০৮.
জীপ এসে ওদের নীলাকাশের কম্পাউন্ডে প্রবেশ করল। সেখানে তখন আরও ভিড় জমেছে, প্রহরারত পুলিস ভিড় সামলাতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে যেন। সুদর্শন মল্লিকই এগিয়ে গিয়ে সকলকে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে সরিয়ে দিলেন, অরুণ লাহিড়ীও সাহায্য করলেন তাঁকে। ক্যামেরাম্যান একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল ভিড়ের জন্য। সেও এবারে এগিয়ে এল। তদন্ত শেষ করতে ও নানা অ্যাংগেলে ফটো তুলতে ঘণ্টাখানেক লাগল। সুদর্শন মল্লিক একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলেন, অত উঁচু থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করবার জন্য পড়লে, মাটিতে আছড়ে পড়বার পর দেহের যে পোজিশন থাকা উচিত তা নেই, যেমন তেমনি মাথার খুলিটা ফেটে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন ইনজুরিও চোখে পড়ল না তার। সর্বশেষে ঐ ধরনের দুর্ঘটনায় যতটা রক্তপাত হওয়া উচিত তাও নজরে পড়ল না। সামান্য রক্ত জমাট বেঁধে আছে মাথার নীচে। উপরের তলায় গিয়ে সরিৎ ও তার বোনের সঙ্গেও কিছু কথাবার্তা বললেন সুদর্শন মল্লিক।
পরের দিন সকালের সংবাদপত্রে একটা নিউজ দেখা গেল চতুর্থ পৃষ্ঠায়—আর্মি অফিসার ক্যাঃ রজত চৌধুরী নীলাকাশের চারতলার ফ্ল্যাট থেকে সম্ভবত নীচের কম্পাউন্ডে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে।
সংবাদটা বিপাশারই প্রথমে নজরে পড়ে।
অনন্য উঠে বাথরুমে গিয়েছে একটু আগে। শোবার ঘরের সামনের ব্যালকনিতে পরেশ একটু আগে চায়ের ট্রের সঙ্গে ঐদিনকার সংবাদপত্রটা রেখে গিয়েছে। অন্যমনস্ক ভাবে সংবাদপত্রের পাতা ওলটাতে ওলটাতে সহসা চতুর্থ পৃষ্ঠায় নিউজটা বিপাশার দৃষ্টি আকর্ষণ করে—আর্মি অফিসার রজতশুভ্র চৌধুরী নীলাকাশের চারতলার ফ্ল্যাট থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে।
বিপাশা যেন অকস্মাৎ বিমূঢ় প্রস্তরীভূত।
রজত–রজতশুভ্র আত্মহত্যা করেছে। নীলাকাশের ফ্ল্যাট থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ে!
রজতশুভ্র আত্মহত্যা করেছে—অক্ষরগুলো যেন ক্রমশ বড় হতে হতে তার চোখের সামনে আরও বড় আকার ধারণ করতে থাকে। বড় বড় আরও বড়—তারপর কেমন সব ঝাপসা!
অনন্য বাথরুম থেকে এসে ব্যালকনিতে প্রবেশ করল এবং সামনের চেয়ারটায় বসতে বসতে ও বিপাশার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, কি হয়েছে বিপাশা, অমন চুপচাপ বসে কেন?
কেমন শূন্য অসহায় দৃষ্টিতে যেন বিপাশা স্বামীর মুখের দিকে তাকাল, হাতের মুঠোয় তখনও তার ধরা ঐদিনকার সংবাদপত্রটা।
সংবাদপত্রে কিছু—
অনন্যর প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে বিপাশা সংবাদপত্রটা স্বামীর হাতে তুলে দিল।
সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় চোখ বুলাতে বুলাতে অনন্যরও সংবাদটার উপরে নজর পড়ল। সেও রুদ্ধশ্বাসে সংবাদটা পড়ে গেল।
রজতবাবু সুইসাইড করেছেন! অস্ফুট কণ্ঠে বললে।
বিপাশার মনের মধ্যে তখন মাত্র একটা কথাই আনাগোনা করছে—যেরাত্রে দুর্ঘটনাটা ঘটে সেই দিন সকালে অনন্য বের হয়ে যাবার পর এখানে রজতশুভ্র এসেছিল এবং তাকে তার ফ্ল্যাটে সন্ধ্যায় দেখা করতে বলে গিয়েছিল। অবিশ্যি সেদিনের সে কোন কথাই সে তার স্বামীকে জানায় নি। পরেশকেও বার বার নিষেধ করে দিয়েছিল, সে যেন কোন কথা বাবুকে না জানায়। বিপাশার মনে পড়ছে, সে গিয়েছিল নীলাকাশে-রাত তখন পৌনে আটটা হবে—অনন্য তখনও ফেরেনি—এজেন্টের বাড়িতে একটা পার্টি ছিল—সে ব্যাংক থেকেই বিপাশাকে বিকেলে টেলিফোন করে জানিয়েছিল ফিরতে তার রাত হবে, বিপাশা যেন তার জন্য অপেক্ষা না করে রাত্রের আহার সেরে নেয়।
অনেক রাত্রে—প্রায় সোয়া বারোটা নাগাদ অনন্য ফিরেছিল ট্যাক্সিতে করে। বিকেলেই গাড়ি সে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল অফিস থেকে। এবং এসেই সে জামাকাপড় ছেড়ে শয্যায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত্রে কোন ঘুমের ওষুধ পর্যন্ত সে খায়নি। আশ্চর্য! সেরাত্রে একবারও অনন্যর ঘুম ভাঙেনি। রাত তিনটা পর্যন্ত জেগে বসেছিল বিপাশা–কিন্তু অনন্যর ঘুম ভাঙেনি।
ঘুমের ওষুধের কথা বলেছিল বিপাশা, ওষুধ খাবে?
না।
ওষুধ খেলে পারতে–
না, প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া ভাবছি—
কি?
আর কোন ওষুধ খাব না।
খাবে না!
না। দেখি না ওষুধ না খেলে কি হয়, এতদিন তো খেলাম!
বিপাশাও আর পীড়াপীড়ি করেনি। বলছে যখন ওষুধ আর খাবে না-থাক না, দেখাই যাক না, ওষুধ না খেলে কি হয়।
দেখা গেল শেষ পর্যন্ত ওষুধ না খেয়েও চমৎকার ঘুমাল অনন্য সারাটা রাত। মনে মনে খুশিই হয়েছিল বিপাশা।
অনন্যর কথায় বিপাশা আবার চমকে ওঠে।
অনন্য বললে, নীলাকাশে রজতবাবু ছিলেন? হঠাৎ ওখানে কেন বল তো?
অ্যাঁ! কিছু বলছ?
রজতবাবুদের তো তোমাদের বাড়ির পাশেই নিজেদের বাড়ি ছিল, তাই না?
হ্যাঁ।
কথাটা বলে বিপাশা চায়ের কাপে পট থেকে চা ঢালতে থাকে।
সেই রাত্রেই বিচিত্র একটা ঘটনা ঘটল।
সেরাত্রেও অনন্য ঘুমের ওষুধ খেল না। শয্যায় গিয়ে শুতে শুতে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, তুমি শোবে না?
তুমি শোও—আমি একটু পরে শোব।
অনন্য আর প্রতিবাদ জানাল না। শয্যায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
বিপাশা একটু পরে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল।
সারাটা দিন ধরে যে কথাটা তার মনের মধ্যে আনাগোনা করেছে সেই কথাটাই তখনও তার মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। একটা অদৃশ্য কাঁটার মতই যেন কি কি করে বিধছে কেবল রজতশুভ্র সুইসাইড করল কেন?
তার সঙ্গে গতরাত্রে রজতের যেসব কথাবার্তা হয়েছিল, তারপর সে কতকটা নিশ্চিন্ত হয়েই গৃহে ফিরে এসেছিল।
রজত ঘরের মধ্যেই ছিল—ঘরের দরজাটা অবিশ্যি খোলাই ছিল। বেলটা বাজাতেই রজতের গলা শোনা গেল, ভিতরে আসুন–দরজা ভোলাই আছে!
বিপাশা ঘরে প্রবেশ করতেই রজত যে চেয়ারটায় বসেছিল সেটা থেকে উঠে দাঁড়ায়, মৃদু হেসে বলে, এই যে এসেছ—এস! তোমার জন্যই আমি বসে আছি! দাঁড়িয়ে কেন—বোস!
বিপাশা সামনের সোফাটায় বসল। একবার ভেবেছিলাম—
কি ভেবেছিলে বিপাশা? রজত বললে।
আসব না—
কিন্তু আমি জানতাম বিপাশা—
কি জানতে?
তুমি আসবেই—আর তুমি যদি না আসতে তো আমিও ফাইন্যাল ডিসিশনটা নিতে পারতাম। যাক আমি খুশি হয়েছি যে তুমি এসেছ–
রজত!
বল। তোমার যদি কিছু বলবার থাকে—
আমাকে এখুনি কিন্তু ফিরে যেতে হবে—
ফিরে যাবে!
হ্যাঁ। কারণ তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ—অনন্যকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না—যেতে পারি না।
যাবে না তুমি?
না।
তবে এলে কেন?
ঐ কথাটাই ভাল করে তোমাকে বুঝিয়ে দিতে, তুমি আমাকে মুক্তি দাও—
অনন্যকে সত্যিই তুমি ভালবাসো তাই না, বিপাশা?
সে কথা তো অনেক দিন আগেই তোমাকে বলেছিলাম রজত।
হ্যাঁ বলেছিলে–কিন্তু—
কিন্তু কি?
আমি বিশ্বাস করতে পারি নি। ঠিক আছে তুমি যাও—
খোলা-মনে কথাটা বলছ তো রজত?
হ্যাঁ—তুমি যাও—তবে আমারও বোধ হয় আর অন্য পথ রইল না।
রজত!
তোমাকে ছাড়া আমার পক্ষেও বাঁচা সম্ভব নয়—আমি—হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছি—এখন আমার সামনে একটি পথই আর আছে–সুইসাইড।
না না! আর্ত চিৎকার করে উঠেছিল অস্ফুট কণ্ঠে বিপাশা।
হ্যাঁ–বিপাশা তাই।
না না—এসব তুমি কি বলছ রজত। ছিঃ ছিঃ, একজন পুরুষমানুষ হয়ে।
তুমি আর এখানে থেকো না বিপাশা, রজত বললে, যাও। বাড়ি যাও। একে আজকের সকালের ব্যাপারে আমি রীতিমত লজ্জিত হয়ে আছি—তারপর যদি তোমার স্বামী জানতে পারেন তুমি এখানে এসেছ—না, না—তুমি যাও বিপাশা। বাড়ি যাও। আমার মন বড় দুর্বল—আমার মত যদি আবার বদলে যায়—যাও তুমি।
আসি তাহলে
হ্যাঁ—এস। আমার একটা অনুরোধ রেখো। আজকের দিনটার কথা ভুলে যেয়ো।
বিপাশা আর কথা বাড়ায়নি। ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল এবং দরজা খুলতেই তার মনে। হল যেন কে একজন দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল—চট করে সরে গেল। এবং করিডোর দিয়ে হন হন করে হেঁটে চলে গেল সিঁড়ির দিকে।
গতরাত্রের ব্যাপারটার মধ্যে কোন গুরুত্ব দেয়নি বিপাশা কিছু মনেও হয়নি অন্যরকম। অন্যমনস্ক ছিল সেভেবেছিল আশেপাশের ফ্ল্যাটেরই কেউ হয়ত হবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে। তা নয়–কেউ হয়ত ভেজানো দরজায় কান পেতে ঘরের মধ্যে তাদের কথা শোনবার চেষ্টা করছিল, আড়ি পেতেছিল। পিছন থেকে লোকটাকে যতটা দেখেছিল-লম্বা সুটপরা লোকটা। সত্যিই যদি ঐ ফ্ল্যাটবাড়ির কেউ না হয়ে থাকে তো–কে হতে পারে লোকটা–আর কেনই বা তাদের কথা শোনবার চেষ্টা করছিল আড়ি পেতে। বড় ঘুম পাচ্ছে।
বিপাশা আর ব্যালকনিতে দাঁড়ায় না। ব্যালকনির দরজাটা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল। ঘরের উজ্জ্বল আলোটা নেভাললা—মৃদু নীলাভ রাত—বাতিটা জ্বলছে। মৃদু নীলাভ আলোয় ঘরের মধ্যে সব যেন কেমন ঝাপসা ঝাপসা।
শয্যার পাশে এসে দাঁড়াল। অনন্য গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন।
বিপাশা এসে সোফাটার উপর বসল। ঘুমে যেন চোখের পাতা দুটো একেবারে সীসের মত ভারী হয়ে আসছে। ঘুমাব না—ঘুমাব না করতে করতেও কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল বিপাশা বসেবসেই। হঠাৎ ঘুমটা তার ভেঙে যায়—গলার উপরে একটা চাপ পড়ছে। এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল—যে হাত দুটো তার গলা টিপে ধরেছিল সেই হাত দুটো গলা থেকে সরিয়ে দেয়, কে–
এ কি! সামনে দাঁড়িয়ে তার স্বামী অনন্য। চট করে এগিয়ে গিয়ে সুইচ টিপে ঘরের উজ্জ্বল আলোটা জ্বেলে দিল বিপাশা।
সত্যই অনন্য–স্লিপিং স্যুট পরিধানে অনন্য দাঁড়িয়ে।
বিপাশা! মৃদু ফিসফিস গলায় অনন্য যেন ডাকল।
তুমি-তুমি—
বিপাশা!
তুমি আমার গলা টিপে ধরেছিলে অনন্য? তুমি-তুমি—
আমিনা তো, না, না–না–
হ্যাঁ—জোরে গলা টিপে ধরেছিলে তুমি আমার—
অনন্য ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে তখন স্ত্রী বিপাশার মুখের দিকে।
আ—আমি তোমার গলা টিপে ধরেছিলাম! অনন্য আমতা আমতা করে বললে।
হ্যাঁ—
মনে নেই—মনে নেই। মনে করতে পারছি না তো কিছু। বিশ্বাস কর বিপাশা—আমি—
বিপাশা অনন্যর হাত ধরে সোফাটার উপরে এনে বসাল আর দ্বিতীয় বাক্য ব্যয় না করে।
অনন্য—
বল।
একটা কথার জবাব দেবে?
কি কথার জবাব চাও?
বল আগে যা জিজ্ঞাসা করব তার সত্য জবাব দেবে।
দেব, বল এবারে কি তোমার প্রশ্ন, অনন্য বলল।
তোমার মার মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল?
কেন তুমি তো জান, একটা দুর্ঘটনায়।
কি সে দুর্ঘটনা?
আমি তখন ছোট ছিলাম—তোমায় তো বলেছি।
ছোট থাকলেও নিশ্চয়ই শুনেছ পরে—কারও না কারোর মুখে—সত্যি কি হয়েছিল, কি কারণে তার মৃত্যু হল?
না—শুনিনি।
শোন নি?
না, না—কেন এক কথা বার বার জিজ্ঞাসা করছ বিপাশা। বলছি তো শুনিনি।
আমি জানতে চাই—কি এমন দুর্ঘটনায় তোমার মার মৃত্যু হয়েছিল যাতে করে তোমার বাবা। পাগল হয়ে গেলেন, পরেশ হয়ত জানে–
জানি না। দেখ আমি জানলে তো বলব। জানি না। কথাটা বলতে বলতে হঠাৎ অনন্য কেমন। যেন গম্ভীর হয়ে গেল। বাকি রাতটা কেউ আর কারও সঙ্গে কথা বললে না। দুজনে দুটো সোফায় মুখোমুখি বসে রইল। বাইরে রাত ঝিমঝিম করতে থাকে।