যুগসন্ধিকালের সমাজ ও সংস্কৃতি

যুগসন্ধিকালের সমাজ ও সংস্কৃতি

আগেকার সমাজে যে সকল কুপ্রথা ও অপপ্রথা ছিল, সেগুলো সবই যুগসন্ধিকালের সমাজেও বর্তমান ছিল। যথা, কৌলিন্যপ্রথা, বাল্যবিবাহ, শিশুহত্যা, সাগরমেলায় শিশু বিসর্জন, সতীদাহ, দেবদাসী প্রথা, দাসদাসীর কেনাবেচা ইত্যাদি। সমাজ সংগঠন ও জাতিবিন্যাসও আগেকার মতোই ছিল। কৌলিক বৃত্তি থাকা সত্ত্বেও বৎসরের তিনমাস সকল জাতির লোকই চাষাবাসে নিযুক্ত থাকত।

শস্যশ্যামলা এই পলিমাটির দেশ বাঙলায় ছিল ঋদ্ধির আকর। এখানেই উৎপন্ন হত, ধান্য, তুলা, রেশম, ইক্ষু, সরিষা প্রভৃতি তৈলবীজ। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসব কৃষিপণ্য বাঙলাদেশের প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হত। এসব পণ্যই বাঙলার কৃষকের সমৃদ্ধির কারণ ছিল। পরে বাঙালীরা এই কৃষি বনিয়াদের আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল, যার পরিণামে আজ আমাদের ইক্ষু ও সরিষার জন্য বিহার ও উত্তর-প্রদেশের মুখাপেক্ষী হতে হয়েছে। তুলার চাষের পরিবর্তে এখন পাটের চাষ হয়, যার ন্যায্য মূল্য বাঙালী কৃষক পায় না; কিন্তু যার মুনাফার সিংহভাগ অবাঙালীর উদর স্ফীত করে।

কৃষি ব্যতীত অষ্টাদশ শতাব্দীতে গ্রাম বাঙলার সমৃদ্ধির উৎস ছিল, নানারূপ শিল্প। অর্থনীতির দিক দিয়ে গ্রামগুলি ছিল স্বয়ম্ভর। গ্রামের লোকের দৈনন্দিন ব্যবহারের সামগ্রীসমূহ ও পালপার্বণে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসমূহ গ্রামের শিল্পীরাই তৈরি করত। তারাই ছিল আমাদের দেশের technologists. অর্থনীতির সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক একেবারে অঙ্গাঙ্গিভাবে গাঁটছড়া বাঁধা ছিল। সমাজ গঠিত হত যৌথ-পরিবারভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন জাতিসমূহকে নিয়ে। প্রতি জাতির একটা করে কৌলিক বৃত্তি ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত এই সকল কৌলিক বৃত্তি অনুসৃত হত। তারপর উনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই বাঙালী তার কৌলিক বৃত্তিসমূহ হারিয়ে ফেলে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর কৌলিক বৃত্তিধারী জাতিসমূহের বিবরণ আমরা সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য থেকে পাই। মোটামুটি যে সকল জাতি বাঙলাদেশে বিদ্যমান ছিল, তা সমসাময়িককালে অনুলিখিত এক মঙ্গলকাব্য যেভাবে বর্ণিত হয়েছে তা এখানে উদ্ধৃত করছি—”সদ্‌গোপ কৈবত আর গোয়ালা তাম্বুলি। উগ্রক্ষেত্রী কুম্ভকার একাদশ তিলি ॥ যোগী ও আশ্বিন তাঁতি মালী মালাকার। নাপিত রজক দুলে আর শঙ্খধর ॥ হাড়ি মুচি ডোম কলু চণ্ডাল প্রভৃতি। মাজি ও বাগদী মেটে নাহি ভেদজাতি ॥ স্বর্ণকার সুবর্ণবণিক কর্মকার। সূত্রধর গন্ধবেনে ধীবর পোদ্দার ॥ ক্ষত্রিয় বারুই বৈদ্য পোদ পাকমারা। পড়িল তাম্রের বালা কায়স্থ কেওরা ॥” এছাড়া, সকলের শীর্ষে ছিল ব্ৰাহ্মণ। এ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর পরিচয় পাওয়া যায়। তবে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলসমূহে ভিন্ন ভিন্ন জাতির প্রাধান্য ছিল। পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি প্রধান জেলায় কোন কোন জাতির কিরূপ প্রাধান্য ছিল, তা নীচের ছকে দেখানো হচ্ছে-

স্থানমেদিনীপুরহুগলীবর্ধমানবাঁকুড়াবীরভূম২৪ পরগনানদীয়া
প্ৰথমকৈবর্তকৈবর্তবাগদিবাউরিসদ্‌গোপপোদকৈবর্ত
দ্বিতীয়সদ্‌গোপবাগদিসদ্‌গোপব্রাহ্মণবাগদিকৈবর্তগোয়ালা
তৃতীয়ব্রাহ্মণব্রাহ্মণব্রাহ্মণতিলিব্রাহ্মণব্রাহ্মণব্রাহ্মণ
চতুর্থতাঁতীগোয়ালাগোয়ালাগোয়ালাডোমবাগদিচামার
পঞ্চমবাগদিসদ্‌গোপতিলিচামারবাউরিগোয়ালাচণ্ডাল

লক্ষণীয় যে পশ্চিম বাঙলার এই সমস্ত জেলাসমূহে সংখ্যাধিক্যের দিক দিয়ে কায়স্থদের প্রথম পাঁচের মধ্যে কোন জেলায় প্রাধান্য ছিল না। সমগ্ৰ পশ্চিম বাঙলার মোট জনসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের স্থান ছিল ছয়। প্রথম পাঁচ ছিল যথাক্রমে কৈবর্ত, বাগদি, ব্রাহ্মণ, সদ্‌গোপ ও গোয়ালা। আজ কিন্তু পরিস্থিতি অন্য রকম। তার কারণ, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষপাদে মহারাজ নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর ‘জাত কাছারী’ স্থাপন করে জাতি নির্বিশেষে অনেক জাতির লোককেই ‘কায়স্থ’ স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। পরে অনেক জাতের লোকই সামাজিক মর্যাদা লাভের জন্য নিজেদের ‘কায়স্থ’ বলে পরিচয় দিতে আরম্ভ করে। এটা নাগরিক জীবনের পরিণাম মাত্র। কেননা, নগরবাসীরা আগন্তুকের কুলশীল সম্বন্ধে কেউই কিছু জানত না। সুতরাং আগন্তুকের জাত যাচাই করবার কোন উপায় ছিল না। গ্রামের লোকরা সকলেই সকলকে চিনত। সেজন্য সেখানে জাত ভাঁড়াবার কোন উপায় ছিল না। গ্রামের লোকরা হয় নিজের গ্রামে, আর তা নয় তো নিকটের গ্রামেই বিবাহ করত। এই বৈবাহিক সূত্রে এক গ্রামের লোক নিকটস্থ অপর গ্রামের লোকেরও জাত জানত।

অষ্টাদশ শতাব্দীর গ্রামবাঙলায় এই সকল হিন্দুজাতি ছাড়া, ছিল, আদিবাসীরা। মেদিনীপুরের আদিবাসীদের মধ্যে প্রধান আদিবাসী ছিল সাঁওতাল, লোধা ও হো। বাঁকুড়ায় আদিবাসীদের মধ্যে ছিল কোরা, ভূমিজ, মাহালি, মেচ, মুণ্ডা, সাঁওতাল ও ওরাওঁ। সকলের চেয়ে বেশি আদিবাসী ছিল বীরভূমে, প্রায় সবাই সাঁওতাল। রাজশাহীর আদিবাসীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে ছিল কম। এখানকার প্রধান আদিবাসী ছিল মুণ্ডা, সাঁওতাল, ওরাওঁ প্রভৃতি। সাঁওতালদের ৭৩.৭৩ শতাংশ বাস করত মেদিনীপুর পুরুলিয়া, বর্ধমান বাঁকুড়া, বীরভূম ও হুগলি জেলায়। বাকী অংশ বাস করত পশ্চিম দিনাজপুর, মালদহ ও জলপাইগুড়ি জেলায়। মুণ্ডারা অধিক সংখ্যায় (৬০.১৮ শতাংশ) বাস করত জলপাইগুড়ি ও চব্বিশ পরগনা জেলায়। বাকী ৩৯.৮২ শতাংশ বাস করত অন্য জেলাসমূহে। ওঁরাওদের ৮৯.০৪ শতাংশ বাস করত জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিম দিনাজপুর ও চব্বিশ পরগনায়। সমষ্টিগতভাবে পশ্চিমবাঙলার আদিবাসীদের মধ্যে ৯০.১৫ শতাংশ ছিল সাঁওতাল, ওরাওঁ, মুণ্ডা, ভূমিজ, কোরা ও লোধা। তবে সাঁওতালরাই ছিল বাঙলার আদিম অধিবাসী। কিংবদন্তী অনুযায়ী তাদের জন্মস্থান মেদিনীপুরের সাঁওতা পরগনায়।

দুই

কিন্তু এই সময় থেকেই বাঙালীর গ্রামীণ জীবনচর্যার ওপর আঘাত হানতে শুরু করেছিল নাগরিক সমাজ। এই নাগরিক সমাজের সূচনা হয়েছিল, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে কলকাতা শহরে এক অভিজাত শ্রেণির অভ্যুত্থানে। এদের উদ্ভব ঘটেছিল ইংরেজের বেনিয়ানী, দাওয়ানী ও দালালী করে। প্রথম প্রথম যাঁরা কলকাতা শহরে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন তাঁরা গ্রামীণ আচার-বিচার ও শাস্ত্রের বিধানসমূহ মেনে চলতেন। কিন্তু শতাব্দীর মধ্যাহ্নের পর যখন রাজা নবকৃষ্ণ দেব রাসপল্লীতে (পরেরকার নাম শোভাবাজার) এসে বসতি স্থাপন করলেন তখন বাঙালীর সমাজজীবন এক নতুন রূপ ধারণ করল। হিন্দুর পালপার্বণে যেখানে ব্রাহ্মণ এবং আত্মীয় ও স্বজনবর্গ নিমন্ত্রিত হত, মহারাজ নবকৃষ্ণ দেব সাহেবদের অনুগ্রহলাভের জন্য তাদের সঙ্গে যোগ করে দিলেন সাহেব মেমদের। পূজাবাড়িতে তখন প্রবেশ করল বিদেশী সুরা ও নিষিদ্ধখানা। সঙ্গে সঙ্গে আরও প্রবেশ করল যবনী নর্তকীর দল। সাহেবদের অনুগ্রহলাভের জন্যও আরও পাঁচজন বড়লোক নবকৃষ্ণকে অনুসরণ করল। শহরে এক নতুন অভিজাত সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে যখন জমিদার সমূহ নিলাম হতে লাগল, তখন এঁরাই কিনলেন সেসব জমিদারী। এঁদের বংশধররা রাত্রিতে নিজ গৃহে থাকা আভিজাত্যের হানিকর মনে করল। রাত্রিটা রক্ষিতার গৃহেই কাটাতে লাগল। এদের জীবনযাত্রা প্রণালী গ্রামীণ সমাজ খুব কুটিল দৃষ্টিতে দেখল, যা উনবিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘কলিকাতা কমলালয়’ ও অন্যান্য গ্রন্থে চিত্রিত করলেন। শহরের অভিজাত শ্রেণির এই জীবনযাত্রা প্রণালী কিন্তু সাধারণ লোককে প্রভাবান্বিত করল না। সাধারণ লোক ও অভিজাত সম্প্রদায়ের অন্দরমহল নিষ্ঠাবান ও গ্রামীণ সংস্কৃতিরই ধারক হয়ে রইল। এটা আমরা সমসাময়িক ইউরোপীয় শিল্পীদের আঁকা ছবি থেকে জানতে পারি। এঁরা হচ্ছেন টমাস ড্যানিয়েল, উইলিয়াম ড্যানিয়েল, সলভিনস ও সিম্পসন। এইসব শিল্পরা অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে এদেশে এলেও গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে তুলে ধরেছেন আমাদের সামাজিক জীবন, ধর্মীয় উৎসব ও রীতিনীতির প্রতিচ্ছবি।

তিন

এবার আমরা সন্ধিক্ষণের সমাজে গ্রামীণ শিক্ষাদীক্ষা ও সাহিত্যসাধনা সম্বন্ধে কিছু বলব। সর্বজনীন স্তরে অষ্টাদশ শতাব্দীর সমাজে শিক্ষাবিস্তারের মাধ্যমে ছিল হিন্দুদের পাঠশালা ও মুসলমানদের মক্তাব। এছাড়া ছিল কথকতা, গান, যাত্রাভিনয় ও পাঁচালী গান, যার মাধ্যমে হিন্দুরা পৌরাণিক কাহিনীসমূহের সহিত পরিচিত হত। হিন্দুদের ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম ছিল চতুষ্পাঠীসমূহ। চতুষ্পাঠীসমূহ পরিচালনা করতেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ। চতুষ্পাঠীসমূহে নানা শাস্ত্রের শিক্ষা দেওয়া হত। নব্যন্যায়ের ও স্মৃতিশাস্ত্রের অধ্যাপনা বাঙলার চতুষ্পাঠীসমূহের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। তবে যে মাত্র নব্যন্যায় ও স্মৃতিশাস্ত্রেরই অনুশীলন হত, তা নয়। জ্যোতিষ, আয়ুর্বেদ, কোষ, নাটক, গণিত, ব্যাকরণ, ছন্দোসূত্র প্রভৃতি ও দণ্ডী ভারবি, মাঘ, কালিদাস প্রমুখদের কাব্যসমূহ এবং মহাভারত, কামন্দকী-দীপিকা, হিতোপদেশ প্রভৃতি পড়ানো হত। এছাড়া, তাঁরা সমাজকে দিতেন পাঁতি। পঞ্জিকার তথ্যও চতুষ্পাঠীতে পাওয়া যেত।

চতুষ্পাঠীসমূহের শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র ছিল নবদ্বীপ। শাস্ত্র অনুশীলন, অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার জন্য নবদ্বীপের বিশেষ প্রসিদ্ধি ছিল। এই প্রসিদ্ধির জন্যই নবদ্বীপকে বাঙলার ‘অকস্ফোর্ড’ বলে অভিহিত করা হত। তবে নবদ্বীপ ছাড়া আরও যে সব কেন্দ্র ছিল, তা হচেছ পশ্চিমবঙ্গে ত্রিবেণী, ভট্টপল্লী, বর্ধমান, নদীয়া, গুপ্তিপাড়া, কুমারহট্ট, গোন্দলপাড়া, জয়নগর- মজিলপুর, খাটুয়া, হুগলি, বালী ও আন্দুল এবং পূর্ববঙ্গে কোটালিপাড়া, ফরিদপুর, বাকলা ও ত্রিপুরা। এ সব জায়গায় পণ্ডিতগণ স্বনামধন্য ছিলেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষ করে নাম করা যেতে পারে নবদ্বীপের শঙ্কর তর্কবাগীশ, গোকুলানন্দ, বিদ্যামণি ও শ্রীকৃষ্ণ তর্কালঙ্কার, ত্রিবেণীয় জগন্নাথ, তর্কপঞ্চানন, বর্ধমানের দুলাল তর্কবাগীশ, গুপ্তিপাড়ার, বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, খাটুয়ার, অনন্তরাম বিদ্যাবাগীশ, নদীয়ার, জয়গোপাল তর্কালঙ্কার ও রামভদ্র সার্বভৌম, জয়রাম ন্যায়পঞ্চানন ও কৃষ্ণরাম ভট্টাচার্য ও হুগলীর কুলাবধূত হরিহরানন্দ তীর্থস্বামী প্রমুখদেব। পূর্ববঙ্গের কোটালিপাড়ার প্রখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন কৃষ্ণনাথ সার্বভৌম, ফরিদপুরের চন্দ্রনারায়ণ ন্যায়পঞ্চানন, ত্রিপুরার কালীকচ্ছের দয়ারাম ন্যায়ালঙ্কার ও বরিশালের বাকলার জগন্নাথ পঞ্চানন ও কৃষ্ণানন্দ সার্বভৌম। কৃষ্ণানন্দ সার্বভৌম বিচিত্র বিধান দিতেন। তিনিই শারদীয়া পূজার নবমীর দিনই দুর্গা প্রতিমার বিসর্জনের বিধান দিয়েছিলেন। তা থেকেই ‘কৃষ্ণানন্দী দশহরা’ প্রবাদবাক্য দাঁড়িয়েছে।

পণ্ডিতদের মধ্যে অনেকেই ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন। তার কারণ ইংরেজ যখন দেশের শাসক হল, তখন দেওয়ানী আদালতে এদেশের বিধান সম্বন্ধে পরামর্শ দেবার জন্য বিচারকরা পণ্ডিতদের আহ্বান করতেন। সেজন্য, কার্যোপযোগী একখানা ব্যবস্থাপুস্তক সংকলন করবার প্রথম আয়োজন করেন ওয়ারেন হেষ্টিংস। এগার জন পণ্ডিতকে দিয়ে এরূপ একখানা ব্যবস্থাপুস্তক তৈরি করে, সেখানা প্ৰথম ফারসীতে ও পরে হ্যালহেডকে দিয়ে ইংরেজিতে অনুবাদ করিয়ে নাম দেন, ‘জেন্টু, কোড’। কিন্তু দু’বার অনুবাদ হওয়ার ফলে বইখানা কোন কাজের বই হল না। তখন মিথিলার পণ্ডিত সর্বরী ত্রিবেদীকে দিয়ে ‘বিবাদ সারার্ণব’ নামে একখানা বই সংকলন করান। কিন্তু সেটাও মনঃপূত না হওয়ায় ত্রিবেণীয় প্রখ্যাত পণ্ডিত তর্কপঞ্চাননকে দিয়ে ‘বিবাদ ভঙ্গার্ণব’ নামে একখানা বই সংকলন করান। এখানাই গৃহীত হয় এবং কোল ক সাহেব এখানার তর্জমা করে নাম দেন ‘A Digest of Hindu Law’. জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননই সে যুগের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ছিলেন। ১১৪ বছর পর্যন্ত (১৬৯৪- ১৮০৭) জীবিত থেকে তিনি তাঁর অনন্য সাধারণ পাণ্ডিত্যের খ্যাতি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অম্লান রেখেছিলেন। (এই সময়ের পণ্ডিত সমাজের বিস্তৃত বিবরণের জন্য লেখকের ‘আঠারো শতকের বাঙলা ও বাঙালী” পৃ. ১০০-১০৩, ১০৪-১১৭ ও ‘কলকাতা : এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস’ পৃষ্ঠ ১৭৭- ১৯৩ দ্রষ্টব্য)।

চার

পণ্ডিতগণ কর্তৃক শাস্ত্র অনুশীলন ও সংস্কৃত ভাষায় প্রামাণিক টীকা-টিপ্পনী রচনা ছাড়া অষ্টাদশ শতাব্দী উদ্ভাসিত হয়ে আছে বাংলা সাহিত্যচর্চার আলোকে। সুধীজন নতুন নতুন কাব্য রচনা করেছিলেন, এবং এ বিষয়ে শতাব্দীর মধ্যাহ্ন পর্যন্ত অনেকেই সমসাময়িক রাজারাজড়াদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। কর্ণগড়ের রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় রামেশ্বর ভট্টাচার্য রচনা করেছিলেন ‘শিবায়ন’ বিষ্ণুপুররাজ’ গোপাল সিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় শঙ্কর কবিচন্দ্র রচনা করেছিলেন। ‘রামায়ণ’ ‘মহাভারত’ ‘গোবিন্দমঙ্গল’ ও ‘কৃষ্ণমঙ্গল’ বর্ধমানরাজ কীর্তিচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ঘনরাম চক্রবর্তী রচনা করেছিলেন ‘ধর্মমঙ্গল’, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পৃষ্ঠপোষকতার ভারতচন্দ্র রচনা করেছিলেন ‘অন্নদামঙ্গল’ পঞ্চকুটাধিপতি রঘুনাথ সিংহের আদেশে জগদ্রাম রায় রচনা করেছিলেন ‘অদ্ভূত রামায়ণ’ ও মেদিনীপুরের কাশীজোড়াধিপতি রাজনারায়ণের পৃষ্ঠপোষকতায় নিত্যানন্দ (মিশ্র) চক্রবর্তী রচনা করেছিলেন ‘শীতলামঙ্গল’ ‘লক্ষ্মীমঙ্গল’ ইত্যাদি।

শতাব্দীর শেষের দিক পর্যন্ত মঙ্গলকাব্য ও অনুবাদকাব্যের ধারা অব্যাহত দেখি। মাণিক গাঙ্গুলি, রামকান্ত ও গোবিন্দরাম রচনা করেছিলেন তিনখানা ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্য ও রামপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করেছিলেন, ‘রামায়ণ; নিধিরাম কবিচন্দ্র রচনা করেছিলেন সংক্ষিপ্ত ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’, শচীনন্দন ‘উজ্জ্বল নীলমণি’ জয়নারায়ণ ঘোষাল পদ্মপুরাণের কাশ্মীখন্ড ও গোলকনাথ দাস ইংরেজি Disguise নাটকের বাংলা অনুবাদ।

এ ছাড়া বৈষ্ণব ও শাক্ত পদাবলী সাহিত্য রচনার জন্যও অষ্টাদশ শতাব্দী বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। আরও এ শতাব্দীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পালাগান রচনার প্রাচুর্য। পালাগান রচয়িতাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন শ্রীকৃষ্ণকিঙ্কর। তাঁর রচিত মনসামঙ্গল, শীতলামঙ্গল, শীতলার জাগরণপালা প্রভৃতি পালাগানগুলি এক সময় মেদিনীপুর ও হাওড়া জেলার গ্রামাঞ্চলে খুব জনপ্রিয় ছিল।

অষ্টাদশ শতাব্দীর সাহিত্যধারার পাশে আর এক সাহিত্যধারার সৃষ্টি হয়েছিল। এটা হচ্ছে কবিওয়ালাদের গান। প্রসিদ্ধ কবিওয়ালদের মধ্যে ছিলেন রঘুনাথ দাস, রাসুনৃসিংহ, নীলমণি ঠাকুর, গোঁজলা, গুঁই নিত্যানন্দ বৈরাগী, নৃসিংহ রায়, বলাই বৈষ্ণব, ভবানী বণিক, ভোলা ময়রা, এন্টনী ফিরিঙ্গি ও হরুঠাকুর।

সঙ্গীতের ক্ষেত্রে অষ্টাদশ শতাব্দীর বিশেষ অবদান ছিল বিষ্ণুপুর ঘরানার উদ্ভব। এটা ধ্রুপদেরই একটা বিশেষ ঘরানা। আঠারো শতকের শেষের দিকে রামশঙ্কর ভট্টাচার্য ছিলেন এই ঘরানার বিখ্যাত গায়ক।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে টপ্পাগানের গায়ক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন নিধুবাবু বা রামনিধি গুপ্ত। শ্যামাসঙ্গীত অদ্বিতীয় ছিলেন হালি শহরের শক্তিসাধক ও কবি রামপ্রসাদ সেন। তাঁর গীতভঙ্গি ‘রামপ্রসাদী সুর’ নামে পরিচিত। রামপ্রসাদী গান একসময় বাঙলার লোককে মাতিয়ে রেখেছিল।

এছাড়া, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বাংলা গদ্য লেখবার একটা রীতিও ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল। বিশেষ করে আইন পুস্তকের তর্জমায়। ১৭৮৪-৮৫ সালে জোনাথান ডানকান চারখানা বই প্রকাশ করেন, ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে জর্জ চার্লস মেয়ার আরও চারখানা, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে জর্জ ফ্রেডেরিক চেরী একখানা, ১৭৯০-৯২ খ্রিস্টাব্দে এডমনস্টোন দু’খানা আর ১৭৯৫ থেকে ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে হেনরি পিটস্ ফরস্টার ১৪ খানা। এটা বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করেছিল উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে। আমরা পরে দেখব যে উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগৃতির সার্থক রূপায়ণে গদ্যসাহিত্যই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছিল (আঠারো শতকের রচিত বাংলা গদ্যগ্রন্থসমূহের জন্য লেখকের ‘আঠারো শতকের বাঙলা ও বাঙালী’ পৃষ্ঠা- ১৩২-১৩৩ দেখুন)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *