যীশুর কাঠের মূর্তি – ৪

সকালে উঠে কিছু খেয়ে নিয়ে আবার শুরু হলো পাহাড়ে ওঠা। এখানে গাছ-গাছালি নেই বললেই হয়। শুধু বিরাট বিরাট পাথরেরাই। সেসব কখনো উঠে কখনো নেমে একফালি জায়গা দিয়ে ওঠা। ঠাণ্ডার তীব্রতা বাড়তে লাগল। কখনো কুয়াশা মেঘের মতো চারদিক ঢেকে ফেলছে। এক হাত দূরে কিছু দেখা যায় না। পরক্ষণেই তীব্র হিমেল বাতাস ও কুয়াশা উড়িয়ে দিচ্ছে। রোদ দেখা যাচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত। তারপরেই কুয়াশা ঢেকে ফেলেছে চারদিক। কুয়াশা আর রোদের খেলা চলছে।

দুপুরে থামল একটা বিরাট পাথরের চাইয়ের নীচে। খাবার বের করে খেয়ে নিল।

আবার পাহাড়ে ওঠা। বিকেলের কিছু আগে একটা বেশ বড়ো সমতলভূমি দেখল। কয়েদঘর পাহাড়ি লোকের বাস এখানে। ঐ সমতলভূমিতে গম ভুট্টার চাষ করে।

সমতলটুকু পেরিয়ে আসতেই দেখল উঁচুতে একটা পাহাড়ি গুহা। এই গুহার মুখটা বড়ো। খাড়া চড়াইয়ের মাথায় সেই গুহা।

গুহাটা দেখিয়ে পারিসি বলল, এই গুহাটাতেই সাধু নিওফিতসের সঙ্গে আমি শেষ পর্যন্ত ছিলাম। ফ্রান্সিস গুহাটা দেখতে দেখতে বলল, কিন্তু গুহাটায় উঠলে কী করে?

সেই দড়ি-মইয়ের কথা বলেছিলাম। পারিসি বলল।

 কিন্তু সেটা কি আছে এখনও? ফ্রান্সিস বলল।

দেখা যাক। পারিসি বলল।

এমন সময় এই বস্তি থেকে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এলো। পারিসির কাছে এসে পারিসিকে দেখে হাসল। বোঝা গেল পারিসিকে চিনেছে। বৃদ্ধের মুখে বলিরেখা ফুটে উঠল। বৃদ্ধের সঙ্গে পারিসির কিছু কথা হলো। ফ্রান্সিস তার কিছুই বুঝল না। বৃদ্ধটি চলে গেল।

পারিসি ফ্রান্সিসকে নিয়ে খাড়া পাহাড়টার নীচে এলো। দেখল দুটো দড়ি ঝুলছে। দড়ির মধ্যেকার কাঠের সিঁড়িগুলো খসে গেছে। দু’টো টানা দড়িই ভরসা।

দু’টো দড়ি ধরেই ওঠা যাবে। ফ্রান্সিস বলল।

আজকে উঠবেন? পারিসি জিজ্ঞেস করল।

না, সন্ধে হয়ে গেছে। কালকে সকালে উঠবো। ফ্রান্সিস বলল।

 রাত হলো। পাহাড়ি বস্তির সেই বৃদ্ধটি এলো। পারিসিকে হেসে কী বলল। পারিসি বলল, ফ্রান্সিস, আজ রাতে এরা অতিথি হতে বলছে।

ভালোই তো, ফ্রান্সিস বলল, তুমি বৃদ্ধকে বলো আমরা আনন্দের সঙ্গে অতিথি হবো। তবে শুধু খাবো, থাকবো না। পারিসি কথাগুলো বৃদ্ধকে বলল। বৃদ্ধ খুব খুশি।

ফ্রান্সিস আর পারিসি বোঁচকা রেখে খেতে গেল। এক বৃদ্ধা ওদের সমাদরে একফালি ঘরে বসাল। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ছেলে-মেয়েরাও ফ্রান্সিসদের পেয়ে খুব খুশি। পাহাড়ি জীবনে বাইরের মানুষের সঙ্গে তো ওদের খুব কমই সাক্ষাৎ হয়। ঐ একফালি ঘরেই ওদের বসিয়ে খাওয়াল-বাড়িতে তৈরি গোল রুটি আর পাখির মাংস। ফ্রান্সিস তো পেট পুরে খেল। একদিন তো ভালো খাবার কপালে জোটেনি। পারিসিও পেট ভরে খেল।

বৃদ্ধটি বারবার ঐ একফালি ঘরেই ওদের থাকতে বলল। ফ্রান্সিস বুঝল এই ঠাণ্ডায় বৃদ্ধের পরিবারের লোকদের কষ্ট হবে। ওরা পাহাড়ি পরিবারের কাছে বিদায় নিয়ে চলে এলো। বড়ো পাথরের চাইটার ওপর পশুলোমের কম্বলমতো পেতে গরম পোশাক গায়ে দিয়েই ওরা শুয়ে পড়ল। শেষরাতের দিকে ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। খোলা জায়গায় শীতার্ত হাওয়া যেন গায়ে কামড় বসাচ্ছে। ফ্রান্সিস আর ঘুমলো না। আকাশে। চাঁদের আলো উজ্জ্বল। তবে মাঝে মাঝে কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে উঁচু পাহাড়ের চুড়ো আর তিনদিকের শূন্যতায় কুয়াসার গায়ে চাঁদের আলো। সুন্দর দেখাচ্ছে। হঠাৎই ফ্রান্সিসের মনে পড়ে গেল মারিয়া আর বন্ধুদের কথা। কী কষ্টে ওদের দিন কাটছে। কুয়াশায় চাঁদের আলো খেলা, পাহাড়ি সৌন্দর্য সবই ফ্রান্সিসের কাছে ম্লান হয়ে গেল। ও চোখ বুজে ঝিমোতে লাগল।

সকাল হতেই ফ্রান্সিসরা কাজে নামল। বোঁচকা পিঠে নিয়ে ফ্রান্সিসই প্রথম দড়ি দুটোর কাছে এলো। ফ্রান্সিস দড়ি দুটো গায়ের জোরে টানল। যাক–দড়ি দুটো আলগা হয়নি। ওপরে কোনো পাথরের চাইয়ের সঙ্গে বাঁধা আছে বোধহয়।

প্রথমে ফ্রান্সিস একটা দড়ি ধরে দড়িটার দুদিকে পাহাড়ের গায়ে পা রেখে রেখে গুহার মুখের কাছে উঠে এলো। এবার পারিসি উঠতে লাগল। ফ্রান্সিস দড়ি টেনে টেনে পারিসিও গুহার মুখে উঠে এলো। দুজনেই হাঁপাচ্ছে তখন।

এবার দু’জনে গুহায় ঢুকল। বাইরের আলো থেকে এসে অন্ধকারই লাগল গুহার ভেতরটা। আস্তে আস্তে অন্ধকারটা চোখে সয়ে এলো। ফ্রান্সিস দেখল গুহাটা বেশ বড়ো। বাইরের তীব্র ঠাণ্ডা হাওয়া গুহার ভেতরে অল্পই ঢুকছে। সেইজন্যেই গুহার ভেতরটায় একটু গরমভাব।

পারিসি গুহাটার বেশ ভেতরে এলো। দেখা গেল অনেকটা জায়গায় শুকনো পাতা বিছানা। জায়গাটা দেখিয়ে পরিসি বলল, এইখানে সাধু নিওফিস শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুর সময়ও তিনি বিন্দুমাত্রও বিচলিত হননি। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। ধর্মতত্ত্বের কথা সেসব। আমার কি সেসব বোঝার মতো বিদ্যেবুদ্ধি আছে নাকি। তবু শুনতাম। বুঝতাম তিনি তাঁর চিন্তাভাবনাগুলো বলে আনন্দ পাচ্ছেন। পারিসি থামল। তারপর গুহার কোণার দিকে পোড়া হাঁড়ি-কুড়ি দেখিয়ে বলল, সেদিন সন্ধের সময়ই সাধু নিওফিতস খেয়ে নিলেন। আমিই রান্নাবান্না করতাম। সব দিন নয়। পাহাড়ি বস্তির লোকেরা সেই দড়ির সিঁড়ির কাছে রান্নাকরা খাবার খেতে যেত। যেদিন ওসব খাবার পেতাম না সেদিন রান্না করতাম। একটু থেমে পারিসি বলতে লাগল, একটু রাতে সাধু নিওফিতস মৃদুস্বরে আমাকে ডাকলেন–পারিসি–পারিসি। আমার ঘুম ভেঙে গেল। শুনলাম উনি বলছেন–পারিসি, তুমি আমার জন্যে অনেক করেছো। এবার আমার যাবার সময় হয়েছে। দেখছে না স্বর্গের দেবদূতেরা এসেছে। আমি যাচ্ছি। আমি তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম। দেখি-গুহাটা এক অপার্থিব আলোয় ভরে গেছে। আমি সেই আলোর বর্ণনা করতে পারবো না। আমি দ্রুত এসে সাধু নিওফিতসের পায়ে হাত দিলাম। বরফের মতো ঠাণ্ডা গায়ে হাত দিলাম–ঠাণ্ডা। মুখের কাছে কান পাতলাম। শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ নেই। বুকে কান পাতলাম কোনো শব্দ নেই। আমি কেঁদে উঠলাম। সারারাত সাধু নিওফিতসের পা ধরে কাঁদলাম। একটু থেমে পারিসি বলল, সকাল হতে আমি গ্রন্থটা হাতে নিয়ে দড়ির মই বেয়ে নীচে নামলাম। একটু বেলায় পাফোসের খ্রীস্টিয় মঠের অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করলাম। গ্রন্থ দিলাম। সব বললাম। তাঁরাই সাধু নিওফিতসের শেষ কাজ করলেন। পারিসি থামল। তারপর কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে মেঝের পাতা-ছড়ানো জায়গাটায় চুম্বন করল। ফ্রান্সিস কোনো কথা বলল না।

এবার ফ্রান্সিস ঘুরে ঘুরে গুহাটা দেখতে লাগল। গুহাটার একবারে পেছনে একটা বড়ো ফাটল মতো আছে। তারপরেই একটা ঝর্ণার জল নীচে নেমে যাচ্ছে। ফ্রান্সিস বুঝল এই ঝর্ণার জলই নিওফিতস খেতেন। এই ঝর্ণার জলেই স্নান করতেন।

ফ্রান্সিস ফিরে এসো বোঁচকা খুলল। শুকনো পাতা-ছাওয়া জায়গাটায় একটা মোটা কম্বলমতো পাতল। তারপর শুয়ে পড়ল। পারিসিও বোঁচকা খুলে মোটা কাপড় পেতে বসল। ফ্রান্সিস বলল, পারিসি, এখানে মানে গুহাটার বাইরে সব জায়গাটাই তুমি দেখেছো?

হা। পারিসি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।

কী আছে বাইরে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

পাহাড়-টাহাড় যেমন হয়। এখানে ছোটো ছোটো কয়েকটা সীডার, চেস্টনাট গাছ আছে। পারিসি বলল।

তাহলে সাধু নিওফিতস কাঠ পেয়েছিলেন। ফ্রান্সিস বলল।

হ্যাঁ, শীতের সময় আগুন জ্বালাবার জন্যে জ্বালানি কাঠও এই গুহার কোণায় জড়ো করা থাকতো। পারিসি বলল।

হুঁ-খাওয়াদাওার পর এই গুহা আর চারপাশ ভালো করে দেখতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

দুপুরবেলায় খোলা বোঁচকা থেকে আটা, আলু এসব বের করে পরিসি রান্না চাপিয়ে দিল।

খাওয়াদাওয়া সেরে ফ্রান্সিস গুহাটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল, জ্বলন্ত মশাল হাতে। গুহাটার কঠিন পাথুরে গা। দেখবার কিছুই নেই।

একসময় ফ্রান্সিস কাঠ রাখবার জায়গাটায় এলো। কাঠ, শুকনো ডালপালা সরিয়ে সরিয়ে দেখছে, তখনই হঠাৎ নজরে পড়ল একটা হাতুড়ি। ছোটো হাতুড়ি। ঐ জায়গায় ডালপাতা সরাতেই দেখল দুটো বাটালি। একটা বড়ো একটা ছোটো। ফ্রান্সিস উত্তেজনায় চেঁচিয়ে ডাকল, পারিসি। পারিসি ওর কাছে এলো। ফ্রান্সিস ততক্ষণে হাতুড়ি আর বাটালি দুটো তুলে নিয়েছে। পরিসি কাছে এলে বলল, এসব কী বুঝতে পারছো। পারিসি মাথা নেড়ে বলল, নাঃ। ফ্রান্সিস বলল–সাধু নিওফিতস এই হাতুড়ি, বাটালি দিয়েই কাঠ কুঁদে কুঁদে প্রভু যীশুর মূর্তি গড়েছিলেন। কাজেই আমার অনুমান ঠিক। এখানেই কোথাও আছে সেই কাঠের মূর্তি।

হাতুড়ি বাটালি রেখে ফ্রান্সিস গুহার চারদিকটা মশালের আলোয় ভালো করে দেখতে লাগল। আর কিছু পেল না। তবে নিশ্চিত হলো যে কাঠের মূর্তি তৈরি করা হয়েছিল।

ফ্রান্সিস মশালটা গুহায় রেখে গুহার শেষ ছোটো মুখটা দিয়ে বাইরে এলো। দেখল সেই ঝর্ণাটা। ফ্রান্সিসের মনে পড়ল নিওফিতসের লেখা সেই গ্রন্থ শুরু হয়েছে যীশুর স্নানের জল পবিত্র–এই কথাটা দিয়ে। তার মানে জলের কথা বলা হয়েছে। কাজেই এই ঝর্ণার জলের গুরুত্ব বেড়ে গেল।

ফ্রান্সিস আর পারিসির একঘেয়ে সময় কাটতে লাগল। খাওয়া দাওয়া আর গুহার মধ্যে বাইরে কাঠের মূর্তির সন্ধান। একটা ব্যাপারে ফ্রান্সিস নিশ্চিন্ত হল যে নিওফিতস তার হাতে তৈরি যীশুর মূর্তির কথা কাউকে বলে যেতে পারেন নি অথবা এও হতে পারে তিনি ইচ্ছে করে কাউকে বলেন নি। যে গুহায় ছিলেন সেখানে অন্য কেউ আসেনি। পরে এই গুহায় থাকাকালীন একমাত্র পরিসিই এসেছিল। বলার ইচ্ছে থাকলে পারিসিকে বলে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি বলেন নি। কোনো সূত্রও রেখে যাননি। শুধুমাত্র এই গ্রন্থের প্রথম কথাটি-যীশুর স্নানের জল পবিত্র। এই জল কথাটি নিয়েই ফ্রান্সিস বেশি ভাবছে।

সেদিন ফ্রান্সিসকে পারিসি বলল–এই ঠাণ্ডায় এই গুহায় পড়ে থেকে কী হবে। চলুন নেমে যাই।

–না–ফ্রান্সিস বলল ইচ্ছে হলে তুমি নেমে যেতে পারো। আমি মূর্তি উদ্ধার করার জন্যে থাকবো। পারিসি বুঝল–ফ্রান্সিসকে সঙ্কল্পচ্যুত করা যাবে না। ও আর কিছু বলল না। ফ্রান্সিস সকাল দুপুর গুহার বাইরে মূর্তি খুঁজে বেড়াতে লাগল। গুহায় গুহার ধারে কাছে ফ্রান্সিস তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল।

সেদিন সকালের খাওয়া সেরেছে ওখানেই। গুহামুখে একজন সৈন্য এসে দাঁড়াল। শিরস্ত্রাণ বর্ম নেই। কিন্তু কোমরে তলোয়ার গোঁজা। ফ্রান্সিস পারিসি দুজনেই বেশ আশ্চর্য হল।

সৈন্যটি সটান গুহার মধ্যে ঢুকে ফ্রান্সিসদের সামনে এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস পারিসিকে বলল–বলো তো লোকটা কি সৈনিক? এখানে এসেছে কেন? পারিসি তাই জিজ্ঞাসা করল। লোকটি গ্রীক ভাষায় কী বলে গেল। পারিসি ফ্রান্সিসকে বলল–ও বলছে–ও সৈনিক। নাম আন্তো। ও নিওফিতসের হাতে তৈরি মূর্তির কথা শুনেছে। সেটা উদ্ধার করতে আমরা এসেছি তাও জানে। কৌতূহল হয়েছে ওর। তাই দেখতে এসেছে কীভাবে আমরা মূর্তিটা উদ্ধার করছি। ফ্রান্সিস এবার আন্তোকে স্পেনীয় ভাষায় বলল–তুমি স্পেনীয় ভাষা জানো?

শুনলে বুঝতে পারি–অল্পস্বল্প বলতেও পারি। আন্তো বলল।

–তাহলে শোনো। সাধু নিওফিতস যীশুর কাঠের মূর্তি গড়েছিলেন সেটা পুরোটাই রাজা গী দ্য লুসিগনান থেকে শুরু করে সকলেরই কল্পনা। এর কোনো প্রমাণ এখনও কেউ পায়নি। আমরাও পাইনি। ফ্রান্সিস বলল।

তবে এখানে এই ঠাণ্ডায় গুহার মধ্যে আছেন কেন? আন্তো বলল।

 –আর কয়েকটা দিন খোঁজাখুঁজি করবো তারপর নেমে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।

আমিও আপনাদের সঙ্গে নেমে যাবো। আন্তো বলল।ফ্রান্সিস বুঝল–এই লোকটা পিছু ছাড়বে না। তাই বলল–

–এখানে কিন্তু খাওয়াদাওয়ার খুব কষ্ট হবে।

আপনারা যা খাবেন তাই খাবো। আপনারা না খেয়ে থাকলে আমিও না খেয়ে থাকবো। আন্তো বলল। তারপর হাতে বড়ো পুঁটুলিটা দেখিয়ে বলল–অবশ্য আমি কিছু শুকনো খাবার নিয়ে এসেছি। একসঙ্গেই খাবো। ফ্রান্সিস বুঝল আন্তো আটঘাট বেঁধেই এসেছে। ওকে এড়ানো মুস্কিল। থাকুক–ক্ষতি তো করবে না।

আন্তো ফ্রান্সিসদের সঙ্গে থেকে গেল।

সেদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর ফ্রান্সিস পারিসিকে বলল–সাধু নিওফিতস আগে মানে প্রথমে যে গুহাটায় ছিলেন সেটা এখনও দেখা হয়ে ওঠেনি। আজকে চলো নেমে ওই গুহাটা দেখে আসি।

ফ্রান্সিস আর পারিসি চলল নামবার দড়িটার দিকে। আন্তোও পেছনে পেছনে চলল।

গুহামুখ থেকে ঝোলানো দড়ি ধরে ধরে ওরা নীচের একফালি সমতলভূমিতে এলো। তারপরই উত্রাই বেয়ে নামতে লাগল। পথ বলে কিছু নেই। ওঁচানো পাথর ধরে ধরে নামা। বেশ কিছুটা নামার পর অন্য গুহাটার মুখে এলো। এই গুহাটা ওপরের গুহাটার তুলনায় ছোটো।

গুহাটায় ঢুকল তিনজনে। ফ্রান্সিস দেখল ওপরের গুহার মতো এই গুহাতেও শুকনো ঘাসপাতা বিছিয়ে বিছানামতো করা। ফ্রান্সিস বলল–পারিসি এই গুহাটায় তুমি কখনো এসেছিলে? পারসি মাথা নেড়ে বলল–না।

ফ্রান্সিস সঙ্গে আনা মোটা কাপড়টা ঘাসপাতার ওপর বিছিয়ে দিল। পারিসি আর আন্তো বসল। ফ্রান্সিস বসল না। ঘুরে ঘুরে গুহাটা দেখতে লাগল। গুহাটার এক কোণে পোড়া হাঁড়িকুড়ি রাখা। সাধু নিওফিতস যখন এখানে থাকতেন তখন রান্নটান্না করতেন। এখানেও একপাশে গাছের শুকনো ডাল কাণ্ড পাতা রাখা। সাধু নিওফিস রান্না করতেন। আগুন জ্বালাতেন। কিন্তু কোথায় কাঠের যীশু মূর্তি?

ফ্রান্সিস গাছের কাণ্ড ডালপাতা সরাল যদি কিছু পাওয়া যায়। পেলও–একটা ছোটো হাতুড়ি আর ছোটো বাটালি। তাহলে বোঝা যাচ্ছে সাধু নিওফিতস এখানেও কাঠের কাজ করেছিলেন। যীশুর মূর্তি তৈরি করেছিলেন। তাহলে কি সাধু নিওফিতস একটার বেশি যীশু মূর্তি কাঠকুদে বানিয়েছিলেন? ফ্রান্সিস ভাবল হয়তো দু’তিনটে মূর্তি সাধু নিওফিতস গড়েছিলেন। কিন্তু একটি মূর্তিও তো পাওয়া গেল না। একটি মূর্তি পাওয়া গেলেও বোঝা যেত আরো মূর্তি তৈরি হয়েছিল কিনা।

ফ্রান্সিস গুহাটার শেষের দিকে এলো। দেখল একটা বড়ো ফাটল। ফাটলটা দিয়ে ফ্রান্সিস বাইরে বেরিয়ে এলো। চারদিকে গাছ পাথর। পাহাড়ি এলাকা যেমন হয়। এদিক ওদিক কিছুদূর ঘুরে এলো ফ্রান্সিস। কিন্তু কোথাও ঝর্ণা বা জলজমা কুণ্ড দেখতে পেল না। তবে সাধু নিওফিতস কোথায় স্নান করতেন? খাবার জলই বা পেতেন কোথায়?

ফ্রান্সিস গুহায় ফিরে এসে পারিসিকে সেই প্রশ্ন করল–পারিসি এখানে কাছাকাছি কোথাও ঝর্ণা বা জমা জল দেখলাম না। তাহলে সাধু নিওফিতস খাবার জল কীভাবে পেতেন? স্নানই বা করতেন কোথায়? পারিসি বলল–তা তো বলতে পারবো না। আমি তো এই গুহায় কখনো থাকি নি। ফ্রান্সিস বলল–আমার দৃঢ় বিশ্বাস এখানে কোথাও ঝর্ণা বা অমনি কোনো জলের জায়গা আছে। পারিসি বলল হতে পারে।

তিনটি পাথরে তৈরি উনুনটায় পারিসি আগুন জ্বালাল। সঙ্গে যে খাবার এনেছিল তাই গরম করে সবাইকে খেতে দিল। খেতে খেতে ফ্রান্সিস বলল–পারিসি আমরা এই গুহায় কয়েকদিন থাকবো। এখানে ঠাণ্ডাটাও অনেক কম। খেয়েদেয়ে যাও ওপরের গুহা থেকে খাবারদাবার কাপড়চোপড় নিয়ে এসো। সব এনে তুমি একবার নীচের পাহাড়ি গাঁয়ে যাবে। গাঁয়ের লোকদের অনুরোধ করবে তারা যেন দু’তিনদিন পর পর আমাদের জন্যে খাবারদাবার এই গুহার নীচের এক চিলতে সমভূমিতে রেখে যায়। এবার আন্তোকেও বলল–তুমিও যাও পারিসিকে সাহায্য করো। খাওয়া-দাওয়া সেরে পারিসি আর আন্তো বেরিয়ে গেল।

পারিসি বিকেলের মধ্যেই ওপরের গুহা থেকে সব এনে এই গুহায় জড়ো করল।

পারিসি আন্তোকে সঙ্গে নিয়ে নীচে নেমে এল। পাহাড়ি গাঁয়ের মানুষদের অনুরোধ করে এলো দুতিনদিন অন্তর অন্তর খাবারদাবার দিয়ে যেতে। কেন ও আর ফ্রান্সিস অনেক কষ্ট সহ্য করেও গুহায় পড়ে আছে তাও বলল। বলল–মহাপুরুষ নিওফিতসের নিজের হাতে গড়া কাঠের যীশুর মূর্তি উদ্ধারই আমাদের উদ্দেশ্য। তার জন্যেই এত কষ্ট সহ্য করছি। সাধু নিওফিতসের নাম শুনেই সবাই মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানাল।

থাকা খাওয়ার মোটামুটি ব্যবস্থা হল। এবার মূর্তি খোঁজা।

গুহাটা ফ্রান্সিস তন্ন তন্ন করে খুঁজল। পাথরের কোনো খোঁজই বাদ দিল না। কিন্তু। মূর্তি নেই। কোথাও নেই। কোনো সূত্রই ফ্রান্সিসের হাতে নেই। শুধু সাধু নিওফিতসের গ্রন্থের সেই প্রথম কথাটা–যীশুর স্নানের জল পবিত্র। অথচ এখানে কোথাও জলই নেই। ওপরের গুহার পেছনে তবু একটা ছোটো ঝর্ণা আছে। এখানে তাও নেই।

পরদিন সকালের খাবার খেয়েই ফ্রান্সিস বেরিয়ে এলো গুহা থেকে। পাথরে পা রেখে এদিকওদিক ঘুরে বেড়ালো। কিন্তু ঝর্ণা কোথাও নেই। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে একটা পাথরের চাইয়ের ওপর বসল। তখনইনজরে পড়ল বাঁ দিকে একটা পাথরের চাইয়ের ওপাশটায় কুয়াশা জমছে। তারপর মনে হল ধোঁয়া। ফ্রান্সিস ভালো করে তাকিয়ে থেকে বুঝল ওটা বাষ্প। কিন্তু জল ছাড়া বাষ্প এটা ঠিক বুঝল না ফ্রান্সিস। সন্দেহ নিরসনের জন্যে ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে পাথরে চাইটা পেরোতেই চমকে উঠল। দেখল একটা জলের কুণ্ড।তাই থেকে বাষ্প উঠেছে। তার মানে উষ্ণ প্রস্রবণ। এই উষ্ণ প্রস্রবণেই নিওফিস স্নান করতেন। ফ্রান্সিস আরো কয়েক পা এগোতেই দেখল উষ্ণ জলের কুণ্ডে ভাসছে একটা কাঠের মূর্তি। ক্রশবিদ্ধ যীশুরমূর্তি। ঠিক যেমনটি ও দেখেছিল নিওফিতসের সেই পুস্তকে। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি নেমে এলো। উবু হয়ে বসে জলে হাত রাখল-বেশ গরম। এবার বুকে ক্রশ আঁকলো। তারপর হাত বাড়িয়ে কাঠের মূর্তিটা তুলে নিল। তারপর কোমরের ফেট্টিতে গুজল। আস্তে আস্তে চলল গুহার দিকে।

গুহায় ঢুকে ফ্রান্সিস চেঁচিয়ে বলল–পারিসি–দেখো। এই মূর্তিটাই নিওফিতস নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন। পারিসি মোটা কাপড়ের বিছানায় শুয়ে ছিল। এক লাফে উঠে পড়ল। ছুটে এলো ফ্রান্সিসের কাছে। ফ্রান্সিস কোমর থেকে খুলে মূর্তিটা পারিসিকে দিল। তখন আন্তোও ছুটে এসেছে। পারিসি মূর্তিটা কপালে ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতেই বলল–এই মূর্তির কথা নিওফিতস আমাকে কখনও বলেন নি। নিওফিতসের হাতে তৈরি মূর্তি। কী অমূল্য সম্পদ।

পারিসি মূর্তিটা পাথরের খাঁজে বসাল। তারপর মাথা নিচু করে ক্রশ আঁকলো। তারপর বিছানায় এসে বসল। তখন ওর ফুঁপিয়ে কান্না বন্ধ হয়েছে। ও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মূর্তিটার দিকে। আন্তোও অবাক চোখে তাকিয়ে রইল মূর্তিটার দিকে। পারিসি এবার ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। বলল–চলুন এবার নেমে যাই। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল–না–এখন নয়। আমার কেমন বিশ্বাস নিওইফতস দুটো মূর্তি তৈরি করেছিলেন। একটা তো পেলাম। আর একটা আছে ওপরের গুহার ধারেকাছে কোথাও। ভুলে যেও না–দুটো গুহাতেই আমরা হাতুড়ি বাটালি পেয়েছি।

–তাহলে আবার ওপরের গুহায় যাবেন? পারিসি বলল।

–হা আর একটা মূর্তির সন্ধান করতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

 খাওয়াদাওয়ার পর ফ্রান্সিস সব গুছিয়ে নিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে এলো। পারিসি কপালে একটা কাপড়ের ফেট্টি বেঁধে তাতে মূর্তিটা গুঁজে রাখল। এতে দু’হাত খোলা রইল। পাহাড়ে ওঠার সুবিধে হল।

তিনজনে পাহাড়ের ওপরের গুহাটায় যাবার জন্যে রওনা হলো। কখনও পাথুরে চাই-এ উঠে কখনও খণ্ড পাথরে পা রেখে রেখে তিনজনে ওপরের গুহার নীচের সমতল অল্প জায়গাটায় এলো। তারপর ঝোলানো দড়ি বেয়ে বেয়ে প্রথমে ফ্রান্সিস উঠে এলো। তারপর পারিসি আর আন্তো উঠে এলো। সবাই গুহাটায় ঢুকল।

গুহায় মোটা কাপড় পেতে বিছানামতো করা হলো।

ফ্রান্সিস আর পারিসি বলল। পারিসি কপালে বাঁধা মূর্তিটা বের করে মাথার কাছে রাখল। আন্তো বসল না। বলল–যাই ঝর্ণার জলে চানটা সেরে আসি। আন্তো গুহার পিছন দিকে দিয়ে বেরিয়ে গেল। এবার পারিসি বলল–ফ্রান্সিস আমি তো নীচের পাহাড়ি গ্রামগুলোয় আমাদের খাবার দেবার কথা বলতে গিয়েছিলাম তখন শুনেছি সেনাপতি ফেলকো রাজা গী দ্য লুসিগনানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। এই কেরিনিয়ার দুর্গে সে আস্তানা গেড়েছে। আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে সেনাপতি ফেলকো আস্তোকে পাঠিয়েছে আমাদের ওপর নজর রাখার জন্যে।

–কেন? ফ্রান্সিস বলল।

–আমরা নিওফিতসের হাতে-গড়া মূর্তি উদ্ধার করতে পারলাম কিনা তার খোঁজ নিতে। দেখছেন না আস্তো কেমন ছায়ার মতো আমাদের সঙ্গে থাকে। আমার একমাত্র চিন্তা আন্তো আমাদের কোনো বিপদে না ফেলে। পারিসি বলল।

দেখা যাক। ফ্রান্সিস বলল।

–এই যে আন্তো হঠাৎ চান করতে চলে গেল তার কারণ কী। আন্তো এত সকালে কোনোদিন চান করে না। পারিসি বলল।

–তাহলে আন্তো কোথায় গেল? ফ্রান্সিস বলল।

–আন্তো এর মধ্যে নীচে নেমে লোক দিয়ে বিদ্রোহী সেনাপতি ফেলকোকে সংবাদ পাঠিয়েছে যে সাধু নিওফিতসের মূর্তি আমরা খুঁজে পেয়েছি। পারিসি বলল।

–তা’তে কী হল? বলল।

–আমরা নীচে নামলেই ফেলকোর সৈন্যরা আমাদের কাছ থেকে মূর্তিটা কেড়ে নেবে। পারিসি বলল।

ফ্রান্সিস একটু ভাবল। তারপর বলল–আমরা অন্য দিক দিয়ে পাহাড় থেকে নামবো। সেনাপতি ফেলকোর সৈন্যদের নজর এড়িয়ে পালাবো।

–সে চেষ্টাই করতে হবে। পারিসি বলল।

বেশ দেরি করে আন্তো ফিরে এলো। হাতে খাবার। বলল–নীচে পাহাড়ি লোকেরা এই খাবারদাবার রেখেছে। আমি তাও নিয়ে এলাম।

তিনজনে খেতে লাগল। ফ্রান্সিস আর পারিসি কোনো কথা বলল না।

খুব ভোরে। তখনও সূর্য ওঠেনি। পারিসির ধাক্কায় ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। ও উঠে বসে জিজ্ঞাসা করল–কী ব্যাপার।

–আন্তো যীশুর মূর্তিটা নিয়ে পালিয়েছে। পারিসি কঁদো কাঁদো গলায় বলল– মূর্তিটা আমি মাথার কাছে রেখে ঘুমিয়েছিলাম। ফ্রান্সিস দেখল আন্তোর শয্যা শূন্য।

.

পরদিন সকালের খাবার খেয়েই ফ্রান্সিস গুহার পেছনের ফাটলটা দিয়ে বাইরে এলো। ঝণাটার জল একনাগাড়ে শব্দ তুলে বয়ে চলেছে। ফ্রান্সিস ঝণাটার পাশ দিয়ে। ছোটো ছোটো ঝোঁপ, পাথরের বড়ো বড়ো টুকরোর ওপর পা রেখে রেখে উঠতে লাগল। কিছুদূরে খাড়াই ওঠার পর দেখল ঝর্ণাটা একটা ছোট্ট গুহামুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। ঝোঁপঝাড় ধরে ধরে ফ্রান্সিস গুহামুখটায় এলো। তখনই দেখল ঝর্ণাটা দুদিকে ভাগ হয়ে গেছে। একটা নেমে গেছে ওদের গুহাটার পেছন দিয়ে আর একটা ধারা। নেমে গেছে ডানদিক দিয়ে। ফ্রান্সিস এই নতুন ধারাটার পাশ দিয়ে নামতে নামতে দেখল ঐ জলাধার একটা কুণ্ডের মতো জায়গায় জমেছে। কুণ্ডটার নীচে কোণে ফাটলের মধ্যে দিয়ে সেই জল বেরিয়ে যাচ্ছে। এই জন্যেই কুণ্ডে বেশি জল জমছে না। কুণ্ডের চারপাশের লম্বা লম্বা ঘাস ঝোঁপঝাড় কুণ্ডটাকে প্রায় ঢেকে দিয়েছে। এ কঁকটুকু দিয়ে তাকিয়ে ফ্রান্সিসের মনে হলো কুণ্ডের জলে কী যেন ভাসছে। ফ্রান্সিস দ্রুত নেমে এলো। লম্বা লম্বা ঘাস ঝোঁপ সরিয়ে দেখল–একটা কাঠের মূর্তি ভাসছে। উল্টোমুখ তাই কীসের মূর্তি বুঝল না। ফ্রান্সিস নিচু হয়ে বেশ কষ্ট করে মূর্তিটা তুলে আনল। এ কী? যীশুর মূর্তি। আর একটি। নিওফিতসের গ্রন্থে আঁকা ছবির সঙ্গে হুবহু মিল। তাহলে এই কাঠের মূর্তিটাও নিওফিতস নিজের হাতে গড়েছিলেন। আনন্দে ফ্রান্সিস দু’হাত তুলে বলে উঠল, পারিসি আর একটি মূর্তি। ফ্রান্সিস ভক্তিভরে বুকে ক্রশ আঁকল।

এবার ফ্রান্সিস মূর্তিটা জামার সামনের গলার কাছ দিয়ে ঢুকিয়ে নিল। দু’হাত তো খোলা রাখতে হবে। নইলে পাথরে ওঠা-নামা করতে পারবে না। ফ্রান্সিস কুণ্ডের এলাকা থেকে আস্তে আস্তে উঠে আগের ঝর্ণাটার মুখে এলো তারপর ঝর্ণার ধার দিয়ে পাথর ঝোঁপঝাড় ধরে ধরে নিজেদের গুহার পেছনে এলো। ফাটল দিয়ে গুহার মধ্যে ঢুকল। দেখল, পারিসি বসে আছে। ফ্রান্সিস মূর্তিটা বের করে পরিসির চোখের সামনে ধরল। মূর্তি দেখে পারিসি অবাক হয়ে মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে রলি। তারপর দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বুকে ক্রশ আঁকল। জলে ভেজা মূর্তির পায়ে চুম্বন করল। ফ্রান্সিস মূর্তিটা ওর বিছানায়। রাখল। কয়েকদিনের পাহাড়ে ওঠার প্রচণ্ড পরিশ্রম, কষ্ট-খাওয়াও ভালো জোটেনি, নাওয়াও হয়নি- ক্লান্তিতে ফ্রান্সিস মূর্তির পায়ের কাছে মাথা রেখে শুয়ে রইল। এই অসময়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যেও শুনল পারিসি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

ঘুম ভাঙতে ফ্রান্সিস দেখল বেশ বেলা হয়েছে। পরিসি ফ্রান্সিসকে ডাকল-খেয়ে যান। ফ্রান্সিস দেখল পারিসি খাবার নিয়ে বসে আছে। তার মানে ওকে আজ রাঁধতে হয়নি। পাহাড়ি বস্তির লোকেরা সেই দড়ির নীচের সমতল মাটিতে খাবার রেখে গেছে। পারিসি দড়ি বেয়ে নেমে সেই খাবার নিয়ে এসেছে।

খাওয়াদাওয়ার পর ফ্রান্সিস বলল, পারিসি, আর এখানে থেকে লাভ নেই। চলো আজকেই নেমে যাবো।

দু’জনে আবার বিছানা কাপড় সব নিয়ে বোঁচকা বাঁধল। পারিসি কোমরের ফেট্টি খুলল। কপালের কাছে যীশুমূর্তি রেখে ফেট্টি দিয়ে বাঁধল। তারপর গুহা থেকে ফ্রান্সিসের পেছনে পেছনে বোঁচকা কাঁধে বেরিয়ে এলো।

নামার সময় যে যে পাহাড়ি বস্তিতে ওরা আশ্রয় নিচেছে সেখানকার সবাই যীশুর মূর্তিতে পা চুম্বন করেছে। পারিসি সেই মূর্তি কপালের ফেট্টির সঙ্গে বেঁধে নিয়ে চলেছে।

পাহাড়ের যে পথ দিয়ে লোকজন ওঠা-নামা করে আর ফ্রান্সিস ও পারিসি যে পথ দিয়ে উঠে এসেছিল সেই পথ দিয়ে ফ্রান্সিস ও পারিসি নামবে না স্থির করল। নামতে লাগল পাহাড়ের পেছন দিক দিয়ে।

এদিক দিয়ে তো লোক চলাচল করে না। কাজেই পথ বলে কিছু এদিকে নেই! বড়ো বড়ো পাথরের চাই, ঝোঁপ জঙ্গল পাথরের টুকরো ছড়ানো জায়গা। এসবের মধ্যে দিয়ে দু’জনে নেমে চলল। পাহাড়ের মাঝামাঝি নামতেই শুরু হল রোদের তেজ। ঐ রোদের মধ্য দিয়েই দু’জনে নামতে লাগল। একে রাস্তা বলে কিছু নেই পাথরের চাই গাছের গুঁড়ি এসব ধরে ধরে নামতে হচ্ছে। দু’জনেই বেশি কাহিল হয়ে পড়ল। এক সময় ফ্রান্সিস বলল–পারিসি–কপাল থেকে মূর্তিটা নামিয়ে পোশাকের ভেতরে রাখো। ঐ মূর্তিটা ওভাবে রাখলে সহজেই লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। কার মনে কী আছে কে জানে। পারিসি মূর্তিটা খুলে পোশাকের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল।

সামনে একটা গাছ। এটা পেরোলেই এবড়োখেবড়ো ঘাসে ঢাকা সমতলভূমি। পাহাড় শেষ। ফ্রান্সিস হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল–পারিসি থামো। দু’জনেই গাছটার আড়ালে দাঁড়াল। দেখল একটু নীচে সমতলভূমিতে আন্তো দাঁড়িয়ে আছে। এখন শিরস্ত্রাণ বর্ম পরা। সঙ্গে চারজন অস্ত্রে সজ্জিত সৈন্য। পারিসি বলল–আন্তো এখানে সৈন্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন?

–ঠিক বুঝতে পারছি না ফ্রান্সিস বলল–তবে কি ও জানতে পেরেছে যে আমরা আর একটা মূর্তি পেয়েছি?

–কী করবেন এখন? পারিসি বলল।

চলো নামা যাক। দেখি আন্তোরা কী চায়। ফ্রান্সিস বলল। ফ্রান্সিস আর পারিসি গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। কয়েকটা পাথরের চাঁইয়ে পা রেখে রেখে নীচে নেমে এলো।

দু’জনে নামতেই আন্তো হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো। বলল–ফ্রান্সিস–তুমি খুব বুদ্ধিমান। আমি ভালো করেই জানতাম যে পথ দিয়ে সবাই পাহাড়টায় ওঠানামা করে সেই পথ দিয়ে তুমি নামবে না। পাহাড়ের উল্টো দিক দিয়ে নামবে। তাই আমি সৈন্যদের নিয়ে এই উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছি। ফ্রান্সিসও হেসে বলল–তোমাকে আমরা খাদ্য দিয়েছিলাম, থাকতে দিয়েছিলাম। বিনিময়ে তুমি মূর্তি চুরি করে পালালে। তুমি যে জন্যে আমাদের গুহায় গিয়েছিলে তা তো করেছে। তবে এখন আবার আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছো কেন? আন্তো বলল–তুমি যা বুদ্ধিমান তাতে আর একটা মূর্তিও তুমি উদ্ধার করতে পেরেছো। আমরা সেটাই নিতে এসেছি।

–আর কোনো মূর্তি আমরা পাইনি। ফ্রান্সিস বলল।

মিথ্যে কথা। আন্তো বলল। ফ্রান্সিস বলল–ঐ মূর্তিটা কী করেছো?

 –সেনাপতি ফেলকোকে দিয়েছি। আন্তো বলল।

–তাহলে আর সেনাপতি অন্য মূর্তিটা চাইবেন কেন? ফ্রান্সিস বলল।

–দুটো মূর্তিই তার চাই। একটা থাকবে সেনাপতির শিয়রে। অন্যটা থাকবে এই দুর্গের গীর্জায়। এবার ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বুঝিয়ে বলল–আন্তো–আমার স্ত্রী ও বন্ধুদের আল জাহিরি কয়েদখানায় বন্দি করে রেখেছে। এখন রাজা গী দ্য লুসিগনানকে আমি বলেছি যে মহামতি নিওফিতসের হাতে তৈরি যীশুর মূর্তি আমি উদ্ধার করে আনবো। শেষ পর্যন্ত একটা উদ্ধার করলাম। সেটা তুমি বেইমানি করে চুরি করে নিয়ে পালালে। মহামতি নিওফিতসের হাতে তৈরি আর একটি একইরকম দেখতে মূর্তি আমরা উদ্ধার করেছি। রাজার সঙ্গে আমার চুক্তি হয়েছে যে মূর্তি উদ্ধার করে দিলে তিনি আল জাহিরির কয়েদঘর থেকে আমার স্ত্রী ও বন্ধুদের মুক্তির ব্যবস্থা করবেন। দুটো মূর্তি উদ্ধার করেছি। অন্তত একটি মূর্তিও তো রাজাকে দিতে হবে। তা নইলে আমার বন্ধুদের, স্ত্রীর মুক্তি হবে না। তাই তোমাকে অনুরোধ করছি যে কথাগুলি আমি বললাম তা সেনাপতি ফেলকোকে গিয়ে বলো। একটা মূর্তি তো পেয়েছেন আর একটা মূর্তি আর ও চাইবেন না।

-না–সেনাপতি ফেলকো দুটি মূর্তিই নেবেন। আন্তো বলল।

–তাহলে তো লড়াইয়ে নামতে হয়। কথাটা বলেই ফ্রান্সিস এক লাফে এগিয়ে এসে আন্তোর, কোমরে ঝোলানো তলোয়ারের খাপ থেকে তলোয়ারটা এক ঝটকায় খুলে নিল। তারপর খোলা তলোয়ার হাতে সৈন্যদের আক্রমণের মোকাবিলা করতে দাঁড়াল। আস্তে বলল–পারিসি তুমি এখান থেকে সরে যাও। পারিসি দ্রুতপায়ে সরে গেল। আন্তো চিৎকার করে বলল–সৈন্যরা খতম করো এই ভিনদেশীটিকে। ফ্রান্সিসের রুদ্রমূর্তি দেখে সকলেই একটু ঘাবড়ে গেল। আন্তো একটি চিৎকার করে বলে উঠল– আক্রমণ করো। ওর কাছেই নিওফিতসের মূর্তিটা রয়েছে। সেই মূর্তি আমাদের চাই। এবার চারজন সৈন্যই ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস নানা কৌশলে ওদের তলোয়ারের মার ঠেকাতে লাগল। নিজে অক্রমণ করল না। সৈন্য চারজন অল্পক্ষণের মধ্যে হাঁপাতে শুরু করল। ফ্রান্সিস তখনও সমান তেজে তলোয়ার চালিয়ে যাচ্ছে।

সৈন্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। ফ্রান্সিসের বুকে বর্ম নেই মাথায় শিরস্ত্রাণ নেই। বেশ কিছুক্ষণ লড়াইয়ের পর এখনও ওর দেহ অক্ষত। সৈন্যরা বুঝল ফ্রান্সিসকে সহজে কাবু করা যাবে না।

ফ্রান্সিস বুঝল সৈন্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ফ্রান্সিস এটাই চাইছিল। এবার ফ্রান্সিস আক্রমণ করল। এক সৈন্যের বাহুতে তলোয়ারের কোপ বসাল। সেই সৈন্যটা তলোয়ার ফেলে বাহু চেপে ধরল অন্য হাতে। তবু রক্ত পড়তে লাগল। একজন সৈন্যের শিরস্ত্রাণ তলোয়ারের মারে উড়িয়ে দিল। শিরস্ত্রাণ মাটিতে পড়ে গেল। এবার ফ্রান্সিস ওর মাথায় আস্তে তলোয়ারের কোপ বসাল। মাথা কেটে রক্ত বেরিয়ে এলো। আর একজনের পায়ে তলোয়ার চালাল। সে বেচারা দু’হাতে পা চেপে ধরে বসে পড়ল।

তলোয়ার চালানোর ফাঁকে ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল আন্তো প্রান্তর দিয়ে ছুটে চলেছে।

আহত সৈন্যরা তখন যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে। দু’জন সৈন্য শুধু আহত হয়নি। দু’জন দূরে সরে গেল। ফ্রান্সিস বলে উঠল–পারিসি পালাও। একথা বলেই ফ্রান্সিস ঘাসে ঢাকা প্রান্তর দিয়ে ছুটল। পেছনে পারিসি। কিছুটা ছুটে গিয়ে দেখল প্রান্তরের ওপাশ থেকে একদল সৈন্য ছুটে আসছে। ফ্রান্সিস বুঝল আন্তো দুর্গে গিয়েছিল সৈন্যদের ডাকতে। দু’জনে ছুটেছে তখনও। সৈন্যরা ছুটে এসে দু’জনকে ঘিরে ফেলল। ফ্রান্সিস তলোয়ার ফেলে দিল। এখন এতজনের সঙ্গে লড়তে যাওয়া বোকামি।

আন্তো এগিয়ে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–এবার মূর্তিটা দাও।ফ্রান্সিস বলল– তোমাকে মূর্তি দেব না। আমাদের সেনাপতির কাছে নিয়ে চল। মূর্তি আমি তাকেই দেব।

–বেশ চলো। আন্তো বলল। আন্তোর সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সিস আর পারিসি চলল।

প্রান্তরের শেষেই দুর্গ। পাথর দিয়ে তৈরি। দুর্গের সদর দেউড়ির কাছে এলো সবাই। বিরাট বন্ধ দরজা ঘর ঘশব্দে খুলে গেল। সৈন্যদের সঙ্গে ফ্রান্সিস আর পারিসি দুজনেই ঢুকল।

দুর্গের একটা ঘরে ওদের নিয়ে এলো আন্তো। মশালের আলোয় দেখা গেল এটা। পাথরের আসনে সেনাপতি ফেলকো বসে আছে। সভাঘরে শুধু ঢুকল আন্তো। পেছনে পেছনে ফ্রান্সিস আর পারিসি। আন্তো একবার মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান জানিয়ে গ্রীক ভাষায় সব জানাল। সেনাপতি ফেলকো ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে কী বলল। ফ্রান্সিস কিছুই বুঝল না। ও বলল—আমি গ্রীক ভাষা জানি না। আপনি যা বলবার স্পেনীয় ভাষায়। বলুন। এবার সেনাপতি স্পেনীয় ভাষায় বলল–দুটো যীশুর মূর্তি তুমি উদ্ধার করেছে। একটা মূর্তি আন্তো নিয়ে এসেছে। অন্যটা তোমার কাছে আছে সেটা দাও। আমি স্থির করেছি একটা মূর্তি এই দুর্গের গীর্জায় বসাবো। ফ্রান্সিস বলল–

–এ কথা সত্য যে আমি দুটো মূর্তিই উদ্ধার করেছি। এর মধ্যে একটা আমার খুবই প্রয়োজন। একাট মূর্তি রাজা লুসিগনানকে দিতে পারলে আমার স্ত্রী ও বন্ধুদের মুক্ত করতে পারবো। কারণ ওরা সবাই আল জাহিরির কয়েদঘরে বন্দি হয়ে আছে। সেনাপতি ফেলকো সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো–না রাজাকে দেওয়া চলবে না। বোধহয় তোমরা জানো যে আমি রাজা গী দ্য লুসিগনানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি। রাজাকে দেওয়া চলবে না। দুটো মূর্তিই আমার চাই।

–তাহলে আপনিই তাদের বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করুন। ফ্রান্সিস বলল।

–না আমি তা পারবো না। আল জাহিরি প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা আমাকে দিয়েছে। তাই তাকে ক্রীতদাস কেনা বেচার হাট এখানে খুলতে দিয়েছি। সেনাপতি বলল।

–তাহলে আল জাহিরিকে বলুন ও যেন আমার স্ত্রী ও বন্ধুদের মুক্তি দেয়।ফ্রান্সিস বলল।

–আমি তা পারবো না। এটা ওর ব্যবসা। সেনাপতি বলল। ফ্রান্সিস চুপ করে রইল। সেনাপতি বলল-মূর্তি দাও। ফ্রান্সিস অনিচ্ছা সত্ত্বেও গলার দিকে দিয়ে হাত ঢুকিতে মূর্তিটা বের করল। এগিয়ে ধরল মূর্তি। সেনাপতি উঠে এগিয়ে এলো। বুকে ক্রশ এঁকে মূর্তিটা নিল। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মূর্তিটার দিকে।

ফ্রান্সিস ঘিরে দাঁড়াল। পারিসিকে বলল–চলো। দু’জনে সেই ঘরটা থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। পারিসি বলল–মূর্তিটা এভাবে দিয়ে দিলেন?

–উপায় কি। আমাদের মাথার শিরস্ত্রাণ তো দূরের কথা একটা ঢালও নেই। এ অবস্থায় লড়াইয়ে নামলে মৃত্যু অবধারিত। বেঁচে থাকলে সবই হবে। ফ্রান্সিস বলল।

–এবার কী করবেন?

–একটা সরাইখানায় থাকবো। মূর্তিটা গীর্জায় প্রতিষ্ঠা করা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। তারপর মূর্তিটা চুরি করবো।

–পারবেন চুরি করতে? পারিসি বলল।

 –সব ব্যবস্থা দেখবো তবেই বলা যাবে পারবো কিনা। ফ্রান্সিস বলল।

কেরিনিয়া নগরের পথ দিয়ে ফ্রান্সিস আর পারিসি চলল। কিছুদূর যেতেই রাস্তার ধারে একটা বড়ো সরাইখানা পেল। দু’জনে ঢুকল। এখানে বিদেশি লোকের সংখ্যাই বেশি। ঐ সরাইখানার একটা ঘরে দু’জনে আশ্রয় নিল।

তখন বিকেল। ফ্রান্সিস পারিসিকে বলল–পারিসি দুর্গে যাও। তুমি এই সাইপ্রাসের মানুষ। তোমাকে সন্দেহ করবে না। গীর্জায় প্রার্থনা করতে যাচ্ছো বললে কেউ বাধা দেবে না। গীর্জায় গিয়ে দেখবে নিওফিতসের তৈরি মূর্তিটা বেদীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিনা। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেখলেই কাজে নামতে হবে। এবার দুর্গের গীর্জায় যাও। লক্ষ্য করো গীর্জায় তালা লাগানো হয় কি না।

পারিসি সরাইখানা থেকে বেরিয়ে দুর্গের গীর্জায় চলল। দুর্গোর সেই সদর দেউড়ির সামনে বেশি পাহারাদার নেই। পারিসি দরজা পার হল। একজন পাহারাদার জিজ্ঞেস করল–কোথায় যাচ্ছো?

–গীর্জায় প্রার্থনা করতে পারিসি বলল।

হু —-যাও। পাহারাদার আর কিছু বলল না।

গীর্জার ভেতরে তখন কিছু লোকজনের ভিড় রয়েছে। ভেতরে ঢোকার আগে পারিসি ভালো করে দরজার মোটা কড়াটা দেখল। না কোনো তালা ঝুলিয়ে রাখা হয়নি। তার মানে গীর্জাটার দরজা সারারাত খোলাই থাকে। এই গীর্জায় পরিসি আগেও দু’তিনবার এসেছে। দূর থেকেই দেখল অগের মূর্তিটা বেদীতে নেই। সেখানে নিওফিতসের হাতে তৈরি মূর্তিটা বসানো হয়েছে। পরিসি যা জানতে এসেছিল তা সবই জানা হয়ে গেল। পারিসি গীর্জার আরো ভেতরে না ঢুকে বাইরে বেরিয়ে এলো। চলল সরাইখানার দিকে।

ফ্রান্সিসকে সব বলল। ফ্রান্সিস খুশিতে লাফিয়ে উঠল। মূর্তিটা বেদীতে স্থাপন করা হয়েছে আর গীর্জার দরজায় তালা দেওয়া হয় না ভেজিয়ে রাখা হয়। এই দুটো তথ্য পেয়ে ফ্রান্সিস খুশি হল। বলল–পারিসি–আজ রাতেই হানা দিতে হবে।

দু’জনে সরাইখানায় ফিরে এলো। সারাদিন শুয়ে বসে সময় কাটাল। কখন রাত হবে। কখন রাত গম্ভীর হবে তার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।

এক সময় সন্ধে হল। দু’জনে তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে নিল। এখন রাত গম্ভীর হওয়ার জন্য অপেক্ষা করা।

রাত বাড়তে লাগল। ফ্রান্সিস একসময় বলল–এবার চলো পারিসি।

দু’জনে সরাইখানা থেকে বেরিয়ে এলো। পথঘাট অন্ধকারে ডুবে আছে। ফ্রান্সিস অন্ধকারই চাইছিল। চললদু’জনে। দু’চারবার জোরহাওয়া বয়ে গেল। ফ্রান্সিস আকাশের দিকে তাকাল। একটা তারাও দেখা গেল না। ঘন মেঘে আকাশ অন্ধকার।

দুর্গের কাছাকাছি আসতে প্রথমে ছুটে এলো প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাস। তারপরই শুরু হল বৃষ্টি। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়তে লাগল। দু’জনেই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে চলল। সদর দেউড়ির দিকে যাওয়া যাবে না। নিশ্চয়ই পাহারাদার রয়েছে।

ফ্রান্সিস দুর্গের পেছন দিকে চলল। তখন প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। দুর্গের পেছনে বিস্তৃত বন জঙ্গল। ফ্রান্সিস দুর্গের প্রাচীর দেখতে দেখতে চলল। দুর্গ প্রাচীর কোথাও ফাটল নেই। দেখতে দেখতে একটা জায়গা এলো। বিদ্যুতের আলোয় দেখল প্রাচীরের একটা চৌকোণো পাথর দেয়াল থেকে বেরিয়ে আছে। আবার বিদ্যুৎ চমকাল। দেখল দেয়ালের মাথার কাছে দুটো পাথর আলগা। ফ্রান্সিস ঠিক করল দুর্গে ঢুকতে হলে এখান দিয়েই ঢুকতে হবে। প্রচণ্ড ঝড়জলের মধ্যে ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলল–পারিসি–এখান দিয়েই দেয়াল ডিঙোতে হবে। ফ্রান্সিস এরকম ঝড়জলই চাইছিল। ও মনে মনে ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাল।

ফ্রান্সিস খুলে ঝুলতে থাকা চৌকোণো পাথরের টুকরোটা সরিয়ে নীচে ফেলল। জায়গাটায় খোঁদলমতোহল। সেটায় রেখে ফ্রন্সিস উঠে দাঁড়াল। বুকের কাছে একটা পাথরের পাটায় হাত দিয়ে বুঝল-নড়বড় করছে। ফ্রান্সিস দুতিনবার টানতেই পাটাটা খুলে এলো। ওটা নীচে ফেলে দিল। এবার সেই খোদলটায় পা রেখে প্রাচীরের মাথার কাছে একটা বেরিয়ে থাকা পাথরের পাটা টানাটানি করে বুঝল ওটা শক্ত আছে। ফ্রান্সিস ঐ পাটায় ঝুলে পড়ে এক ঝটকায় প্রাচীরের মাথায় উঠে বসল।

এতক্ষণে বৃষ্টি কমে এসেছে। হাওয়ার সেই তেজও আর নেই। ফ্রান্সিস প্রাচীরের গায়ে দুটো পাথরের পাটা আগা দেখল। ও তারই একটা ঠেলে দিল। যে খোদলমতো হল সেটাতে পা রেখে লাফ দিয়ে নেমে এলো। প্রাচীরের ওপাশে তো ঘন জঙ্গল। তাই এপাশের প্রাচীরের ধারে কাছে সেনাপতি ফেলকোর কোনো পাহারাদার সৈন্য নেই। অবশ্য এই ঝড়জলে কোনো পাহারাদারও এদিকে থাকতে আসেনি।

এতক্ষণে বৃষ্টি আরো কমে এসেছে। হাওয়ার দাপটও কমেছে।

পাথর বাঁধানো প্রাঙ্গণ দিয়ে মাথা নিচু করে ফ্রান্সিস ছুটে চলল গীর্জাটার দিকে। গীর্জাটা ঘুরে আসতে হবে গীর্জাটার দরজার কাছে। ফ্রান্সিস এবার সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে দেখল–কোথাও মশাল জ্বলছে না। শুধু সৈন্যাবাসে মশাল জ্বলছে।

ফ্রান্সিস মাথা নিচু করে পাথরের প্রাঙ্গণটা পার হয়ে গীর্জার সদর দরজার কাছে। এলো। দেখল দরজায় দুটো বড়ো কড়া লাগানো কিন্তু তালা দেওয়া নেই। ফ্রান্সিস আস্তে দরজার একটা পাট খুলল। কচ্ কোঁচ্। অল্প শব্দ হল। ও গীর্জার ভেতরে ঢুকল। ভেতরে দু’পাশের পাথুরে দেওয়ালে দুটো নয় একটা মশাল জ্বলছে। বেদীতে কয়েকটা মোমবাতি জ্বলছে। সেই আলোয় যীশুখ্রীস্টের মূর্তিটা দেখা যাচ্ছে।

ফ্রান্সিস দ্রুত বেদীর কাছে ছুটে এলো। ঝড়বৃষ্টি থেমে গেছে। এখন হয়তো পাহারাদাররা পাহারা দিতে বেরুবে। মূর্তিটার সামনে দাঁড়িয়ে ও বুকে ক্রশচিহ্ন আঁকল। তারপর আলগোছে মূর্তিটা তুলে নিয়ে বুকের কাছে পোশাকের নীচে ঢুকিয়ে রাখল।

এবার পালানো। গীর্জার দরজার কাছে এলো ফ্রান্সিস। দেখল সদর দেউড়িতে কয়েকটা মশাল জ্বলছে। ওখানে জনা কয়েক সৈন্য পাহারা দিচ্ছে। ওদিক দিয়ে পালানো যাবে না।

ফ্রান্সিস মাথা নিচু করে অন্ধকারে ছুটল যেখান দিয়ে ঢুকেছিল সেইদিকে। পাথরখসা খোঁদলে পা রেখে রেখে প্রাচীরের মাথায় উঠে এলো। তারপর নীচের ঝোঁপ জঙ্গলে ঝপ করে নেমে এলো। পারিসি গলা নামিয়ে বলল–মূর্তি আনতে পেরেছেন? ফ্রান্সিস হেসে বলল–এ তো ছেলেখেলা। চলো এবার। এতল্লাটে আর থাকবো না।

অন্ধকার পথ দিয়ে দু’জনে সরাইখানায় এলো। খাওয়া-দাওয়ার পর দু’জনে শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস বলল–পারিসি–পাফোসের মঠটা কোথায় জানো?

জানি। এখান থেকে মাইল কয়েক দূরে। পারিসি বলল।

কালকে ঐ মঠে যাবো। অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করবো। ফ্রান্সিস বলল।

 পরদিন দু’জনে চলল পাফোসের মঠের অধ্যক্ষের উদ্দেশে। মঠেই দু’জনে দেখা করল অধ্যক্ষের সঙ্গে। মূর্তি দেখাল। অধ্যক্ষ তো আনন্দে দিশাহারা। বললেন, পারিসি কী পরম পবিত্র মূর্তি তোমরা এনেছো, তোমরা বোধহয় জানো না। মহান পুরুষ নিওফিতসের নিজের হাতে তৈরি মূর্তি যে খ্রীস্টিয় সমাজে কী অপরিসীম মূল্যবান তা বলে বোঝাতে পারবো না।

ফ্রান্সিসকে দেখিয়ে পারিসি বলল, এঁর নাম ফ্রান্সিস। জাতিতে ভাইকিং। ইনিই উদ্ধার করেছেন এই মূর্তি। অধ্যক্ষ তখন ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বললেন, বলো তুমি কী পুরস্কার চাও।

ফ্রান্সিস বলল, আমি কোনো পুরস্কার চাই না। আপনি দয়া করে এই মঠের একজন ধর্মযাজককে আমার সঙ্গে যেতে আদেশ দিন।

তা দিচ্ছি, কিন্তু সে তোমার সঙ্গে কোথায় যাবে? অধ্যক্ষ জানতে চাইলেন।

 রাজা গী দ্য লুসিগনানের রাজসভায়। রাজা লুসিগনানের সঙ্গে আমার একটা শর্ত ছিল। ধর্মযাজক যেন বলেন আমি মূর্তি উদ্ধার করেছি এবার রাজা তার শর্ত রাখুন।

মঠাধ্যক্ষ বললেন–বেশ তোমাকে একজন ধর্মযাজক নিয়ে যাবেন। এই মূর্তি এখন আমরা গীর্জার পবিত্রস্থানে রাখবো। কালকে রাজধানী নিকোশিয়া যাবার আগে তোমাদের দেওয়া হবে। সেই রাতটা দু’জনে অধ্যক্ষের অতিথি হয়ে মঠেই রইল।

পরদিন সকালে মঠাধ্যক্ষ একটা বড়ো গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন। একজন ধর্মযাজককে সঙ্গে দিলেন। সেই ধর্মযাজক মূর্তিটা দু’হাতে বুকের কাছে ধরে রইলেন। গাড়িতে ধর্মযাজকের পেছনে পেছনে ফ্রান্সিস, পারিসি উঠল। গাড়ি চলল রাজধানী নিকোশিয়ার দিকে।

দ্রুতগতিতে গাড়ি চলল। দুপুরের আগেই গাড়িটা নিকোশিয়া পৌঁছল। রাজপ্রাসাদের সামনে এসে দাঁড়াল। তিনজনেই রাজসভায় ঢুকল। চারপাশের লোকজন প্রহরীরা সবাই মাথা নুইয়ে ধর্মযাজককে সম্মান জানাল। রাজাও সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ধর্মযাজক হাত নেড়ে তাদের বসতে বললেন। সবাই বসলেন।

ধর্মযাজককে একটা আসনে বসতে দেওয়া হলো। ফ্রান্সিস আর পারিসি দাঁড়িয়ে রইল। ধর্মযাজক তার বুকে ধরা যীশুর মূর্তিটা রাজাকে দেখিয়ে বললেন–রাজা–এই মূর্তিটিই মহাপুরুষ নিওফিতসের নিজের হাতে তৈরি মূর্তি। ফ্রান্সিসকে দেখিয়ে বললেন–এর নাম ফ্রান্সিস। এরা দুঃসাহসী ভাইকিং। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর প্রায় উপবাসে থেকে এই মূর্তিটা উদ্ধার করেছি। কিন্তু আপনার বিদ্রোহী সেনাপতি ফেলকো সেটা লোক দিয়ে চুরি করিয়ে নিয়ে নিজের কাছে রেখেছে। রাজা বললেন–কয়েকদিনের মধ্যে ফেলকোকে পরাস্ত করে আমি ঐ মূর্তিটাও উদ্ধার করবো। ধর্মযাজক এবার ফ্রান্সিসকে বললেন–তুমি রাজকে কী বলবে বলেছিলেন সেটা বলো। ফ্রান্সিস মাথা একটু নুইয়ে সম্মান জানিয়ে রাজাকে বলল– মহামান্য রাজা–আপনি কথা দিয়েছিলেন যে মূর্তি উদ্ধার করতে পারলে আমার স্ত্রী ও বন্ধুদের আল জাহিরির হাত থেকে মুক্ত করে দেবেন। রাজা বললেন–হ্যাঁ বলেছিলাম। সমস্ত সাইপ্রাসবাসীরা আজ তোমার জন্য এক অমূল্য সম্পদের অধিকারী হল। তোমার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। একটু থেমে বললেন–কিন্তু মুস্কিল হয়েছে আমার ভূতপূর্ব সেনাপতি ফেলকো বিদ্রোহ করে এর মধ্যে কেরিনিয়ার দুর্গ দখল করে ওর রাজত্ব কায়েম করেছে। আমার লোকজন আর এখন কেরিনিয়ায় ঢুকতে পারবে না।

–তাহলে আমার বন্ধুরা কীভাবে মুক্তি পাবে। ফ্রান্সিস বলল।

কয়েকদিনের মধ্যেই আমি কেরিনিয়া আক্রমণ করে দখল করবো। তখন তোমার বন্ধুদের মুক্ত করবো। রাজা বললেন।

–ততদিনে ক্রীতদাসের হাটে হয়তো আমার স্ত্রী আর বন্ধুরা বিক্রি হয়ে যাবে। ফ্রান্সিস বলল। রাজা বললেন–সেজন্যেই আমি স্থির করলাম আমার বর্তমান সেনাপতি তোমাকে গাড়িতে নিয়ে গিয়ে কেরিনিয়ার সীমান্তে রেখে আসবে। তুমি কেরিনিয়ায়। ঢুকে বন্ধুদের খোঁজখবর করতে পারবে। তুমি বিদেশি। তোমাকে কেউ কিছু বলবে না।

–কিন্তু আল জাহিরি আমাকে দেখলেই বন্দি করবে। ফ্রান্সিস বলল।

–তুমি যতটা সম্ভব আত্মগোপন করে কাজ সারবে। রাজা বললেন।

–বেশ তাই হবে। ফ্রান্সিস বলল। এবার রাজা বললেন—

–এবার বলো তুমি যে মূর্তি উদ্ধার করেছে তার বিনিময়ে কি চাও?

–আমি দশটি স্বর্ণমুদ্রা চাই। প্রয়োজনে আমি আংটি বন্ধক রেখেছিলাম। সেটা ছাড়াতে হবে। আর কয়েকটা দিন আমাকে আত্মগোপন করে থাকতে হবে। কাজেই দশটি স্বর্ণমুদ্রা আমার খুবই প্রয়োজন।

-বেশ। আর কিছু চাই? রাজা বললেন।

–না। ফ্রান্সিস বলল।

তুমি একটা অমূল্য জিনিস উদ্ধার করেছো। তুমি যা খুশি চাইতে পারো। রাজা বললেন।

–না। মান্যবর রাজা আমার কিছুই চাই না। শুধু আমার বন্ধুদের মুক্তি চাই। ফ্রান্সিস বলল।

–ঠিক আছে। রাজা একজন প্রহরীকে ইঙ্গিতে কাছে ডাকলেন। রাজা তাকে কিছু নির্দেশ দিলেন। একটু পরেই প্রহরীটি ফিরে এসে রাজাকে দশটি স্বর্ণমুদ্রা দিল। রাজা সেই দশটি স্বর্ণমুদ্রা ফ্রান্সিসকে দিলেন।

রাজপ্রাসাদ থেকে ফ্রান্সিস ও পারিসি বেরিয়ে এলো। পারিসি বলল–ফ্রান্সিস আমার কাজ তো শেষ। আমি এবার বাড়ি যাবো। আমার বুড়ি মা একা আছে।

–ঠিক আছে তুমি যাও। আমার সঙ্গে থেকে অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। এই কথা বলে ফ্রান্সিস পারিসির ডান হাতটা জড়িয়ে ধরল। পারিসিও হাতে জোরে চাপ দিল। তারপর চলে গেল। পারিসি ওর মা’র কথা বলল। তাতেই ফ্রান্সিসের নিজের মায়ের কথা মনে পড়ল। ওর চোখ দুটো ভিজে উঠল। চোখ মুছে তাকিয়ে দেখল সামনেই রাজবাড়ির গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িতে সেনাপতি বসে আছে। সেনাপতি ইঙ্গিতে ফ্রান্সিসকে গাড়িতে উঠে আসতে বলল। ফ্রান্সিস গাড়িতে উঠে সেনাপতির সামনের আসনে বসল। ফ্রান্সিস বলল–কেরেনিয়া তো বেশ দূর। পৌঁছোতে পৌঁছোতে রাত গম্ভীর হয়ে যাবে।

–আমিও সেটাই চাই। রাতের অন্ধকারেই তোমতাকে রেখে আসবো। সেনাপতি বলল।

গাড়ি চলল কেরিনিয়া বন্দর শহরের উদ্দেশে। কথা প্রসঙ্গে সেনাপতি বলল–এই মওকায় তুমি সোনাদানা চাইলে রাজা তাই দিতেন। ফ্রান্সিস হেসে বলল–সোনাদানার ওপর কোনো লোভ নেই আমার। আমার এখন সবচেয়ে প্রয়োজন বন্ধুদের মুক্তি। আর কিছু না। কথাটা বলেই ফ্রান্সিসের মনে পড়ল ওদের বিয়ের সেই দামি আংটিটা এক স্বর্ণকারের কাছে বন্ধক আছে। ফ্রান্সিস বলল–সেনাপতি মশাই–একটা ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই।

–বলো কী রকম সাহায্য? সেনাপতি বলল।

–একজন স্বর্ণকারের কাছে অভাবের সময় একটা আংটি বন্ধক রেখেছি। ওটা ছাড়িয়ে নিয়ে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।

–বেশ তো–স্বর্ণকারের দোকানটা কোথায় দেখিয়ে দাও। সেনাপতি বলল।

–চলুন দেখাচ্ছি। ফ্রান্সিস বলল।

দোকানটার সামনে এসে ফ্রান্সিস সেনাপতিকে দোকানটা দেখাল। সেনাপতি গাড়ি থামাতে বলল। গাড়ি থামল। সেনাপতি কোচওয়ানকে বলল–স্বর্ণকারকে ডেকে নিয়ে, আয়। একটু পরেই কোচয়ানের সঙ্গে কাঁপতে কাঁপতে স্বর্ণকার এলো। সেনাপতি ডাকছেন। ভয় তো হবেই। সেনাপতি ফ্রান্সিসকে দেখিয়ে বলল–এর একটা আংটি তোমার কাছে বন্ধক আছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ। স্বর্ণকার ভীতস্বরে বলল।

–ঐ আংটিটা নিয়ে এসো। সেনাপতি বলল।

–এক্ষুণি আনছিস্বর্ণকার পড়িমরি করে ছুটল। আংটিটা নিয়ে ফিরে এলো। সেনাপতি আংটিটা হাতে ফ্রান্সিসকে বলল–এটাই তোমার আংটি?

-হ্যাঁ। ফ্রান্সিস বলল। সেনাপতি আংটিটা ফ্রান্সিসকে দিল। ফ্রান্সিস আংটিটা আঙ্গ লে পরতে পরতে বলল–কিন্তু আমাকে কত দিতে হবে। সেনাপতি হাত তুলে ফ্রান্সিসকে .থামাল। কোচোয়ানকে বলল–গাড়ি চালা। গাড়ি চলল।

গাড়িতে বসে ফ্রান্সিসের সঙ্গে সেনাপতির সামান্য কথাই হল।

তখন রাত গভীর। অন্ধকারে একটা বিরাট গাছের নীচে এসে সেনাপতি গাড়ি থামাতে বলল। কোচোয়ান গাড়ি থামাল। সেনাপতি বলল–এখান থেকে কেরিনিয়া শুরু হল। আমরা আর যাবো না। তুমি নেমে যাও।

ফ্রান্সিস গাড়ি থেকে নেমে এলো। অন্ধকারে উত্তরমুখো কেরিনিয়া বন্দরের উদ্দেশে চলল।

কেরিনিয়া বন্দর শহরে যখন ঢুকল্প তখন পুব আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। একটু পরেই সূর্য উঠল। ফ্রান্সিস আগেই জাহাজঘাটার দিকে গেল না। খুঁজে খুঁজে একটা সরাইখানায় উঠল। সকালের জলখাবার খেয়েই শুয়ে পড়ল। মাথায় চিন্তা কীভাবে বন্ধুদের মুক্ত করবে। কে জানে এই কদিনের মধ্যেই মারিয়া আর বন্ধুদের আল জাহিরি ক্রীতদাসের হাটে বিক্রি করে দিয়েছে কিনা। এইসব ভাবতে ভাবতে রাত জাগার ক্লান্তিতে ফ্রান্সিস ঘুমিয়ে পড়ল।

দুপুরে ঘুম থেকে উঠে স্নান খাওয়া সারল। তারপর তৈরি হয়ে গেল। কেরিনিয়া দুর্গ জাহাজঘাটা থেকে দূরে। কাজেই বিদ্রোহী সেনাপতি ফেলকোর সৈন্যদের নজরে পড়ার সম্ভাবনা নেই। বাকি রইল আল জাহিরি আর তার সৈন্যরা কয়েদঘরের আড়াল থেকে সব দেখতে হবে।

ফ্রান্সিস যখন জাহাজঘাটার কাছে পৌঁছল তখন বেশ বেলা হয়েছে। দূর থেকেই দেখল জাহাজঘাটায় ওদের জাহাজটা নেই। ফ্রান্সিসের কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগল। তাহলে কি ওর বন্ধুদের ও মারিয়াকে ক্রীতদাসের হাটে বিক্রি করে আল জাহিরি ওর সৈন্যদের নিয়ে জাহাজ চালিয়ে চলে গেছে? ফ্রান্সিস কিছুই ভেবে ঠিক করতে পারল না। সত্যি সত্যি এখানে ঠিক কী ঘটেছে।

ফ্রান্সিস বাড়িঘরের আড়ালে আড়ালে লম্বাটে কয়েদঘরটার কাছে এলো। কয়েদঘরের আড়াল থেকে নজর রাখল ওদের জাহাজের ওপর। জাহাজের ডেক-এ কয়েকজন ভাইকিং শুয়ে বসে আছে এটা দেখল। আবছা আন্দাজে চিনতেও পারল না। কিন্তু ওরা বন্দি না মুক্ত এটা ঠিক বুঝল না।

বেশ কিছুক্ষণ কয়েদঘরের আড়াল থেকে ফ্রান্সিস নজর রাখল।হঠাৎ বন্ধুদের সামনে যাওয়াটা উচিত হবে না। বন্ধুদের দেখে এটা বোঝা যাচ্ছে যে ওরা বন্দি নয়। বন্দি হলে নীচে কয়েদঘরে থাকতো ওরা। ডেক-এ নয়।

ফ্রান্সিস এসব ভাবছে তখনই দেখল ধনুকতির কাঁধে শাঙ্কো জাহাজের পাটাতন দিয়ে নেমে আসছে। এবার ফ্রান্সিস নিশ্চিন্ত হল যে বন্ধুরা বন্দি হয়ে নেই।

শাঙ্কো শিকারের জন্যে কয়েদঘরের ওপাশে বড়ো জঙ্গলটার দিকে যাচ্ছে। শাঙ্কো কয়েদঘর:ছাড়িয়ে আসতেই ফ্রান্সিস ছুটে ওর সামনে গেল। ডাকল–শাঙ্কো। শাঙ্কো ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। শাঙ্কো কিছুতেই ফ্রান্সিসকে ছাড়ছে না। তখন ফ্রান্সিস ওর পিঠে আস্তে চাপড় মেরে বলল–এই শাঙ্কো-পাগলামি করো না। শাঙ্কো হাত আলগা করল। ফ্রান্সিস বলল–কী ব্যাপার বলো তো? আল জাহিরি তার জাহাজ পাহারাদার সৈন্যরা কোথায় সব?

–মাঝ সমুদ্রে নিজে একা আল জাহিরি তার জাহাজে ঘুরপাক খাচ্ছে। শাঙ্কো বলল।

 –কিছুই বুঝলাম না। ফ্রান্সিস বলল। বলো–

–জাহাজে চলো সব বলছি। তার আগে বলো তুমি কি যীশুর মূর্তি উদ্ধার করতে পেরেছো? শাঙ্কো জানতে চাইল।

-হ্যাঁ–একটা নয় দুটো মূর্তি। তার একটা বিদ্রোহী সেনাপতি ফেলকো চুরি করে নিয়েছে। অন্যটা আমি আর পারিসি রাজা গী দ্য লুসিগনানের হাতে দিয়েছি। শাঙ্কো চিৎকার করে ধ্বনি তুলল—ও হো হো। ফ্রান্সিসও গলা মেলাল। তারপর দুজনে ওদেরজাহাজে দিকে চলল।

জাহাজের পাটাতনে ফ্রান্সিসরা পা রাখতেই ডেক-এ শুয়ে বসে থাকা ভাইকিং বন্ধুরা ওদের দেখল। ওরা উঠেপঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল–ফ্রান্সিস এসেছে। নিচের কেবিনঘর থেকে সবাই ছুটে এসে ডেক-এ উঠতে লাগল। হ্যারি ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। মারিয়া হাসতে হাসতে ছুটে এলো। ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল মারিয়ার শরীরটা বেশ রোগা হয়ে গেছে। ভাবল–মারিয়াকে এই অভিযানে আনা উচিত হয়নি। ছোটবেলা। থেকে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে আদরে মানুষ হয়েছে মারিয়া। ওর পক্ষে এত ধকল পোহানো সম্ভব নয়। ফ্রান্সিস দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল এখন আর ওসব ভেবে কি লাভ। ওদিকে বন্ধুরা সমস্বরে চিৎকার করে উঠল—ও হো হো ।

মারিয়া হাসতে হাসতে এসে ফ্রান্সিসের একটা হাত ধরল। ফ্রান্সিস হেসে বলল– এবারও আমার হাত খালি। তবে যদি আর এক সপ্তাহ এখান অপেক্ষা করতে পারো তবে মহাত্মা নিওফিতসের নিজের হাতে তৈরি একটা যীশুর মূর্তি পেতে পারি।

-না-মারিয়া মাথা নেড়ে বলল–আমরা এবার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ফিরবো।

বেশ তোমরা যেমন চাও। ফ্রান্সিস বলল।

ভাইকিংরা চিৎকার করে উঠল—ও হো হো। তারপর একদল ছুটল নোঙর তুলতে অন্যদল পাল খুলে দিতে আর একদল দাঁড়ঘরে দাঁড় টানার জন্যে। এবার দেশে ফেরা। জাহাজ চালাতে হবে যত দ্রুত সম্ভব।

হ্যারি আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসকে বলল মারিয়ার অসুস্থতার কথা আল জাহিরির সৈন্যদের সঙ্গে লড়াইয়ের কথা সবই বলল। ফ্রান্সিস মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল–এখন তোমার শরীর কেমন? মারিয়া হেসে বলল–তুমি এসেছো–আমার দুশ্চিন্তা কমল–এবার আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হবো। তুমি কিচ্ছু ভেবো না।

ততক্ষণে জাহাজের সব পাল খুলে দেওয়া হয়েছে। দাঁড়িরা দাঁড়ঘরে দাঁড় টানছে। ফ্রান্সিসদের জাহাজ পূর্ণবেগে সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে চলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *