যুগল

যুগল

“আহ-হা, দেরি হয়ে গেছে,” বিড়বিড়িয়ে বললো যুবক। “আমাকে উঠতে হবে এখন।” তার আচরণেই স্পষ্ট যে কোনোমতে এখান থেকে উঠে যেতে পারলেই বাঁচে।

“তাই!” সামনে বসে থাকা যুবতি বললো। দৃষ্টিতে অনিশ্চয়তা খেলা করছে তার। এখন অবধি যুবক অবশ্য বলেনি যে তাদের মধ্যে সবকিছু পুরোপুরি চুকেবুকে গেছে। কিন্তু তিন বছরের প্রেমিকাকে আজ সে ডেকে পাঠিয়েছিল কিছু ‘গুরুত্বপূর্ণ কথা’ বলবার জন্য। আলাপের এক পর্যায়ে হঠাৎই সে জানায় যে চাকরির খাতিরে মার্কিন মুল্লুকে পাড়ি জমাতে হবে। খুব বেশি সময়ও নেই হাতে। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ছেড়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্রগামী ফ্লাইট। ততক্ষণে মেয়েটা বুঝে গেছে যে কথাবার্তা কোনদিকে এগোচ্ছে। নিশ্চয়ই ব্রেকআপের কথা বলবে বলেই আজ এখানে নিয়ে এসেছে তার প্রেমিক। অথচ ও কি না আশায় বুক বেঁধেছিল যে ‘গুরুত্বপূর্ণ কথা’ বলতে হয়তো বিয়ে সংক্রান্ত কিছু বুঝিয়েছিল সে।

“কী?” শুকনো কণ্ঠে বললো যুবক। এখনো তার চোখে চোখ রাখছে না।

“শুধু এটুকুই বলার আছে তোমার?” জিজ্ঞেস করলো ও।

যুবতি জানে যে এভাবে প্রশ্নের সুরে কথা বলাটা পছন্দ করে না তার প্রেমিক। এই মুহূর্তে বেইজমেন্টের একটা ক্যাফেতে বসে আছে ওরা দুজন। আলোর উৎস বলতে সিলিং থেকে ঝুলন্ত ছ’টা ল্যাম্প এবং প্রবেশপথের কাছে ছোট্ট একটা ঝাড়বাতি। ভেতরের সবকিছুতেই বয়সের ছাপ। পুরানো দিনের ছবির মতোন কালচে বাদামি আভা চারদিকে। ঘড়ি ছাড়া ভেতরে সময় বোঝার কোনো উপায় নেই।

ক্যাফের একপাশে তিনটা বিশাল অ্যান্টিক দেওয়ালঘড়ি ঝোলানো। প্রত্যেকটা ঘড়ি আবার ভিন্ন ভিন্ন সময় দেখাচ্ছে। ব্যাপারটা কী ইচ্ছাকৃত? নাকি ঘড়িগুলোয় সমস্যা আছে? প্রথমবার আগত খদ্দেরদের এই ধাঁধার জবাব পেতেই সময় লেগে যায় অনেকক্ষণ। অগত্যা নিজেদের হাতঘড়ির ওপরেই ভরসা করতে হয় তাদের। লোকটাও সেই পথেই হাঁটলো। ঘড়ির ডায়ালে চোখ দিয়ে আরেক হাতের আঙুলগুলো নিয়ে এলো ডান ভ্রুর উপরে। নীচের ঠোঁটটা কাঁপছে তিরতির করে।

অন্য সময় দৃশ্যটা যুবতির মনে মায়ার উদ্রেক ঘটালেও আজ বিরক্তিকর ঠেকছে সবকিছু। “তোমার চেহারা দেখে কিন্তু সবাই ভাববে আমি বুঝি তোমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছি,” বললো সে।

“আরে না, আমি অমন কিছু ভাবছি না,” লজ্জিত স্বরে বললো লোকটা।

“ভাবছো!”

আবারো আগের ভঙ্গিতে কথাটা এড়িয়ে গেল যুবতির প্রেমিক। দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে রেখেছে। তার এরকম উদাসীন ভাবভঙ্গি বেচারির রাগে যেন ঘি ঢালছে। “তুমি তাহলে চাইছো আমার মুখ থেকে কথাটা শুনতে?”

কফির কাপে হাত রাখলো সে। একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে। গরম কফিতে চুমুক দেওয়ার সুযোগ হারিয়ে মেজাজের আরো অবনতি হলো যুবতির।

আরো একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মনে মনে ফ্লাইট ছেড়ে যেতে কতক্ষণ সময় বাকি, সেই হিসেব কষে নিলো যুবক। ঠিক সময়মতো পৌঁছাতে চাইলে খুব দ্রুত ক্যাফে ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে তাকে। নিজেকে সামলানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে আবারো ডান হাতের আঙুলগুলো কপালের কাছে নিয়ে এলো সে। এটা তার একটা মুদ্রাদোষ।

প্রেমিকের বারবার সময় দেখা বিরক্তির পরিমাণ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়িয়ে দিচ্ছে যুবতির। প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত শব্দ করে কাপটা নামিয়ে রাখলো সে পিরিচের উপরে।

চমকে গেল যুবক। কিছুক্ষণ আগেও ডান ভ্রুর উপরে থাকা আঙুলগুলো এখন শোভা পাচ্ছে চুলের মাঝে। বিভ্রান্ত অবস্থায় চুল টানার অভ্যাস তার দীর্ঘদিনের। কিন্তু এরপরেই বদলে গেল চিত্রপট। লম্বা একটা শ্বাস টেনে যুবতির চোখে চোখ রাখলো সে। খানিক আগের বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠেছে পুরোপুরি। চেহারা একদম শান্ত।

প্রেমিকের মুখভঙ্গির আকস্মিক এই পরিবর্তনে রীতিমতো হকচকিয়ে গেল যুবতি। চোখ নামিয়ে নিজের কোলের উপরে দৃষ্টি স্থাপন করলো।

যুবক অবশ্য পরবর্তী কথাগুলো বলার জন্য আর অপেক্ষা করলো না। তাড়া আছে তার। “আসলে, দেখো…”

এখন আর বিড়বিড় করছে না সে। নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে।

“কিছু বলতে হবে না। তুমি চলে যাও,” যুবকের কথা শেষ হবার আগেই বলে উঠলো যুবতি। চোখজোড়া এখনো নামিয়ে রেখেছে সে।

কে বলবে যে এতক্ষণ সে-ই কি না প্রেমিকের মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে ছিল? স্থাণুর মতো বসে আছে যুবক। দেখে মনে হবে যেন সময় থমকে গেছে।

“তোমার তো এখন যেতে হবে, তাই না?” বাচ্চাদের মতো অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললো যুবতি।

জবাবে বিস্মিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো যুবক, যেন বুঝতে পারছে না প্রেমিকা কী বলছে।

যুবতি জানে তার কথাগুলো কতটা ঠুনকো শোনাচ্ছে। সেজন্যেই বোধহয় অন্যদিকে তাকিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে বেগ পেতে হচ্ছে ভীষণ। চেয়ার ছেড়ে উঠে কাউন্টারের পেছনে দাঁড়ানো ওয়েট্রেসের উদ্দেশ্যে হাত নাড়লো যুবক।

“এক্সকিউজ মি, আমাদের বিলটা দিয়ে দিতে চাইছি এখনই,” ক্ষীণকণ্ঠে বললো সে। এরপর টেবিলে রাখা বিলের কাগজটা উঠিয়ে নিতে গিয়ে দেখলো যুবতি সেটা হাত দিয়ে চেপে রেখেছে।

“আমি আরো কিছুক্ষণ থাকবো…যাবার সময় আমিই বিল দিয়ে দিব,” কিন্তু তাকে কথা শেষ করতে দিলো না যুবক। বিলের কাগজটা টান দিয়ে ছুটিয়ে নিলো সহজেই। হাঁটা দিলো ক্যাশ রেজিস্টারের দিকে।

“হ্যাঁ, একসাথে বিল হবে।”

“বললাম তো আমি দিয়ে দিব।”

চেয়ার থেকে না উঠেই যুবকের উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিলো যুবতি। কিন্তু তার কথা যেন কানেই ঢুকছে না যুবকের। চেয়ার ছেড়ে ওঠার পর এখন অবধি একবারের জন্য তাকায়নি পর্যন্ত। ওয়ালেট থেকে এক হাজার ইয়েনের একটা নোট বের করলো সে।

“বাকিটা আপনি রেখে দিন,” বিলের কাগজ এবং নোটটা ওয়েট্রেসের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো যুবক। এরপর বিষাদগ্রস্ত চোখে প্রেমিকার দিকে একঝলক তাকিয়ে ব্যাগটা উঠিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল ক্যাফে থেকে।

“…এটা এক সপ্তাহ আগের ঘটনা,” এটুকু বলেই একদম ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল ফুমিকো কিয়োকাওয়া। মাথা নামিয়ে এনেছে টেবিলের ওপরে। কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে বেঁচে গেল কফির কাপটা।

কাউন্টারে মুখোমুখি বসে এতক্ষণ ফুমিকোর গল্প শুনছিলো ওয়েট্রেস আর এক কাস্টমার। একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো তারা।

সিনিয়র হাইস্কুলের গণ্ডি পেরুবার আগেই ছয়টা ভাষায় কথা বলতে এবং লিখতে শেখে ফুমিকো। নিজ ক্লাসের সেরা ছাত্রী হিসেবে পাশ করে ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটি থেকে। চাকরি পেতেও খুব বেশি সময় লাগেনি। টোকিওর নামকরা একটি মেডিক্যাল আইটি ফার্মে যোগ দেয়। চাকরিতে দুই বছর শেষ হবার আগেই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টের দায়িত্ব অর্পিত হয় তার কাঁধে। ক্যারিয়ার সচেতন তিলোত্তমা নারীর এক জলজ্যান্ত প্ৰতিমূৰ্তি ফুমিকো।

আজকে তার পরনে সাধারণ অফিসের পোশাক। সাদা ব্লাউজ, কালো স্কার্ট এবং জ্যাকেট। সবকিছু বিবেচনায় এটা স্পষ্ট যে কাজ থেকে বাড়ি ফিরছিল সে।

ফুমিকোকে বেশ সুন্দরীই বলা চলে। কমনীয় দেহসৌষ্ঠব এবং চিকন ঠোঁটজোড়া যে-কোনো পপ আইডলের কথা মনে করিয়ে দেবে। ঘনকালো চুলগুলো খুব বেশি লম্বাও নয়, আবার খাটোও নয়। এতেই মানিয়ে গেছে তাকে। সাধারণ পোশাকেও তার দারুণ ফিগার নজর কাড়বে যে কারো। যেন ফ্যাশন ম্যাগাজিন থেকে উঠে আসা কোনো মডেল। ইংরেজিতে একেই বলে ‘বিউটি উইথ ব্রেইন’। তবে নিজের সম্পর্কে সে ঠিক কী রকম ধারণা পোষণ করে তা একটা রহস্য বটে।

অতীতে ফুমিকো কখনো হৃদয়ঘটিত কোনো ব্যাপারে এভাবে ভেঙে পড়েনি। কাজই ছিল তার জীবনের একমাত্র জিয়নকাঠি। তার মানে এই নয় যে প্রেম পা রাখেনি ওর জীবনে। কিন্তু কাজকেই সবসময় প্রাধান্য দিয়েছে। কাজই আমার প্রেমিক-প্রায়শই ঠাট্টাচ্ছলে বলতো ফুমিকো। অনেক পুরুষের নিবেদন বিনা বাক্যব্যয়ে নাকচ করে দিয়েছে। মানুষ যেভাবে টোকা দিয়ে কাপড় থেকে ধুলো পরিষ্কার করে, সেভাবে।

যে যুবকের ব্যাপারে এতক্ষণ কথা বলছিল সে, তার নাম গোরো কাতাডা। গোরো একজন সিস্টেমস ইঞ্জিনিয়ার। ফুমিকোর মতোনই এক মেডিক্যাল কোম্পানিতে চাকরি করত সে। অবশ্য সেই কোম্পানিটার খুব বেশি নামডাক ছিল না।

গোরো ফুমিকোর প্রাক্তন প্রেমিক। হ্যাঁ, প্রাক্তন। বয়সে সাবেক প্রেমিকার চাইতে তিন বছরের ছোটো সে। দুই বছর আগে একটা ক্লায়েন্টের প্রজেক্টে একসাথে কাজ করার সময় পরিচয় হয় দুজনার।

এক সপ্তাহ আগে ফুমিকোকে ফোন দিয়ে গোরো বলে যে ‘গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে’। দামি একটা হালকা গোলাপি রঙের ড্রেস আর নীল স্প্রিং কোট পরে ক্যাফেতে আসে ফুমিকো। পথে বিপরীত লিঙ্গের সবাই যে তার দিকে তাকিয়ে আছে, এটা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি। এভাবে অবশ্য আগে কখনো সাজেনি ফুমিকো। সে এতটাই কাজপাগল যে গোরোর সাথে দেখা হওয়ার আগে তার কোনো পার্টি ড্রেস কিংবা স্প্রিং ড্রেসই ছিল না। ক্লোজেট ভর্তি থাকতো কেবল কাজে যাওয়ার স্যুট আর শার্টে। প্রথম দিকে গোরোর সাথে কাজ শেষে ডেটে যাওয়ার সময়েও স্যুট পরতো ফুমিকো।

‘গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে’-গোরোর এই কথাটা শুনে সে ভাবে যে প্রেমিকপ্রবর নিশ্চয়ই এবারে বিশেষ কথাটা বলবে। খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে তাই নতুন একটা ড্রেসই কিনে ফেলে ফুমিকো।

কোন ক্যাফেতে দেখা করবে সেটাও আগে থেকে ঠিক করে নেয় ওরা। ক্যাফেটার ভেতরে সব প্রাইভেট বুথ হওয়াতে একান্ত কথা বলার জন্য একদম আদর্শ। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে ক্যাফের সামনে গিয়ে ওরা দেখতে পায় ‘অনিবার্য কারণবশত’ ক্যাফে বন্ধ। অগত্যা নতুন জায়গা খুঁজতে বের হয় দুজনে। কিছুক্ষণ পর সুনসান একটা রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ে ফুমিকোর। ক্যাফেটা বেইজমেন্টে অবস্থিত হওয়াতে বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। কিন্তু ফুমিকোর কাছে ক্যাফের নামটা ভালো লেগে যায়। তার ছেলেবেলার একটা গানের লাইন থেকে নাম পছন্দ করেছে ক্যাফে মালিক। গোরোও আপত্তি জানায়নি।

কিন্তু ভেতরে পা রেখেই প্রমাদ গুণতে শুরু করে ফুমিকো। যেরকম ভেবেছিল, ক্যাফেটা সেই তুলনায় অনেক ছোটো। বসার ব্যবস্থা বলতে একটা মাঝারি সাইজের কাউন্টারের তিনটা চেয়ার আর ছোটো ছোটো তিনটা টেবিল। টেবিলগুলোয় কেবল দুজন কাস্টমার মুখোমুখি বসতে পারবে। অর্থাৎ নয়জন কাস্টমার হলেই আর কারো বসার জায়গা থাকবে না।

গুরুত্বপূর্ণ কথাটা ফিসফিস করে না বললে গোটা ক্যাফের সবাই সহজেই শুনতে পাবে। আরেকটা বিষয় যেটা ফুমিকোর পছন্দ হয়নি, গোটা ক্যাফেতেই কম পাওয়ারের শেডেড ল্যাম্পের কারণে জীর্ণ একটা ভাব। ওর রুচির সাথে এটা একদমই যায় না।

বিশেষ কোনো কথা বলার জন্য আদর্শ জায়গা নয় মোটেও। বরং যারা নিচু গলায় আলাপ করতে পছন্দ করে, তাদের জন্য চলনসই।

প্রথম দেখায় ক্যাফেটা সম্পর্কে এরকম ধারণাই হয়েছিল ফুমিকোর। একমাত্র খালি টেবিলটায় গিয়ে মুখোমুখি বসে ওরা। সেই সময়ে আরো তিনজন কাস্টমার এবং একজন ওয়েট্রেস ছিল সেখানে।

সবচেয়ে দূরবর্তী টেবিলটায় বসে মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছিল এক মাঝবয়সি মহিলা, পরনে সাদা রঙের খাটো হাতার জামা। দরজার সবচেয়ে কাছের টেবিলটায় বসে একমনে ট্রাভেল ম্যাগাজিন থেকে মেমোতে কী যেন টুকে নিচ্ছিল বোকাটে চেহারার একটা লোক। আর কাউন্টারের উলটো পাশে বসে থাকা কাস্টমারের পরনে ছিল উজ্জ্বল লাল রঙের ক্যামিজোল আর সবুজ লেগিংস। তার চেয়ারের পেছনে একটা স্লিভলেস কিমোনো জ্যাকেট ঝুলতে দেখে ফুমিকো। মহিলার মাথায় বেশ কয়েকটা কার্লার গোঁজা। এক মুহূর্তের জন্য ওদের দিকে তাকিয়ে দরাজ একটা হাসি উপহার দেয় সে। পরবর্তীতে ফুমিকো এবং গোরোর কথোপকথন চলার সময়ে বেশ কয়েকবার ওয়েট্রেসের উদ্দেশ্যে কিছু একটা বলে হেসে ওঠে।

.

