চতুর্থ খণ্ড (স্নেহের দীপঙ্কর আচার্য এবং সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়)
পঞ্চম খণ্ড (বন্ধুবর স্নেহপ্রতিম শ্রী নিতীশ রায় ও বউদিকে)
4 of 6

যুবক

যুবক

আজকের যুবকদের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য, তাদের চালনা করার মতো আজ আর কেউ নেই। জাতীয় কোনও নেতা নেই। দুর্ভাগ্য যুবকদের নয়। দুর্ভাগ্য নেতৃত্বের। সকলেই গদির লড়াইয়ে ব্যস্ত। অনুকরণীয় কোনও আদর্শ নেই দেশে। শিক্ষা বলতে আমরা কতকগুলো, ডিগ্রি-ডিপ্লমা বুঝি। প্রতিষ্ঠা বলতে বুঝি বড় চাকরি আর ব্যাবসা। মানুষ প্রকৃত মানুষ হল কিনা, দেখার দরকার নেই। মানবিক গুণসমূহের বিকাশ হল কিনা, দেখার প্রয়োজন নেই। সেই মানুষটা সামাজিক কিনা, না অসামাজিক সমাজ-বিরোধী বিচার করার প্রয়োজন নেই। অন্য মানুষের জন্যে ভাবে কিনা, সামান্যতম স্বার্থত্যাগে প্রস্তুত কিনা, আমরা খতিয়ে দেখি না। আজকের তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। আপনি আর আপনার পরিবার, এর বাইরে কিছু নেই। এমনকি নিজের বৃদ্ধ পিতামাতার কথাও ভাবার দরকার নেই। বাড়ি, গাড়ি, আধুনিক ভোগের সামগ্রী, কেরিয়ার, বিদেশ ভ্রমণ, ছেলেমেয়ে ইংলিশ মিডিয়াম এডুকেশান, তাদের বিদেশ পাঠান, ঘটা করে নিজের মেয়ের বিয়ে, সারাটা জীবন এই নিয়ে ব্যস্ত। নিজের ফ্ল্যাটেই পার্টি। প্রভূত মদ্যপান। মেলামেশাটা। নিজের সার্কলে। এক সময় সায়েবরা যেমন নেটিভদের ঘৃণা করত, এঁরাও সেইরকম নিচের তলার মানুষকে দেখে নাক সিটকোন। অথচ নীচের তলাটা তৈরি হয়েছে ওপরতলার স্বার্থপরতায়। জীবনে যাঁরা বৈষয়িক প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, তাঁরা বিভ্রান্ত, হতাশাগ্রস্ত যুবকদের দিকে তাকিয়ে ঘৃণার উক্তি করেন, দেশটা উচ্ছন্নে গেছে, এ জাতের কিছু হবে না। কী করে হবে? কিছু হওয়াতে গেলে যে কিছু স্বার্থত্যাগ করতে হবে। বাবা। পরদাফেলা, ওপরতলার, কার্পেট-মোড়া ঘরে বসে বিলিতি ফ্যাশান ম্যাগাজিন পড়লে, কী ভি সি আর-এ রগরগে ফিল্ম দেখলে কিছু হবে না। নিজেদের পায়ের তলা থেকেই ধীরে ধীরে জমি সরে যাচ্ছে। খরগোশ-বৃত্তি নিলে কী হবে। পশ্চাদ্দেশ যে উন্মোচিত!

জাতীয় স্তরেও এক সুন্দর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। হতাশ যুবক হল রাজনীতিকদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার। যেসব বাঁধন দিয়ে বাঁধলে মানুষ মানুষ হতে পারে সেই সব বাঁধন কেটে ফেলা হয়েছে। প্রাচীন বিশ্বাস ভেঙে ফেলা হয়েছে। আদর্শকে মেরে ফেলা হয়েছে গলা টিপে। ধর্ম ছিল মস্ত বড় একটা মেরুদণ্ড। ধর্ম মানে ঘণ্টা নাড়া কুসংস্কার নয়। তেত্রিশ কোটি দেবদেবীকে মানা নয়। হিন্দুধর্ম হল আদর্শ মানবের আচরণ-বিধি। একজন সায়েবও হিন্দু হতে পারে। পরিমিতিবোধ, সদাচরণ, স্বার্থত্যাগ, ধৈর্য, সংযম, তিতিক্ষা, আত্মচিন্তা, উদারতা, সহিষ্ণুতা প্রভৃতির অনুশীলনই ধর্ম। এর বিপরীতটাই অধর্ম। ধার্মিকের একটা ভয় থাকে। সে ভয় হল, আমি অমানুষ হয়ে যাচ্ছি না তো! একটা সময় ছিল যখন শৈশব থেকেই শেখানো হত, শ্রদ্ধেয়কে শ্রদ্ধা করো। মহাপুরুষদের শ্রদ্ধা করো। দেবতাজ্ঞানে পিতামাতাকে ভক্তি করো। দুশ্চরিত্র হোয়ো না। ছাত্রের তপস্যা হল অধ্যয়ন। ধর্ম হল ব্রহ্মাচর্য। শেখানো হত, দেশকে ভালোবাসো। দশের কথা ভাবতে শেখো। বড় মানুষের সংজ্ঞা ছিল ধনী হওয়া নয়, চরিত্রবান আদর্শ মানুষ হওয়া, বিনয়ী হওয়া, আত্মপ্রচার না করা, আগ্রাসী না হওয়া। বলা হত— আপনারে বড় বলে বড় সেই নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়। শেখানো হত সংযম। জীবনকে গ্রহণ করতে শেখানো হত। সেই সব এখন চুলোয় গেছে। নিজের দেশের মহাপুরুষ বিতাড়িত। বিদেশ থেকে ধরে আনা হয়েছে বর। তিনিই এখন ধ্রুবতারা।

ধর্মকে মারার পর, তছনছ করা হয়েছে শিক্ষা-ব্যবস্থা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন রাজনীতির বাসা। অশ্রদ্ধাই এখন পরিবেশ। বিদ্বেষই এখন আচরণ। ঘৃণাই এখন শিক্ষা। অহিংসা হল দুর্বলতা। হিংসাই হল বীরত্ব। কোথায় গেল আমাদের অহিংসা। সহিষ্ণুতা। সবস্তরে চেষ্টা চলছে খুনি তৈরির। মগজে ধোলাইয়ের কাজ বেশ ভালোই এগোচ্ছে। সর্বহারার দল তৈরি করতে হবে। শিক্ষায়, দীক্ষায়, জীবিকায়, অর্থে, আশ্রয়ে সব অর্থে সর্বহারা। তছনছ করে দিতে হবে ন্যায়-অন্যায়বোধ। অদৃশ্য শত্রু তৈরি করতে হবে। শত্রু দারিদ্র বা অশিক্ষা নয়। প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি মানুষের শত্রু। এইভাবেই যুবসমাজকে অনিকেত করে, টেনে নিতে হবে রাজনীতির শিবিরে। সেখানে বস হলেন দলীয় নেতারা। পিতা, মাতা, ভাই, বোন, শিক্ষাগুরু, ধর্মগুরু, পথ, পথপ্রদর্শক, কোনও কিছুই নেই। আছেন দাদারা। খানা-টেবিলে বসে তাঁরা অলীক সব ধাপ্পা দেবেন। মাখন-মাখান রুটি তাঁরাই খাবেন। মাঝেমধ্যে গুড়ো গাঁড়া, টুকরো-টাকরা তলায় ফেলবেন। পোষ্যরা খেয়োখেয়ি শুরু করে দেবে। ধর্মের নামে মধ্যযুগে ক্ষমতা লোভী পুরোহিতের দল পুড়িয়ে মানুষ মেরেছে। রাজনীতির পুরোহিতেরা সেই একই কাজ করছে। হাতিয়ার হতাশ যুবশক্তি। অবিশ্বাসী বিভ্রান্ত যুবকের দল। যাদের সামনে মিথ্যা এক ভবিষ্যতের চিত্র আঁকা হয়েছে। অতীত মুছে গেছে, ভবিষ্যৎ নেই। আছে ক্রীতদাসের বর্তমান। দেশ আজ কি সুগভীর চক্রান্তের শিকার। ভারতীয়রা বিশেষ করে বাঙালিরা কখনও জাতির কথা ভাবেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *