দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

যা দেবী বঙ্গভূতেষু

যা দেবী বঙ্গভূতেষু

কেন জানি না, এই পুজো এলেই মনের আকাশে অতীত উঁকি মেরে যায়। এ মনে হয়, নীল আকাশের ষড়যন্ত্র, প্যাঁজা তুলোর মতো মেঘের ষড়যন্ত্র, ঊষার শীতল বাতাসের কেরামতি, ভোরের ফোঁটা শিশিরে ফিরে তাকানো। ঝরা শিউলির স্মৃতিচারণ। কেন যে এমন হয় আমার জানা নেই। পোড়-খাওয়া প্রৌঢ়ের শরীর থেকে একটি কিশোর বেরিয়ে এসে অতীতের দিকে হাঁটতে থাকে। কতদূরে সে চলে যায়! প্রায় চল্লিশ বছর পেছনে।

তখন যে আমি কর্তা ছিলুম না। জীবনে তখন সুখ ছিল কত। মন সবে ফুটছে, স্বপ্নে, কল্পনায়। পৃথিবীর যত নোংরামি, দাসত্ব সব দূরে পড়ে আছে। রাজনীতি কাকে বলে জানি না, অর্থনীতি তাও বুঝি না। কেরিয়ার কি বস্তু, খবর রাখি না। তেল দিলে কি হয়, তেল না দিলে কি হয়, আমার অজানা। কিশোরের চোখে সবই সুন্দর। সবুজ শ্যামল। ছোটো-ছোটো পাওয়া।

যে-যে জীবন থেকে ওঠে সেই জীবনের জন্য তার ভীষণ একটি আকুতি থাকে। সব মানুষই দিনের শেষে ঘরে ফিরতে চায়। যে জীবন হারিয়ে গেছে স্মৃতি হয়ে গেছে, শরতের নীল আকাশ বেয়ে ঢাকের শব্দে ক্ষণিকের জন্যে ফিরে আসে। জীবন-নৌকোর হালটি তখন ক্লান্ত, অলস হাত থেকে খুলে পড়ে যায়। যাত্রী হয়ে ভাসতে থাকি দু:সময়ের জলাশয়ে।

মা যেমন ছিলেন তেমনই আছেন। যেমন আসেন তেমনি প্রতিবছর। কোনও পরিবর্তন নেই। আমিই কেবল পালটে গেছি। দিনে-দিনে আমার মনে হচ্ছে। বিশ্বাসের জগৎ ছেড়ে অবিশ্বাসের জগতে প্রবেশ করেছি। আমার সমস্ত পূজা ব্যর্থ হয়ে গেছে। মা আমার কাছে শক্তিহীন পুতুলমাত্র। বিচিত্র অঙ্গসজ্জায় প্রাণহীন। মৃণ্ময়ীর প্রাণপ্রতিষ্ঠার সাধ্য আমার হয়নি।

শক্তির পূজারী হিসেবে আমার যা চেহারা হওয়া উচিত ছিল আমার তা হয়নি। অপসৃত কৈশোর বিপর্যস্ত যৌবন মাড়িয়ে, দিকভ্রষ্ট প্রৌঢ়ত্বে এসে অহরহ বলছে—ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। নিজের দোষেই দরকচা মেরে গেছি।

সকলকে নিয়ে যে বাঁচতে শেখেনি তার বেঁচে থাকার সব থাকতে পারে সুখ থাকে না। সব তফাৎ যাও, তফাৎ যাও করতে-করতে জীবন পল্লবশূন্য। এ ডালে বসে পাখি আর গান গাইতে আসে না। কাকের কর্কশ চিৎকারে কান ফাটে, প্রাণ ভরে না। এখন আমার দেবী আরাধনা, মা আমাকে পূর্ণতার বদলে শূন্যতা দিলেন। লক্ষ্মী বিরূপ, সরস্বতী বীতরাগ, কুলুঙ্গিতে ওলটানো গণেশ। চতুর্দিকে নেংটি ইঁদুরের নাচানাচি। সিংহ বিক্রমে দিনের প্যাঁচা কোটরে বসে লাল চোখ ঘোরাচ্ছে।

বেশ ভালোই হয়েছে। শাপগ্রস্ত সাধক। শিব হতে গিয়ে বাঁদর হয়ে গেছি। সাধনার জোরে ন্যাজটিই বহরে বেড়ে চলেছে। বাঁদরামিরও শেষ নেই। মা আসেন, আর হাসেন। মনে-মনে বলেন—কি হয়েছিস খোকা? শৈশবে তোকে দেখেছিলুম বাঙালির-বাচ্চা। ভাসা-ভাসা নিষ্পাপ দুটি চোখ। বর্ষার জলে ভরা শরতের জলাশয়ের পাশে নেচে-নেচে ফড়িং ধরছিস। সোনার চামচ মুখে ধনীর ব্যাটা ছিলি না; কিন্তু জীবনে বেশ একটা সুখ ছিল। তখন তোকে দেখার জন্যে মাথার ওপর কত আত্মীয়-স্বজন ছিল। জ্যাঠাইমা, কাকিমা, পিসিমা, দাদা, বউদি। চন্ডীমন্ডপে ঠাকুর গড়ার সময় হাঁ করে যে কিশোরটি দাঁড়িয়ে থাকত সে কি তুই?

হ্যাঁ, মা আমিই সেই। শৈশব আমার শান্তি নিয়ে সরে পড়েছে। নির্ভরতার সব আশ্রয় স্বার্থপরতায় তছনছ হয়ে গেছে। চণ্ডীমন্ডপের ওপর দিয়ে চলে গেছে জাতীয় সড়ক। সাপলা ভাসা, নীল আকাশের রঙচোঁয়ানো শরতের জলাশয়ে ধাপার আবর্জনা ঠেসে মানুষের জন্যে পায়রার খুপরি তৈরি হয়েছে। দিকে-দিকে গৃহ-স্বামীর আস্ফালন, ভাড়াটের চিৎকার। জলের কলে বালতি ধরে টানাটানি। মানুষে-মানুষে কাজিয়া। মহিষাসুরের হামাগুড়ি। ঝ্যাঁটা, জুতো, লাথিতে প্রেমের আদানপ্রদান। পরিবার ভেঙে গেছে, সমাজ অসংলগ্ন, সব প্রতিষ্ঠান চুরমার। প্রকৃতির শিশির মাখা শীতল বাতাস ভোরের শয্যায় মাথার সামনে এসে বলে না, ঘুমকাতুরে উঠে বসো, দ্যাখো, ষষ্ঠীর সকালে শরৎ কেমন সেজেছে? সরস্বতী নদীতে নাও সাজানো হয়েছে, সদাগর যাবেন সাতসাগরের পারে বাণিজ্যে। রাজা যাবেন মৃগয়ায়। পায়রার খোপে রাতের পাখা ঘুরছে ড্রাগনের উত্তপ্ত নি:শ্বাস ফুঁসে।

কোথায় গেল আমার সেই শৈশবের শিউলি-লোটানো সকাল। শিশির ভেজা দুর্বা। দোয়েলের নাচানাচি। কোদলানো ফুটপাথের ওপর দিয়ে আমার সকাল চলেছে টপকে-টপকে, নাকে রুমাল চাপা দিয়ে। লো প্রেসারের সকালে কর্মপ্রবাহ এনেছে এক কাপ পানসে চা। লাইনের সকাল শুরু হল। দুধের লাইন, রেশানের লাইন, বাসের লাইন, ইলেকট্রিকের লাইন। লাইনটানা জীবন। কোথাও একটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে।

সংগ্রাম যেখানে চলছে চলবে সেখানে আবার উৎসব কিসের! এ তো আমাদের অস্ত্র শানানোর যুগ। দেব-দানবের সংগ্রাম, না দানবে-দানবে সংগ্রাম, কে বলবে! সবই কি মায়ের ইচ্ছা, না দানবের ইচ্ছা! আধুনিক প্রতিমা কি তাহলে উলটে যাবে! মায়ের জায়গায় অসুর, অসুরের জায়গায় মা! স্থান পরিবর্তন। পায়ের জিনিস মাথায়, মাথার জিনিস পায়ে। পাদুকার দাম অবশ্য খুবই বেড়েছে। ইঙ্গিতপূর্ণ বুদ্ধি। মাথার চেয়েও মনে হয় দামি। নরমুন্ডের ইদানিং তেমন দাম নেই। যে হারে গেন্ডুয়া খেলা হচ্ছে। এক কোপে সাবাড়। সাবড়ে দেবার পর সোজা মর্গে, সেখান থেকে সৎকার। ছবি ছেপে তল্লাস চলে। অনেক জল ঘোলা করে আত্মীয়-স্বজন ফিরে পায় হয় একটি হাতঘড়ি, না হয় পরিত্যক্ত পরিধেয়, অথবা একটি মাদুলি।

যে মঞ্চে মা আসেন, তার চারপাশে ভক্তজন বড় বিমর্ষ। কি হবে জানা নেই। কখন কি হবে তার কোনও পূর্বাভাস নেই। আজ আছি, কাল নেই। এ যুগে মায়ের ভূমিকা দর্শকের। অস্ত্রে কৃপাণে মরচে ধরে গেছে। বিশ্বকর্মা যে কল চালিয়ে ধার দিয়ে দেবেন, সে উপায়ও নেই। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি, ইউনিয়ন বাজি, কল বিকল করে দিয়েছে। মা লক্ষ্মী বাঙালিকে ঘৃণা করেন। মা সরস্বতী সিলেবাসের গোলে পড়ে বিদ্যালয় ছাড়া। ছাত্রে-ছাত্রে লাঠালাঠি। বিদ্যার চেয়ে মহাবিদ্যার দিকেই একালের ঝোঁক বেশি। গণেশ ঠাকুর এখন গদিলোভী। ইঁদুরে সব ফসল খেয়ে গেল। রেশনে ডিউস্লিপ। প্যাঁচা এখন গট-আপ গেম খেলছে। ইঁদুরে ঘুষ দিয়ে লিগ জিতছে।

সার্বজনীন-অলারা মাকে ধরে আনে, তাই তিনি আসেন। ভাঙা, গলাপচা শহরে আলোর গোড়ের মালা দেখতে, হিটহিন্দি গান শুনতে, নিজের ইচ্ছেয় আর আসেন না। আগমনী গান গাইবার শিল্পী কোথায়। সবাই তো ডিসকো ড্যানসার! সংসারের ডিসকোতে সারাদিন নেচে কুঁদে অস্থির। সন্ধ্যায় আরক্ত চোখে ক্ষতস্থান লেহন। প্যান্ডেলে বসে মা আমার উর্ধ্বনেত্র। ভেবেই পান না, মায়ের পুজো, না প্যান্ডেলের পুজো, না আলোর পুজো। ফুঁকো দেওয়া দুধের মতো, ফুঁকো দেওয়া জোলো উল্লাসে, বাঙালির কষ্টার্জিত কয়েক কোটি, প্রতিবছরই ফুঁকে যায়। চাঁদা এখন ট্যাকসের মতো। বছর-বছর দিতেই হবে আর চার রাত জেগে কাটাতে হবে।

চ্যাল বে আর হ্যাট বে-র যুগে বারোয়ারী মায়ের চেহারা খ্যামটাউলির মতো। পাগলামিরও শেষ নেই। পেরেকের প্রতিমা, আলপিনের প্রতিমা, নাট বল্টুর প্রতিমা। তাইতেই প্রাণ প্রতিষ্ঠা। বিল্বপত্র নিক্ষেপ।

আমার পিতার শিশুটির মগজ ধোলাই হয়নি। তার শৈশবকে কেউ হত্যা করতে পারেনি। সেকালের শিশু শিশুই ছিল। একালের মতো বুড়িয়ে যায়নি। আমার শিশুটির কিন্তু শৈশব নেই। তার কল্পনার জগৎ আমরা ছোট করে দিয়েছি। সে ড্যাংগুলি খেলে না। ঘুড়ি ওড়ায় না, ভোরে উঠে ঝরা শিউলি কুড়োয় না। ঘাসের ডগায় শিশিরের নাকছাবি দেখে না। তার জন্যে সবুজ কোনও মাঠ নেই : বাতাবি লেবুর ফুটবল নেই। বর্ষার নালাতে সে কাগজের নৌকো ভাসাতে ছোটে না। তিনতলার কোনও দমআটকানো খুপরিতে তার ঘুম ভাঙে। এক চিলতে বৃক্ষহীন আকাশ করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে। তার জন্যে আছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, ডাঁই ডাঁই বই, সদাজাগ্রত মাতার সায়েব বানানোর তিরস্কার। আছে ঘড়ি ধরা সময়ে পরিচ্ছন্ন ব্রেকফাস্ট, প্রাোটিন-সমৃদ্ধ মধ্যাহ্নের আহার আর আছে উইক-এন্ড ও টার্মিনাল পরীক্ষার আতঙ্ক। সিলেবাসের ভারে নুয়ে পড়ে সে এগিয়ে চলেছে কেরিয়ারের দিকে। তার জীবনে শরৎ নেই, বসন্তের কোকিল নেই, পুজোও নেই। আছে কালচার্ড সভ্যতার বিকৃত আনন্দ। আমার নিজের শৈশবের মৃত্তিকাগন্ধী সেই আনন্দ, সেই সরলতা তাকে আমি ফিরিয়ে দিতে পারব না।

সেকালে মানুষ মানুষের অন্দরমহলে প্রবেশাধিকার পেত। একালে তার ছাড়পত্র সাজানো বৈঠকখানা পর্যন্ত। দেঁতো হাসি, প্রাণহীন ভদ্রতা বিজয়ার আলিঙ্গনে সেকালের উষ্ণতা নেই। পুজোর আগেই বাঙালি এখন বাইরে হাওয়া খেতে চলে যায়। শুনতে হয়, এই ন্যাস্টি শহর, ন্যাস্টি পুজো, হই হট্টগোল ডিসগাস্টিং। এ কেমন আবাহন।

বর্ণাশ্রম ভেঙে ফেললেও অর্থাশ্রম ঠিকই বেঁচে আছে। মানুষের পরিচয় মানবিকতায় নয়, উপার্জনের অঙ্কে বাঁধা। সেই কতকাল আগে ত্রৈলোক্যনাথ বাঙাল নিধিরামে লিখেছিলেন—মশায়ের ব্যাতোন। কলেরায় আক্রান্ত নিধিরাম পড়ে আছে গঙ্গার ধারে। তিন ব্রাহ্মণ স্নানে এসেছে। জিজ্ঞাসাবাদ চলছে, মশায়ের নাম? নিবাস? শেষে মশায়ের ব্যাতোন কত? বেতনের অঙ্কের ওপর নির্ভর করছে নিধিরামকে সাহায্য করা হবে কিনা। বিজয়ার পরের দিন অফিসে-অফিসে কোলাকুলির ধরন দেখলে সেই কথাই মনে পড়ে। ব্রাহ্মণ, শূদ্রে ভেদাভেদ না থাকলেও, হাজারী, দু-হাজারী, তিন হাজারী মনসবদারের বিভাগে মানুষ আড়ষ্ট। পাঁচশো টাকার চাকরে আর দু-হাজার টাকার চাকরেতে কোলাকুলি চলেছে, পাঁচশো টাকা, ডানাকাটা পেঙ্গুইনের মতো সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন, ভেবেই পাচ্ছেন না, কাঁধে না কোমরে না পিঠের দিকে হাত রাখবেন। মাঝের বাতাসে স্পর্শ বাঁচিয়ে বুকের ডাইনে বামে অর্ধ মোড়ে। একে বলে হাফকোলাকুলি।

যে দেশে পাড়ায়-পাড়ায় বোমাবাজি, মানুষ বিচ্ছিন্ন, বিব্রত, বিস্রস্ত, বিভেদ যেখানে রাজনীতির, অর্থনীতির, যে দেশে বেঙ্গলি আর ইংলিশ মিডিয়ামের কাটাকাটি, লাঠালাঠি, ঝুটোপুটি, যে দেশের রাত ভয়াবহ, দিন মিছিলাকীর্ণ, সে দেশে মাতৃসাধনা একটি প্রথা মাত্র। কিছু দেওয়া, কিছু নেওয়া, কিছু দেনা, কিছু পাওনা, গানের ঝরনা, বিসর্জনের বায়না, সামান্য বোনাস, আকাশছোঁয়া দাম। মন গেলে মানুষের আর কি রইল! কোথায় সেই হাসি, কোথায় সেইসব দিলখোলা মানুষ! প্রকৃতির পীড়ন মানুষকে যেমন সহ্য করতে হয় শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, ঝটিকা—ঠিক সেইভাবেই চোখ কান বুজিয়েই পার করে দিতে হয় বারো মাসের তেরো পার্বণ! দেবীকে কি বলব, কিভাবে আসতে বলব:

যা দেবী বঙ্গভূতেষু

স্যানিটারি ইনসপেকট্রেস রূপেণ

সংস্থিতা!!

যা দেবী বঙ্গভূতেষু

পুলিশাধ্যক্ষ রূপেণ সংস্থিতা!!

যা দেবী বঙ্গভূতেষু

সৎ বিধায়ক রূপেণ সংস্থিতা !!

কি ভাবে আসবে মা! একাধারে এসো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *