যুক্তিবাদী সমাজ ও সাহিত্য
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যাহ্নটাই বাঙালী সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও সাহিত্যের ক্রান্তিকাল। এই ক্রান্তিমুহূর্ত রচনায় অসামান্য অবদান ছিল মদনমোহন তর্কালঙ্কার (১৮১৭-১৮৫৮) ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-১৮৯১)। বিদ্যাসাগর মহাশয়ই বাংলা মুদ্রণের মান নির্ধারণ করেন ও নানাবিধ বই লিখে বাংলা গদ্যের একটা আদর্শ স্থাপন করেন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবার পর এক শিক্ষিত রুচিশীল মধ্যবিত্ত সমাজের সৃষ্টি হয়, তাঁরা যে মাত্র সৃষ্টিধর্মী সাহিত্য রচনার দিকেই মন দিলেন তা নয়, তাঁরা সমাজ সংস্কারের দিকেও মন দিলেন। সমাজ সংস্কারের দিক থেকে রামনারায়ণ তর্করত্ন (১৮২২-১৮৮৬) ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রভাব এক বৈপ্লবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করল। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে রামনারায়ণ তাঁর ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটক লিখে সনাতনী সমাজের ওপর এক প্রচণ্ড আঘাত হানলেন। ওই নাটক দ্বারা তিনি প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা করলেন যে জন্মের সঙ্গে কৌলীন্যের কোন সম্পর্ক নেই। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কয়েকটি নিবন্ধ লিখে প্রমাণ করলেন শাস্ত্রীয় বিধান অনুযায়ী বাল্যবিধবার পুনর্বিবাহ দেবার অনুকূলে কোন বাধা নেই। বহু টাকা খরচ করে বিদ্যাসাগর মহাশয় কয়েকটি বিধবা বিবাহও দিয়ে দিলেন। ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ (১৮৫৪) ছাড়া, ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে রামনারায়ণ ‘নব-নাটক ‘ নামে আর একখানা নাটক লিখে বহু-বিবাহের বিরুদ্ধে জেহাদ চালালেন। এসবই হচ্ছে যুক্তিবাদী সমাজের সাহিত্য। ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় এসে রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) ‘আত্মীয়সভা’র মাধ্যমেই এই যুক্তিবাদী সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ স্থাপনের পর, ওর অন্যতম শিক্ষক হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-৩১) যখন বাঙালী ছাত্রদের ফরাসী বিপ্লবের নীতি, পাশ্চাত্ত্য- সাহিত্য ও দর্শন যথা শেকস্পীয়ার, স্কট্, বারস, বাইরন, বেকন, হিউম, পেইন ও বেনহাম প্রমুখ লেখকদের রচনার সঙ্গে ছাত্রদের পরিচিত করিয়ে দিলেন, তখন যুক্তিবাদী সমাজ জোরদার হয়ে দাঁড়াল। তারপর ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা মারফত অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬) বাঙালী পাঠককে কারলাইল, ফিকটে, নিউম্যান ও পারকারের চিন্তাধারার সঙ্গেও বাঙালী সমাজকে পরিচিত করালেন।
এ যুগেই কালীপ্রসন্ন সিংহ (১৮৪৪-৭০) প্রতিষ্ঠা করেন ‘বিদ্যোৎসাহিনী’ সভা। তিনি বিদ্যাসাগরের উৎসাহে ও তত্ত্বাবধানে হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য প্রমুখ কয়েকজন পণ্ডিতের সাহায্যে মূল সংস্কৃত মহাভারত বাংলায় অনুবাদ করে এক কীর্তি স্থাপন করেন। তাঁর রচিত নাটক ‘বাবু’,’বিক্রমোর্বশী’,’সাবিত্ৰী সত্যবান’ ও ‘মালতী মাধব’ এবং সামাজিক ব্যঙ্গ রচনা ‘হুতোম প্যাঁচার নকসা’ বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয়।
আবার এ যুগেই সাহিত্যক্ষেত্রে প্রথম আবির্ভাব ঘটে মহিলাদের। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণকামিনী প্ৰকাশ করেন তার কাব্যগ্রন্থ ‘চিত্তবিলাসিনী’, ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে কামিনীসুন্দরী তাঁর নাটক ‘উর্বশী’, ‘১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে হেমাঙ্গিনী তাঁর উপন্যাস ‘মনোরমা’,১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাসসুন্দরী তাঁর ‘আমার জীবন’ ও ১৮৭৭ থেকে স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদনা করতে লাগলেন ‘ভারতী’ পত্রিকা। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে বনলতা দেবী অন্তঃপুর নামে এক মাসিক পত্রিকা বের করেন যাতে মাত্র মেয়েদের লেখা ছাপা হত।
দুই
যুক্তিবাদী সমাজের সাথে সাথে অভ্যুত্থান ঘটল জাতীয়তাবাদী সমাজের। জাতীয়তাবাদ অব্যাহত রইল ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, যখন ভারত স্বাধীনতা লাভ করল। এই যুগের প্রারম্ভে বাঙালীর চিন্তাধারা বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিল অগস্ট কোঁৎ-এর ‘পজিটিভিজম’,জন স্টুয়ার্ট মিলের ও হার্বার্ট স্পেনসারের চিন্তাধারার দ্বারা। পাশ্চাত্ত্য দেশের ‘রোমান্টিসিজম’ চিন্ত াধারার প্রভাবও ছিল। ১৮৫৮ থেকে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ঋষি বঙ্কিমচন্দ্ৰ চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, বিহারীলাল চক্রবর্তী, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মোসার্রফ হোসেন, কেশবচন্দ্র সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী ও ভূদেব মুখোপাধ্যায় এবং ১৮৮৫ থেকে ১৯০৪ পর্যন্ত সময়কালে নবীনচন্দ্র সেন, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রাজকৃষ্ণ রায়, কামিনী রায়, কায়কোবাদ, ইন্দ্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকদের রচনার মধ্যে আমরা উক্ত চিন্তাধারার প্রভাবই লক্ষ্য করি। তাঁদের রচনার দ্বারা আরও যাঁরা এই শেষোক্ত যুগের বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধশালী করেছিলেন ও বাঙালীর চিন্ত াধারাকে নতুন দিগন্তের দিকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, দীনেশচন্দ্র সেন, রমেশচন্দ্র দত্ত, অক্ষয়চন্দ্র সরকার প্রমুখ লেখকগণ। এ যুগের কবিদের মধ্যে স্মরণীয় অক্ষয়কুমার বড়াল, রজনীকান্ত সেন ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। এই যুগেই স্থাপিত হয়েছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ (১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে)। ১৯০৫ থেকে ১৯১৯ পর্যন্ত সময়কালে আমরা বাংলা সাহিত্যের নায়ক হিসাবে দেখি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৭৩-১৯৩২), অনুরূপা দেবী, (১৮৮১-১৯৫৮), বিপিনচন্দ্র পাল (১৮৫৮-১৯৩২), রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (১৮৬৪-১৯১৯), হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১), অরবিন্দ, মোজাম্মেল হক, প্রমথ চৌধুরী, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে (১৮৬৫-১৯৪৩)। এই যুগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘উদ্বোধন’ ‘প্রবাসী’,’ভারতবর্ষ’, ‘সবুজপত্র’ প্রভৃতি পত্রিকাসমূহ। এই যুগেই রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার (১৯১৩)। তিনিই ছিলেন এ যুগের বাণীমূর্তির জীবন্ত প্রতীক। সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিকশিত হয়েছিল তাঁর বহুমুখী প্রতিভা। তিনিই প্রথম বাংলা ভাষাকে উন্নীত করেছিলেন বিশ্ব-সাহিত্যের দরবারে। ওই যুগেরই চিন্তানায়করা যথা প্রজ্ঞানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্ৰমথ চৌধুরী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, (১৮৭০-১৯২৫) প্রমুখেরা আধুনিক গদ্য লেখার রীতি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এই যুগেই (১৯১৪-১৯১৯) অধ্যাপক বিনয়কুমার সরকার (১৮৮৭-১৯৪৯) তাঁর ৫০০০ পৃষ্ঠা ব্যাপী ‘বর্তমান জগৎ’ গ্রন্থ লিখে বাঙালী পাঠককে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ইতিহাস, শিল্প ও রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেন। বাঙালীর চিন্তাধারার মধ্যে আন্তর্জাতিকতার সৃষ্টি তিনিই করেন। এ যুগে শিশুসাহিত্য, রচনা করেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার (১৮৭৭-১৯৫৭), যোগীন্দ্রনাথ সরকার, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (১৮৬৩-১৯১৫) ও সুকুমার রায় (১৮৮৭-১৯২৬)। এ যুগের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল নগেন্দ্রনাথ বসু (১৮৬৬-১৯৩৮)-কর্তৃক সম্পাদিত বাংলা ভাষায় প্রথম ‘বিশ্বকোষ’ প্রকাশ। এ যুগে প্রমথ চৌধুরী (১৯৬৮-১৯৪৬) মহাশয় তাঁর ‘সবুজপত্র’ (১৯১৪) মারফত চলতি ভাষায় প্রবন্ধ রচনা করে এক নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করেন। যদিও শরৎচন্দ্রের (১৮৭৬-১৯৩৮) ‘নারীর মূল্য’,’বিরাজ বৌ’ (১৯১৪), ‘পল্লীসমাজ’, ‘চরিত্রহীন’ (১৯১৭) ও ‘শ্রীকান্ত’ প্রথম পর্ব (১৯১৭) এই যুগেই প্রকাশিত হয়েছিল, তা হলেও তাঁর ‘শ্রীকান্ত’-এর ২য় (১৯২৮), ৩য় (১৯২৭), ও চতুর্থ পর্ব (১৯৩৯), ‘বামুনের মেয়ে’ (১৯২০), ‘পথের দাবী’ (১৯২২) প্রভৃতি বিখ্যাত উপন্যাস পরবর্তী যুগে প্রকাশিত হয়। কাহিনীকার হিসাবে তিনি ছিলেন এ যুগের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। বঞ্চিত সমাজের মর্মবেদনা ও নারীহৃদয়ের জটিল রহস্য তিনিই প্রথম উদঘাটিত করেন।
তিন
পরবর্তী যুগের (১৯১৯-১৯৪৭) লেখকদের উল্লেখনীয় নিরুপমা দেবী (১৮৮৩-১৯৫১), রাজশেখর বসু (১৮৮০-১৯৬০), নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত (১৮৮২-১৯৬৪), উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৭৯-১৯৫০), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৮৯-১৯৭৬), কালিদাস রায় (১৮৮৯-১৯৭৫), করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৭৭-১৯৫৫), সজনীকান্ত দাস (১৯০০- ১৯৬২), বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০), বনফুল (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭৯), সতীনাথ ভাদুড়ী (১৯০৬-১৯৬৫), নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (১৯১৮-১৯৭১), নরেন্দ্র দেব (১৮৮৮-১৯৭১), মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২), অন্নদাশঙ্কর রায়, জসিমুদ্দিন (১৯০৪-১৯৭৬), বুদ্ধিদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৮), সীতা দেবী (১৮৯৫-১৯৭৪), শান্তা দেবী (১৮৯৩-১৯৮৪), সুখলতা রাও, মন্মথ রায়, যোগেশ চৌধুরী, বিধায়ক ভট্টাচার্য, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, গোকুল নাগ (১৮৯৫-১৯২৫), বন্দে আলী মিঞা (১৯০৬-১৯৭৯), সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯০১-১৯৭৪), মুজফ্ফর আহমেদ (১৮৮৯-১৯৭৩), যোগেশচন্দ্র রায় (১৮৫৯-১৯৫৬), প্রমুখ। নজরুলের গান ও কবিতা এ যুগের শিক্ষিত ও অশিক্ষিত, সকল শ্রেণীর মানুষকেই মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল। এ যুগের পুরুষদের মধ্যে জনপ্রিয় লেখক ছিলেন শরৎচন্দ্র, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯৬৬), নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত (১৮৮২-১৯৬৪) ও উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৮১-১৯৬০), এবং মহিলাগণের মধ্যে প্রভাবতী দেবী সরস্বতী ও রাধারাণী দেবী। এ যুগের শেষের দিকে (১৯৩৫- ১৯৪৭) আবির্ভূত হন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১), প্রবোধ সান্যাল (১৯০৭-১৯৮৩), বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার ((১৮৯২-১৯৪৪), অদ্বৈত মল্লবর্মণ, সুভাষচন্দ্র বসু, দিলীপ রায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৭৬), সুধীন দত্ত, অচিন্ত্য সেনগুপ্ত, (১৯০৩- ১৯৭৬), শচীন সেনগুপ্ত (১৮৯১-১৯৬১), লীলা মজুমদার, আবু সয়ীদ আইয়ুব, গোপাল হালদার, আশালতা দেবী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যোগেশচন্দ্র বাগল, সুনীতি চট্টোপাধ্যায় ও সুকুমার সেন প্রমুখ। এ যুগেই প্রথম অর্থনীতির বই লেখেন অধ্যাপক বিনয় সরকার, অনাথগোপাল সেন এবং অতুল সুর। এ ছাড়া, আমিই প্রথম বাংলায় লিপি নৃতত্ত্বের বই। বে-সরকারী উদ্যোগে প্রথম বাংলায় আইনের বইও তর্জমা করি। এ যুগের সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ছিল বিদ্রোহী মনোভাবের প্রকাশ- সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই।
চার
স্বাধীনতা-উত্তর যুগের সমাজের প্রতি স্তরে প্রকাশ পেয়েছে বিশৃঙ্খলা ও দুর্নীতি। সাহিত্যের প্রধান ধর্ম হচ্ছে সমাজকে বিপথ থেকে ঠিক পথে নিয়ে যাওয়া। সে সাফল্য এ যুগের সাহিত্য অর্জন করতে পারেনি। এ যুগের সাহিত্যিকদের না আছে সংগ্রামী মন, না আছে আত্মপ্রত্যয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত সুসংহত ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা। দু-একজনের মধ্যে মাত্র লক্ষ্য করেছি এ সমাজের বাস্তব চিত্রাঙ্কণের প্রয়াস। যেমন বিমল মিত্র মহাশয় তাঁর ‘আমি’ উপন্যাসে চেষ্টা করেছেন রাজনৈতিক নেতাদের ‘সাধুতা’র মুখোশ খুলে দেবার। বিশৃঙ্খলা ও দুর্নীতি-দূষিত সামাজিক পরিবেশের মধ্যে যা ঘটে, বর্তমান সময়ে সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। সবাই সাহিত্যিক হতে চান, যার ফলে সৃষ্ট হয়েছে অসংখ্য গ্রন্থ—শ্লীল ও অশ্লীল। তাঁদের সকলের নাম করাও এখানে অসম্ভব। তবে যাঁদের নাম না করলে গভীর অপরাধ করা হবে তাঁদেরই নাম করছি। কবিতার ক্ষেত্রে সুকান্ত ভট্টাচার্য, জীবনানন্দ দাশ, নীরেন চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়; উপন্যাসের ক্ষেত্রে, বিমল মিত্র, সমরেশ বসু, বিমল কর, সুবোধ ঘোষ, প্রমথনাথ বিশী, আশাপূর্ণা দেবী, শংকর, সন্তোষ ঘোষ, রমাপদ চৌধুরী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, মহাশ্বেতী দেবী, ও বুদ্ধদেব গুহ, এবং নিবন্ধের ক্ষেত্রে ড. নীহার রায়, সুশীল রায়, গোপাল রায়, হীরেন দত্ত, বিনয় ঘোষ, অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, অতুল সুর, উজ্জ্বল মজুমদার, অজিত ঘোষ ও নারায়ণ চৌধুরী। আর ব্যঙ্গ-রচনায় এ যুগের যিনি অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তিনি হচ্ছেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়।
সবশেষে সাম্প্রতিক কালে বাঙলার সাহিত্য ও প্রকাশ ক্ষেত্রের কয়েকটি শুভ লক্ষণের কথা বলতে চাই। প্রথম বিশিষ্ট লেখকদের রচনাবলী প্রকাশ; দ্বিতীয়, বিদেশী লেখকদের বহুল বাংলা অনুবাদ প্রচার; ও তৃতীয়, পুস্তক বিপণনের জন্য বই মেলার প্রবর্তন। আর এক শুভ লক্ষণ হচ্ছে প্রকাশকদের নিবন্ধ সাহিত্য প্রকাশের দিকে প্রবণতা। চল্লিশের দশকে অসীম সাহসের সহিত এই অভিযানে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন ‘জিজ্ঞাসা’ প্রকাশন- সংস্থার কর্ণধার শ্রীশকুমার কুণ্ড। তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী হচ্ছেন ‘সাহিত্যলোক’-এর নেপালচন্দ্র ঘোষ। এখন অবশ্য অনেক প্রকাশকই নানা সুধীজনের নিবন্ধ গ্রন্থ প্রকাশ করছেন।