২
ওদিকে ফ্রান্সিস আর পারিসি পালিয়ে গেছে বলে হ্যারিদের সবাইয়ের হাত বেঁধে দেওয়া হলো। হাত-বাঁধা অবস্থাতেই খাওয়া শোওয়া।
সেদিন বিকেলে ডঠাং ঢং করে কয়েদখানার লোহার দরজা খুলে গেল। ভাইকিংরা একটু আশ্চর্যই হলো। এ সময় তো দরজা খোলা হয় না।
দরজা দিয়ে ঢুকল আল জাহিরি। সঙ্গে এক রোগা লিকলিকে আরবী। বেশ ফর্সা। চিবুকে ছাঁটা দাড়ি। মাথায় লাল ফেজ টুপি পরা। দু’জন পাহারাদারকে আল জাহিরি কী বলল। তারা মারিয়ার কাছে এলো। মারিয়ার হাত ধরল। মারিয়া এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল। এবার হ্যারিরা বুঝতে পারল মারিয়াকে ক্রীতদাসীর মতো ঐ শুটকো লোকটার কাছে বিক্রি করা হবে। হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল– ও-হো-হো। সঙ্গে সঙ্গে সব ভাইকিং বন্ধুরা উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল। ও-হো-হো৷ পাহারাদার দু’জন বেশ ঘাবড়ে গেল। কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। আল জাহিরি দেখল এসব। তারপর ইঙ্গিতে হ্যারিকেডাকল। ঐ শুটকো লোকটা বোধহয় গ্রীক আর আরবী ভাষা জানে। অন্য ভাষা জানে না। তাই হ্যারিকে ডাকল আল জাহিরি।
হ্যারি এগিয়ে গিয়ে আল জাহিরির সামনে দাঁড়াল। আল জাহিরি বলল, আজ হোক, কাল হোক, তোমাদের সবাইকে বিক্রি করা হবে। তবে তোমরা বাধা দিচ্ছো কেন?
হ্যারি বলল, শুধু রাজকুমারীকে আমরা বিক্রি করতে দেব না। আমাদের সবাইকে যেদিন বিক্রি করবেন সেইদিন রাজকুমারীকে বিক্রি করতে পারবেন। তার আগে নয়। আল জাহিরি হেসে বলল, ভালো দামে বিক্রি হতো।
সে তো আপনার কেঠো হাসি দেখেই বুঝতে পারছি। হ্যারি বলল।
আল জাহিরি ব্যবসাদার। বুঝল–এত তাড়াহুড়ো করতে গেলে ঝামেলায় পড়তে হবে। ওর দরকার হ্যারিদের আর মারিয়াকে বিক্রি করা। সময় সুযোগ মতো সেটা করতে হবে। দু’চারজনকে অন্য কয়েদখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এই অজুহাত দেখিয়ে দফায় দফায় নিয়ে বিক্রি করতে হবে। ভাইকিংদের সংখ্যাও কমে আসবে। তখন রাজকুমারীকে বিক্রি করা হবে। কারণ তখন বাধা দেওয়ার মতো ভাইকিংরা খুব কম থাকবে। সহজেই সব মিটে যাবে।
সেই শুটকো মতো লোকটাকে কী বোঝাতে বোঝাতে আল জাহিরি চলে গেল।
সেদিন একটু বেলায় কয়েদঘরের দরজা ঢং ডঠাংশব্দে খুলে গেল। সৈন্যরা কয়েদঘরে ঢুকতে লাগল। সকলের হাত দড়ি দিয়ে বাঁধতে লাগল। মারিয়াও বাদ গেল না। তারপর আট-দশজন সৈন্য খোলা তলোয়ার হাতে ওপরে ডেক-এ ওঠার সিঁড়ির কাছে দাঁড়াল। পাহারাদাররা হ্যারিকে বলল, সবাইকে বলো–ডেক-এ উঠতে হবে। হ্যারি গলা চড়িয়ে সেই কথাই সবাইকে বলল। ফ্রান্সিসের ভাইকিং বন্ধুরা একে একে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল।
প্রায় অন্ধকার কয়েদঘর থেকে বাইরের আলোয় আসতেই সবাই কিছুক্ষণ তাকাতেই পারল না। এই অভিজ্ঞতা ফ্রান্সিস আর বন্ধুদের আছে, কিন্তু মারিয়ার এই অভিজ্ঞতা নেই। মারিয়া বলে উঠল, আমি যে তাকাতেই পারছি না।
হ্যারি বলল, রাজকুমারী কিছুক্ষণের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। সত্যিই তাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরের আলোর তীব্রতা মারিয়ার চোখে সয়ে গেল। ক্যারাভেল থেকে কাঠের পাটাতন ফেলা হয়েছে। পাটাতন দিয়ে হেঁটে হেঁটে সবাই নেমে এলো। সৈন্যদল ওদের ঘিরে নিয়ে চলল। যেখানে হ্যারিদের নামানো হলো সেখান থেকে কেরিনিয়া বন্দর বেশ দূরে।
কেরিনিয়া বন্দরে তখন ব্যস্ততা। বেশ কয়েকটি নানা দেশের জাহাজ ভেড়ানো আছে। দু’একটা জাহাজ বন্দর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। হ্যারিরা যেখানে নামল সেখানটায় দেখল দুতিনটে লম্বাটে ঘর। ঘরগুলোর মাথায় শুকনো ঘাস আর পাতার ছাউনি। কাফ্রি আরবী গ্রীক পাহারাদার সৈন্যরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরা সবাই ঐ তিনটি কয়েদঘরের পাহারাদার।
ভাইকিংদের নিয়ে আসা হলো মাঝখানের ঘরটার সামনে। লোহার গরাদ লাগানো দরজা। দু’জন পাহারাদার তালা খুলে ঢং ডটাং শব্দে লোহার দরজা খুলল। ওদের সেই ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। শব্দ তুলে দরজা বন্ধ করা হলো।
এই পাথরগাঁথা কয়েদঘরে ওপরের দিকে গরাদ দেওয়া দু’টো জানালা। এই দিনের বেলাও মশাল জ্বলছে। মেঝেয় শুকনো ঘাস লতাপাতা দড়ি দিয়ে বেঁধে শক্ত করা বিছানা মতো।
যীশুর কাঠের মূর্তি ভাইকিংরা কেউ বসল, কেউ শুয়ে পড়ল, কেউ কেউ পায়চারি করতে লাগল।
হ্যারি কয়েদঘরের কাঠের দেয়ালে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে বসেছিল। মাথায় নানান চিন্তা। ফ্রান্সিস আর পারিসি তো পালাল। ওরা নির্বিঘ্নেই পালিয়েছে। কিন্তু ওরা কী করে হ্যারিদের মুক্ত করতে পারবে সেটাই চিন্তার। হ্যারিদের একমাত্র সান্ত্বনা ফ্রান্সিস বাইরে আছে। ও মুক্ত। একটা কিছু উপায় ফ্রান্সিস নিশ্চয়ই বুদ্ধি করে বের করবে। ওদিকে শাঙ্কো ভাবল–সে একা পালাবে। ক্রীতদাসের হাটে হ্যারিদের বিক্রি করার আগেই সবাইকে মুক্ত করতে হবে। এই নিয়ে শাঙ্কো ভাবতে লাগল। শেষ পর্যন্ত স্থির করল পালাতে হবে। ও হ্যারির কাছে গিয়ে বসল। মৃদুস্বরে বলল–হ্যারি আমি পালাবো।
–কী করে? হ্যারি একটু আশ্চর্য হয়েই বলল।
–সেসব আমার ভাবা হয়ে গেছে। শাঙ্কো বলল।
–শাঙ্কো ভেবেচিন্তে পা ফেলো–হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস আর পারিসি পালিয়েছে। ফ্রান্সিস আমাদের মুক্তির একটা কিছু ব্যবস্থা করবেই। তার আগে তুমি পালাতে যেও না। তোমার যদি কোনো বিপদ হয় ফ্রান্সিস রাগ করবে আমাদের ওপর। কেন আমরা তোমাকে বাধা দিই নি এই জন্যে। শাঙ্কো বলল–
–আমার কোনো বিপদ হবে না। আমি আটঘাট বেঁধেই নামবো।
–বেশ–তোমার দায়িত্বেই তুমি এই ঝুঁকি নিচ্ছে। পরে আমাদের দোষ দিও না। হ্যারি বলল।
–আমি কাউকেই দোষ দেব না। এই ঝুঁকির সব দায়িত্ব একা আমার। শাঙ্কো বলল।
তখনও রাতের খাবার দেবার সময় হয়নি। শাঙ্কো হ্যারিকে বলল–রাতের খাবার দেবার সময় আমি পালাবো। এবার হ্যারি আমার জামার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে ছোরাটা বার করো। হ্যারি দড়িবাঁধা দু’হাত শাঙ্কোর গলার কাছে জামার মধ্যে ঢুকিয়ে ছোরাটা বের করে আনল। শাঙ্কো বলল এবার আমার হাতের দড়িটা কাটো। হ্যারি জোড়া দু’হাতে ছোরা ধরে শাঙ্কোর হাত বাঁধা দড়ি ঘষে ঘষে কাটতে লাগলো। ছোরাটা তো হ্যারি ভালো করে ধরতে পারছে না। ছোরা এদিক-ওদিক ঘুরে যাচ্ছে। শাঙ্কোর হাত কেটে যাচ্ছে। রক্ত বেরোচ্ছে। শাঙ্কো মুখ বুজে আছে। একসময় দড়িটা কেটে গেল। শাঙ্কো ছোরাটা নিয়ে জামার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল।
রাত হল। ঢঢং ঢং শব্দে লোহার দরজা খুলে গেল। তিনজন পাহারাদার খাবার নিয়ে ঢুকল। লোহার দরজার বাইরে দু’জন সৈন্য খোলা তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে রইল। ফ্রান্সিস আর পারিসি পালাবার পর ওরা সাবধান হয়ে গেছে। তিন পাহারাদার যখন খাবার দিতে শুরু করল শাঙ্কো একলাফে উঠে লোহার দরজা পার হয়ে বাইরে চলে এলো। তিন পাহারাদার খাবার কাঠের মেঝেয় রেখে তলোয়ার খুলে দরজার দিকে ছুটল। ততক্ষণে শাঙ্কো লোহার দরজা বাইরে থেকে কড়া টেনে বন্ধ করে দিয়েছে। তিন পাহারাদার আটকা পড়ে গেল। বাইরের খোলা তলোয়ার হাতে দু’জন সৈন্য শাঙ্কোর দিকে ছুটে এল। শাঙ্কো প্রথম সৈন্যটিকে আর তলোয়ার চালাতে দিল না। দ্রুত ছুটে এসে ওর পেটে মাথা দিয়ে ফুঁ মারল। সৈন্যটি কাত হয়ে কাঠের মেঝের পড়ে গেল। হাতর তলোয়ার ছিটকে গেল। পরের সৈন্যটি তলোয়ার চালাল। শাঙ্কো মাথা নিচু করে তলোয়ারের মার এড়াল। তারপর ছুটল কাঠের সিঁড়ির দিকে। সৈন্যটিও খোলা তলোয়ার হাতে পেছনে পেছনে ছুটলো। শাঙ্কো ততক্ষণে সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ দ্রুত উঠে গেছে। শাঙ্কো বুঝল যে সৈন্যটি এবার চেঁচিয়ে অন্য সৈন্যদের ডাকবে। কাজেই ওর মুখ বন্ধ করতে হবে। শাঙ্কো ঘুরে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির প্রথম ধাপে-ওঠা সৈন্যটির মুখে গায়ের সমস্ত জোর একত্র করে লাথি মারল। সৈন্যটা চিত হয়ে সিঁড়ির ওপর গড়িয়ে পড়ল। চিৎকার করে উঠতে পারল না।
এবার শাঙ্কো দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উঠে ডেক-এ উঠে এলো। সৈন্যরা কিছু বোঝার আগেই শাঙ্কো রেলিং ডিঙিয়ে এক লাফে সমুদ্রের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ডুব সাঁতার দিয়ে যতটা দমে কুলোয় ততটা এগিয়ে গেল। তারপর আস্তে আস্তে জলের ওপর মাথা তুলল। দেখল জাহাজ থেকে অনেকটা দূরেই চলে এসেছে। ডেক-এ সৈন্যদের সঙ্গে আল জাহিরি এসে দাঁড়িয়েছে। শাঙ্কো আস্তে আস্তে জলে কোনোরকম শব্দ না করে নিজেদের জাহাজটার দিকে সাঁতার কেটে চলল।
একসময় জাহাজটার পেছনের দিকে এলো। তারপর হালের খাঁজে পা রেখে জল থেকে উঠল। তারপর হালের খাঁজে খাঁজে পা রেখে রেখে ডেক-এর কাছে উঠে এল। আগেই ডেক-এ নামল না। রেলিঙের আড়াল থেকে দেখল মাত্র দু’জন সৈন্য ডেক-এ রয়েছে। একজন ডেক-এর কাঠের মেঝেয় শুয়ে আছে অন্যজন বসে আছে। শাঙ্কো ডেক-এ শুয়ে পড়ল। তারপর বুক নিয়ে চলল সিঁড়িঘরের দিকে। সিঁড়ির কাছে এসে আস্তে সিঁড়িতে পা রেখে উঠে দাঁড়াল। অন্ধকারে সৈন্য দু’জন কিছুই দেখতে পেল না। এলো ওরা আগের মতোই গল্প করতে লাগল। শাঙ্কো সিঁড়ি দিয়ে কেবিনঘরে নেমে এলো। নিজের কেবিনঘরে গিয়ে শুকনো পোশাক বের করল। তখনও শাঙ্কো হাঁপাচ্ছে। জলে ভেজা পোশাক ছেড়ে শুকনো পোশাক পরে নিল। এবার খাওয়া। রাতের খাবারটা খাওয়া হয়নি। ভীষণ খিদে পেয়েছে। শাঙ্কো রসুইঘরে ঢুকল। দেখল বেশ কয়েকটা গোল রুটি আছে। দু’তিনদিনের মতো নিশ্চিন্ত ছুরি দিয়ে গোল রুটি কেটে কেটে খেতে লাগল। খাওয়া হলে জল খেয়ে নিজের কেবিনঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুমনো পর্যন্ত একটা চিন্তাই ঘুরে ঘুরে মাথায় এলো–মারিয়া হ্যারিদের কীভাবে মুক্ত করা যায়? ফ্রান্সিস পালিয়েছে। আমিও পালালাম। কিন্তু বন্ধুরা সবাই তো ফ্রান্সিস বা আমার মতো পালাতে পারবে না। ওদের পালাবার উপায় একটা বের করতে হবে। ফ্রান্সিস আর পারিসি পালিয়ে কী করল সেও জানি না। রাজা’গী দ্য লুসিগনানের সঙ্গে ফ্রান্সিস দেখা করতে পেরেছে কি না কিছুই জানি না। যা হোক–আমিই বন্ধুদের মুক্ত করবো। তার উপায়টা ভেবে ভেবে বের করতে হবে। দেখা যাক। রাত বাড়তে শাঙ্কোর দু’চোখ ঘুমে জড়িয়ে এলো।
সকালে ঘুম ভেঙে গেল। শাঙ্কো রসুইঘরে গিয়ে কিছু খেয়ে এলো। সারাক্ষণই ভাবতে লাগল কী উপায়ে হ্যারি, মারিয়া আর বন্ধুদের মুক্ত করা যাবে। কিন্তু কোনো উপায় ভেবে ভেবে স্থির করতে পারল না।
এমন সময় আল জাহিরির ক্যারাভেল জাহাজ থেকে উচ্চস্বরে কথাবার্তা ভেসে। এলো। শাঙ্কোর কৌতূহল হল। কী ঘটল ঐ জাহাজে।
শাঙ্কো আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে ডেক-এ উঠে এলো। তারপর জাহাজের পাটাতনে শুয়ে পড়ে গড়িয়ে চলে এলো মাস্তুলের পেছনে। মাস্তুলের আড়াল থেকে তাকিয়ে দেখল মারিয়া হ্যারিদের জাহাজ থেকে নামিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। বোঝা গেল ওদের সমুদ্রতীরের কাছে কোনো কয়েদখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মারিয়া হ্যারিদের জাহাজ থেকে নামিয়ে আনা হল। সৈন্যরা খোলা তলোয়ার হাতে ওদের ঘিরে দাঁড়াল। তারপর হাঁটিয়ে নিয়ে চলল কিছুদূরে একটা লম্বাটে ঘরের দিকে। শাঙ্কো বুঝল–ঐ লম্বাটে ঘরটাই কয়েদঘর। ক্রীতদাস কেনাবেচারহাট এখানেই আছে। হাতবাঁধা মারিয়া হ্যারিরা ততক্ষণে ঐ কয়েদখানায় পৌঁছে গেছে।শাঙ্কো গভীরভাবে ভাবতে লাগল কী করবে ও? একটু ভেবে ভেবে বের করল যে জাহাজের বাইরে আসায় হ্যারিদের মুক্ত করা সহজ হবে। মৃত্যু রক্তপাত না। ঘটিয়ে জাহাজ থেকে মুক্ত করা অসম্ভব ছিল। এখন কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেল। শাঙ্কো ভেবে ভেবে স্থির করল যা করার আজ রাতেই করতে হবে। সময় নষ্ট করা চলবে না। হয়তো কাল পরশুর মধ্যেই এখানে ক্রীতদাস কেনাবেচার হাট বসবে। মারিয়া হ্যারিরা একবার বিক্রি হয়ে গেলে আর তাদের খোঁজ পাওয়া অসম্ভব। কাজেই আজ রাতেই ওদের মুক্তির জন্যে চেষ্টা করতে হবে। শাঙ্কো এরমধ্যে উপায়টা ভেবে নিল। সবকিছুই নির্ভর করছে কয়েদখানায় ক’জন পাহারাদার রাখা হয় তার ওপর।
শাঙ্কো নিজের কেবিনঘরে নেমে এলো। বিছানায় শুয়ে পড়ল। ভাবতে লাগল। অনেক ভাবনা মাথায়।
দুপুরে গোল রুটি কেটে নিয়ে চিনি দিয়ে খেল। খিদের মুখে ঐ খাবারই অমৃত মনে হল।
সন্ধে হল। শাঙ্কো তখনও চুপ করে বিছানায় শুয়ে রইল।
রাত হল। রাতের খাওয়া খেয়ে শাঙ্কো ওদের অস্ত্রঘরে গেল। তীর ধনুক নিল। কোমরে তলোয়ার গুজল। বলা যায় না যদি লড়াইয়ে নামতে হয়।
রাত বাড়তে লাগল। শাঙ্কো তখনও বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম করছে।
রাত গম্ভীর হল। শাঙ্কো তীর ধনুক নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো। ডেক-এ শুয়ে পড়ে গড়িয়ে মাস্তুলের আড়ালে এলো। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে দেখল–পাহারাদার সৈন্যরা ডেক-এর এখানে-ওখানে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। ডাক্নিশ্চিন্ত।
শাঙ্কো কাঠের পাটাতন দিয়ে অন্ধকারে আস্তে আস্তে তীরে নেমে এলো। তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে চলল কয়েদঘরের দিকে।
অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে কয়েদঘরের কাছে এসে দেখল কয়েদঘরে দরজার কাছে। দুতিনটে মশাল জ্বলছে। চারজন পাহারাদার পাহারা দিচ্ছে। দু’জন বসে আছে। দু’জন। খোলা তলোয়ার হাতে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
শাঙ্কো অন্ধকারে হাঁটু গেড়ে বসল। ধনুকে তীর পরাল। তারপর মশালের আলোয় নিশানা ঠিক করতে লাগল। বেশি তীর খরচ করা চলবে না। একটুক্ষণ নিশানা ঠিক করে শাঙ্কো তীর ছুঁড়ল। তীর গিয়ে লাগল খোলা তলোয়ার হাতে এক পাহারাদারের পায়ে। সে তলোয়ার ফেলে পা চেপে বসে পড়ল। অন্য তিনজন পাহারাদার চারদিকে তাকাতে লাগল। ওরা রবুঝে উঠতে পারলো না কোথা থেকে তীর ছুটে এলো। শাঙ্কো আবার তীর ছুঁড়ল। এই তীর একজন পাহারাদারের বুকে গিয়ে লাগল। সে উবু হয়ে দরজার কাছে মুখ থুবড়ে পড়ল। বাকি দুজন সভয়ে চারদিকে তাকাতে লাগল। শাঙ্কোর পরের তীরটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। তীরটা ঠং করে লোহার দরজায় লেগে নীচে পড়ে গেল। দু’জন পাহারাদার আর ওখানে থাকতে সাহস পেল না। দু’জনেই অন্ধকারে লাফিয়ে নেমে ছুটল নিজেদের জাহাজের দিকে। অন্ধকারে শাঙ্কো লক্ষ্য স্থির করতে পারল না। ওরা নিশ্চয়ই জাহাজে গিয়ে আল জাহিরিকে খবর দেবে। হাতে সময় কম। ধনুক পিঠে ঝুলিয়ে শাঙ্কো দ্রুত ছুটে এলো। দেখল একজন পাহারাদার পা টিপে ধরে বসে আছে। অন্যজন উবু হয়ে পড়ে আছে। ওর কোমরেই শাঙ্কো দেখল চাবির গোছা। শাঙ্কো এক হ্যাঁচকা টানে চাবির গোছা নিয়ে নিল। শাঙ্কো আহত পাহারাদারকে স্পেনীয় ভাষায় বলল–একেবারে চুপ করে থাকবে। টু শব্দটি করেছো কি তোমাকে শেষ করে দেব। সব কথা না বুঝলেও পাহারাদারটি বুঝল ওকে চ্যাঁচামেচি করতে মানা করছে। ও চুপ করে হাত চেপে পায়ের রক্তপড়া বন্ধ করার চেষ্টা করতে লাগল।
শাঙ্কো আর দাঁড়াল না। ছুটে গেল কয়েদঘরের দরজার কাছে। বড়ো তালাটায় চাবি ঢুকিয়ে। ঢুকিয়ে দেখতে লাগল। একটা চাবি লেগে গেল। কন্ট্র করে তালাটায় শব্দ হল। তালা খুলে গেল। শাঙ্কো বেশ শব্দ করেই দরজা খুলল যাতে সবাই সজাগ হয়। ভেতরে ঢুকেশাঙ্কো চাপা গলায় বলল–ভাইসব–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের পালাতে হবে। জলদি। ভাইকিংরা সঙ্গে সঙ্গেউঠেদাঁড়াতে লাগল।তারপরছুটল দরজার দিকে। সবারই দু’হাত বাঁধা। ছুটে যেতে অসুবিধা হচ্ছিল। কিন্তু উপায় নেই। পালাবার এই সুযোগ ছাড়া চলবে না।
সবাই কয়েদঘর থেকে বেরিয়ে এলো। শাঙ্কো বলল–এখন আমরা শহরে যাবো না অন্য কোথাও লুকিয়ে থাকবো।
হ্যারি বলল–বাঁদিকে কিছুদুরে একটা জঙ্গলা জায়গা দেখা যাচ্ছে। ওখানেই আমরা আশ্রয় নেব। ছোটো সবাই। সবাই ছুটলে সেই জঙ্গলের দিকে। জঙ্গলে ঢুকে একটা ফাঁকা জায়গামতো পেল। সেখানেই বসে পড়ল সবাই। হাঁপাতে লাগল।
শাঙ্কো কোমর থেকে ছোরা বের করল। তারপর মারিয়ার হাতবাঁধা দড়ি কেটে দিল। একে একে সবাইর হাতের দড়ি কাটা হল।
হ্যারি ওপরের দিকে তাকাল। একফালি আকাশ দেখল। তারাগুলোর আলো ম্লান হয়ে আসছে। তার মানে রাত শেষ হয়ে আসছে।
কিছু পরে সূর্য উঠল। হ্যারিরা জঙ্গলের মধ্যে থাকায় সূর্য ওঠা দেখতে পেল না। ততক্ষণে পাখিদের ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেছে।
আল জাহিরির কয়েদখানা থেকে তো পালানো গেল। এবার চাই খাদ্য আর আশ্রয়। এতজনের খাদ্যআরআশ্রয় জোগাড় করা একসমস্যা।হ্যারি বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল ভাইসব–এবার খাদ্য আর আশ্রয় চাই। কিন্তু এতজন সবাই একসঙ্গে বাইরে বেরুনো যাবে না। আমি জনাদশেককে সঙ্গে নিয়ে বেরুবো। ফিরে এসে আবার জনা দশেককে নিয়ে যাবো। তোমরা কেউ গ্রীক ভাষা জানো না। কথা বলে আমাকেই সব ব্যবস্থা করতে হবে। এবার জনাদশেক আমার সঙ্গে চলো। হ্যারি থামল। তারপর মারিয়াকে বলল–আপনিও চলুন। মারিয়া বলল সবাইআশ্রয়পাকতারপরআমি যাবো।-না রাজকুমারী–আপনি এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হন নি। আপনার কথা আমাকে বিশেষভাবে ভাবতে হবে। চলুন।
মারিয়া আর জনাদশেক বন্ধুকে নিয়ে হ্যারি বন থেকে বেরিয়ে এলো। দেখল কিছুটা খোলা মাঠের মতো। তারপর কেরিনিয়া নগরের রাস্তা।
ওরা রাস্তা দিয়ে চলল। রাস্তায় লোকজনের খুব একটা ভিড় নেই। একটা পাথরের বড়ো বাড়ির সামনে এসে হ্যারি বলল দাঁড়াও সবাই। সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। হ্যারি এগিয়ে গিয়ে কাঠের দরজায় বড়ো কড়াটা দিয়ে ঠক্ঠক্শব্দ করল। একটু পরেই দরজা খুলে একজন প্রৌঢ় এসে দাঁড়ালেন। তিনি বেশ অবাক হয়েই হ্যারিদের তাকিয়ে দেখলেন। প্রৌঢ়ের গায়ে বেশ দামি পোশাক। বোঝা গেল যথেষ্ট স্বচ্ছল পরিবার। হ্যারি ভাঙাভাঙা গ্রীক ভাষায় বলল– আমরাবিদেশি–ভাইকিং। প্রৌঢ় বললেন তোমাদের কথা আমরা শুনেছি।দক্ষ জাহাজ চালক তোমরা। দুঃসাহসী। তবে জলদস্যু বলে তোমাদের দুর্নামও আছে।
আমাদের সঙ্গে যারা পেরে ওঠে না তারা এই দুর্নাম দেয়। হ্যারি বলল।
–ঠিক আছে ঠিক আছে। ওসব কথা থাক। তোমরা কী চাও? প্রৌঢ়টি বললেন।
–দেখুন–আমাদের জাহাজডুবি হয়েছে। কোনোরকমে এই ক’জন প্রাণে বেঁচেছি। আপনার বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য আশ্রয় চাই। হ্যারি বলল।
–নিশ্চয়ই–প্রৌঢ়টি বললেন–আপনারা থাকুন। আসুন। প্রৌঢ়টি দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। প্রথমে মারিয়া পরে শাঙ্কো, বিস্কোরা কয়েকজন ঢুকল। প্রৌঢ়টি হ্যারিকে বললেন–আমার নাম অ্যান্তিকো। তোমাদের যখন যা প্রয়োজন পড়ে জানাবে।
বাইরের ঘরটায় এসে দাঁড়াল সবাই। দেখলকাঠের তক্তায় পাতা বিছানামতো। ওরা বসল। বাড়ির ভেতর থেকে একজন বয়স্কা মহিলা এঘরে এলেন। অ্যান্তিকো তাকে হ্যারিদের কথা বললেন। মহিলাটি মারিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন–তুমি কে? গ্রীক ভাষা। মারিয়া কিছুই বুঝল না। হ্যারি বলল–উনি গ্রীক ভাষা জানেন না। আমি ওঁর পরিচয় দিচ্ছি। উনি আমাদের দেশের রাজকুমারী।
–তা রাজকুমারী রাজপ্রাসাদের আরাম স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে এভাবে বিদেশে এসেছেন কেন? মহিলাটি বললেন।
–রাজকুমারী দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন। তাঁর স্বামীও আমাদের সঙ্গে আছেন। হ্যারি বলল।
–তা রাজকুমারীর স্বামী কে? মহিলাটি বললেন।
-ওসব জেনে তোমার কী হবে? অ্যান্তিকো বললেন–ওদের জলখাবারের ব্যবস্থা করো। মহিলাটি আর কোনো কথা বললেন না। বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। হ্যারি বলল-রাজকুমারী আপনারা এখানে থাকুন। আমি যাচ্ছি। অন্য বন্ধুদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। হ্যারি চলে গেল।
হ্যারি আরও দুটো বাড়িতে বন্ধুদের ভাগ ভাগ করে থাকার ব্যবস্থা করল। আশ্রয় আহার জুটল। এবার ফ্রান্সিসের আসার জন্য অপেক্ষা করা।
কিন্তু হ্যারিদের ভাগ্য খারাপই বলতে হবে। হ্যারিদের পালিয়ে যাবার খবর শুনে আল জাহিরি রেগে আগুন হয়ে গেল। কয়েদঘরের পাহারাদার ক’জনকে চাবুক মারল। মনের ঝাল মিটিয়ে এবার ভাবতে বসল কী করে বন্দিদের আবার ধরা যায়। ফিরিয়ে আনা যায়।
খোঁজখবর করতে করতে অ্যান্তিকোর বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো আল জাহিরি। আশপাশের দোকানে বাড়িতে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানল কিছু ভিনদেশি লোক অ্যান্তিকোর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। কাজেই আল জাহিরির হ্যারিদের হদিশ পেতে অসুবিধে হয়নি।
বাড়ির বাইরে আটদশজন সৈন্যকে দাঁড় করিয়ে রেখে আল জাহিরি বাড়ির দরজায় হাত ঠুকে টক্ শব্দ করল।
একটু পরে অ্যান্তিকো দরজা খুলে দাঁড়ালেন। আল জাহিরিকে দেখে সৈন্যদের দেখে একটু অবাকই হলেন। বললেন–কী ব্যাপার?
–আপনার বাড়িতে আমার ক্রীতদাসরা পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে। আমি তাদের ধরে নিয়ে যেতে এসেছি। আল জাহিরি বলল। অ্যান্তিকো বললেন আমাকে তো ওরা বলেছে ওদের জাহাজডুবি হয়েছে।
–মিথ্যে কথা। ওরা আমার ক্রীতদাস। আল জাহিরি বলল।
–আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। অ্যান্তিকো বললেন।
আল জাহিরি ঢোলা পোশাকের নীচে থেকে একটা গুটোনা পার্চমেন্ট কাগজ বের করল। অ্যান্তিকোর হাতে দিয়ে বলল–এটা রাজা গী দ্য লুসিগনানের ফরমান। এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে ক্রীতদাস কেনাবেচার ফরমান আমি পেয়েছি। কাজেই পলাতক ক্রীতদাসদের বন্দি করে ধরে নিয়ে যাবার অধিকার আমার আছে।
–তা ঠিক। তবে আমার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে এরা। এভাবে এদের
–কোনো কথা নয়। অ্যান্তিকোকে কথা শেষ করতে না দিয়েই আল জাহিরি বলে উঠল–আপনি সরে দাঁড়ান। আমি দেখছি।
আল জাহিরি অ্যান্তিকোকে প্রায় হঠিয়ে দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল। বাইরের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল।হারিরাও চমকে উঠল। একেবারে দোরগোড়ায় আল জাহিরি দাঁড়িয়ে আছে। আল জাহিরি কেঠো হাসি হাসল। বলল–আমার হাত থেকে নিস্তার নেই। সব চলো কয়েদখানায়। হ্যারি বলে উঠল–না–আমরা যাবো না। আমরা আপনার ক্রীতদাস নই। এসময় অ্যান্তিকো এলেন। বললেন–তোমরা ক্রীতদাস এটা আমাকে বলোনি। হ্যারি বলে উঠল–আল জাহিরি আমাদের জাহাজ দখল করে আমাদের ধরে নিয়ে এসেছে। আমাদের অর্থের বিনিময়ে কেনেনি। তাহলে আমরা ক্রীতদাস হলাম কী করে? অ্যান্তিকো বললেন –এসব তো প্রমাণসাপেক্ষ। তাছাড়া ক্রীতদাস কেনাবেচার অধিকার নিয়ে একে রাজা গী দ্য লুসিগনান ফরমান দিয়েছেন। এক্ষেত্রে কেউ বাধা দিতে পারবে না। এবার হ্যারি বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে দেশীয় ভাষায় সব বলল। তারপর বলল–আমরা যাবো না। সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল– ওহোহো। আজ জাহিরি এতে খুব ঘাবড়াল না। কারণ ওর হাতে রাজার ফরমান রয়েছে। আল জাহিরি বাইরে সদরদরজার দিকে তাকিয়ে ইশারায় সৈন্যদের ডাকল। সৈন্যরা খোলা তলোয়ার হাতে এসে ঘরে ঢুকল। হ্যারি বুঝল আল জাহিরি তৈরি হয়েই এসেছে। বুঝল সশস্ত্র সৈন্যদের নিরস্ত্র অবস্থায় বাধা দেওয়া অসম্ভব। বাধা দিতে গেলে বন্ধুদের অনেকেই মারা যাবে। কাজেই ধরা দেওয়াই এখন ভালো। পরে মুক্তির উপায় ভেবে বের করতে হবে।
হ্যারি গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসবজানি এখন ধরা দিতে আমাদের পৌরুষে বাধবে। কিন্তু উপায় নেই। আমাদের ধরা দিতেই হবে। তাহলেই আমরা সবাই বেঁচে থাকবো। পরে মুক্তির উপায় ভাববো। বন্ধুদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো। অনেকেই এভাবে কাপুরুষের মত হার স্বীকার করতে রাজি হচ্ছিল না। হ্যারি বুঝল বিপদ। যদি বন্ধুরা মাথা গরম করে সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে এক রক্তঝরা লড়াই হবে। নিরস্ত্র বন্ধুদের অনেকেই মারা যাবে বা ভীষণ আহত হবে। তাই হ্যারি চিৎকার করে বলল–কেউ লড়াইয়ে নেমো না। আমাদের সবচেয়ে বড়ো সান্ত্বনা ফ্রান্সিস মুক্ত আছে। ফ্রান্সিস আমাদের মুক্তির কোনো পথ নিশ্চয়ই বের করবে। এখন সবাই শান্ত হও। কেউ মাথা গরম করো না। বুদ্ধিমানে মতো মাথা ঠাণ্ডা রাখো। ফ্রান্সিস থাকলে সেও ঠিক এ কথাই বলতো। এবার বন্ধুরা শান্ত হলো। বুঝল–এখন লড়াইয়ে নামা বোকামি হবে। তাছাড়া ফ্রান্সিস তো মুক্ত আছে। ফ্রান্সিসের ওপর ওদের বিশ্বাস খুবই গভীর। শুধু বিস্কো বলল–আমরা আল জাহিরির সঙ্গে ফিরে যাবো। কিন্তু আমারে হাত বাঁধা চলবে না। আমরা কেউ পালাবার চেষ্টা করবো না। আর একটা কথা রাজকুমারী মারিয়াকে কয়েদঘরে রাখা চলবে না। তাকে আমাদের জাহাজে রাখতে হবে। হ্যারি কথাগুলো আল জাহিরিকে বুঝিয়ে বলল। আল জাহিরি খুবই বুদ্ধিমান। ও দুটো শর্তেই রাজি হলো। ওর তখন চিন্তা কোনোরকমে একবার কয়েদঘরে ঢোকাতে পারলেই নিশ্চিন্ত।
হ্যারি ওরা সৈন্যদের পাহারায় বাড়ির বাইরে এলো। রাস্তায় দাঁড়াল। সৈন্যরা ওদের ঘিরেদাঁড়াল। আল জাহিরি হ্যারিকে বলল–তোমাদের আরো বন্ধু আছে। তারা কোথায়?
–আমি জানি না। হ্যারি বলল।
–একসঙ্গে পালালে আর এখন বলছো জানি না। আল জাহিরি বলল।
-যে যেখানে পেরেছে আশ্রয় নিয়েছে নয় তো এ নগর থেকেই পালিয়ে গেছে। হ্যারি বলল।
–ঠিক আছে। তাদেরও ধরবো। আল জাহিরি বলল।
–দেখুন চেষ্টা করে। হ্যারি বলল।
সবাই চলল জাহাজটার দিকে। শাঙ্কো ওর তির-ধনুক নিয়ে যাচ্ছিল। একজন সৈন্য আল জাহিরির ইঙ্গিতে তির-ধনুক কেড়ে নিল।
সৈন্যদের পাহারায় হ্যারিরা যখন যাচ্ছে তখন রাস্তার লোকজন ওদের দেখতে লাগল। হয়তো ভাবল এরা কোন্ দেশের লোক। এদের পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কেন।
জাহাজঘাটা থেকে একটু দূরে সেই কয়েদখানার সামনে এলো সবাই। হ্যারিদের এক এক করে ঢোকানো হতে লাগল। সবশেষে হ্যারি ও মারিয়া। হ্যারি বলল রাজকুমারী আপনি এইকয়েদখানায় থাকবেন না। আমাদের জাহাজে আপনার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আল জাহিরি এ ব্যবস্থায় রাজি হয়েছে। মারিয়া মাথা নেড়ে বলল–না–আমি তোমাদের সঙ্গে এখানেই থাকবো। হ্যারি বলল-রাজকুমারী এসময় আপনি অবুঝ হবেন না। আপনি জাহাজে থাকলে আমরা অনেক নিশ্চিন্ত থাকবো। তাছাড়া আপনাকে জাহাজে রাখার কারণ আছে। একটু থেমে হ্যারি বলল–আল জাহিরির সঙ্গেশর্ত থাকবে আপনি প্রতিদিন সকালে আর বিকেলে আমাদের এই কয়েদঘরে দেখতে আসবেন। এবার হ্যারি গলা নামিয়ে আস্তে বলল–আসার সময় আপনি গাউনের নীচে যে ক’টা তলোয়ার আনা সম্ভব আনবেন। এভাবে কিছু অস্ত্র হাতে পেলে আমরা লড়াইয়ে নামবো। আপনি এখানে থাকলে সেটা সম্ভব হবে না। কাজেই আপনি জাহাজেই থাকুন। আপনার শরীরের দুর্বলতা এখনো যায়নি। মারিয়া আর কোনো কথা বলল না। বুঝল হ্যারি ঠিকই বলেছে।
হ্যারি কয়েদঘরে ঢুকল। আল জাহিরি একজন সৈন্যকে হুকুম করল–মারিয়াকে তাদের জাহাজে রেখে আসতে। দু’জন সৈন্য খোলা তলোয়ার হাতে মারিয়াকে তাদের জাহাজের দিকে নিয়ে চলল।
পরদিন সকালে খাওয়া-দাওয়ার পর মারিয়া পোশাক রাখার চামড়ার পেটিটা খুলল। খুঁজে খুঁজে সবচেয়ে বড়ো আর ঢোলা গাউনটা বের করল। গাউনটা বেশ জমকালো।
এবার মারিয়া অস্ত্রঘরে এলো। কোমরের দুপাশে আর পেছনে তিনটে তলোয়ার দড়ি দিয়ে শরীরের সঙ্গে বেঁধে নিল। তারপর কেবিনঘরে এসে সেই বড়ো গাউনটা পরল। বাইরে থেকে কিছুই বোঝার উপায় রইল না। তলোয়ারগুলোর মারিয়া খুপসুদ্ধ বেঁধেছিল। তাই হাঁটতে গিয়ে তলোয়ারের খোঁজা লাগল না। তলোয়ারের খাপগুলো লাগল। তাতে কেটে ছড়ে গেল না।
সেই জমকালো গাউন পরে মারিয়া জাহাজ থেকে পাটাতন দিয়ে নেমে এলো। দু’জন সৈন্য ছুটে এসে মারিয়ার দু’পাশে খোলা তলোয়ার হাতে নিয়ে দাঁড়ালো। সৈন্যরা সবাই হাঁ করে মারিয়ার সেই জমকালো পোশাক দেখতে লাগলো। যেন নাচের আসরে যাচ্ছে এমনি ভঙ্গিতে মারিয়া কয়েদঘরের দিকে চলল।
কয়েদঘরের দরজার কাছে এসে পাহারাদারদের ইঙ্গিতে দরজা খুলে দিতে বলল। পাহারাদার দরজার তালা খুলল। দরজা খুলে দিল। মারিয়া কয়েদঘরে ঢুকে একপাশে ডানদিকে সরে গেল। পাহারাদাররা আর মারিয়াকে দেখতে পেল না।
মারিয়া এবার শাঙ্কোকে ডেকে বলল–আমার শরীরে তলোয়ার বাঁধা আছে। খুলে নাও। শাঙ্কো আস্তে আস্তে খাপসুষ্ঠু তলোয়ার তিনটের বাঁধা দড়ি খুলে তলোয়ার বের করে আনল। তারপর দ্রুতহাতে ঘাসের বিছানার নীচে তলোয়ার তিনটে গুঁজে রাখল।
একটু পরে কিছু কথাবার্তা বলে মারিয়া চলে এলো।
এভাবে তিনদিন ধরে মারিয়া গাউনের নীচে তলোয়ার নিয়ে কয়েদঘরে আসতে লাগল। শাঙ্কো আর বিস্কো তলোয়ার লুকিয়ে রাখতে লাগল।
পরের দিন দুপুরে দুটো জাহাজ জাহাজঘাটায় এসে লাগল। হ্যারি পাহারাদারদের কথাবার্তা থেকে জানল ঐ দুটো জাহাজে মূর ক্রীতদাসদের বিক্রির জন্যে আনা হয়েছে। কালকেই ক্রীতদাসদের কেনাবেচার হাট বসবে। একটু দূরে দুটো বাদামগাছের নীচে কাঠের পাটাতন পাতা মাচার মতো। ওখানেইক্রীতদাসদের তোলা হয়। ক্রেতারা চারদিকে জড়ো হয়। ক্রীতদাসদের দেখেশুনে দাম হাঁকে। দরাদরির পর ক্রীতদাসদের কিনে লোকেরা নিয়ে যায়। হ্যারি বুঝল আর দেরি করা চলবে না। আজ রাতেই যা অস্ত্র পাওয়া গেছে। তাই নিয়ে লড়াইতে নামতে হবে।
হ্যারি বন্ধুদের ডেকে বলল–ভাইসব–কালকে এখানে ক্রীতদাস বিকিকিনির হাট বসবে। তাই আজকে রাতেই লড়াইয়ে নামতে হবে। বেশ কিছু তলোয়ার পেয়েছি। এই নিয়েই লড়াই করতে হবে। সবাই চিৎকার করে উঠল–ও-হো-হো। পাহারাদার কয়েকজন লোহার দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। বন্দিরা চিৎকার করে ধ্বনি তুলল কেন কিছুই বুঝল না ওরা। হ্যারিরা নিজেদের মধ্যে যে কথাবার্তা বলছে তাও বুঝল না। ওরা একটুক্ষণ দেখে দরজা থেকে সরে গেল।
তখন রাতের খাওয়া হয়ে গেছে। যে সৈন্যরা খাবার দিতে এসেছিল তারা চলে গেছে।
হ্যারি মৃদুস্বরে ডাকল–শাঙ্কো। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এলো। হ্যারির সামনে এসে মাথা নিচু করল। হ্যারি বাঁধা হাত দুটো শাঙ্কোর ঢোলা পোশাকের মধ্যে ঢুকিয়ে ছোরাটা বের করল। ছোরাটা দিয়ে শাঙ্কোর হাতের দড়ি ঘষে ঘষে কাটতে লাগল। উত্তেজনায় ছোরার মুখ এদিক ওদিক ঘুরে যেতে লাগল। তাতে শাঙ্কোর হাত কেটে যেতে লাগল। রক্ত বেরুলো। শাঙ্কো দাঁত চেপে সব সহ্য করতে লাগলো।
একসময় দড়িটা কেটে গেল। শাঙ্কো একহ্যাঁচকা টানে সবটা কাটা দড়ি ছিঁড়ে ফেলল। তারপর ছোরাটা হাতে নিয়ে সবার হাতের দড়ি কেটে ফেলতে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যেই সবার হাতে দড়ি কাটা হলো।
তারপর মরিয়া যে দশ-বারোটা তলোয়ার এনেছিল সেইসব তলোয়ারগুলো ঘাসের বিছানার তলা থেকে বের করে ভাইকিংরা লড়াইয়ের জন্যে তৈরি হলো।
হ্যারির নির্দেশমতো দু’তিনজন ভাইকিং কয়েদঘরের দরজার কাছে গিয়ে চাঁচামেচি শুরু ক। দু’জন পাহারাদার দরজার কাছে এলো। বলতে লাগল কী হয়েছে? ভাইকিংরাও আজেবাজে বকতে লাগল।কউে কারো কথা বুঝল না। ভাইকিংরা ইঙ্গিতে পাহারাদারদের ভেতরে আসতে বলল। পাহারাদার দরজা খুলল। তিনজন পাহারাদার খোলা তলোয়ার হাতে ভেতরে ঢুকল। সশস্ত্র ভাইকিংরা দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। পাহারাদাররা ঘরে ঢুকতেই ওদের ওপর তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পাহারাদাররা স্বপ্নেও ভাবেনি এরকমভাবে আক্রান্ত হবে। ওরা তলোয়ার চালিয়ে লড়াই করতে লাগল। কিন্তু ভাইকিংদের নিপুণ তলোয়ার চালানোর সামনে ওরা দাঁড়াতেই পারল না। তিনজন পাহারাদারই আহত হয়ে মেঝেয় পড়ে গেল। গোঙাতে লাগল।
হ্যারিওরা খোলা দরজা দিয়ে বাইরে এলো। কয়েদঘরের বাইরে উঠোন মতো জায়গায় আল জাহিরি একদল সৈন্য শুয়ে ঘুমিয়ে ছিল। কয়েদঘরের চিৎকার চাচামেচিতে ওদের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ওরা কয়েদঘরের দরজার কাছে জ্বলন্ত মশালের আলোয় দেখল হ্যারিরা খোলা তলোয়ার হাতে বেরিয়ে আসছে। সৈন্যরা পরস্পরকে ধাক্কাধাক্কি করে ঘুম ভাঙাল। তারপর খাপ থেকে তলোয়ার খুলে নিয়ে ছুটে এলো।
ভাইকিংরাও ছুটে এলো। শুরু হলো তরোয়ালেরলড়াই।আল জাহিরির সৈন্যরা একটুক্ষণের মধ্যেই বুঝল–এ বড়ো কঠিন ঠাই। দুর্ধর্ষ ভাইকিংদের অভিজ্ঞ হাতের তলোয়ারের মারের কাছে ওরা একে একে হার স্বীকার করতে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যেই অর্ধেক সৈন্য আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। উঠোনমতো জায়গাটা ভরে উঠল আহত সৈন্যদের গোঙানিতে আর্ত চিৎকারে। বাকিরা প্রাণভয়ে অন্ধকারে এদিক ওদিক পালিয়ে গেল।
ওদিকে এখানে লড়াইয়ের চিৎকারে আর্তনাদে আল জাহিরির জাহাজের সৈন্যদের ঘুম ভেঙে গেল। ওরা খোলা তলোয়ার হাতে দল বেঁধে জাহাজ থেকে নেমে এলো। ভাইকিংরাও ওদের দিকে ছুটে এলো। আল জাহিরির একদল সৈন্যকে হারিয়ে ভাইকিংরা প্রত্যেকেই তলোয়ার পেয়েছে। ভাইকিংরা একবার অস্ত্র হাতে পেলে তাদের সঙ্গে মোকাবিলা করা সহজ কথা নয়।
দু’দল পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে হ্যারি গিয়ে দু’দলের মাঝখানে দাঁড়াল। হ্যারি দু’হাত তুলে চিৎকার করেউঠল–থামো। দু’দলই দাঁড়িয়ে পড়ল।হ্যারি আলজাহিরির সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল–সৈন্যরা–এইমাত্র তোমাদের একদল সৈন্যকে আমরা হারিয়ে দিয়ে এসেছি। আমাদের সঙ্গে লড়াইয়ে নামলে তোমাদেরও সেই দশা হবে। তার আগে বলছি—তোমরা অস্ত্ৰ ত্যাগ কর। হার স্বীকার করো। তোমাদের জাহাজে করে তোমরা চলে যাবে। আমরা কোনো বাধা দেব না। হ্যারি একটুক্ষণের জন্যে থেমে বলল–এখন তোমরাই বিবেচনা কর কী চাও তোমরা মৃত্যু না বেঁচে থাকা। আল জাহিরির সৈন্যদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো। এসময় আল জাহিরি জাহাজের রেলিঙের কাছে এসে দাঁড়াল। চিৎকার করে ওর সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? আক্রমণ করো। সৈন্যরা দ্বিধায় পড়ে গেল। কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। হ্যারি চিৎকার করে বলল–সৈন্যরা–তোমরা একবার লড়াইয়ে নামলে কেউ বাঁচবে না। আল জাহিরির কথায় তোমরা বোকার মতো মরতে যাবে কেন? অস্ত্র ত্যাগ করো। আবার সৈন্যদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো। ওরা সংখ্যায় বেশি হলেও লড়াইতে নামতে ইতস্তত করতে লাগল। হ্যারি আবার চিৎকার করে বলল–সৈন্যরা অস্ত্র তাগ কর। আল জাহিরি চিৎকার করে বলে উঠল কাপুরুষের দল লড়াই ক–আক্রণ কর।
এবার কিছু সৈন্য তলোয়ার মাটিতে ফেলে দল থেকে সরে দাঁড়াল। বাকিরা এগিয়ে এলো। মুহূর্তে ভাইকিংরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হলো লড়াই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আল জাহিরির অর্ধেকের বেশি সৈন্য হয় মারা গেল না তো আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গোঙাতে লাগল। লড়াই চলল। কিন্তু আল জাহিরির বাকি সৈন্যদের মনোবল ততক্ষণে ভেঙে গেছে। ওরা অন্ধকারের মধ্যে গা ঢাকা দিল। নয়তো পালিয়ে গেল।
ভাইকিংরা ধ্বনি তুলল ওহোহো। লড়বার জন্যে আল জাহিরির একটি সৈন্যও আর তখন সামনে নেই।
হ্যারি দেখল জাহাজের রেলিঙের কাছে আল জাহিরি নেই। হ্যারি চিৎকার করে বলল–শাঙ্কো শিগগিরি জাহাজে যাও। আল জাহিরি না পালিয়ে যায়।
শাঙ্কো এক ছুটে জাহাজে উঠে পড়ল। ডেক-এর কোথাও আল জাহিরিকে দেখল না। সিঁড়ি বেয়ে নীচেনামল। কেবিনঘরের মধ্যে দেখতে লাগল।আল জাহিরি কোনো কেবিনঘরে নেই। রসুইঘরেও নেই। নিশ্চয়ই ডেক-এ কোথাও লুকিয়ে আছে। অন্ধকারে জলে নেমে পালাবার ধান্দায় আছে। শাঙ্কো দ্রুতপায়ে ডেক-এ উঠে এলো। চারদিকে খুঁজতে লাগল। তখনই অস্পষ্ট জলে সাঁতার কাটার শব্দ শুনলো। শাঙ্কো জহাজের পেছনের দিকে এলো। হালের কাছে এসে নীচে জলের দিকে তাকাল। অন্ধকারে অস্পষ্ট দেখল কেউ যেন জলে সাঁতরে চলেছে তীরের দিকে। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ার দাঁতে চেপে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। দ্রুত সাঁতার কেটে পলায়নপর আল জাহিরি পেছনে পেছনে চলল।
কিছুক্ষণ পরে আল জাহিরি তীরে উঠল। শাঙ্কোও শ্যাওলাধরা পাথরে পা রেখে সাবধানে তীরে উঠল। অন্ধকারে আল জাহিরি ছুটে পালাতে যাবে তখনই শাঙ্কো ওর পেছনে এসে দাঁড়াল। দু’জনেই হাঁপাচ্ছে তখন।
তলোয়ার হাতে নিয়ে শাঙ্কো তলোয়ারের ডগাটা আল জাহিরির গলায় ঠেকিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–পালাবার চেষ্টা করলেই মরবে। কথাটা শাঙ্কো স্পেনীয় ভাষায় বলল। আল জাহিরি এটুকু বুঝল যে আর পালাবার উপায় নেই। আল জাহিরিও তখন হাঁপাচ্ছে। শাঙ্কো বলল–তোমার সৈন্যরা কিছুমরেছে কিছু আহত হয়ে গোঙাচ্ছে কিছু পালিয়েছে। মোট কথা আল জাহিরি এখন তুমি একেবারে একা।
আল জাহিরি হঠাৎ একটু নিচু হয়ে একহঁচকা টানে কোমরের ঝোলানো তলোয়ারটা খুনে আনল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল এখন তুমিও একা। লড়ে আমাকে হারাও দেখি। শাঙ্কোও কোমর থেকে তলোয়ার বের করল। আকাশে ভাঙা চাঁদ। অনুজ্জ্বল চাঁদের আলোয় দু’জনের তলোয়ারের লড়াই শুরু হলো। প্রায় অন্ধকারে দু’জনের হাঁপানোর শব্দ আর তরোয়ালের ঠোকাঠুকির শব্দ।
কিছুক্ষণ লড়েই আল জাহিরি বুঝল কেন ভাইকিংদের দুর্ধর্ষ বলা হয়। শাঙ্কোর নিপুণ তলোয়ার চলানো দেখে আল জাহিরি বুঝল ওকে সহজে হারানো যাবে না। অথচ এখন শাঙ্কোকে হারাতে না পারলে ওর আর পালিয়ে যাওয়া হবে না। আল জাহিরি প্রাণপণে লড়তে লাগল। দু’জনের নাক মুখ দিয়ে বেশ শব্দ করে শ্বাস পড়ছে। লড়াই চলল।
একসময় শাঙ্কো কয়েক পা দ্রুত পিছিয়ে গেল। আল জাহিরি এক লাফে এগিয়ে এলো। শাঙ্কো এই সুযোগ কাজে লাগালো। শাঙ্কো সামনে লাফিয়ে পড়ে দ্রুত তলোয়ার চালাল। এত দ্রুত তলোয়ারে ঘা নেমে এলো যে আল জাহিরি আত্মরক্ষা করার সময় পেল না। শাঙ্কো আল জাহিরির ডানবাহুতে তলোয়ারের কোপ বসিয়ে দিল। তীব্র ব্যথায় আল জাহিরি ঝাঁকিয়ে উঠল। হাতির দাঁতে বাঁধানো বাঁটওয়ালা তলোয়ারটা মাটিতে ফেলে বাঁ হাত দিয়ে কাটা জায়গাটা চেপে ধরল।
শাঙ্কো তলোয়ারটা তুলে নিল। তারপর হাঁপাতে হাঁপতে বলল–তোমাকে এক্ষুণি নিকেশ করতে পারি। কিন্তু তা করবো না। তোমাদের জাহাজের কয়েদঘরে তোমাকে বন্দি করে রাখবো। কত নিরীহ মানুষদের রক্তে আর চোখের জলে ভেজা ঐ কয়েদঘর। তোমাকে সেখানে বন্দি করে রাখা হবে। নিরীহ মানুষগুলো দিনের পর দিন কী অমানুষিক দুঃখকষ্টের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থেকেছে তার স্বাদ তুমিও পাও। তোমার প্রায়শ্চিত্ত হোক। আল জাহিরি অনুনয়ের সুরে বলল–আমাকে ছেড়ে দাও। কথা দিচ্ছি–আমি আর ক্রীতদাস বিক্রির ব্যবসা করবো না।
না–শাঙ্কো বলল–তুমি অনেক রক্ত ঝরিয়েছো, অনেক চোখের জল ঝরিয়েছো। তার প্রায়শ্চিত্ত তোমাকে করতেই হবে। চলো তোমাদের জাহাজে। শাঙ্কো ওর তলোয়ার আল জাহিরির পিঠে ঠেকাল। বলল চলো।
দু’জনে যখন আল জাহিরির জাহাজ থেকে ফেলা কাঠের পাটাতন দিয়ে উঠছে তখন ভাইকিংরা নিজেদের জাহাজ থেকে উল্লাসের ধ্বনি তুলল ওহোহো।
সিঁড়ি বেয়ে দু’জনে নেমে কয়েদঘরের দরজার কাছে এলো। আর জাহিরি এবার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল–এই কয়েদঘরে থাকলে আমি মরে যাবো।
–তোমাকে তিলে তিলে মারবার জন্যেই এই কয়েদঘরে রাখা হবে। শাঙ্কো বলল।
এবার আল জাহিরি বলল–আমার কাছে মুক্তো মণি-মাণিক্য আছে। সব তোমাকে দেব। আমাকে ছেড়ে দাও।
–ও সব লোভ আমাকে দেখিও না। ঢোকো কয়েদঘরে। কথাটা বলে শাঙ্কো আল জাহিরির পিঠে তলোয়ারের চাপ বাড়ালো। আল জাহিরি এবার কেঁদে ফেলল। বলল আমাকে এভাবে তিল তিল করে মেরো না। বুকে তলোয়ার ঢুকিয়ে একবারে মেরে ফেলো।
–না–তোমাকে এই কয়েদঘরেই মরতে হবে। ঢোকো কয়েদঘরে। কথাটা বলে শাঙ্কো তলোয়ারের চাপ বাড়ালো। আল জাহিরি কাঁদতে কাঁদতে কয়েদঘরে ঢুকল। শাঙ্কো বাইরে থেকে লোহার দরজা বন্ধ করে দিল।
কোমরে তলোয়ার খুঁজেশাঙ্কো সিঁড়ি দিয়ে জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো। জাহাজের পেছন দিকেহালের কাছে এলো। দেখল এই ক্যারাভেল জাহাজের সঙ্গে ওদের জাহাজটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। শাঙ্কো কোমর থেকে ছোরা বের করল। বাঁধা দড়িটা ছোরা দিয়ে ঘষে ঘষে কেটে ফেলল। ওদের জাহাজটা হাত দশেক দূরে সরে গেল।
এবার শাঙ্কো কয়েকজন ভাইকিংকে এই জাহাজে আসতে বলল।ওরা এলো। শাঙ্কো বলল-চলো নোঙর তুলতে হবে।
কয়েকজন মিলে টেনে টেনে নোঙর তুলল। যেখানে নোঙর আটকানো থাকে সেখানে নোঙর তুলে রাখলো তারপর ক্যরাভেলহাজ থেকে সকলেই নেমে এসে নিজেদের জাহাজে উঠল। ক্যারাভেল জাহাজটা হাওয়ার ধাক্কায় আস্তে আস্তে মাঝ সমুদ্রের দিকে চলল। জাহাজটার নীচের কয়েদঘরে একা আল জাহিরি তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
হ্যারি জিজ্ঞেস করলশাঙ্কো, আল জাহিরিকে কী করেছো?
–ঐ জাহাজের কয়েদঘরে বন্দি করে রেখে এসেছি। শাঙ্কো বলল।
–ভালো করেছে। নিজের জীবন দিয়ে ও বুঝুক মানুষের ওপর অত্যাচারের ফল কী? হ্যারি বলল। আল জাহিরিকে কী শাস্তি দেওয়া হয়েছে সেটা সকলেই শুনল। আনন্দে ওরা আবার চিৎকার করে উঠল–ওহোহো।
ওদিকে আল জাহিরির যে পাঁচ-ছ’জন পাহারাদার সৈন্য অক্ষত দেহে পালাতে পেরেছিল তারা কয়েদঘরের পেছনের জঙ্গলটায় জড়ো হল। ওরা কয়েদঘরের আড়াল থেকে দেখেছিল একজন ভাইকিং আল জাহিরিকে ওদের জাহাজে নিয়ে যাচ্ছে। ওদের আশঙ্কা ছিল হয়তো ওরা আল জাহিরিকে মেরে ফেলেছে। এখন দেখল আল জাহিরি বেঁচে আছে। ওদের জাহাজেই আল জাহিরিকে বন্দি করে রাখা হয়েছে–এটা বুঝল।
ওরা আরো দেখল ভাইকিং যোদ্ধাটি ওদের জাহাজ থেকে নেমে এলো। ঘাট পর্যন্ত। পাতা কাঠের পাটাতন তুলে ফেলল। তারপর ভাইকিংটা নিজেদের জাহাজে গিয়ে উঠল। বোঝাই গেল আল জাহিরিকে কয়েদঘরেই বন্দি করে রেখে ভাইকিংটা চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে ওরা দেখল ওদের জাহাজ মাঝ সমুদ্রের দিকে ভেসে চলেছে।
একজন সৈন্য বলে উঠল-জাহাজটা চালাবার মতো কেউ নেই। এভাবে ভেসে গেলে অনেক দূর চলে যাবে। আমরা আর জাহাজটার কোনো খোঁজই পাবো না। কাজেই এখনি আমাদের ঐ জাহাজটায় গিয়ে উঠতে হবে।
–কিন্তু যাবো কীভাবে? একনজ সৈন্য বলল।
সাঁতার কেটে চলল। একজন সৈন্য বলল।
–না। এতদূর সাঁতরে যেতে গিয়ে হয়তো হাঙরের মুখে পড়বো। কেউ বাঁচবো না তাহলে। অন্যজন বলল।
–তাহলে এক কাজ করা যাক। জেলেপাড়ায় চলো।
ওখানে নিশ্চয়ই একটা মাছধরা নৌকো পাবো। একজন বলল। এ কথায় সবাই। রাজি হল। অন্ধকারে চলল জেলেপাড়ার দিকে।
কিছুক্ষণ পরে জেলেদের বস্তী দেখল। পাথ আর কাঠের বাড়িঘরদোর। সমুদ্র তীরটা এখানে বেঁকে গেছে। সেই বাঁকে অন্ধকারেও দেখা গেল আট-দশটা জেলে নৌকো জল থেকে একটু দূরে লয়াড়িতে তুলে রাখা হয়েছে।
সৈন্যরা পাঁচজন নৌকোগুলোর কাছে গেল। শক্তপোক্ত দেখে একটা নৌকো ওরা বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে চলল। তারপর সমুদ্রের জলে নামাল। নৌকোতে উঠল ওরা। দাঁড় নিল একজন। অন্যজন দাঁড় হালের মতো জলে রাখল। দাঁড় বাওয়া চলল। নৌকোও চলল আল জাহিরির জাহাজ লক্ষ্য করে। রাত শেষ হয়ে। সূর্য উঠল। ভোরের নরম আলো ছড়ালো আকাশে সমুদ্রে। ওদের ভাগ্যি ভালো যে একটা ঘন কুয়াশার আস্তরণে ওদের নৌকোটা ঢাকা পড়ে গেছে।
ফ্রান্সিসদের জাহাজের নজরদার পেড্রো কুয়াশায় ঢাকা পড়া নৌকোটা দেখতে পেল না।
কুয়াশা ঢাকা সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপর দিয়ে ওদের নৌকো চলল আল জাহিরির জাহাজ লক্ষ্য করে। আল জাহিরির জাহাজও কুয়াশায় দেখা যাচ্ছে না। বেশ আন্দাজেই দিক ঠিক করে ওরা নৌকো বেয়ে চলল।
কিছুক্ষণ পরেই ঘন কুয়াশাঘেরা আল জাহিরির জাহাজটা ওরা দেখতে পেল। ওরা নৌকোটা আরো দ্রুত চালাল।
একসময় জাহাজের গায়ে এসে লাগল ওদের নৌকোটা। জাহাজ থেকে ঝুলে থাকা দড়িদড়া ধরে ওরা জাহাজটায় উঠল। দেখল ডেক-এ কেউ নেই। ওরা দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচের কেবিনঘরগুলোর সামনে এলো। প্রত্যেকটি কেবিনঘর খুঁজে দেখল– আল জাহিরি কোথাও নেই। ওদের চিন্তা হল–তাহলে কি ঐ ভিনদেশি লোকেরা আল জাহিরিকে মেরে ফেলে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে? একজন পাহারাদার সৈন্য বললও সেকথা। আর একজন বলল-ওরা আল জাহিরিকে মেরে ফেলে নি। চলোতো একবার কয়েদখানাটা দেখি।
এবার সবাই ছুটল নীচের কয়েদঘরের দিকে। কয়েদঘরের গরাদের সামনে এসে দেখল কয়েদঘরে মেঝের দুই হাঁটুতে হাত রেখে মাথা নিচু করে আল জাহিরি বসে আছে। ওদের পায়ের শব্দে আল জাহিরি মুখ তুলে তাকাল। সৈন্যদের দেখেই ছুটে লোহার দরজার কাছে এলো। চিৎকার করে বলল-শিগগিরি দরজা খো। আমাকে বোঁচা। সৈন্যরা দেখল দরজায় তালা লাগানো। কিন্তু চাবি কোথায়? ওরা লোহার দরজার কাছে জায়গাটা ভালো করে খুঁজল। কোথাও চাবিটা পড়েনি।
তখন একজন সৈন্য ছুটল যেখানে জাহাজ মেরামতির জন্যে হাতুড়ি গজাল থাকে।
একটা মোটা হাতুড়ি আর গজাল নিয়ে সৈন্যটি ফিরে এলো। গজালটা তালার ওপর রেখে গজালটায় হাতুড়ির ঘা মারতে লাগল। ও কয়েকটা হাতুড়ির ঘা মেরে আর একজনের হাতে হাতুড়িটা দিল। সে এবার হাতুড়ির ঘা মারতে লাগল। লোহার গরাদের ওপাশে আল জাহিরি তখন ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর বলছে–আমাকে বাঁচা তোরা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তালার জোড়াটা ভেঙে খসে পড়ল। ওরা দরজা খুলল। আল জাহিরি পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে এলো। চিৎকার করে বলল-ওরা আমাকে এখানে বন্দি করে ক্ষুধায় তৃষ্ণায় মারার ব্যবস্থা করেছিল। আমি এর শোধ তুলবো। ওদের দেশের রাজকুমারীর ওপর নজর রাখবো। একা পেলেই বন্দি করে এই জাহাজে নিয়ে আসবো। তারপর উত্তর কার্সিকায় যে ক্রীতদাস কেনাবেচার বড় হাট বসে সেখানে রাজকুমারীকে বিক্রি করে দেব। এত দাম পাবো যে বাকি জীবন আমার রাজার হালে। কেটে যাবে। কথাগুলো বলে আল জাহিরি হাঁপাতে লাগল। হাঁপতে হাঁপাতে বলল– শিগগিরি আমায় খেতে দে। খিদের জ্বালায় মরে গেলাম।
সৈন্যদের মধ্যে একজন চলে গেল রসুইঘরে। তাড়াতাড়িতে কিছু খাবার রান্না করতে লাগল।
আল জাহিরি চলল নিজের কেবিনঘরের দিকে। পেছন চারজন সৈন্যও চলল। আল জাহিরি কেবিনঘরে ঢুকেই বিছানায় শুয়ে পড়ল। সৈন্যরা দাঁড়িয়ে রইল।
আল জাহিরি বলল কালকে সকালেই তোরা তীরে যাবি। আমার সৈন্যরা অনেক মরেছে। তবে কিছু বেঁচেও তো আছে। তাদের খুঁজে বের করবি। এভাবেই সৈন্য সংখ্যা বাড়াতে হবে। একটু থেমে জাহিরি বলল–একজন সৈন্য সবসময় কয়েদঘরের আড়াল থেকে লক্ষ্য রাখবি ওদের রাজকুমারী নিশ্চয়ই জাহাজ থেকে নেমে একা একটু বেরিয়ে বেড়াতে পারে। সুযোগ বুঝে রাজকুমারীকে বন্দি করতে হবে। কী? পারবি তো? চারজনেই বলল–হ্যাঁ পারবো। একজন সৈন্য বলল–রাজকুমারী ঐ ভিনদেশিদের চোখের আড়ালে গেলেই আমরা রাজকুমারীকে ধরবো। আল জাহিরি বলল–তোরা এই জাহাজে এলি কী করে? সাঁতরে?
না—-জেলেদের নোকোয় চড়ে এসেছি। একজন সৈন্য বলল।
এবার ঐ নৌকো করেই তীরে যা। যা যা বললাম তাই করবি। আল জাহিরি বলল।
সৈন্য চারজন চলে গেল।
তখনই রাঁধুনি সৈন্যটি কাঠের থালা বাটিতে গোল রুটি আর মাংসের ঝোল নিয়ে ঢুকল। বিছানায় রাখল। আল জাহিরি পাগলের মতো খাবারের ওপর যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল। হাপুস হুপুস করে খেতে লাগল।
সৈন্য চারজন জাহাজ থেকে দড়ির মই নামিয়ে দিল। মই বেয়ে বেয়ে ওরা নৌকোয় ৭ উঠল। দাঁড় হাতে নিয়ে নৌকো চালাল তীরভূমির দিকে।
তখন ভোর হয়েছে। সকালের নরম রোদ সমুদ্রের জলের ওপর ছড়িয়েছে। কয়েদঘরের পেছনে জঙ্গলে পাখির ডাকাডাকি শুরু হয়েছে। নৌকো তীরে এসে লাগল। ফ্রান্সিসদের জাহাজ থেকে নজরদার পেড্রো অস্পষ্ট নৌকোটা দেখল। কিন্তু জেলেদের নৌকো বলে ও নৌকোটাকে কোনো গুরুত্ব দিল না।
আল জাহিরির জাহাজটা সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে যেখানে সমুদ্রের তীরভূমি বাঁক নিয়েছে সেখানটায় এলো। এই বাঁকের জন্যেই ফ্রান্সিসদের জাহাজ থেকে নজরদার পেড্রো জাহাজটা দেখতে পাচ্ছিল না।
আল জাহিরির চার সৈন্য তীরে নামল। চলল জেলে পাড়ার দিকে। জেলেপাড়া থেকে তখন জেলেরা বেরিয়ে আসছে। নৌকো নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাবে। ওরা জেলেদের জিজ্ঞেস করতে লাগল–আমাদের কয়েকজন সৈনিক বন্ধু কি তোমাদের কারো বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। জেলেরা মাথা নেড়ে বলল–না। একজন জেলে বলে উঠল–দু’জন সৈন্য আমার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। তবে সে দু’জন তোমাদের বন্ধু কি না জানি না। একজন সৈন্য বলল–আমাদের তোমার বাড়িতে নিয়ে চলো। ঐ। দু’জন সৈন্যকে দেখলেই বুঝতে পারবো আমাদের বন্ধু কিনা। জেলেটি বলল–বেশ– এসো। আমি দেরি করতে পারবো না। আমাকে এখুনি নৌকো নিয়ে মাছ ধরতে যেতে হবে।
–না-না। আমরা দেখলেই বুঝতে পারবো। একজন সৈন্য বলল।
জেলের পেছনে পেছনে সৈন্য চারজন চলল। জেলেটি ওদের নিজের কাঠপাথরের বাড়িতে নিয়ে এলো। গলা চড়িয়ে বৌকে বলল–যে দু’জন সৈন্য আশ্রয় নিয়েছে। তাদের বাইরে আসতে বলো। দু’জন সৈন্য তখন ঘরের ভেজানো দরজার আড়াল থেকে বাইরে কারা এসেছে দেখল। ওরা নিশ্চিন্ত হল। ওদেরই বন্ধু। দু’জনে বাইরে বেরিয়ে এলো। ওরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল। একজন সৈন্য বলল–এখানে দেরি করা চলবে না। অন্য বন্ধুদের খুঁজতে হবে। চলো সব।
সৈন্যরা দল বেঁধে চলল। ওরা জাহাজঘাটার দিকে গেল না। কয়েদঘরের পেছনের জঙ্গলটায় ঢুকল। বড়ো বড়ো গাছের গুঁড়ি আর লতাপাতার মধ্যে দিয়ে আস্তে আস্তে চলল ওরা। গাছের ডালপালার মধ্যে দিয়ে কোথাও ভাঙা ভাঙা রোদ পড়েছে। ওরা আস্তে আস্তে যেতে যেতে বন্ধুদের নাম ধরে ডাকতে লাগল। হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে থেকে তিজন বন্ধু সাড়া দিল। তারপর ওদের দিকে এগিয়ে এলো। ওরা এসে বলল আরো দু’জন কেরিনিয়া নগরে কোথায় আশ্রয় নিয়েছে। এবার সবাই মিলে চলল। কেরিনিয়া নগরে। নগরের পথে খুব একটা ভিড় নেই। ওরা ঐ রাস্তা দিয়ে ঘুরতে লাগল। খুঁজতে লাগল দুই বন্ধুকে।
খুঁজতে খুঁজতে বেশ বেলা হল। খিদেও পেয়েছে। ওরা একটা সরাইখানায় ঢুকল খাবার খেতে। তখনই ওরা দেখল বন্ধু দু’জনও খাচ্ছে। দুই বন্ধুকে পেয়ে ওরা খুশিই হল।
খেয়েদেয়ে সবাই হাঁটতে হাঁটতে জেলেপাড়ায় এলো। শুধু একজন সৈন্য কয়েদঘরের আড়ালে দাঁড়াল। মারিয়ার ওপর নজর রাখার জন্যে।
জেলেপাড়ার ঘাটে নৌকো পেল না ওরা। সবকটা নৌকো চালিয়ে জেলেরা মাছ ধরতে চলে গেছে। অগত্যা ওরা নৌকো ফিরে আসার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।
বিকেল নাগাদ জেলেরা নৌকো নিয়ে ফিরল। সৈন্যরা দুটো জেলে নৌকো জোগাড় করল। নৌকোয় চড়ে চলল আল জাহিরির জাহাজের দিকে।
সেদিন বিকেল থেকেই মারিয়া বুঝতে পারল জ্বর আসছে। শরীরের গাঁটে গাঁটে ব্যথা শুরু হল। মারিয়া চুপ করে বিছানায় শুয়ে রইল।
সন্ধের সময় হ্যারি মারিয়ার কাছে এলো খোঁজখবর করতে। মারিয়াকে শুয়ে থাকতে দেখে বলল–আপনার কি শরীর খারাপ?
–না-না–একটু বিশ্রাম করছি। মারিয়া বলল।হ্যারি বলল–বেশি শুয়ে থাকবেন না। এসময় তো আপনি ডেক-এ যান। এখন যান। একটু ঘুরে আসুন।
–আজকে ভালো লাগছে না। মারিয়া বলল। এবার হ্যারি চিন্তিতস্বরে বলল– ফ্রান্সিসরা ফিরল না। যীশুর মূর্তি উদ্ধার করতে পেরেছে কি না–এখন ওরা কোথায় আছে-কী করছে কোনো খবরই পাচ্ছি না।
–এতে ভাববার কী আছে। মূর্তি খুঁজে পেলেই চলে আসবে। মারিয়া বলল।
–তা ঠিক। তবু দুশ্চিন্তা হচ্ছে। হ্যারি বলল। একটু থেমে বলল–আপনি বিশ্রাম করুন আমি যাচ্ছি। হ্যারি চলে গেল।