যুগলবন্দী – পরিচ্ছেদ ৫

০৫.

কথাগুলো বলে রজতশুভ্র ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। সেদিনকার রজতশুভ্রর সেই কথাগুলোর সঙ্গে কি অপরিসীম ঘৃণা আর আক্রোশ যে জড়িয়ে ছিল, সেটা কি বিপাশা বুঝতে পারেনি?

পেরেছিল। আর তাই যেন সে একেবারে পাথর হয়ে গিয়েছিল।

কথাটা আজও ভুলতে পারেনি বিপাশা—আর সেই কথাটাই যেন আজ বিপাশার মনে পড়েছিল ডাঃ দাশগুপ্তের চেম্বারে বসে তার কথার উত্তর দিতে দিতে হঠাৎ রজতশুভ্রর কথাটা বলতে গিয়ে।

ঐ সঙ্গে বিপাশা বলে এসেছে, কি একটা দুর্ঘটনায় অনন্যর মার, মৃত্যুর কিছুদিন পরেই অনন্যর বাবার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে।

ডাঃ দাশগুপ্ত কি দুর্ঘটনা জিজ্ঞাসা করায় সে বলেছে সে জানে না।

রজতশুভ্রর মুখে সেদিন সেই কথাটা শোনবার পর বিপাশার বহুবার মনে হয়েছে, অনন্যকে সে কথাটা জিজ্ঞাসা করবে কিন্তু পারেনি।

একটা সংকোচ—যেন একটা দ্বিধা বার বার তার কণ্ঠ চেপে ধরেছে। সে আজও আশা করে আছে অনন্যই একদিন তাকে মার সব কথা বলবে। কি দুর্ঘটনা হয়েছিল কিভাবে সত্যি সত্যি তার মৃত্যু হয়েছে—আর অনন্য যে বলবেই সে বিষয়েও সে স্থিরনিশ্চিত।

বাইরে আকাশে মেঘ করছে হয়ত বৃষ্টি নামবে। একপশলা বৃষ্টি হলে মন্দ হয় না। বিশ্রী গুমোট চলেছে কদিন ধরে।

একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া বিপাশার চোখেমুখে এসে ঝাপটা দেয়—মনে হয় তার দূরে বোধ হয় কোথাও বৃষ্টি নেমেছে। বিপাশা বারান্দা থেকে ভিতরে চলে এল ঘরে। ব্যালকনির দরজাটা বন্ধ করে দিল। মৃদু নীলাভ আলোয় শয্যায় নিদ্রিত স্বামীর মুখের দিকে তাকাল বিপাশা। অনন্য গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

এমনি করে যদি ও ঘুমোতে পারে, যদি ওর ঘুম আজ অন্যান্য রাত্রের মত না। ভাঙে-ভগবান তাই করো, তাই করো–

পায়ে পায়ে শয্যার একেবারে নিকটে এগিয়ে এল।

হঠাৎ অনন্যর ঘুম ভেঙে যায়—ঢং ঢং করে ঘরের দেওয়াল-ঘড়িতে রাত্রি দুটো ঘোষিত হল। চমকে ওঠে বিপাশা।

অনন্য শয্যা থেকে নামছে বিপাশা বুঝতে পারে ওর দিকে তাকিয়েই, অনন্যর চোখে ঘুমের ঘোর—ডাঃ দাশগুপ্তের পরামর্শমতই বিপাশা অন্যান্য রাত্রের মত প্রথমটায় নীরব সাক্ষীমাত্র না থেকে দুহাতে ওর একটা হাত চেপে ধরে বললে, কি কি হল অনন্য—অনন্য, ঘুম থেকে উঠে বসলে কেন অনন্য—অনন্য

ঝাঁকুনি দেয় বিপাশা স্বামীকে একটা।

আঃ—

অনন্য!

আঃ ছাড়—বিশ্বাস করি না আমি—সব—সব সমান–

কার কথা বলছ—কি বলছ?

কে?

আমি—আমি বিপাশা—

বিপাশা! কেমন বিস্ময়ের সঙ্গে অনন্য বিপাশার দিকে তাকাল।

হ্যাঁ হ্যাঁ, বিপাশা—

এত রাত্রে তুমি–তুমি এখনও ঘুমাওনি?

না। কেন, ঘুমোও নি কেন—ঘুমোও নি কেন বিপাশা?

তুমি শুয়ে পড়ো, রাত এখনও অনেক আছে

তুমি জেগে আছ কেন এখনও? গলার স্বরটা যেন অনন্যর কেমন, প্রশ্নের ভঙ্গিটা যেন কেমন–বিপাশার মনে হয় যেন ঠিক স্বাভাবিক নয়। বিপাশা ভাবে, হয়ত ঘুমের ঘোর এখনও ভাল করে কাটেনি।

অনন্য, শোও—শুয়ে পড়া। বিপাশা আবার বললে।

না। তুমি জেগে আছ কেন বিপাশা এত রাত্রেও তা তোকই বললে না। অনন্য আবার প্রশ্ন করল।

বিপাশা ভাবল একবার বলে, আমি তো আজকাল রোজ রাত্রেই এমনি করে জেগে থাকি–কিন্তু কথাটা বলল না বিপাশা, বললে, ঘুম আসছে না তাই–

ঘুম আসছে না, না—

বাঃ, ঘুম না আসলে কি করব?

কোথায় ছিলে?

কেন?

তাই জিজ্ঞাসা করছি—কোথায় ছিলে, এই ঘরে?

ব্যালকনিতে বসেছিলাম—

কটা রাত?

একটু আগে রাত দুটো বাজল।

অনন্য কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে বিপাশার মুখের দিকে চেয়ে থাকে, তারপর বলে, আমি, ঘুমোচ্ছিলাম

জানি।

আচ্ছা বিপাশা—

কি?

আজ কে এসেছিল আমাদের বাড়িতে বল তো?

কেমন করে জানব?

জান না তুমি?

বাঃ, দেখেছি নাকি তাকে!

আমি জানি কে এসেছিল—

কে?

রজতশুভ্রবাবু!

কি করে বুঝলে রজতই এসেছিল?

নিশ্চয়ই সে, তোমার সঙ্গে দেখা করতেই এসেছিল—

তা আমার সঙ্গে সে হঠাৎ দেখা করতে আসবে কেন?

পুরানো দিনের বন্ধু, আসলে ক্ষতিই বা কি–ক্ষতি তো নেই কিছু, দোষের কিছু নেই–

না, সে আর কোন দিন আসবে না আমার সামনে।

কি করে বুঝলে?

আমি জানি—আচ্ছা একটা কথা বলব?

কি?

আজ এতদিন পরে হঠাৎ রজতের কথা কেন?

একসময় তো তোমার বন্ধু ছিল, তাই না?

রজতের কথা তো সব তোমাকে বলেছিলাম। বিপাশা বললে।

প্রতি রাত্রে যে কুয়াশাটা আমাকে ঘিরে ধরে, তার মধ্যে অস্পষ্ট একটা মুখ আমি দেখতে পাই মাঝে মাঝে–

মুখ!

হ্যাঁ, কার জান?

কেমন করে বলবো–তুমি তো কখনও বলনি।

না বলিনি, আজ বলছি–কার মুখ দেখি জান?

কার?

আমার বাবার! আচ্ছা কেন দেখি বল তো?

কেমন করে বলব! রাত অনেক হল—তুমি এবার ঘুমোও।

তুমি ঘুমোবে না?

না।

কেন?

ঘুম আসছে না–

অনন্য আর কথা বলে না—শুয়ে পড়ে। এবং দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে। বিপাশা চেয়ে থাকে ঘুমন্ত স্বামীর মুখের দিকে।

অনন্য হঠাৎ রজতের কথা বলছিল কেন? প্রশ্নটা বিপাশার মনের মধ্যে কেবলই ঘোরাফেরা করতে থাকে।

বাকি রাতটা বিপাশা একটা চেয়ারে বসেই কাটিয়ে দেয়।