দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

যা হয় না

যা হয় না

যদি এমন হত, রোজ আমি যখন সকালে বিছানা থেকে নিজেকে টানা-হ্যাঁচড়া করে তুলি, সেই সময় ঠিক একই ভাবে কোনও দেশনায়ক নিজেকে ঠেলে তুলতেন। আমারই মতন কোনও রকমে এক কাপ চা খেয়ে খালি দুধের বোতল আর খাস্তা একটি কার্ড হাতে বিষণ্ণ একটি দুধের গুমটির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন। বুক ঢিপঢিপ করছে। যেন পরীক্ষার ফল বেরোবে। এসেছে, না আসেনি? যদি এসে থাকে, ঠান্ডা একটি হড়হড়ে বোতল ব্যাগে ভরে বাজারের দিকে দৌড়ে। যদি না এসে থাকে, অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকো।

না, তা হয় না।

যদি এমন হত, ঠিক যেসময় স্নান করতে যাচ্ছি, ঠিক সেই সময় আলো আর জল দুটোই চলে গেল। আমিও যেমন যা: বলে প্রায়ান্ধকার বাথরুমে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলুম, ঠিক সেই রকম কোনও দেশনায়কও দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ধীরে-ধীরে বেরিয়ে এসে সেই অবস্থাতেই জামাপ্যান্ট পরে আহারে বসে পড়লেন।

না, তা হয় না।

সেই ঘিনঘিনে অবস্থায় মিনমিনে আহারের আয়োজন দেখে আমার মতোই তিনি যদি আঁতকে উঠতেন, আর অদ্ভুত এক মানসিক শূন্যতায় গপাগপ গিলে তড়াক করে লাপিয়ে উঠে ঘড়ির কাঁটা দেখে ঘরময় কাঁকড়া বিছের মতো নাপচিয়েল ড্যান্স শুরু করতেন, আমার রুমাল কই, ব্যাগ কই, চশমা কই, ঘড়ি কই।

না তা হয় না।

তারপর তিনি যদি ঊর্ধ্বশ্বাসে হোঁচট খেতে-খেতে বাস স্টপেজের দিকে দৌড়তে -দৌড়োতে আমার মতোই ভাবতেন, কী কর্পোরেশন, কী পৌর এলাকা, সব অঞ্চলের অবস্থাই প্রায় একপ্রকার। শ্রীহীন, বিবর্ণ। খানাখন্দ, ঢিপি, আবর্জনা, বারোমাসই জলকাদায় গদগদে। যে অংশে গাড়ি চলে, সেখানে ধুলোর ঝড় বয়। পৌর অঞ্চলে সাইকেল রিকশার দাপট। যেন এথেনসে চ্যারিয়ট রেস হচ্ছে। সব বেনহুরের বাচ্চা। আমার মতোই তাঁর মনে হতে থাকবে দেশ শাসন করছে কারা? রিকশাওয়ালা, ঠ্যালাওয়ালা, লরিওয়ালা, টেম্পোওয়ালা! তিনি ভাবতে থাকবেন, না এভাবে চলে না। একটা কিছু করা দরকার! আমি ওদের একটু কড়কে দেব, যারা জনসাধারণের অর্থে জনসেবার সামান্য ছিটোফোঁটাও অবশিষ্ট না রেখে শুধু লুট লে, লুট লে করছে। আমার মতোই তার লজ্জা করতে থাকবে, এই শ্রীহীন জনপদ কোনও কৃতিত্বের কথা ঘোষণা করছে না। শাসনের অঙ্গে কলঙ্ক লেপন করে চলেছে। দেশের মানুষকে সব কিছু সহ্য করানো যায়। তারা সহনশীল ভোটদাতা। কিন্তু বিদেশিদের বিচারে এই রাজ্য অবহেলা আর নোঙরামির শেষ সীমায় নেমে গেছে। বিদেশি বিমান এশহর ঘৃণায় পরিত্যাগ করেছে। তিনি ভেবে আতঙ্কিত হবেন, আমি যখন বিদেশে যাব, তখন আমি কোথায় থাকি কেমন করে বলব! বলার সাহস থাকলেও ভাবতে বিশ্রী লাগবে, তাঁরা মনে-মনে ফু:ফু: করে উঠবেন। তখন আমার সব বড় কথাই মনে হবে বাতুলের প্রলাপ। আবর্জনার পাশ দিয়ে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে যেতে-যেতে তিনি সেই সত্যের সন্ধান পাবেন, সংগ্রাম বিপক্ষ দলের সঙ্গে নয়, সংগ্রাম হল মানসিকতার সঙ্গে, বিকৃত রুচির সঙ্গে, নিষ্ক্রিয়তার সঙ্গে।

না, তা হয় না।

তারপর সেই দেশনায়ক আমার মতোই ঘর্মাক্ত কলেবরে ভাদ্রের রোদে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াবেন। দয়াপরবশ হয়ে ধনিকসংঘ যে যাত্রীছাউনিটি করে দিয়েছিলেন, সেদিকে একবার তাকাবেন। বড় করুণ অবস্থা। যে দেশের বিরাট এক অংশের মাথায় শুধু আকাশের চাঁদোয়া, তাঁরা সেটি দখল করে নিয়েছেন। তাঁদের জীবনধারণের আয়োজনে চাকচিক্য না থাকাই স্বাভাবিক। ছেঁড়া চট, নোংরা কাঁথা, কালো হাঁড়ি, পোড়া ইট, তালতোবড়ানো দু-একটা কুড়িয়ে পাওয়া থালা-বাটি। উদ্ধার করে আনা রুটি রোদে শুকিয়ে ভবিষ্যতের সঞ্চয়। বাজারের ফেলে দেওয়া পচা আনাজ। বন্ধু প্রতিবেশী নেড়িকুকুর দু-একটা, গা ঘেঁষে বসে ঘা চাটছে। একটি পরিবার স্থির ব্যঙ্গচিত্রের মতো রেলিঙে ঝুলছে। অপরপারে বিশাল হোর্ডিং। কোনও এক বস্ত্রপ্রস্তুতকারক সংস্থার। মোহিনী নারীর শাড়ির আঁচল উড়ছে, সিনেমার নায়কের মতো একটি যুবক তেড়ে আসছে জাপটে ধরার জন্যে। বক্তব্য সেই আদি-অকৃত্রিম প্রেমের জগতে প্রজাপতির মতো মুহূর্তে জন্মে মুহূর্তে মেলাও। দেশনায়ক অবাক হয়ে ভাববেন, এ বিজ্ঞাপন কোন স্বপ্নরাজ্যের!

ইতিমধ্যে লুটোপুটি খেতে-খেতে একটি বাস আসবে। আমার মতোই তিনি জানের মায়া ছেড়ে আর পাঁচজন মারমুখী ভোটদাতাদের সঙ্গে ফুটবোর্ডে সূচ্যগ্র মেদিনীর জন্যে কুরুক্ষেত্র সমরে সামিল হবেন। হতে-হতে ভাববেন, ‘না:, একটা কিছু করা দরকার। দিনের পর দিন এ ভাবে চলে না। সবাই কুস্তিগীর নয়। শিশুরা স্কুলে চলেছে। চাপে আধহাত জিভ বেরিয়ে পড়েছে। অসুস্থ মানুষের সংখ্যা কম নয়। ভাতভিক্ষের দায়ে পথে নেমেছেন। বৃদ্ধরা আছেন। সন্তানসম্ভবা রমণী আছেন। এ ভাবে কর্মস্থলে গিয়ে কারুরই আর কর্মক্ষমতা অবশিষ্ট থাকে না। সেই প্রবাদোক্ত পাওনাদারকে খাতক বলেছিল, ভাবছ কেন? এই দ্যাখো তোমার ব্যবস্থা আমি করে ফেলছি। এক মুঠো শিমূল বীজ এই আমি মাটিতে ছড়িয়ে দিলুম। গাছ হবে। বীজ আসবে। ফেটে তুলো উড়বে। ধরো আর পোরো। বেচলেই টাকা। মেট্রো, সার্কুলার, ডবলডেকার ট্রাম, আরও বাস, আসছে, আসছে মরীচিকার মতো। শুধু এযাত্রা বেঁচে থাকার চেষ্টা করো। তিনি ভাববেন, হাফবয়েল হতে-হতে ভাববেন, না:, আর ললিপপে হবে না। কিছু করতে হবে।

না, তা হয় না।

পুরাকালে এক রাজা ছিলেন। নাম ফেলারিস। তিনি কিঞ্চিৎ অত্যাচারী ছিলেন। তাঁর অত্যাচারের কায়দাটি ছিল বড় অভিনব। পেট-ফাঁপা বিশাল একটা পেতলের ষাঁড়ের মধ্যে প্রজাদের ঠেসে দিতেন। তারপর গনগনে আঁচের ওপর ঝুলিয়ে দিতেন সেই বস্তুটিকে। প্রাণীরা ভাপে রোস্ট হতে-হতে আর্তচিৎকার তুলত। সে চিৎকার রাজার কানে যেত না। তিনি শুনতেন পেতলের ধাতব ঝংকার। কানে এসে বাজত মধুর সঙ্গীতের মতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *