যুধিষ্ঠিরের আয়না
গগনচন্দ্র গিয়েছিল শহরে। বড়দিনের ফুর্তি করতে।
পৌষ মাস। পূর্ণিমা। গাছপালা মাঠঘাটের যেন সাড় নেই শীতে। হিমে সব কিছু ভেজা, কুয়াশাও ঘন। কনকনে হাড়-চেরা হাওয়া দিচ্ছিল পৌষের।
খেস্টান-পাড়ার কাছাকাছি এসে গগনচন্দ্র তার মোটরবাইক নিয়ে কাঁটা আর কুলঝোপের গায়ে ছিটকে পড়ল।
তারপর আর হুঁশ ছিল না তার।
হুঁশ এল যখন, তখন দেখল, কে যেন তাকে ঝোপের কাঁটা সরিয়ে হাত ধরে টেনে তুলছে।
গগনচন্দ্র প্রথমটায় উঠতে পারছিল না। হাত পা নড়ছে কই! কোমর-পিঠ ভারী। মাথায় ঘোর লেগে আছে।
লোকটা অল্পক্ষণ টানাটানির পর গগনচন্দ্রকে বসিয়ে দিল।
ধীরে ধীরে নিজের হাত-পায়ে সাড় পাচ্ছিল গগন। মাথাও খানিকটা পরিষ্কার হয়ে এল। কোথায় কোথায় লেগেছে বুঝতে পারছিল না।
”আমি ধরে থাকি, আপনি উঠে দাঁড়ান, বাবু।”
লোকটা গগনের হাত ধরেই থাকল। বরং আরও জোর করেই ধরল।
গগনচন্দ্র উঠে দাঁড়াল। কাতরাচ্ছিল খানিকটা।
পায়ে কোমরে লেগেছে। বাঁ দিকের হাতে, পিঠে। খানিকটা বেঁকে এক পাশে হেলে দাঁড়িয়ে ঝোপের দিকে তাকাল গগন। কুলঝোপই বেশি, কাঁটাগাছ কম, তার পাশেই জংলাপাতার ঝোপ। পাতার ঝোপটাই তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
হাত পা খেলিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে গগনচন্দ্র দেখে নিল, কোথায় কোথায় লেগেছে। মনে হল, হাত-পা ভাঙেনি, মাথাতেও চোট লাগেনি। ছিটকে পড়ার দরুন ব্যথা লাগছিল, জোর ব্যথাই, তবে সে বেঁচে গেছে।
এমন সময় গগনচন্দ্রের কানে এল, খোল করতাল খঞ্জনি বাজিয়ে গান হচ্ছে কোথাও, কাছাকাছি।
গানটাও মোটামুটি শোনা গেল। ‘প্রেমের রাজা জনম নিল বেথেল গোশালাতে, ভয় ভাবনা দূর হল ভাই আলোর মহিমাতে।’
গগনচন্দ্র বুঝতে পারল। ”খেস্টান পাড়া না?”
”হ্যাঁ বাবু।”
”বড়দিনের গান হচ্ছে!”
হিম আর কুয়াশার জন্যে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পাড়াটা বোঝা যাচ্ছে। ছোট পাড়া। চালাবাড়ির মতন একটা বাড়িতে আলো জ্বলছে, ফাঁকফোকর দিয়ে দু-চার ছটা আলোর রেখা। ওই বাড়ির মধ্যেই গানের আসর বসেছে। অনেকেই গান গাইছে একসঙ্গে। কীর্তনের ঢঙে। খোল করতাল বাজছে।
গগনচন্দ্র দু-চার পা হাঁটবার চেষ্টা করল। বাঁ দিকে পড়েছিল বলে ওই পাশটাতেই বেশি ব্যথা। তবে পা ফেলতে পারছে কোনো রকমে। হয়তো গোড়ালির কাছটায় মচকেছে।
”হাঁটতে পারবেন, বাবু?”
”লাগছে। তবে পারব।” বলে গগনচন্দ্র নিজের পোশাক দেখে নিল। মাথায় তোর মোটা মাফলার আর লোমওঠা পুরু চামড়ার টুপি ছিল। দুটোই ঠিক আছে। গায়ে না-হোক তিন প্রস্থ শীতের জামা। তুলোর গেঞ্জি, পুরো হাতা সোয়েটার, তার ওপর গলাবন্ধ কোট, গলায় মাফলার। পরনে প্যান্ট। পায়ে মোজা জুতো।
গগনচন্দ্র নিজেই বলল, ”কোনো রকমে বাড়ি পৌঁছতে পারলে হয়।”
”পারবেন হাঁটতে?”
”খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পারব মনে হচ্ছে। এই শীতে আর তো দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।”
”চলুন তবে।”
”আমার মোটর বাইক?”
”আমি ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাব।”
”পারবে?”
”দেখি না কেন?”
লোকটাকে এবার ভাল করে দেকল গগনচন্দ্র। তেমন স্বাস্থ্যবান নয়, তবে রোগা বলা যাবে না। আলখাল্লা ধরনের এক জামা, বোস্টম বৈরাগীরা যেমন পরে। মাথায় তুলো-ওঠা হনুমান টুপি, তার ওপর মামুলি এক মাফলার জড়ানো। কান মাথা গাল জাপটে রাখা। পরনে ধুতি না পাজামা বোঝা যায় না।
”আমার বাড়ি এখানে থেকে সিকি মাইলটাক। পারবে যেতে?”
”আপনি পারলে আমিও পারব।”
”তবে চলো।”
লোকটা ঝোপের পাশ থেকে মোটরবাইক উঠিয়ে নিতে লাগল।
কাঁচা রাস্তা। কোথাও ইটের টুকরো, কোথাও পাথরের টুকরো, কোথাও-বা মাটি, কয়লার গুঁড়ো। গর্তের আর শেষ নেই।
গগনচন্দ্র খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। কনকনে হাওয়া, হমি যেন নাকেচোখে ঢুকে যাচ্ছে। এপাশে ওপাশে এবড়োখেবড়ো মাঠ, কোথাও তেঁতুলগাছের তলায় অন্ধকার, কোথাও-বা নিমগাছের আঁধার। অন্য গাছপালাও আছে। মাঠময় কুয়াশা ভেজানো জ্যোৎস্না।
হাঁটতে কষ্টই হচ্ছিল গগনচন্দ্রের। আজ সে শহরে বড়দিন করতে গিয়েছিল। রসময় তাকে ডেকেছিলঃ ‘আসবে হে বাপ, খাওয়া-দাওয়া করব। নবতারা মুরগির রুস্টু করছে নিজের হাতে। দু বোতল মালু। প্রভাকর নিমাইচাঁদ থাকবে। বিকেল বিকেল চলে এসো।’
শহরে ক’জন বন্ধু আছে গগনচন্দ্রের। প্রভাকর তার স্কুলের বন্ধু। ওর বাপকাকার মিষ্টির দোকান। শহরের পুরোনো দোকান। ‘দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। নিচে ব্র্যাকেটে লেখা : ‘শক্তিগড়’। মানে শক্তিগড়ের ঘরানার ময়রা ওরা। দোকান এখনও আছে। বিক্রিবাটাও বেশ। বাপকাকাই ব্যবসাটা দেখে।
তবে প্রভাকর তাদের জাত-ব্যবসায় যায়নি। এখানে ওখানে হাত লাগিয়ে শেষে এক মালখানা খুলেছে। মালখানা বলাই ভাল। সকালের দিকে চা ওমলেট; বিকেলে চপ কাটলেট ডিম—এসব নিতান্ত পোশাকি ব্যাপার, সন্ধে থেকে বোতল গ্লাস সোডা আর ঝাল কাবাব, আলুভাজা।
প্রভাকরের বুদ্ধি আছে। শহরের মাঝমধ্যিখানে মালখানা খুলে বসেনি। বাপের মুখোমুখি কি বসা যায়? শেষ-বাজারে পুরনো সাহেব ক্লাবের উলটো দিকে তার ‘মেরি রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড ড্রিংকস’ খুলে বসেছে। ওস্তাদ ছেলে প্রভাকার। বাপকাকার চোখের সামনে ‘বার’ সাঁটলে হুজ্জোতি বাড়ত। বাইরে ড্রিংকস, ভেতরে মাল। পুলিশের সঙ্গে ব্যবস্থা করে নিয়েছে, ঝঞ্ঝাট করে কী লাভ!
নিমাইচাঁদও গগনচন্দ্রের বন্ধু। তবে স্কুলের নয়। নিমাইচাঁদের হল মোটর গাড়ির টায়ারের ব্যবসা। মোটামুটি পুরনো টায়ার নতুনের মতন করে সে বেচে। কম্পানির বাতিল টায়ার কেমন করে সে জোগাড় করে কে জানে! দিল্লি থেকেও তার মাল আসে। আবার চোরাই টায়ারও আছে।
নিমাইচাঁদের টায়ারের দোকানের পাশে এক খোলার চালের ঝুপড়িঘর। সেখানে মোটর বাইক, স্কুটার, মপেড সারানো হয়। মিস্ত্রি রেখেছে নিমাইচাঁদ। ভালই চলে তার ব্যবসা। নিমাই আবার রগচটা, গুণ্ডা ধরনের, ব্যবসা করতে বসেও মিঠে বুলি সে আওড়ায় না। তবে হ্যাঁ, খদ্দেরকে সে ঠকাতে চায় না। সাফসুফ কথা বলে। নিমাইচাঁদ এমনিতে দিলখোলা, কথাবার্তাও মজা করে বলতে পারে।
বন্ধুদের মধ্যে রসময় হল রসের রাজা। ওর নাম রসরাজ হলেও হতে পারত। খাসা চেহারা, কারখানার স্টোরে, বলা হয় ওয়ার্কশপ স্টোরস, যত লোহা-লক্কড়ের মালপত্র ঢোকে লরি কবে, নাট বল্টুর বস্তা থেকে যাবতীয় যা কিছু তার খবরদারি রসময়ের হাতে। সে পয়লা নম্বর ইনসপেক্টার। ভালই ঘুষ খায়। নিজে খায়, ওপরঅলাকেও খাওয়ায়।
সে যেমনই হোক রসময় কিন্তু রাজা লোক। খাও দাও ফুর্তি করো—এই তো জীবন। হাসো হুল্লোড় করো, নাচো গাও—নয়ত শালা জীবন কিসের! রসময়ের কথায় বার্তায় সব সময় হাসির ছোঁয়া, শব্দগুলোও বানায় ভাল, রোস্টকে বলে ‘রুস্টু’, মালকে ‘মালু’।
রসময়ের বাড়িতে এসেছে নবতারা। চব্বিশ ছাব্বিশ বয়েস। টকটকে ফরসা রং, মুখ গোল, বড় বড় চোখ, চোখের মণি কটা রঙের। গড়ন খানিকটা ভারী। মাথার চুল যেন কোমর ছাড়িয়েছে, তেমন ঘন। বুক বলো, পিছন বলো—সবই ভার-ভারিক্কি।
নবতারা এসেছে মাস ছয়েক হয়ে গেল। রসময় বলে, তার মামাতো বোন। ওর কোনো মামা মাসি ছিল না। অন্তত নিজের তো নয়ই। তবু কোন সম্পর্কে মামাতো বোন জুটে গেল রসময়ের কে জানে!
তা নবতারাকে রসময়ের কাছে মানিয়েছে ভাল। রসময়ের মতনই সে হাসিখুশি, হালকা স্বভাবের। সাজগোজেও নজর আছে।
গগনচন্দ্র বন্ধুদের সঙ্গে ফুর্তি করতে গিয়েছিল শহরে। রসময়ের বাড়িতে জমিয়ে ফুর্তি হল। খাওয়া-দাওয়া মদ্যপান। নবতারা আবার গান গেয়ে শোনাল—’কে এলে মোর-ঘুমঘোরে’।
দেখতে দেখতে রাত বারোটা বাজতে চলল।
প্রভাকর তখন গড়াগড়ি যাচ্ছে কাশ্মীরি সতরঞ্জিতে। নিমাইচাঁদ যাত্রার ঢঙে কবিতা আওড়াচ্ছে, ‘বল বীর চির উন্নত মম শির।’
গগচন্দ্রের কী খেয়াল হল সে বাড়ি ফিরতে চাইল।
রসময মাতাল গলায় বলল, নেহি যায়গা….মর যায়গে শালে।
নিমাইচাঁদ বলল, কোথায় যাবি! আয় আমরা এখানে লটকে যাই।
গগনচন্দ্রর নেশা হয়েছিল, কিন্তু সে মাতাল হয়নি। মদ খাওয়ায় সে এখনও ততটা রপ্ত হয়ে ওঠেনি বলে কমই খায়।
এক একসময় মানুষের মাথায় ভূত চাপে। গগনচন্দ্রের মাথাতেও চাপল। বাড়ি সে যাবেই।
বন্ধুরা টানাটানি শুরু করল। যাস না শালা, মরে যাবি। ব্লাডি, বাইরে বরফ পড়ছে। তোর চোখ ঢুলুঢুলু। এত রাতে তুই বাইক হাঁকিয়ে বাড়ি যাবি কীরে! রাস্তায় উলটে গিযে মরে পড়ে থাকবি।
আমি যাব।
তোর বউ একটা রাত দিব্যি এক থাকতে পারবে।
আমি ঠিক চলে যাব।
শালা, তোর বউয়ের পেটের বাচ্চা কি খসে যাচ্ছে যে তুই যাবি! মরতে চাস!… তো ঠিক আছে, তুই তারার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়। আমি কিছু মনে করব না। তা বলে তোকে আমি মরতে দিতে পারি না।
গগনচন্দ্র শুনল না। বরং একশো টাকার বাজি রেখে তার মোটরবাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
মাইল চারেক পথ। শহর ছাড়াতে মাইলটাক। তারপর দু’মাইল মতন পাকা রাস্তা। বাকিটাই কাঁচা। গ্রাম আর কোলিয়ারির রাস্তা।
বারো আনা পথ পার হয়ে এসে শেষমেষ এই অঘটন।
”বাবু?”
গগনচন্দ্রর খেয়াল হল। নেশা এখনও আছে খানিকটা, তবু ব্যথাটাই বেশি লাগছিল। গোড়ালিটা কী ফুলে যাচ্ছে? কোমর টনটন করছিল।
”বাবুর হাঁটতে কষ্ট পাচ্ছেন, আমার কাঁধ ধরুন।”
”চলো তুমি। আর শ দুই গজ!”
”চলুন তবে।”
হঠাৎ যেন মনে পড়ল গগনচন্দ্রের। ”তোমার নাম কী হে?”
”যুধিষ্ঠির।”
”যুধিষ্ঠির কী? মানে পদবি?”
”বিশ্বাস।”
”তুমি এত রাতে ওখানে এলে কেমন করে?”
”আজ্ঞে, গান শুনতে এসেছিলাম। একটি বার বাইরে এলাম জল ফেলতে। দেখি গাড়ি উলটে আপনি পড়ে গেলেন।”
”ও!…তুমি গান শুনছিলে। খেস্টান পাড়ায় থাক?”
”না আজ্ঞা। আমার এক চেনা জন থাকে!”
গগনচন্দ্র একটু দাঁড়াল। গোড়ালির সঙ্গে হাঁটুটাও গিয়েছে নাকি? দেখার উপায় নেই। মনে হচ্ছে, হাঁটু ক্রমশই ফুলে যাচ্ছে, বেশ ব্যথা। পিঠ কোমরও টনটন করছে। তিন—চার প্রস্থ গরম জামাকাপড় না থাকলে কুলের কাঁটায় কেটে-ছড়ে সারা গা রক্তারক্তি হয়ে যেত।
যুধিষ্ঠিরের কাঁধে হাত না রেখে পারল না গগনচন্দ্র। ”তুমি কি খেস্টান?”
”বাপ-মা যা হয় ছেলেও তো তাই, বাবু!”
যন্ত্রণার মধ্যেও গগনচন্দ্র একটু যেন হাসল। ”নামটি কিন্তু যুধিষ্ঠির গো!…না না, আমি তোমায় ঠাট্টা করছি না। এখানে সবাই তো ওই রকম।”
যুধিষ্ঠির কিছু বলল না।
গগনচন্দ্রও আর ঠাট্টা-তামাশা করল না। এখানে খেস্টান পাড়ার সবাই ওই রকমই। কৃষ্ণপদ দাস, শিবপদ মণ্ডল ভবানীচরণ বিশ্বাস, কালীনাথ সরকার আরও কত। মেয়েরাও কেউ সাবিত্রী, কেউ দুর্গাবালা। গগনচন্দ্রের বন্ধু ছিল। যাকোব কান্তিনাথ বিশ্বাস, তার মায়ের নাম বীণাপাণি। নিষ্ঠাবান কৃশ্চান। কান্তিনাথ জামালপুর থেকে রেলের অ্যাপ্রেনটিসশিপ পাস করে মোগলসরাই চলে গিয়েছিল। তারপর সে কোথায় আছে কে জানে!
খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেল গগনচন্দ্র। বলল, ”ওই যে আমার বাড়ি।”
যুধিষ্ঠির মাথা নাড়ল।
দুই
সকালে বোঝা গেল গগনচন্দ্র তিন চার জায়গায় বেশ চোট পেয়েছে। বাঁ পায়ের গোড়ালি বেশ ফুলে ঢোল। বদখত চেহারা হয়েছে। হাঁটুও জখম। ফুলেছে, নীল হয়ে গেছে। কোমর নোয়ানো যাচ্ছে না। পিঠ জুড়ে ভীষণ ব্যথা। ডান হাতের কনুই আর বুড়ো আঙুলও জখম।
কাছাকাছি ডাক্তার বলতে বিজয়হরি। কানে কালা, বুড়ো। একসময় কোলিয়ারির ডাক্তার ছিল। বর্ধমান স্কুলের পাস করা। পুরনো ডাক্তার। হাতযশ আছে।
বিজয়হরি এসে দেখে গেলেন গগনচন্দ্রকে। বললেন, দু-চার দিন যাক, দেখো ফোলা আর ব্যথা কমে কি না! না হলে শহরে গিয়ে ছবি করাতে হবে। বলে বিজয়হরি তাঁর পুরনো চিকিৎসা-ব্যবস্থা লিখে দিলেন ফর্দর মতন করে। লোশন, অ্যাসপিরিন বড়ি, পট্টি, কালসিটে মেলাবার জন্যে আর-এক রকম বড়ি, একটা মলম। বললেন, হাঁটাচলা করবে না। পট্টি বেঁধে বিছানায় শুয়ে থাকবে; চেয়ারেও বসে থাকতে পার তবে পা ঝুলিয়ে রাখবে না।
বিজয়হরি চলে গেলে রোহিণী স্বামীকে কয়েক পলক দেখল। তারপর বলল, ”নাও, এবার পা মাথায় নিয়ে বসে থাকো। ঠিক হয়েছে। তখনই বলেছিলাম, শীতের মধ্যে রাত জেগে ফুর্তি করতে যেতে হবে না। শুনলে আমার কথা! ইয়ার বন্ধুরা নিশিডাক ডাকল। তা এবার সেই আকাশের তারাটিকে ডাকো, সে এসে তোমার পা নিয়ে বসে থাকুক কোলে করে। লজ্জাও করে না। ছিছি!”
যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছে গগনচন্দ্র, তার ওপর ওই ঠেস দিয়ে নবতারার কথা তোলায় সে রেগে গেল। বলল, ”কেন, তুমি আছ কী করতে?”
”তোমার পা আমার কোলে তুলে বসে থাকতে বয়ে গেছে!”
”কোন রাজরানীর কোল তোমার!”
” তোমারই বা কোন রাজপুত্তরের পা?”
”বাজে ঝগড়া করো না। পা আমার ভেঙেছে তোমার নয়। আমার পা নিয়ে আমি বসে থাকব, তুমি তোমার পা নিয়ে বেড়াও গে যাও! যেমন স্বভাব তেমনই মুখ। শালা বিয়ে করে পাঁকে পড়ে গিয়েছি।”
রোহিণী ঠোঁট-পাতলা, কিন্তু দাঁত ধারালো। বলল, ”তাই নাকি! পাঁকে পড়েছ! তা এই পাঁকে যখন ডুবে থাকো হাত-পা ছড়িয়ে তখন তো মুখের বচন অন্য রকম শুনি। কত কী মধু ঝরাও মুখে, এই পাঁকের মুখে-বুকে পদ্মগন্ধ ছোটে। জিবের জলটিও শুকোতে পায় না…”
রোহিণীকে আর কথা শেষ করতে দিল না গগনচন্দ্র, খেপে গিয়ে বলল, ”চলে যাও, আমার সামনে দাঁড়াবে না।”
রোহিণী চলে যেতে যেতে বলল, ”কালই আমি মায়ের কাছে চলে যাব।”
”যাও যাও, যেখানে খুশি চলে যাও। শালা বউ না ধিনিকেষ্ট!”
রোহিণী চলে গেল।
মাথাটা গরমই হয়ে থাকল গগনচন্দ্রের। তার বউ যে সুন্দরী সবাই জানে। একেবারে নিখুঁত না হোক, রীতিমতো সুন্দরী। গায়েগড়নে সুন্দর, মানানসই। মুখ ঝকঝকে। যেমন কপাল, তেমনই নাক-চিবুক। চোখ দুটিই যা একটু বেশি বড়-বড়। চোখের পাতা সামান্য মোটা, কী ঘন পলক চোখের পাতার। গলা লম্বা। ভরা শক্ত বুক। ছিপছিপে শরীর। কোমর মাঝারি। রোহিণীর গায়ের রঙ ফরসা।
বিয়েটা দিয়েছিল বাবা। নিজের পছন্দে। মধুডাঙার মেয়ে। ধনী নয় মোটামুটি চলে-যায় গোছের পরিবার। জ্ঞাতি গোষ্ঠীও বড়। রোহিণী এ-বাড়িতে এসেছিল একুশ বছর বয়েসে। এখন তার বয়েস চব্বিশ হল। এখানে পা দিয়েই সংসারের চাবির গোছা আঁচলে বেঁধেছিল রোহিণী। গগনচন্দ্রের মা নেই। সেই মড়কের বছরে মা মারা গেল। বছর ছ’ সাত হতে চলল। ছেলের বিয়ে দিয়ে বাবা যখন বেশ খুশিতেই আছে তখন একদিন সন্ন্যাস রোগে চোখ বুজল আচমকা। বউ আনার পরের বছর। এখন বাড়িতে শুধু গগনচন্দ্র আর রোহিণী। অন্যদের মধ্যে জ্ঞাতি সম্পর্কের এক কম বয়েসী বিধবা দিদি, দু-তিনজন কাজকর্মের লোক।
বাবা বেঁচে থাকলে রোহিণীর কর্তামি যে কমত তা নয়, তবে এখন যেন ও সাপের পাঁচ পা দেখেছে। গগনের ওপর বড় বেশি খবরদারি করতে চায়। কথায় লাগাম নেই।
গগনচন্দ্র কিন্তু বউকে ভালবাসে। রোহিণীও কি ভালবাসে না? যথেষ্টই বাসে। তবে দু’জনের মধ্যে খটাখটিও লাগে। তা তো লাগবেই। দু’জনেরই কম বয়েস, মাথার ওপর গুরুজন নেই। পাড়ার এক ঠাকুমা—মতিঠাকুমা খুব রসিক, মুখেও কিছু আটকায় না। ছড়া কাটে কত রকম, পদ্য বলে। আবার গানও গায় বুড়ি হেসে হেসে। মতিঠাকুমা বলে : ‘বুঝলি শালা, নাতি। নাতবউয়ের ওই চেহারা—অমনটি তুই পাবি কোথায়! আমার আর কী রূপ ছিল বল। তাতেই তোর ঠাকুরদা রস করে গান গাইত : তুমি আমার ঘরকান্না তুমিই আমার ঘুঁটি, ধান ভানতে তুমিই ঢেঁকি, গলা কাটতে বঁটি।…বউ সামলে চলবি নাতি, নয়ত গলায় কোপ পড়বে।’
গগনচন্দ্র ভালই জানে, তার বউ শুধু বঁটি নয় আশবঁটি।
পায়ের শব্দ পেল গগনচন্দ্র।
”দাদাবাবু?”
হলধর ঘরে এল। বাইরের মহলের কর্তা। গগনদের দত্ত-কম্পানির লোক। সর্বেসর্বাই বলা যায়। পুরনো কর্মচারী। বাবার পেয়ারের ‘হলো’। বাবা নেই, হলধর আছে। এ-বাড়িতেই থাকে। থাকবেও বুড়ো হয়ে না-মরা পর্যন্ত।
গগনচন্দ্র বলল, ”কী হল?”
”যে-লোকটা তোমায় নিয়ে এসেছিল সে এখনও বসে আছে। দেখা করে যাবে বলছে।
”যুধিষ্ঠির! আছে এখনও? ডাকো তাকে।”
হলধর চলে যাচ্ছিল, গগনচন্দ্র বলল, ”ওকে চা-টা খাইয়েছ সকালে!”
”খাইয়েছি।”
”ডাকো।”
চলে গেল হলধর।
সামান্য পরে যুধিষ্ঠিরকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে হলধর চলে গেল আবার।
গগনচন্দ্র দেখল যুধিষ্ঠিরকে। রাত্রে তার মাথা চোখ যেন পরিষ্কার ছিল না। থাকার কথাও নয়। নেশার ঘোর হয়তো সামান্যই ছিল—কিন্তু ব্যথা যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছিল, যুধিষ্ঠিরকে দেখেও ঠিকমতন দেখা হয়নি। এখন সকালের আলোয় ভাল করে দেখল। মাথায় মাঝারি, রোগাটে চেহারা, ঘাড় পর্যন্ত রুক্ষ চুল, বোধহয় পাকা রঙ ধরেছে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গায়ের রঙটি ঠিক কালো নয়, তামাটে। শুকনো মুখ, লম্বাটে। চোখ দুটি বুজে আসছে। গায়ে এক আলখাল্লা। মনে হল, ভুট-কম্বলের কাপড় কেটে আলখাল্লাটি বানানো। একটি মাফলার। টুপিটা মাথায় নেই। হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যুধিষ্ঠির।
গগনচন্দ্র বলল, ”বসো।”
যুধিষ্ঠির বসল না। দাঁড়িয়ে থাকল। ”কেমন আছেন বাবু? ডাক্তারবাবু কী বললেন?”
”ওষুধপত্র লাগাতে বললেন। খাবার ওষুধও দিয়েছেন। বললেন, ক’দিন দেখতে। ব্যথা না কমলে শহরে গিয়ে ছবি করাতে হবে।”
”তা ঠিক—” যুধিষ্ঠির দু পা এগিয়ে এসে গগনচন্দ্রর পা দেখল। বলল, ”ভাঙেনি। ভাঙলে আপনি এতটা পথ হেঁটে আসতে পারতেন না।”
”পা ভাঙলেই বাঁচি।”
যুধিষ্ঠির দাঁড়িয়ে থাকল।
গগনচন্দ্র কী বলবে বুঝতে পারছিল না। ”চা-টা খেয়েছে!”
”আজ্ঞা হ্যাঁ।”
”কাল তুমি ওই সময়টিতে না থাকলে কী হত জানি না!”
যুধিষ্ঠির কিছু বলল না। একটু যেন হাসল।
”বসো না তুমি!”
ঘরের কোণে টুল ছিল। সরে গিয়ে টুলের কাছে দাঁড়াল যুধিষ্ঠির। বসল না।
”তুমি এখন যাবে কোথায়?”
ঘর দেখতে দেখতে যুধিষ্ঠির বলল, ”কিছু ঠিক নেই বাবু!”
গগনচন্দ্র খানিকটা অবাক হল। ”তোমার বাড়ি কোথায়?”
যুধিষ্ঠির আবার একটু হাসল। ঘাড় নাড়ল। বলল, ”নিজের ঘরবাড়ি নাই। এখানে ওখানে দিন কেটে যায়। একটা তো মানুষ, যখন যেখানে ঠাঁই পাই থেকে যাই।”
গগনচন্দ্রের মনে হল, মানুষটি তো অদ্ভুত। বে-ঠিকানার লোক, নিরাশ্রয়। অথচ কথা শুনে মনে হয় না, কোনো আফসোস রয়েছে।
”তুমি করো কী?” গগনচন্দ্র বলল।
যুধিষ্ঠির একইভাবে বলল, ”যখন যা হাতে জোটে। কাঠকুটোর কাজ জানি, রঙের কাজ জানি। ছবি বাঁধাই পারি, বাবু।”
গগনচন্দ্র হেসে বলল, ”কেমন ছবি বাঁধো?”
”যে যেমন বাঁধতে দেয়। লক্ষ্মীর পট, মা দুর্গার পট, রাধা-কেষ্টর ছবি…।”
”যিশুর ছবি?” গননচন্দ্র একটু মজা করল।
”আজ্ঞা হাঁ। যে যেমন দেয়। মেরী মায়ের ছবি, সাধু পল…। মানুষের ছবিও বাঁধি। ফটো। গাছপালা নদী আকাশের ছবিও।”
গগনচন্দ্র পায়ের গোড়ালিতে হাত বোলাতে কী যেন ভাবছিল। যুধিষ্ঠিরকে তার বেশ লাগছে। সরল, সাদাসিধে। বলল, ”তুমি এখন আবার যাবে কোথায়?”
যুধিষ্ঠির নিজের চোখ মুছতে মুছতে হাই তুলল। বলল, ”ওইখানেই যাব একবার। আমার ঝোলাটি পড়ে আছে। আমায় গান গাইতে ডেকেছিল। আজকের দিনটি থাকতে পারি….”
”তুমি গান গাও?” গগনচন্দ্র বেশ অবাক।
”ডাকলে গাই, না-ডাকলেও গাই। প্রভুর গান।”
”আচ্ছা আচ্ছা!” গগনচন্দ্র কৌতুক বোধ করছিল। ”কাল তুমি কোন গান গাইলে যুধিষ্ঠির?”
”গোশালার গান।… ‘আজি আকাশেতে জ্বলে তারা/আজি পথ চলি আসে কারা,/আজি মেষ ফেলি রাখালেরা/চলে গোশালায়……, ”
গগনচন্দ্র জোরেই হেসে উঠল। মানুষটা কী সরল, অকুণ্ঠ। বৃথা লজ্জা নেই। ”বাঃ, তুমি তো গানটি ভাল বললে গো! লেখাপড়া জান?”
”বাংলা অক্ষর পড়তে পারি।”
কী যেন একটু ভেবে গগনচন্দ্র হঠাৎ বলল, ”যুধিষ্ঠির, তুমি আমার এখানে থাকবে? থাকো না।”
যুধিষ্ঠির এবার গগনচন্দ্রকে দেখতে দেখতে হাসল একটু। বলল, ”আমায় রেখে আপনি কী করবেন?”
”করব আবার কী! থাকো!… মানুষটি তুমি বেশ হে! কাল তুমি না থাকলে আমি কাঁটাঝোপে পড়ে থাকতাম। মরেই যেতাম ঠাণ্ডায়।… থাকো তুমি।”
যুধিষ্ঠির ভাবল; বলল, ”আপনি থাকতে বলছেন বাবু থাকলাম। কাজ কী করব?”
”কাজের লোক অনেক আছে, তোমায় কিছু করতে হবে না।”
যুধিষ্ঠির মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ”না বাবু, কাজ না করে খেতে নেই। প্রভু যিশু বলেছেন, নিজের রুটির জন্যে কাজ করবে। রুগ্ন আর শিশুরা কাজ করবে না—; আমি জোয়ান-মানুষ, আমি কেন কাজ করব না?”
গগনচন্দ্র হেসে ফেলল। ”তুমি তো বেশ জ্ঞানের কথা বলতে পার! ঠিক আছে, কাজের একটা ব্যবস্থা হবে তোমার। বাড়ি আছে, দোকান আছে। অ্যাসবেসটাস শিট, টিনের শিট, পাইপ, লোহা-লক্কড়ের দোকান আমাদের। লোকজন খাটে। তুমি এখানেই থেকে যাও। এখনকার মতন তো থাকো। তারপর তোমার মন না-চাইলে চলে যেও। কেমন?”
যুধিষ্ঠির রাজি হয়ে গেল। মাথা নাড়ল। ”আমার ঝোলাটি তবে নিয়ে আসি?”
”এসো।”
চলে গেল যুধিষ্ঠির।
তিন
বড়দিন কাটল। সাহেবি নতুন বছর পড়ল। পৌষের বাতাসে গাছের পাতা খসে উড়ে যাওয়ার মতন নতুন বছরের দিনগুলিও উড়ে যেতে লাগল। দেখতে দেখতে মাঘ মাস।
মাঘ মাসে শীত এখানে যেন থিতু হয়। পৌষে শীতের বোধহয় খানিকটা চাঞ্চল্য থাকে। মাঘ একেবারে ঘন। সকাল দুপুর তবু রোদ থাকে, বিকেল ফুরোলো কি কনকনে হাড়-জমানো শীত মাঠঘাট গাছপালা থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে ধীরে ধীরে। আকাশ থেকেও হিম ঝরে; বৃষ্টির ফোঁটা নয়, হিমের বিন্দু ঝরে-ঝরে ভিজে যায় গাছের পাতা, মাঠের ঘাস। কুয়াশা নিবিড় হয়ে জমে থাকে চারপাশে।
গগনচন্দ্র পা কোলে নিয়ে বসে থাকল দিন পনেরো। তার কপাল ভাল হাড়গোড় ভাঙেনি পায়ের। পরের সাতটা দিন পা নামিয়ে লেঙচে লেঙচে হাঁটল দশ বিশ পা। ততদিনে পিঠ কোমরের ব্যথা মরেছে বারো আনা। কালশিটেও মিলিয়ে এসেছে। মাঝে ক’দিন জ্বরও হয়েছিল গগনচন্দ্রের। ঠাণ্ডা-লাগার জ্বর। সে-জ্বর সেরে গেল। হপ্তা তিনেক পরে অনেকটাই যখন সুস্থ সে, রোহিণী বলল, ”কই, তোমার ইয়ার-বন্ধুর তো খোঁজ নিতে এল না—তুমি মরলে না বাঁচলে?”
রসময়রা কেউ আসেনি সত্যি কথাই। না আসার বড় কারণ—তারা জানেই না সেদিন ফেরার পথ গগনচন্দ্র মোটরবাইক থেকে ছিটকে পড়েছিল। কেমন করেই বা জানবে? কেউ কি তাদের খবর দিয়েছে! গগনচন্দ্রও কাউকে দিয়ে খবর পাঠায়নি। লজ্জা করেছে। দোষ বন্ধুদের নয়, তারই দোষ। সে কানে তোলেনি বন্ধুদের কথা, সাহস আর মেজাজ দেখিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। এখন কোন লজ্জায় খবর দেয়ে যে—আমি উলটে পড়েছি রে—পা জখম, এসে দেখে যা।
বউয়ের কথা হজম করে নিয়ে গগনচন্দ্র বলল, ”ওরা জানে না।”
”জানাতে কতক্ষণ! কাউকে পাঠিয়ে দাও।”
”সে দেখা যাবে।”
রোহিণী ঠোঁট টিপে হাসল। সে জানে, স্বামী এই পড়ে যাবার ব্যাপারটা চাপা দেবার চেষ্টা করবে যতটা পারে। পুরুষমানুষটির কোনো কোনো ব্যাপারে বেশ অহঙ্কার আর অভিমান আছে। তার ধারণা, ওর মতন পাকা মোটর সাইকেলঅলা এ-তল্লাটে নেই। রাস্তা যেমনই হোক, সাকল হোক আর দুপুর হোক, রাত হোক—ঝড়বৃষ্টি কাদা যেমনই হোক বাবু ঠিক কায়দা-কৌশল করে বাইক নিয়ে বেরিয়ে আসবে। এ নিয়ে রোহিণী কত ঠাট্টাই করে স্বামীকে। বলে, ‘তুমি বাবা-ঠাকুরের ব্যবসাটি নিয়ে বসে আছ কেন, সার্কাস পার্টিতে চলে যাও না, না হয় হিন্দি সিনেমায়—তোমার দু-চাকা নিয়ে খেলা দেখাবে!’
গগনচন্দ্র মাথা নাড়ে। ‘যাব, একদিন পিছলে যাব। তোমার সঙ্গে ঘর করা তো যাবে ন। সার্কাস পার্টিতেই ভিড়ে যাব।’
‘আ-হা-রে, সেদিন যে কবে আসবে! আমি একটু হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে বসে দিন কাটাতে পারব! তোমার ফরমাস খাটার হাত থেকে বাঁচব, বাবা!’
স্বামী-স্ত্রীর এই হাসি-তামাশার মধ্যেও রোহিণী মনে মনে স্বীকার করে নেয়, তার পুরুষমানুষটি সত্যিই ভাল ভটভটি চালায়। এ-তল্লাটে অমন দেখা যায় না। অবশ্য এখানকার তল্লাটই বা কী, কটাই বা ভটভটি! কোলিয়ারির দিকে তিন চারটি, লালা মারোয়াড়ির বাড়িতে তার ছোট ছেলের একটা, আর পাল কন্ট্রাক্টারের ছোট ভাইয়ের একটা। পালরা অবশ্য এখানে থাকে না।
রোহিণী ঘর গুছিয়ে চলে যাবার আগে স্বামীর সঙ্গে খুনসুটি ঝগড়া করছিল। এ রকম রোজই হয়। সকালে দুপুরে রাত্রে। না হলে দিন যেন মজার হয় না। গগনচন্দ্রের ভাষায় ‘পানসে’; আর রোহিণীর ভাষায় ‘স্যাঁতসেতিয়ে থাকে’।
বন্ধুদের খবর দেওয়া কথাটা হয়ত তামাশা, কিন্তু রোহিণীর অন্য উদ্দেশ্য ছিল। স্বামীর পা এখন নিশ্চয়ই অনেকটাই ভাল, তবু তার ধারণা, শহরে গিয়ে একটা কি দুটো ছবি করিয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কারণ, সবটুকু ফোলা এখনও যায়নি গোড়ালির, ব্যথাও নয়। কোমরেও একটা ফিক ব্যথা লেগে আছে গগনচন্দ্রের।
শহরের বন্ধুরা খবর পেলে দেখতে আসবে গগনচন্দ্রকে। তখন ছবির কথা তুললে—তারাই টেনেটুনে নিয়ে যাবে তাকে।
রোহিণী বলল, ”ডাক্তারবাবুর যা যা করতে বললেন করলে, এখনও ফোলা ব্যথা যায়নি পুরোপুরি। অন্য একজন কাউকে দেখানো ভাল!”
”সেরা তো আসছে!”
”সারা দিন উঃ আঃ করছ, লেঙচে হাঁটছ—শেষ পর্যন্ত লেঙড়া হয়ে থাকবে নাকি? একবার দেখাতে ক্ষতি কিসের?”
”কাকে?”
”শহরের ডাক্তার নেই! আমি বলি কী, তোমার বন্ধুদের খবর দি—তারা গাড়িটাড়ি জোগাড় করে আসুক। তোমায় নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে আনুক।”
গগনচন্দ্র বলল, ”গাড়ি এখানেও পাওয়া যায়। কোলিয়ারি মহেশ্বরকে খবর দিলে সে জিপ নিয়ে আসবে।”
”যাবে কার সঙ্গে?”
”যুধিষ্ঠির থাকবে সঙ্গে।”
যুধিষ্ঠির কথায় রোহিণী বলল, ”লোকটা সারাদিন কী করে বুঝি না।”
”কেন, ওর কাজ করে। আমি তো বলে দিয়েছি—বাড়িতে কাঠকুটোর মেরামতির কাজগুলো আগে শেষ করবে। তারপর বাড়িতে যা পুরনো ছবিটবি আছে সেগুলো নতুন করে বাঁধাবে। যুধিষ্ঠিরকে যা বলেছি তাই করছে।” গগনচন্দ্র বাড়িতেই রেখেছে যুধিষ্ঠিরকে, দোকানে লাগায়নি। নিজে যখন দোকানে গিয়ে বসবে তখন না-হয় নিয়ে যাবে তাকে। নতুন লোককে তার অসাক্ষাতে দোকানে পাঠানো উচিত হবে না।
রোহিণী বলল, ”খুটখাট করে কী করছে জানি না। তবে বাড়ির কেউ খুশি নয়। রাস্তা থেকে উটকো লোক ধরে এনে এভাবে না ঢোকালেই পারতে।”
গগনচন্দ্র অসন্তুষ্ট হল। বলল, ”আমার বাড়ি, আমি যাকে খুশি ঢোকাব, কার কী বলার আছে!”
”আমার আছে। বাড়ি আমারও।” রোহিণী চটে গেল। ”আমি এ-বাড়ির ময়না-ঝি নই যে ও আমার দিকে তাকিয়ে দেখবে, আর কী বকম অসভ্যের মতন মুখ টিপে টিপে হাসবে।”
গগনচন্দ্র থ’ হয়ে গেল! কী বলছে রোহিণী? মাথা খারাপ হয়ে গেল তার! সাদাসিধে সরল একটা মানুষ, একেবারে মামুলি, ভিখিরি গোছের, চালচুলো নেই লোকটার, সেই লোক কি কখনও এ-বাড়ির মালিকানীর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে পারে, আর হাসতে পারে! গগনচন্দ্র বিশ্বাস করল না। তার মনে হল, পুরনো লোক যারা এ-বাড়িতে আছে বছরের পর বছর, কাজ করুক না-কারুক, ফাঁকি মেরে বউদিমণির মন জুগিয়ে দিব্যি জায়গা জুড়ে বসে আছে—তাদের ঠিক সহ্য হচ্ছে না যুধিষ্ঠিরকে। এ-রকম হয়। খুবই স্বাভাবিক। ঈর্ষা। এই জন্যেই যুধিষ্ঠিরকে সে এখনও দোকানে পাঠায়নি।
গগনচন্দ্র বলল, ”তুমি কী! তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? ওই লোকটা একটা বাউন্ডেলে, ভিখিরি। ওর বয়েস আমার চেয়ে বেশি। চল্লিশ অন্তত। ও তোমায় তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে। অসম্ভব।”
”তবে আমি মিথ্যে কথা বলছি?” রোহিণীও রুক্ষ গলায় বলল।
গগনচন্দ্র কোনো জবাব খুঁজে পাচ্ছিল না। রোহিণী মিথ্যে বলছে না হয়ত, কিন্তু ভুল করছে। বা কেউ তার কান ভাঙিয়েছে। ”তোমায় কেউ বলেছে?”
”না। আমার চোখ নেই?”
”তুমি থাক অন্দরমহলে, ও রয়েছে বাইরে—?”
”বাইরে কতক্ষণ থাকে, ভেতর বাড়িতেই ঘোরেফেরে, কাজ করে।”
”বাইরে কই এ-কথা তো বলোনি?”
”আগে কী বলব! ক’দিন এসেছে ও! তোমায় দেখব, না তোমার যুধিষ্ঠিরকে দেখব! নজর করিনি। আজ ক’দিন নজরে পড়ছে।”
গগনচন্দ্র চুপ করে থাকল। খারাপ লাগছিল তার। মানুষটাকে তো গগনচন্দ্র ভাল বলেই জানে। শুধু ভাল নয়, কথাবার্তাও বলে বেশ। মাঝে মাঝে গগনচন্দ্র তাকে ডেকে পাঠিয়ে গল্প করে। আবার নিজেও এসে হাজির হয় যুধিষ্ঠির। আচারে ব্যবহারে নম্র; সহবত জানে।
রোহিণী বলল, ”ওর হাবভাব দেখে আমার মনে হচ্ছে, ও যেভাবে সব দেখেশুনে নিচ্ছে এই বাড়ির, একদিন চুরি ডাকাতি করে পালাবে। গয়নাগাঁটি আর আমি আলমারিতে রাখব না; বাবাঠাকুরের পুরনো সিন্দুকে রাখব”।
বিরক্ত হয়েও গগনচন্দ্র বলল, ”বাজে কথা বলো না। তোমার বাড়িতে একটা লোক এসে থাকছে ক’দিন—তাতেই তোমার মনে হচ্ছে সে চোর ডাকাত!’
”আমার না হয় কুচ্ছিত মন হল, তোমার দিদিকে ডাকব?”
”কমলাদিদি?”
”দিদি বিধবা মানুষ। গয়নাগাঁটি পরে না। হাতে সরু সরু দু’গাছা চুড়ি, আর গলায় একটা হার। সেই হার গত পরশু কোথায় হারিয়ে গেল। দিদি আমায় প্রথমটায় বলেনি। পরে যখন সারা বাড়ি খোঁজ হচ্ছে—তোমার ওই যুধিষ্ঠির হারটা এনে দিল। বলল, কলঘরের বাইরের নালায় পড়েছিল।”
কমলাদিদি নিজের নয়, আশ্রিতা। বাবাই আশ্রয় দিয়েছিল। বিধবা মেয়ে, বয়েস কম, কোথায় ভেসে বেড়াবে! দেখতে মাঝারি। তবে খুব চাপা, তার ভেতরের কথা আঁচ করা যায় না। গগনচন্দ্রের বিয়ের আগে দিদির সঙ্গে ভাবসাব ভালই ছিল। আড়ালেই বেশি। বিয়ের পর দিদি সাবধান হয়ে গিয়েছে। গগনচন্দ্রও আর সেই ঝোঁকটা অনুভব করে না—আগে যা যা করত। কমলাদিদিও সরে গিয়েছে। আগে তার একটা অধিকার-বোধ জন্মে গিয়েছিল—গগনচন্দ্রকে কোনো কোনো ব্যাপারে বাধ্য করত, রাগ অভিমান দেখাত। রোহিণী এ-বাড়িতে আসার পর থেকে বড় অদ্ভুতভাবে নিজেকে পিছিয়ে নিল দিদি। গুটিয়ে নিল, আড়াল করে ফেলল। এখন গগনের ঘরে একা কখনো আসে না। এই যে গগনচন্দ্র হাত-পা পিঠ জখম করে বিছানায় পড়ে থাকল, কমলাদিদি ক’বার আর নিজে ঘরে এসে খোঁজ নিয়ে গিয়েছে গগনের। বার কয়েক মাত্র, তাও রোহিণীর সামনে। খোঁজ-খবর যা করার রোহিণীর কাছেই করে অন্দরমহলে।
গগনচন্দ্র স্ত্রীকে দেখল অন্যমনস্কভাবে। বলল, ”ঝট করে একটা লোককে চোর ঠাওরানো ঠিক নয়। তোমরা নিজেরা সাবধান নও, ভুল করে এটা-সেটা ফেলে রাখো যেখানে সেখানে। কী ঘটেছে না জেনে আমি নিরীহ একটা মানুষকে চোর বলতে পারব না।”
”তা হলে ডাকি দিদিকে?”
”কোনো দরকার নেই।”
রোহিণী সামান্য দাঁড়িয়ে চলে যেতে যেতে বলল, ”নাম যুধিষ্ঠির হলেই ধম্মপুত্তুর হয় না।”
চলে গেল রোহিণী।
মন-মেজাজ খারাপ হয়ে গেল গগনচন্দ্রের। যুধিষ্ঠির মানুষটার মুখে গায়ে যেন নোংরা মাখিয়ে দিয়ে গেল তার বউ। একটা ভাল মানুষকে তুমি ওভাবে ইতর চোর বদমাশ করতে পার না। সে তোমার বাড়িতে আছে, দুটি খাচ্ছে বলেই তার ভাল-মন্দ ন্যায়-অন্যায় জ্ঞান থাকবে না, সে মন্দ মানুষ হয়ে যাবে!
যুধিষ্ঠির লোকটা যে অকর্মণ্য তাও নয়। গগনচন্দ্র দেখেছে, মানুষটার চোখ আছে, বোধবুদ্ধি আছে, হাতের কাজ ভাল। এ-বাড়ি তো কম পুরনো হল না। দরজা জানলা, ছিটকিনি, হুড়কো—কত কী খারাপ হয়ে গিয়েছিল। নষ্ট হয়েছিল। যুধিষ্ঠির তো একে একে অনেক কিছুই সেরে ফেলল। তা ভালই হল। চৈত্র মাসে বাড়িতে কলি ফেরানোর কাজ হবে, তার আগে মেরামতির ঝঞ্ঝাট চুকে যাবে। ও দিকে আসবাবপত্রেরও সেই অবস্থা। এটা ভেঙেছে, ওটা হেলে পড়েছে, কোনোটার ডালা খুলে গেছে, রঙচঙ বলে কিছু নেই আর। তা এসবেও একে একে হাত দিতে শুরু করেছে যুধিষ্ঠির। নিজের মনে কাজ করে আর বিড়ি খায়।
যদি পয়সার কথা ওঠে—এসব মেরামতিতেও তো গগনচন্দ্রের পয়সা লাগত—তবে সে হাসে, যেন ও আবার কী কথা বাবু! নিজের কাজ দিয়ে যুধিষ্ঠির দুটো খায়। তা হলে অকারণ তার নামে এত অপবাদ কেন?
সংসারে মেয়েরা এই রকমই হয়। খুঁত ধরে আর সন্দেহ করে। তাদের মন বড় ছোট। চোখের পাতাও থাকে না অনেকের।
গগনচন্দ্র বেশ বিমর্ষ হযে বসে থাকল।
চার
একবার কিছু শুরু করলে রোহিণী যেন থামতে জানে না।
পরের দিন আবার। ”তোমার যুধিষ্ঠির ভেবেছে কী! দিনের মধ্যে দশবার ছুতো করে-করে মেয়েদের সামনে এসে দাঁড়ায়! ছেঁড়া কাপড় দাও, সোডা থাকলে সোডা দাও, সাবান দাও…! কোন কাজটা ও করে! সারাদিন ঠুকঠুক আর আমাদের দিকে নজর…!”
গগনচন্দ্র বিরক্ত বোধ করে। বলে, ”কী করে গিয়ে দেখলেই পার!”
আসলে যুধিষ্ঠির কাপড়ের টুকরো, সোডা-সাবান চায় ময়লা চিট কাঠকুটো ধুয়ে সাফ করে নিতে। পরিষ্কার না হলে সে কেমন করে বুঝবে কোন দরজার কী অবস্থা, কোন জানলার পাল্লা চিড় ধরা! আসবাবপত্রের বেলাতেও তাই। সাফসুফ না করে কাজ করা যায়! রঙ কি এমনি এমনিই হয় পুরনো কাঠে। পুডিংও সে নিজের হাতে তৈরি করে নেয় খড়িমাটি আর তেল দিয়ে।
রোহিণীর সঙ্গে খানিকটা কথা কাটাকাটি হয়ে যায় গগনচন্দ্রের।
পরের দিন আবার। রোহিণী বলল, ”তোমার যুধিষ্ঠির বিড়ি খায় দেখতাম, তাড়ি খায় জানতাম না।”
”তাড়ি!”
”ময়নাকে দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে তাড়ি আনিয়েছে।”
”গগনচন্দ্র ঠিক যেন বুঝতে পারল না। গাঁয়ের লোক যুধিষ্ঠির, তাড়ি খেজুর রস খেতেই পারে। চাই কি ফটক বাজারের দিকে ভাটিখানাতেও যদি যায়—যেতে পারে। তবে ময়না-ঝিকে দিয়ে তাড়ি আনানোর কথাটা কি সত্যি!
এই ভাবে চলতে লাগল।
রোহিণীর ঘোরতর সন্দেহ, কাজের পাম করে যুধিষ্ঠির যে এ-ঘরে ও-ঘরে ঘুরে বেড়ায় তার পিছনে কোনো অভিসন্ধি রয়েছে। বাড়ি পুরনো, ঘরদোর যথেষ্ট না হলেও শোওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে খুপচি ঘর পাঁচ ছ’টা। কত কী পড়ে থাকে সেখানে। এমনকি, গগনচন্দ্রের দোকানের খুচরো কিছু মালও মজুত থাকে।
ঝামেলাটা ভাল লাগছিল না গগনচন্দ্রের। মাঝে মাঝে সে যুধিষ্ঠিরকে ডেকে পাঠায়। ভাবে, তাকে কিছু বলবে। যুধিষ্ঠির সামনে এসে দাঁড়ালে কিছুই বলতে পারে না। অস্বস্তি হয়, লজ্জা করে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে মানুষটাকে। সরল চোখে সে চেয়ে আছে, নিরীহ মুখ। গগনচন্দ্রকে চুপ করে থাকতে দেখে যুধিষ্ঠির নিজেই কথা শুরু দেয়। নানান গল্প ফাঁদে।
দিনসাতেক এইভাবেই কাটল।
গগনচন্দ্র এবার হাঁটতে পারছে। অবশ্য খোঁড়াতে হচ্ছে সামান্য। বিজয়হরি ডাক্তার টিপে টিপে পা দেখল। বলল, ”ফোলা এখন থাকবে খানিকটা। গরম জল ঠাণ্ডা জল করো; চলে যাবে ফোলা। দু-দশ পা হাঁটো বাইরে গিয়ে। আর ক’দিন পরে দোকান যেতে পারবে। তবে বাপ, তোমার দু-চাকাটি এখন চড়বে না বেশ কিছুদিন।”
গগনচন্দ্র ভেবেছিল, দোকানে গিয়ে বসতে পারলে যুধিষ্ঠিরের একটা ব্যবস্থা করবে। বড় না হলেও ‘দত্ত সন্স’ দোকানটা ছোট নয়। বাবার আমলের দোকান। পুরনো। আগে ছিল ঢেউ খেলানো টিনের বাজার, তারপর এল অ্যাসবেসটাস শিট বা চাদরের বাজার, সেই সঙ্গে সরু মোটা পাহপ। এ ছাড়া টুকটাক কিছু। বাবা ধীরে ধীরে দোকানটা গুছিয়ে ফেলেছিল। তিন চারজন কর্মচারী খাটে। গগনচন্দ্র অবশ্য নিজে দোকানে বেশিক্ষণ একনাগাড়ে বসে না। সে এ-কোলিয়ারি, ছোটখাটো কারখানায় ঘুরে বেড়ায় মোটরবাইক করে, অর্ডার ধরে। আজকাল অ্যাসবেসটাস চাদরের চাহিদা ভাল।
তা দোকানে যেতে যেতে এখনও দিন দশ পনেরো।
যুধিষ্ঠির ততদিনে দরজা জানলার কাজকর্ম অনেকটাই সেরে ফেলেছে। ফেলে ভাঙাচোরা আসাববপত্র হাতে দিয়েছে।
রোহিণী রোজই কথা ওঠায়। গগনচন্দ্র শোনে। স্ত্রীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। তার পর মনে হয়, রোহিণীর চোখের সামনে থেকে যুধিষ্ঠিরকে সরিয়ে দিলে মুখ বন্ধ হয়ে যাবে ওর। দোকানে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেবে যুধিষ্ঠিরকে, কাছাকাছি থাকার ব্যবস্থা করে দেবে মানুষটার। বউয়ের কথায় একটা নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে সে তাড়াতে পারে না।
দিন কয়েক পড়ে রোহিণী অগ্নিমূর্তি হয়ে এসে বলল, ”এবার কী করবে?”
”কিসের কী করব!”
”তোমার যুধিষ্ঠির দিদির ঘরে গিয়ে চুপ করে বসেছিল।”
গগনচন্দ্র যেন কানে শুনতে পায়নি। ”কার ঘরে? কী বললে?”
”কানে শোনো না। বলছি, ওই যুধিষ্ঠির দিদির ঘরে গিয়ে চুপ করে বসে ছিল।”
বিশ্বাস হল না গগনচন্দ্রের। ”কবে?”
”আজ বিকেলে।”
”দিদি দেখেছে?”
”কী কথা! দিদি দেখবে না তো কে দেখবে? দিদির ঘর।”
”কে বলল, দিদি বলেছে?”
”ডাকব দিদিকে?” রোহিণী রাগে কাঁপছিল, তার কথায় এত অবিশ্বাস তার স্বামীর!
”থাক”, গগনচন্দ্রের কানমাথা যেন জ্বলে যাচ্ছিল। কমলাদির ঘরে বিকেলে ঢুকে কী করছিল যুধিষ্ঠির? কী দরকার ছিল তার ও-ঘরে ঢোকার! তুমি বাইরের লোক, ঘরের এক বিধবার ঘরে লুকিয়ে কেন ঢোকো তুমি!
রোহিণী বলল, ”আরও আছে। শুনলে তোমার মাথায় রক্ত চড়বে কিনা জানি না, আমার তো মাথা আগুন হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে লোকটাকে জুতোপেটা করে তাড়িয়ে দি বাড়ি থেকে।”
তাকাল গগনচন্দ্র। ”আবার কী?”
‘ময়না-ঝিকে পাঁচটা টাকা দিয়েছে।”
”টাকা! কেন?”
”সে তোমার যুধিষ্ঠির জানে।” বলে এক মুহূর্ত থেমে রোহিণী আবার বলল, ”ময়নার রোজই টাকা দরকার। আজ পাঁচ টাকা দাও, কাল দশ টাকা দাও। একটা না একটা ছুতো। মাসের মাইনে আগে-আগেই নিয়ে নেয় সব। তার ওপরও রয়েছে পাঁচ দশ টাকা। আমার কাছে টাকা চেয়েছিল সকালে। আমি দিইনি। গালমন্দ করেছি। শুনেছে তোমার যুধিষ্ঠির। ময়নামাগীও বলতে পারে। তা ওই যুধিষ্ঠিরের দয়ার প্রাণ কেঁদে উঠল। জোয়ান মাগী, কলসির মতন পেছন—, তায় আবার তাড়ি-মাড়ি এনে দেয়; টাকা কেন দেবে না। ছিছি, আমার ঘরসংসার বাড়ি নষ্ট করে দিলে গো! মান মর্যাদা আর রাখল না।”
গগনচন্দ্র চুপ। মুখ লালচে হয়ে উঠল। মাথা কান দপদপ করছিল। শেষে বলল, ”আচ্ছা, দেখছি।”
”দেখাদেখির কী আছে! তাড়াও ওকে। বদমাশ, হারামজাদা মিনসে। বাইরে গোবেচারি, ভেতরে ডুবে ডুবে জল খায়।”
সন্ধেবেলায় ডাক পড়ল যুধিষ্ঠিরের।
গগনচন্দ্র প্রথমে কিছু বলতে পারল না। লোকটাকে দেখল। তারপর চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, ”তোমার কাজকর্ম কতদূর?”
যুধিষ্ঠির বলল, ”বাকি ছিল খানিকটা। তা বাবু, আমি একটা কথা বলি?”
”বলো!”
”আমি ক’দিন ঘুরে আসি। অন্য একটি কাজ আছে বাইরে।”
”কী কাজ?”
কী কাজ তা বলল না যুধিষ্ঠির। হাসল একটু। ভাবটা এই, ছোটখাটো কাজের কথা কী আর বলবে!
গগনচন্দ্রও যেন কোনো কৌতূহল বোধ করল না জানার। নিতান্তই বুঝি কথার কথা হিসেবে জানতে চেয়েছিল ‘কী কাজ’ করতে চলেছে যুধিষ্ঠির। মনে মনে সে স্বস্তি পাচ্ছিল; নিজের মুখে তাকে বলতে হল না কিছুই যুধিষ্ঠিরকে, তাকে তাড়িয়ে দিতে হল না বাড়ি থেকে, নিজেই চলে যাচ্ছে যুধিষ্ঠির!
লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল গগনচন্দ্র। যুধিষ্ঠির কি বুঝতে পেরেছে তার আচার ব্যবহারে গগনচন্দ্র অসন্তুষ্ট? বিরক্ত? বাড়ির মধ্যে যেসব অন্যায় যুধিষ্ঠির করছে—বাড়ির মালিকের কানে সেসব কথা উঠছে রোজই। এরপর আর এখানে ওর জায়গা হবে না! বুঝেশুনেই তবে যুধিষ্ঠির কাজের ছুতো দেখিয়ে মানে মানে পালিয়ে যেতে চাইছে!
তা যাক; ভালই হল। গগনচন্দ্রকে আর রূঢ় হতে হল না।
”আমি তবে যাই, বাবু?”
”তা যাও!…কাল সকালে যাবে তো?”
”আজ্ঞা না, এই সন্ধেকালেই যাব।”
”এখন কেন? কাল সকালে যেও।”
”সন্ধেকালেই হাঁটতে-চলতে ভাল লাগে। সামনে পূর্ণিমা। জোছনার আলো আছে। শীতও ফুরলো। দু-তিন ক্রোশ হাঁটা কিছুই নয়।”
গগনচন্দ্র বলল, ”এসো তবে।”
যুধিষ্ঠির খুব বিনীতভাবে হাত জোড় করে গগনচন্দ্রকে নমস্কার জানাল। বলল, ”ঘর থেকে আমার ঝোলাটি নিয়ে আমি চলে যাব। …ওই দেখো, একটি কথা বলতে ভুলে গেছি, বাবু। উই যে উত্তরের ঘরটি আছে আজ্ঞা কোঠার শেষে, উই ঘরটিতে ভাঙাচোরা জিনিস গুদাম করে রাখা। হাতড়ে-হুতড়ে আমি দেখেছি। একটি কথা বলি বাবু, উই ঘরে একটি পুরানো আরশি আছে। হাতখানেক লম্বা। ফুলকাটা কাঠ দিয়ে বাঁধানো। ওটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পারা উঠে গিয়েছিল অনেক জায়গায়। আমি ওই আরশিটি ঠিক করে দিয়েছি। বাবু উটি কিন্তু বড় ভাল আরশি। অমনটি আর পাবেন না। পুরানো হলেই কি জিনিস খারাপ হয়! পারলে উটি এনে ঘরে কোথাও রেখে দেবেন।”
গগনচন্দ্র শুনল, কিছু বলল না। সে কোনো খোঁজ রাখে না আয়নার। এই বাড়ির কোথায় কোন জঞ্জালে কী পড়ে আছে কে তার খোঁজ রাখে!
যুধিষ্ঠির মাথা নুইয়ে আবার বলল, ”আসি বাবু!”
”এসো। তা এ-দিকে এলে এসে দেখা করে যেও।”
”আজ্ঞা,” যুধিষ্ঠির ঘাড় নেড়ে জানাল আসবে। তারপর চলে গেল ঘর ছেড়ে।
গগনচন্দ্র চুপ করে বসে থাকল।
ঘরের বাইরে ধীরে ধীরে জ্যোৎস্না ফুটে উঠছে। আজ পূর্ণিমা নয়, দিন দুই তিন বাকি। জানালা দিয়ে তাকালে মনসাতলার মাঠ চোখে পড়ে, মস্ত এক শিমুলগাছ, তার অন্য পাশে ঝিরিকাঁটার জঙ্গল। ফাল্গুনের বাতাস আসছিল। শীত নেই, আবার পুরোপুরি বসন্তও নয়। রাত বাড়লে মাঠের ওপর পাতলা কুয়াশা নামে।
ভাল লাগছিল না গগনচন্দ্রের। মানুষটা তবে চলেই গেল।
আরও খানিকটা পরে গগনচন্দ্রের নজরে পড়ল, যুধিষ্ঠির মাঠ ভেঙে চলে যাচ্ছে। ঝোলাটা তার কাঁধেই ঝুলছিল। ওর গায়ে এখন আলখাল্লার মতন জামাটা নেই, সাধারণ শার্ট পাঞ্জাবি কিছু একটা পরে আছে। যেতে যেতে একবার দাঁড়াল যুধিষ্ঠির, পিছনে ফিরে তাকাল না, দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে লাগল।
রোহিণী ঘরে এল। সাঁঝ করে গা-ধুয়েছে। ভাল গন্ধ সাবান ছাড়া চলে না তার। দু’দিনে সাবান ফুরোয়। মাথার তেলেও সুগন্ধ। চোখমুখ সবসময ঝকঝকে রাখে। নিজের শরীরের ব্যাপারে রোহিণীর নজরটি কম নয়।
সদ্য-ধোওয়া গা, ভিজে শাড়ির ওপর ডুরে-কাটা সবুজ গামছা জড়ানো, কপালের চুলের গুচ্ছ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে।
কাছে এসে রোহিণী বলল, ”আপদ বিদায় নিয়েছে?”
গগনচন্দ্র বলল না কিছু।
স্বামীকে চুপচাপ দেখে রোহিণী গায়ের কাছে এসে সামান্য নুয়ে পড়ে যেন সামান্য মজার গলায় বলল, ”গন্ধটা ভাল না? নতুন আনিয়েছি। তোমার তো আবার নাক নেই। দেখো তবু…।”
রোহিণী আরও নুয়ে পড়ল। গা বুক হাত যেন গগনচন্দ্রের মুখের কাছে নামিয়ে ছুঁইয়ে দিল। দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
গন্ধ পাচ্ছিল গগনচন্দ্র, চোখেও দেখছিল।
”ভাল গন্ধ!”
”শুধুই গন্ধ! আর কিছু না?”
”তুমিও।”
রোহিণী যেন খুশি হয়ে ছেলেমানুষের মতন আলতো করে চুমু খেল গগনচন্দ্রকে।
পাঁচ
কোথাও কোথাও আগুন লাগলে যেমন দাউ করে সেটা ছড়িয়ে যায়, এবারের গরমটা যেন সেইভাবে গনগনে আকাশ থেকে ছুটে এল। চৈত্র মাস শেষ হবার আগেই মাঠঘাট পুড়তে লাগল, গাছপাতা শুকিয়ে ঝলসে খয়েরি হয়ে যাচ্ছিল। যত রোদের তাত-তেজ, ততই গা-জ্বালানো বাতাস।
গগনচন্দ্র একেবারে স্বাভাবিক। তার পায়ে ব্যথা-বেদনা নেই আর। মোটর সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র। কাজে অকাজে। একদিন শহরে গিয়ে বন্ধুদের জানিয়ে এল, শিগগির একদিন হাসপাতালের লেডি ডাক্তারের কাছে আসতে হবে রোহিণীকে নিয়ে।
বন্ধুরা গগনচন্দ্রের পিঠ চাপড়ে নাচতে নাচতে বলল, জয় গগন! দারুণ শট দিয়েছি তো এবার। দেখিস বাবা, সামলে।
গগনচন্দ্রের একটা চাপা দুঃখ আছে। বিয়ের পরের বছর রোহিণী অন্তঃসত্বা হয়েছিল। বাবাও ঠিক তখন মারা গেল। কী হয়েছিল কে জানে—সদ্য অন্তঃসত্বা রোহিণী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। যেটি এসেছিল সেটি নষ্ট হয়ে গেল। তারপর বছর দুই বাদে আবার এই। রোহিণীর হিসেবমতন মাস আড়াই হয়ে গেল।
মনে মনে একটু ভয় থাকলেও গগনচন্দ্র মোটামুটি খুশি। বাবার বড় সাধ ছিল নাতির মুখে দেখে যাবে। নাতি না হোক নাতনি। বাবার সে-সাধ মেটেনি।
প্রথমটির জন্যে গগনচন্দ্রের আফসোস সামান্য ছিল—তবে সে উতলা হয়নি। কীই বা তার বয়েস, আর রোহিণীরই বা কত বয়েস—যে দু’জনকে হাহুতাশ করতে হবে! গাছের প্রথম ফল অনেক সময়েই থাকে না, পুষ্ট হবার আগেই পড়ে যায় মাটিতে। গগনচন্দ্রই তার মায়ের তৃতীয় সন্তান। আগের দুটি এসেছে গিয়েছে। এ-রকম হয়। ভগবানের খেলা, কী আর করা যাবে!
চমৎকার লাগছিল গগনচন্দ্রের। রোহিণীও যেন নতুন করে কিছু পেয়েছে তার শরীরে। মুখটি আরও আহলাদে ভরে গেছে। স্বামী যেন তার কাছে এখন ‘রাত-বেলার’ শশী। কথাটা রোহিণী নিজেই বলে স্বামীর সোহাগ গায়ে মনে মাখতে মাখতে, নিজেকেই মাখাতে মাখাতে।
গগনচন্দ্র বেজায় ফুর্তিতে আছে। মাঝে মাঝে আজকাল কমলাদিদিকে বলে, ‘একটু নজর রেখো। বউ যা জল ঘাঁটাঘাঁটি করে—গরমের দিন—সর্দিগরমি না ধরিয়ে বসে। কলঘরটায় শ্যাওলা জমতে দেবে না।’
কমলাদিদি মাথা নাড়ে। হাসে মুখ টিপে। হাসিটা যেন কেমন! সরল, না, চাপা বোঝা যায় না।
এই চৈত্র মাসেই বাড়িতে কাজ শুরু হয়েছিল। কলি ফেরানোর কাজ। বছর দুই অন্তর না হোক অন্তত তিন বছরের মাথায় চুনকামের কাজ হয় এ-বাড়িতে। পুরনো বাড়ি, সাদামাটা শোভা, তবু তার চেহারাটি মাঝে মাঝে ঘষে মেজে না দিলে কী হয়!
এই চৈত্র মাসেই বাড়িতে কাজ শুরু হয়েছিল। কলি ফেরানোর কাজ। বছর দুই অন্তর না হোক তিন বছরের মাথায় চুনকামের কাজ হয় এ-বাড়িতে। পুরনো বাড়ি, সাদামাটা শোভা, তবু তার চেহারাটি মাঝে মাঝে ঘষে মেজে না দিলে কী হয়!
বাবার আমলেও নিয়ম ছিল, চৈত্র মাসে কলি ফেরানোর। বাড়ির কাজ শেষ করে মিস্ত্রি-মজুররা চলে যেত দোকানে। তা বাবা বেঁচে থাকতে, গগনের বিয়ের আগে, কর্তা নিজেই ঘরদোর মেরামতি রঙচঙ করিয়ে ছিল বাড়ির। তারপর আর হয়নি। হব হব করেও আটকে যাচ্ছিল।
এবার রোহিণী গোঁ ধরল। ঘরদোরের দেওয়ালের চুন একেবারে হলুদ, বিবর্ণ হয়ে গেছে। বাড়ির বাইরের রঙও রোদে জলে ধুলোয় ময়লায় হতকুচ্ছিত। রোহিণী গোঁ না ধরলেও গগনচন্দ্র বাড়ি রঙয়ের কাজে হাত দিত। নতুন বছর পড়ার আগে রঙচঙ হয়ে গেলে ঘরবাড়ি দেখতেও সুন্দর লাগে।
ক’দিন ধরে কলি ফেরানোর কাজই চলছিল। তবে ধীরে সুস্থে। শুধু তো চুনকামের কাজ নয়, চুন করার আগে কিছু মেরামতিও থেকে যায় বালি সিমেন্টের। বাড়িটা এখন কেমন হতচ্ছাড়া চেহারা নিয়েছে, চুন বালি সিমেন্ট, বাঁশ, শনের পুঁটলি, বালতি এখানে-ওখানে, তারই সঙ্গে কত কী ডাঁই হয়ে পড়ে আছে ঘর-লাগোয়া ঢাকা বারান্দায়। এক একটা ঘরের জিনিসপত্র বার করে রাখা হচ্ছে বারান্দায়। টাল হয়ে পড়ে থাকছে। ঘর মেরামতি আর চুনকামের পর আবার সেসব জিনিসপত্র ঘরে ঢোকানো হচ্ছে। সারা বাড়িময় নতুন চুনের গন্ধ।
সেদিন দোকান থেকে খানিকটা তাড়াতাড়িই ফিরেছিল গগনচন্দ্র। কোনো কারণে নয়, এমনিই। ভেবেছিল সন্ধের পর বাড়িতে বসে বসে দোকানের হিসেবপত্র দেখবে। চৈত্র শেষ হয়ে এল। বৎসরান্তে একবার লাভক্ষতির হিসেবটা দেখতে হয় বইকি!
তখনও আলো মরেনি। চৈত্রের বেলা কি সহজে ফুরোয়!
বাড়িতে পা দিয়েই বড় মিস্ত্রি হরেনের সঙ্গে দেখা। তার সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে পা বাড়াচ্ছে—নজরে পড়ল উত্তর দিকের এই বারান্দার শেষ ঘরের বাইরে—ঢাকা বারান্দায় রাজ্যের জঞ্জাল ডাঁই করা। মনে হয় যেন, ভেতরের কোনো গুদোম থেকে কেউ টান মেরে সব বাইরে ফেলে দিয়েছে। ভাঙা খাটের বাজু, মশারির ছত্রি, ছেঁড়া নারকোল ছোবড়া, ভাঙা টুল, লোহার ছোট ছোট শিক, পাখির খাঁচা, তোবড়ানো বাক্স থেকে ফেঁসে যাওয়া ডুগি তবলা, ছেঁড়া চটি—কী নয়। আরও কত কিছু! গগনচন্দ্রের কেমন মজাই লাগছিল। এসব জিনিস জমিয়ে রেখে কী লাভ! কেনই বা জমানো আছে! সংসারী মানুষের এই হল স্বভাব। কোনো জিনিস ফেলতে প্রাণ ওঠে না। জমিয়ে রাখে। বাবার আবার এই দোষ খুবই ছিল। ভাঙা বালতিও ফেলতে দিত না। বলত, রেখে দাও—কখন কী কাজে লাগে।
চলেই আসছিল গগনচন্দ্র, হঠাৎ নজরে পড়ল, পা-ভাঙা পিঠ-ভাঙা একটা বেতের চেয়ারের ওপর ময়লা কাগজে মোড়া কী-একটা রয়েছে। কাগজ ছেঁড়া। একটা জায়গা চকচক করছিল। দু পা এগিয়ে পিঠ নুইয়ে জিনিসটা দেখল সে। আয়না নাকি?
আয়না…আয়না। হঠাৎ গগনচন্দ্রের মনে হল, যাবার আগে যুধিষ্ঠির বলেছিল, উত্তরের এই জঞ্জাল-জামানো ঘরটিতে একটি আরশি আছে। পুরনো আয়না। কিন্তু ভাল আয়না। লতাপাতা-করা কাঠের ফ্রেম দিয়ে বাঁধানো। ওটির পারা উঠে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল অনেকটাই, যুধিষ্ঠির নতুন করে পারা লাগিয়ে আয়নাটি ঠিক করে দিয়েছে। ‘আরশিটি বড় ভাল বাবু, পুরনো জিনিস, ফেলে রেখে নষ্ট করবেন না, ঘরে এনে রেখে দেবেন।’
এটি তবে সেই আরশি। যুধিষ্ঠির তো বেশ যত্ন করে কাগজ মুড়ে রেখে গিয়েছে।
কী মনে করে হাত বাড়িয়ে আয়নাটি তুলে নিল গগনচন্দ্র, তারপর ঘরে চলে গেল।
ঘরে গিয়ে একপাশে রেখে দিল জিনিসটা। ওপর ওপর ধুলো পরিষ্কার করল কাগজের। পরে দেখা যাবে—জিনিসটা কেমন মূল্যবান!
জামাকাপড় আলনায় রেখে লুঙ্গি পরে গগনচন্দ্র স্নান করতে চলে গেল।
স্নান করতে করতে যুধিষ্ঠিরের কথাই ভাবছিল গগনচন্দ্র। মানুষটাকে আগে খুবই মনে পড়ত। মনে পড়লেই নিজের মন খুঁত খুঁত করত। যে যাই বলুক, তার মনে হত, যুধিষ্ঠির লোকটা ভাল ছিল। সরল মানুষ। তার কথাবার্তাও ছিল সরল। সাদাসিধে মানুষকে লোকে আজকাল ভুল ভাবে। গগনচন্দ্র বাস্তবিক যুধিষ্ঠিরকে চোর, ছ্যাঁচড়া কি অসভ্য ধরনের মানুষ ভাবেনি। তার তো ভালই লাগত। এখন যদি বাড়ির লোক নিত্য কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে সে কী আর করতে পারে! বাইরের একটা মানুষের জন্যে তো ঘরের স্বস্তি নষ্ট করা যায় না।
মনে মনে গগনচন্দ্রের খারাপ লাগত, দুঃখও হত যুধিষ্ঠিরের জন্যে। লোকটা একদিন তাকে বাঁচিয়ে ছিল। সেদিন যদি যুধিষ্ঠির ওই সময়ে কুল আর কাঁটাঝোপের কাছে গিয়ে হাত ধরে না টেনে তুলতো তাকে—তবে তার পক্ষে উঠে দাঁড়ানো হয়ত সম্ভব হত না। পৌষের শীতে সারা রাত তাকে পড়ে থাকতে হত ঝোপের পাশে। নিউমোনিয়া হয়ে মরত গগনচন্দ্র। সত্যি বলতে কি সেদিন ওই অবস্থায় যুধিষ্ঠিরকে না দেখলে তার নিজেরাও সাহস ফিরে আসত না। এই জগতে এটা একটা বড় অদ্ভুত ব্যাপার। সাহস পেলে ডুবন্ত মানুষও যেন বাঁচাবার জন্যে হাত-পা ছুঁড়ে জলের ওপর ভাসতে চায়।
যুধিষ্ঠির বলেছিল, সে কী একটা কাজে যাচ্ছে, কাজ শেষ হয়ে গেলে—এদিকে পান এলে দেখা করবে। কিন্তু সে আর আসেনি।
গগনচন্দ্র নিজে মাঝে এর ওর কাছে খোঁজ নিয়েছে যুধিষ্ঠিরের। কেউ কিছু বলতে পারে না। শুধু বিষ্ণু বলে একজন বলেছিল, যুধিষ্ঠিরকে সে যেন দেখেছে। চাঁচুরিয়ার দিকে দিশি খ্রিশ্চানদের যে কবরখানা আছে, তার কাঠকুটো গাছপালার বেড়ার পাশে বসে কাজ করছিল বাগানের।
বিষ্ণুর কথা ঠিক হতে পারে, নাও পারে।
স্নান সেরে ঘরে ফিরল গগনচন্দ্র।
রোহিণী চা-জলখাবার নিয়ে বসে রয়েছে।
গা-মাথা ভাল করে মুছে চুল আঁচড়ে বসল গগনচন্দ্র।
রোহিণী জলখাবার চা এগিয়ে দিয়ে বলল, ”তোমার এই মিস্ত্রি মজুরের কাজ করে নাগাদ শেষ হবে?”
”হয়ে যাবে। আর বড় জোর হপ্তা খানেক। কেন?”
”দু’চার দিনের জন্যে মাকে আনাতাম।”
”ও! উনি কি আসবেন? চৈত্র মাস!”
”থাকতে আসছে না। দু’চার দিনের জন্যে আসবে, চলে যাবে।”
”চৈত্র মাসের আর ক’দিন আছে জান?”
”দিন দশ বারো।”
”উনি আসতে পারলে আসতে বলো।”
”ঘর পরিষ্কার না হলে আসতে বলতে পারছি না। বাড়ি নরক হয়ে আছে।”
”তোমায় একবার শহরে নিয়ে যেতে হবে। হাসপাতালের লেডি ডাক্তারকে বলে রাখবে রসময়। তার সঙ্গে জানাশোনা আছে।”
”চৈত্র মাসে নয়। ক’টা দিন কাটুক, তারপর।”
কথাবার্তার মধ্যেই গগনচন্দ্রের জলখাবার চা খাওয়া শেষ হল। ও উঠে গেল টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে আসতে। রোহিণী থালা গ্লাস চায়ের কাপ প্লেট সরিয়ে ঘরের একপাশে রেখে দিচ্ছিল। যাবার সময় নিয়ে যাবে।
সিগারেট ধরিয়ে গগনচন্দ্র বিছানায় এসে বসল আরাম করে। সামান্য সময় শুয়ে থাকবে, আলস্য ভাঙবে, তারপর খাতাপত্র টেনে এনে বসবে।
হঠাৎ রোহিণী বলল, ”ওটা কী?”
তাকাল গগনচন্দ্র। রোহিণীর চোখে পড়েছে কাগজ-মোড়া আয়নাটা।
”আয়না।”
”আ-য়-না! কিসের আয়না? ওখানে কেন? কে আনল?”
”ওটা বাইরে জঞ্জালের মধ্যে পড়ে ছিল। মিস্ত্রিরা বার করে বাইরে রেখে দিয়েছে।”
”তুমি তুলে আনলে?”
”পুরনো আয়না। বাড়িতে ছিল। যুধিষ্ঠির বলেছিল, খুব ভাল আয়না। পারা-টারা উঠে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, ও ঠিক রেখে দিয়েছে। ঘরে এনে রাখতে বলেছিল।”
”ও তোমার যুধিষ্ঠিরের আয়না।” বলতে বলতে দু’চার পা এগিয়ে গেল রোহিণী। ”দেখি কেমন আয়না?”
গগনচন্দ্র বলল, ”ধুলো ভরতি হয়ে আছে। পরিষ্কার করে নিতে হবে।”
রোহিণী এ-পাশ ও-পাশ তাকাল। আলনার র্যাকের তলায় একটা ফুল ঝেঁটা রয়েছে। মোছামুছির জন্যে খানিকটা ময়লা কাপড়ও পুঁটলির মতন করে রাখা।
কেমন এক কৌতূহলবশে রোহিণী ফুল ঝেঁটা আরয ময়লা কাপড়ের টুকরো নিয়ে এল।
ধুলো-ময়লা রোহিণী বিশেষ পছন্দ করে না। খানিকটা আলগোছে আয়নার ওপরকার কাগজের ময়লা ঝাড়ল, তারপর কাগজটা ফেলে দিল সরিয়ে। বার কয়েক ঝেঁটা বুলিয়ে নিল আয়নাটায়। ময়লা কাপড় দিয়ে মুছে নেবে ওপরে কাচ।
গগনচন্দ্র আরাম করে সিগারেট টানছিল। গতকাল কালবৈশাখী উঠেছিল। বৃষ্টিও হয়েছে এক পশলা। ফলে আজ একটু ঠাণ্ডা ভাব আছে।
হঠাৎ বিশ্রী এক চিৎকার, যেন ভয়ে আর্তনাদ করে উঠেছে কেউ—, শুনে তাকাল গগনচন্দ্র। রোহিণী বিকটভাবে চেঁচিয়ে ডঠেছে। বিশ্রী চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে তার হাত থেকে আয়নাটা পড়ে গেল মাটিতে। কাচ ভাঙার শব্দ। পায়ের কাছে ভাঙা আয়না। ফ্রেমের কাঠ খুলে—জোড় খুলে ছিটকে গিয়েছে কিছু। কয়েকটা আয়নার টুকরো এপাশে ওপাশে ছড়ানো। রোহিণীর মুখ অদ্ভুত দেখাচ্ছিল। ভীষণ ভয় পাওয়ার মতন; সেই সঙ্গে ঘেন্নায় যেন তার সারা মুখ বিকৃত। একেবারে ফ্যাকাশে মুখ, চোখ আতঙ্কে ভরা। কাঠের মতন দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ, তারপর যেন কাঁপতে লাগল।
কমলা বোধহয় কাছাকাছি কোথাও ছিল বাইরে, বা বারান্দা দিয়ে যাচ্ছিল কোথাও, রোহিণীর চিৎকারে ভয় পেয়ে হুড়মুড় করে ঘরে এসে ঢুকল।
গগনচন্দ্র বিছানা থেকে নেমে পড়ল তাড়াতাড়ি। ”কি হয়েছে?”
রোহিণী কথা বলতে পারছিল না।
গগনচন্দ্র কিছুই বুঝতে পারছিল না। আয়নার কাচের গায়ে কি মরা টিকটিকির বাচ্চা বা বিছে কি আরশোলা চিপটে ছিল? রোহিণীর ভীষণ ভয় আর ঘেন্না এইসব পোকামাকড়ে।
কমলা বলল, ”কী হয়েছে?”
গগনচন্দ্র বলল, ”ওই আয়নাটা দেখছিল! কী হল হঠাৎ….”
কমলা কোমর নুইয়ে তাড়াতাড়ি আয়নার টুকরো তুলে নিতে গেল। সাবধান হয়নি। হবার কথা মনে হয়নি। কেমন করে যেন তার হাত কেটে গেল কাচে। খারাপ ভাবেই কাটল। বক্তে তার হাত ভাসল। আয়নার টুকরোটাও লাল হয়ে গেল। কমলা যেন রক্ত ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছিল না আয়নার কাচে।
ততক্ষণে গগনচন্দ্র রোহিণীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ভূত দেখার মতন করেই দাঁড়িয়ে আছে রোহিণী। শুধু কাঁপছিল।
স্ত্রীর পায়ের দিকে তাকাল গগনচন্দ্র। রোহিণীর পায়ের কাছেই আয়নার বড় অংশটা পড়ে। ফেটে চৌচির। মাকড়শার জালের মতন দেখাচ্ছে চিড় ধরা, ফাটা অংশগুলো। আশেপাশে টুকরো কাচ ছিটিয়ে রয়েছে। মরা টিকটিকির বাচ্চা বা বিছে কী আরশোলা কিছুই দেখতে পেল না সে।
তা হলে? তা হলে কী এমন হল যে রোহিণী ভয় পেয়ে হাত থেকে আয়নাটা ফেলে দিল?
গগনচন্দ্র কিছুই বুঝতে না পেরে সাবধানে পিঠ নুইয়ে উবু হয়ে মাটিতে বসল। বসে ভাঙাফাটা চৌচির-হওয়া আয়নার নিজের মুখ দেখার চেষ্টা করল। ভাঙা, আলগা, ফাটা, বিচ্ছিন্ন কাচের টুকরোগুলোর মধ্যে নিজের মুখটি ঠিকমতন দেখতে পেল না। হয়ত একটা চোখ, নাক কোথাও লম্বা হয়ে গেছে, কান নেই না আছে, গলা থুতনির তলা থেকে কাটা, গাল আধখানা আছে, বাকিটা কোথায় সরে গেছে কে জানে!
কমলার কাটা হাতের রক্তমাখা টুকরোটা মাটিতে পড়ে গেল।
তাকাল গগনচন্দ্র মুখ তুলে।
কমলার যেন ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। চোখে জল। শাড়ির আঁচল দিয়ে হাত বাঁধছিল। রোহিণীরও ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হঠাৎ কেঁদে উঠল।
ছয়
গ্রীষ্ম কাটল, বর্ষা এল। বর্ষাও শেষ হয়ে সবে শরৎ দেখা দিযেছে। আশ্বিনের শুরু। এক এক পশলা বৃষ্টি এখনও এলোমেলো ভাবে আসে আর যায়।
একদিন আচমকা যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল গগনচন্দ্রের।
তখন বিকেল ফুরিয়ে এসেছে। দুপুরভোর বৃষ্টি হয়েছে। বিকেলে মেঘ কেটে আকাশ খানিকটা পরিষ্কার। মাঠেঘাটে জল, রাস্তায় কাদা। ডোবাগুলো ভরতি। পথের পাশের লতাপাতার ঝোপঝাড় ভিজে সপসপ করছে।
গগনচন্দ্র গিয়েছিল শ্রীপুর। কাজ সেরে তার মোটর সাইকেল নিয়ে ফিরছিল সাবধানে। হঠাৎ নজরে পড়ল, কে একজন আসছে মাঠ দিয়ে, গান গাইতে গাইতে।
প্রথমটায় না হলেও কয়েক মুহূর্ত পরে গগনচন্দ্র চিনতে পারল, যুধিষ্ঠির। দাঁড়িয়ে গেল গগনচন্দ্র, মোটর সাইকেল পাশ করে রাখল।
যুধিষ্ঠির কাছে এল।
”যুধিষ্ঠির নাকি?”
কাছে এসে যুধিষ্ঠির দেখল গগনচন্দ্রকে। পিঠ কোমর ভেঙে নমস্কার জানাল হাত জোড় করে। ”নমস্কার বাবু।”
”কেমন আছে? এদিকে কোথায়?”
”রামনগর গিয়েছিলাম। ফিরছি।”
”আছ কেমন?”
”তা আছি বাবু! দিন কেটে যাচ্ছে। তাঁর দয়ায় আছি।”
গগনচন্দ্র সামান্য নজর করে দেখল যুধিষ্ঠিরকে। গায়ের আলখাল্লাটা নেই। বাকি সব সেই রকম। গায়ে জামা, পরনে ময়লা ধুতি। কোমরের কাছে কোচার অংশটি জড়ানো। পায়ে ছেঁড়াফাটা চটি। হাতে ছাতা। ঝুলিটি পিঠে ঝোলানো।
”বাড়ির সব ভাল বাবু? ওনারা ভাল আছেন?”
গগনচন্দ্র একটা সিগারেট ধরাল। দুটো কথা বলতে চায় যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে। ”সিগারেট খাবে একটা? নাও…!”
যুধিষ্ঠির যেন কুণ্ঠার সঙ্গে সিগারেট নিল। ধরিয়েও নিল গগনের হাত থেকে দেশলাই নিয়ে।
”তুমি যাবে কোথায়?”
”আজ্ঞা ঘুষুলিয়া যাব। মণ্ডলবাবা খোঁজ করছিলেন। কাজ আছে বাবার।”
”তোমার পথটি অন্য দিকে হয়ে গেল, নয়ত আমারপেছনে বসে যেতে খানিকটা।”
”আমি চলে যাব। এক ক্রোশও পথ নয়। সাঁঝের আগেই পৌঁছে যাব।”
”তা যাবে”। গগনচন্দ্র একবার আকাশের দিকে তাকাল। টুকরো টুকরো হালকা মেঘ ভাসছে। বৃষ্টি আর বোধহয় আসবে না। বেলা পড়ে গেল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর খানিকটা যেন ইতস্তত করে গগনচন্দ্র বলল, ”সেই আয়নাটির কথা তোমার মনে আছে?”
দু’পলক গগনচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে যুধিষ্ঠির বলল, ”সেই আরশিটি? আজ্ঞা হাঁ, মনে আছে বইকি!”
”ওটি কেমন আয়না গো?”
”কেন বাবু?”
”তোমার কথায় ঘরে এনে যেদিন রাখতে গেলাম, তোমার বউদিদিমণি আয়নার মুখ দেখতে গিয়ে ভয় পেয়ে গেল! সে-ভয় তুমি বুঝবে না। দু’একদিনেও ভয় ভাঙল না। শরীর খারাপ হল। ডাক্তার-বদ্যি। শেষে….। তা শুধু বউদিদিমণির একার নয়, কমলাদিদিরও হাত কাটল, সে কী রক্ত! কাটা হাত পাকল, পুঁজ হল। ভুগল মাস খানেক।”
”আহা….!”
”আমার পায়েও কাচের টুকরো ফুটে গিয়েছিল। ভোগান্তি আমারই কম হয়েছে।”
যুধিষ্ঠির চুপ করে থাকল। তার যেন কষ্টই হচ্ছিল কথাগুলো শুনতে শুনতে।
শেষে গগনচন্দ্র বলল, ”তুমি বলেছিলে আয়নাটি পুরনো হলেও ভাল। তা ভাল কই দেখলাম না। ওটি মন্দই করল হে!”
যুধিষ্ঠির অল্পসময় চুপচাপ থাকল। তারপর বলল, ”বাবু সত্য কথাটা কী জানেন? একটা তবে গল্প বলি। কাকেদের স্বভাব আপনি জানেন। দশ বিশটা কাক একত্র হলে কান পাতা যায় না। তা বাবু, একদিন বিশ পঁচিশটি কাক এক নদীর তীরে বসে কা-কা করছিল। এই ওড়ে তো ওই বসে, আবার ওড়ে। এমন সময় একটি হাঁস এসে বসল কাছে। অনেক দূর থেকে উড়ে ডড়ে আসছে। আজ্ঞা ধরুন, মানসসরোবর থেকে। হাঁসটিকে দেখে কাকের দল ঠাট্টা তামাশা করতে লাগল। তাকে জ্বালাতে লাগল। হাঁসটি ভাবল এখানে বসে দরকার নেই, অন্য কোথাও চলে যাই। তা হাঁসটি আবার উড়তে শুরু করলে—একটি কাক বলল, তুমি তো ওড়াই জান না বাপু! একই ভাবে আকাশে ওড়ো। আমরা একশো রকম ওড়া জানি।” বলতে বলতে থামল যুধিষ্ঠির।
গগনচন্দ্রের মজা লাগছিল। কোথায় আয়না, আর কোথায় কাকের গল্প! তবে যুধিষ্ঠির গল্পগুলো বলে ভাল। গগনচন্দ্র আগেও কত গল্প শুনেছে তার মুখে।
যুধিষ্ঠির বলতে লাগল, ”হাঁসটিকে আর উড়তে দেয় না কাকটি। সারাক্ষণ এটি বলে সেটি বলে। তাকে গালমন্দ করে, আর নিজের ওড়ার গর্ব করে। শেষ পর্যন্ত কাক বলল, চলো তোমার সঙ্গে পাললা দিয়ে আমিও উড়ি। দেখবে কতরকম ভাবে উড়তে জানি আমরা। এই বলে কাক নানান কায়দা করে উড়তে উড়তে চলল। নদী শেষ হয়ে সাগর। কাকটি ততক্ষণে থেকে গেছে। তা ছাড়া সাগর সে দেখেনি। জল আর জল। ভয় পেয়ে গেল কাক, থেকেও গিয়েছিল। আর উড়তে পারল না। ঝপ করে সাগরের জলে গিয়ে পড়ল। পড়ে আর উঠতে পারে না, জলে চোবানি খেতে লাগল। হাঁসটি তখন পিছু পিছু ফিরে এসে বলল, ও ভাই কাক—এটি তোমার কী ধরনের ওড়া, জলের ওপর পাখা ঝাপটাচ্ছ। কাকটি তখন মরছে যে, কত আর পাখা ঝাপটাবে জলে। কাক বলল, ভাই—আমি মরছি, আমায় তুমি বাঁচাও। আমাকে আমার জায়গায় পৌঁছে দাও।…হাঁসটি তখন তার লম্বা ঠোঁট দিয়ে কাকটিকে তুলে নিয়ে নিজের পিঠের ওপর বসল। তারপর একই ভাবে উড়তে উড়তে ফিরে এসে কাকটিকে তার দলবলের কাছে নামিয়ে দিল।”
গগনচন্দ্র বলল, ”তা না হয় হল। কিন্তু হাঁসটির সঙ্গে আয়নার সম্বন্ধটি কোথায়?”
যুধিষ্ঠির বল, ”সম্বন্ধটি একটু আছে, বাবু। মানুষের মধ্যে অনেকের ওই দোষটি থাকে। তারা দম্ভ করে, কুকথা বলে, অন্যকে বিনি-দোষে ঠোকরায়। কেউ নিজেরণিটেকেই বড় বলে ভাবে, কেউ অন্যকে ছোট করে আনন্দ পায়। তাই না? …এ হল মানুষের মুখ্যুমি। আকাশের হাঁসটি তো অন্যরকম, বাবু। তিনি তো কাক নন। তাঁর ওড়ার কি বিরাম আছে!”
গগনচন্দ্র একটু ঘাড় নাড়ল। কী বুঝল কে জানে!
”আমি তো কমলাদিদিমণির হার চুরি করিনি। তিনি কলঘরে হারটি হারিয়েছিলেন। আংটা ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছিল। জলের সঙ্গে নালা দিয়ে বাইরে এসে ময়লায় আটকে গিয়েছিল।”
গগনচন্দ্র জানত না, রোহিণী বলেনি যে, কমলাদিদির হারের আংটা পলকা ছিল। ”তুমি ময়নাকে টাকা দিয়েছিল?”
”আজ্ঞা হাঁ, দিয়েছি বাবু! ময়নার বলেনি যে, কমলাদিদির হারের আংটা পলকা ছিল। ”তুমি ময়নাকে টাকা দিয়েছিলে?”
”আজ্ঞা হাঁ, দিয়েছি বাবু! ময়নার মেয়েকে কুকুরে কামড়েছিল। ও ডাক্তারবাবুর কাছে যাবে। কেঁদেকেটে ক’টি টাকা চাইছিল বউদিমণির কাছে। বউদিমণি দিলেন না। আমি দিলাম। …কাউকে না কাউকে তো দিতেই হয়। না দিলে সংসারে বাঁচা কেন!”
কুকুরে কামড়ানোর কথাও গগনচন্দ্র জানত না। তার খারাপ লাগল।
”যুধিষ্ঠির! …একটা কথা। তুমি নাকি কমলাদিদির ঘরে একলা একলা যেতে? কেন যেতে? কী ছিল সেখানে?”
যুধিষ্ঠির একটু হাসল। বলল, ”বাবু, ওই ঘরটি থেকে একটি গন্ধ পেতাম। গন্ধটি কেমন তা বোঝাতে পারব না। পোড়া গন্ধের মতন। আমি ঘরে গিয়েছিলাম গন্ধটির খোঁজ নিতে। দেখতে। গিয়ে দেখি ঘরের কোথাও কিছু নেই, তবু গন্ধটি আছে। …কমলাদিদির কোন জিনিসটি পুড়ছিল—আপনি জানেন না, বাবু?”
গগনচন্দ্র চমকে উঠল। মুখটি নামিয়ে নিল নিজের।
যুধিষ্ঠির নিজেই বলল, ”তবে বাবু একটি কথা স্পষ্ট বলি, আপনি দোষ ধরবেন না। মানুষ বড় বোকা। এই যে আমাদের অঙ্গগুলি—এই হাতটি পা-দুটি পিঠটি মুখটি আমি সাবান মেখে বার বার পরিষ্কার করতে পারি। ভাল সাবানের সুবাসটিও ছড়াতে পারি অঙ্গ থেকে। কিন্তু ওটির বেলা কী হবে?” বলে সে গগনচন্দ্রের দিকে তাকাল।
”কোনটি?”
যুধিষ্ঠির নিজের বুক দেখাল। বলল, ”এর তলায় যেটি আছে। প্রাণটি হৃদয়টি তো সাবান মাখিয়ে পরিষ্কার করা যায় না, বাবু। বাজারের তেলসাবান আতর মাখিয়ে কি তাতে গন্ধ ছোটানো যায়!…প্রভু তাই বলেছেন, নিজের হৃদয়টি পরিচ্ছন্ন করো, অন্যগুলি তুমি তোমার হাত দিয়ে জল ঢেলে ধুতে পার, হৃদয়টি পারো না। সেটি তোমায় ভালবাসা মায়ামমতা দিয়ে ধুয়ে পরিচ্ছন্ন করতে হবে। হৃদয় যদি নির্মল না হয়—একটি শিশুকেও তুমি চুম্বন করতে পার না।”
গগনচন্দ্র স্তম্ভিত। যুধিষ্ঠির এত কথা জানে? কে তাকে শেখাল? গেঁয়ো, গরিব, মূর্খ একটা মানুষ, ধুলোকাদায় যার পা-হাত মাখামাখি, পরনে যার ছেঁড়া ধুতি জামা—সে এত কথা শিখলো কেমন করে? কে তাকে শেখাল?
যুধিষ্ঠির বলল, ”আপনি আরশিটির কথা বলছিলেন। ওটি তো পুরনো বাবু। আপনার বাপ পিতামহ, তাঁর পিতামহও জানতেন, এই সংসারে একটি আরশি আছে। নিজের মুখটি সেই আরশিতেই দেখতে হয় মাঝে মাঝে। দেখলে বোঝা যায়, কার মুখটি কেমন! ওটি তো আপনার অন্তরে আছে! নাই, বলুন! … আর ওই হাঁসটি, তিনি তো নিত্যকাল আকাশে উড়ে বেড়ান। … তা যাক বাবু আমি মুখ্য মানুষ। কত ভুল বললাম।”
গগনচন্দ্র কিছু বলল না।
এবার যুধিষ্ঠির যাবার জন্যে পা বাড়াল। ”আসি বাবু, নমস্কার।”
আঁধার ঘনিয়ে আসছিল। আকাশে সন্ধ্যাতারাটি সবে ফুটল। বাতাস দিচ্ছিল শরতের।
গগনচন্দ্রের মনে হল, যুধিষ্ঠির যেন নিজেই সেই গল্পের হাঁস, এসেছিল হঠাৎ, তাদের বড় জব্দ করে চলে গেল। না, জব্দ করে নয়, বোধহয় ডুবন্ত কাকের মতন তাকেও পিঠে করে তুলে এনে আবার বাঁচিয়ে দিয়ে গেল।