3 of 8

যা দেবী সর্বভূতেষু

যা দেবী সর্বভূতেষু

যা দেবী সর্বভূতেষু একটি চমৎকার শ্লোক, সর্বভূতেষুর পরে শক্তি, শান্তি, বিদ্যা যে-কোনও একটা দু’ মাত্রার লাগসই শব্দ বসিয়ে দিলেই রোমাঞ্চকর মন্ত্রে পরিণত হয়,

যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা,…

…যা দেবী সর্বভূতেষু বিদ্যারূপেন সংস্থিতা,..

ইত্যাদি, ইত্যাদি।

নিপাতনে, আর্ষ প্রয়োগে বা প্যারোডিতে মেমরূপেন, শ্যালীরূপেন এমনকী গিন্নিরূপেন সংস্থিতাও শোনা গেছে।

অবশ্য দেবীপূজার পবিত্রমন্ত্র নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ারকি করা রুচিসম্মত নয়।

বরং দুয়েকটা গুরুগম্ভীর কথা বলি।

দুর্গা খুব সুখের ব্যাপার নয়। বরং সংস্কৃত অর্থ ধরে আধুনিক বাঙালি কবির ভাষায় দুর্গাপূজার সময়টাকে ‘সে বড় সুখের সময় নয়’ বলা যায়।

সংস্কৃত থেকে অর্থ করলে বাংলায় দুর্গা শব্দের মানে দাঁড়ায় যাকে অতি দুঃখে পাওয়া যায়, যে দেবীকে পেতে কঠিন সাধনা করতে হয়।

দুর্গার স্বামীদেবতা শিবঠাকুরকে কত সহজে সন্তুষ্ট করা যায়, দুটো ধুতরোফুল, একটা কঁচা বেল, ধান-দূর্বা আর ভগবান গোবিন্দ আরও সহজলভ্য, শুধু নাম জপলেই হয়ে যাবে বড়জোর উড়োখই গোবিন্দায় নমঃ।

দুর্গাঠাকুরের চাই অষ্টোপচার, ষোড়শোপচার, অষ্টোত্তর শত উপচার। পদ্মই তো চাই একশো আটটা। বেশ্যাবাড়ির দরজার মাটি চাই, যেখানে মানুষ তার সব পুণ্য বিসর্জন দিয়ে ভিতরে ঢোকে।

ভাসমান সাদা মেঘ ও নীল আকাশ এবং তারও ঊর্ধ্বে আমাদের দৃষ্টির ওপরে দেব-দেবীদের জগৎ যার নাম স্বর্গ, সেই স্বর্গের দেবতারা শরৎকালে ঘুমিয়ে থাকেন। রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ জয় করে সীতাকে উদ্ধারের জন্যে রাম ঠিক করলেন দুর্গাপূজা করবেন, দেবীর বর নেবেন।

সেটাও শরৎকাল, মেঘেরা দল বেঁধে যায় কোনখানে, যেখানে নিঃসীম প্রান্তর শুভ্র কাশফুলে দোলায়িত, প্রাচীন আকাশের ছায়া ভাসা সাদা-নীল জলে থরে থরে উন্মোচিত এবং বিকচোন্মুখ লালকমল।

সবই ঠিক আছে, কিন্তু সেটা পুজোর সময় নয়। দুর্গাপূজা হত বসন্তকালে এখন যে সময় বাসন্তীপুজো হয়। তবে লিখে রাখা ভাল যে বাংলাদেশের (পশ্চিমবঙ্গে অবশ্যই) প্রায় প্রতি মাসেই দুর্গাপূজার কোনও না কোনও রকম ব্যাপার আছে। জগদ্ধাত্রী, কাত্যায়নী, অন্নপূর্ণা, বাসন্তী, সর্বমঙ্গলা—সবাই, মহাদেবীর সবাই দুর্গাঠাকুরানী।

রামচন্দ্র শ্রীদুর্গার ঘুম ভাঙিয়ে অকালবোধন করলেন। কিন্তু দুর্গাদেবী তো মোটেই একা নন, কার্তিক আছেন, গণেশ আছেন, লক্ষ্মী আছেন, সরস্বতী আছেন এবং শুধু তাঁরা নন, তাঁদের বাহনেরা—হাঁস, ময়ূর, পেঁচা, ইদুর আছে। ঠাকুরানীর সিংহ আছে, অসুরের, তার নাম মহিষাসুর, তার মোষ আছে অথবা মোষের অসুর আছে, মোষের গলা কেটেই অসুর বেরচ্ছে।

এই এত সকলের ঘুম ভাঙিয়ে রামচন্দ্র অকালবোধন করলেন। তাতেও কম বাধা নাকি, আশ্বিনের ফুরফুরে বাতাসে, সোনালি রোদে দুর্গাঠাকরুণ পরিহাসপ্রবণ হয়ে উঠলেন।

বহু কষ্টে বহু পরিশ্রমে দিগ্বিদিক অন্বেষণ করে একশো আটটি রক্তপদ্মের জোগাড় করেছিলেন রামচন্দ্র। কিন্তু পুজোর সময় দেখা গেল একটা পদ্ম কম। দেবী স্বয়ং পরিহাস করে একটি পদ্ম লুকিয়ে ফেলেছেন।

অঞ্জলিদানের সময় যখন একশো সাতটি পদ্ম দেওয়ার পর একশো আটতম পদ্মটি রামচন্দ্র দেখতে পেলেন না তখন তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন, দেবীকে সম্বোধন করে বললেন, ‘মা, আমার একটি পদ্ম কম পড়েছে, তাই বলে তোমার আরাধনা অসম্পূর্ণ রাখব না। লোকে আমাকে কমললোচন বলে, আমি অস্ত্র দিয়ে আমার একটা চোখ উপড়িয়ে তোমার পদতলে অঞ্জলি দিচ্ছি। মা, তুমি গ্রহণ করো।’

দেবী দুর্গা তো নিষ্ঠুরা, নির্মমা নন, রামচন্দ্র নিজের কমললোচন উপড়িয়ে ফেলার আগেই রামচন্দ্রের হাত ধরে তিনি সেই লুকনো পদ্মটি ফেরত দিয়ে দিলেন।

এসব সত্ত্বেও বলি, শ্রীদুর্গা বৈদিক দেবতা নন। কোনও বেদেই তাঁর নামোল্লেখ পাওয়া যায় না। শুধু নারায়ণ উপনিষদে এবং শুক্লযজুঃ সংহিতায় দেবী অর্থে দুর্গি শব্দ পাওয়া যায়। আর পাওয়া যায় অম্বিকা, সেও অবশ্য দুর্গাবাচক শব্দ।

পৃথিবীতে দুর্গাপূজার শুরু হয় সুরথ রাজার সময়ে। বিদর্ভ রাজ্যের নৃপতি ছিলেন শ্বেত রাজা। শ্বেত রাজা তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা সুরথকে রাজ্য দান করে রাজ্যশাসনের ভার দিয়ে বনে চলে যান। সেই সুরথ প্রথম পৃথিবীতে দুর্গাপূজা করেন।

তার আগে একটা ঘটনা ঘটেছিল।

সুরথের রাজ্য শত্রুরা দখল করে নিয়েছিল। তখন মহর্ষি মেধস সুরথ রাজাকে উপদেশ দিলেন নদীর তীরে মৃন্ময়ীদেবী অর্থাৎ মাটির প্রতিমা বানিয়ে তার আরাধনা করো। সেই আরাধনা করে মহারাজা সুরথ শুধুমাত্র হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করেছিলেন তা নয় জন্মজন্মান্তরেও দেবীকৃপায় ধন্য হয়েছিলেন।

মহারাজা সুরথ মরপৃথিবীর সামান্য মানুষ। তিনি মরপৃথিবীতে প্রথম শ্রীদুর্গার আরাধনা করেছিলেন।

কিন্তু তার আগে?

তার আগেও দুর্গাপূজা ছিল।

এমনকী দেবাদিদেব ব্রহ্মদেব মহাদেবী শ্রীদুর্গার আরাধনা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অসুর মধুকৈটভের অত্যাচারে দীর্ণ হয়ে ব্রহ্মা দুর্গার আরাধনা করেন।

দেবাদিদেব ইন্দ্র দুর্বাসার অভিশাপে লক্ষ্মীহীন অর্থাৎ একালের ভাষায় লক্ষ্মীর সঙ্গে সেপারেটেড হয়ে দুর্গাপূজা করে আবার লক্ষ্মীকে ফিরে পান। অর্থাৎ শ্রীদুর্গা হলেন দেবতাদের দেবতা। যেমন সাহিত্যে কোনও কোনও বড় লেখককে বলা হয় লেখকদের লেখক, তেমনই শ্রীদুর্গা হলেন দেবদেবীদের দেবী।

শাস্ত্রকথা অনেক হল। অতঃপর একালের পুজো নিয়ে একটা হালকা গল্প বলি। একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে, রাস্তায় জল জমেছে। তবু পুজোর বাজার। দোকানে দোকানে ভিড়, হইচই। এমন সময়ে একই সঙ্গে ভিজে গলদঘর্ম হয়ে হন্তদন্ত এক ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন রাস্তার মোড়ের এক হোসিয়ারির দোকানে। তারপর দ্রুত নিক্ষিপ্ত বন্দুকের গুলির মতো পরপর চারটি প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন দোকানদারের উদ্দেশে।

প্রশ্নগুলো হল, ‘আমার গায়ে কত সাইজের গেঞ্জি হবে, হাতাওলা গেঞ্জি হবে কিনা, রাস্তার মোড়ে যে জল জমে আছে, সেটা কতটা গভীর এবং দাম কত?’

প্রশ্নগুলো একত্র পেয়ে দোকানদার ভদ্রলোকটির দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, ‘আটত্রিশ ইঞ্চি, হাতাওলা গেঞ্জি হবে, হাঁটু পর্যন্ত, বাইশ টাকা পঞ্চাশ পয়সা।

পুনশ্চ:

শুধুই মনোরঞ্জনের অজুহাতে অন্য একটি বকেয়া গল্পকে স্মরণ করি। যাঁরা গল্পটি ভুলে গিয়েছেন তাঁদের অবশ্যি কাহিনীটি এখনও ভাল লাগবে।

গল্পটি ছোট।

নববিবাহিতা স্ত্রী নিয়ে স্বামী বের হয়েছে সারারাত সব মণ্ডপে ঘুরে ঘুরে প্রতিমা দেখবার জন্যে। স্বামীর নাম সুরঞ্জন, তার চোখে এই বয়েসেই অতি হাইপাওয়ারের চশমা।

চশমা চোখে না থাকলে সুরঞ্জন প্রায় কিছুই দেখতে পারে না।

রাত দুটো নাগাদ স্বামী-স্ত্রী তেইশের পল্লী অতিক্রান্ত হয়ে হরিশ মুখার্জি রোড ধরে কালীঘাট দমকলের পাশে ফরোয়ার্ড ক্লাবের মণ্ডপে পৌঁছল।

মহানবমীর রাত। বৃষ্টি-বাদল নেই, আকাশ পরিষ্কার। রাস্তায় কাতারে কাতারে লোক, মনে হয় না কলকাতার কিংবা আশপাশের কোনও এলাকার কোনও বাসায় আজ রাতে কোনও লোক আছে। সবাই হইহই করে বেরিয়ে পড়েছে। জটলা, গুঁতোগুঁতি, ধাক্কাধাক্কি, মাঝে-মধ্যে একটু আধটু হাতাহাতিও হচ্ছে। শেষ পুজোর রাত, আজ আর পুলিশের তৈরি শক্ত বাঁশের ব্যারিকেড নেই। ভিড়ের ধাক্কা একেকবারে দক্ষিণ থেকে উত্তরে আসছে, একেবারে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উঠে আসছে আবার এক মহূর্ত থমকিয়ে উত্তর থেকে ফিরে দক্ষিণের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে।

এ রকমই একটি দক্ষিণমুখী ধাক্কার ঢেউয়ে আরোহণ করে সস্ত্রীক সুরঞ্জন ওই কালীঘাট দমকলের পাশে ফরোয়ার্ড ক্লাবের মণ্ডপের সামনে এসে পৌঁছল কিন্তু শেষ মুহূর্তে পেছনের একটা বড় ঢেউয়ের ধাক্কায় সে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।

কোনও রকমে সামান্য আহত হয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সুরঞ্জন দেখে চোখের চশমা জোড়া খুলে পড়ে গেছে এবং অনতিপরেই পায়ের কাছে মুচমুচ শব্দ শুনে বুঝতে পারল জনতার দ্বারা পদদলিত হয়ে চশমাটা চুরমার হয়ে গেল।

এরপর সব অন্ধকার।

গোলমালটা হয়েছিল শেষরাতে যখন সুরঞ্জন বউকে নিয়ে বাড়ি ফিরল।

সুরঞ্জনের বিধবা মা ঘুমচোখে দরজা খুলে দিয়ে হঠাৎ বউকে দেখে চমকিয়ে উঠে আরেকবার চোখ কচলিয়ে তারপর বললেন, ‘ও সুরঞ্জন এ কে?

সুরঞ্জন বলল, ‘আমার বউ। তোমার স্নেহের বউমা।’

সুরঞ্জনের চোখের দিকে তাকিয়ে সুরঞ্জনের মা বললেন, ‘সুরঞ্জন তোর চশমা কী হল। কিছুই তো দেখতে পাচ্ছিস না।’

সুরঞ্জন বলল, ‘ভিড়ের ধাক্কায় রাস্তায় পড়ে ভেঙে গেছে।’

সুরঞ্জনের মা বললেন, ‘ওমা, তাই তো বলি, এ বউমা তো আমাদের বউমা নয়। নিজের বউ ফেলে এ পুজোর বাজারে কোন মণ্ডপ থেকে তুই কাদের বউ নিয়ে চলে এলি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *