মঞ্চে আবার যেন সোনালি যুগ
পাথুরিয়াঘাটার প্রখ্যাত প্রয়াত প্রসন্নকুমার ঠাকুরের দৌহিত্র নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের শখ হয়েছিল, তিনি একটা নতুন মঞ্চ নির্মাণ করে থিয়েটার চালাবেন। নিতান্ত ব্যবসার কারণে নয়, উচ্চাঙ্গের নাটকের অভিনয়, যা ইংরেজদের থিয়েটারের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে। এ জন্য তিনি প্রায় নির্বাসন থেকে ফিরিয়ে আনলেন গিরিশচন্দ্রকে।
স্টার থিয়েটার গড়ে তোলার জন্য অভিনেত্রী বিনোদিনীকে শরীর বিক্রয় করতে হয়েছিল। সেই বিনোদিনীকেও এক সময় স্টারের সঙ্গে সংস্রব ত্যাগ করতে হয়। আর গিরিশচন্দ্রও এক সময় তাঁর অতি প্রিয় স্টারের জন্য মস্তক বিক্রয় পর্যন্ত করেছিলেন। তাঁকেও বিতাড়িত হতে হয় সেই মঞ্চ থেকে। সে সব কাহিনি এখানে অপ্রাসঙ্গিক। অপমানিত গিরিশচন্দ্র থিয়েটারের জগৎ থেকেই দূরে সরে গিয়েছিলেন। কিন্তু মঞ্চ-মায়ায় যিনি একবার আবদ্ধ হয়েছেন, তাঁর পক্ষে কি বেশি দিন এই অভিমান টিকিয়ে রাখা সম্ভব? নগেন্দ্রবাবুর প্রস্তাবে তিনি আবার পাদপ্রদীপের সামনে ফিরে আসতে রাজি হলেন। শুধু নাট্যকার হিসেবেই নয়, অনেক কাল পর তিনি আবার ধরাচুড়ো পরে অভিনয়ও করবেন।
ইংরেজদের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার জন্য উপযুক্ত নাটক চাই। তাই অনেক পরিশ্রমে গিরিশচন্দ্র অনুবাদ করলেন শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ-এর মতো শক্ত নাটক। ভাবানুবাদ নয়, একেবারে সাহেব-মেমদের মতো পোশাক পরে, উপযুক্ত সেটে অনুষ্ঠান। গিরিশচন্দ্র স্বয়ং সাজলেন ম্যাকবেথ। নতুন মঞ্চটির নাম মিনার্ভা। সেখানে ম্যাকবেথের প্রথম অভিনয় হয়েছিল ২৮ জানুয়ারি, ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ।
তার পর তো এতগুলি বছরে মিনার্ভা থিয়েটার অনেক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে গেছে। একবার আগুনে ভস্মীভূত হয়েছিল। তার পরেও জোড়াতালি দিয়ে মাঝে মাঝে চালাবার চেষ্টা হয়েছিল। ইদানীং একেবারেই পোডড়াবাড়ির হাল হয়েছিল। সরকারি উদ্যোগে আবার আমূল সংস্কার করে, পুরনো রূপটি অনেকটা ফিরিয়ে এখন চালু করা হয়েছে। এবং মঞ্চস্থ হচ্ছে শেক্সপিয়রেরই অন্য একটি নাটক, ‘কিং লিয়ার’। প্রধান ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। একশো সতেরো বছর পর পুনর্নির্মিত মিনার্ভাকে জীবন্ত করে তোলার জন্য আবার শেক্সপিয়রেরই নাটক মঞ্চস্থ করা উদ্যোক্তাদের পরিকল্পিত কি না তা জানি না। তবে শুনেছি, রাজা লিয়ারের ভূমিকায় অভিনয় করার শখ সৌমিত্রর অনেক দিনের। অনেক কাল আগে অধ্যাপক সুনীল চট্টোপাধ্যায়ের অনূদিত রূপটিই খানিকটা মাজা-ঘষা করে নেওয়া হয়েছে।
কেমন হয়েছিল গিরিশচন্দ্রের সেই প্রোডাকশন? সেই সময় তিনি হাঁপানিতে ভুগছিলেন। তবু নাকি তিনি সিংহবিক্রমে দাপাদাপি করেছেন মঞ্চে। দেশীয় অনেক জ্ঞানী-গুণী ম্যাকবেথের প্রভূত প্রশংসা করেছিলেন তো বটেই এমনকী সাহেবদের পত্রিকা ‘দি ইংলিশম্যান’ পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল যে, বাঙালির এই প্রশংসনীয় উদ্যম ইংরেজদের মঞ্চের সঙ্গে তুলনীয়।
কিং লিয়ারের এই প্রোডাকশন সম্পর্কে এ কালের ইংলিশম্যানরা কী বলছেন জানি না, তবে আমি বা আমার মতো অনেকেই এমনই অভিভূত যে মনে হয়েছে, দেশ-বিদেশের অন্য অনেক শেক্সপিয়র নাট্য প্রযোজনার সঙ্গে মিনার্ভার এই অনুষ্ঠানের তুলনা তো অনায়াসেই করা যায়, এমনকী এটি হয়তো উৎকৃষ্টতর। কী অসাধারণ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়, কোনও প্রশংসাই যেন যথেষ্ট নয়। এক কালের বাংলা সিনেমার সেই রোম্যান্টিক প্রেমিক, সত্যজিৎ রায় যাঁকে বহু ভাবে ব্যবহার করেছেন, উত্তমকুমারের পাশাপাশি যাঁর নাম উচ্চারিত হয়েছে, অনেক পথ পেরিয়ে এসে সেই সৌমিত্র এখন বাংলা মঞ্চের রাজা। একের পর এক নাটক মঞ্চস্থ করে যাচ্ছেন, বিভিন্ন আঙ্গিকে। ‘হোমাপাখি’ কিংবা ‘তৃতীয় অঙ্ক, অতএব’-এর তুলনায় কিং লিয়ারের ভূমিকায় তার সম্পূর্ণ অন্য রূপ। দার্ঢ্য ও করুণ রস সমান ভাবে পাশাপাশি। গিরিশচন্দ্র যখন ‘ম্যাকবেথ’ করেন তখন তাঁর বয়স ঊনপঞ্চাশ। এর পর তিনি আর বিশেষ কোনও নতুন নাটকে মঞ্চাবতরণ করেননি। আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বয়স এখন ছিয়াত্তর। তবু তাঁর পরিশ্রম করার কী অসীম ক্ষমতা, কত দিকে ছড়িয়ে রেখেছেন নিজেকে।
কিং লিয়ার নাটকে অনেক চরিত্র। শুধুমাত্র নায়কের অভিনয় নৈপুণ্যে এমন নাটক সার্থক হতে পারে না। সে কৃতিত্ব পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়ের। আমরা আগেই লক্ষ করেছি, (যেমন, ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’) মঞ্চে বহু চরিত্রের উপস্থিতি নিখুঁত ভাবে চালনা করায় সুমন বিশেষ দক্ষ। এই নাটকেও এত চরিত্র, ইংরেজ ও ফরাসি সৈন্য সমেত। কোথাও তাদের পোশাক ও পদক্ষেপের ভ্রান্তি চোখে পড়ে না। অন্যান্য অভিনেতাও যথেষ্ট পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। সেটটিও চমৎকার।
এই নাটক দেখার পর এ কথাও অবশ্যই মনে আসে যে, সম্প্রতি যেন বাংলার নাট্যজগতে আবার একটা সোনালি যুগ এসেছে। বছরে একটা দুটোও বাংলা সিনেমা দেখার যোগ্য হয় কি না সন্দেহ। কিন্তু মঞ্চ-নাটকগুলির প্রয়োগ, অভিনয়, শিল্পগুণ অনেক উন্নতমানের। মফস্সলের দলগুলিরও অনেক প্রয়াস অভিনব।
এক সময় বাংলার তুলনায় মহারাষ্ট্রের থিয়েটার আন্দোলন অনেকটা এগিয়ে ছিল। এখন যেন সেখানে খানিকটা ঝিমোনো ভাব এসেছে। বাংলার নাট্যজগৎ এখন বেশ চাঙ্গা। প্রবীণদের মধ্যে নান্দীকারের রুদ্রপ্রসাদ ও স্বাতীলেখা এখনও সমান সক্রিয়। সদ্য প্রয়াত কুমার রায়ের বহুরূপী দলও নতুন নাটক মঞ্চস্থ করে চলেছে। মারীচ সংবাদ-এর অরুণ মুখোপাধ্যায়কেও দেখা যায় কখনও সখনও। আর বিভাস চক্রবর্তী নিজের দল ছাড়াও অন্য অনেক দলের সার্থক পরিচালক। মেঘনাদ ভট্টাচার্য পরিচালক ও অভিনেতা হিসাবে সার্থক। উষা গঙ্গোপাধ্যায়ের রঙ্গকর্মী-র নতুন নতুন প্রোডাকশন বাংলা বা হিন্দিতে খুবই উল্লেখযোগ্য। ব্রাত্য বসু একই সঙ্গে নাট্যকার, পরিচালক ও অভিনেতা— এই তিন দিকেই প্রতিভার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। কৌশিক সেনের প্রযোজনার আঙ্গিক ও তাঁর নিজস্ব অভিনয় আমার খুব প্রিয়। রমাপ্রসাদ একজন পাকা অভিনেতা ও সার্থক নাট্য রূপকার। স্কুলের বাচ্চাদের দিয়ে তাঁর একটি নাটকের অভিনয় দেখতে দেখতে আমি চোখের জল সামলাতে পারিনি। (এই লেখার পর হঠাৎ শুনলাম রমাপ্রসাদ বণিক আর নেই, শুনে আবার আমার চোখে জল আসার উপক্রম হল।) ‘পূর্ব পশ্চিম’ নামের নতুন দলটির পর পর প্রকল্পগুলির একটা দেখলে অন্যগুলিও দেখার অদম্য ইচ্ছে হয়। আরও কত দলের ভাল নাটকের নাম শুনি। সময় করে দেখা হয় না বলে আফসোস থেকে যায়। অনেকের কথা উল্লেখ করা হল না, বাদ রয়ে গেল। মোট কথা, এ কথা বেশ জোর দিয়ে বলা যায়, এই মুহূর্তে বাংলায় যে বাংলার দু’একটি ব্যাপার নিয়ে গর্ব করতে পারি, তার মধ্যে নাট্য আন্দোলনের স্থান অবশ্যই প্রথমে।
এলেবেলে খেলুড়ে
কৌশিক বসু একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ। কিছু দিন আগে তিনি আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। এখন ভারত সরকারের অর্থ মন্ত্রকের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। তাঁর একটি গ্রন্থের নাম ‘The Retreat of Democracy.’ এর প্রথম অধ্যায়টির নাম ‘Ele bele, The subversion of Democracy.’ এই Ele Bele কিন্তু কোনও ল্যাটিন শব্দ নয়, কথ্য বাংলায় এলেবেলে। প্রসঙ্গটি বেশ মজার। ছেলেবেলায় যখন আমরা কয়েকজন মিলে কোনও খেলা করতাম, তখন অন্তরঙ্গ কয়েকজন খেলার সঙ্গ ছাড়া অন্য কেউ এসে যোগ দিলে কিংবা অন্য কাউকে চাপিয়ে দেওয়া হলে তা আমাদের মোটেও পছন্দ হত না। ধরা যাক, আমাদের কোনও মাসি বেড়াতে এসেছেন তাঁর ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। গুরুজনেরা বলতেন, সেই ছেলেকেও আমাদের খেলার মধ্যে নিতে হবে। আমরা নিতে বাধ্য হতাম। কিন্তু বন্ধুদের মধ্যে চোখে চোখে কথা হয়ে যেত—ও আছে বটে, কিন্তু ধর্তব্যের মধ্যে নয়, ও এলেবেলে। তেমনই অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিশ্বের অনেক দেশের মতামত নিয়ে যেখানে নীতি নির্ধারণ করার কথা, সেখানে আসল কলকাঠি নাড়ে কয়েকটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের একটা ছোট গোষ্ঠী। বাকিরা সবাই এলেবেলে। আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও বাণিজ্যনীতির ক্ষেত্রে আসল খেলুড়ে মাত্র কয়েকটি, এলেবেলের সংখ্যাই অনেক বেশি।
অরণ্যের রাজবাড়ি
‘আমাকে যেমন বলা হলো, তেমনই স্নানের সময় কোমরে গামছা জড়িয়ে খালি পায়ে লাফাতে লাফাতে বাথরুমে ঢুকলাম। এখন হয়েছে কি, বাথরুম থেকে বেরিয়ে কুয়োতলা যাবার পথে একটা তারে ধোওয়া জামাকাপড় মেলা ছিল। আমাকে আসতে দেখেই পিসিমা কোনও কথা না বলে একটি লাঠির ডগা দিয়ে ধোওয়া জামাকাপড়গুলি উঁচু করে, আমার মাথায় যাতে না লাগে সেই রকম করে তুলে ধরলেন।
‘ও হো, স্নান না করে ধোওয়া জামাকাপড় তো ছোঁওয়া চলবে না’— তাই না? আমি হাসতে হাসতে পিসিমাকে এই কথা বলতে পিসিমাও হাসতে হাসতে জবাব দিলেন…’
এই উদ্ধৃতি পাঠ করলে কি একটুও বোঝার উপায় আছে যে, এর লেখক বাংলাভাষী নন, দূর বিদেশি? আসলে ‘অরণ্যের রাজবাড়ি’ নামের গ্রন্থটি রচনা করেছেন জাপানের অধিবাসী শ্ৰীনাওকি নিশিওকা। তিনি জাপানি ভাষারও একজন সুখ্যাত লেখক ও গবেষক। শান্তিনিকেতনে যাওয়া-আসার সূত্রে বাংলা শেখা। এমন স্বচ্ছ, সাবলীল গদ্যে তাঁর রচনা অত্যন্ত উপভোগ্য।
ইদানীং কালে বেলজিয়ান পাদ্রি ফাদার দ্যতিয়েন ‘ডায়েরির ছেঁড়া পাতা’য় অত্যন্ত রসমাধুর্য পূর্ণ বাংলা গদ্য লিখে আমাদের মুগ্ধ করেছেন। ফাদার দ্যতিয়নকে তাঁর শেষ বয়সে, এ বছরই রবীন্দ্র পুরস্কার দেওয়াটা একটা পুণ্য-কাজ হয়েছে। নাওকি নিশিওকা-র মতো বাংলা গদ্য অনেক বাঙালি লেখকের কাছেই ঈর্ষণীয় মনে হবে। এই বইয়ের পাঁচটি রচনা অনেকটা ছোট গল্প আর ভ্রমণ অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ। অতি সাধারণ মানুষজনকেও তিনি বড় মায়াময় দৃষ্টিতে ফুটিয়ে তুলেছেন। সত্যি, এটি বাংলা ভাষার একটি ‘অতি’ উল্লেখযোগ্য বই।
২৯. ১২. ২০১০
এক অসাধ্যসাধকের বিস্ময়কর কাহিনি
প্রথমে মনে হয়েছিল, ‘আমি কি ভুল শুনলাম? বারোশো না বারো হাজার? দু’বার জিজ্ঞেস করার পর জানা গেল, সত্যি সত্যিই বারো হাজার। অনেক সময় কোনও সত্যি কথা শুনলেও মুখে একটা অবিশ্বাসের ছাপ ফুটে ওঠে। সত্যকেও মনে হয় অবাস্তব। — এ কাহিনির সবটাই প্রথমে অবিশ্বাস্য বা অবাস্তব মনে হলেও চমকপ্রদ ভাবে সত্য।
অচ্যুত সামন্ত ছিলেন ওড়িশার একটা গ্রামের গরিব ঘরের ছেলে। অল্প বয়সে পিতৃবিয়োগ হওয়ায় লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটেছিল। মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাই কষ্ট করেও চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করে পেয়েছিলেন এক কলেজের লেকচারারের চাকরি। এর পর এ রকম অধিকাংশ মানুষের জীবনই ধরাবাঁধা ছকে চলে। শুধু দু’ একজনই ব্যতিক্রম হয়, অচ্যুত সামন্ত সে রকমই একজন। কিছু দিন চাকরি করার পর তিনি ঠিক করলেন, ছেলেবেলায় তাঁর পড়াশোনা চালাতে যে রকম অসুবিধা হয়েছিল, সে রকম অসুবিধাতে এ কালের অনেক ছাত্রও তো পড়ে। তাদের জন্যে কিছু একটা করা দরকার। সম্পূর্ণ একার উদ্যোগে স্কুল-কলেজ গড়ায় মন দিলেন। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত কলেজ পেয়ে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা। সে মর্যাদা পেতে হলে অনেক শর্ত পূরণ করতে হয়। তা-ও হয়ে গেল। সেই কলিঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় কিট (KITT) নামে পরিচিত। হল নিজস্ব ভবন। এবং পর পর তৈরি হতে লাগল ডাক্তারি পড়ার জন্য মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি পাঠের জন্য পৃথক ব্যবস্থা। মাত্র দু’দশকের মধ্যে এক সুবৃহৎ প্রতিষ্ঠান। ভুবনেশ্বরের অদূরে এক বিশাল ক্যাম্পাস, সুদৃশ্য বাড়িগুলি দেখলে চোখ জুড়োয়। মন্দিরময় ভুবনেশ্বরে এ সবই যেন নতুন মন্দির ভাস্কর্য।
এ পর্যন্ত মনে হয়, চমকপ্রদ সাকসেস স্টোরি, কিন্তু অবিশ্বাস্য কিছু নয়। এত সব কিছু গড়ে তোলার জন্য শ্রীসামন্ত কোনও প্রকার সরকারি সাহায্যের মুখাপেক্ষী হননি। কিছু বন্ধুবান্ধব, শুভার্থী সাহায্য করেছেন এবং প্রধানত নির্ভর করেছেন ব্যাঙ্কের ঋণের উপর। যথাসময়ে ঋণ শোধ দিয়ে তিনি ব্যাঙ্কের বিশ্বাস অর্জন করেছেন।
এরপর সেই অবিশ্বাস্য ঘটনা। উচ্চাঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থায় সার্থকতা অর্জনের পর শ্রীসামন্ত শুরু করলেন একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। কলিঙ্গ ইনস্টিটিউট অব সোশাল সায়েন্সেস। সংক্ষেপে কিস (KISS)। এখানে শুধু আদিবাসী সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ। না, বারোশো নয়, বারো হাজার ছাত্রের জন্য হস্টেল। সম্পূর্ণ বিনা বেতনে পড়াশোনা আর বিনা খরচে খাওয়া। কে জি থেকে পি জি পর্যন্ত পড়ার ব্যবস্থা। সারা ভারতে আর কোথাও এক সঙ্গে বারো হাজার আদিবাসী সন্তানদের খাওয়া থাকা, লেখাপড়ার ব্যবস্থা, সব বিনা খরচে, না আর কোথাও নেই। এর জন্য যে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন তা আসে কোথা থেকে? ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল কলেজ চালিয়ে যথেষ্ট উপার্জন হয় তো বটেই, সেই উপার্জন ব্যয়িত হয় আদিবাসী কল্যাণে।
অচ্যুত সামন্ত তাঁর এই কর্মযজ্ঞের জন্য দেশবিদেশের অনেক স্বীকৃতি পেয়েছেন। এ বছর সিঙ্গাপুরে তাঁকে এশিয়ার শ্রেষ্ঠ সামাজিক সংগঠক হিসেবে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
ব্যক্তিগত জীবনে মধ্যবয়সি অচ্যুতবাবু মৃদুভাষী ও অতিশয় ভদ্র। কাজ-পাগল এই মানুষটি বিবাহ এবং সংসার করার সময় পাননি। একা থাকেন ক্যাম্পাসের বাইরে। একটা ছোট ভাড়াবাড়িতে। একলা এত কাজ সামলান, তবু তাঁর ব্যবহারে কোনও টেনশন নেই। এবং বেশ সাহিত্যপ্রীতি আছে। কখনও কবিতা লিখতেন কি না, তা-ই বা কে জানে! এই প্রতিষ্ঠান থেকেই নিয়মিত প্রকাশিত হয় একটি উচ্চাঙ্গের ওড়িয়া সাহিত্য পত্রিকা। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে সাহিত্যপাঠেরও আসর বসে। এবং সে কারণে কখনও তিনি অন্য রাজ্যের, অন্য ভাষার কোনও কবিকেও আমন্ত্রণ জানান।
কামিনী কলঙ্ক
প্রায় দেড়শো বছর আগে এই নামে প্রকাশিত নবীনকালী দেবীর বইটি নিয়ে অনেক আলোচনা ও তর্কবিতর্ক হয়েছিল। তার পর বইটি অদৃশ্য হয়ে যায়। সম্প্রতি লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরিতে এর একটি কপি খুঁজে পেয়ে ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ বুকস নামে এক নবীন প্রকাশক বইটির হুবহু এক সংস্করণ প্রকাশ করেছেন। নবীনকালী দেবী নামটি ছদ্মনাম কি না, তা ঠিক বোঝা গেল না। লেখিকা নিজেই বলেছেন, যে তিনি এক বারবনিতা। স্বেচ্ছায় কুলত্যাগ করে, বেশ কয়েক বছর অসামাজিক জীবন (তথাকথিত পাপের জীবন) যাপন করে, পরে অনুতাপ করেছেন। কিন্তু খটকা লাগে, বারবনিতার পক্ষে আত্মজীবনী লেখা অসম্ভব কিছু নয়, কিন্তু তাঁরা কি ‘দেবী’ ব্যবহার করতেন নামের সঙ্গে? বিনোদিনী লিখেছেন, ‘দাসী’। নবীনকালী আত্মপরিচয় লিখেছেন এই ভাবে:
শুন শুন সভাজন করি নিবেদন।
সংক্ষেপেতে মম দুঃখ, করিব বর্ণন।।
বারাসত গ্রাম মোর হয় পিতৃধাম
দ্বিজের তনয়া আমি, নবীনাদ্যা নাম।।…
এই লেখিকা অকপটে নিজের জীবনকাহিনি লিখেছেন। তিনি ভালই পড়াশোনা জানতেন, অনেক পুরাণের গল্প-টল্প উল্লেখ করেছেন, শৃঙ্গার রসের বর্ণনা দিতেও দ্বিধা করেননি। এবং যদিও নিজের সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমি অতি পাপমতি, অধমের শেষ’, তবু এক জায়গায় তর্ক তুলেছেন, পাপ কী, পুণ্য কী, কেন মানুষ পাপ বা অন্যায় কাজে প্রবৃত্ত হয়— তাতে কি বিধাতারও কোনও দায়িত্ব নেই?
একটি অতি মূল্যবান ভূমিকা এবং গ্রন্থটির সারাৎসার লিখেছেন সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে, এক জায়গায় বলা হয়েছে, কামিনী কলঙ্ক প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৮০ সালে। আবার অন্যত্র এই বইটি নিয়ে বিতর্কের উল্লেখ আছে ১৮৭১ সালে। বাংলা সাহিত্যের উপাদান কিংবা বিচিত্র রসের রচনা সম্পর্কে যাঁরা আগ্রহী, তাদের বইটি সংগ্ৰহযোগ্য মনে হতে পারে।
বিনায়ক সেন
প্রায় প্রতিদিনই গরিব, সাধারণ গ্রামের মানুষের রাজনৈতিক দলাদলির কারণে খুনোখুনির খবর দেখে মন কিছুটা সময় বিবশ হয়ে থাকে। তারপরই মনে পড়ে বিনায়ক সেনের কথা। কিছু কিছু মানুষ অন্য মানুষের প্রাণ হরণ করতে পারে অক্লেশে। আর কিছু বিরল সংখ্যক মানুষ অন্যকে বাঁচাবার জন্য নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যও গ্রাহ্য করে না।
ডাক্তার বিনায়ক সেনের সঙ্গে আমার কখনও পরিচয় হয়নি। তাঁকে আমি কখনও চাক্ষুষও দেখিনি। কিন্তু এর মধ্যে আমি তাকে স্বপ্নে দেখেছি দু’বার। স্বপ্নে কত রকম উদ্ভট ঘটনাই তো ঘটে। দু’বারই এই স্বপ্নে আমি দেখেছি, বিনায়ক সেন মিলিয়ে যাচ্ছেন আমার বাবার চেহারার মধ্যে। ধ্যুত, তিনি আমার পিতৃপ্রতিম হবেন কী করে? আমি নিশ্চয়ই বিনায়ক সেনের চেয়ে অনেক বড়।
এমনকী আমি আমার বাবার চেয়েও বয়োজ্যষ্ঠ। বাবা শেষ নিশ্বাস ফেলেছিলেন মাত্র একান্ন বছর বয়সে। সে বয়স আমি কবেই পেরিয়ে এসেছি।
চক্ষুশূল
ইস্টার্ন বাইপাসে কোনও এক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংয়ে প্রায় চব্বিশ পয়েন্টে লেখা আছে ‘উৎকর্ষতা’। সে দিকে চোখ পড়লেই, না রাগ নয়, অনেক কাল রাগ কমে গেছে। এখন মন-খারাপ লাগে। কোনও কোনও সংবাদপত্রে দু’একটি সাহিত্য রচনাতেও ভাষার এই অপব্যবহার চোখে পড়ে।
ইংরেজিতে বানান ভুল কিংবা অপপ্রয়োগ হলেই লজ্জায় আমাদের যেন মাথা কাটা যায়। কিন্তু বাংলায় অশুদ্ধ শব্দের যথেচ্ছাচার চলে। বানানের তো মা-বাপ নেই বলেই মনে হয়। এগুলি নিবারণ করার কি কোনওই উপায় নেই? হোর্ডিংয়ে অশ্লীলতার গন্ধ থাকলেই হইচই হয়। ব্যাকরণের এই ব্যভিচারও কি অশ্লীল নয়?
১২. ১. ২০১১
একেবারে একশো ভাগ সত্যি একটি ঘটনা
কয়েক বছর আগের কথা। কুলু-মানালি থেকে ফিরছি দিল্লিতে, সেখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম একসঙ্গে চার জন মিলে। ফেরার সময় মাত্র তিন জন আর একটি ছোট মাটির পাত্র-ভর্তি ছাই।
সে বারে হিমালয়ের ওই অঞ্চলে বেড়াবার পুরো পরিকল্পনা করেছিল ভাস্কর দত্ত। সে ছিল ক্লাস টু থেকে আমার সারা স্কুলজীবনের বন্ধু, কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর একমাত্র কবিতা না লিখেও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কী খেয়ালে চলে গেল লন্ডন, তার পর সেখানেই কাটিয়ে দিল পঁয়তাল্লিশ বছর। পরের দিকে সে বছরে তিন-চার মাস কাটিয়ে যেত কলকাতায়, আমরা প্রতি বছরই বেড়াতে যেতাম কোথাও না কোথাও, এ দেশে এবং বিদেশেও। অনেক বারই আমাদের সঙ্গী হয়েছে ফরাসি দেশের বন্ধু অসীম রায়, কয়েক বার কানাডার দীপ্তেন্দু চক্রবর্তী। এবং স্বাতী, সে তো যে-কোনও ভ্রমণের নামেই এক পায়ে খাড়া।
এই ভ্রমণে ব্যবস্থাপনার সব দায়িত্ব নিয়েছিল ভাস্কর, এমনকী সান্ধ্য পানাহারের আড্ডার জন্য আলাদা আলাদা প্যাকেটে চানাচুর, কাজুবাদাম, সালামি, এমনকী মুখশুদ্ধি পর্যন্ত। এবং ইনসুলিন ইঞ্জেকশনের সরঞ্জাম। বেশ কয়েক জায়গায় উপভোগ্য ঘোরাঘুরির পর অকস্মাৎ মানালির এক হোটেলে সকালবেলা ভাস্কর খুব স্বার্থপরের মতন শেষ নিশ্বাস ফেলে চলে গেল৷ সে তখনও হাঁটছিল, দু’পাশে আমি আর অসীম। এ রকম মৃত্যুতে যে যায়, সে তো ভালই যায়; যারা থাকে, তাদের এতই দুর্ভোগ শুরু হয় যে শোক অনুভবেরও সময় থাকে না। ভাস্করের ব্রিটিশ পাসপোর্ট, তার দেহ বিলেতে পাঠাতে হবে কি না, লন্ডনে রয়েছে তার স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে, তারাই বা কী চায়, বিহ্বল অবস্থার মধ্যে আমাদের এই সব নিয়েও ব্যস্ত থাকতে হল। যা-ই হোক, ব্রিটিশ হাই কমিশন থেকে জানানো হল যে, এ বিষয়ে পরিবারের মতামত নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। লন্ডন থেকে ভাস্করের স্ত্রী-সন্তানেরাও জানাল, যে প্রচুর ঝঞ্ঝাট করে দেহ পাঠাবার দরকার নেই। আমরা নেমে এলাম মান্ডি শহরে, সেখানে ভাস্করের এক আত্মীয় অতি উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার, তার ব্যবস্থাপনায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভাস্করের দেহ দাহ করা হয়ে গেল। পরদিন সকালে আমরা দিল্লি রওনা হলাম এক মুঠো ছাই নিয়ে।
সুদীর্ঘ পথ, তার মধ্যে অনেকটাই পাহাড়ি রাস্তা, প্রায় দশ ঘণ্টা লেগে যায়। আমরা ফিরছি একটা ভাড়া করা গাড়িতে। সারা পথ আমরা তিন জন প্রায় নিস্তব্ধ, কিছু খেতেও ইচ্ছে করছে না। দু’পাশের মনোরম দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আছি যদিও, কিন্তু কিছুই দেখছি না।
দিল্লি শহরের প্রান্তে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গেল, আমাদের গন্তব্য ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার, সেখানে ঘর সংরক্ষিত আছে। গাড়ির চালকটি পাহাড় অঞ্চলের মানুষ, দিল্লি শহর চেনেন না, আমরাও পথঘাট ঠিক মালুম করতে পারি না। ঘোরাঘুরি করতে করতে কেটে গেল আরও এক ঘণ্টা। তার পর লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে প্রায় পৌঁছলাম উদ্দিষ্ট স্থানের কাছাকাছি। গাড়ি একটা ছোট রাস্তায় ঢুকতে যাচ্ছে, তখনই ঘটল এক মারাত্মক কাণ্ড। একটা মাঝারি আকারের বিড়াল গুটি-গুটি পায়ে রাস্তা পার হয়ে গেল। ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে দিলেন গাড়ি।
বেড়াল বিষয়ে গাড়ির ড্রাইভারদের নানারকম কুসংস্কারের কথা শুনেছি। কিন্তু অবস্থার নিশ্চয়ই কোনও প্রতিকারও থাকবে। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ড্রাইভার সাহেব, কী হবে এখন? তিনি বললেন, বেড়ালটা যদি ফিরে আসে, কিংবা কোনও ব্রাহ্মণ যদি উল্টো দিক দিয়ে এ রাস্তা পার হয়।
বেড়ালটি কী উদ্দেশ্যে রাস্তা পার হয়েছে তা জানি না। তার কখন ফিরে আসার মর্জি হবে, তাও জানার কোনও উপায় নেই। তবে, ওই ব্রাহ্মণের ব্যাপারটা শুনে, আমি জীবনে যা কখনও করিনি, বুক বাজিয়ে নিজের ব্রাহ্মণত্বের পরিচয় দিয়ে বললাম, তা হলে আমি নামছি। আমিই তো ব্রাহ্মণ।
লোকটি অদ্ভুত বিকৃত মুখ করে নিদারুণ অশ্রদ্ধার সঙ্গে বললেন, কেয়া, আপ ব্রামভণ? বাঙালি কভি ব্রাহ্মভণ হোতা হ্যায়? কভি নেহি! ধোঁকা মত দিজিয়ে।
আমার সত্যিই ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম, রীতিমতন উপাধ্যায় পদবি। কৈশোরে অভিভাবকদের নির্বন্ধে আমার উপনয়নও হয়েছিল, ন্যাড়ামাথায় একটা ছোট্ট টিকিও রাখা ছিল, মাসের পর মাস পৈতে হাতে নিয়ে সকাল-সন্ধ্যা গায়ত্রী মন্ত্র জপ করেছি। বছরখানেকের মধ্যে একদিন গঙ্গায় সাঁতার কাটতে গিয়ে পৈতেটা ভেসে যায়। বাড়ির লোকরা নতুন পৈতের জন্য জোরাজুরি করেননি, ওই ব্যাপারটাই চুকে যায়। গায়ত্রী মন্ত্র অবশ্য আজও মুখস্থ আছে।
প্রমাণ দেওয়ার কোনও উপায় নেই, বাঙালিদের সম্পর্কে পাহাড়ি ড্রাইভারের এই মনোভাবের প্রতিবাদ করেই বা কী হবে? গায়ত্রী মন্ত্র বলতে গেলেও সে ড্রাইভারের যে তা বোঝার ক্ষমতা নেই, তা বোঝা যায়।
তা হলে আর কোনও উপায়? একটা সামান্য বিড়ালের জন্য আমাদের এই অসহায় অবস্থা।
ড্রাইভার বলেন, যদি অন্য কোনও লোক কিছু না জেনে এই রাস্তা দিয়ে যায়…
এটাও প্রায় একটা অসম্ভব ব্যাপার। দিল্লির অনেক রাস্তাই জনবিরল, একটু রাত হলে গেলে পায়ে-হাঁটা মানুষ প্রায় দেখাই যায় না।
ড্রাইভারটির কুসংস্কারের তীব্রতা প্রায় বেয়াদপির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে দেখে অসীম একেবারে চুপ। স্বাতী অতি বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠল, তা হলে গাড়ি ঘোরাও, অন্য রাস্তা দিয়েও নিশ্চয়ই যাওয়া যায়।
ড্রাইভার তাতেও রাজি নন। ইঞ্জিন স্টার্ট নিলেই নাকি বিপদ ঘটে যাবে।
কুসংস্কারের এমন তীব্র ঝাঁঝের মুখোমুখি হইনি আগে কখনও। আমাদের মন বিবশ হয়ে আছে, শরীর অত্যন্ত ক্লান্ত, খিদে না পেলেও তৃষ্ণার্ত, কতক্ষণে একটা বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দেব। কিন্তু কোনও উপায় নেই। ড্রাইভারের ওপর প্রচণ্ড রাগ হলেও তাকে ঠেলে সরিয়ে যে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাব, তাও সম্ভব নয়, কারণ তাতে আমাদের ভদ্রতায় বাধে। গাড়ি থেকে যে নেমে পড়ব, গন্তব্য হাঁটাপথের দূরত্ব নয়। তা ছাড়া, সঙ্গের মালপত্র বহন করে নিয়ে যাবার ক্ষমতা নেই, ফেলে রেখে যাওয়াও চলে না ভরসা করে।
নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম তিন জন। এই হচ্ছে সেই রকম সময়, যখন প্রতি মুহূর্তকে মনে হয় অনন্ত কাল। খালি মনে হতে লাগল, এই সময় ভাস্কর সশরীরে উপস্থিত থাকলে কী ব্যবস্থা নিত। কেউ যদি না আসে, তবে কি সারা রাত আমাদের এই অবস্থায় থাকতে হবে?
কতক্ষণ পর জানি না, দেবদূতের মতন এসে গেল আমাদের উদ্ধারকর্তা। দূর থেকে গান গাইতে গাইতে আসছে এক জন। এলোমেলো পদক্ষেপ দেখে বোঝা যায়, সে বেশ রসস্থ হয়ে আছে। নির্ঘাত সে বলরামের চ্যালা। তাকে কাছাকাছি দেখেই গাড়িতে স্টার্ট দিলেন ড্রাইভার।
এই ঘটনা একেবারে পুরোপুরি একশো ভাগ সত্যি। এত দিন পর আবার মনে পড়ল, তার কারণ, সম্প্রতি অসীম ও দীপ্তেন্দুর সঙ্গে আমি ও স্বাতী পাঁচ দিন ধরে গাড়িতে ঘোরাঘুরি করলাম। কলকাতা থেকে বহরমপুর, সেখান থেকে শান্তিনিকেতন, তার পর দুর্গাপুর, পরের দিন আসানসোল। বিভিন্ন গাড়ি, বিভিন্ন চালক। গ্রামবাংলার পথে অন্তত তিন বার রাস্তায় বেড়াল পার হতে দেখেছি, কোনও ড্রাইভারই তাতে ভ্রুক্ষেপও করেননি। বাঙালিদের মধ্যে খাঁটি ব্রাহ্মণ না থাকতে পারে, বাঙালিরা বিড়াল-ভীতি অন্তত জয় করতে পেরেছে।
গায়ত্রী মন্ত্র
আমাদের ছেলেবেলায় শুনতাম, গায়ত্রী মন্ত্র অতি পবিত্র। একমাত্র ব্রাহ্মণদেরই আছে এই মন্ত্রে অধিকার। অব্রাহ্মণদের কাছে এই মন্ত্র প্রকাশ করাও পাপ। তখন মানে বুঝতাম না। এখন বুঝি সেটা ছিল পুরুতদের ধাপ্পা কিংবা অজ্ঞতার ফল। ওটা তো সূর্যস্তব মাত্র, মন্ত্রও নয়, শ্লোক। ওর মধ্যে গোপনীয়তার কী আছে? এখন তো ওই শ্লোক নিয়ে ঝিং-চ্যাক গানও হয়ে গেছে, যা সবাই শুনতে পারে।
তিন বাঁড়ুজ্যে এবং
বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাঁড়ুজ্যে সম্বোধন বাংলা প্রথাসম্মত। কিন্তু বাঙালি লেখকদের পদবি চ্যাটার্জি, ব্যানার্জি, মুখার্জি এমনকী গাঙ্গুলি লেখাও দৃষ্টিকটু, কেমন যেন সাহেব-সাহেব ভাব। এই সব পদবির আগে মিস্টার না দিলে ভাল শোনায় না। অফিস-টফিসে চলে, কিন্তু সাহিত্যে এখনও বেমানান।
বাংলা সাহিত্যের তিন দিকপাল— তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ এবং মানিক, এঁরা তিন বাঁড়ুজ্যে নামেও পরিচিত। এঁদের মধ্যে তারাশঙ্কর ছাড়া আর দু’জন কখনও নাটক লেখেননি, তবু ‘অন্য থিয়েটার’ নাট্য সংস্থা একত্রিশে ডিসেম্বর নাট্যস্বপ্নপ্রকল্প নামে সারা রাত ধরে যে অনুষ্ঠান করে, তার এ বারের বিষয়বস্তু ওই তিন বাঁড়ুজ্যে। ওঁদের সম্পর্কে বক্তৃতার ব্যবস্থা, ওঁদের রচনার নাট্যরূপ উপস্থাপনা। খুবই আকর্ষণীয় ব্যাপার।
এই উপলক্ষে ‘তিন বাঁড়ুজ্যে’ নামে যে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বিভাস চক্রবর্তী লিখেছেন, নোবেল পুরস্কার পাবার পূর্ণমাত্রায় যোগ্যতা ছিল এঁদের। একেবারে ঠিক কথা। এটা পড়ে আমার এক অতি প্রিয় লেখকের নাম যোগ করতে ইচ্ছে হল। যখনই আমি কোনও নোবেল পুরস্কার পাওয়া লেখকের বই পড়ি, তখনই আমার মনে পড়ে সতীনাথ ভাদুড়ীর কথা। তার ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’-এর তুল্য বই ভূ-ভারতে এ কালে আর কেউ লিখতে পেরেছেন কি? বহুকাল আগে তুলসীদাস লিখেছিলেন ‘রামচরিত মানস’।
২৬. ১. ২০১১
জেলখানার অভ্যন্তরে এক সন্ধ্যায়
ধরা যাক, আমি একটা জেলখানার মধ্যে আছি। উঁচু পাঁচিল তোলা আলিপুর সেন্ট্রাল জেল। নানা কারণেই তো মানুষ জেলে যেতে পারে।
কারাগারের এখন আর এক নাম সংশোধনাগার। পাপকে ঘৃণা করো, কিন্তু পাপীকে নয়— এই আপ্তবাক্য অনুসারে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের এখন নানা ধরনের শিক্ষা ও নিজস্ব গুণাবলি প্রকাশের সুযোগ দিয়ে তাদের সুপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে। বন্দিদের জীবন কিছুটা সুসহ করার জন্য এখন জেলখানার ভেতরটা অনেক খোলামেলা করা হয়েছে, এমনকী এ কথাও জানা গেল যে, কোন রাজ্যের জেলে যেন ছোট ছোট কুঁড়েঘর বানিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে বসবাসেরও ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। কারাবাস যদি এমন আরামদায়কই হয়, তা শুনে মনে একটা কু-চিন্তাও জাগে। তা হলে তো কোনও এক দিন আমার মতন এক জন সাধারণ মানুষও রাস্তায় বেরিয়ে, যার ওপর রাগ আছে এমন এক জন মানুষের পিঠে হালকা ভাবে (যাতে সে মরে না যায়) একটা ছুরি বসিয়ে দিতেই পারে, যাতে দু-একটা বছর দিব্যি সরকারি খরচে জেলের অভ্যন্তরে ছুটি কাটিয়ে আসা যায়।
না, ঠাট্টা-ইয়ার্কির বিষয় নয়। সংশোধন আগারগুলিতে সত্যিই অনেক ভাল কাজ হচ্ছে। কিছু পেশাদার খুনি আর অসংশোধনীয় বদ চরিত্রদের কথা বাদ দিলে, অধিকাংশ অপরাধীই একটা কুকীর্তি করে ফেলে তাৎক্ষণিক ঝোঁকের মাথায় কিংবা ক্রোধ নামে দ্বিতীয় রিপুর বশে। পরে কৃতকর্মের জন্য তাদের সাজা পেতেই হয়, কিন্তু তার মধ্যেই যদি তাদের অন্তর্গত গুণপনা প্রকাশের সুযোগ দেওয়া হয়, তা হলে তারা মুক্তি পাওয়ার পর সুস্থ নাগরিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। দেখা গেছে, তাদের কেউ কেউ ভাল ছবি আঁকে বা মূর্তি গড়ে, গান গায়, ভাল করে শেখালে শিল্পসম্মত নাটকে অভিনয়ও করে। অলকানন্দা রায়ের উদ্যোগে ও প্রযোজনায় কয়েদিদের ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’ বহু প্রশংসিত হয়েছে।
এবং কেউ কেউ গল্প-কবিতাও রচনা করতে পারে। সেগুলির সাহিত্যমূল্য কতখানি, সে বিচারের চেয়েও বড় কথা, ভাষার মাধ্যমে তাদের আত্মপ্রকাশের স্পৃহা। যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন। এই সব অপটু হাতের রচনাগুলির মধ্যে হঠাৎ কোনও কালজয়ী সৃষ্টির সন্ধান পাওয়া খুব আশ্চর্যের কিছু নয়। তেমন দৃষ্টান্তও আছে। ফরাসি দেশে জ্যঁ জেনে নামে এক যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত, কুখ্যাত কয়েদি এমন একটা উপন্যাস লিখে ফেলেন (আওয়ার লেডি অব দা ফ্লাওয়ার্স), যা গোপনে বাইরে পাচার হওয়ার পর ছাপা হলে ফরাসি সাহিত্যে বিপুল আলোড়ন হয়। জ্যঁ পল সার্ত্র এবং অন্যান্য অনেক লেখক ও চিন্তাবিদ সরকারের কাছে এই বন্দির মুক্তির জন্য আবেদন করেন। সার্ত্র এই অসাধারণ লেখকটিকে ‘সন্ত জেনে’ আখ্যা দিয়ে একটা বইও লিখে ফেলেন। মুক্তি পাওয়ার পর জ্যঁ জেনে আরও অনেক নাটক ও উপন্যাস লিখে ফরাসি সাহিত্যে স্থায়ী আসন পেয়ে যান।
আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে কয়েদিদের রচনা নিয়ে একটি পত্রিকাও প্রকাশিত হচ্ছে। সেই পত্রিকার উদ্বোধন উপলক্ষে জেলের অভ্যন্তরেই এক সভা। সেখানে উপস্থিত কারামন্ত্রী থেকে শুরু করে আরও দু’চারটি লেখক, শিল্পী, গায়ক এমনকী ইয়ান জ্যাক নামে এক সাহেব লেখক পর্যন্ত। সবাই বক্তৃতায় ভাল ভাল কথা বলছেন, সেটাই স্বাভাবিক। তারই মধ্যে একটি ছোট্ট ঘটনা উপলক্ষেই এই রচনা।
লম্বা হলঘর, শ্রোতারা সবাই এই জেলখানার অধিবাসী। তাদের মধ্যে এক জন, বিশিষ্টদের বক্তৃতার মাঝখানে হাত তুলে বলল, সেও কিছু বলতে চায়। গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী তাকেও ডাকা হল মঞ্চে। সেই মুসলমান যুবকটি মাইকের সামনে এসে গভীর অভিমানের সুরে বলল যে, তিন বছর ধরে সে বিনা বিচারে বন্দি হয়ে আছে। তার কী অপরাধ, কিংবা কত দিন শাস্তি হবে সে জানে না। যত বারই তার কেস ওঠে, তত বার জানা যায়, ম্যাজিস্ট্রেট অনুপস্থিত, আবার একটা ডেট পড়ে। এই তিন বছরে তার বাড়ির লোকজন চরম দুর্দশার মধ্যে রয়েছে। ‘আমাকে আর কত দিন এই অবস্থায় থাকতে হবে?’
সবাই চুপ! কে উত্তর দেবে? কারামন্ত্রীরও এক্তিয়ারের মধ্যে এটা পড়ে না। হায় গণতন্ত্র!
অসমাপ্ত বাঙালির ইতিহাস
‘বাঙালির ইতিহাস, আদি পর্ব’ একখানি অতি মূল্যবান গ্রন্থ। পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাস, অথচ সুখপাঠ্য। বাংলা ভাষার সম্পদ। কিন্তু আফশোসের বিষয় এই যে, নীহাররঞ্জন রায় শুধু আদিপর্ব রচনা করেছেন, পরবর্তী পর্ব আর লেখেননি৷
বেশ কিছু বছর আগে, এক ভোজসভায় নীহাররঞ্জন রায়ের একেবারে মুখোমুখি পড়ে গিয়ে এক খুদে লেখক বিনীত ভাবে অনুযোগ করেছিল, আপনি আদি পর্বের পর আর কিছু লিখলেন না কেন? বেশ রাশভারী ব্যক্তিত্ব ছিল নীহাররঞ্জনের, কিন্তু তিনি এক সামান্য লেখকের প্রশ্ন নস্যাৎ করে দিলেন না। সস্নেহে বললেন, ব্যাপার কী জানো, এক সময় আমি রাজনৈতিক কারণে জেল খেটেছি, তখন হাতে অনেক সময় ছিল, বইপত্রও পাওয়া যেত, তখনই ওই বইয়ের অনেকখানি লিখে ফেলেছিলাম। তার পর বাইরে বেরিয়ে এসে অন্যান্য কাজে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে আর ও-বিষয়ে লেখার সময় পাইনি।
অসীম সাহস সঞ্চয় করে খুদে লেখকটি তৎক্ষণাৎ বলে ফেলল, তা হলে তো আপনাকে এক্ষুনি আবার জেলে ভরে দেওয়া উচিত, তাতে বাংলা সাহিত্যের অশেষ উপকার হবে।
বলাই বাহুল্য, সে ছোকরার এই প্রস্তাবে কেউ কর্ণপাত করেনি। সে কারণে বাংলা তার বাকি ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হয়ে গেল।
বই উদ্বোধন অনুষ্ঠান
আজকাল সারা বছর ধরেই বই উদ্বোধন অনুষ্ঠান হয়। হল ভাড়া করে, কিংবা কোনও প্রকাশ্য জায়গায় চেয়ার-টেবিল পেতে, একটা নতুন বই রাংতায় মুড়ে, ফিতে বেঁধে দেওয়া হয় উদ্বোধকের হাতে। তিনি ফিতের গিঁট খুলতে গিয়ে উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েন, কিংবা রাংতাটা সহজে ছিঁড়তে চায় না। যা-ই হোক, আবরণমুক্ত সেই বই উদ্বোধক হাসি-হাসি মুখে উঁচুতে তুলে ধরেন, সামনের কিছু লোক হাততালি দেয়। শুধু উদ্বোধকই নন, আরও দু’তিন জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকেও টেনে-হিঁচড়ে এনে বসানো হয় মঞ্চের ওপর। কেউই বইটি আগে দেখেননি, তবু সেই বই ও লেখক সম্পর্কে অনেক সুধা-বাক্য উচ্চারণ করেন, তাতে লেখক বা উক্ত বইটির কী উপকার হয়, তার কোনও পরিসংখ্যান নেই অবশ্য।
একটি স্মরণীয় বই-উদ্বোধন অনুষ্ঠানের ছোট্ট স্মৃতিকথা এখানে লিপিবদ্ধ করে রাখতে চাই। সত্যজিৎ রায়ের ‘আওয়ার ফিলম্স, দেয়ার ফিলম্স’ নামের বইটির উদ্বোধন অনুষ্ঠান হয়েছিল প্রচুর জনসমাগমে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে৷ উদ্বোধক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, প্রধান অতিথি নীহাররঞ্জন রায়। নীহাররঞ্জন চোস্ত ইংরেজিতে অতিশয় সারগর্ভ বক্তৃতা দিলেন। উদ্বোধক সুনীতিকুমার বাংলায় বললেন, তিনি বইটি আগে পড়েননি, তবে উদ্বোধকরা সবজান্তা হন, তাঁরা যে-কোনও বিষয়ে বক্তৃতা দিতে পারেন। বইটি সিনেমা বিষয়ে, তিনি সারাজীবনে আঙুলে গোনা কয়েকটি মাত্র সিনেমা দেখেছেন এবং শ্রীমান সত্যজিতের একটাও সিনেমা তাঁর দেখা হয়ে ওঠেনি। তাঁর অনেক সুখ্যাতি শুনেছেন। তবে, সত্যজিতের বাবা সুকুমার রায় তার বন্ধু ছিলেন, সেই হিসেবে এখানে বক্তৃতা দেওয়ার যোগ্যতা তাঁর অবশ্যই আছে, সুকুমার রায় বিষয়ে তিনি অনেক কিছু বলতে পারবেন!
বেঁচে রয়েছি অনেক দিন
ভালোবেসেছি কম
আরও ভালোবাসার আগে
ডাকে না যেন যম…
…যমকে ডেকে বলি, ওহে
শুনতে পাচ্ছো যম
কবিতা লেখার জন্য একটা
জীবন বড্ড কম।
প্রবাসী লেখিকা তনুশ্রী ভট্টাচার্যের কাব্যগ্রন্থ ‘ঈশ্বরীর সমান সমান’ থেকে উদ্ধৃত
৯. ২. ২০১১
‘সবাই আমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে শপথ নিন’
জীবনে আমি অনেক বক্তৃতা শুনেছি, বেশ কিছু শুনতে বাধ্যও হয়েছি। কিন্তু এমন অভিনব, মর্মস্পর্শী ও মজার বক্তৃতা জীবনে শুনিনি। শোনার পর থেকেই সে অভিজ্ঞতা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য ছটফট করছি।
বক্তা একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী। ভারতের যে কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি, ইনি তাঁদের মধ্যে এক জন। এবং একই সঙ্গে একজন কবি, কবিতার বই আছে। এবং এ দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম।
দিল্লির সাহিত্য অকাদেমির সম্বৎসর বক্তৃতায় তিনিই একমাত্র বক্তা। মঞ্চের ওপর সেই পরিচিত মূর্তি। সাত জন্মে মাথার চুল আঁচড়ান না মনে হয়, পোশাকের পারিপাট্য নেই, কখনও টাই পরেন না। এমনই ভাবভঙ্গি যে, অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড প্রফেসরের কথা মনে পড়ে। বক্তৃতা দেওয়ার আহ্বান জানাবার আগেই তিনি উঠে আসছেন পোডিয়ামের কাছে। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে একজন যখন তাঁর পরিচয় জানাতে গিয়ে নানাবিধ গুণাবলির উল্লেখ করছেন, তখন মাঝে মাঝে হাততালি দিয়ে উঠছেন দর্শকরা, তিনিও একবার হাততালি দিয়ে ফেলে বিহ্বলভাবে তাকাচ্ছেন এ দিক ও দিক!
বক্তৃতার বিষয় হচ্ছে, জ্ঞানের বিশ্বে ভ্রমণ। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও সাহিত্য ও দর্শনের কী কী বই তাঁকে প্রভাবিত করেছে সারা জীবন, সেই কথা বলতে লাগলেন। তাঁর মতে, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেডিক্যাল কলেজেও ভাল ভাল সাহিত্যের বই রাখা উচিত। ছাত্রজীবনের একটা অভিজ্ঞতার কথাও বললেন, যখন তিনি চেন্নাইতে ম্যাড্রাস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি-র দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, থাকেন হস্টেলে, তখন এক গ্রীষ্মে তাঁদের দেশের বাড়ি রামেশ্বরমে তুমুল ঝড়-বৃষ্টিতে অনেক বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যায়। তাঁর বাবা-মা আছেন সেখানে, তাঁদের কোনও বিপদ হয়েছে কি না সেই উদ্বেগে কালাম তখনই সেখানে যেতে চাইলেন। কিন্তু মাসের শেষ, হাতে একেবারে পয়সা নেই। গাড়িভাড়াই বা জোটাবেন কোথা থেকে? সোজা চলে এলেন মুর মার্কেটে। সেখানে একটা দোকানে নতুন ও পুরনো বই কেনাবেচা হয়। সে দোকানে এসে তিনি একখানা বই বিক্রি করার চেষ্টা করলেন, বইখানির নাম ‘দা থিয়োরি অব ইলাসটিসিটি’। তিনি রেকর্ড নম্বর পেয়েছিলেন বলে এম আই টি-র অধ্যক্ষ তাঁকে বইটি উপহার দিয়েছেন। দামি বই। সেই পঞ্চাশের দশকেই চারশো টাকা। কালামের রামেশ্বরম যেতে ষাট টাকা লাগবে, তা পেলেই তিনি বইটি বিক্রি করে দিতে রাজি। দোকানের মালিক মাথায় টিকিওয়ালা এক প্রৌঢ় ব্রাহ্মণ। তিনি বইটা নেড়েচেড়ে দেখে বললেন, এ রকম পুরস্কার পাওয়া এত মূল্যবান বই তুমি বিক্রি করছ কেন? এ বই আমি কিনতে পারব না। তার পর কালামের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আবার বললেন, তোমার যখন এতই টাকার দরকার, আমি তোমাকে ষাট টাকা দিচ্ছি। পরে কোনও এক সময় টাকাটা জোগাড় করে আমাকে দিয়ে বইটা ফেরত নিয়ে যেও। কালাম বললেন, তিনি সারা জীবনেও সেই ব্যক্তিটির মুখ ভুলতে পারেন না।
বইয়ের কথা বলতে বলতে হঠাৎ তিনি বলতে শুরু করলেন একটা অর্জুন গাছের কথা। তাঁর দিল্লির বাড়ির বাগানে দণ্ডায়মান এই গাছটির বয়েস একশো বছরেরও বেশি, কালামের বাবাও একশো তিন বছর বেঁচেছিলেন। শত শত ডালপালা ছড়ানো সেই বিশাল অর্জুন গাছটির সঙ্গে মাঝে মাঝেই তাঁর নানান কথাবার্তা হয় বন্ধুর মতন। গাছ তাঁর অনেক প্রশ্নের উত্তর দেন।
এ সব তো আছেই, তাঁর বক্তৃতার আসল মজা অন্য। তাঁর বক্তব্য শুনতে শুনতে শ্রোতারা এক-এক জায়গায় যেই হাততালি দিচ্ছে, অমনি তিনি বলছেন, কী, এটা ভাল লেগেছে? তা হলে আমি যা বলছি, আমার সঙ্গে সঙ্গে গলা মিলিয়ে সবাই শপথ নাও। বলো, ‘আজ থেকে আমি’…। শ্রোতারা সমস্বরে বলল, আজ থেকে আমি…। ‘এই শপথ করছি যে,’ শ্রোতারাও, এই শপথ করছি যে…। ঠিক বাচ্চাদের নামতা পড়াবার মতন।
শেষ শপথটির কথা না বললেই নয়। সেটা এ রকম:
১) আজ থেকে আমার বাড়িতে অন্তত ২০টি বই নিয়ে একটা লাইব্রেরি চালু করব, যার মধ্যে দশটি বই থাকবে বাচ্চাদের জন্য।
২) আমার মেয়ে আর ছেলে বাড়ির সেই লাইব্রেরির বইয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে ফেলবে অন্তত ২০০টি।
৩) আমার নাতি-নাতনিরা সেই বইয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে ফেলবে অন্তত দু’হাজারে।
৪) আমাদের বাড়ির লাইব্রেরিটিই হবে আমাদের পরিবারের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তি।
৫) আমরা পরিবারের সবাই মিলে সেই লাইব্রেরিতে প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা সময় কাটাব!
কালাম আরও জানালেন যে, তামিলনাড়ুর এক বইমেলায় তিনি প্রায় দু’লক্ষ মানুষের এক সমাবেশে শ্রোতাদের এই শপথ পাঠ করিয়েছিলেন। তার পর অনেকেই তক্ষুনি একসঙ্গে কুড়িখানা বই কেনার জন্য ছুটে যায়। বইমেলার অনেক দোকানই খালি হয়ে গেল এর ফলে।
পর দিন দিল্লির বড় বড় সংবাদপত্রের, যাদের বলা হয় ন্যাশনাল নিউজপেপার, কোনওটিতেই এই বক্তৃতার একটি লাইনেরও উল্লেখ আমি দেখিনি। খুনোখুনি, ধর্ষণ, ঘুষ-কেলেঙ্কারি, রাজনৈতিক দলগুলির ঘেষাঘেষি বা লম্বা-লম্বা আত্মপ্রচার, এই সব দরকারি খবরেই সংবাদপত্রগুলির সব পৃষ্ঠা খরচ হয়ে যায়। যে-কোনও প্রাক্তন, এমনকী রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত, তাঁদের বক্তব্য নিয়ে সংবাদমাধ্যম মোটেই মাথা ঘামাতে রাজি নয়।
আকাঙক্ষা ও শিহরন
এই দুটি শব্দ নিয়ে বেশ মুশকিলে পড়েছি। আমাদের শিক্ষা-সংস্কার অনুযায়ী আকাঙ্ক্ষা কিংবা শিহরন দেখলে ভুরু কুঁচকে যাবেই। অথচ এ রকমই তো চলেছে যত্রতত্র। আজকাল প্রুফ পাঠক নামে সম্প্রদায়টি প্রায় বিলীয়মান। অথচ কম্পিউটারও সব বানান জানে না। এই সরলীকরণের যুগে ঙ্ক্ষ-এর মতন তিনতলা শব্দ অনেকেই পছন্দ করতে পারে না। আর শিহরন-এর যে রোমাঞ্চ তা মাত্রাহীন শিহরণ হলেই যেন ভাল হয়। অনেকে ভাবে র-এর পর ণ হওয়াই তো ব্যাকরণ সম্মত। কিন্তু ব্যাকরণে ব্যতিক্রম বলেও একটা কথা আছে, তা-ও মনে রাখতে হয়।
তবে, ব্যতিক্রমেরও তো ব্যতিক্রম থাকে। আকাঙ্ক্ষাকে আকাংখা হিসেবে মেনে নিলেই বা ক্ষতি কী? শিহরনও হোক না শিহরণ। অত খুঁতখুঁতুনি না থাকাই ভাল। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, পবিত্র সরকার, সুভাষ ভট্টাচার্য এবং অশোক মুখোপাধ্যায় প্রমুখরা কী বলেন?
এবং জঙ্ঘা
‘তোমার জঙ্ঘায় রাখি চুম্বনের ফুল’, কিংবা মাখনের মতন জঙঘা আঙুলের স্পর্শে জেগে থাকে’ এই ধরনের কবিতার লাইন দেখলে খটকা লাগে। কবিদ্বয় এখানে কি জঙ্ঘা বলতে ঊরু বোঝাতে চাইছেন? জঙ্ঘা শব্দের একমাত্র অর্থ জানু অর্থাৎ হাঁটু থেকে গুল্ফ পর্যন্ত পায়ের অংশ। সেই অংশটা কি চুম্বনের উপযুক্ত স্থান? পদতলে চুম্বনের কবিপ্রসিদ্ধি আছে। নারীর উরুর সঙ্গে মাখনের উপমা দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু মাঝখানের হাঁটু? হাঁটু থেকে গুল্ফ এই অবয়বটুকু কাব্যে উপেক্ষিতই বলা যায়। অথচ শব্দটি কাব্যময়। কাঞ্চনজঙ্ঘা শব্দটির প্রকৃত উৎস যা-ই হোক, বাংলায় শ্রুতিমধুর এই শব্দটিকে পাহাড়ের গোড়ালি থেকে হাঁটু পর্যন্ত বলে মেনে নিতে মন চায় না। তবু, কবিদের যতই আবদার থাক, জঙ্ঘার অর্থ বিস্তার ঘটলে কি হাঁটু থেকে আরও ওপর পর্যন্ত টেনে তোলা সম্ভব হবে?
২৩. ২. ২০১১