যুগের দায়
এই প্রশ্নের উত্তর সবটা রামচরিত্রের মধ্যে পাওয়া যাবে না। সেই যুগটাকেও দেখতে হবে। রামায়ণ রচনার কাল নির্ণয়ে দেখেছি মূলগ্রন্থ (আদিকাণ্ডের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত) মোটামুটি কুষাণ সাম্রাজ্যের সমকালীন: খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যে। এই সময়ে ভারতবর্ষের সমাজ, দর্শন ও চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন ঘটে। এর কিছু আগে থেকেই বারবার বিদেশী আক্রমণকারীরা আসে; ধীরে ধীরে তাদের মত, বিশ্বাস, আচার অনুষ্ঠান সামাজিক বিধি ইত্যাদি নিয়ে তারা ভারতীয় জনসাধারণের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত ক্রমাগত যবন, শক, পারদ, পহ্লব, কুষাণ, হুণ, ইত্যাদি আক্রমণগুলি ঘটে এবং এর দ্বারা ভারতবর্ষের সামাজিক ও মননগত জগতে যে বিরাট ও স্থায়ী পরিবর্তন আসে তার সবচেয়ে স্পষ্ট চিহ্ন আছে রামায়ণ মহাভারতের ভার্গব প্রক্ষেপ।
এই কালসীমার মধ্যেই রচিত বাৎস্যায়নের কামসূত্র যেখানে দু’বার নারী সম্বন্ধে স্পষ্ট করে উচ্চারিত হয়েছে যে সে ‘পণ্যদ্রব্য’। (তস্যাঃপণ্যসধর্মত্বাৎ ২:১:১৩, ৪:১:১) এই কাল-সীমার মধ্যে রচিত ভাগবদ্গীতা, যেখানে বর্ণসঙ্করের পুরো দায়িত্ব নারীকে দেওয়া হয়েছে (স্ত্রীষু দুষ্টাসু বায়ে জায়তে বর্ণসঙ্কর; ১:৪০)। অথচ ভেবে দেখলে বোঝা যায় পুরুষের ভূমিকা সমান সক্রিয় না হলে বর্ণসঙ্কর হওয়া অসম্ভব। অর্থাৎ, বিদেশিদের সঙ্গে বৈবাহিক বা বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক সম্বন্ধে সমাজের আতঙ্ক তখন অত্যন্ত তীব্র। মহাভারতের ভার্গব সংযোজনে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন, ‘নারীর চেয়ে পাপিষ্ঠ আর কেউ নেই।’ (১৩:৪০:৪) এই মর্মে বিস্তর কথা তৎকালের সাহিত্যে পাওয়া যায়। মনুসংহিতা আর একটি ভার্গব রচনা; গোবিন্দরাজের টীকায় দেখি ভৃগুর কোনও শিষ্য ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত উপাদান সংগ্রহ করে মনুসংহিতা রচনা করেন। ব্যুলার বলেন ভৃগুর মনুসংহিতা হলো বহু ছন্দোবদ্ধ মনুসংহিতার শেষতম অংশ।’[১] মনুতে নারীর উপনয়ন নেই, আছে বিবাহ, বেদপাঠ হল পতিসেবা এবং প্রতিকুলে বাস হল ব্রহ্মচর্য। (২:৬৭) অর্থাৎ, সমাজের নারীর অবনমনের এটি একটি দলিল।
[১. সেক্রেড্ বুক্স্ অর দি ইস্ট গ্রন্থরাজিতে মনুসংহিতার ভূমিকা পৃ. ৯৭]
তা হলে এই সেই যুগ, যখন নারী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বঞ্চিত, স্বাধীন বৃত্তির অধিকারও তার নেই, সে পণ্য-দ্রব্য রূপে পরিগণিত, একা তারই দোষে বর্ণসংকর হয়, এবং তার চেয়ে পাপিষ্ঠ কেউই নেই। বিদেশি আক্রমণের ফলে আরও প্রবল হল বর্ণসংকরের আতঙ্ক। বার্ডোসানেস্ নামে এক সীরিয় গ্রন্থাকার একটি গ্রন্থ রচনা করেন (ইংরেজি তর্জমাতে বুক অব দ্য ল’স অব দ্য কান্ট্রিস), ১৪০ খ্রিষ্টাব্দ। তাতে তিনি লিখেছেন কুষাণেরা নিজেদের স্ত্রীদের রক্ষিতার মতো দেখত, তাদের কাছে কোনও যৌন আনুগত্য প্রত্যাশা করত না। তা হলে হয়তো আক্রমণ-পরম্পরার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন জাতির দাম্পত্য সম্পর্কের শিথিলতার প্রভাবে আর্যাবতের সমাজ জীবনে কিছু শৈথিল্য দেখা দিয়ে থাকবে, যে-আতঙ্কে নারীজাতিকে মোটামুটি অন্তঃপুরে বন্দিত্বের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়। ফলে, তাকে সন্দেহ করা অত্যন্ত ব্যাপক ভাবে সমর্থিত হয়। এই সন্দেহ প্রথম বার করেন রাম, যখন রাক্ষস সীতাকে স্পর্শ করে, তখন। পরে সন্দেহ করেন মূল গ্রন্থাংশে (লঙ্কাকাণ্ডে); এর পরে সন্দেহ করে অযোধ্যার প্রজারা, প্রক্ষিপ্ত অংশে, উত্তর কাণ্ডে। জে এল বাকিংটনের কথায়, ‘যুদ্ধকাণ্ডের শেষাংশ রামায়ণ রচনার দ্বিতীয় পর্যায়ে, তখন ক্ষত্রিয় বীর আর শুধু শৌর্যে মহীয়ান নন, তাঁর আচরণের মানদণ্ডও মহাকাব্যের কেন্দ্রে দেখা দেয়। প্রথম অংশে রাম নিশ্চিতই মানব, …ন্যায়বিধির ধারক ও বাহক। দ্বিতীয় পর্যায়ের রচনায় শৌর্যের চেয়ে নান্দনিক অংশের দিকে একটা ঝোঁক দেখা যয়, যেটা শৈলীর মধ্যে দিয়ে বৃহত্তর একটা প্রসারের দিকে সরে এসেছে।’[২] এই যে রাম ক্ষত্রিয় শৌর্যের আদর্শ থেকে আদর্শ রাজা হওয়ার চেষ্টা করলেন এতে তাঁর ওপরে দায়িত্ব এল আদর্শ রাজা হওয়ার নিরিখ অক্ষুণ্ণ রাখার। এই আদর্শ রাজার সম্বন্ধে মহাভারত, মনু ও সমকালীন ধর্মশাস্ত্র এবং শিলালিপিতে কতগুলি মানদণ্ড পাওয়া যায়। প্রথমত, মৌর্যযুগ থেকেই এবং বিশেষত কুষাণ যুগে, রাজা দেবতা হয়ে ওঠেন। ‘কুষাণ সাম্রাজ্যের অবসংগঠনে ছিল রাজ-কর্মচারী সৈন্যদল এবং সামন্ত শক্তি, আর শীর্ষভাগে ছিল এক পূর্ণ নিরঙ্কুশ বা প্রায়-নিরঙ্কুশ একক সৈন্য শাসিত সাম্রাজ্য।[৩] কুষাণ আমলেই প্রথম রাজকীয় মুদ্রার প্রচলন হয়; বৈদেশিক বাণিজ্য প্রসারের ফলে ও দেশে কৃষি শিল্প বাণিজ্যের বিস্তারের ফলে সমৃদ্ধির বৃদ্ধি ও বিকাশ হয় এবং সে সমৃদ্ধির রক্ষাকর্তা হিসেবে রাজার দায়িত্ব বাড়ে। সমৃদ্ধিমান ও সমৃদ্ধিহীন মোটামুটি এই দুই অংশে ভাগ হয়ে যায় প্রজা। যেমন খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়, তৃতীয় শতকের জৈনপ্রাকৃত গ্রন্থ অঙ্গ-বিজ্জা বলে, বর্ণ কেবল দুটি, ‘অজ্জ ও পেস্স’ (বা মিলক্ষু অর্থাৎ ম্লেচ্ছ, নিম্নতম বর্গের মানুষ); আর্য অর্থাৎ ধনী, পেস্স = প্রেষ্য অর্থাৎ, দাস অর্থাৎ নির্ধন।[৪] এর মধ্যে ধনিক শ্রেণির ধন যেন নিরাপদ থাকে, অজ্জ যেন পেস’কে বশীভূত রাখতে পারে— সেটার দায়িত্ব বর্তায় রাজার উপরেই। কাজেই মহাভারত এবং তৎকালীন অন্যান্য গ্রন্থে রাজাকে দেবত্বে উন্নীত করা হয়েছে (মহাভারত: ১২:৬৫:২৮, ২৯,৩২,৩৩,৪০; মনু সংহিতা: ৮:৫,১৪)।
[২. দি রাইটিয়স্ রাম, অক্সফোর্ড ইউনিভারসিটি প্রেস, ১৯৮৪, পৃষ্ঠা ৩২৩, ৩২৪, ৩১৯
৩. ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, রাইজ অ্যান্ড ফল অব দ্য কুষাণ এম্পায়ার, ফার্মা কে এল মুখোপাধ্যায়, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ৪৪৮]
৪. পুণ্য বিজয়জীর সংস্করণ ৫৪ তম অধ্যায়, পৃষ্ঠা ২১৮]
শূদ্রের কাজ উচ্চ তিন বর্ণের সেবা। শাস্ত্র শূদ্রকে ধন সঞ্চয়ে অধিকার দেয়নি; সে যদি সঞ্চয় করেও, তবু সে ধন ব্রাহ্মণ যজ্ঞের জন্যে আত্মসাৎ করতে পারে। শূদ্রনারীকে উচ্চ তিন বর্ণের পুরুষ যথেচ্ছ ভোগ করতে পারে। শাস্ত্র নানা ভাবে তাকে স্বীকার করিয়ে অসম্মানের মধ্যে রাখতে চেয়েছে। কিছু বৈশ্য ক্রমেই বাণিজ্যের দিকে চলে যাওয়ার ফলে কৃষি ও পশুপালন ক্রমেই শূদ্রেরই করণীয় হল এবং কখনও কখনও সে ব্যক্তিগত কিছু ধন অর্জন করতে পারত। মনু ‘আত্মোপজীবী’ অর্থাৎ, স্বনির্ভর শূদ্রের কথা বলেছেন (৭:১৩৮), বলেছেন ‘ন্যায়বর্তী’ শূদ্রের কথা। টীকাকার মেধাতিথি বলেছেন, ‘ন্যায়বর্তী শূদ্র’ পাক-যজ্ঞ সম্পাদন করতে পারেন। যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা পঞ্চ-মহাযজ্ঞেও শূদ্রের অধিকার স্বীকার করছে (১:১২১, মনু ৩:১৫৬)। বৃহস্পতি বলেছেন, শূদ্র উচ্চবর্ণের ক্ষেতে খামারে বেগার খাটার পরিবর্তে কাঞ্চন মূল্য দিতে পারে (১২:১৬), আর শূদ্র বণিকের পক্ষে রাজস্বের হার সর্বাধিক। তা হলে কিছু কিছু শূদ্র আর্থিক ভাবে সচ্ছল এবং সমৃদ্ধিমান এবং ধর্মের ক্ষেত্রে অনেকটা উন্নতমানের অবস্থান লাভ করেছিলেন। অর্থাৎ, কিছু শূদ্র ধীরে ধীরে অজ্জ বর্ণের কাছে আশঙ্কা এবং আতঙ্কের হেতু হয়ে উঠেছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে রামায়ণের শম্বুকের তপশ্চর্যা সম্বন্ধে অসহিষ্ণুতা বোঝা যায়। গীতায় কৃষ্ণ বলেন— শূদ্র, নারী, বৈশ্য এরা পাপযোনি, কিন্তু কৃষ্ণকে অবলম্বন করলে এরা ‘পরাগতি’ প্রাপ্ত হয়। (৯/৩২) তাই যদি হবে, তা হলে সশরীরে স্বর্গে যাওয়ার জন্য তার তপস্যা এত অসহ্য হবে কেন? মনে রাখতে হবে শম্বুক নিধনের পরে দেবতারা রামের উপরে পুষ্পবৃষ্টি করে বলেন— ‘তোমার জন্যে এই শুদ্র স্বর্গভাক্ হতে পারল না।’ অর্থাৎ, মৃত্যু না হলে শম্বুক স্বর্গে যেত, রাম সেটা নিবারণ করলেন। কিছু কিছু শূদ্রকে সামাজিক ও আধ্যাত্মিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দেখবার প্রয়োজন হচ্ছিল, অতএব পরবর্তী কালে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এ ‘মায়াতি’’সদ্র’ জাতিকে বলি দেওয়ার বিধান যে কারণে, সেই কারণেই এই যুগেই শূদ্রকে সর্বতো ভাবে অবদমিত করে রাখার দায়িত্ব ছিল রাজার। যে শূদ্র দাস, পরিচারক, সে যদি ধনে বা ধর্মে কিছু স্বাতন্ত্র্য অর্জন করে তা হলে ‘অজববন্ন’ হতে পারে।
ব্যাকট্রিয়ান, গ্রিক, রোমান, চিনের হান রাজারা, শক কুষাণ রাজারা, ইউয়েহ্ চিহ্ন ও পারসিক রাজারা এই কাল সীমার মধ্যেই দেবায়িত হচ্ছেন। ভারতবর্ষে রাজার দেবায়নের সঙ্গে যে-সব দায়িত্ব আসছে তার মধ্যে প্রধান একটি হল বর্ণ-ধর্মরক্ষা। নাসিক শিলালিপিতে (খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে) রাজা নহপানের জামাই উষভদাত ব্রাহ্মণ-কন্যার বিবাহে ধন দান করেছেন। দ্বিতীয় সাতকর্ণীর নানাঘাট লিপিতে পড়ি, তিনি চারটি বর্ণের মধ্যে সংকর নিবর্তন করেছেন (বিনিবতিতচাতুর্বর্ণসংকর)। মহাভারতে প্রথম যে রাজার উপাখ্যান পাই, তিনি বেন-এর ‘পৃথু’। তিনি প্রথমেই প্রতিজ্ঞা করেন, ‘বর্ণসংকর’ থেকে দেশকে রক্ষা করবেন। (১২:৫৯:১১৪-১৫)
বর্ণসংকরে এত ভয় কেন? কারণ চারটি। ঐতিহাসিক ভাবে চারশো বছরের বেশি কাল-সীমার মধ্যে পাঁচ ছটির বিদেশি আক্রমণ ঘটে এবং অনিবার্য ভাবে বর্ণসংকরের বিস্তার ঘটে, যার দ্বারা ধীরে ধীরে বৈদেশিকরা সমাজ জীবনে অনুপ্রবিষ্ট হয়— প্রথমে শূদ্র রূপে ও পরে বিজেতা বলে ক্ষত্রিয় রূপে। দ্বিতীয়ত, বর্ণসংকর ঘটলে ওই চতুর্বর্ণের পরিচ্ছন্ন একটা ছক, শাস্ত্রে ও সমাজে যা চলে আসছিল, সেটা এলোমেলো হয়ে যায়; সমাজপতিদের মিশ্রবর্ণ সম্বন্ধে নতুন আইন তৈরি করতে হয়। তৃতীয়ত, বৃত্তিভেদ অনুসারে বর্ণ ক্রমেই বহু বিভিন্ন ভাগ হয়ে গিয়েছিল এবং হয়ে চলছিল। তার ওপরে বিদেশি জাতির সঙ্গে মিলনে আরও বহুধা-বিভক্ত সমাজের ছক নির্মাণ ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছিল। চতুর্থত, বিদেশিদের প্রথমে শূদ্র বললেও যেহেতু তাঁরা বিজেতা এবং শক্তিমান, তাই ধীরে ধীরে তাঁরা ক্ষত্রিয়ত্বে উন্নীত হলেন। এই যে উচ্চতর বর্ণে অধিরোহণ, এটা শাস্ত্রকারদের অগ্রাহ্য মনে হয়েছিল। (লক্ষণীয় মহাভারত ৭:১৫৮:২০) এর পশ্চাতে ছিল কলিযুগ সম্বন্ধে আতঙ্ক, কারণ সব শাস্ত্রে কলিযুগের একটা প্রধান লক্ষণই হল বর্ণসংকর এবং কলিতে শূদ্র নিজের হীনত্ব মেনে নেবে না; সে যে শুধু উচ্চবর্ণের বৃত্তি অবলম্বন করবে তাই নয়, উচ্চবর্ণ সম্বন্ধে শ্রদ্ধাপোষণও করবে না। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের শেষেই এই আতঙ্কের প্রকাশ দেখি যুগপুরাণ-এ (শ্লোক ৫০, ৫৩, ৫৪)।