যুধিষ্ঠিরের ডায়েরি
বার বছর বনবাসে থাকাকালীন পাণ্ডবরা কখন কোথায় ছিলেন, এবং কিভাবে ছিলেন, ওই সময়ে কখন কোন্ উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল—এসব আমাদের জানতে ইচ্ছে করে।
সত্যনিষ্ঠ যুধিষ্ঠির যদি তখন রোজ ডায়েরি লিখতেন, আর সে ডায়েরি যদি আমাদের হাতে থাকত, তাহলে এই মজার পর্ব লেখার দরকারই হত না। বনবাসের সব তথ্যই আমরা পেয়ে যেতাম।
রোজনামচা না হলেও মাঝে মধ্যেই যুধিষ্ঠির যদি তাঁর দিনলিপি লিখতেন, তাহলে তা কেমন হত, তা কল্পনার রঙে আঁকার চেষ্টা করা হল। জানি না, মাটির তাল শিব হতে গিয়ে বাঁদর হয়ে গেল কিনা।
॥ বনবাসে থাকাকালীন আমরা (পাণ্ডবেরা) কখন কোথায় ছিলাম ॥
॥ আমাদের (পাণ্ডবদের) বার বছর বনবাসের দিনলিপি (যুধিষ্ঠিরের বয়ানে) ॥
॥ কাম্যক বনে ॥
হস্তিনাপুরে থেকে বেরিয়ে আমরা (পাণ্ডবরা) প্রথমেই গেলাম পশ্চিম দিকে। বনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছলাম সরস্বতী নদীর তীরে মুনি-ঋষিদের প্রিয় জায়গা কাম্যক বনে। (বর্তমান কচ্ছ উপসাগরের কাছে।) কৃষ্ণ এসে কিছুদিন থাকলেন আমাদের (পাণ্ডবদের) সঙ্গে। কটা দিন বেশ আনন্দেই কাটল। ভারি সুন্দর জায়গা এই কাম্যক বন। ভাবছি এখানেই কাটাব বনবাসের দিনগুলো।
॥ দ্বৈত বনে ॥
কৃষ্ণ দ্বারকায় চলে যাবার পর আমরা (পাণ্ডবরা) চলে এলাম দ্বৈতবনে। (এখনকার সাহারানপুর জেলার দেওবাঁদ বা দেওবন্দে। ) দ্বৈতবনও সরস্বতী নদীর ধারেই। এখানেই একদিন সন্ধ্যেবেলা আমার (যুধিষ্ঠিরের) সাথে দ্রৌপদীর বিখ্যাত কথোপকথন হয়। এখানেই ব্যাসদেব আমাকে (যুধিষ্ঠিরকে) ‘প্রতিস্মৃতি বিদ্যা’ শেখান। এই দ্বৈতবনও বেশ সুন্দর জায়গা। আমার এক মারাত্মক ভুলের মাশুল গুণতে হচ্ছে আজকে আমার নিরপরাধ চার ভাই আর অপাপবিদ্ধা দ্রৌপদীকে।
॥ আবার কাম্যক বনে ॥
আবার কাম্যক বনে ফিরে এলাম আমরা (পাণ্ডবরা )। এখানে বন্য হরিণের মাংসই ছিল আমাদের প্রধান খাদ্য। এখান থেকেই অর্জুন দেবলোকে গেছে নানা দিব্যাস্ত্র আনতে। আর আমি (যুধিষ্ঠির) অন্য ভাইদের আর দ্রৌপদীকে নিয়ে বেরিয়েছি নানা তীর্থ পর্যটনে। মুনি-ঋষি-দের কথা মত তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেশ আনন্দ পেলাম।
॥ বদরিকাশ্রমে ॥
তীর্থ পর্যটন শেষে আমি (যুধিষ্ঠির), ভীম, নকুল, সহদেব আর দ্রৌপদী—আমরা কজন এলাম বদরিকাশ্রমে। (এখনকার কাশ্মীরের কোথাও ছিল এই বদরিকাশ্রম বা নরনারায়ণাশ্রম। ) জায়গাটা খুব সুন্দর। মনোরম।
॥ গন্ধমাদন পর্বতে ॥
বনবাসের চার বছর কেটে গেছে। আমরা (পাণ্ডবরা) এসেছি গন্ধমাদন পর্বতে। (রুদ্র-হিমালয়ের উত্তর দিকে ছিল গন্ধমাদন। পুরাণ মতে কৈলাস পর্বতে ছিল। ) এখানেই স্বর্গ থেকে দিব্যাস্ত্র-বিদ্যা আর নাচ-গান ইত্যাদি শিখে এসে অর্জুন আবার মিলিত হয়েছে আমাদের (অন্যান্য পাণ্ডবদের) সঙ্গে। অর্জুনকে ওর ধর্মপিতা ইন্দ্র অনেক দিব্যাস্ত্র দিয়েছেন। এগুলো হয়তো পরে আমাদের কাজে লাগলেও লাগতে পারে।
॥ হিমালয়ের পথে পথে ॥
এর পর হিমালয়ের পথে পথে এ পাহাড় থেকে সে পাহাড় ঘুরে বেড়িয়েছি আমরা (পাণ্ডবরা)। এখানেই নহুষের অনেক জটিল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তাঁকে খানিকটা তৃপ্ত করতে পেরিছিলাম আমি (যুধিষ্ঠির)। শাপগ্রস্ত অজগররূপী নহুষ শাপমুক্ত হয়েছেন আমার দর্শনে। এরকম কিছু একটা যে ঘটবে তা নাকি আগে থেকেই স্থির ছিল। বেশ মজার ব্যাপার।
॥ আবার কাম্যকবনে ॥
আবার কাম্যক বনে ফিরে এসেছি আমরা (পাণ্ডবরা)। এই নিয়ে তিন বার আসা হল এখানে। এখানেই কৃষ্ণ আর মার্কণ্ডেয় এসে দেখা করে গেলেন একদিন আমার (যুধিষ্ঠিরের) সঙ্গে। অনেক মূল্যবান কথাবার্তা হল ওঁদের সঙ্গে।
॥ আবার দ্বৈত বনে ॥
কাম্যক বন থেকে আবার দ্বৈত বনে এসেছি আমরা (পাণ্ডবরা)। এই নিয়ে দু’বার। আমাদের (পাণ্ডবদের) দুর্দশা দেখতে ‘ঘোষযাত্রায়’ এখানে এসেছে। সপার্ষদ দুর্যোধন। গন্ধরাজ চিত্রসেনের সঙ্গে যুদ্ধ লেগে গেল দুর্যোধনের। কৌরবদের পিটিয়ে ছাতু করে দিলেন চিত্রসেন। আমার (যুধিষ্ঠিরের) আদেশে ভীম আর অর্জুন সস্ত্রীক দুর্যোধন, দুঃশাসন ইত্যাদিকে মুক্ত করেছে। এটা করা দরকার ছিল। শত হক ওরা তো আমাদের নিজের লোক। এই পর্যায়ে এক বছর আট মাস কেটে গেছে দ্বৈত বনে।
কাল রাতে স্বপ্নে দেখলাম, দ্বৈতবনের হরিণেরা এসে কাতর প্রার্থনা জানাচ্ছে, আমরা (পাণ্ডবরা) যেন তাদের খেয়ে নির্মূল করে দিই। ঠিকই বলেছে ওরা। আমরা (পাণ্ডবরা) আবার ফিরে যেতে চাই কাম্যক বনে। কাম্যক বনেই আমরা ভাল ছিলাম। বড় শান্তির জায়গা।
॥ আবার কাম্যক বনে ॥
দ্বৈত বন থেকে আমরা (পাণ্ডবরা) আবার ফিরে এসেছি কাম্যক বনে। এবার নিয়ে চার বার। কিছুদিন পরেই এখানেই আমাদের বনবাসের এগার বছর পূর্ণ হবে।
ব্যাসদেব একদিন এসে আশীর্বাদ করে গেলেন, তের বছর পূর্ণ হলেই আমরা (পাণ্ডবরা) আবার আমাদের সব ঐশ্বর্য ফিরে পাব। এই সময়ই দুর্বাসা মনি দুর্যোধনের চক্রান্তে দশ হাজার শিষ্য নিয়ে আচমকা আমাদের (পাণ্ডবদের) অতিথি হলে দ্রৌপদীর প্রার্থনায় কৃষ্ণ সে বিপদ থেকে আমাদের (পাণ্ডবদের) বাঁচিয়েছেন।
এর মধ্যে একদিন জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে হরণ করতে গিয়ে ভীমের হাতে বেধড়ক ঠেঙানি খেয়েছে। আমি (যুধিষ্ঠির) জয়দ্রথকে প্রাণভিক্ষা দিয়েছি। নইলে আমারই জ্যাঠতুতো বোন দুঃশলা যে বিধবা হবে। সে আমি সইতে পারব না।
॥ আবার দ্বৈতবনে ॥
এর পর আমরা (পাণ্ডবরা) আবার এসেছি দ্বৈত বনে। এই নিয়ে তিনবার। বকরূপী ধর্মের হাতে একে একে প্রাণ দিয়েছে সহদেব, নকুল, অর্জন আর ভীম। আমি (যুধিষ্ঠির) বকের নানা কঠিন প্রশ্নের সদুত্তর দিয়ে তাঁকে খানিকটা তৃপ্ত করেছি। বক খুশি হয়ে সবার প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছেন।
বনবাসের বার বছর পূর্ণ হয়েছে। এখান থেকেই এক বছরের অজ্ঞাতবাসের জন্যে দ্রৌপদী সহ আমরা পঞ্চপাণ্ডব বিরাটনগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। বারটা বছর দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে যে কেটে গেল, বুঝতেই পারলাম না। এখন বুঝতে পারছি, এরও প্রয়োজন ছিল।