়িত্বে একাজ করতে হল৷’

‘নিজের রাজ্য মহারাজ হর্ষবর্ধনের হাতে তুলে দিয়ে আপনি রাজ্যের স্বার্থ দেখছেন, একথা কি বিশ্বাস করবেন মহারাজ শশাঙ্ক?’

মানবদেব স্তম্ভিত হল৷ ‘নিজের রাজ্য মহারাজ হর্ষবর্ধনের হাতে তুলে দেব? কী বলছেন আপনি?’

‘কার চিঠি এসেছিল আপনার কাছে?’ বলল কাত্যায়ন৷

‘আমি কি ধরে নেব যে আপনি চিঠি দুটো পড়েননি?’

‘পড়েছি৷’

‘তাহলে আপনিই বলুন কার চিঠি?’

‘মহারাজ হর্ষবর্ধনের সান্ধিবিগ্রহিক অবন্তীদেবের চিঠি৷’

‘না৷ আপনি ভুল বলছেন৷ মহারাজ হর্ষবর্ধনের মহাবলাধিকৃত ভণ্ডীর চিঠি৷ অবন্তীদেবের কোনো চিঠির কথা আমি জানি না৷’

‘হয়তো জানেন, কিংবা জানেন না৷ কিন্তু আপনার চিঠি অবন্তীদেবের চিঠিরই উত্তর৷’

‘না, আমার উত্তর ভণ্ডীদেবের চিঠির৷’

‘তাই কি? ভণ্ডীদেব আপনাকে কী লিখেছেন, তাও আমি জানি৷ সে চিঠিও আমার কাছে আছে৷ তাতে লেখা আছে,-মহারাজকুমার মানবদেব জয়তু৷ নানা কারণে আমি এবং আমার সহযোগী ভটাশ্বপতি কুন্তলদেব মহারাজ হর্ষবর্ধনের অধীনে আর থাকতে চাই না৷ তিনি বৌদ্ধ৷ আমরা বৌদ্ধ নই৷ তাই তিনি আমাদের উপর বিরূপ৷ মহারাজ শশাঙ্ক সনাতন ব্রাহ্মণ্যধর্মের স্তম্ভস্বরূপ৷ তাঁর সেবায় নিযুক্ত হতে পারলে আমরা নিজেদের ধন্য মনে করব৷ আমরা এখন কিছুদিন সীমান্তে অবস্থান করছি৷ আপনিও যদি সীমান্তে এসে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তাহলে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা যায়৷ আপনার অনুমতি পেলে কুন্তলদেব সীমান্ত অতিক্রম করে আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারে৷ আপনার চিঠি পেলে আমরা আমাদের পরবর্তী কর্মসূচি স্থির করব৷ চিঠিতে প্রত্যক্ষভাবে সম্বোধন করবেন না৷ কারণ আপনার চিঠি আমাদের এখানে যদি অন্য কারও হাতে পড়ে, আমরা বিপন্ন হতে পারি৷ ভবদীয়, ভণ্ডী, মহাবলাধিকৃত৷-চিঠিতে সইয়ের নীচে ভণ্ডীদেবের মুদ্রার ছাপ৷’

‘হ্যাঁ, এ চিঠিরই উত্তর আমি দিয়েছিলাম,’ মানবদেব বলল, ‘মহারাজ হর্ষবর্ধনের প্রধান সেনাপতি ভণ্ডী এবং অশ্বারোহী বাহিনীর সেনাপতি কুন্তল যদি হর্ষবর্ধনকে ত্যাগ করে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন, তাহলে হর্ষবর্ধন দুর্বল হয়ে পড়বেন এবং আমাদের শক্তি বেড়ে যাবে৷ আমার মনে হয়েছিল, এ প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে৷ মহারাজাধিরাজের রাজধানীতে ফিরে আসতে অনেক দেরি৷ তাই আমি নিজের দায়িত্বে এ চিঠির উত্তর দিয়েছিলাম৷’

কাত্যায়ন বলল, ‘এ চিঠির উত্তর কি না আমি জানি না৷ তবে আপনার চিঠিতে কী লেখা আছে, তাও আমি জানি৷ আপনি লিখেছেন,-ভদ্রে, আপনার অভিপ্রায় অনুসারে চিঠিতে আপনাকে প্রত্যক্ষভাবে সম্বোধন করলাম না৷ আপনার প্রস্তাব আমরা বিবেচনা করে দেখতে রাজি আছি৷ আমার পক্ষে এখন সীমান্তে যাওয়া সম্ভব নয়৷ তবে আগামী মাসের শুক্লপক্ষে আমি কয়েকদিনের জন্যে পাটলিপুত্রে যাচ্ছি৷ শুক্লা নবমীর দিন যদি কুন্তলদেব গোপনে পাটলিপুত্রে এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন, তাহলে বিস্তারিতভাবে সব কথা আলোচনা করে দেখা যাবে৷ তিনি যদি আসতে পারেন, আমাকে আগে জানাবেন৷ আমি তাঁর নিরাপত্তার সবরকম ব্যবস্থা করব৷ ভবদীয়, মানবদেব৷-সইয়ের নীচে আপনার মুদ্রা৷’

‘হ্যাঁ, এরকমই লেখা আছে আমার চিঠিতে৷ এটা সেনাপতি ভণ্ডীর চিঠিরই উত্তর৷’

‘সেকথা আমি জানি না,’ উত্তর দিল কাত্যায়ন, ‘আমার কাছে মহারাজ হর্ষবর্ধনের সান্ধিবিগ্রহিক অবন্তীদেবের একখানি চিঠি আছে৷ সেটিও আপনার লেখা৷’

‘আমি ওরকম কোনো চিঠি পাইনি৷’

‘চিঠিতে কী লেখা আছে শুনুন৷-মহারাজকুমার মানবদেব জয়তু৷ আমার আগের চিঠির উত্তরে আপনি যে প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটা আমরা মন্ত্রণাসভার আলাপ আলোচনা করে দেখেছি৷ মহারাজ শশাঙ্ককে অপসারিত করে আপনি গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করবেন এবং আমাদের সঙ্গে সন্ধি করবেন, এ অতি উত্তম প্রস্তাব৷ তবে আমাদের মহারাজাধিরাজ হর্ষবর্ধনদেব শুধু সন্ধির প্রস্তাবেই রাজি হতে পারেন না৷ শশাঙ্কদেবের বিরুদ্ধে সমরসজ্জা করতে আমাদের অনেক অর্থব্যয় হয়েছে৷ তার ক্ষতিপূরণ হওয়া দরকার৷ ভবিষ্যতে আপনারা আবার শক্তিশালী হয়ে আমাদের দেশ আক্রমণ না করেন, সেটাও আমাদের দেখতে হবে৷ হর্ষবর্ধনদেবের নির্দেশ অনুসারে আপনাকে জানাচ্ছি, গৌড়ের রাজা হিসেবে আপনাকে স্বীকৃতি দিতে তাঁর আপত্তি নেই, যদি আপনি তাঁকে উত্তরাপথের সার্বভৌম রাজচক্রবর্তী বলে মেনে নেন, তাঁর আনুগত্য স্বীকার করেন, এবং প্রতি বছর অল্প কিছু কর দেন৷ বিনিময়ে তিনি আপনাকে কামরূপের রাজার হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে প্রতিশ্রুতি দেবেন৷ আমাদের সেনাবাহিনীর ভট্টাশ্বপতি কুন্তলদেব কিছুদিনের জন্যে পূর্ব সীমান্তে যাচ্ছেন৷ আপনিও যদি সীমান্তে এসে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তাহলে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা যাবে৷ আপনার অনুমতি পেলে কুন্তলদেব সীমান্ত অতিক্রম করে আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারে৷ আপনার চিঠি পেলে আমরা আমাদের পরবর্তী কর্মসূচি স্থির করব৷ আপনি আপনার চিঠিতে আমাকে প্রত্যক্ষভাবে সম্বোধন করবেন না, কারণ চিঠি যদি এখানে অন্য কারও হাতে পড়ে, আমাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে৷ কারণ মন্ত্রীপরিষদের অনেকে এবং সেনাপতিদের মধ্যে কেউ কেউ এখনও আপনাদের সঙ্গে কোনোরকম সন্ধির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে৷-ভবদীয়, কুন্তল, মহাসান্ধিবিগ্রহিক৷-সইয়ের নীচে তাঁর মুদ্রার ছাপ৷ এখন বলুন, আপনার চিঠি কি এ-চিঠির উত্তর বলে মনে হয় না? কিংবা, যদি কারও সেরকম মনে হয়, ধরুন মহারাজাধিরাজ শশাঙ্কের, তখন আপনি কী উত্তর দেবেন?’

জয়ধর চুপচাপ শুনছিল মানবদেবের কথা৷ মানবদেব বলল, ‘একথা শুনে বুঝতেই পারছ আমার মনের অবস্থা কী হল৷ আমি একটা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি, একটা ফাঁদে পড়ে গেছি৷ আগের থেকে পরিকল্পনা করে এরকম করা হয়েছে কাত্যায়নের সহযোগিতায়৷ একরকম চিঠি আমার কাছে পাঠানো হয়েছে, আরেকরকম চিঠি রাখা হয়েছে কাত্যায়নের কাছে৷ এমন কৌশল করে চিঠি লেখা হয়েছে যে, প্রথম চিঠির লেখা উত্তর দ্বিতীয় চিঠির উত্তর বলে মনে হতে পারে৷ আমার ভুল হয়ে গেছে মহামন্ত্রীর সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা না করা৷ হর্ষবর্ধনের মন্ত্রী অবন্তীদেব অত্যন্ত ধূর্ত লোক৷ সে এই চালাকি করেছে, যাতে আমার চিঠি আর ওর চিঠি মহারাজাধিরাজের হাতে পড়লে তাঁর মনে হবে আমি তাঁকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছি৷ এ কথা জানাজানি হয়ে গেলে কী হবে ভাবতে পার? মন্ত্রীসভায় গণ্ডগোল বেধে যাবে, রাজপরিবারে অশান্তি দেখা দেবে, আর আমার কী অবস্থা হবে তা তো সহজেই অনুমান করতে পার৷’

জয়ধর কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, এমন সময় একজন লোক এল সেখানে৷ হাতে চৌকো সাদা ভূর্জপত্রে লেখা কয়েকটি সরকারি দলিলপত্র৷ যুবরাজ সেগুলো দেখল, তারপর রেখে দিল সামনের বড়ো ফলক, অর্থাৎ টেবিলের একপাশে, সেখানে আরও কিছু দলিল ও চিঠিপত্র৷

‘বাসুদেবকে ডাকো,’ বলল যুবরাজ৷

লোকটি এল, যুবরাজ বলল, ‘এগুলি নিয়ে মহারাজাধিরাজের মন্ত্রণাগৃহে রেখে দাও৷ দু-দিন ধরে এগুলো পড়ে আছে৷ তুলে নিয়ে যাওনি কেন? এসব মহারাজাধিরাজ নিজে দেখবেন, আর শোনো, এই পত্র তিনটিও তাঁরই জন্যে৷ সেদিন বোধ হয় নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলে৷ এখানে পড়ে আছে তিন-চার দিন ধরে৷ হ্যাঁ, কী বলছিলে জয়ধর?’

‘আমার কয়েকটি প্রশ্ন আছে৷’

‘বলো৷’

‘আপনারা বলছেন, আপনার ওই চিঠি কাত্যায়নের বাড়ি থেকে আমায় চুরি করতে হবে৷ সেগুলো যে সেখানেই আছে সেকথা কি নিশ্চিত হয়ে বলা যায়? হয়তো অন্য কারও হাতে পাচার করে দেওয়া হয়েছে৷’

‘শোনো জয়ধর, তোমাকে ডাকিয়ে আনার আগে দু-দিন ধরে আমরা নিজেরা অনেক চেষ্টা করেছি৷ সেদিন কাত্যায়ন চলে যাবার পর, আমাদের গুপ্তচর বিভাগের প্রধান বজ্রসেনকে খবর দিয়েছিলাম৷ তাকে সব খুলে বললাম, তার কাছে যা শুনলাম, তাতে আরও অবাক হলাম৷ গুপ্তচর বিভাগের কাছে খবর ছিল যে, কাত্যায়নের সঙ্গে একটা গোপন যোগাযোগ আছে মহারাজ হর্ষবর্ধনের৷ তবে কাত্যায়ন একজন মন্ত্রী৷ নিশ্চিত প্রমাণ হাতে না এলে কিছু করা যায় না৷ এজন্য আমাদের গুপ্তচর বিভাগ ওর উপর কড়া নজর রেখেছিল এবং আমাদের মহারাজাধিরাজের ফিরে আসার অপেক্ষা করছিল৷ ওরা যে তার উপর নজর রেখেছে, একথা কাত্যায়নও অনুমান করেছিল৷ সেও খুব সাবধান হয়ে গেছে৷

‘বজ্রসেনের কাছে শুনলাম, যেদিন আমার চিঠি খোয়া গেছে এবং কাত্যায়ন আমার সঙ্গে প্রথম দেখা করতে এসেছিল, তারপর কাত্যায়ন সোজা নিজের বাড়িতেই ফিরে গিয়েছিল৷ এই ক-দিন সে নিজের বাড়ি আর প্রাসাদে নিজের দফতর ছাড়া আর কোথাও যায়নি৷ ওর বাড়িতে কেউ ওর সঙ্গে দেখা করতে আসেনি৷ ওর দফতরেও দু-চারজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মী ছাড়া আর কারও সঙ্গে ওর দেখা হয়নি৷ ওর পরিবারের সবাই কর্ণসুবর্ণে নেই, দেবগৃহে গেছে তীর্থ করতে৷ বাড়িতে শুধু চাকরবাকর আছে৷ তাদের মধ্যে আছে আমাদের গুপ্তচর সংস্থার তিনজন লোক৷

‘আমার নির্দেশে বজ্রসেনের লোকেরা দু-তিন দিন ধরে কাত্যায়নের অনুপস্থিতিতে সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছে৷ কোথাও পায়নি আমার চিঠি৷ তাকে যে স্নান করায়, তার বসনভূষণের ব্যবস্থা করে, সেও খুঁজে দেখেছে৷ জানিয়েছে কাত্যায়নের সঙ্গেও কিছু থাকে না তার বসনের মধ্যে৷

‘তাহলে এখন ওটা গেল কোথায়? ওটা অন্য কারও কাছে পাচার করে দেওয়া হয়নি, কারণ এর মধ্যে অন্য কেউ তার ওখানে কি তার দফতরে আসেনি৷ যে দু-চারজন রাজকর্মচারীর সঙ্গে ওর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ, তারা আমাদের অত্যন্ত বিশ্বস্ত, তারা এসব ষড়যন্ত্রের মধ্যে থাকবে না৷ কাত্যায়নের অনুপস্থিতিতে তার দফতরে তার নিজের ঘরে ঢুকেও খোঁজাখুঁজি করেছে বজ্রসেনের অনুচরেরা, দফতরেও পায়নি৷

‘একটা কথা আমরা নিশ্চিতভাবে জানি, চিঠিগুলো অন্য কারও হাতে পাচার করে দেওয়া হয়নি৷ তার নিজের কাছেই আছে৷ দফতরে নেই৷ তাহলে বাড়িতেই আছে৷ কিন্তু বাড়িতেও কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না৷ গেল কোথায় তাহলে? এটাই তোমায় খুঁজে বার করতে হবে৷ যদি সন্ধান পাও, চুরি করে নিয়ে আসতে হবে৷’

আরেকজন লোক এল৷ একটি চিঠি দিল যুবরাজকে৷ যুবরাজ পড়ল৷

‘ঠিক আছে৷ তুমি বাইরে অপেক্ষা করো৷’

সে চলে গেল৷

যুবরাজ বলল, ‘একটু অপেক্ষা করো জয়ধর৷ চিঠির উত্তরটা লিখে নিই৷’

জয়ধর অপেক্ষা করল৷ উত্তর লেখা হয়ে গেল৷

ছুটির দিনেও কাজের চাপ৷ রাজকার্য উপলক্ষে অনবরত লোক আসছে৷ এখনও একজন এল৷ হাতে কয়েকটি চিঠি ও দলিলপত্র৷ যুবরাজ সেগুলো নিয়ে চোখ বুলিয়ে দেখে একপাশে সরিয়ে রাখল৷ তারপর বলল, ‘হ্যাঁ, জয়ধর, কী বলছিলে তুমি?’

‘ভাবছি, কাত্যায়নকে এখানেই ডেকে পাঠাব কি না৷ ওকে আমার কিছু প্রশ্ন করার আছে৷’

‘এখন কাত্যায়ন প্রাসাদেই আছে৷ ওকে ডেকে পাঠাচ্ছি৷’

‘আমি এক্ষুনি ওর সামনে থাকছি না৷ আমি এই অবসরে দফতরটা একটু দেখে আসতে চাই৷ আপনারা অন্য কথায় কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে দিন৷ আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব৷ আর, আমি তো ওর দফতর চিনি না৷ ওর ঘরে আসব, কেউ ঢুকতেও দেবে না৷ যদি সঙ্গে কাউকে দিয়ে দেন!’

‘বাসুদেবকে ডেকে দাও,’ বলল যুবরাজ৷

সে এল, যুবরাজ বলল, ‘ইনি জয়ধর৷ এঁকে কাত্যায়নের দফতরে ওঁর ঘরে নিয়ে যাবে৷ ইনি আমার বিশেষ অন্তরঙ্গ৷ ইনি যেখানে যেতে চান যাবেন৷ যা দেখতে চান দেখবেন৷ এঁকে কেউ যেন কোনো বাধা না দেয়৷ আর হ্যাঁ, বাসুদেব, যাওয়ার সময় এই দলিলপত্র ও চিঠিগুলো মহারাজাধিরজের মন্ত্রণাগৃহে ওঁর ফলকের উপর সাজিয়ে রেখে দিয়ো৷ জয়ধর, তুমি চলে যাও বাসুদেবের সঙ্গে৷ আমি ইতিমধ্যে কাত্যায়নকে ডেকে পাঠাচ্ছি৷’

জয়ধর বলল, ‘সেই সঙ্গে বজ্রসেনকেও ডেকে পাঠানো হোক৷ সব কথাবার্তা ওর সামনেই হবে৷’

‘বেশ, তাকেও ডেকে পাঠাচ্ছি৷’

কিছুক্ষণ পর জয়ধর যখন ফিরে এল, তখন ঘরের মধ্যে কাত্যায়ন আর বজ্রসেন দু-জনেই বসে আছে যুবরাজের সামনে৷ যুবরাজের অন্যপাশে বসে আছে মাধবশূর৷ সাধারণ অন্য কথাবার্তা হচ্ছে দৈনন্দিন রাজকার্য সম্বন্ধে৷

জয়ধর আসতে যুবরাজ বলল, ‘কাত্যায়ন, ইনি জয়ধর৷ আমার খুব ঘনিষ্ঠ সহচর৷ ইনি আপনাকে কয়েকটি প্রশ্ন করতে চান৷’

‘সব কথাবার্তা একটু নিরিবিলিতে হওয়া দরকার,’ জয়ধর বলল, ‘আপনার কাছে এখন কেউ আসবে?’

‘না, কেউ আসবে না৷ মাধবশূর, বাইরে বলে দাও, কেউ আর এখানে আসবে না৷ ও হ্যাঁ, কোষাধ্যক্ষের চিঠির উত্তরটা নিয়ে যাও, দিয়ে দাও ওই লোকটিকে৷ সে বাইরে অপেক্ষা করছে৷ আরে, চিঠিটা গেল কোথায়?’

ফলকের উপর অন্যান্য ভূর্জপত্রের মধ্যে খোঁজাখুঁজি করল মানবদেব, কিছু পেল না৷ চোখ তুলে কাত্যায়নের দিকে তাকাল৷ অবশ্য এ চিঠি নিয়ে কাত্যায়ন কী করবে? এটা কোষাধ্যক্ষের একটি সাধারণ চিঠির উত্তর৷ একটি ব্যাপারে সে কয়েকটি নির্দেশ চেয়েছিল৷

জয়ধর বলল, ‘মন্ত্রীবর কাত্যায়ন নেননি তো?’

‘আমি! আমি কেন নিতে যাব?’

‘আপনার তো চিঠি সরানোর অভ্যেস আছে৷’

‘তুমি কে হে? তোমায় চেনা চেনা মনে হচ্ছে৷ ও, তুমি নগরপাল পূর্ণ মিত্রের ছেলে-না? আমার সঙ্গে সমীহ করে কথা বলবে৷’

‘খুব সমীহ করেই বলছি মন্ত্রীমশাই৷ আপনি বোধ হয় জানেন না, মহারাজকুমার মানবদেব আমাকে নিযুক্ত করেছেন ওঁর হারিয়ে যাওয়া চিঠিগুলো খুঁজে বার করার জন্যে৷’

‘কী চিঠি?’

‘আপনি জানেন না?’

‘না, আমি কী করে জানব?’

‘আমাদের সবার সামনে আপনি কিছু স্বীকার করতে চান না৷ এই তো ব্যাপার? আমার ধারণা, রাজদ্রোহের অপরাধে মহারাজকুমারের নির্দেশে বজ্রসেন আপনাকে একটু পরে বন্দি করবে৷ সে জন্যেই আপনাকে এখানে আনানো হয়েছে৷’

কাত্যায়ন তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল যুবরাজের দিকে৷

‘বন্দি করা হবে? রাজদ্রোহের অভিযোগে? কোনো প্রমাণ আছে?’

‘হ্যাঁ আছে,’ জয়ধরই উত্তর দিল৷

কাত্যায়ন এক একবার করে সবার দিকে তাকাল৷ তারপর বলল, ‘বেশ সোজাসুজি কথা বলছি সবার সঙ্গে৷ কেউ যেন আমার কেশ স্পর্শও না করে৷ তা হলে যুবরাজের চিঠি মহারাজাধিরাজের হাতে পড়বে৷ যুবরাজ তাতে খুশি হবেন না৷’

জয়ধর বলল, ‘আপনাকে আগেই বলেছি, মহারাজকুমার আমায় নিযুক্ত করেছেন সেই চিঠি খুঁজে বার করার জন্যে৷’

‘বেশ তো৷ খুঁজে বার করো৷ আমি স্বীকার করছি, ওটা আমি লুকিয়ে রেখেছি৷ মহারাজাধিরাজ এলে তাঁকে দেব৷ কিন্তু এমন জায়গায় রেখেছি যে কেউ খুঁজে পাবে না৷’

‘আমি যদি খুঁজে বার করে দিতে পারি, আমায় কী দেবেন?’

কাত্যায়ন হেসে উঠল৷ কোনো উত্তর দিল না৷

জয়ধর যুবরাজের দিকে ফিরল৷ ‘আপনি এইমাত্র কোষাধ্যক্ষের চিঠির একটা উত্তর লিখেছিলেন, সেটি খোয়া গেছে৷ বাসুদেবকে ডেকে বলুন তো যেসব দলিলপত্র ও চিঠি সে মহারাজাধিরাজের মন্ত্রণাগৃহে রেখে এসেছে, তার মধ্যে ওই উত্তরটা খুঁজে পায় কি না?’

কাত্যায়ন লাফিয়ে উঠল৷ বজ্রসেন তাকে চেপে ধরে বসিয়ে দিল৷

মানবদেব বলল, ‘কিন্তু সে চিঠি ওসব দলিলপত্রের মধ্যে যাবে কেন? ওরকম ভুল তো আমি করি না৷’

জয়ধর উত্তর দিল, ‘আপনি ভুল কিছু করেননি৷ আমিই আপনাদের চোখের সামনে ওটা বাসুদেবের হাতের থালায় অন্য চিঠিপত্রের মধ্যে গুঁজে দিলাম৷ আপনারা লক্ষ করেননি৷ আমারই একটুখানি হাত সাফাই, এই আর কি! একই কার্য আমাদের মন্ত্রীমশাইও করেছিলেন৷ সত্যি কি না জিজ্ঞেস করুন৷’

মানবদেবকে খুব উত্তেজিত দেখাল৷ বলে উঠল,-‘ডাকো, বাসুদেবকে ডাকো৷’

জয়ধর বলল, ‘ওকে আর ডাকতে হবে না৷ আমি অন্য কোথাও যাইনি, বাসুদেবের সঙ্গে মহারাজার মন্ত্রণাগৃহেই গিয়েছিলাম৷ সেখানে একটু ঘেঁটেছি সব ভূর্জপত্র৷ আপনার অনুমতি নিইনি, তার জন্যে আমায় মার্জনা করবেন৷ অবশ্যি বাসুদেব আমায় বাধা দেয়নি৷ তাকে তো আপনার নির্দেশ দেওয়া ছিল, ইনি যেখানে যেতে চান যাবেন, যা দেখতে চান দেখবেন, এঁকে কেউ যেন বাধা না দেয়৷ এই নিন-‘

জামার ভিতর থেকে তিনটি চিঠি বার করে নামিয়ে রাখল মানবদেবের সামনের ফলকের উপর৷

যুবরাজ লাফিয়ে উঠল, ‘হ্যাঁ, এই তো চিঠিগুলো৷ এটি ভণ্ডীদেবের চিঠি৷ এই আমার উত্তর৷ আর এটি, অবন্তীদেবের চিঠি৷’

একপ্রস্থ ইতর গালাগাল বেরোল কাত্যায়নের মুখ থেকে৷

বজ্রসেন বলল, ‘কাত্যায়ন, এখন আপনি আমাদের বন্দি৷ আমাদের হাতে প্রমাণ আছে যে, আপনি মহারাজ হর্ষবর্ধনের কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ পেয়ে দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন করার জন্যে ষড়যন্ত্র করছেন৷ আপনার হাতে ওই চিঠিগুলো ছিল বলে এই ক-দিন আমরা চুপ করে ছিলাম৷ এখন তো আর চুপ করে থাকার দরকার নেই৷ চলুন আমাদের দফতরে৷ এবার আপনাকে আমাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে৷’

‘এত সাহস? কাত্যায়ন গর্জে উঠল,’ আমি মহারাজ শশাঙ্কের মন্ত্রী৷ উনি এলে আমি নালিশ করব সবার বিরুদ্ধে৷

‘সে তখন দেখা যাবে’,-এই বলে বজ্রসেন তার রক্ষীদের ডাকল৷

কাত্যায়নকে নিয়ে বজ্রসেন চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ কেটে গেছে৷ ঘরের মধ্যে শুধু যুবরাজ মানবদেব, কুমারামাত্য মাধবশূর আর জয়ধর৷ প্রাসাদের ভেতর থেকে সুপেয় ঠান্ডা পানীয় এসেছে এদের জন্যে৷

জয়ধর বলছিল, ‘আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, কাত্যায়ন এমন জায়গায় চিঠিগুলো রেখেছে যেটা আপনারা ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করতে পারেন না, যেখানে আপনারা কখনো খুঁজতে যাবেন না৷ একেবারে আপনাদের চোখের সামনে, অথচ আপনাদের চোখে পড়ছে না৷ ভাবছিলাম তেমন জায়গা কী হতে পারে? কাত্যায়নের জায়গায় আমি হলে কী করতাম, কোথায় লুকিয়ে রাখতাম চিঠিগুলো৷ যেই আপনি বাসুদেবকে ডাকলেন, ওকে দলিল ও চিঠিপত্র দিলেন মহারাজের মন্ত্রণাগৃহে রাখবার জন্যে, অমনি মাথায় খেলে গেল৷ বুঝলাম, এ তো খুব সহজ হাত সাফাইয়ের ব্যাপার৷’

যুবরাজ বলল, ‘আজ থেকে তুমি আমারই কাজে নিযুক্ত হলে৷ মাসে তিরিশ স্বর্ণমুদ্রা মাইনে৷’

সেদিন থেকে এক হাজার তিন-শো ষাট বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে৷ আমরা সেদিনের ইতিহাস সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু মনে রাখিনি৷ শুধু এটুকু জানি যে সান্ধিবিগ্রহিক অবন্তীদেবের কূট চাল খাটেনি৷ এবং হর্ষবর্ধনদেব ও ভাস্করবর্মার সেনাবাহিনীও, যদ্দিন মহারাজ শশাঙ্ক বেঁচেছিলেন তদ্দিন গৌড়দেশ আক্রমণ করতে সাহস করেনি৷ পরে যখন শশাঙ্কদেব মারা গেলেন, হর্ষবর্ধন ও ভাস্করবর্মার সম্মিলিত সেনাবাহিনী গৌড়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল৷ মানবদেব শুধু আট মাস রাজত্ব করেছিল৷ তারপর গৌড় দখল করেছিল ভাস্করবর্মা৷

ব্যাঘ্রভূমির বঙ্গবীরহেমেন্দ্রকুমার রায়

ললিতাদিত্য তখন কাশ্মীরের রাজা৷ তিনি সিংহাসন অধিকার করেছিলেন ৭৩৩ থেকে ৭৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত৷

তিনি ছিলেন শক্তিশালী দিগ্বিজয়ী৷ তিব্বতিদের, ভুটিয়াদের ও সিন্ধুতীরবর্তী তুর্কিদের দমন করে তিনি নাম কিনেছিলেন৷ ভারতের দেশে দেশেও উড়েছিল তাঁর জয়পতাকা৷ কাশ্মীরের বিখ্যাত মার্তণ্ড-মন্দির তাঁর দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল৷ আজও বিদ্যমান আছে ওই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ৷

সেই সময়ে কনোজ বা কান্যকুব্জে রাজত্ব করতেন আর এক পরাক্রান্ত রাজা, নাম তাঁর যশোবর্মা৷ তাঁর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মগধ ও বঙ্গদেশের রাজারা পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হন৷ মগধের রাজা ছিলেন দ্বিতীয় জীবিতগুপ্ত৷ কিন্তু বঙ্গ বা গৌড়ের সিংহাসন ছিল কোন রাজার অধিকারে, ঐতিহাসিকরা আজও তাঁর নাম খুঁজে পাননি৷ তবে তিনি ছিলেন নাকি অসংখ্য হস্তীর অধিকারী৷

চিরকালই এক রাজার উন্নতি আর-এক রাজা দেখতে পারেন না৷ পৃথিবীতে এই নিয়েই যত অশান্তি, যত যুদ্ধবিগ্রহ৷ রাজা যশোবর্মার যশ ললিতাদিত্য সহ্য করতে পারলেন না৷ সসৈন্যে তিনি করলেন যশোবর্মাকে আক্রমণ৷ যশোবর্মা হলেন পরাজিত ও সিংহাসনচ্যুত৷

তখন বঙ্গেশ্বর কতকগুলি হস্তী উপঢৌকন স্বরূপ পাঠিয়ে দিলেন ললিতাদিত্যের কাছে৷ এর দু-টি কারণ থাকতে পারে৷ যশোবর্মার দ্বারা বিজিত বঙ্গেশ্বর শত্রুর পতনে খুশি হয়েই হয়তো ললিতাদিত্যের কাছে উপহার পাঠিয়ে মনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন৷ কিংবা এও হতে পারে, ললিতাদিত্য পাছে বঙ্গদেশও আক্রমণ করেন, সেই ভয়েই তিনি তাঁকে তুষ্ট করতে চেয়েছিলেন৷

তার পর বঙ্গেশ্বরের কাছে কাশ্মীর থেকে এল আমন্ত্রণ, তাঁকে ললিতাদিত্যের আতিথ্য স্বীকার করতে হবে৷

তখন অষ্টম শতাব্দী চলছে৷ সে সময় বাংলা থেকে কাশ্মীরে যাওয়া বড়ো যে-সে কথা ছিল না৷ তারপর এই আমন্ত্রণের উদ্দেশ্য এবং ললিতাদিত্যের মনের কথা কেউ জানে না৷ বঙ্গেশ্বর যথেষ্ট ভীত হলেন বটে, কিন্তু উপায় কী? দিগ্বিজয়ী ললিতাদিত্যের আমন্ত্রণ ও আদেশ একই কথা৷

সুদীর্ঘ, দুর্গম পথ পার হয়ে কয়েক মাস পরে বঙ্গেশ্বর কাশ্মীরে গিয়ে উপস্থিত হলেন৷

কাশ্মীরে ললিতাদিত্য একটি নতুন নগর স্থাপন করে তার নাম রেখেছিলেন, ‘পরিহাসপুর’, এখন তাকে ‘পরসপোর’ বলে ডাকা হয়৷ সেখানে ছিল তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘পরিহাসকেশব’ নামে দেবতার বিগ্রহ ও মন্দির৷

অবশেষে পরিহাসপুরে হল দুই রাজার সাক্ষাৎকার৷

বঙ্গেশ্বরের মুখ বিষণ্ণ, তখনও তাঁর মনের ভয় ভাঙেনি৷

আসল ব্যাপারটা উপলব্ধি করে ললিতাদিত্য বললেন, ‘রাজন, আশ্বস্ত হন৷ আপনি আমার অতিথি৷ এই আমি ভগবান পরিহাসকেশবকে মধ্যস্থ রেখে প্রতিজ্ঞা করছি, আমার দ্বারা আপনার কোনো অনিষ্ট হবে না৷’

বঙ্গেশ্বর হয়তো আশ্বস্ত হলেন৷

তার পরের ব্যাপারটা ভালো করে বোঝা যায় না৷ বঙ্গেশ্বর যখন ত্রিগামী নামে একটি স্থানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন, ললিতাদিত্য তাঁকে হত্যা করে নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলেন৷ হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়ে এক অসহায় অতিথিকে এমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার কারণ কী? ইতিহাস সে সম্বন্ধে নীরব! এমন অহেতুক বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনি পৃথিবীর ইতিহাস খুঁজলেও আর পাওয়া যায় কি না সন্দেহ৷

যথাসময়ে এই দারুণ দুঃসংবাদ এসে পৌঁছোল বাংলাদেশে৷

সারা দেশ শোকাচ্ছন্ন, রাজপ্রাসাদে হাহাকার৷

কিন্তু নারীর মতো হায় হায় করে কেঁদে নিজেদের কর্তব্য সমাপ্ত করল না বঙ্গেশ্বরের প্রিয় পরিচারকবৃন্দ৷ বাঘের মুলুক বাংলাদেশে কোনোদিনই দৃপ্তমনের অভাব হয়নি৷ একালে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্যেই ফিরিঙ্গি বণিকরা বাঙালি কাপুরুষ বলে মিথ্যা অপবাদ রটাবার চেষ্টা করেছে৷ আসলে তারাও বাঙালিদের ভয় করত মনে মনে৷

পরিচারকদের সর্দার ক্রোধকম্পিত কন্ঠে চিৎকার করে উঠল, ‘প্রতিশোধ চাই, প্রতিশোধ চাই!’

কেউ প্রশ্ন করল, ‘কেমন করে প্রতিশোধ নেবে?’

‘আমরা কাশ্মীরে যাত্রা করব৷’

‘কোথায় কাশ্মীর, কোথায় বাংলা!’

‘দরকার হলে আমরা পৃথিবীর শেষ প্রান্তেও যেতে ছাড়ব না৷ হাত গুটিয়ে বসে থেকে এ অপমান মাথা পেতে সহ্য করব? ভাইসব, আমরা কি বাঙালি নই?’

‘আমরা হচ্ছি মুষ্টিমেয় বিদেশি, সেই সুদূর অজানা দেশে অসংখ্য শত্রুর সামনে গিয়ে আমরা কি দাঁড়াতে পারব? এ অসাধ্যসাধন কি সম্ভবপর?’

‘আমাদের অন্নদাতা প্রভু বিশ্বাসঘাতকের হাতে নিহত৷ যে তাঁর অন্ন গ্রহণ করেছে, সেই-ই আজ একাই হবে এক-শো জন-সেই-ই আজ করতে পারবে অসাধ্যসাধন৷ আজ কোনো কথা নয়-কাশ্মীরে চলো, কাশ্মীরে চলো৷’

পরিচারকের দল সমস্বরে গর্জন করে উঠল, ‘কাশ্মীরে চলো, কাশ্মীরে চলো!’

দিনের পর দিন যায়, রাতের পর রাত৷ সূর্য ওঠে, চাঁদ ওঠে, উদয়ের পরে অস্ত, মাসের পরে হয় মাসকাবার৷ নদ, নদী, প্রান্তর, দুর্গম কান্তার, দুরারোহ গিরিদরী৷ ক্রোশের পর ক্রোশ-তবু যেন পথের শেষ নাই৷ ঋতুর পর ঋতু চলে যায়-কখনো অগ্নিবাণ হেনে, কখনো তুষারবৃষ্টি করে- তবু পথিকরা শ্রান্ত নয়, তারা চলছে, দুলছে, চলছে৷ একটু শিথিল হয়নি তাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা৷

অবশেষে পথের শেষ৷ এই তো কাশ্মীরের সীমান্ত!

কাশ্মীরি রক্ষী সবিস্ময়ে দেখল, অদ্ভুত পোশাক-পরা একদল বিদেশিকে৷ শুধোল, ‘কে তোমরা?’

‘আমরা গৌড়বাসী৷’

‘এদেশে এসেছ কেন?’

‘তীর্থ করতে৷’

‘কোথায় যাবে?’

‘কাশ্মীরে সারদা দেবীর মন্দিরে পূজা দিতে৷’ রক্ষী পথ ছেড়ে দিল৷

সর্দার পরিচারক বলল, ‘আমরা পরিহাসপুরেও গিয়ে পরিহাসকেশবের মন্দির দেখব৷ সেখানে যাবার পথ কোন দিকে?’

রক্ষী পথ বাতলে দিল৷

‘মহারাজ ললিতাদিত্য এখন কোথায়?’

‘রাজ্যের বাইরে৷’

মনে মনে হতাশ হয়েও সর্দার মুখে কোনো ভাবই প্রকাশ করল না৷

তারা প্রবেশ করল পরিহাসপুরে৷

সর্দার গম্ভীর স্বরে বলল, ‘সবাই ছদ্মবেশ খুলে ফেলো৷ অস্ত্র ধরো!’

‘তারপর আমরা কী করব?’

‘পরিহাসকেশবকে আক্রমণ করব৷’

‘পরিহাসকেশব যে দেবতা!’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বিশ্বাসঘাতকের উপাস্য দেবতা! পরিহাসকেশবকেই মধ্যস্থ রেখে ললিতাদিত্য প্রতিজ্ঞা করেছিল, বঙ্গেশ্বরের গায়ে সে হাত দেবে না৷ তারপর সে যখন প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে উদ্যত হয়, পরিহাসকেশব কি তাকে নিরস্ত করতে পেরেছিলেন? ললিতাদিত্য রাজ্যের বাইরে, এত দূরে এসে আমরা কি ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাব? তার বদলে চাই আমরা পরিহাসকেশবকেই! যে-দেবতাকে উপাসনা করে মানুষ এমন হীন, এমন বিশ্বাসঘাতক হতে পারে, আমরা সকলে মিলে আজ চূর্ণবিচূর্ণ করব সেই পঙ্গু, অপদার্থ দেবতাকে! ভাইসব! অস্ত্র ধরো, অস্ত্র ধরো!’

পরিহাসকেশবের মন্দিরের পূজারিরা সভয়ে ও সবিস্ময়ে দেখলেন, একদল ভৈরবমূর্তি শূন্যে তরবারি নাচাতে নাচাতে ও বিকট স্বরে চিৎকার করতে করতে বেগে ছুটে আসছে-‘চূর্ণ করো, চূর্ণ করো, চূর্ণ করো পরিহাসকেশব!’

প্রমাদ গুণে পুরোহিতরা মন্দিরের প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দিলেন৷

বাঙালিরা তখন পর্যন্ত জানত না, কোনটি পরিহাসকেশবের মন্দির৷

সামনে পেল তারা আর একটি জমকালো মন্দির, তার ভিতরে ছিল রামস্বামীর রৌপ্যনির্মিত বিগ্রহ৷ তাকেই পরিহাসকেশবের মূর্তি মনে করে তারা হইহই করে তার উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ল ক্রুদ্ধ শার্দুলের মতো৷ যারা বাধা দিতে এল, তারা হল হত কি আহত৷ তারপর খণ্ডবিখণ্ড হয়ে ধুলোয় লুটোতে লাগল রুপোয়-গড়া মূর্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ৷ রাজধানী থেকে খবর পেয়ে ছুটে এল কাতারে কাতারে কাশ্মীরি সৈনিক৷

সর্দার পরিচারক নির্ভীক কন্ঠে বলল, ‘আমরা বাংলার বীর৷ কারুর দয়া চাইব না, কারুকে দয়া করব না৷ আমরা অস্ত্র নিয়ে শত্রুসংহার করতে করতে সম্মুখযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন করব! ভাইসব, মারো আর মরো!’ নগণ্য বাঙালির দল, অগণ্য শত্রুসৈন্য৷ এক-এক বাঙালি চেষ্টা করল এক-শো জনের মতো হতে, মরিয়া হয়ে সবাই লড়তে লাগল-বধ করল বহু শত্রুকে৷ তারপর শত্রুরক্তে প্লাবিত মৃত্তিকার উপর লুটিয়ে পড়ে একে একে করল শেষ নিশ্বাস ত্যাগ৷ কেউ পালিয়েও গেল না, কেউ প্রাণেও বাঁচল না৷

প্রায় চার শতাব্দী পরেও কহ্লন দেখেছিলেন রামস্বামীর বিগ্রহহীন মন্দির এবং তখনও সারা কাশ্মীরে কথিত হত বঙ্গবীরদের অপূর্ব বীরত্ব৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *