যিশু খ্রিস্ট (আনু. ৬ খ্রি. পূ.–আনু. ২৯ খ্রি.) – খ্রিস্টানধর্মের প্রবর্তক
ইহুদিরা তখনও পরাধীন জাতি! রোমানদের হাতে প্যালেস্টাইন পদানত। এই পরাধীন জাতিকেই আশার আলোর কথা বলে সান্ত্বনা দিয়ে বেড়াতেন একজন। তিনি নিজেও ছিলেন ইহুদি। নাম জন দি ব্যাপটিস্ট (John the Baptist)। তিনিই সবাইকে ডেকে ডেকে বলতেন, অচিরেই তোমাদের ত্রাণকর্তা আসছেন। তাঁকে গ্রহণ করে নেওয়ার জন্য তৈরি হও।
তার পরই ঘটল সেই ঘটনা। সেদিন এক কিশোর এলেন তাঁর কাছে উপদেশ শুনতে। সে ছুতোর মিস্ত্রির কাজ করে। কিন্তু তা হলেও এই বয়সেই অনেকগুলো ভালো ভালো গ্রন্থ সে পড়ে ফেলেছে। তাই বালক হলেও অনেক প্রধান ব্যক্তির চেয়েও তাঁর জ্ঞানের সীমা ছিল সুগভীর। কী প্রবল আকর্ষণ-শক্তি এই বালকের! এই বালক আর কেউ নন, স্বয়ং যিশু খ্রিস্ট।
প্রথম দিকের সব খ্রিস্টানই ছিলেন ইহুদি। যিশু নিজেও ছিলেন ইহুদি পরিবারের সন্তান। এ ধর্মমতের সাথে খ্রিষ্ট ধর্মমতের যেমন মিল আছে, তেমনি অমিলও অনেক।
যিশু জন্ম গ্রহণ করেন (৮-৬ খ্রি. পূর্বাব্দে) জেরুজালেম থেকে আট কিলোমিটার দূরে নাজারেথ প্রদেশের বেথেলহাম নামের একটি গ্রামে।
জন দি ব্যাপটিস্ট নিজেও এই কিশোর-বালকের প্রতি আকৃষ্ট হলেন প্রবলভাবে। তার পর থেকেই তিনি তাঁকে আর সঙ্গ-ছাড়া করতে চাইতেন না। তাঁর মনে হলো, প্যালেস্টাইনের মুক্তির জন্য হয়তো ঈশ্বর এই বালককেই পাঠিয়েছেন। স্বাধীন প্যালেস্টাইনের রাজা হবেন এই বালকই।
যিশুর জন্মের সময় ইহুদিদের রাজা ছিলেন হেরদ। তিনি রাজজ্যোতিষীর কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন, নবজাত এক শিশু কালক্রমে এদেশের রাজা হবেন। তাই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন হেরদ।
এরপর তিনি বেথেলহাম ও তার আশপাশের নবজাত সব চেলে সন্তানকে হত্যার আদেশ দিলেন।
এই খবর শুনে যিশুর পিতা-মাতা জোসেফ ও মেরি তাঁদের শিশুসন্তানকে নিয়ে মিশরে চলে গেলেন। রাজা হেরদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মিশরেই থাকতে হয়েছিল যিশুকে। তারপর আবার নিজের প্রদেশ নাজারেথে ফিরে আসেন রাজার মৃত্যুর পর।
যিশুর যখন বয়স তিরিশ বছর, তখন থেকে তিনি প্রকাশ্যে ঈশ্বরের বাণী প্রচার করতে শুরু করেন। তিনি তাঁর ধর্মমত প্রচার করতেন একান্ত সাধারণ ভাষায়। অনেকটা গল্পের মতো করে।
তিনি মানুষের কাছে প্রচার করতে লাগলেন ঈশ্বরের বাণী এবং মানুষের মনে জাগিয়ে তুলতে লাগলেন ভ্রাতৃভাব। তিনি চেষ্টা করতে লাগলেন পৃথিবীতে এক পবিত্র সভ্যতা সৃষ্টির, যেখানে কেউ কারও দেশ কেড়ে নেবে না। কোথাও থাকবে না হিংসা কিংবা হানাহানি। এভাবেই তিনি জয় করবেন রোমানদের এবং মুক্ত করবেন প্যালেস্টাইনকে।
তাই তিনি সবাইকে ডেকে বলতে লাগলেন, মানুষকে ভালবাসো। মানুষের সমস্ত অপরাধকে ক্ষমা করো। যারা তোমাদের ক্ষতি করে, যারা তোমাদের ঘৃণা করে, তাদেরকেও ভালবাসো। তা হলেই ঈশ্বর তোমাদের ভালোবাসবেন।
যিশুর উপদেশ শুনে অনেকেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হলো। দলে দলে লোক আসতে লাগল তাঁর বাণী শোনার জন্য। ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল তাঁর অনুসারীর সংখ্যা।
শুধু অনুসারী নয়, বাড়তে লাগল তাঁর শত্রুর সংখ্যাও। তিনি ইহুদিদের উদ্ধার করবেন, একথা শুনে অনেকেই ক্ষিপ্ত আর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল তাঁর প্রতি। সকলের চেনা- জানা একজন কাঠমিস্ত্রির ছেলে কি না তাদের উদ্ধারকর্তা হবেন—এটা অনেকেই সহ্য করতে পারল না। তারা ক্রোধের বশে যিশুকে তাড়িয়ে দিল তাঁর জন্মস্থান নাজারেথ থেকে।
তখন যিশু অন্য জায়গায় গিয়ে প্রচার করতে লাগলেন তাঁর বাণী। তিনি তাঁর অনুসারীদের ডেকে বলতে লাগলেন, আমিই সত্য পথ। আমাকে ছাড়া পিতার কাছে যাবার অন্য কোনো পথ নেই। নরকে যাবার পথ খুব সহজ। সেজন্য অনেকেই সে-পথ বেছে নেয়। কিন্তু স্বর্গে যাবার পথ সংকীর্ণ ও কষ্টকর। খুব কম লোকই সে-পথ দিয়ে যায়।
সে সময় প্রতি বছরই জেরুজালেম শহরে উৎসব হতো। মন্দিরে ইহুদিরা পুজো দিতে আসত। সেখানে পশুবলি দেওয়া হতো। যিশু এ দৃশ্য সহ্য করতে পারতেন না। তাই তিনি পশু-বিক্রেতাদের তাড়িয়ে দিলেন, যাতে ধর্মের নামে মন্দিরে এ ধরনের নিষ্ঠুর কাজ আর না হয়। কিন্তু এতে জেরুজালেমের লোভী পশু-ব্যবসায়ীরা যিশুর ওপর ভয়ানক খেপে গেল। ঘটনা শুনে খেপে গেল রোমানরাও।
ইহুদি পুরোহিতরা এসে রোমান শাসনকর্তা পাইলেটের কাছে অভিযোগ করল, যিশু তাদের ঈশ্বরকে অপমান করেছেন। তাই তিনি ঈশ্বরদ্রোহী। তাঁর বিচার করতে হবে। তাঁকে শাস্তি দিতে হবে।
বারোজন শিষ্য সবসময় থাকতেন যিশুর সাথে। তিনি খুবই ভালবাসতেন তাঁদের। এই বারোজন শিষ্যের মধ্যে একজনের নাম ছিল জুডাস।
শত্রুরা টাকার লোভ দেখিয়ে জুডাসকেই হাত করে ফেলল। এই বিশ্বসঘাতকই টাকার লোভে যিশুকে ধরিয়ে দিল একদিন রোমানদের হাতে। জুডাসের বিশ্বাসঘাতকতা আজও পৃথিবীরে ইতিহাসে এক কলঙ্কিত ঘটনা হয়ে আছে।
যাইহোক, পুরোহিতরা ধরে নিয়ে এল যিশুকে। পন্টিয়াস পাইলেট বিচারের নামে প্রহসন করে যিশুকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিলেন। তারপর তাঁরই আদেশে নগরের সীমানায় ক্যাল্ভারি পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে ক্রুশকাষ্ঠে ঝুলিয়ে হাতে-পায়ে পেরেক ঠুকে যিশুকে হত্যা করা হলো নির্মমভাবে। নির্মমতা কত মারাত্মক হতে পারে, যিশুর ওরপ পরিচালিত নিষ্ঠুরতাই বড় প্রমাণ। যেয ক্রুশকাষ্ঠে যিশুকে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, সেই ক্রুশকাঠটি তাঁকে দিয়েই বহন করানো হয়েছিল! এ-ভাবেই হিংস্র জাননোয়ারতুল্য একদল মানুষের হাতে নির্মমভাবে নিহত হলেন ঈশ্বরের মহান দূত।
কিন্তু মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তেও ভালোবাসা আর প্রেমের মহান দূত যিশু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, – হে পিতা, তুমি এদের ক্ষমা কোরো। এরা জানে না এরা কী করছে।
যিশুখ্রিস্ট নেই। কিন্তু তাঁর প্রচারিত সত্যের বাণী, তাঁর ধর্মমত আজও আছে। আজও সারা বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মহান যিশু খ্রিস্ট প্রবর্তিত ধর্মের অনুসারী।