“ওহ আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি,” ফুমিকোর কথা শেষ হলে বললো মাথায় কার্লার গোঁজা মহিলা।

আদতে কিছুই বোঝেনি সে। কেবল ভদ্রতার খাতিরে কিছু একটা বলতে হবে দেখে বলেছে। নাম তার ইয়াইকো হিরাই। ক্যাফের নিয়মিত কাস্টমারদের একজন। কয়েক দিন আগে ত্রিশে পা দিয়েছে। কাছেই একটা ইজাকায়া (জাপানিজ স্থানীয় পাব বা বার) চালায় সে। নিজেই সেখানকার হোস্টেসের দায়িত্ব পালন করে। কাজ শুরু করার আগে প্রতিদিন এখানে কফি খেতে আসে হিরাই। মাথা থেকে কার্লারগুলো এখনো খোলেনি সে। তবে আজ তার পরনে হলুদ রঙের টিউব টপ, লাল শর্টস্কার্ট আর বেগুনি লেগিংস। এতক্ষণ পা ভাঁজ করে চেয়ারে বসে ফুমিকোর কথা শুনছিল সে।

“এটা তো এক সপ্তাহ আগের কথা, ভুলে গেছেন?” সোজা হয়ে কাউন্টারের পেছনে দাঁড়ানো ওয়েট্রেসের দিকে তাকিয়ে বললো ফুমিকো।

“ইয়ে মানে…হ্যাঁ,” অস্বস্তিভরা কণ্ঠে জবাব দিলো ওয়েট্রেস। চোখ নামিয়ে রেখেছে।

ওয়েট্রেসের নাম কায়ু তোকিতা। এই ক্যাফের মালিকের কাজিন। এখানে পার্টটাইম ওয়েট্রেসের চাকরির পাশাপাশি টোকিও চারুকলা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। কায়ুর চেহারা মিষ্টি। গায়ের রং ফরসা, সরু অ্যালমন্ড আকৃতির চোখ। তবুও তার চেহারা খুব বেশি মানুষের মনে থাকে না। আসলে এই ধাঁচের মুখশ্রী দেখার পর চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় এই বুঝি স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেল। ভিড়ে খুব সহজেই মিশে যেতে পারে কায়ু, কারো নজর না কেড়েই। কোনো জটলায় আলাদাভাবে তার উপস্থিতিও টের পাওয়া যায় না। খুব বেশি বন্ধু অবশ্য নেই তার। কায়ু বরং এতেই খুশি। সম্পর্ক রক্ষায় বরাবরই একটু উদাসীন সে।

“তো…কি যেন বলছিলেন? এখন কোথায় সে?” হাতের কাপে আঙুল বুলিয়ে বললো হিরাই, আগ্রহের বালাই নেই তার কণ্ঠে

কিশোরীদের মতো গাল ফোলালো ফুমিকো। “আমেরিকা।”

“তাহলে আপনার বয়ফ্রেন্ড চাকরিকেই প্রাধান্য দিয়েছে?” এরকম চাঁছাছোলা কথা বলা হিরাইয়ের অভ্যাস (কিংবা বদভ্যাস)।

“না! বিষয়টা এরকম নয়!” প্রতিবাদ জানালো ফুমিকো।

“তাই কী? উনি তো আমেরিকাতেই আছেন এখন,” হিরাই বললো। ফুমিকোর কথা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে তার।

“আমি এতক্ষণ কী বললাম, শোনেননি?” ক্রমেই অসহিষ্ণুতা ভর করছে ফুমিকোর চিত্তে।

“শুনেছি। কিন্তু ঠিক কোনো অংশটার কথা বলছেন?”

“আমি ওকে বলতে চেয়েছিলাম যে ‘যেয়ো না’। কিন্তু নিজের অহংয়ের কাছে হেরে গেছি।”

“খুব বেশি মানুষ এই সত্যটা স্বীকার করে না,” হেসে বললো হিরাই। আরেকটু হলেই তাল হারিয়ে চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিল সে।

হিরাইয়ের প্রতিক্রিয়া আমলে নিলো না ফুমিকো। “আপনি বুঝতে পারছেন তো আমি কী বলছি, তাই না?” সাহায্যের আশায় কায়ুর দিকে তাকালো সে।

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো মেয়েটা। “অর্থাৎ আপনি চাচ্ছিলেন না তিনি আমেরিকা যান, তাই তো?”

কাযুও একদম মনের কথাটাই বললো।

“হ্যাঁ…মানে, সেটা বলতে পারেন। কিন্তু …”

“আপনাকে বুঝতে আসলে বেগ পেতে হচ্ছে আমার,” ফুমিকোকে ইতস্তত করতে দেখে আমুদে কণ্ঠে বললো হিরাই।

“সে যদি ফুমিকোর জায়গায় হতো, তাহলে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলতো, যেয়ো না!” সেই কান্নাটা অবশ্য হতো কুমিরের কান্নার শামিল। নারীদের জন্য চোখের জলের চেয়ে মোক্ষম অস্ত্র আর কিছু নেই-এই ধারণায় বিশ্বাসী হিরাই।

কাউন্টারের মাঝামাঝি দাঁড়ানো কাযুর দিকে তাকালো ফুমিকো চোখজোড়া ছলছল করছে বেচারির। “যাইহোক, আমি চাই আপনি আমাকে সেই দিনটাতে নিয়ে যান…ঠিক সাতদিন আগে!” অনুনয় ঝরছে তার কণ্ঠে

এক সপ্তাহ আগে নিয়ে যাওয়ার এই পাগলাটে অনুরোধ শুনে হিরাই প্রথমে কথা বলে উঠলো, “অতীতে ফিরতে চাইছে এখন…” ভ্রু উঁচিয়ে কাযুর দিকে তাকালো সে।

অস্বস্তিভাবটা আগের চেয়ে আরো প্রকট হয়েছে কাযুর। “ওহ…” কেবল এটুকুই বললো সে।

ক্যাফেটা যে কাউকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে—এই কিংবদন্তিটা বেশ লম্বা একটা সময় ধরেই প্রচলিত শহরে। কিন্তু এরকম আজগুবি কথায় কখনোই বিশ্বাস ছিল না ফুমিকোর, তাই ভুলেই গিয়েছিল একরকম। গত সপ্তাহে গোরোর সাথে এখানে আসাটা ছিল, যাকে বলে একদম দৈবাৎ। কিন্তু গত রাতে একটা টিভি প্রোগ্রাম দেখতে গিয়ে উপস্থাপকের মুখে ‘শহুরে কিংবদন্তি’ শব্দটা কানে আসা মাত্র ক্যাফেটার বিশেষত্ব মনে পড়ে যায় ওর। এই ক্যাফেটা আপনাকে নিয়ে যাবে ফেলে আসা অতীতে। পুরো বাক্যটা ওর ঠিক মনে নেই, কিন্তু এরকম কিছুই শুনেছিল।

আমি যদি অতীতে ফিরতে পারি, তাহলে সবকিছু সামলে নিতে পারবো। গোরোর সাথে এবারে আগের চেয়ে গুছিয়ে কথা বলতে হবে। এই কথাটাই বারবার মাথায় ঘুরতে থাকে ফুমিকোর। অতীতে ফেরার চিন্তায় এতটাই মগ্ন হয়ে যায় যে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

পরদিন সকালে অফিসে যাবার আগে সকালের নাস্তা করতে ভুলে যায়। ওখানে গিয়েও কাজে মন বসাতে পারেনি। শুধু বসে বসে সময় পার করেছে মাত্র। আমাকে জানতেই হবে যে এটা আদৌ সম্ভব কি না। যত দ্রুত সম্ভব জবাব চাই তার।

কাজে একগাদা ভুল করে ফুমিকো। ওর মতো একজন কর্মীর এরকম অস্বাভাবিক আচরণ দেখে এক সহকর্মী জানতে চায় শরীর ঠিকঠাক আছে কি না। কিন্তু ততক্ষণে ছুটির ঘণ্টা বেজে যাওয়ায় তার প্রশ্নের জবাবে কিছু বলার প্রয়োজনবোধ করেনি সে।

ত্রিশ মিনিটের মধ্যে অফিস থেকে ক্যাফেতে পৌঁছে যায় সে। স্টেশন থেকে বের হয়ে বাকিটা পথ একপ্রকার দৌড়েই এসেছে। শশব্যস্ত হয়ে ক্যাফেতে পা দিয়েই কায়ুর দিকে ছোটে।

“প্লিজ আমাকে অতীতে পাঠানোর বন্দোবস্ত করুন!” কায়ু অভ্যর্থনা সূচক কিছু বলার আগেই বলে ফুমিকো। গোরোর সাথে কথোপকথনের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়ার পুরোটা সময় একই রকম অস্থিরতা কাজ করে তার মধ্যে। কিন্তু এখন হিরাই আর কাযুর প্রতিক্রিয়া দেখে কিছুটা ধন্ধে পড়ে গেছে সে।

মুখে বাকা একটা হাসি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে হিরাই, আর কাযুর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কেউ বুঝি জোর করে তেতো কিছু খাইয়ে দিয়েছে তাকে। ইচ্ছা করে চেহারা অন্যদিকে ঘুরিয়ে রেখেছে যাতে চোখাচোখি না হয়।

অতীতে ফিরে যাওয়ার কিংবদন্তিটা যদি সত্যি হতো, তাহলে এখন নিশ্চয়ই অনেক মানুষ থাকতো এখানে, মনে মনে ভাবে ফুমিকো। কিন্তু এই মুহূর্তে ক্যাফেতে কাস্টমার বলতে সাদা পোশাক পরিহিতা সেই মহিলা, ট্রাভেল ম্যাগাজিনে মুখ ডুবিয়ে রাখা লোকটা, হিরাই আর সে নিজে। এক সপ্তাহ আগেও এই কজনই ছিল।

“অতীতে ফিরে যাওয়া তো সম্ভব, তাই না?” শঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে সে।

এখন মনে হচ্ছে যে শুরুতে এই প্রশ্নটা করা উচিত ছিল। কিন্তু যা হবার হয়ে গেছে।

“বলুন? সম্ভব কি না?” এবারে কাউন্টারের অন্যপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাযুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলো ফুমিকো।

“হুম, মানে…” কায়ু বলে।

আশার প্রদীপের নিভু নিভু সলতেটা আবারো জ্বলে ওঠে ফুমিকোর শরীরের শিরায় শিরায় রক্তের নাচন টের পাচ্ছে এখন। সরাসরি না বলেনি মেয়েটা।

“প্লিজ, আমাকে অতীতে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।” আবারো কাতর কণ্ঠে বলে সে। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে লাফিয়ে কাউন্টার পেরিয়ে অন্য পাশে চলে যাবে।

“অতীতে ফিরে কী করতে চান আপনি?” ঠান্ডা হয়ে আসা কফির কাপে চুমুক দিয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে হিরাই।

“সবকিছু ঠিক করতে চাই,” ফুমিকোর চেহারা গম্ভীর।

“বেশ…” বলে কাঁধ ঝাঁকায় হিরাই।

“প্লিজ!” এবারে আগের চাইতে অনেক জোরে বলে সে। পুরো ক্যাফেতে প্রতিধ্বনিত হয় ওর কণ্ঠস্বর।

গোরোকে বিয়ে করার ভাবনাটা মাথায় এসেছে খুব বেশিদিন হয়নি। এই বছরে আটাশে পা দেবে ও। ইতোমধ্যে মা-বাবা কয়েক হাজার বার জিজ্ঞেস করে ফেলেছে যে গাঁটছড়া কবে বাঁধবে। হাকোদাতে থেকেও ওর জন্য চিন্তা করেন তারা। এখনো কী বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবছো না তুমি? ওরকম কারো সাথে পরিচয় হয়নি? এমন আরো হাজারটা প্রশ্ন। বিশেষ করে গত বছর যখন ওর পঁচিশ বছর বয়সি ছোট বোন বিয়ে করে ফেলে, পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে মোড় নেয়। এখন প্রতি সপ্তাহে একগাদা ই-মেইল এসে জমা হয় ওর ইনবক্সে। ছোট বোনের পাশাপাশি তেইশ বছর বয়সি এক ছোটোভাইও আছে ওর। গার্লফ্রেন্ড প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ায় তড়িঘড়ি করে তাকে বিয়ে করে ফেলে সে। ফলে ভাইবোনদের মধ্যে এখন একমাত্র ফুমিকোই অবিবাহিত।

বিয়েশাদির ব্যাপারে অবশ্য কখনোই ওরকম কোনো তাড়া অনুভব করেনি ও। কিন্তু ছোট বোন বিয়ে করে ফেলার পর একটু নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়। যদি গোরোকে বিয়ে করা যায়, তাহলে ব্যাপারটা মন্দ হবে না-এমনটাই ভাবে ফুমিকো।

পাউচ থেকে একটা সিগারেট বের করলো হিরাই।

“ওনাকে একটু ভালোমতো বুঝিয়ে বলা উচিত বোধহয়, কী মনে হয় তোমার?” সিগারেটে আগুন দিতে দিতে বললো সে।

“হ্যাঁ, আমিও সেটাই ভাবছিলাম,” নিরুত্তাপ কণ্ঠে কথাটা বলে কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এসে ফুমিকোর সামনে দাঁড়ালো কায়ু। “আপনাকে এখন যা বলবো, মন দিয়ে শুনবেন, কেমন?” ছোট বাচ্চাদের কিছু বোঝাতে চাইলে বড়রা যেভাবে কথা বলে, ঠিক ওভাবেই বললো সে।

“কী?” কিছুটা শক্ত হয়ে গেল কায়ুর শরীর।

“আপনি অতীতে ফিরতে পারবেন, এটা সত্যি। কিন্তু…”

“কিন্তু…?”

“অতীতে ফিরে গিয়ে আপনি হাজার চেষ্টা করলেও বর্তমানে কিছু

বদলাবে না।”

বর্তমানে কিছু বদলাবে না। এরকম কিছু শুনতে হবে বলে আশা করেনি ফুমিকো। “কী?” কিছু না ভেবেই উচ্চকণ্ঠে বললো সে।

শান্তগলায় আবারো তাকে বোঝাতে শুরু করলো কায়ু। “আপনি যদি অতীতে ফিরে গিয়ে আপনার…বয়ফ্রেন্ডকে নিজের অনুভূতির কথা জানান, তবুও…”

“তবুও?”

“তবুও তার আমেরিকায় যাওয়ার বিষয়টায় কোনো হেরফের হবে না।” যে কথাটা শুনতে চাইছিল না ফুমিকো, ঠিক সেই কথাটাই বললো কাযু।

গোটা শরীর রীতিমতো কাঁপছে এখন ওর।

কিন্তু কাযু যেন এসব দেখতেই পাচ্ছে না। আগের সুরেই কথা বলে চলেছে সে। “অতীতে ফিরে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করে তাকে আমেরিকা যেতে মানা করলেও বর্তমানে কিছু বদলাবে না।”

শীতল কণ্ঠে বলা কায়ুর কথাগুলো যেন চাবুকের মতো আঘাত করলো ফুমিকোকে। “তাহলে অতীতে গিয়ে লাভটা কী হবে?” ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বললো সে।

“উত্তেজিত হবেন না, সামলান নিজেকে,” হিরাই কথা বললো এবারে। সিগারেটটা অর্ধেক মতো টানা শেষ তার। ফুমিকোর প্রতিক্রিয়ায় খুব একটা অবাক হয়নি সে।

“কেন?” মরিয়া কণ্ঠে কাযুকে জিজ্ঞেস করলো ফুমিকো।

“কারণ এটাই নিয়ম,” কেবল এটুকুই বললো কায়ু।

সময় পরিভ্রমণ সংক্রান্ত যে-কোনো সিনেমা বা উপন্যাসে সাধারণত একটা নিয়মের উল্লেখ থাকে। অতীতে গিয়ে এমন কিছু করবে না, যাতে বর্তমানে কোনো পরিবর্তন আসে। যেমন, অতীতে গিয়ে যদি কেউ তার বাবা-মা’র বিয়ে রুখে দেয়, তাহলে তার জন্মই হবে না!

ফুমিকোও টাইম ট্রাভেল নিয়ে যতগুলো গল্প শুনেছে, সেখানে এই নিয়মটা বহাল ছিল। অতীতে কিছু পরিবর্তন করলে, বর্তমানেও সেটার প্রভাব পড়বে। আর সেই কারণেই আজ সে অতীতে ফিরে যেতে চেয়েছিল, যাতে সবকিছু নতুন করে শুরু করতে পারে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেই স্বপ্নটা অধরাই থেকে যাবে!

অতীতে ফিরে গিয়ে আপনি হাজার চেষ্টা করলেও বর্তমানে কিছু বদলাবে না—এই কথাটার যুক্তিযুক্ত ব্যাখা চাই তার। কিন্তু কাযু শুধু বলেছে, এটাই নিয়ম। মেয়েটা কী আসলে ওর সাথে ঠাট্টা করছে? নাকি ব্যাখ্যাটা এতই জটিল যে সেই ঝামেলায় নিজেকে জড়াতে চাইছে না? আরেকটা সম্ভাবনা হচ্ছে, কায়ু নিজেও আসলে বিষয়টা ঠিকমতো বোঝে না। তার নির্লিপ্ততার এটাই হয়তো মূল কারণ।

এখনো হাসি মুছে যায়নি হিরাইয়ের মুখ থেকে। ফুমিকোর এই বেহাল দশা দেখে যেন আনন্দ পাচ্ছে সে। “ভাগ্যটাই খারাপ আপনার,” বলে আয়েশ করে ধোঁয়া ছাড়লো সে।

এই বাক্যটা বলার জন্য অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল হিরাই। এতক্ষণ বলতে পেরে সন্তুষ্টি ভর করলো তার চিত্তে।

“কিন্তু…কেন?” ফুমিকোর মনে হলো কেউ বুঝি তার শরীর থেকে সমস্ত প্রাণশক্তি শুষে নিয়েছে। চেয়ারের উপরে এলিয়ে পড়লো সে। এই সময় একটা স্মৃতি ভেসে উঠলো তার মনের পর্দায়। এই ক্যাফেটা সম্পর্কে কোনো পত্রিকায় যেন প্রতিবেদন ছেপেছিল। শিরোনাম ছিল— ‘টাইম ট্রাভেলিং ক্যাফের আসল গোমড় ফাঁস!’ প্রতিবেদনের সারমর্ম অনেকটা এরকম-

ক্যাফেটার নাম ফানিকুলি ফানিকুলা। সময় পরিভ্রমণ সম্পর্কিত গুজবটা ছড়িয়ে পড়ার পর প্রথম দিকে প্রতিদিন কাস্টমারের ঢল নামতো ছোট জায়গাটায়। কিন্তু ভেতরে সবার স্থান সংকুলান না হওয়ায় লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হতো আগত অতিথিদের। কিন্তু এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, যে কি না দাবি করতে পারবে যে সে অতীতে ফিরে গিয়েছিল। এর কারণ মূলত বিরক্তিকর কিছু নিয়ম। নিয়মগুলো হচ্ছে-অতীতে গিয়ে কেবল এমন মানুষের দেখা পাওয়া যাবে, যারা কিনা ক্যাফেটায় পা রেখেছে। এই নিয়মটা শোনার পরেই বেশির ভাগ মানুষ ক্যাফেটা সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আরেকটা নিয়ম-অতীতে গিয়ে হাজার চেষ্টা করলেও বর্তমান সময়ের কোনো কিছু বদলানো যাবে না। ক্যাফের লোকদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এহেন নিয়মের কারণ। কিন্তু জবাবে তারা সন্তোষজনক কিছু বলতে পারেনি।

প্রতিবেদক যেহেতু এমন কাউকে খুঁজে পায়নি যে কিনা অতীতে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে, তাই ক্যাফেটা আসলেও কাউকে অতীতে নিয়ে যেতে পারে কি না এই রহস্যটা রয়েই গেছে। আর কিংবদন্তিটা যদি সত্যি হয়েও থাকে, হতচ্ছাড়া নিয়মগুলোর কারণে অতীতে ফিরে যাওয়াটা নিতান্তই অমূলক।

হঠাৎ একটা শব্দে চিন্তার বাঁধন ছিঁড়ে গেল ফুমিকোর। বর্তমানে ফিরে এলো সে। হিরাই এসে বসেছে ওর উলটো দিকের চেয়ারটায়। হাসিমুখে সময় পরিভ্রমণের আরো কিছু নিয়ম ব্যাখ্যা করে চলেছে সে। চেয়ারে হেলান দেওয়া অবস্থাতেই টেবিলে রাখা চিনির পাত্রের দিকে তাকালো ফুমিকো, ক্যাফেটা সুগার কিউবের বদলে এখনো এরকম খোলা চিনি কেন ব্যবহার করে, সেই বিষয়ে ভাবছে।

“শুধু ওই নিয়মগুলোই নয়, আপনি কী জানেন যে এখানকার নির্দিষ্ট একটা চেয়ারই কেবল আপনাকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে? আর অতীতে ফিরে সেই চেয়ার ছেড়েও নড়তে পারবেন না,” হিরাই বললো। “আরো কিছু নিয়ম আছে না?” বলে কায়ুর দিকে তাকালো সে। বাম হাতের কড়ায় গুণছে নিয়মের সংখ্যা।

“একটা নির্দিষ্ট সময়সীমাও আছে,” গ্লাস মুছতে মুছতে বললো কায়ু। তার বলার ভঙ্গি দেখে মনে হবে বুঝি নিজের সাথেই কথা বলছে।

এবারে হুঁশ ফিরলো ফুমিকোর। “সময়সীমা?” মাথা তুলে বললো সে।

একটা মৃদু হাসির রেখা ফুটে আবার মিলিয়ে গেল কায়ুর ঠোঁটে। মাথা নেড়ে সায় জানালো মেয়েটা।

“এই নিয়মগুলো শোনার পর কেউই অতীতে ফিরে গিয়ে সময় নষ্ট করতে চায় না,” টেবিলে আলতো করে একটা চাপড় দিয়ে বললো হিরাই। গোটা বিষয়টাই উপভোগ করছে সে। তার চেহারা দেখে মনে হবে এই মুহূর্তে ফুমিকোর মতো আজব চিড়িয়া দুনিয়াতে আর একটিও নেই। “অনেক দিন পর আপনার মতো কাউকে পাওয়া গেল, যে কি না অতীতে ফিরে যাওয়ার জন্য এতটা মরিয়া।”

“হিরাই…” তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো কায়ু।

“জীবনে সবকিছু নিজের মর্জি মাফিক হয় না। এটা মেনে নিতে শিখুন,” হিরাইয়ের মধ্যে থামার কোনো লক্ষণই নেই।

“হিরাই…” আবারো তাকে সাবধান করলো কায়ু।

“কী? আমার মতে যেটা সত্য, সেটাকে স্বীকার করে নেওয়াই ভালো। তাই না?” বলে হেসে উঠলো হিরাই।

বার হোস্টেসের প্রতিটা কথা ছুরির মতো বিঁধেছে ফুমিকোর অন্তরে। কিছুক্ষণ আগের মতো আবারো টেবিলের ওপরে নেতিয়ে পড়লো সে।

“আমি কী আরেক কাপ কফি পেতে পারি?” দরজার কাছে ট্রাভেল ম্যাগাজিন হাতে বসে থাকা লোকটা বললো এসময়।

“নিশ্চয়ই,” বলে কাউন্টারের দিকে এগোলো কায়ু।

.

একজন মহিলা প্রবেশ করেছে ক্যাফেতে। ধূসর নীল রঙের শার্ট-ড্রেসের উপরে একটা কার্ডিগান চাপানো তার। দুই হাতে সাদা রঙের ক্যানভাস ব্যাগ। চোখ দুটো দেখে বাচ্চাদের কথা মনে পড়ে যেতে বাধ্য। সেখানে খেলা করছে কৌতূহল।

“হ্যালো,” ক্যাফের মধ্যে গমগম করে উঠলো কায়ুর কণ্ঠস্বর।

“হাই, কাযু।”

“হ্যালো, আপু!”

কাযু মহিলাকে আপু বলে ডাকলেও আসলে সে তার চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী, কেই তোকিতা।

“চেরি ব্লসমের সময় শেষই হয়ে গেল,” কেইয়ের হাসি দেখে অবশ্য মনে হচ্ছে না যে এই ঘটনায় কষ্ট পেয়েছে সে।

“হ্যাঁ, গাছগুলো তো খালিই হয়ে গেছে প্রায়,” শান্তস্বরে বললো কায়ু। কিছুক্ষণ আগেও ফুমিকোর সাথে শান্ত ভঙ্গিতেই আলাপ করছিল সে। তবে খেয়াল করলে কথা বলার ধরনের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে। এবারে আগের তুলনায় অনেকটাই আন্তরিক কায়ুর কণ্ঠস্বর।

“গুড ইভিনিং,” ফুমিকোর টেবিল থেকে উঠতে উঠতে বললো হিরাই। ওর দুর্দশার কাহিনির মাঝে আর কোনো আগ্রহ খুঁজে পাচ্ছে না। “কোথায় গিয়েছিলে?”

“হাসপাতালে।”

“কেন? রুটিন চেক-আপ?”

“হ্যাঁ।”

“তোমাকে কিন্তু আজকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।”

“শরীরটাও ভালো লাগছে।”

নিস্তেজ ভঙ্গিতে টেবিলে বসে থাকা ফুমিকোর দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচু করলো কেই। জবাবে কেবল মাথা নাড়লো হিরাই। অপেক্ষা না করে কাউন্টারের পেছনের রুমটায় হারিয়ে গেল কেই।

.

কেই পেছনের রুমে ঢোকামাত্র একজন উঁচা-লম্বা ভদ্রলোক পা রাখলো ক্যাফেতে। মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকতে হয়েছে তাকে। শেফের ইউনিফর্মের উপরে একটা হালকা জ্যাকেট পরে আছে সে। ডান হাত থেকে ঝুলছে চাবির বিশাল একটা গোছা। তার নাম নাগারে তোকিতা। এই ক্যাফের মালিক।

“শুভ সন্ধ্যা,” তাকে অভ্যর্থনা জানালো কায়ু।

জবাবে মাথা নেড়ে দরজার পাশের টেবিলটায় বসা লোকটার দিকে তাকালো নাগারে।

খালি হয়ে যাওয়া কাপটা কাযুর দিকে বাড়িয়ে ধরলো হিরাই। সেটা ভরে আনতে রান্নাঘরে চলে গেল মেয়েটা। এখন কাউন্টারে এক হাত দিয়ে হেলান দিয়ে বসে একদৃষ্টিতে নাগারেকে দেখছে বার হোস্টেস।

ম্যাগাজিনে বুঁদ হয়ে থাকা লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ক্যাফে মালিক। “ফুসাগি,” শান্তস্বরে ডাকলো।

ফুসাগি নামের লোকটার মধ্যে প্রথমে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না, যেন বুঝতেই পারেনি যে নিজের নাম ধরে ডাকা হয়েছে। এরপর ধীরে ধীরে মাথা তুলে নাগারের দিকে তাকালো।

“হ্যালো,” আলতো মাথা নেড়ে বললো নাগারে।

“ওহ, হ্যালো,” ফুসাগির কণ্ঠে বা চেহারায় অনুভূতির লেশমাত্র নেই। আবারো ম্যাগাজিন পড়ায় মনোযোগ দিলো সে। কিছুক্ষণ লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলো নাগারে।

“কাযু,” রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে হাঁক ছেড়ে বললো সে।

রান্নাঘর থেকে মাথা বের করলো কায়ু। “কী?”

“আমার হয়ে কোহতাকে’কে একবার ফোন করবে?”

অনুরোধটা শুনে একটু অবাকই হলো কায়ু। “কোহতাকে?”

“হ্যাঁ। খোঁজাখুঁজি করছে ও,” বলে ফুসাগির দিকে একবার তাকালো নাগারে।”

এবারে কায়ুর বুঝতে সমস্যা হলো না। “ওহ…আচ্ছা।”

হিরাইয়ের কাপে আবারো কফি ঢেলে দিয়ে ফোন করার জন্য পেছনের ঘরটায় চলে গেল সে।

টেবিলে মাথা নিচু করে বসে থাকা ফুমিকোর দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে কাউন্টারের পেছনে প্রবেশ করলো নাগারে। শেলফ থেকে একটা গ্লাস নামিয়ে কমলার জুস ঢাললো সেটায়। এক চুমুকেই শেষ করে ফেললো জুসটুকু।

গ্লাসটা ধোয়ার জন্য রান্নাঘরে ঢুকেছে নাগারে, এসময় কাউন্টারে আঙুল দিয়ে শব্দ করলো কেউ। কী ঘটছে দেখার জন্য রান্নাঘর থেকে মাথাটা বের করলো সে।

তাকে সামনে এগোনোর ইশারা করলো হিরাই। হাতে পানি নিয়েই নীরবে সামনে এগিয়ে এল ক্যাফে নাগারে। কাউন্টারের উপরে আরেকটু ঝুঁকলো বার হোস্টেস।

“কেমন দেখলে সবকিছু ওখানে?” ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো হিরাই।

“হুমম,” কিচেন পেপার খুঁজতে ব্যস্ত নাগারে। শব্দটাকে কীসের লক্ষণ হিসেবে ধরবে, ঠিক ঠাওর করতে পারলো না হিরাই। সন্তুষ্টির হতে পারে, আবার হতাশারও হতে পারে। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে পরবর্তী প্রশ্নটা করলো সে।

“টেস্ট রেজাল্টগুলোর কী অবস্থা?”

প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে নাক চুলকাতে লাগলো নাগারে।

“খারাপ?” আগের তুলনায় গম্ভীর ভঙ্গিতে জানতে চাইলো হিরাই।

তবে নাগারের অভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন হলো না।

“টেস্ট রেজাল্ট দেখার পর মেডিক্যাল বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয় যে ওকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে না,” প্রায় বিড়বিড়িয়ে বললো নাগারে, যেন নিজের সাথেই কথা বলছে।

নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো হিরাই। “আচ্ছা…” বলে পেছনের রুমটার দিকে তাকালো সে। নাগারের স্ত্রী এখনো ভেতরেই আছে।

জন্ম থেকেই হৃদ্‌পিণ্ডের দুর্বলতায় ভুগছে কেই। এই ভালো তো এই খারাপ। কিছুদিন পরপরই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয় তাকে। হাসপাতালে থাকতে হয় দিনের পর দিন। তবে শারীরিক অবস্থা যতটাই খারাপ হোক না কেন, সবসময় মুখে একটা হাসি লেগে থাকে তার। ভীষণ বন্ধুবৎসল এবং পরোপকারী।

হিরাইয়ের এসব ভালো করেই জানা আছে। শরীর খারাপ হলেও কেইয়ের মুখ দেখে কখনো কিছু বোঝা যায় না। এজন্যই নাগারেকে জিজ্ঞেস করা।

“অবশেষে কিচেন পেপার খুঁজে পেয়েছে নাগারে। তোমার কী খবর, হিরাই? ওনারা সবাই ঠিক আছেন?” হাত মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলো সে।

তার প্রশ্নটা ঠিক বোধগম্য হলো না হিরাইয়ের। “মানে?”

“তোমার বোন তো প্রায়ই আসছে তোমার সাথে দেখা করতে, তাই না?”

“ওহ। আসছে বোধহয়,” ক্যাফের চারধারে একবার নজর বুলিয়ে বললো হিরাই।

“তোমার বাবা-মা তো একটা সরাইখানা চালান?”

“হ্যাঁ।”

নাগারে এই বিষয়ে খুব বেশি কিছু জানে না। শুধু এটুকু শুনেছে যে হিরাই বাড়ি ছেড়ে চলে আসার কারণে তার বোনকে সব দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে এখন।

“তোমার বোনের জন্য একটু কষ্ট হয়ে যায় বোধহয়। মানে, একা একা সবকিছু…”

“নাহ, ঠিকঠাক সামলে নিয়েছে। এই ধরনের কাজকর্ম ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে ও।”

“তবুও…”

“বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এখন আর বাড়ি ফিরতে পারবো না আমি,” হিরাইয়ের কণ্ঠে প্রচ্ছন্ন রাগের আভাস।

চিতা-প্রিন্টের পাউচটা থেকে একটা বড় পার্স বের করলো সে। জিনিসটা এতই বড় যে দেখে মোটা ডিকশনারি বলে ভুল হয়। কয়েনের ঝনঝনানি ভেসে আসছে ভেতর থেকে।

“কেন পারবে না?”

“বাড়ি ফিরে গেলেও, কোনো কাজে আসবো না আমি,” বোকার মতো হেসে বললো হিরাই। নিজেকে সামলে নিয়েছে।

“কিন্তু…”

“যাইহোক, কফির জন্য ধন্যবাদ। এখন যেতে হবে আমাকে,” নাগারের কথা শেষ হবার আগেই বললো সে। কাউন্টারে বিল রেখে দ্রুত ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেল। যেন এই অস্বস্তিকর আলাপ থেকে ছুটে পালাতে চাইছে।

.

নাগারের রেখে যাওয়া পয়সাগুলো তুলতে তুলতে টেবিলে মাথা নিচু করে বসে থাকা ফুমিকোর দিকে তাকালো নাগারে। তবে ব্যাপারটা শুধু সৌজন্যের খাতিরেই। ফুমিকোর ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী মনে হলো না তাকে। পয়সাগুলো বিশাল হাতের মুঠোয় নিয়ে আনমনে খেলতে লাগলো। “ভাইয়া,” কাযু উদয় হলো এসময়। আপন ভাই না হলেও নাগারেকে ভাইয়া বলেই ডাকে মেয়েটা।

“কী?”

“আপু ডাকে তোমাকে।”

“আসছি,” একবার পুরো ক্যাফেতে নজর বুলালো নাগারে। পয়সাগুলো কাযুর হাতে তুলে দিলো এরপর।

“কে।হতাকে বললেন যে এসে পড়বেন তাড়াতাড়ি,” কায়ু জানালো।

কথাটা শুনে একবার মাথা নাড়লো নাগারে। “ক্যাফের দিকে খেয়াল রেখো, ঠিক আছে?” বলে পেছনের ঘরে উধাও হয়ে গেল সে।

“আচ্ছা।”

ক্যাফেতে এই মুহূর্তে খদ্দের বলতে উপন্যাসের বই হাতে নিয়ে বসে থাকা সেই মহিলা, ফুমিকো (এখনো মাথা নিচু করে রেখেছে) আর ফুসাগি (ট্রাভেল ম্যাগাজিন থেকে নোট নেওয়া শেষ হয়নি তার)। পয়সাগুলো ক্যাশ রেজিস্টারে রেখে হিরাইয়ের কাপটা ধুয়ে ফেললো কায়ু। ক্যাফের পুরানো তিনটি দেওয়াল ঘড়িগুলোর একটা পাঁচবার ঢংঢং করে উঠলো এই সময়।

“কফি, প্লিজ।”

টেবিল থেকে কায়ুর উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে বললো ফুসাগি। কফির কাপটা উঁচিয়ে ধরেছে। অনুরোধ করার পরে এখন অবধি রিফিল পায়নি সে।

“ওহ…হ্যাঁ! নিশ্চয়ই!” ভুল বুঝতে পেরে দ্রুত রান্নাঘরে ফিরে গেল কাযু। একটা স্বচ্ছ কাচের ক্যারাফ ভর্তি কফি নিয়ে বেরিয়ে এলো কিছুক্ষণের মধ্যে।

.

“এতেই চলবে আমার,” মাথা নিচু করে বসে থাকা অবস্থায় বললো ফুমিকো।

ফুসাগির কাপে কফি ঢালছিলো কায়ু। আড়চোখে ফুমিকোর দিকে তাকালো সে।

সোজা হয়ে বসলো ফুমিকো। “এতেই চলবে আমার। যদি কিছু না বদলায়, তাতে কোনো সমস্যা নেই। সব যেরকম আছে, সেরকমই থাক,” উঠে দাঁড়িয়ে কায়ুর কাছে এসে দাঁড়ালো সে। একটু বেশিই কাছে। কফির কাপটা ফুসাগির টেবিলে নামিয়ে রেখে ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালো কাযু। পিছিয়ে গেল দুই কদম।

“ঠিক আছে…’”

আবারো সামনে এগিয়ে এলো ফুমিকো। “তাহলে…আমাকে পাঠিয়ে দিন…এক সপ্তাহ আগে!”

দেখে মনে হচ্ছে মন থেকে সব সন্দেহ দূর হয়ে গেছে তার। দ্বিধার লেশমাত্র নেই কণ্ঠে। বরং সেই জায়গায় খেলা করছে অতীতে ফিরে যাওয়ার চাপা উত্তেজনা। নাকের পাটাগুলো ফুলে উঠেছে রীতিমতো।

“আচ্ছা…কিন্তু-”

ফুমিকোর এই অতি আগ্রহ কিছুটা অস্বস্তিকর ঠেকছে কায়ুর কাছে। দ্রুত পায়ে কাউন্টারের পেছনে চলে এলো সে। “আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম আছে।”

কথাটা শুনে বিরক্তি ভর করলো ফুমিকোর চেহারায়। “কী? আরো নিয়ম?” ভ্রু কুচকে বললো সে।

“এই ক্যাফেতে যারা কখনো আসেনি, তাদের সাথে দেখা হবে না আপনার। বর্তমানের কিছু বদলাবে না। অতীতে ফিরে যাওয়ার জন্য কেবল একটা সিটই আছে, সেখান থেকে নড়তে পারবেন না আপনি। আর, নির্দিষ্ট সময়কালেরও একটা ব্যাপার আছে।”

নিয়মগুলো শোনার সময় আঙুলে গুণছিলো ফুমিকো। রাগের পারদ ধীরে ধীরে চড়ছে তার।

“শেষেরটাই বোধহয় সবচেয়ে ঝামেলার,” কায়ু বললো।

যে নিয়মগুলো আগে শুনেছিলো, সেগুলোও খুব একটা পছন্দ হয়নি ফুমিকোর। ‘সবচেয়ে ঝামেলাপূর্ণ নিয়ম’-কথাটা শোনার সাথে সাথে রাগে ফেটে পড়তে যাচ্ছিলো সে, কিন্তু ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলালো।

“আচ্ছা, ঝামেলাপূর্ণ হলে হোক। বলুন আমাকে,” বুকের উপরে দুই হাত ভাঁজ করে কায়ুর উদ্দেশ্যে বললো সে।

একবার মাথা নেড়ে ক্যারাটা রান্নাঘরে রেখে আসতে গেল কায়ু।

কাউন্টারের সামনে একা দাঁড়িয়ে নিজেকে আরেকটু ধাতস্থ করার জন্য লম্বা করে শ্বাস নিলো ফুমিকো। প্রথমে তার লক্ষ্য ছিল গোরোর আমেরিকায় যাওয়া আটকানো।

কাউকে তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত থেকে টলানো যে নৈতিক নয়, তা ভালো করেই জানে ফুমিকো। কিন্তু ও যদি বলতো যে ‘আমি চাই না তুমি আমেরিকায় যাও’—তাহলে হয়তো গোটা বিষয়টা পুনর্বিবেচনা করত গোরো। আর সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে, তাদের মধ্যে ব্রেকআপটাও হতো না। মোদ্দা কথা, অতীতে সে ফিরতে চেয়েছিল বর্তমানকে বদলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।

কিন্তু বর্তমানের কোনো কিছু যদি পরিবর্তনই না করা যায়, তাহলে ওদের ব্রেকআপও আটকানো যাবে না। এসব জানা সত্ত্বেও, অতীতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছাটুকু বিন্দুমাত্র কমছে না ফুমিকোর। সে কিছু বিষয় যাচাই করে দেখতে চায়। তাছাড়া অতীত পানে যাত্রাটাও কম রোমাঞ্চকর শোনাচ্ছে না। এরকম অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ কজনের হয়?

ফুমিকো জানে না যে এই যাত্রার ফলাফল ভালো হবে নাকি খারাপ। ভালো যদি না-ও হয়, খারাপ হবার তো কোনো সম্ভাবনা নেই। নিজেকে বোঝালো সে। লম্বা শ্বাস নিলো কয়েকবার। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এলো কাযু। শক্ত হয়ে গেল ফুমিকোর চেহারা, মনে হচ্ছে যেন আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারকের রায় শোনার অপেক্ষা করছে। কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কায়ু।

“ক্যাফের নির্দিষ্ট একটা সিটে বসেই কেবল অতীতে ফিরে যাওয়া সম্ভব,” ঘোষণার সুরে বললো মেয়েটা।

“কোনটা?” সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলো ফুমিকো। “কোথায় বসবো আমি?” চারপাশে দ্রুত মাথা নাড়তে লাগলো সে, যেন কায়ু বলা মাত্র উড়ে গিয়ে বসে পড়বে।

তার এই অস্থির আচরণ আমলে নিলো না কাযু। একবার ইশারা করে সাদা পোশাক পরিহিতা মহিলাকে দেখালো কেবল।

তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকালো ফুমিকো।

“ওই সিটটা,” নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললো কায়ু

“ওইটা? ভদ্রমহিলা বসে আছেন যেখানে?” সেদিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো ফুমিকো।

“হ্যাঁ…”

কাযুর কথা শেষ হবার আগেই নির্দিষ্ট সিটটার উদ্দেশ্যে পা চালালো ফুমিকো।

সাদা পোশাক পরিহিতা মহিলাকে দেখে প্রথমেই মনে হবে যে সুদিন পেছনে ফেলে এসেছেন বেশ আগে। গায়ের রং ফরসা না বলে ফ্যাকাসে বললেই মানানসই হবে। পরনের পোশাকটাও এখনকার আবহাওয়ার সাথে ঠিক খাপ খায় না। ছোট হাতার পোশাকটা ঠান্ডা কতটা দূর করতে পেরেছে, কে জানে। কোনো জ্যাকেটও চোখে পড়লো না ফুমিকোর। কিছু একটা ঠিক নেই। কিন্তু এখন এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নয়।

“এক্সকিউজ মি, আপনি যদি কিছু না মনে করেন, তাহলে আমরা কী সিট অদলবদল করতে পারি?” মহিলার উদ্দেশ্যে বললো ফুমিকো। অধৈর্য ভাবটা চেপে রাখার চেষ্টা করছে যথাসম্ভব। তার কাছে মনে হচ্ছে যথেষ্ট ভদ্রভাবেই অনুরোধটা করা হয়েছে; তা সত্ত্বেও সাদা পোশাক পরিহিতা মহিলার মধ্যে কোনো বিকার দেখা গেল না। যেন ওর কথা শুনতেই পায়নি সে। কিছুটা দমে গেল ফুমিকো। তবে মাঝে মাঝে মানুষজন বই পড়ায় এতটাই মগ্ন হয়ে যায় যে আশপাশে কী হচ্ছে, তা বুঝতে পারে না। এক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই সেরকম কিছুই হয়েছে।

“হ্যালো?… আপনি কী আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?”

“…”

“সময় নষ্ট করছেন আপনি।”

অপ্রত্যাশিতভাবে পেছন থেকে কথাটা বললো কেউ। কায়ু যে কখন ওখানে এসে দাঁড়িয়েছে, ফুমিকো টেরই পায়নি। মেয়েটার কথার অর্থ বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো ওর।

আমি তো শুধু ওনার সাথে সিট অদলবদল করতে চাইছি। এতে সময় নষ্ট হচ্ছে কীভাবে? ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করে সময় নষ্ট করার কথা বলছে? এটাও কী কোনো নিয়ম নাকি? অন্য কোনো ভাবে বলতে হবে? সেরকমটা হলে সোজাসুজি না বলে এভাবে ‘সময় নষ্ট করছেন’ বলার মানে কী?

এই চিন্তাগুলো মাথায় ঘুরপাক খেলেও একদম সাধারণ একটা প্রশ্ন করলো সে।

“কেন?” কণ্ঠে বাচ্চাদের মতো নিষ্পাপ কৌতূহল।

সরাসরি ফুমিকোর চোখের দিকে তাকালো কায়ু। “কারণ এই ভদ্রমহিলা…একজন ভূত,” দৃঢ় কণ্ঠে বললো মেয়েটা, চেহারা গম্ভীর।

আবারো অনেকগুলো প্রশ্ন এসে জমা হলো ফুমিকোর মাথায়।

ভূত? জলজ্যান্ত একটা ভূত? অমাবস্যায় চিলেকোঠার অন্ধকারে থাকে যে ভূত? মেয়েটা তো একদম সাধারণ ভঙ্গিতে কথাটা বলেছে, আমি ভুল শুনিনি তো?

“ভূত?” বিভ্রান্তি দূরে ঠেলে জিজ্ঞেস করলো ফুমিকো।

“হ্যাঁ।”

“আমার সাথে ঠাট্টা করছেন আপনি।”

“না, উনি আসলেও একজন ভূত।

ফুমিকোর মুখে রা সরছে না। ভূত বলে কিছু আছে কি না এরকম প্রশ্ন করার মতো মানসিক অবস্থাও নেই তার। কিন্তু তাই বলে তো সাদা পোশাক পরিহিতা ভদ্রমহিলাকে ভূত হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না! দিব্যি সাধারণ মানুষদের মতোন দেখতে।

“আমি তো ওনাকে পরিষ্কার…”

“দেখতে পাচ্ছেন,” ওর বাক্যটা শেষ করে দিলো কায়ু। যেন সে আগে থেকেই জানতো যে ও কী বলবে।

বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে ফুমিকোকে। “কিন্তু…” কোনো কিছু না ভেবেই ভদ্রমহিলাকে ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো। ওর হাত মহিলার শরীর স্পর্শ করবে, ঠিক এই সময় কায়ু বললো, “ওনাকে ধরতেও পারবেন আপনি।”

আবারো আগে থেকে জবাব তৈরি করে রেখেছিল কায়ু। তবুও নিশ্চিত হবার জন্য মহিলার কাঁধে হাত রাখলো ফুমিকো। ভদ্রমহিলার ত্বক একদম মোলায়েম, ড্রেসটার কাপড় কিছুটা খসখসে। উনি যে একজন ভূত, সেটা বিশ্বাস করতে পারছে না ও।

কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিলো ফুমিকো। কিছুক্ষণ পর কী মনে করে আবারো সেখানে হাত রেখে কায়ুর দিকে তাকালো। যেন বলতে চাইছে, আমি তো ওনাকে ঠিকই ছুঁতে পারছি! তাহলে ভূত হবে কী করে!

কিন্তু কায়ুর অভিব্যক্তিতে কোনো পরিবর্তন এলো না। “উনি একজন ভূত।”

“আসলেই? ভূত?”

ভদ্রমহিলার একদম পাশে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকালো ফুমিকো। সাধারণ অবস্থায় অভদ্রতা হিসেবেই গণ্য হতো এরকম আচরণ।

“হ্যাঁ,” কাযুর কণ্ঠে এখনো সেই আগের দৃঢ়তা।

“অসম্ভব, বিশ্বাস করি না আমি।”

এমন যদি হতো যে ফুমিকো মহিলাকে দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু ছুঁতে পারছে না, তাহলে কাযুর কথা মেনে নিত। কিন্তু এই ক্ষেত্রে ঘটনা তো ভিন্ন। ও একদম ঠিকঠাক স্পর্শ করেছে ওনাকে। হাতের বইটা ও একদম সাধারণ দর্শন। যদিও বইটার নাম আগে কখনো শোনেনি ফুমিকো। তবে দোকানে গেলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। এবারে একটা সন্দেহ দানাবাঁধতে শুরু করলো ওর মনে। ক্যাফেটা আসলে কাউকে অতীতে নিয়ে যেতে পারে না। গোটা বিষয়টাই এওটা ভাঁওতা মাত্র। বিরক্তিকর নিয়মগুলো বানানোই হয়েছে এই জন্য। ওগুলো শোনার পর কোনো কাস্টমারের আর অতীতে যাওয়ার ইচ্ছা থাকবে না। আর যদি ইচ্ছা থাকেও, এই মহিলা হবে অতীত যাত্রার পথে দ্বিতীয় বাধা। চোখের সামনে ভূত দেখলে যাওয়ার ইচ্ছা এমনিতেই মরে যাবে। কিন্তু সাদা ড্রেস পরিহিতা মহিলাটা আসলে ভূতের অভিনয় করছে।

ফুমিকোর রোখ চেপে গেছে।

মিথ্যে হলে মিথ্যেই সই। আমাকে এসব মিথ্যে বলে দমানো যাবে না।

“দেখুন আমি খুব বেশি সময় নেব না। দয়া করে আমাকে এখানে বসতে দিন,” মহিলার উদ্দেশ্যে শান্ত কণ্ঠে বললো ফুমিকো।

কিন্তু ওর কথাগুলো যেন মহিলার কর্ণকুহর অবধি পৌঁছুতেই পারছে না। এখনো আগের মতোনই বইটা পড়ে চলেছে সে।

পরপর দুবার এভাবে উপেক্ষিত হওয়ায় মেজাজ খারাপ হয়ে গেল ফুমিকোর। খপ করে মহিলার হাত ধরলো সে।

“থামুন! এমন করবেন না!” কাযু সাবধান করলো তীক্ষ্ণ কণ্ঠে।

“এই যে! শুনছেন আমার কথা! ইচ্ছা করে না শোনার ভান করে আছেন কেন?”

জোর করে ভদ্রমহিলাকে সিট থেকে সরানোর চেষ্টা করলো ফুমিকো। আর ঠিক তখনই ঘটলো ঘটনাটা…চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকালো মহিলা।

ফুমিকোর মনে হলো ওর ওজন বুঝি কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। কেউ যেন ভারী কম্বল ফেলে দিয়েছে ওর উপরে। ক্যাফের বাতিগুলোর উজ্জ্বলতাও কমে গেছে। মোমবাতির মতোন টিমটিমে আলো। অপার্থিব একটা চিৎকার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চারপাশে।

নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে ফুমিকো। একটা পেশিও নাড়াতে পারছে না। মুখ থুবড়ে মেঝেতে পড়ে গেল ও।

“কী হচ্ছে! কী হচ্ছে এসব!”

এরকম হেনস্থা আগে কখনো হতে হয়নি ফুমিকোকে। ‘আগেই সাবধান করেছিলাম আপনাকে’-এরকম একটা দৃষ্টি খেলা করছে কায়ুর চোখে। “আপনাকে অভিশাপ দিয়েছেন উনি।”

‘অভিশাপ’ শব্দটা কেমন যেন অচেনা ঠেকলো ফুমিকোর কানে। “কী?” কাতর কণ্ঠে বললো ও।

এখন রীতিমতো উপুড় হয়ে মেঝের উপরে পড়ে আছে ফুমিকো। অদৃশ্য চাপের পরিমাণ বাড়ছে ক্রমশ।

“কী হচ্ছে এসব?” আবারো বললো সে।

“আপনাকে নিষেধ করেছিলাম আমি। এখন কৃতকর্মের ফল ভোগ করছেন,” বলে ফুমিকোকে মেঝেতে রেখেই উধাও হয়ে গেল কায়ু।

উপুড় হয়ে পড়ে থাকায় দৃশ্যটা দেখতে পেলো না ফুমিকো। কিন্তু একটা কান মেঝের সাথে লেগে থাকায় টের পেল যে পদশব্দ দূরে সরে যাচ্ছে। বেচারি এতটাই ভয় পেয়ে গেছে যে পুরো শরীর শীতের দিনের মতোন ঠকঠক করে কাঁপছে।

“আমাকে এভাবে রেখে কোথায় যাচ্ছেন! এখন কী করবো আমি?”

টেবিলের একধারে বসে থাকা মহিলাটা এখনো জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে ফুমিকোর দিকে। কে বলবে যে এই ভদ্রমহিলাই কিছুক্ষণ আগে ওভাবে গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছিল!

“সাহায্য করুন আমাকে! প্লিজ সাহায্য করুন!” রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়লো ফুমিকো।

কিছুক্ষণ বাদে শান্ত পদক্ষপে ফিরে এলো কায়ু, তার হাতে কফি ভর্তি একটা কাঁচের ক্যারাফ। ফুমিকো অবশ্য কিছু দেখতে পাচ্ছে না, কেবল শব্দ শুনে বুঝতে পারলো যে ফিরে এসেছে কায়ু। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল দশা তার। প্রথমে সেই আজগুবি নিয়মগুলো, এরপর একটা জলজ্যান্ত ভূত আর এখন এই অভিশাপ! এরকম খারাপ দিন এর আগে কখনো আসেনি ওর জীবনে।

কাযুর ভাবভঙ্গি থেকে বোঝা যাচ্ছে না যে সে আদৌ ওকে সাহায্য করবে কি না। কিছু একটা করুন! বলে চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল ফুমিকো, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে…

“আপনার কী আরো কফি দরকার?” নিস্পৃহ কণ্ঠে কায়ুকে বলতে শুনলো ফুমিকো।

মাথায় রক্ত চড়ে গেল ওর। কায়ু ওকে সাহায্য তো করছেই না, বরং এখন সাদা পোশাক পরিহিতা মহিলাকে আরো কফি সাধছে! আমাকে অবশ্য বলা হয়েছিল যে এই মহিলা একজন ভূত, আমিই বিশ্বাস করিনি। তাছাড়া, জোর করে হাত ধরে টেনে সরানোর চেষ্টা করাটাও ছিল ভুল একটা কাজ। তবুও, আমি মেঝেতে পড়ে থেকে সাহায্যের জন্য চ্যাঁচাচ্ছি, অথচ মেয়েটা উলটো ওনাকে কফি সাধছে! একটা ভূত কফি দিয়ে কী করবে!

“আপনি কী আমার সাথে ফাজলামো করছেন!” কেবল এটুকুই বলা সম্ভব হলো ফুমিকোর পক্ষে।

“দিন, প্লিজ,” একটা অপার্থিব কণ্ঠ বলে উঠলো এসময়।

কথাটা যে সাদা ড্রেস পরিহিতা মহিলা বলেছে, তা বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগলো ফুমিকোর। সাথে সাথে ওর শরীরের উপরে চেপে বসা বোঝাটা হালকা হয়ে গেল।

“আহ…..”

অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে ফুমিকো। কোনমতে হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়ালো ও। চোখ গরম করে কাযুর দিকে তাকালো।

কাযুও একই ভঙ্গিতে তাকালো ওর দিকে, যেন জিজ্ঞেস করতে চাইছে, কিছু বলার আছে আপনার? শেষ পর্যন্ত অবশ্য কিছু না বলে কেবল কাঁধ ঝাঁকালো মেয়েটা। কফির কাপে চুমুক দিয়ে আবারো বই পড়ায় মনোযোগ দিলো সাদা ড্রেস পরিহিতা মহিলা।

যেন কিছুই হয়নি, এমন ভঙ্গিতে রান্নাঘরে ফিরে গেল কায়ু। আবারো মহিলার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো ফুমিকো। এবারেও ঠিক আগের মতোনই তার কাঁধ স্পর্শ করলো ওর হাত। উনি এখানেই আছেন। তার অস্তিত্ব মিথ্যে নয়!

এরকম অদ্ভুত একটা ঘটনা পুরোপুরি বিভ্রান্ত করে দিয়েছে ফুমিকোকে। তবে পুরো অভিজ্ঞতাটাই যে বাস্তব, সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাকে চেপে রেখেছিল মেঝের সাথে। মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ না করলেও, হৃৎপিণ্ড তার কাজ ঠিকই করে যাচ্ছে। শিরা- উপশিরায় রক্তের উপস্থিতি স্পষ্ট টের পাচ্ছে এখন।

উঠে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে কাউন্টারের দিকে এগোলো ফুমিকো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে এখনো। ও কাউন্টারের কাছে যেতে যেতে রান্নাঘর থেকে ফিরে এলো কায়ু।

“উনি কী আসলেও ভূত?” কায়ুকে জিজ্ঞেস করলো ফুমিকো।

“হ্যাঁ,” বলে চিনিদানিতে চিনি ঢালতে শুরু করলো কায়ু।

তাহলে এই অসম্ভব ঘটনাটা আসলেও ঘটেছে… মনে মনে নিজেকে বোঝাতে শুরু করলো ফুমিকো। যদি এই ভূত…আর এই অভিশাপের বিষয়টা আসলেও সত্যি হয়ে থাকে তাহলে…অতীতে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারটাও সত্য!

সাদা ড্রেস পরিহিতা মহিলাকে জোর করে সিট থেকে সরানোর চেষ্টার ফলস্বরূপ শাস্তি ভোগ করেছে ফুমিকো। আর সেই শাস্তির অভিজ্ঞতাটাই ওর মন থেকে দূর করে দিয়েছে সব সন্দেহ। কিন্তু একটা সমস্যা আছে এখনো। অতীতে ফিরতে হলে ঐ নির্দিষ্ট সিটটাতেই বসতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সিটটায় ঐ মহিলা বসে আছে। আমার কোনো কথাই কানে যাচ্ছে না তার। জোর করে বসার চেষ্টা করলেই অভিশাপ দিবে ভূতটা। তাহলে এখন কী করবো?

“আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে,” ওর প্রশ্নের জবাবেই যেন বললো কাযু।

“মানে?”

“প্রতিদিন, নির্দিষ্ট একটা সময়ে টয়লেটে যাওয়ার জন্য সিট ছেড়ে ওঠেন উনি।”

“ভূতেদেরও টয়লেটে যেতে হয়!” কায়ুর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো ফুমিকো।

জবাবে একবার কেবল মাথা নাড়লো কায়ু। ফুমিকো কী আসলেও প্রশ্নটার উত্তর চায়, নাকি ব্যঙ্গের উদ্দেশ্যে বলেছে, তা পরিষ্কার নয়। তাই মধ্যম পন্থা হিসেবে গম্ভীর মুখে মাথা নাড়াটাই সহজ সমাধান মনে হয়েছে ওর কাছে।

লম্বা একটা শ্বাস নিলো ফুমিকো। কিছুক্ষণ আগেও সব আশা একদম ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু এতদূর এসে হাল ছাড়লে চলবে না। কথায় বলে যে ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে। এখন একটা খড় যেহেতু হাতে আটকেই গেছে, সেটাকে ছাড়া যাবে না। ছোটবেলায় গল্পে পড়েছিল যে এক লোক সামান্য একটা খড় অদলবদল করতে করতে একসময় লাখপতি হয়ে যায়। কে জানে ওর ভাগ্যে কী আছে?

“ঠিক আছে…আমি অপেক্ষা করবো!”

আচ্ছা। ওনার কাছে কিন্তু দিন বা রাতের কোনো পার্থক্য নেই, এটা মনে রাখবেন।”

“ঠিক আছে। আমি অপেক্ষা করবো,” মরিয়া ভঙ্গিতে বললো ফুমিকো। “আপনারা ক্যাফে বন্ধ করেন কখন?”

“আটটার সময়। কিন্তু আপনি যদি অপেক্ষা করতে চান, তাহলে যতক্ষণ দরকার থাকতে পারবেন।

‘ধন্যবাদ!”“

ক্যাফের মাঝের টেবিলটায় গিয়ে বসলো ফুমিকো। সাদা ড্রেস পরিহিতা মহিলার দিকে মুখোমুখি হয়ে বসেছে। বুকের ওপরে হাত ভাঁজ করে শান্ত ভঙ্গিতে শ্বাস নিলো কয়েকবার। “আমি এই সিটে বসেই ছাড়বো!” ঘোষণার সুরে বললো এরপর। ভূত ভদ্রমহিলা অবশ্য এসব আমলে নিলো না। একমনে বই পড়ে চলেছে সে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো কায়ু।

.

“হ্যালো, শুভ সন্ধ্যা!” ঘণ্টার শব্দ শুনে অভ্যাসবশত বলে উঠলো কায়ু।

“কোহতাকে!”

একজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। দেখে মনে হচ্ছে তার বয়স চল্লিশের একটু উপরে।

কোহতাকের পরনে নার্সদের ইউনিফর্ম। একটা নেভি ব্লু কার্ডিগান চাপিয়েছে ইউনিফর্মের উপরে, কাঁধে সাধারণ দর্শন ব্যাগ। থেকে থেকে হাঁপাচ্ছে সে, যেন দৌড়ে এসেছে পথটা। বুকে হাত দিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করছে এখন। “খবর দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ,” বললো সে। দ্রুত কথা বলার অভ্যাস তার।

হেসে একবার মাথা নেড়ে রান্নাঘরে উধাও হয়ে গেল কায়ু।

দুই কদম সামনে এগিয়ে দরজার কাছের টেবিলটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো কোহতাকে। ফুসাগি নামের লোকটা এখনো বসে আছে সেখানে। কোহতাকের উপস্থিতি খেয়াল করেনি সে।

“ফুসাগি,” কোমল কণ্ঠে ডাক দিলো কোহতাকে। সাধারণত বাচ্চাদের সাথে এভাবে কথা বলে সবাই।

প্রথমে কোনো প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হলো না ফুসাগির মধ্যে, যেন সে ডাকটা শুনতেই পায়নি। কিন্তু আড়চোখে যখন খেয়াল করলো যে কেউ একজন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, শূন্য দৃষ্টিতে মাথা তুলে তাকালো।

“কোহতাকে,” বিড়বিড় করে বললো সে।

“হ্যাঁ, আমি,” আগের তুলনায় স্পষ্ট সুর এবারে কোহতাকের কণ্ঠে।

“তুমি এখানে?”

“এখন ব্রেক চলছে আমার, তাই ভাবলাম এক কাপ কফি খেয়ে যাই।

ওহ…আচ্ছা,” বলে আবারো ম্যাগাজিনের দিকে মনোযোগ দিলো ফুসাগি। তার দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে বিপরীত দিকের টেবিলটায় বসে পড়লো কোহতাকে। এবারেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না ফুসাগি।

“শুনলাম তুমি নাকি এখানে প্রায়ই আসো?” প্রথমবার আসা কাস্টমারদের মতোন ক্যাফের চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে বললো কোহতাকে।

“হ্যাঁ।”

“এখানে ভালো লাগে তোমার?”

“ইয়ে মানে…ওরকম কিছু না,” মুখে এই কথাটা বললেও ফুসাগির হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে জায়গাটা আসলেও মনে ধরেছে। মুখে একটা হাসি খেলা করছে তার। “আমি আসলে অপেক্ষা করছি,” ফিসফিস করে বললো সে।

“কীসের অপেক্ষা করছো?”

চকিতে একবার ঘুরে সাদা ড্রেস পরিহিতা মহিলার দিকে তাকালো ফুসাগি। “ওনার সিট থেকে ওঠার,” কিশোরসুলভ একটা হাসি ঝুলছে তার মুখে।

কান পেতে কারো কথা শোনার অভ্যাস নেই ফুমিকোর, কিন্তু ক্যাফেটা বড্ড বেশি ছোট। “কিহ!” ফুসাগিও তার মতোন ওই মহিলার বাথরুমে যাওয়ার অপেক্ষা করছে শুনে নিজেকে আটকাতে পারলো না ও।

ফুমিকোর কণ্ঠস্বর শুনে তার দিকে ঘুরে তাকালো কোহতাকে, কিন্তু ফুসাগির মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।

“তাই নাকি?” কোহতাকে জিজ্ঞেস করলো।

“হ্যাঁ,” বলে কফির কাপে চুমুক দিলো ফুসাগি।

অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে ফুমিকোর। এখন দেখছি সিটের দখল পাওয়ার জন্য আমাকে প্রতিযোগিতাও করতে হবে।

আর প্রতিযোগিতায় শুরু থেকেই পিছিয়ে আছে সে। ফুসাগি ক্যাফেতে এসেছে তার আগে। অর্থাৎ, ভদ্রমহিলা যদি টয়লেটে যায়, তাহলে সিটে বসার অধিকারও প্রথমে তার। ফুমিকো তো হুট করে তার আগে বসে যেতে পারে না, সেটা হবে চরম অভদ্রতা। সাদা ড্রেস পরিহিতা মহিলা প্রতিদিন একবার মাত্র টয়লেটে যায়। অর্থাৎ সিটটায় প্রতিদিন কেবল একজনের বসার সুযোগ হয়।

ফুমিকো তো পারলে এখনই সিটটায় বসে অতীতে পাড়ি জমাতে চায়। আরো একটা দিন অপেক্ষা করতে হতে পারে, এই চিন্তাটা অসহনীয় ঠেকছে তার কাছে। চেষ্টা করেও নিজের অস্থিরতা ঢাকা সম্ভব হচ্ছে না। ভালোমতো ফুসাগিদের কথা শোনার জন্য আরেকটু সামনে এগিয়ে বসলো সে। লোকটা অতীতে আসলেও ফিরতে চায় কি না, এটা নিশ্চিত হবে ওকে।

“আজকে কী সিটটায় বসার সুযোগ পেয়েছিলে?” কোহতাকে জানতে চাইলো।

“নাহ।”

“ওহ, ওখানে বসতে পারোনি?”

“হ্যা…মানে, না।”

যতই দু’জনের কথোপকথন শুনছে, শঙ্কাটা আরো জেঁকে বসছে ফুমিকোর মনে।

“ফুসাগি, অতীতে ফিরে গিয়ে কী করতে চাও তুমি?”

আর কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই, ফুসাগি আসলেও সাদা ড্রেস পরিহিতা মহিলার সিটে বসে অতীতে ফেরার অপেক্ষা করছে। ফুমিকোর পরিকল্পনায় একটা বড়োসড়ো আঘাত বিষয়টা। হতাশ হয়ে আবারো টেবিলের উপরে নেতিয়ে পড়লো সে। ওদিকে কোহতাকে আর ফুসাগি কথা বলেই চলেছে।

“কিছু ঠিক করতে চাও?”

“আসলে,” কিছুক্ষণ ভাবলো ফুসাগি। “এটা আমার ব্যক্তিগত বিষয়।” বাচ্চাদের মতো একটা আত্মতুষ্টির হাসি ফুটলো তার মুখে।

“তোমার ব্যক্তিগত বিষয়?”

“হ্যাঁ।”

হাসি ফুটলো কোহতাকের মুখে, যেন মজার কিছু শুনেছে। সাদা ড্রেস পরিহিতা মহিলার দিকে তাকালো সে।

“কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে আজকে উনি টয়লেটে যাবেন না।”

এরকম কিছু শুনবে আশা করেনি ফুমিকো। দ্রুত টেবিল থেকে মাথা ওঠালো সে। এতই দ্রুত যে কান পাতলে হয়তো শব্দও শোনা যেত। তাহলে কী এটাও সম্ভব যে মহিলাটা টয়লেটে যাবে না? কায়ু তো বলছিল যে প্রতিদিন একবার হলেও সিট ছেড়ে ওঠে সে। হয়তো আজকে ইতোমধ্যেই একবার টয়লেটে গিয়ে ফিরে এসেছে…না, এমনটা হতে পারে না!

প্রার্থনা করা ছাড়া এখন আর উপায় নেই। ভয়ে ভয়ে ফুসাগির পরবর্তী কথাগুলো শোনার জন্য অপেক্ষা করছে ও।

“ঠিকই বলেছো বোধহয়,” কোহতাকের সাথে একমত পোষণ করলো ফুসাগি।

অসম্ভব! আরেকটু হলেই চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল ফুমিকো। কথাটা শুনে চোয়াল ঝুলে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে ওর। সাদা ড্রেস পরিহিতা মহিলা এখনো টয়লেটে যাচ্ছে না কেন? কোহতাকে নামের মহিলাটা কী জানে এই বিষয়ে? জবাব পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে ফুমিকো।

তবুও ওনাদের কথায় নাক গলালো না ও। কোনো কাজ করার আগে পারিপার্শ্বিকতা বিচার করতে হয়, এটা ভালো করেই জানা আছে ফুমিকোর। এই মুহূর্তে কিছু না বলাই উত্তম হবে। কারণটা জিজ্ঞেস করলে অবশ্য কিছু বলতে পারবে না, কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে কোহতাকে আর ফুসাগির কথোপকথনের মাঝে কথা বলার অধিকার নেই বাইরের কারো।

“তাহলে…আমরা উঠি এখন?” অনুরোধের সুরে বললো কোহতাকে।

“কী?”

আবারো একটা সুযোগ দেখা যাচ্ছে। সাদা ড্রেস পরিহিতা ভদ্রমহিলা টয়লেটে যাক বা না যাক, ওকে অন্তত কারো সাথে সিটে বসা নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে হবে না।

কোহতাকে যখন বললো যে ভদ্রমহিলা আজ চেয়ার ছেড়ে নাও উঠতে পারে, তার সাথে একমত পোষণ করে ফুসাগি। ঠিকই বলেছো বোধহয়। ‘বোধহয়’ শব্দটা উচ্চারণ করে সে, অর্থাৎ কোহতাকের ধারণা ঠিক নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে হয়তো আরো অপেক্ষা করবে ফুসাগি। ফুমিকো হলে সেটাই করত। লোকটার জবাব শোনার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে আছে সে এখন। তবে চেহারা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে।

একবার ভূত ভদ্রমহিলার দিকে তাকালো ফুসাগি, এরপর বললো, “ঠিক আছে, চলো।”

পরিষ্কার জবাবটা শুনে আবারো উত্তেজিত হয়ে উঠলো ফুমিকো। বুকের ধড়ফড়ানি বেড়ে গেছে।

“তুমি তোমার কফি শেষ করো। এরপর বের হবো আমরা,” ফুসাগির কাপের কফির দিকে নির্দেশ করে বললো কোহতাকে।

কিন্তু ফুসাগির আর অপেক্ষা করতে ইচ্ছা করছে না। “ওটুকু থাক। ঠান্ডা হয়ে গেছে,” কাপা কাপা হাতে ম্যাগাজিন, নোটবুক আর পেনসিল তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। চেয়ারের ঝোলানো জ্যাকেটটা তুলে নিলো। কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কাররা এই ধরনের জ্যাকেট পরে সাধারণত। ধীর পদক্ষেপে কাউন্টারের দিকে এগোলো সে। ঠিক সেই সময়েই রান্নাঘর থেকে বের হলো কায়ু। যেন সে জানতো ফুসাগি আসবে।

“বিল কত হয়েছে?”

একটা প্রাগৈতিহাসিক ক্যাশ রেজিস্টারে বিলের পরিমাণ চাপলো কায়ু। এদিকে ফুসাগি তার শার্টের পকেট, প্যান্টের পকেট, ব্যাগ হাতড়েই চলেছে। কিছু একটা খুঁজছে সে।

“অদ্ভুত তো, আমার মানিব্যাগ…” বিড়বিড় করে বললো লোকটা।

মনে হচ্ছে মানিব্যাগ ছাড়াই ক্যাফেতে এসে পড়েছে সে। একই জায়গায় কয়েকবার করে খুঁজেও জিনিসটা পেলো না সে। চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো চেহারায়, দেখে মনে হচ্ছে বুঝি কেঁদেই দিবে।

এসময় হঠাৎ মানিব্যাগ হাতে এগিয়ে এলো কোহতাকে।

“এই যে।”

বহুল ব্যবহৃত একটা চামড়ার মানিব্যাগ। ভেতরে নানা রকম রসিদে ঠাসা। থমকে গিয়ে কোহতাকের হাতের মানিব্যাগটা দিকে তাকালো ফুসাগি। চোখে তন্ময় দৃষ্টি। বেশ কিছুক্ষণ পর নীরবে হাত বাড়িয়ে মানিব্যাগটা নিলো সে।

“বিল কত হয়েছে?” কয়েন পার্সের ভেতরে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো ফুসাগি।

কিছু না বলে পাশে তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কোহতাকে, দৃশ্যটা দেখছে একমনে।

“তিনশো আশি ইয়েন।”

একটা কয়েন বের করে কায়ুর হাতে দিলো ফুসাগি। “এই যে, পাঁচশো ইয়েন…”

কায়ু টাকাটা নিয়ে ক্যাশ রেজিস্টারে নামিয়ে রাখলো। এরপর ড্রয়ার থেকে খুচরা টাকা বের করে রিসিট সমেত সামনে এগিয়ে ধরলো। “এই নিন আপনার একশো বিশ ইয়েন।”

“কফির জন্য ধন্যবাদ,” ভাংতি টাকা মানিব্যাগে রাখতে রাখতে বললো ফুসাগি। এরপর মানিব্যাগটা ব্যাগে ঢুকিয়ে দরজার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো, যেন ভুলেই গেছে কোহতাকের কথা।

.

ফুসাগির এরকম আচরণে একটুও বিরক্ত মনে হলো না কোহতাকে’কে। “ধন্যবাদ,” বলে তার পিছু নিলো সে।

.

“অদ্ভুত,” বিড়বিড় করে বললো ফুমিকো।

ফুসাগির টেবিলটা মুছে নিয়ে আবারো রান্নাঘরে উধাও হয়ে গেল কাযু হঠাৎ করেই একজন প্রতিযোগীর মুখোমুখি হওয়ায় মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল ফুমিকোর। কিন্তু এখন আবারো উদ্যম ফিরে পেয়েছে সে। গোটা ক্যাফেতে সে আর সাদা ড্রেসের মহিলাটা ছাড়া আর কেউ নেই। জয়মাল্য তার গলাতেই ঝুলবে আজকে।

কেউ আর এখন পাল্লা দেবে না আমার সাথে। বসে বসে শুধু অপেক্ষা করতে হবে, ভাবলো সে। ক্যাফেটায় কোনো জানালা নেই, তিনটা ঘড়ি তিন রকম সময় দেখাচ্ছে। কোনো কাস্টমারও আসছে না অনেকক্ষণ যাবৎ। সময়ের হিসেব তাই গুলিয়ে ফেলেছে ফুমিকো।

বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনি এসে গেলে অতীতে ফিরে যাবার নিয়মগুলো আবারো মনে মনে ঝালিয়ে নিলো সে।

প্রথম নিয়ম-এই ক্যাফেতে যারা পা রেখেছে, অতীতে ফিরে গেলে কেবল তাদের সাথেই দেখা হতে পারে। ফুমিকো আর গোরোর শেষ আলাপ এই ক্যাফেতেই হয়েছিল।

দ্বিতীয় নিয়ম-অতীতে ফিরে গিয়ে কেউ যতই চেষ্টা করুক না কেন, বর্তমানের কোনো কিছু পরিবর্তন করতে পারবে না। অন্যভাবে বললে, ফুমিকো এক সপ্তাহ আগে ফিরে গিয়ে গোরোকে আমেরিকায় না যাওয়ার অনুনয় করলেও আদতে কোনো লাভ হবে না। এই নিয়মটা মেনে নিতে কষ্টই হচ্ছে ওর। কিন্তু নিয়ম তো নিয়মই।

তৃতীয় নিয়ম-অতীতে ফিরতে হলে, নির্দিষ্ট একটা সিটে বসতে হবে। এই মুহূর্তে সাদা পোশাকের মহিলাটা বসে আছে ওখানে। জোর করে বসতে গেলে তার অভিশাপের সম্মুখীন হতে হবে।

চতুর্থ নিয়ম-অতীতে ফিরে যাওয়ার পর, নির্দিষ্ট সিটটা ছেড়ে ওঠা যাবে না। অর্থাৎ, অতীতে ফেরার পর একবার টয়লেটেও যেতে পারবে না কেউ।

পঞ্চম নিয়ম-একটা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ফিরে আসতে। এই নিয়মটার ব্যাপারে এখনো খুব বেশি কিছু বলা হয়নি ওকে। সময়সীমাটা কম নাকি বেশি, এই বিষয়েও কোনো ধারণা নেই তার। নিয়মগুলো নিয়ে বারবার ভাবতে লাগলো ফুমিকো। একবার মনে হলো যে এসব নিয়ম মাথায় নিয়ে অতীতে ফিরে কোনো লাভ নেই। আবার পরমুহূর্তেই মনে হলো, অতীতে ফিরে এবার যা বলার সে-ই বলবে। বর্তমানে কোনো পরিবর্তন তো হচ্ছে না, তাহলে ইচ্ছামতোন কথা শোনাতে দোষ কোথায়? এসব নিয়ে চিন্তা করতে করতে একসময় টেবিলের উপরেই ঘুমিয়ে পড়লো ফুমিকো।

.

তৃতীয় ডেইটে গিয়ে গোরোর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রথমবার জানতে পেরেছিল ফুমিকো। গোরো হচ্ছে গেইসিংয়ের পাগল। বিশেষ করে মাল্টিপ্লেয়ার অনলাইন রোল-প্লেয়িং গেইমগুলোর পাড় ভক্ত সে। সময় পেলেই কম্পিউটারের সামনে বসে পড়তো। তার চাচা আবার ‘আর্ম অফ ম্যাজিক’ নামের বিশ্ববিখ্যাত গেইমটার ডেভেলপারদের একজন। ছোট থেকেই চাচার মতো হতে চেয়েছে গোরো। তার স্বপ্ন চাচার দেওয়া গেইম কোম্পানিটায় যোগ দেওয়া। টিপ-জি। এই কোম্পানিতে নিয়োগ পরীক্ষা দিতে হলে দু’টো অভিজ্ঞতা থাকা আবশ্যকীয়। ১-মেডিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে সিস্টেমস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ন্যূনতম পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা আর ২-নিজের ডেভেলপ করা একটা অপ্রকাশিত গেমিং প্রোগ্রাম। মেডিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি সরাসরি মানুষের জীবনমরণের সাথে জড়িত। সুতরাং এই ইন্ডাস্ট্রিতে ভুলের কোনো সুযোগ নেই। ছোটখাটো সব ভুলও জহুরির চোখে বের করে আনতে হয়। একইভাবে অনলাইন গেমিং ইন্ডাস্ট্রিতেও কোনো প্রকার বাগ সহ্য করা হয় না। কোনো বাগের রিপোর্ট পেলে যত দ্রুত সম্ভব সেটার সমাধান করে নতুন আপডেট ছাড়তে হয় বাজারে।

টিপ-জি কোম্পানিটা একটু অন্যরকম। তারা শুধু মেডিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা লোকদেরই চাকরি দেয়, কারণ তাদের দরকার একদম সেরা সব প্রোগ্রামার। গোরো যখন এই কথাগুলো ফুমিকোকে বলছিল, হাসিমুখেই সব শুনেছিল ও। একটা বিষয় তখন অজানা ছিল ওর, টিপ-জি’র হেডকোয়ার্টার আমেরিকায়।

সপ্তম ডেইটে, ফুমিকো গোরোর জন্য অপেক্ষা করছিল এক জায়গায় দাঁড়িয়ে, এসময় দু’জন লোক ওর সাথে গায়ে পড়ে কথা বলতে শুরু করে। এরকম ঘটনা ফুমিকোর জন্য নতুন কিছু নয়, পুরুষেরা বরাবরই সখ্যতা গড়ে তোলার চেষ্টা করে ওর সাথে। এদের সামলানোর কৌশলও জানা আছে। লোক দু’জন দেখতে খুব একটা খারাপ না হলেও, তাদের প্রতি কোনো আকর্ষণ বোধ করে না ফুমিকো। এসময় গোরো চলে আসে সেখানে। অস্বস্তিভরে একপাশে দাঁড়িয়ে সব শোনে সে। ফুমিকো দ্রুত এগিয়ে যায় তার দিকে। কিন্তু লোক দু’টো গোরোকে কথা শোনাতে ছাড়েনি। ‘এই ছাগলটার গলায় গিয়ে ঝুলেছে, দেখো’। ব্যস, নিজের মোক্ষম অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে যায় ফুমিকো।

গোরো অবশ্য মাথা নিচু করে রাখে সেদিন, কিছু বলেনি। কিন্তু ফুমিকো উলটো দিকে ঘুরে বলে ‘ওর কী যোগ্যতা, তা আপনারা বুঝবেন না কোনদিন’ (ইংরেজিতে), ‘চাকরিতে সবচেয়ে কঠিন সমস্যার সমাধান নিজেকে করে সে’ (ফরাসিতে), ‘কখনো হাল ছাড়ে না’ (গ্রিকে), ‘অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতা আছে ওর’ (ইতালিয়ানে), ‘নিজেকে এই অবস্থানে আনতে অনেক পরিশ্রম করেছে ও’ (রাশিয়ানে), ‘আমার চেনা অন্য সবার চাইতে ওর যোগ্যতা অনেক বেশি’ (স্প্যানিশে)। এরপর জাপানিজে সে বলে, “এতক্ষণ আমি যা বললাম, তা যদি আপনারা না বুঝে থাকেন, তাহলে আমার সাহচর্য পাবার যোগ্যতা নেই আপনাদের।”

হতভম্ব দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওখান থেকে দ্রুত কেটে পড়ে লোক দু’জন।

উজ্জ্বল হেসে গোরোর দিকে তাকায় ফুমিকো। “তুমি নিশ্চয়ই আমার সব কথা বুঝেছো?” এবারে পর্তুগিজ ভাষায় কথাটা বলে সে।

লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে তার প্রেমিক।

দশম ডেটে গোরো স্বীকার করে যে এর আগে কখনো কারো সাথে সম্পর্কে জড়ায়নি সে।

“ওহ, তাহলে আমিই তোমার জীবনের প্রথম প্রেম?” হাসিমুখে বলে ফুমিকো। ‘প্রেম’ কথাটা সেদিনই প্রথমবারের মতো উচ্চারণ করে সে। গোরোর চোখজোড়া বড় বড় হয়ে যায়। সেই রাতই ছিল ওদের সম্পর্কটার প্রথম সোপান।

.

বেশ কিছুক্ষণ ধরেই ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছে ফুমিকো। এসময় হঠাৎই হাতের বইটা শব্দ করে টেবিলে নামিয়ে রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ভদ্রমহিলা। এরপর ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে উঠে দাঁড়িয়ে ধীর পদক্ষেপে এগোতে থাকলো টয়লেটের দিকে।

ঘুমিয়ে থাকার কারণে ফুমিকো খেয়াল করেনি যে সিটটা খালি হয়েছে। পেছনের ঘর থেকে কায়ু বের হয়ে এলো এসময়। এখনো ইউনিফর্ম পরে আছে সে-একটা সাদা শার্ট, কালো রঙের বো-টাই, ওয়েস্টকোট, কালো ট্রাউজার আর একটা অ্যাপ্রন। টেবিল পরিষ্কার করতে করতে ফুমিকোকে ডাক দিলো সে।

“ম্যাডাম। ম্যাডাম।”

“হ্যাঁ? কী?” তুফানের বেগে সোজা হয়ে বসলো ফুমিকো। কিছুক্ষণ চোখ পিটপিট করে চারদিকে তাকানোর পর বুঝতে পারলো যে কী পরিবর্তন এসেছে ক্যাফেতে। সাদা পোশাক পরিহিতা মহিলা টেবিলে নেই।

“ওহ!”

“সিটটা এখন খালি। আপনি কী বসতে চান?”

“অবশ্যই!” ফুমিকো বললো।

দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে অতীতে ফিরে যাওয়ার চেয়ারটায় কাছে চলে গেল সে। দেখতে আর দশটা সাধারণ চেয়ারের মতোনই। কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। দাঁড়িয়ে থেকে চেয়ারটা দেখতে দেখতে হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠলো ওর। সব প্রতিবন্ধকতা পার করে অবশেষে লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে সে।

“ঠিক আছে তাহলে, আমাকে অতীতে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন এখন।”

লম্বা একটা শ্বাস নিলো সে। নিজেকে আরেকটু গুছিয়ে নিয়ে বসে পড়লো চেয়ারে। ওর মনে হচ্ছিল যে চেয়ারে বসার সাথে সাথে বুঝি এক সপ্তাহ পেছনে চলে যাবে। তাই স্বাভাবিকভাবেই উত্তেজনার মাত্রা অনেক বেশি, সেই সাথে কাজ করছে উদ্‌বেগ।

“এক সপ্তাহ পিছিয়ে যাক সবকিছু!” বললো সে।

আশাতুর চোখে ক্যাফের চারপাশে তাকালো সে। জানালা না থাকায় বোঝা যাচ্ছে না যে এখন দিন নাকি রাত। পুরানো তিনটা দেওয়ালঘড়ি দেখেও কিছু আন্দাজ করা যাচ্ছে না। কিছু একটা তো নিশ্চয়ই বদলে গেছে। আবারো চারধারে নজর বুলালো ফুমিকো, কিন্তু কোনো পরিবর্তন চোখে পড়লো না এবারেও। ও যদি এক সপ্তাহ আগে ফিরেই গিয়ে থাকে, তাহলে তো গোরো এখানে থাকার কথা।

“আমি বোধহয় অতীতে ফিরিনি,” বিড়বিড় করে বললো ফুমিকো। এখন যদি দেখা যায় অতীতে ফেয়ার গোটা বিষয়টাই ধাপ্পাবাজি, তাহলে…

কান্নায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে ওর, ঠিক এমন সময় কায়ু এসে হাজির হলো সেখানে। হাতে করে একটা রুপালি রঙের ট্রে নিয়ে এসেছে সে। ট্রে’র উপরে রুপালি কেতলি আর সাদা রঙের কফি কাপ

“আমি এখনো অতীতে ফিরিনি!” আর থাকতে না পেরে বললো ফুমিকো।

বরাবরের মতোনই নির্মোহ অভিব্যক্তি কাযুর। “আরেকটা নিয়ম আছে,” নিস্পৃহ স্বরে বললো সে।

ধ্যাত! আরো একটা নিয়ম। শুধু চেয়ারে বসলেই হবে না! ফুমিকোর এখন আর কিছু ভালো লাগছে না। “আরো নিয়ম আছে?” বললো সে। তবে কিছুটা স্বস্তিও পেয়ছে। এর মানে এখনো অতীতে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

ফুমিকোর অবশ্য কোনো বিকার নেই। “আপনাকে এক কাপ কফি ঢেলে দিব কিছুক্ষণের মধ্যে,” ওর সামনে একটা কাপ রাখতে রাখতে বললো সে।

“কফি? কফি কেন?”

“কাপে কফি ঢালার সাথে সাথে আপনার অতীত ভ্রমণ শুরু হবে,” প্রশ্নটা আমলে না নিয়ে বললো কায়ু। ফুমিকো অবশ্য অতীতে ভ্রমণের কথাটা শোনা মাত্র আগ্রহী হয়ে উঠেছে। “এবং আপনাকে অবশ্যই কফি ঠান্ডা হবার পূর্বেই ফিরে আসতে হবে।”

সব আশা আবারো ধোঁয়াশায় পরিণত হলো ফুমিকোর। “কী? এত তাড়াতাড়ি?”

“শেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়মটা হচ্ছে…”

কথা দেখি শেষই হচ্ছে না। ফুমিকোর আর তর সইছে না। “খালি নিয়ম আর নিয়ম…” কফি কাপটা শক্ত করে আকড়ে ধরে বললো সে। অতি সাধারণ একটা কাপ, কে বলবে এই কাপটাই পারবে কাউকে অতীতে নিয়ে যেতে। গতানুগতিক চীনামাটির বাসন তুলনায় একটু বেশিই শীতল ঠেকলো কাপটা।

“আপনি কী আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?” কায়ু বললো। “অতীতে ফিরে যাওয়ার পর, কাপের সবটুকু কফি শেষ করতে হবে আপনাকে।”

“আসলে, আমার কফি খুব একটা ভালো লাগে না।”

বিস্ফারিত নয়নে ওর দিকে তাকালো কায়ু। এরপর সামনে এগিয়ে এসে নিচু কণ্ঠে বললো, “এই নিয়মটা আপনাকে মানতেই হবে।”

“তাই?”

“আর যদি না মানেন, খুব খারাপ কিছু ঘটে যাবে আপনার সাথে…”

“ক-কি?”

অস্বস্তিতে ভুগতে শুরু করেছে ফুমিকো। এরকম কিছু আশা করেনি সে। সময় পরিভ্রমণ বিষয়টাই প্রকৃতির নিয়ম বিরোধী, সুতরাং ঝুঁকি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এরকম চরম মুহূর্তে এসে সেই বিষয়ে কিছু বলবে কাযু, এটা ভাবেনি। তবে তার মানে এটা নয় যে উলটোদিকে ঘুরে দৌড় দিবে, বিশেষ করে এতদূর আসার পর। শঙ্কিত দৃষ্টিতে কায়ুর চোখের দিকে তাকালো সে।

“কী? কী হবে?”

“আপনি যদি ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার আগে কাপের সবটুকু কফি না শেষ করেন…”

“যদি না শেষ করি…?”

“তাহলে এরপরে সারা দিনরাত এই সিটে বসে থাকার পালা হবে আপনার, ভূত হয়ে।”

চমকে উঠলো ফুমিকো। “আসলেই?”

“কিছুক্ষণ আগেও এখানে যে ভদ্রমহিলা বসে ছিল…”

“নিয়ম ভেঙেছিল সে?”

“হ্যাঁ। মৃত স্বামীর সাথে দেখা করতে অতীতে পাড়ি দিয়েছিলেন উনি। কিন্তু সময়ের দিকে খেয়াল ছিল না নিশ্চয়ই। যতক্ষণ ভুল বুঝতে পারে, কফি ঠান্ডা হয়ে যায়।”

“…আর সে পরিণত হয় একটা ভূতে?”

যা ভেবেছিলাম, সেই তুলনায় ঝুঁকি অনেক বেশি, ফুমিকো ভাবলো। এত বিরক্তিকর সব নিয়ম। আজকের দিনটায় কেবল একটা ভূতের মুখোমুখিই হয়নি ও, তার দ্বারা অভিশপ্তও হয়েছে। তবে এখন কায়ু যা বললো, এর চেয়ে বিপজ্জনক আর কিছু হয় না।

বেশ, তাহলে অতীতে ফিরতে পারবো আমি। কিন্তু কাপের কফি ঠান্ডা হবার আগেই ফিরে আসতে হবে। কফি ঠান্ডা হতে কতক্ষণ লাগে, সেটা সঠিক জানা নেই আমার। তবে খুব বেশিক্ষণ লাগার কথা না। কফিটা যতই বিস্বাদ হোক না কেন, পুরোটা খেতে হবে আমাকে। আর যদি না খেতে পারি, তাহলে ভূত হয়ে বসে থাকতে হবে এখানে সারাজীবন—এই বিষয়টা একটু কেমন যেন। অতীতে গিয়ে আমি কোনো কিছু বদলাতে পারবো না, সুতরাং সেদিক থেকে কোনো ঝুঁকি নেই। অর্থাৎ, সব নিয়ম মেনে চললে আমার কোনো লাভ হবে না, আবার কোনো ক্ষতিও হবে না। তবে ভূত হয়ে গেলে, সেটা অবশ্যই ক্ষতিকর।

নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠলো ফুমিকোর শরীর। হাজারো শঙ্কা ভিড় জমিয়েছে ওর মাথায়। এর মধ্যে প্রথমটা হচ্ছে, কায়ুর দেওয়া কফিটা খেতে নিশ্চয়ই জঘন্য হবে। অবশ্য এই সামান্য ব্যাপারটা ওকে টলাতে পারবে না। কিন্তু কফিটায় যদি গোলমরিচ দেওয়া থাকে? কিংবা ওয়াসাবি ফ্লেভারের কফি হলে? এরকম এক কাপ কফি কীভাবে খাবো আমি?

একটু অতি-কল্পনা করে ফেলছে, এটা বোঝার পর মাথা ঝাঁকিয়ে মন থেকে দুশ্চিন্তাগুলো ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলো ফুমিকো।

“ঠিক আছে। আমাকে কফি ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার আগেই ফিরে আসতে হবে, তাই তো?”

“হ্যাঁ।”

নিজেকে পুরোপুরি তৈরি করে নিয়েছে ও। কিংবা বলা যায়, জেদ চেপে গেছে। যে করেই হোক, অতীতে ফিরবেই।

আগের ভঙ্গিতেই পাশে দাঁড়িয়ে আছে কায়ু। এখন যদি ফুমিকো হঠাৎ বলে বসে, সরি, আমি অতীতে ফিরতে ইচ্ছা করছে না, তাহলেও অভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন হবে না মেয়েটার। কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করে কোলের উপরে হাত নিয়ে এলো ফুমিকো। লম্বা করে শ্বাস টানলো কয়েকবার, যেন প্রাণায়ামে বসেছে।

“আমি তৈরি,” কিছুক্ষণ পর কায়ুর চোখে চোখ রেখে আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বললো ও।

জবাবে একবার আলতো মাথা নেড়ে ট্রে থেকে রুপালি কেতলিটা তুলে নিলো। শান্ত দৃষ্টিতে ফুমিকোর দিকে তাকিয়ে বললো, “মনে রাখবেন। ঠান্ডা হবার পূর্বেই কফিটা খেয়ে নিতে হবে।”

কাপে কফি ঢালতে শুরু করলো কায়ু। একদম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কাজটা করলেও ফুমিকোর মনে হচ্ছে মেয়েটা কোনো পবিত্র আচার পালন করছে।

কাপ থেকে ধোঁয়া উড়তে শুরু করা মাত্র ফুমিকোর মনে হলো তার চারপাশের পৃথিবী দুলছে। বাষ্পের সাথে একীভূত হয়ে গেল সবকিছু। ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো ও। নিজেকে এখন ধোঁয়ার অংশ মনে হচ্ছে তার, ঠিক ওভাবেই দুলছে। হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে ফেললো শক্ত করে। এরকমটা চলতে থাকলে তো আমি অতীত কিংবা বর্তমান, কোথাওই যেতে পারবো না। স্রেফ ধোঁয়ায় মিলিয়ে যাব। বেশি উদ্‌বিগ্ন বোধ করায় গোরোর সাথে প্রথম সাক্ষাতের দিনটা মনে করার চেষ্টা করলো ও।

.

গোরোর সাথে ফুমিকোর দেখা হয় দুই বছর আগের বসন্তে। ওর বয়স ছিল তখন ছাব্বিশ, গোরোর চাইতে তিন বছর বেশি। দু’জনই কাজের খাতিরে একই অফিসে বসতো, কিন্তু তাদের কোম্পানি ছিল আলাদা আলাদা। প্রজেক্ট ডিরেক্টরের দায়িত্ব বর্তায় ফুমিকোর কাঁধে। খণ্ডকালীন চুক্তিতে যোগ দেওয়া কর্মীদের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ন করত সে।

কারো কোনো কাজ নিয়ে আপত্তি থাকলে সামনাসামনি সেই বিষয়ে কথা বলতে কখনোই পিছপা হয়নি ফুমিকো; হোক সেটা কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার প্রজেক্ট। এমনকি বয়স্ক সহকর্মীদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে তর্কও হয়েছে তার। কিন্তু কেউ কখনো তার সম্পর্কে একটা খারাপ কথাও বলেনি। ডিরেক্টর হিসেবে সে ছিল সৎ এবং স্পষ্টভাষী। এরকম উদ্যমী একজন কর্মীকে সবাই পছন্দ করবে, এটাই স্বাভাবিক।

গোরোর বয়স তখন তেইশ হলেও, তাকে দেখে মনে হতো বুঝি ত্রিশের কাছাকাছি কেউ। অর্থাৎ, ফুমিকোর চেয়ে অনেক বয়স্ক দেখাতো তাকে। প্রথম দিকে তাই যথেষ্ট বিনয়ী ভঙ্গিতেই তার সাথে কথা বলতো ফুমিকো, বয়সে বড়দের সাথে সচরাচর সে যেভাবে কথা বলে আর কী। তবে গোটা টিমটায় গোরোর বয়স সব চেয়ে কম হলেও, সে-ই ছিল সবচেয়ে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার। চুপচাপ নিজের কাজ করে যেত। অল্পদিনেই ফুমিকো বুঝে যায় যে ছেলেটা ভরসার যোগ্য।

ফুমিকোদের প্রজেক্টের কাজটা দেখতে দেখতে শেষ হয়ে আসে। কিন্তু ডেলিভারি ডেডলাইনের ঠিক আগ দিয়ে একটা বাগ পাওয়া যায় মূল প্রোগ্রামে। আর মেডিক্যাল সিস্টেমসের প্রোগ্রামিংয়ে সাধারণ বাগও যথেষ্ট ক্ষতিসাধনে সক্ষম। এরকম অবস্থায় ডেলিভারি দেওয়ার কথা চিন্তাই করা যায় না। কিন্তু বাগের কারণটা খুঁজে বের করা খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতোনই। তার উপর হাতে সময় একদমই ছিল না।

প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে সব শর্তাদি মেনে প্রোডাক্ট সময়মতো ডেলিভারি দেওয়ার দায়িত্ব ফুমিকোর কাঁধেই বর্তায়। এক সপ্তাহ পরে ডেডলাইন, অথচ এরকম প্রোগ্রামে বাগের কারণ খুঁজে বের করে ঠিক করতে করতে অন্তত এক মাসের মতোন সময় লেগে যায়। ফুমিকো একবার ভাবে কাজে ইস্তফা দিয়ে দিবে। এই ডামাডোলের মধ্যে হঠাৎই কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে যায় গোরো, তার সাথে যোগাযোগও করা যায় না। অনেকে বলাবলি শুরু করে যে বাগটার জন্য সে-ই দায়ী। আর এজন্যেই মুখ লুকিয়ে আছে।

তবে এই দাবির স্বপক্ষে কারো কাছে কোনো প্রমাণ ছিল না। কিন্তু এরকম কোনো প্রজেক্ট মুখ থুবড়ে পড়লে সাধারণত নির্দিষ্ট কাউকে বলির পাঁঠা বানানো হয়। আর গোরো সেখানে উপস্থিত না থাকায় কাজটা আরো সহজ হয়ে যায়। ফুমিকোও সন্দেহ করে তাকে। কিন্তু চারদিন উধাও থাকার পর হঠাৎ করে উদয় হয় গোরো। বলে যে বাগটা খুঁজে পেয়েছে সে।

এই ক’দিনে শেভ করেনি সে, গা দিয়েও দুর্গন্ধ বেরুচ্ছিল। কিন্তু সেই বিষয়ে কেউ একটা কথাও বলেনি তাকে। তার ক্লান্ত চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে গত কয়েকদিন ঘুমায়নি। যেখানে ফুমিকোসহ প্রজেক্টের অন্যান্য সদস্যরা হাল ছেড়ে দিয়েছিল, সেখানে গোরো একাই সমস্যাটা খুঁজে বের করেছে। এটাকে বিস্ময়কর বললেও কম বলা হবে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়াটা অবশ্য অফিসের নিয়মের পরিপন্থি। তবুও, অন্যান্য সবার চাইতে কাজের প্রতি বেশি একাগ্রতা প্রদর্শন করেছে সে। প্রোগ্রামার হিসেবেও নিজের দক্ষতার প্রম দিয়েছে আবারো।

ফুমিকো মন থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে জবাবে কেবল হেসে একবার বাউ করে গোরো। অনর্থক সন্দেহের জন্য মাফও চায় ও।

“আচ্ছা ঠিক আছে, একদিন আমাকে তাহলে কফি খাওয়াবেন আপনি,” গোরো বলে জবাবে।

ঠিক সেই মুহূর্তেই তার প্রেমে পড়ে যায় ফুমিকো।

প্রোগ্রামটা ডেলিভারি দেওয়ার পর আবার যার যার কর্মস্থলে ফিরে যায় ওরা। দেখা বলতে গেলে হতোই না। কিন্তু ফুমিকো অন্য ধাতে গড়া। শত ব্যস্ততার মাঝেও সময় বের করে গোরোর সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে বের হতো সে। কফির কথা বলতো প্রতিবারই।

গোরো তার কাজের প্রতি সবসময় নিবেদিতপ্রাণ। কোনো লক্ষ্যে কাজ শুরু করলে, তাকে সেই লক্ষ্য থেকে হটানো সম্ভব নয় কারো পক্ষে। টিপ- জি’র হেডকোয়ার্টার যে আমেরিকায়, এটা ফুমিকো প্রথম জানতে পারে গোরোর বাড়িতে পা দিয়ে। টিপ-জি নিয়ে কথা বলার সময় চোখেমুখে যেরকম আবেগ খেলা করে গোরোর, তা দেখে কিছুটা শঙ্কিতই হয়ে ওঠে ও। যদি ও স্বপ্নের চাকরিটা পেয়ে যায়, তাহলে কাকে বেছে নেবে? আমাকে নাকি ওর স্বপ্নকে? নাহ, এসব ভাবা ঠিক হচ্ছে না আমার। কিন্তু…

ধীরে ধীরে গোরোর জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে ফুমিকো। এরকম মুহূর্তে প্রেমিককে হারানোর কথা চিন্তাই করতে পারে না সে। সময় বয়ে যায় সময়ের মতো। এই বসন্তের শুরুতে টিপ-জি’র কাছ থেকে পরম আকাঙ্ক্ষিত ই-মেইলটা পায় গোরো। তার স্বপ্ন হাতছানি দিয়ে ডাকে তাকে।

ফুমিকোর দুশ্চিন্তাটুকু আসলে যৌক্তিকই ছিল। আমেরিকাই বেছে নেয় গোরো। নিজের স্বপ্নের মূল্য তার কাছে অনেক বেশি। এক সপ্তাহ আগে এই ক্যাফেতে বসেই সবকিছু জানতে পারে ও।

.

চোখ খোলে ফুমিকো। মনে হয় যেন এতক্ষণ কোনো স্বপ্ন দেখছিল, কেবলই ঘুম ভেঙেছে। এরকম অনুভূতি আগে কখনো হয়নি তার। কিছুক্ষণ আগেও নিজেকে ধোঁয়ার অংশ মনে হচ্ছিল। মুক্ত আত্মার মতোন ভেসে বেড়াচ্ছিল চারপাশে, কিন্তু এখন নিজের শরীর অনুভব করতে পারছে আগের মতোন। সবকিছু স্বাভাবিক হবার পর ফুমিকো খেয়াল করলো যে এক বিভ্রান্ত যুবক তাকিয়ে আছে তার দিকে।

গোরো। অথচ তার এখন আমেরিকাতে থাকার কথা। আসলে ও অতীতে চলে এসেছে ও! গোরোর চেহারায় খেলা করা বিভ্রান্তির কারণ এখন স্পষ্ট ফুমিকোর কাছে। ক্যাফের সবকিছু একদম এক সপ্তাহ আগের মতোন।

ফুসাগি নামের লোকটা দরজার কাছের টেবিলটায় ম্যাগাজিন খুলে বসে আছে। হিরাই বসেছে কাউন্টারের উলটোদিকে। কায়ুও আছে তার জায়গায়। আর ফুমিকোর উলটোদিকে বসেছে গোরো, সেদিন ওরা যে টেবিলে বসেছিল, সেখানে।

তবে একটা জিনিস আগের মতোন নেই। ফুমিকোর নিজের অবস্থান। এই মুহূর্তে ওই সাদা ড্রেস পরিহিতা মহিলার সিটটায় বসে আছে সে। অর্থাৎ, গোরো বসে আছে ওর পাশের টেবিলটায়। এখানে বসেও প্রেমিককে ঠিকঠাকই দেখতে পাচ্ছে ফুমিকো।

বিষয়টা যতই অস্বাভাবিক হোক, ফুমিকো ওর সিট ছেড়ে নড়তে পারবে না। এটাই অতীত পরিভ্রমণের নিয়মগুলোর একটা। কিন্তু ও যদি জিজ্ঞেস করে, আমি এখানে বসে আছি কেন? তখন কী বলবো? বিষয়টা ভেবে একবার ঢোক গিললো ফুমিকো।

“আহ-হা, দেরি হয়ে গেছে। আমাকে উঠতে হবে এখন,” ওদের অবস্থান পরিবর্তিত হলেও, আজকেও ঠিক আগের কথাটাই বলে গোরো। এটাও বোধহয় অতীত পরিভ্রমণের একটা নিয়ম।

“ওহ, ঠিক আছে। তোমার হাতে বোধহয় খুব বেশি সময় নেই, তাই না? আমার হাতেও সময় নেই।”

“কী?”

“সরি?”

দু’জন দুই বিষয়ে কথা বলছে। ফুমিকো অবশ্য জানে যে ঠিক কোন মুহূর্তটায় ফিরে এসেছে ও, তবুও মনে মনে কিছুটা বিচলিত বোধ করছে। হাজার হোক, এই প্রথম অতীতে এসেছে।

নিজেকে সামলানোর জন্য কফি কাপে একবার চুমুক দিয়ে গোরোর দিকে তাকালো।

ঈশ্বর! কফি তো দেখি এর মধ্যেই অনেকটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আর খুব বেশি সময় নেই।

এখন ভয় কাজ করছে ফুমিকোর মধ্যে। কফিটা যেরকম গরম, চাইলেই ঢকঢক করে গিলে ফেলতে পারে ও। শুধু তাই নয়…

“এত…তিতা।”

যতটা ভেবেছিল তার তুলনায় অনেক বেশি তিতা। এরকম তিতা কফি আগে কখনো খায়নি ও।

ফুমিকোর অদ্ভুত কথাবার্তা শুনে বিভ্রান্তির পরিমাণ আরো বেড়ে গেল গোরো। ডান ভ্রুর উপরে হাত বুলিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো সে। ফুমিকো বুঝতে পারছে সবকিছু। ওর নিজেরও তাড়া আছে।

“তোমাকে জরুরি একটা কথা বলতে চাই,” দ্রুত কথাগুলো বলে সামনে রাখা চিনিদানি থেকে কফিতে চিনি ঢালে ফুমিকো। এরপর পরিমাণ মতো দুধ ঢেলে চামচ দিয়ে নাড়তে থাকে।

“কী?” ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে গোরো।

ভ্রু কুঁচকানোর কারণটা অবশ্য বুঝতে পারে না ফুমিকো। ও বেশি চিনি খেয়ে ফেলছে, এইজন্যে? নাকি এই মুহূর্তে জরুরি কোনো কথা শুনতে চায় না সে?

“আসলে…আমি গোটা বিষয়টা নিয়ে ঠিক মতোন কথা বলতে চাই।” আবারো ঘড়ির দিকে তাকালো গোরো।

“এক সেকেন্ড…” বলে কফির কাপে চুমুক দেয় ফুমিকো। সন্তুষ্টির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। গোরোর সাথে পরিচয় হবার আগে কখনো কফি খাওয়ার অভ্যাস ছিল না ওর। কিন্তু এই কফির সূত্র ধরেই ওদের সম্পর্কের শুরু। ফুমিকো, যে কি না কফি অপছন্দ করে, তাকে কাপের মধ্যে তাড়াহুড়ো করে চিনি আর দুধ মেশাতে দেখে শুকনো একটা হাসি ফোটে গোরোর চেহারায়।

“আমরা জরুরি কথা বলছি, আর তুমি কি না আমার কফি খাওয়া দেখে হাসছো?”

“না তো।”

“আমি দেখতে পাচ্ছি!”

কথা অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য এখন আক্ষেপ হচ্ছে ফুমিকোর আজকেও ঠিক এক সপ্তাহ আগের মতোন হাবিজাবি কথা বলে দূরে ঠেলে দিচ্ছে গোরোকে।

সিট ছেড়ে উঠে পড়লো গোরো, বিরক্তি ভর করেছে তার চেহারায়। “এক্সকিউজ মি…কত হয়েছে আমাদের?” কাউন্টারের পেছনে দাঁড়ানো কাযুকে উদ্দেশ্য করে বললো সে।

ফুমিকো জানে যে সে যদি এখনই কিছু না করে তাহলে বিল পরিশোধ করে চলে যাবে গোরো।

“দাঁড়াও!”

“থাক, এই বিষয়ে আর কথা বাড়াতে চাইছি না।”

“আমি অন্য কিছু বলতে চাই তোমাকে।”

“কী?”

(যেয়ো না।)

“আমার সাথে চাকরির বিষয়টা নিয়ে কথা বলোনি কেন তুমি?”

(আমি চাই না তুমি যাও। )

“আসলে…”

“আমি জানি এটা তোমার স্বপ্ন। তাই তুমি আমেরিকাতে চলে গেলেও আমি কিছু মনে করবো না। বাঁধাও দেব না।”

(আমি তো ভেবেছিলাম আমরা সারাজীবন একসাথে থাকবো।)

“কিন্তু, অন্ততপক্ষে…”

(আমি একাই কী এটা ভেবেছি?)

“আমি ভেবেছিলাম আমার সাথে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করবে তুমি। এভাবে আগে থেকে কিছু না জানিয়ে তোমার হুট করে চলে যাওয়া…আমার জন্য কতটা কষ্টের বুঝতে পারছো?”

(আমি তোমাকে আসলেই…)

“পরিস্থিতিই এমন যে কী বলবো…”

(…অনেক বেশি ভালোবাসি।)

“আমার তো মনে হচ্ছে আমাকে এক নিমেষে ছুড়ে ফেলে দিলে তুমি…”

“না, মানে…”

“আমি আসলে তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম…”

“কি……..”

(এখন আর বলে লাভ নেই। কোনো কিছু বদলাবে না…)

“না…এটুকুই। আর কিছু বলার নেই আমার।”

ফুমিকো ভেবেছিল সবকিছু খোলাখুলিই বলবে, কারণ এখানে ও যা-ই বলুক না কেন, বর্তমানে কোনো পরিবর্তন আসবে না। কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না। ওর এখন মনে হচ্ছে এসব বলা মানে পরাজয় স্বীকার করে নেওয়া। ‘তোমার কাজ বেশি জরুরি নাকি আমি?’ এরকম কিছু বলে ফেললে নিজেকে পরে ক্ষমা করতে পারবে না। গোরোর সাথে পরিচয় হওয়ার আগ পর্যন্ত সবসময় কাজকেই বেশি প্রাধান্য দিত ফুমিকো। এখন তিন বছরের ছোট প্রেমিকের সামনে বেফাঁস কিছু বলে নিজের আত্মসম্মান খোয়াতে চাইছে না। তখন এমনটাও মনে হতে পারে যে গোরোর ক্যারিয়ারের ঊর্ধ্বগতি দেখে ঈর্ষান্বিত বোধ করছে সে। যাইহোক, এমনিতেও দেরি হয়ে গেছে।

“আচ্ছা…যাও তুমি এখন। আমি যা-ই বলি না কেন, তোমার আমেরিকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত তো আর বদলাবে না।”

এটুকু বলে ফুমিকো বাকি কফিটুকুও গিলে ফেললো। “ওহ…”

সেই অনুভূতিটা ফিরে এসেছে আবারো। ধোঁয়ার জগতে ফিরে যাচ্ছে ও।

অতীতে কেন ফিরতে চেয়েছিলাম আমি? আরো একবার ভাবে ফুমিকো।

“নিজেকে কখনো তোমার যোগ্য মনে হয়নি আমার।”

গোরোর মুখে এরকম কিছু শুনবে কল্পনাও করেনি ফুমিকো।

“আমাকে যেবার কফি খাওয়ার দাওয়াত দিলে প্রথম,” বলেই চলেছে গোরো। “বারবার নিজেকে সাবধান করেছিলাম যাতে তোমার প্রেমে না পড়ি…।”

“কী?”

“কারণ হচ্ছে…” বলে কপালের উপরে এসে পড়া চুলগুলো সরালো গোরো। একটা পোড়া দাগ দেখা যাচ্ছে সেখানে। ডান ভ্রুর উপর থেকে ডান কান অবধি দাগটা। “তোমার সাথে দেখা হবার আগ অবধি আমি সবসময় ভেবে এসেছি যে মেয়েরা আমাকে দেখে ভয় পায়। তাদের সাথে কখনো ঠিকমতোন কথাও বলতে পারতাম না আমি।”

“আমি…”

“এমনকি আমরা ডেটিং শুরু করার পরেও এমনটা মনে হয় আমার।”

“এটা নিয়ে আমি কখনো কিছু ভাবিওনি!” চিৎকার করে বলতে চায় ফুমিকো, কিন্তু সে এখন ধোঁয়ার অংশ। ওর কথা শুনতে পাচ্ছে না গোরো।

“আমি ভেবেছিলাম কিছুদিনের মধ্যেই আমার প্রতি আগ্রহ ছুটে যাবে তোমার, অন্য সুদর্শন কারো প্রতি আকৃষ্ট হবে।”

(অসম্ভব…এমন কিছু কীভাবে ভাবলে তুমি!)

“আমি সবসময়ই ভেবে এসেছি…”

(কক্ষনো না!)

প্রথমবারের মতোন গোরোর এই সরল স্বীকারোক্তি শুনে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছে ফুমিকো। তবে কথাটা অযৌক্তিক মনে হচ্ছে না। গোরোর সাথে ওর সম্পর্কের গভীরতা যত বেড়েছে, ততই মনে হয়েছে একটা অদৃশ্য দেওয়াল কাজ করছে দু’জনের মধ্যে। কী যেন একটা ঠিক নেই।

ফুমিকো যখনই গোরোকে জিজ্ঞেস করত যে সে ওকে ভালোবাসে কি না, প্রতিবারই জবাবে মাথা নাড়তো গোরো। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি, এই শব্দ তিনটা উচ্চারণ করত না। মাঝে মাঝে রাস্তায় একসাথে হেঁটে যাওয়ার সময় মাথা নিচু করে কপালে হাত বুলাতো গোরো। সে বুঝতে পারতো যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া সব পুরুষ তার প্রেমিকার দিকে তাকিয়ে আছে ড্যাবড্যাব করে।

(ও কী খুব বেশি ভাবতো এটা নিয়ে?)

নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিলো ফুমিকো। তার কাছে হয়তো বিষয়টা জরুরি কিছু না, কিন্তু গোরোর জন্য ব্যাপারটা যথেষ্ট বেদনার। ছোট থেকেই নিশ্চয়ই দাগটার কারণে অনেক কিছু পোহাতে হয়েছে বেচারাকে।

(আমি ভাবতেও পারিনি যে ও বিষয়টা এভাবে নেবে।)

ফুমিকোর চেতনা মিইয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। আবারো সেই দুলুনি অনুভব করছে। বিলের কাগজটা হাতে নিয়ে ক্যাশ রেজিস্টারের দিকে হেঁটে যাচ্ছে গোরো।

বর্তমানের কিছু পরিবর্তন হবে না। সেটাই ভালো। ঠিক সিদ্ধান্তটাই নিয়েছে গোরো। আমার চাইতে ওর স্বপ্নের মূল্যটা অনেক বেশি। আমার উচিত ওর আশা ছেড়ে দেওয়া। নিজের জীবনটা নিজের মতো করে গুছিয়ে নিক ও।

ফুমিকোর আর্দ্র চোখগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে, এই সময়-

“তিন বছর,” ওর দিকে না ফিরেই বললো গোরো। “প্লিজ, তিন বছর অপেক্ষা করো। আমি ফিরে আসবো, কথা দিচ্ছি।”

কথাটা বলা হয়েছে একদম আস্তে, কিন্তু ক্যাফেটা বড্ড ছোট। এই ধোঁয়া ধোঁয়া অবস্থাতেও গোরো কণ্ঠ ঠিকই শুনতে পেল ফুমিকো।

“আমি যখন ফিরবো…” অভ্যাসবশত ডান ভ্রুর উপরে একবার হাত বুলালো গোরো। পরবর্তী কথাগুলো আর বোধগম্য হলো না ফুমিকোর

“কী?”

ঠিক তখনই পুরোপুরি ধোঁয়ায় মিলিয়ে গেল ফুমিকোর চেতনা। একদম শেষ মুহূর্তে একবার গোরোর চেহারা দেখতে পেলো ও। ক্যাফে থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগে পিছনে ফিরে তাকায় সে। হয়তো বলতে চেয়েছিল, “আমাকে এক কাপ কফি খাওয়াবে তুমি?”

.

জ্ঞান ফিরে আসলে ফুমিকো টের পেলো যে ক্যাফেতে সে একা। মনে হচ্ছে যেন এতক্ষণ একটা স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু সামনের কফি কাপটা খালি। মুখে এখনো মিষ্টি স্বাদটা লেগে আছে।

এসময় সাদা ড্রেস পরিহিতা মহিলা বেরিয়ে এল টয়লেট থেকে। ফুমিকোকে সিটটায় বসে থাকতে দেখে দ্রুত পাশে এসে দাঁড়ালো সে। “উঠুন,” নিচু অপার্থিব কণ্ঠে বললো।

“আমি…আমি দুঃখিত,” বলে উঠে পড়লো ফুমিকো।

স্বপ্নালু অনুভূতিটা এখনো দূর হয়নি। আসলেও কী অতীতে ফিরে গিয়েছিল ও?

সময় পরিভ্রমণে যা-ই করা হোক না কেন, বর্তমানে সেটার কোনো প্রভাব পড়বে না। সুতরাং, সবকিছু স্বাভাবিকই লাগার কথা। কফির ঘ্রাণ ভেসে আসছে রান্নাঘর থেকে। ওদিকে ঘুরলো ফুমিকো। ট্রে’তে করে আরেক কাপ কফি হাতে বেরিয়ে এসেছে ফুমিকো।

এমন ভাবে ওর পাশ দিয়ে হেঁটে গেল মেয়েটা, যেন কিছুই হয়নি। সাদা পোশাক পরা মহিলার টেবিলটার কাছে গিয়ে প্রথমে ফুমিকোর ব্যবহৃত কাপটা তুলে নিলো সে, এরপর নতুন কাপটা নামিয়ে রাখলো টেবিলে। ধন্যবাদের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে আবারো বই পড়ায় মনোযোগ দিলো ভদ্রমহিলা।

“কেমন লাগলো?” কাউন্টারে ফিরে স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো কাযু।

প্রশ্নটা শোনার পর ফুমিকোর পুরোপুরি বিশ্বাস হলো যে আসলেও অতীতে ফিরে গিয়েছিল সে। এক সপ্তাহ আগের সেই দিনে। কিন্তু ও যদি…

“আমি ভাবছিলাম যে…”

“জি?”

“বর্তমানে কিছু তো বদলাবে না, তাই তো?”

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু এর পরে যা ঘটবে, সেটা?”

“আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।”

“মানে আমি বলতে চাইছি, আজকের পর থেকে যা ঘটবে। ভবিষ্যতে…”

এবারে সোজাসুজি ফুমিকোর দিকে তাকালো কায়ু। “ভবিষ্যতে কী ঘটবে, সেটা নির্ভর করছে আপনার উপরে…” এই প্রথম একটা হাসি ফোটে মেয়েটার মুখে।

উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ফুমিকোর চেহারা।

ক্যাশ রেজিস্টারের সামনে চলে এলো কায়ু। “কফি, সাথে লেট নাইট সারচার্জ মিলিয়ে চারশ বিশ ইয়েন হয়েছে।”

ফুমিকো নিজেও ক্যাশ রেজিস্টারের কাছে এসে দাঁড়ালো। চারশ বিশ ইয়েন বিল মেটানোর পর কায়ুর দিকে তাকিয়ে বললো, “ধন্যবাদ।” সনাতন রীতিতে মাথা নিচু করে একবার বাউ-ও করলো মেয়েটার উদ্দেশ্যে। এরপর ক্যাফের চারপাশে তাকিয়ে আরেকবার বাউ করলো। যদিও এবারে কার উদ্দেশ্যে বাউ করছে সে, তা বোঝা গেল না।

আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে ক্যাফে ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে।

.

কিছুক্ষণ আগের নিস্পৃহতা আবারো ফিরে এসেছে কায়ুর মধ্যে, যেন অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি। টাকাগুলো ক্যাশ রেজিস্টারে গুছিয়ে রাখলো সে। হাতের বইটা বন্ধ করে একবার হাসলো সাদা পোশাক পরিহিতা ভদ্রমহিলা। উপন্যাসটার নাম ‘যুগল’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *