যুদ্ধে কার লাভ?
আজ দেশে একটা যুদ্ধ চলছে। এটা দীর্ঘকাল না-ও চলতে পারে; অর্থাৎ এ লেখা যখন ছাপা হবে তখন হয়তো দেশে যুদ্ধ থাকবে না। তবুও এর কিছু প্রাসঙ্গিকতা থাকবে কারণ, যে সব উদ্দেশে রাষ্ট্রশক্তি যুদ্ধ বাধায় ও চালায়, সে সব লুপ্ত হবে না।
খ্রিস্টীয় অষ্টম বা নবম শতকে এক বাঙালি নাট্যকার ভট্টনারায়ণ সংস্কৃতে একটি নাটক লেখেন, নাম ‘বেণীসংহার’, বিষয় মহাভারতের যুদ্ধের শেষ দিনের ঘটনাবলি। এই নাটকে তৃতীয় অঙ্কের ঠিক আগে একটি খণ্ডাংশ আছে, নাট্যসাহিত্যে একে বলে ‘প্রবেশক’। এখানে পাত্র-পাত্রী রাক্ষসদম্পতি, এদের নাম বসাগন্ধা ও রুধিরপ্রিয়। আঠারো দিন ধরে যুদ্ধ চলছে, হাতিঘোড়া মানুষ মরছে প্রচুর, রাক্ষস-রাক্ষসী ভারী খুশি। বসাগন্ধা সদ্যোমৃতের গরম গরম রক্ত এনে স্বামী রুধিরপ্রিয়কে পান করাচ্ছে, তার যেন সুরাপানের নেশা মিটছে। স্ত্রীর কাছে খবর নিচ্ছে কে কে মরল, ভাঁড়ারে কত জমা পড়ল। বসাগন্ধা পরিতৃপ্ত গৃহিণীর মতো সানন্দে খবর দিচ্ছে, কত চর্বি (বসা), কত মাংস, কত রক্ত জমা আছে ভাঁড়ারে; সোৎসাহে স্বামীকে জানাচ্ছে যে, তারা এখন প্রাণভরে যত ইচ্ছে চর্বি, মাংস খেতে ও রক্ত পান করতে পারে, এ খাদ্যপানীয়ে টান পড়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। কারণ, ভাঁড়ারে পূর্বসঞ্চিত রক্ত-মাংস-চর্বিই প্রচুর ছিল যুদ্ধের শুরু থেকে জমা করা, আর এখন তো দু’পক্ষে রোজ কত লোক মরছে, বিস্তর জমছে আরও, চিন্তার কোনও কারণ নেই। দু’জনেরই মেজাজ শরিফ; নিত্য ভোজ চলছে, আর এত জমছে যে, বহুদিনের সংস্থান জমা রয়েছে ভাঁড়ারে। খোশমেজাজে বসাগন্ধা কামনা করছে, যুদ্ধটা যেন শতবর্ষ স্থায়ী হয়।
মনে পড়ে মহাভারতের দ্রোণপর্বের একটি কথা; কুকুর আর শুয়োর যখন যুদ্ধ করে মরে তখন লাভ চণ্ডালের (৭:১৮০:৮)। কারণ, মৃতদেহের মাংসে পেট ভরবে তারই। যুদ্ধে রাক্ষস-রাক্ষসী, অথবা পশুযুদ্ধে চণ্ডালের ভূমিকায় প্রকৃত তাৎপর্য কী— আজকের দিনে? এক কথায় এরা হল, যুদ্ধোপজীবী অর্থাৎ যুদ্ধকে অবলম্বন করে যারা বেঁচে থাকে। এরা সৈনিক নয়, অস্ত্রব্যবসায়ী, শুধু এরাই সর্বান্তকরণে কামনা করে, যেন যুদ্ধ দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়। অর্থনীতির সঙ্গে রাজনীতি যেখানে এক, সেখানে দেখি অস্ত্রনির্মাতারা বিধাতার মতো শক্তিমান। এরা চায় বলেই যুদ্ধ লাগে, এরা চায় বলে যুদ্ধ চলে। এদের অস্ত্র বিক্রয়ের অর্থে ধনতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রপতিরা ক্ষমতায় আসে, ক্ষমতায় থাকে; এদের অস্ত্রশস্ত্র: কামান, বন্দুক, যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন, গোলাগুলি দু’পক্ষই কেনে। কেউ সদর রাস্তা দিয়ে, কেউ বা অন্যান্য রাষ্ট্রের মারফত ঘুরপথে। এই কারণে কোরিয়ার পর ভিয়েতনাম, ইরাক, ইরান, যুগোস্লাভিয়া পৃথিবীর কোথাও না কোথাও যুদ্ধ লেগেই থাকে। ছাড়া পায় শুধু অস্ত্রনির্মাতা দেশগুলি, সেখানে অস্ত্রের প্রয়োগ যত না দুষ্টের দমনে তার অনেকগুণ বেশি গণআন্দোলন দমনে নইলে তৃতীয় বিশ্বই এদের বাজার, তৃতীয় বিশ্বই এদের বিস্তৃত রণাঙ্গন। যেখানে বহু বিচিত্র কারণে এরা ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের চক্রান্ত করে, যুদ্ধকে অব্যাহত রাখে।
মহাভারতের যুদ্ধের মতোই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের প্রবর্তন করে এরা ছোটবড় নানা আকারে চর দিয়ে, গুপ্ত প্ররোচক দিয়ে রাষ্ট্রের একাংশকে অন্য অংশের শত্রু বলে প্রতিপন্ন করে। এর ওপরে যদি রাষ্ট্রের জনমানসে ভ্রাতৃঘাতী বিষ আগে থেকে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে থাকে, তা হলে তো আর কথাই নেই, তখন যুদ্ধকে দু’পক্ষের কাছেই এরা ধর্মযুদ্ধ বলে প্রতিপাদন করবার চেষ্টা করে, সার্থক হয়। শুরু হয় যুদ্ধ, চলতে থাকে, মরে সাধারণ মানুষ। চাষিমজুরের মায়ের সন্তান যায়, স্ত্রীর স্বামী ও সন্তানের পিতা। এরা গরম গরম দেশাত্মবোধক বাণী আকণ্ঠ পান, রায় দেশবাসীকে, ফলে মুখে যতই শান্তির বাণী ঘোষণা করুক না কেন, আসলে রাক্ষসের কথাই উচ্চারিত হয়। ‘যুদ্ধ চলুক শতবর্ষ ধরে।’ একটু ভাবলে বোঝা যায়, এতে লাভ কার? ইংরেজিতে প্রবচন আছে, ‘নিবারণ নিরাময়ের চেয়ে উৎকৃষ্ট’ (Prevention is better than cure) এবং প্রায় যুদ্ধকালেই এবং যুদ্ধের শেষেও বিশ্লেষণ করে জানা যায় যে, অধিকাংশ স্থলেই যুদ্ধটা অবশ্যম্ভাবী ছিল না, যথাকালে অন্য উপায়ে ঠেকানো যেত। কিন্তু তাতে একদিকে যেমন অস্ত্রব্যবসায়ীর বাণিজ্যে ভাটা দেখা যেত, অন্য দিকে তেমনই রাষ্ট্রপতিরা দেশের উদ্ধারকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বীরত্বের, দেশপ্রেমের তকমা এঁটে আশু ইষ্টসিদ্ধি করতেও পারত না।
রাষ্ট্রপতিরা দেশের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণ করে ঠিকই; কিন্তু সে কিছু দূর পর্যন্তই। শেষ কথাটা বলে দেশের সাধারণ মানুষ। হিটলার, মুসোলিনি যুদ্ধ বাধিয়েছিল, দীর্ঘকাল চালিয়েও ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ থামল সাধারণ মানুষের সংহত প্রচেষ্টায়। কারণ, যুদ্ধে সত্যিকার ক্ষতি হয় শুধু সাধারণ মানুষেরই। তাই আত্মরক্ষাবৃত্তিতে এক সময়ে মানুষের কর্তব্যে প্রতিভাত হয় কদর্য সত্যটা: যুদ্ধে লাভ শুধু রাক্ষসের। যুযুধান দু’পক্ষের কেউ হারেও না, জেতেও না
পৃথিবীর ইতিহাসের অপেক্ষাকৃত আদিপর্বেই ব্যাবিলনের এক প্রাচীর গাত্রে একটি লেখা পাওয়া যায়, সেখানে যুদ্ধরত সৈনিকদের মা ও স্ত্রীরা আবেদন জানাচ্ছেন শান্তির জন্যে; তাঁদের বাড়ি এবং তাঁদের জীবন শূন্য হয়ে যাচ্ছে যুদ্ধে। এ তো চিরকালের ইতিহাস। আরও একটা কথা, এখন পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাস আমরা যা জানি, তার মধ্যে প্রায় দশ হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথম যুগে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বাদ দিলে অধিকাংশ সময়ের ইতিহাসই শান্তির ইতিহাস। মানুষ তার নিজের স্বার্থ বোঝে; ক্ষণকালীন স্বার্থবুদ্ধিতে হানাহানির উন্মাদনা ও স্বার্থসংঘাত থাকলেও এর ওপরে একটা চিরকালীন স্বার্থবুদ্ধিও মানুষের আছে, যা তাকে প্রেরণা জুগিয়ে এসেছে পরস্পরের সঙ্গে শান্তিতে বাস করতে। মানুষ সৃষ্টিশীল জীব; সংঘর্ষে, অশান্তিতে কিছু কিছু সৃষ্টি হয় ঠিকই, কিন্তু মানসিক নিরাপত্তা, সামাজিক শান্তি না থাকলে তার বৃহত্তর সৃষ্টিকর্ম ব্যাহত হয়। মানুষ তার শ্রেষ্ঠ সত্তার বিকাশের জন্যেই বারেবারে রাক্ষসকে প্রতিহত করেছে। কারণ নরমেধ ঘটলে একমাত্র রাক্ষসেরই ইষ্টিসিদ্ধি হয়, শুভবুদ্ধির প্রণোদনাই মানুষকে বাঁচিয়েছে দীর্ঘকালীন হত্যাকাণ্ড থেকে। তাই বৈদিক যুগের ওই প্রার্থনাটি আজও প্রাসঙ্গিক— স নো বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুক্ত। রাক্ষসের ভোজ্যপানীয় সংস্থান করার আত্মঘাতী দুর্মতি থেকে মানুষের শুভবুদ্ধিই তাকে বাঁচায়।