বিবেক মানে কী? তা কি কোনও বায়বীয় বস্তু?
সম্প্রতি গুয়াহাটিতে একটি অতি কুৎসিত ঘটনা ঘটেছে। তখন বেশি রাত নয়, মাত্র সাড়ে ন’টা, রাস্তায় লোকজনের চলাচল থামেনি, তারই মধ্যে একটি দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীকে যৌন অত্যাচার শুরু করে গুটি কয়েক পেঁচি মাতাল। পথচারীরা দাঁড়িয়ে পড়ে সেই দৃশ্য দেখে, আরও কয়েক লক্ষ মানুষ সেই বাস্তব দৃশ্যটি দেখতে পায় টিভি-র সম্প্রচারে, প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে। সাধারণত এ-ধরনের ছবি প্রায়ই দেখা যায় ইদানীংকার অনেক সিনেমায়, বলাই বাহুল্য সে সব সাজানো। এ ঘটনা দেখানো হয়েছে, যাকে বলে ‘লাইভ’, অত্যাচারিত মেয়েটির মুখ স্পষ্ট, সে কোন স্কুলে পড়ে, তার নাম, এ সবও জানানো হয়েছে। কি করে তা সম্ভব হল? সেখানে দৈবাৎ উপস্থিত ছিলেন একজন দক্ষ ফোটোগ্রাফার, তিনি ভিডিয়ো ক্যামেরায় পুরো দৃশ্যটি তুলে রাখেন, যাতে ওই সব নিপীড়নকারীর বাঁদারামি এবং মেয়েটির অসহায় কান্না আর বাঁচার চেষ্টা, সবই ফুটে ওঠে নিপুণ ভাবে। একজন ফোটোগ্রাফারের পক্ষে এটা খুবই কৃতিত্বের ব্যাপার। নিউজ ফোটোগ্রাফি হিসেবে খুবই বিরল দৃষ্টান্ত। তবু এই ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে হইচই শুরু হয়, ক্যামেরাম্যানটির পক্ষে আর বিপক্ষে শুরু হয় তর্কাতর্কি। ক্যামেরাম্যানটির বক্তব্য ছিল এই যে, এই ছবি থেকে অত্যাচারীদের মুখ চেনা অনেক সহজ হবে, তাদের শাস্তির পথও সুগম হবে। অন্য পক্ষের বক্তব্য, একজন ক্যামেরাম্যান তো শুধুই ফোটো-জার্নালিস্ট নন, তিনি তো একজন দায়িত্বশীল নাগরিকও বটে। ততক্ষণ ধরে ওই ছবি তোলায় ব্যস্ত না থেকে, তিনি কি মেয়েটিকে বাঁচাবার কিছু চেষ্টাও করতে পারতেন না? তিনি তো একা ছিলেন না, সেখানে অন্যান্য দর্শকও উপস্থিত ছিলেন।
এই উপলক্ষে আমার মনে পড়ল আর একটি ঘটনা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জাপানে। সে দেশের অর্থমন্ত্রী এক দিন তাঁর এক বান্ধবীকে নিয়ে লাঞ্চ খেতে এসেছিলেন এক নামকরা রেস্তোরাঁয়। সে সব দিনে পৃথিবীর কোনও দেশেই মন্ত্রী বা সরকারি ক্ষমতাবানদের জন্য এত নিরাপত্তা ব্যবস্থার বাহুল্য ছিল না। তাঁরা অনেক স্বাধীন ভাবে রাস্তাঘাটে বেরুতে পারতেন। সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে নাইট শো-এ সিনেমা দেখার পর পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছেন, এ দৃশ্যও তো আমরা দেখেছি। যাই হোক, সে দিন সেই রেস্তোরাঁয় অকস্মাৎ দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল খোলা তলোয়ার হাতে এক আততায়ী। সে সোজা দৌড়ে এসে অর্থমন্ত্রীর পেটে তলোয়ার ঢুকিয়ে দিল। সেই গমগমে আহারালয়ে অন্য সবাই ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল। অর্থমন্ত্রীর পাশের টেবিলেই বসে ছিলেন এক বিখ্যাত সংবাদপত্রের ফোটোগ্রাফার, তিনিও আততায়ীটি ঢোকার সময়ই দেখতে পেয়েছিলেন, ইনস্টিঙ্কট-এর বশেই ক্যামেরা হাতে নিয়ে তিনি তুলে ফেললেন সেই হত্যাদৃশ্য।
এই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য দেশের সমস্ত সংবাদমাধ্যমের শিরোমণিদের সুপারিশে সেই ফোটোগ্রাফারকে দেওয়া হয় বছরের শ্রেষ্ঠ ফোটো জার্নালিস্টের সম্মান। এবং আগামী দু’বছরের জন্য কোনও পত্র-পত্রিকায় তাঁর ছবি নিষিদ্ধ হয়ে যায় এই শাস্তি। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, ছবি তোলার বদলে ফোটোগ্রাফারটি যদি তাঁর ক্যামেরাটি ছুড়ে দিতেন সেই আততায়ীর দিকে, তা হলেও হয়তো সেই অর্থমন্ত্রীর প্রাণ বাঁচানো যেত।
আর একটি ঘটনাও জেনেছিল পৃথিবীর সব দেশের মানুষ। প্রায় দু’দশক আগের কথা। সেটা আবার মনে করিয়ে দিলেন শ্রীমতী অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায় নামে এক সাংবাদিক। আমেরিকার বিখ্যাত ফোটোগ্রাফার কেভিন কার্টার গিয়েছিলেন সুদান। এই দুর্ভাগা দেশটায় যে কত কাল ধরে দুর্ভিক্ষের মতন অবস্থা আর আত্ম-হানাহানি চলছে তার ঠিক নেই, প্রতি বছরই এর জন্য বহু মানুষ মরে।
মাঠের মধ্যে পড়ে আছে একটি কঙ্কালসার শিশু। অনাহারে, অবহেলায় সে প্রায় মুমূর্ষ। আকাশে উড়ছে অনেক শকুন। শকুনরা সাধারণত মৃত প্রাণীদের মাংস খায়, এই শকুনগুলো কি ছেলেটির মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করবে ধৈর্য ধরে, না কি নেমে আসবে আগেই? অদূরে একটা ঝোপের মধ্যে ক্যামেরা বাগিয়ে অপেক্ষা করছেন কেভিন কার্টার। অনেক সময় কোনও বিরল দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করার জন্য ফোটোগ্রাফারদের অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এমনকী দিনের পর দিন।
বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে আকাশ থেকে নেমে এল কয়েকটা শকুন, গুটি গুটি পায়ে তারা এগোল শিশুটির দিকে। সে তখনও বেঁচে আছে।
শকুনরা এক জীবন্ত শিশুর মাংস খুবলে খুবলে খাচ্ছে, এ রকম ছবি আগে কে দেখেছে? এই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য কেভিন পান পুলিৎজার পুরস্কার। তবু বহু মানুষের প্রশ্নের বাণ বিদ্ধ করেছে তাঁকে। তিনি কি শুধুই একজন ফোটোগ্রাফার? একজন বিবেকসম্পন্ন মানুষ নন? ছবি তোলার বদলে ছেলেটিকে তুলে, কিছুটা স্নেহ, কিছুটা সেবা, কিছু খাদ্য ও ওষুধের ব্যবস্থা করলে সে হয়তো বেঁচে যেত। মানবিকতা সেটা দাবি করে। সম্ভবত সেই সব প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত হয়েই কেভিন আত্মহত্যা করেন এক বছর পর।
এই পর্যন্ত লিখে হঠাৎ আমার মনেও একটা প্রশ্ন জাগল, এই রে, আমাদের এখানকার বহু সংবাদ-ফোটোগ্রাফার আছেন। কেউ যদি হঠাৎ আমার এই লেখাটি পড়ে ফেলেন, তা হলে কি মনে করবেন যে আমি ফোটোগ্রাফার প্রজাতিকে হেয় করার জন্যই এ সব লিখছি? তা কিন্তু মোটেই ঠিক নয়। এটা একেবারেই সত্যি। আমি যত জন সংবাদ-ফোটোগ্রাফারের কাজকর্ম দেখেছি কিংবা ব্যক্তিগত ভাবে চিনি, তাঁদের কারওর মধ্যেই মানবিকতার বিন্দুমাত্র অভাব দেখিনি। বরং বেশ কয়েক জনই কিছু কিছু সেবার কাজেও যুক্ত। আমাকে আসলে জ্বালাতন করছে ‘বিবেক’ শব্দটি।
বিবেক জিনিসটা ঠিক কী? ইংরাজিতে বলে, কনশ্যেন্স, সেটারও স্পষ্ট কোনও সংজ্ঞা নেই। মানুষে-মানুষে কি এই বিবেক বোধ আলাদা হতে পারে? আমরা যৌবনবেলায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের একটা লাইন আউড়ে বেশ আনন্দ পেতাম। ‘শরীর, শরীর, তোমার মন নাই কুসুম?’ বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি হয় যে, শরীরের বাস্তবতা বড্ড বেশি প্রকট, আর মন খানিকটা উড়ু-উড়ু ব্যাপার। সেই মন আর বিবেক বোধ কি এক হতে পারে? কিংবা বিবেক কি শুধু মঙ্গলচিন্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত? একেবারে বিবেকবর্জিত কোনও মানুষ টিকে থাকতে পারে? যে সব মানুষ বা রাজনৈতিক দলের নেতা ট্রেন লাইন উড়িয়ে দিয়ে বহু নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলতে চায়, তাদের কারও কি বিবেক নামে বায়বীয় বস্তুটির কোনও অস্তিত্ব থাকে না? এই শব্দটি নিয়ে আরও চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।
‘নুন চা’ এবং পাহাড় অঞ্চলে বাংলা
‘নুন চা’ নামে বিমল লামা রচিত একটি ছোট উপন্যাস আমিও পড়েছি, আর সেই লেখকের সঙ্গে কথাবার্তাও বলেছি। লেখাটি আমায় খুবই আকৃষ্ট করেছে। নেপালি ভাষাতেও এ রকম কোনও গ্রন্থ রচিত হলে তা আমাদের গর্বের বিষয় হতে পারে। উপন্যাসটির ভাষা ও চরিত্রের রেখাচিত্রগুলির সংলাপ এমনই নিপুণ যে, আমার মনে এখনও একটা খটকা রয়ে গেছে, লেখক কি সত্যিই আমাদের পাহাড় অঞ্চলের নেপালি, না কি কোনও বাঙালি লেখকের ছদ্মনাম?
এ বিষয়ে আমার চেয়ে অনেক ভাল বুঝবেন দেবেশ রায়। তাঁর বসতবাটি ওই অঞ্চলেই এবং গোটা উত্তরবঙ্গ সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা দীর্ঘ দিনের। তাঁর অনেক উপন্যাসে তা প্রতিফলিত হয়েছে। তিস্তাপারের বৃত্তান্ত এখন ক্লাসিকের পর্যায়ভুক্ত। দেবেশ রায় আমার অনেক কালের পরিচিত এবং বন্ধু। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ পরীক্ষাটা একসঙ্গে দিয়েছিলাম। বলাই বাহুল্য যে, সেই পরীক্ষার ফলাফলে দেবেশের স্থান ছিল একেবারে শীর্ষস্থানে, আর আমি একেবারে নীচের সারিতে কোনও মতে ঝুলে ছিলাম। এর পর দেবেশ রায় কৃতিত্বের সঙ্গে অধ্যাপনা করেছেন অনেক বছর, সাহিত্য রচনাতেও পেয়েছেন প্রভূত খ্যাতি, মাঝে মাঝে রাজনৈতিক বিশ্লেষণেও তাঁকে ভূমিকা নিতে দেখা যায়। আমি এর কাছাকাছিও পৌঁছতে পারিনি। পাহাড় অঞ্চলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এখন বাংলা ভাষা শিক্ষার সুযোগ পায় কি না, সে সম্পর্কে আমার স্পষ্ট ধারণা নেই। দেবেশই তা ভাল জানবেন। আমি প্রত্যেক মানুষেরই নিজের মাতৃভাষা অধিকার রক্ষার ও প্রসারের চেষ্টা সমর্থন করি। এরাজ্যে নেপালি, উর্দু বা সাঁওতালি ভাষার শিক্ষার সুযোগ থাকার পক্ষপাতী। কৈশোর বয়েসে দু’তিনটে ভাষা শিক্ষা মোটেই শক্ত কিছু নয়। সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, তা শুধু মহারাষ্ট্রের জন্যই নয়, প্রত্যেক রাজ্যের স্কুলে সেই রাজ্যের মূল ভাষার শিক্ষা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। আমি সেই নীতি পশ্চিমবঙ্গেও প্রয়োগের দাবি করি। দেবেশ রায়ও তা-ই চান জেনে খুব আনন্দ হল।
১. ৮. ২০১২
শিশিরকুমার ভাদুড়ির হাহাকার
একটা নাট্যশালা
ঋণের দায়ে শ্রীরঙ্গম ছাড়তে হল শিশিরকুমার ভাদুড়িকে। শুধু অভিনয় নয়, এখানে একটা ঘরে তিনি মাঝে মাঝে রাত কাটাতেন। আদালতের ডিক্রি নিয়ে সেই বাড়ির মালিক এক দুপুরে শিশিরকুমারকে বিতাড়িত করার ব্যবস্থা করলেন, তাঁকে বার করে দেওয়া হল রাস্তায়, তাঁর ব্যবহৃত অনেক জিনিস, যেমন তাঁর জামা-কাপড়, জুতো। এই দৃশ্য দেখার জন্য সেখানে ভিড় জমা তো স্বাভাবিক। শিশিরকুমার আগে বাংলা রঙ্গমঞ্চের সম্রাট বলে গণ্য হতেন।
শিশিরকুমার মঞ্চ থেকে সব সংস্রব কাটিয়ে থাকতে লাগলেন বরানগরের এক বাড়িতে। তখনও বরানগর ছিল কলকাতা থেকে দূরে, নিরিবিলি মফস্সল। অত্যন্ত অহংকারী পুরুষ তিনি, কারও কাছ থেকে কোনও রকম সাহায্য নিতে রাজি নন। এক সময়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন, সে সবই ঐতিহাসিক নাটক কিংবা শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের নাট্যরূপ, সবই নাটক হিসেবে খুব দুর্বল। তিনি সব সময়ই চাইতেন নতুন, সাহিত্য গুণসম্পন্ন রচনা। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি নাটক খুব যত্ন নিয়ে মঞ্চস্থ করেছিলেন, দর্শক জোটেনি, শিশিরকুমারকে ক্ষতিস্বীকার করতে হয়েছে প্রত্যেক বার। একটি রবীন্দ্ৰনাটক সাড়ম্বরে উদ্বোধন করার দিনে মোট দর্শকের সংখ্যা ছিল ছ’জন। তিনি চাইতেন লাভ-ক্ষতির হিসেব না করে এমন একটি জাতীয় থিয়েটার কেন্দ্র, যেখানে হবে নতুন নতুন সত্যিকারের নাটক চর্চা, নতুন নট-নটীদের ট্রেনিং দিয়ে গড়ে তোলা। অনেক দেশেই সরকার এ রকম প্রতিষ্ঠান চালাবার দায়িত্ব নেয়। আমাদের দেশে পরাধীন আমলে সরকার এ নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নাও হতে পারে। তার পর দেশ স্বাধীন হল, তখনও শিশিরকুমার তাঁর এই আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়েছেন, কিন্তু কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার সে রকম উদ্যোগই নেয়নি।
নিজস্ব রঙ্গমঞ্চ আর পাননি জীবনে। আগে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে কয়েকবার এ বিষয়ে আলোচনাও করেছেন শিশিরকুমার। বিধানচন্দ্র রায়ের আর যত গুণই থাকুক ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে খুব উৎসাহী ছিলেন, এ দাবিটা করা যায় না বোধ হয়। এর মধ্যে ভারত সরকার ঘোষণা করল যে পদ্মভূষণ খেতাব দেওয়া হবে শিশিরকুমারকে। সে চিঠি পেয়ে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন, এ যেন গরু মেরে জুতো দান!
সারা ভারতে খুব সম্ভবত শিশিরকুমারই এই সরকারি খেতাব নিতে অস্বীকার করেছিলেন। এই সব ঘটনা অনেকেরই জানা। ওই সময় আমি থাকতাম উত্তর কলকাতায়, মঞ্চে শিশির ভাদুড়ির শেষ দু’তিনটি নাটক দেখেছি, রাস্তাতেও তাঁকে দেখেছি কয়েকবার। অহংকারী শিশিরকুমার নিজের দুর্বলতার কোনও রকম চিহ্ন রাখতেন না। কিন্তু ওর মধ্যে নিশ্চিত একটা হাহাকার ছিল। সেটা আমি সেই কৈশোরে বুঝতে পারিনি, তবে সেই স্মৃতি রয়ে গেছে প্রায় অম্লান। শিশিরকুমারের মৃত্যুর অনেকদিন পরে টের পেয়েছি সেই হাহাকারের। স্বাধীনতার এত দিন পরেও কি গড়ে উঠেছে কোনও জাতীয় নাট্যশালা? একটা নাট্যশালা চালাতে কত টাকা আর লাগে? প্রত্যেক সরকারের আমলেই কত দিকে কত টাকা বাজে খরচ হয়। তবে শুনেছি, নান্দীকারের রুদ্রপ্রসাদ, আরও কোনও কোনও দল নিজেদের উদ্যোগে পথশিশু কিংবা বস্তির ছেলে-মেয়েদের ট্রেনিং দিয়ে কিছুটা সুস্থ জীবনের স্বাদ দিতে পেরেছেন। অলকানন্দা রায় জেলখানার কয়েদিদের নিয়ে নাচ-গান-নাটকের শিক্ষার মধ্য দিয়ে যে আশ্চর্য কাজ করেছেন, তা অভূতপূর্ব তো বটেই এবং তা অবিস্মরণীয়। আমাদের নাট্যজগৎ-এর মান এখন বেশ উঁচুতে, তা নিয়ে আমরা অবশ্যই গর্ব করতে পারি।
মিনার্ভা থিয়েটার বহুদিন বন্ধ থাকার পর এখন সারিয়ে-সুরিয়ে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হয়েছে। যত দূর মনে হচ্ছে, এর মালিকানা এখন রাজ্য সরকারের, তা হলে এটাকেই এখন কি জাতীয় নাট্যশালা হিসেবে গণ্য করা যায়? অন্তত মিনি জাতীয় নাট্যশালা। এবং এরই মধ্যে এ থেকে একটি চমৎকার উদ্যোগ নিয়েছে, যার নাম মিনার্ভা রেপার্টরি থিয়েটার। এরই মধ্যে পাদপ্রদীপের সামনে এসেছে তিনটি নাটকের উপস্থাপনা, তিনটিই দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার, প্রতিটি দেখেই আমি মুগ্ধ। প্রথমটি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অসাধারণ অভিনয় সমৃদ্ধ শেকসপিয়ার অবলম্বনে রাজা লিয়ার। তার পর মনোজ মিত্রের নাটক, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় দেবী সর্পমস্তা (যেটা আমার বার বার দেখার ইচ্ছে হয়) আর তৃতীয়টি অতি সম্প্রতি ডি এল রায়ের বহু-চর্চিত নাটক চন্দ্রগুপ্ত। এটা এমন কিছু আহা মরি নাটক নয়, কৃত্রিমতা প্রচুর, তবু দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্মের দেড়শো বছর পালন উপলক্ষে তাঁর প্রতি সম্মান জানানোর জন্য তাঁর একটি নাটক নির্বাচন করা ঠিকই আছে। এর সঙ্গে অবশ্য জি পি দেশপাণ্ডের একটি নাটকের কিছু দৃশ্য মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।
চন্দ্রগুপ্ত নাটকের ত্রুটিগুলি অনেকটাই ঢেকে দিয়েছেন পরিচালক কৌশিক চট্টোপাধ্যায়। তিনি এনেছেন গতি, যার ফলে দর্শকদের কেউই কয়েক চুমুক ঘুমিয়ে নেবার সুযোগ পাবেন না। এই কৌশিক চট্টোপাধ্যায় থাকেন কৃষ্ণনগরে। কলকাতার কোনও নাট্য দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না থেকেও তিনি অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন এই নাটকের নির্দেশনায়। দুর্বল নাটকের মঞ্চ-সাফল্য আনা খুবই কঠিন কাজ, কৌশিক সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে অনেকটাই জয়ী হয়েছেন।
দেবী সর্পমস্তা দেখতে গিয়ে শুনেছিলাম, প্রায় সব কুশীলবকেই আনা হয়েছে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে। তাদের কেউ কেউ আগে কখনও মঞ্চে ওঠেনি। কয়েক মাস তাদের এখানেই রেখে দিয়ে তাদের নাচ-গান-অভিনয় শেখানো হয়েছে, তাদের সার্থকতার প্রধান নিদর্শন, মঞ্চে তাদের সাবলীল বিচরণ। যারা সদ্য সদ্য গান বা নাচ শিখেছে, তাদের কোথাও তাল কাটেনি।
চন্দ্রগুপ্ত দেখতে গিয়েও শুনলাম, এই নাটকেও প্রায় কোনও খ্যাতিমান নেই, সেই আগের দলের ছেলে-মেয়েরাই এ নাটকে অংশগ্রহণ করেছে। দু’টি বিপরীতধর্মী নাটক, চরিত্র বদল করা কম কঠিন নয়। আমি চেষ্টা করছিলাম, আগের নাটকে যারা খুব ভাল অভিনয় করেছিল, তাদের এই নাটকে চেনা যায় কি না। পোশাক-পরিচ্ছদ অন্য রকম, সংলাপও সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের, তা হলে আর চিনব কী করে? এই নাটকের রাজা নন্দ অনেকটা ভিলেন ধরনের, আর তার উপস্থিতিও অনেকটা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং নন্দও শুধু সাদা বা কালো নয়, অনেকটা সিরিও কমিক ধরনের, এবং সে নাচতে পারে, গাইতেও পারে, তার অভিনয় অন্যদের ছাপিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ এক সময় আবিষ্কার করলাম, আরে! এ তো দেবী সর্পমস্তার প্রধান চরিত্রটি। এর নাম অনির্বাণ ভট্টাচার্য। আমি এর মধ্যেই ওর ভক্ত হয়ে উঠেছি, আমার দৃঢ় ধারণা, এই ছেলেটি আরও অনেক নাটকে ফাটাবে। চাণক্যের মতন কঠিন চরিত্রের অভিনেতা অধিকারী কৌশিকও ছিল আগের নাটকে। আর অনেককে চিনতে পারলাম না, তবে সবারই অভিনয় বেশ স্বচ্ছন্দ।
একটা ছোট কথা। কোনও নাটকের পটভূমি হয় কয়েক শতাব্দী আগের কোনও ঘটনা, তা হলে তাদের ক্ষমতা দখলের প্রশ্নে এক বার না এক বার দু’জনের তলোয়ারের লড়াই থাকে। বিদেশের নাটকের এই সব অভিনেতাদের বেশ কিছু দিন ফেনসিং শিখতে হয়, যেমন আমরা দেখেছি হ্যামলেটের ভূমিকায় লরেন্স অলিভিয়ারকে। আমাদের বাংলা থিয়েটার বা সিনেমায় এ রকম লড়াইয়ের দৃশ্য থাকলে অভিনেতারা ওসব শেখা-টেখার জন্য সময় দিতে চায় না, একটুখানি ঠুকুস-ঠাকুস করেই পরের দৃশ্যে চলে যায়। এই নাটকেও রাজা নন্দ আর চন্দ্রগুপ্তের একটা তলোয়ারে লড়াইয়ের দৃশ্য আছে। আমি সবিস্ময়ে দেখলাম, এই নাটকে দুই তলোয়ারধারীর লড়াই খুবই বাস্তবসম্মত, নাচের কোরিওগ্রাফির মতন পদক্ষেপ নিখুঁত। যেন রোনাল্ড কোলম্যান আর ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস, জুনিয়ার।
মিনার্ভা রেপার্টরির সভাপতি ব্রাত্য বসু। সে সত্যিকারের এক ক্ষমতাবান নাট্যকার আর অভিনেতা হিসেবেও দুর্দান্ত, অতি সম্প্রতি মুক্তধারা চলচ্চিত্রে তার অভিনয় বহুদিন মনে রাখার মতন। এখন সে এই রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী। এই দফতরের মন্ত্রীর কাজ অনেক বেশি আর ঝঞ্ঝাটও হয় প্রত্যেক দিন। তবু ব্রাত্যকে আমরা অনুরোধ করব, মন্ত্রিত্বের ব্যস্ততার মধ্যেও যেন তার থিয়েটার-সংসর্গ অটুট থাকে। এই রেপার্টরি আরও অনেক নতুন উদ্যোগ নিতে পারে। এবং রাজনৈতিক দলাদলি ও পক্ষপাতিত্ব যেন এই ধরনের কাজ ছিন্নভিন্ন করে না দেয়।
আবির দিয়ে রাঙাও তাকে
ঘাতক এত রক্তধারায় খুঁজছ কাকে?
আবীর দিয়ে রাঙাও দেখি সভ্যতাকে।
(নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তুমিও জ্বরের মতো এসো’ কাব্যগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত)
১৫. ৮. ২০১২
ভারতীয় পুরুষদের লিবিডো কি বেড়ে গেল, না…
নিউ ইয়র্কের অদূরে, নিউ জার্সি রাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক বাঙালি বা বাংলাভাষীর বাস। এদের কয়েকটি ক্লাবও আছে। মাঝে মাঝে এরা নানান উৎসবের আয়োজন করে। সে রকমই একটা উৎসব উপলক্ষে আমি উপস্থিত ছিলাম সেখানে। একটা বিশাল স্কুলবাড়ির প্রাঙ্গণে চলছে গান-বাজনা ও নানা রকম গয়নাগাটির প্রদর্শনী। আমরা কয়েকজন ভেতরের একটা ঘরে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে চুল ছেঁড়াছেঁড়ি চালাচ্ছি, আসলে সেটা একটা আড্ডা। এক সময় আমাকে টয়লেটে যেতে হল, সেখানে গিয়েই আমার আক্কেল গুড়ুম। এখানে আক্কেল গুড়ুম ঠিক খাটে কি না তা জানি না, তবে বহু দিন পরে এত বেশি অবাক হয়েছি।
ও দেশের নানান জায়গায় থাকে এক ধরনের মেশিন, তাতে কিছু পয়সা দিয়ে একটা ছবি দেখে টিপলেই বেরিয়ে আসে একটা না একটা কেক বা পেস্ট্রি, আরও বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য, এমনকী ঠান্ডা পানীয়ের বোতল। এখানে হিসিখানার মধ্যেও রয়েছে সে রকম একটা ছোটখাটো মেশিন, তাতে লেখা রয়েছে, পাঁচ বা দশ পয়সা দিলে পাওয়া যাবে একটি কনডোম। ইস্কুলের এলাকার মধ্যে কনডোম বিক্রির ব্যবস্থা? ফিরে এসে সেই আড্ডায় আমার বিস্ময়ের কথা জানাতেই একজন মহিলা, যিনি বহু কাল ধরে ও দেশে আছেন, তিনি একটুও বিচলিত না হয়ে বললেন, হ্যাঁ, বেশ কিছু দিন আগে থেকেই এটা চালু হয়েছে। এ ছাড়া উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়েদের কিছুটা সাহায্য করার আর তো কোনও উপায় নেই।
সাহায্য? উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়েরা নানা রকম খেলা করতে শুরু করে, তার মধ্যে আছে শারীরিক খেলাও। এতে বাধা দেবার যে কোনও চেষ্টা করলে কোনও সুফলও পাওয়া যাবে না, ওরা মানবেই না। অভিভাবকরা প্রায় অনেকেই, ছেলে বা মেয়েকে শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবেন না, সেটা নাকি ওদের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।
এই ছেলেমেয়েদের শারীরিক মিলনের জন্য হন্যে হয়ে জায়গা খুঁজতে হয়। সে রকম সুযোগ অগাধ। প্রকাশ্য চুম্বন নিয়ে মাথাই ঘামায় না কেউ। যে কোনও ঘাস জন্মানো জায়গায় দু’টি শরীর প্রায় এক হয়ে যায়, গড়াগড়ি দেয়, সে দিকে ফিরেও তাকায় না কেউ। সাময়িক উত্তেজনায় ছেলে ও মেয়েটি একেবারে চরমে চলে যায়, তাতে যদি কোনও মেয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়ে, তখনই শুরু হয় নানা রকম বিপদের ছায়াপাত। ছেলেটি কোনও দায়িত্ব না নিয়ে সরে পড়তে পারে। মেয়েটি তো তা করতে পারে না। এমনকী গর্ভপাতের ব্যবস্থা থাকলেও একটা সতেরো-আঠারো বছরের মেয়ে তাতে রাজি হতে না-ও পারে। তখনও তার শ্বশুরবাড়ি বলতে কিছু নেই, কারণ তার তো বিয়েই হয়নি। তার বাবা-মা’ও এই অবস্থায় তাকে কাছে টেনে নিতে চায় না, তা হলে সে এক শিশুকে সঙ্গে নিয়ে কোথায় যাবে, কী ভাবে বাঁচবে। এক বছর আগেও যে মেয়েটিকে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, সাহসিনী অবস্থায় দেখেছি, সে এখন সন্তানকে বুকে জড়িয়ে রাস্তার ধারে বসে অসহায় অবস্থায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রাস্তার ধারে ঝোপেঝাড়ে যে মাঝে মধ্যেই কোনও সদ্য শিশুর কান্নার আওয়াজ শোনা যায়, তা-ও নিশ্চিত ভাবেই এই রকম অবস্থারই একটি দুঃখজনক, কালো দিক। সেই জন্যই শিশুটিকে বাঁচানো ও তার মানে সুস্থ জীবনে ফেরাবার জন্য ওদের সামনে দুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে কনডোম।
এ রকম ঘটনা দেখলেই যে আমরা এত বিস্মিত হই, ভেতরে ফুসফুস করে প্রতিবাদ, তার কারণ কী? আসল কারণ, আমাদের নৈতিক আপত্তি। আমাদের মধ্যে এক এক জনের এক এক রকম বিশ্বাস থাকতে পারে, কিংবা কোনও কিছুতেই বিশ্বাস না থাকতে পারে, কিন্তু যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে আমরা এখনও কিছুটা রক্ষণশীল। কেননা, প্রকৃতিদেবী যিনি আমাদের ঘাড় ধরে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাচ্ছেন, তাঁর বিচারে তো এই সব ছেলেমেয়ের যৌন স্বাধীনতার দাবির মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। মেয়েদের বোধহয় দশ-এগারো বছরে আর ছেলেদের সতেরো-আঠারো বছরে যৌন চেতনা এসে যায়, আর প্রথম প্রথম তা যেন বেশ অশান্ত থাকে। প্রকৃতি তখন ওদের বলতে থাকে, সন্তান উৎপাদন বাড়াও, যত পারো বাড়াও। তবু আমরা যে অনেকেই কিছুটা সংযত থাকি, সন্তান-সম্ভাবনা জমিয়ে রাখি ভবিষ্যতের জন্য, তার কারণ মোটেই বিজ্ঞানসম্মত নয়, সামাজিক, আর সেই সামাজিকতার নানান ধারা আমরা নিজেরাই তৈরি করে রেখেছি। বিয়ে নামে কৃত্রিম ব্যবস্থাটাও রয়েছে এর মধ্যে। বিয়ের প্রথার মূল উদ্দেশ্য দু’টি। নিজের পরিবারের ধারাবাহিক অগ্রগতি রক্ষা করা। (পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভাৰ্যা, অর্থাৎ ছেলেরাই বংশ রক্ষা করবে, এটা সম্পূর্ণ একটা ভুল ধারণা চলে আসছে বহু দিন ধরে; মেয়েরাও বংশ রক্ষা করে যেতে পারে অবশ্যই।) আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে বিষয়সম্পত্তির সুষ্ঠু ভাগাভাগি। যাতে সব কিছু চিলুবিলু না হয়ে যায়। যদিও তা হচ্ছে এখনও। ভাইয়ে ভাইয়ে বা আত্মীয়স্বজনের ঝগড়া ও মারামারি নিয়েই তো লেখা হয়েছে পৃথিবীর আদি সব মহাকাব্য। এখন নাকি ধর্ষণ-টর্ষণের ঘটনা খুব বেড়ে গিয়েছে। হঠাৎ ভারতীয় পুরুষদের লিবিডো বেশি বেশি চাঙ্গা হয়ে উঠল নাকি? কারও কারও মতে, অরাজক অবস্থায় পড়লেই এই সব অন্যায় কর্ম বেড়ে যায়, শুধু ধর্ষণ নয়, তার সঙ্গে খুনটুনও সমান তালে চলে। আবার অন্য মতে, এর অনেকগুলিই সত্যি নয়। বিরোধীদের সাজানো গল্প। কিছু কিছু সংবাদমাধ্যম সেগুলো রগরগে ভাবে প্রকাশ করে। এই রকম মিথ্যে দিয়ে উত্তেজিত করে তোলা হয় সাধারণ মানুষকে। আগেও এরকম ধর্ষণের ঘটনা ঘটত, কিন্তু সব প্রকাশের সুযোগ থাকত না। এখন নাকি সাংবাদিকরা টাকা খেয়ে, কিংবা নিজেরা টাকা দিয়ে অনেক কিছু মিথ্যে সাজায়। এই নিয়ে আমরা মনে মনে অনেক কথাই বলি, কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না।
এই এক জীবনে আমরা কত রকম চমকপ্রদ ঘটনাই না দেখলাম। তার মধ্যে একটি হচ্ছে বীর্য-ব্যাঙ্ক। এখন যে কোনও রমণীই কোনও পুরুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে না এসেও সন্তানের জননী হতে পারে। ওই ব্যাঙ্ক থেকে কোনও অজ্ঞাতনামা পুরুষের বীর্য কিনে আনবে। তাঁর পরে প্রক্রিয়াগুলোও আর তেমন কিছু জটিল নয়।
বেশ তো চলছিল, এরই মধ্যে আর একটি গোলমেলে খবর পাওয়া গেল বিজ্ঞানীদের মহল থেকে। একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সংস্থা জানিয়েছে যে, ভারতীয় পুরুষদের ( হ্যাঁ, বিশেষ করে ভারতীয় পুরুষদের) বীর্যে কিছু কিছু দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। নানা কারণে। তার মধ্যে অন্যতম রেডিয়েশন-এর বিস্তার। এই দুর্বল বীর্য নিয়ে তাদের সন্তানের জন্ম দেওয়ার ক্ষমতাও কমে যাবে, কিংবা তারা দুর্বল সন্তানের জন্ম দেবে। সংখ্যাটা অবশ্য এখনও খুব বেশি নয়, শতকরা দুটি মাত্র। কিন্তু আমরা তো অনবরতই দেখছি, এই ধরনের ঘটনা কখনও কমে , বাড়তেই থাকে। তা হলে কি অদূর ভবিষ্যতে, কিংবা দূর ভবিষ্যতে এই অবস্থা বাড়তে বাড়তে এমন একটা চূড়ান্ত অবস্থায় আসতে পারে, যখন ভারতীয় পুরুষদের সন্তানের জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা একেবারে চলে যাবে? কোনও পুরুষই যদি আর না থাকে, তা হলে নারীবাদীরাই বা আন্দোলন করবে কার বিরুদ্ধে? এরই মধ্যে একটামাত্র আশার কথা এই যে, এই অবস্থা থেকে অনেক আগেই আমি কেটে পড়তে পারব পৃথিবী থেকে।
কোথায় বাস্তব, কোথায় কল্পনা
একটি বছর পাঁচেকের শিশুকে নানান গল্প শোনায় তাঁর মা। ভূত-প্রেত বা যুদ্ধ-বিগ্রহের গল্প এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে মা, যাতে ছোটবেলা থেকেই তার ছেলে ওই সব কুসংস্কার থেকে মুক্ত থাকতে পারে। কিন্তু বাচ্চাদের গল্পে কোথাও না কোথাও দৈত্য-দানো, রূপকথার কাহিনি এসে পড়ে। ছেলেটি সে রকম কোনও ছবির দিকে আঙুল দেখালে মা তখন সেই গল্প শোনাতে বাধ্য হলেও বার বার বোঝাতে থাকে যে এই সব আসলে কোথাও নেই। ডানাওয়ালা পক্ষীরাজ ঘোড়া, কিংবা দৈত্য-রাক্ষসদের সঙ্গে ভীমের লড়াই, এ সবই কল্পনা, মানুষের ইমাজিনেশন। এক সময় ওরা তিন জনে মিলে বেড়াতে গেল আমেরিকার এক প্রান্তে একটা পেট্রিফায়েড ফরেস্ট-এ। সেখানে মাইলের পর মাইল সবুজ গাছপালা। সে রকম একটা জায়গাতেই গাড়ির গতি কমিয়ে দিল বাবা। খুব কাছে এসে দেখা গেল, তার দিয়ে ঘেরা সেই স্থানটি একটি ছোটখাটো চিড়িয়াখানাও বটে। প্রথমেই চোখে পড়ল, একটা ঝাঁকড়া গাছের নীচে বসে আছে একটা ভাল্লুক। বাচ্চা ছেলেটি সে দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে উঠল, ওই তো একজন রাজকুমারী। শি ইজ আ প্রিন্সেস, শুধু তাঁর বাবা-মা’ই নয়, কাছাকাছি কিছু লোকও এই কথা শুনে অবাক। একটা ভাল্লুক দেখেই তাকে রাজকুমারী বলল কেন বাচ্চাটি। তার মা তাকে এই কথাটা জিজ্ঞেস করতেই অয়ন নামে বাচ্চাটি বেশ জোরের সঙ্গে বলে উঠল, ‘আই ইউজ্ড মাই ইমাজিনেশন, আমি কল্পনা করেছি।’
২৯, ৮. ২০১২
কলকাতায় তখন উঁচু বাড়ি ছিল না
আমাদের ছেলেবেলায় উঁচু কোনও বাড়ি ছিল না। প্রাক্তন জমিদার, অভিজাত শ্রেণি আর ধনী ব্যবসায়ীদের অনেকখানি ছড়ানো বাগানওয়ালা বাড়ি ছিল। কলকাতার প্রান্তসীমার ও পাশে আর এক ধনিক শ্রেণির প্রমোদ ভবন। তারপর এক সময় শুরু হল জমি নিয়ে টানাটানি। তখন আর ছড়ানো বাড়ির বদলে নতুন বাড়িগুলো হতে লাগল ঊর্ধ্বমুখী। রিফিউজিদের ঢল নামার পর তারা ওই সব বাগানবাড়ি দখল করে নিল। বাগানবাড়ি দখল করা খুব বেশি শক্ত কিছু নয়, কিন্তু ফ্ল্যাট বাড়ি সে ভাবে দখল করা যায় না। শুরু হয়ে গেল ফ্ল্যাট কালচার।
আমি থাকতাম তখন উত্তর কলকাতায়। হাতিবাগান অঞ্চলে অনেকগুলি থিয়েটার হল ছিল এবং ছিল একটি বেশ সুসজ্জিত সিনেমা হল, রূপবাণী। বাংলা উচ্চারণের নিয়ম অনুযায়ী বলা উচিত রুপোবাণী। অনেকেই অবশ্য বলত, রূপ্বাণী। তাঁর পাশেই গড়ে উঠল একটা পাঁচতলা বিশাল ফ্ল্যাটবাড়ি। সেটা এমনই অভিনব যে অজ পাড়াগাঁ থেকেও অনেক ছেলেমেয়ে সেটা দেখতে আসত। সেটার নাম হয়ে গেল পাঁচতলা বাড়ি, এবং দিক্দর্শক। ওই অঞ্চলের কোনও ঠিকানা বলতে হলে বলা হত, ওই তো পাঁচতলা বাড়ির ডান দিকে বা পিছন দিকে ইত্যাদি।
এখন তো পৃথিবীর অনেক শহরের মতন কলকাতায়ও কুড়ি-তিরিশ তলা অট্টালিকায় ভরে গেছে। আমি নিজেও এখন একটা উঁচুবাড়িতে থাকি। এই ফ্ল্যাটবাড়ির উপকারিতা-অপকারিতা নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হয়। তার মধ্যে একটা সর্বসম্মত তথ্য উঠে আসে। আত্মহত্যা করার জন্য এই উঁচুবাড়ির অবস্থান। বেশ সুবিধাজনক।
খবরের কাগজে প্রায় রোজই খুন বা আত্মহত্যা, ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির খবর পড়তে পড়তে গা গুলিয়ে ওঠে। তাই ইদানীং আর ও-সব একেবারেই পড়ি না। কয়েক দিন আগে একজন পরিচিত মানুষ ফোন করে বলল, দাদা, আপনি খবরটা দেখেছেন? মুকুতা আর নেই। সে তার মা আর এক বোনকে নিয়ে…।
জীবনে এমন কিছু ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় যা কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না। আমার সমস্ত পরিচিত ব্যক্তি, আত্মীয়-স্বজন, সবারই একটা চরিত্র-চিত্র তৈরি করে নিই, নিজের বিচারক্রমে। অর্থাৎ আমাদের বোধের মধ্যে রয়েছে একটা বিরাট আর্ট গ্যালারি। যাতে রয়েছে সব চেনা মানুষের ছবি আর তাদের সম্পর্কে আমার ধারণা-বৰ্ণনা। সেই সব চরিত্র-চিত্রণ বাস্তবে কিছুটা এ-দিক ও-দিক হতেই পারে। কিন্তু সম্পূর্ণ ভাবে বিপরীত হলে মেনে নিতে কষ্ট হয়। যেমন ধরা যাক, একজন খুব ভাল তবলা বাজায়। হঠাৎ যদি সে ছবি এঁকে খুব নাম করে ফেলে, তাতে অস্বাভাবিক কিছু নেই, আমরা মেনে নিই, খুশি হই। কিন্তু এমন এক জন বন্ধু প্রায়ই আসে আমাদের বাড়ি। মুড়ি আর বেগুনি খেয়ে আড্ডা দেয় আমাদের সঙ্গে। আমার স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গেও বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তার পর যদি একদিন হঠাৎ দেখি যে, রাস্তায় আমাকে দেখেও মুখ ফিরিয়ে থাকে, ডাকলেও সাড়া দেয় না। তাতে কেমন লাগে? কারণটা খোঁজার জন্য আমার রাত্তিরে ঘুম চলে যায়।
সেই রকমই মুকুতা সম্পর্কে আমার যে ধারণা করে রেখেছি, তাতে এই সরল তেজি মেয়েটি যদি দেখে কোনও ব্যক্তি তার আদর্শকে বাধা দিচ্ছে কুৎসিত ব্যবহার করে, তা হলে ঝোঁকের মাথায় মুকুতা তাকে গুলি করে মেরে ফেলতেও পারে। তা আমি বিশ্বাস করে নিতে পারি। কিন্তু আত্মহত্যা? এ তো তার চরিত্র থেকে একেবারে বিপরীত মেরুতে সরে যাওয়া।
কত দিন ধরে চিনি মুকুতাকে। সে নিজে নিজেই দেখা করতে এসেছিল আমাদের বাড়িতে। তখন সে বেহালা ফ্লাইট ক্লাবে বিমান-উড়ান শিখছে। যত দূর জানি, দশ হাজার মাইল নিজে নিজে চালাতে শিখলে তবেই সে পাইলট হওয়ার পরীক্ষায় যোগ্য হতে পারে। সংখ্যাটা ঠিক না-ও হতে পারে। মুকুতার সাড়ে সাত হাজার মাইল হয়েছে তখন পর্যন্ত। এই শেষের দিকটায় খরচও বেশি। যাই হোক, সে সব ব্যবস্থা হয়ে গেল, পরে মুকুতা পাইলট হওয়ার লাইসেন্স পেয়েছে। মেয়েদের পক্ষে পাইলট হওয়া এখন আর অভিনব কিছু নয়। অনেক আগেই দুর্বা ব্যানার্জির নাম শুনেছি। কিন্তু আমাদের চেনাশোনা, মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ে হঠাৎ আকাশে উড়তে চাইবে কেন, তা নিয়ে আমাদের কৌতূহল থাকবেই। পাইলট হয়েও মুকুতা কিন্তু সেটাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেনি। কেন, তা জানি না। তাঁর বাবা একজন সরকারি অফিসার, মুকুতা মাঝে মাঝে ছোটখাটো কাজ করে কিছু উপার্জন করত, সে বাঁধা পড়ে থাকতে চায়নি৷ এবং মধ্যবিত্ত জীবনের ধারা অনুযায়ী এই সময়েই তো বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা। সে বেশ সুন্দরী, বুদ্ধিমতী এবং আকর্ষণীয়া তরুণী। তবু তার বিয়ের বিষয়ে কোনও প্রস্তাবনার কথাও শুনিনি। তাঁর সঙ্গে কোনও পুরুষের গোপন হৃদয়-সম্পর্ক ছিল কি না তাও জানা যায়নি। মাঝে মাঝে হঠাৎ সে চলে আসত এক ঝলক স্নিগ্ধ, মিষ্টি বাতাসের মতন। এর মধ্যেই সে হয়ে উঠল একজন সমাজকর্মী এবং কট্টর ভাবে পরিবেশ সংরক্ষণের সৈনিক। কোথাও বেআইনি গাছ কাটা কিংবা পুকুর ভরাটের খবর পেলেই সে ছুটে যেত সেখানে। কখনও দলবদ্ধ ভাবে, কখনও একাই সে সব জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তুলত। সেই জন্যই প্রোমোটার নামের যে শ্রেণির এখন খুব রমরমা, তাদের একটা অংশ দু’চক্ষে দেখতে পারত না। টাকার লোভ দেখিয়ে কিংবা হত্যার হুমকি দিয়েও তাকে বাধ্য করা যেত না। তারা ভাড়াটে খুনি লাগিয়ে তাকে মেরে ফেলতেও পারত। মুকুতার মতো মেয়েকে মেরে ফেলা যায়, কিন্তু জয় করা যায় না।
আমাদের পরিবারে স্বাতীর সঙ্গেই তার পরিচয় ছিল বেশি। সেই স্বাতীকেও সে একবার বকুনি দিয়েছিল। ব্যাপারটা হয়েছিল কী, আমাদের শান্তিনিকেতনের বাড়ির পাশেই আছে একটা ছোট পুকুর। এটা আমার পূর্ববঙ্গীয় স্মৃতি আর শখের ব্যাপার। আমি সেখানে ছিপ ফেলে বসে থাকতাম অনেকক্ষণ। তার মধ্যে কয়েক বার মাছও ধরেছি। কয়েকটা হাঁসও সেখানে খেলে বেড়ায়। দেখেছি মাছ-ধরা পাখির সুনিপুণ ছোঁ মারা। দু’একটা সাপেরও ডুব সাঁতার।
একবার আমি দেশের বাইরে ছিলাম কিছু দিন, তারই মধ্যে স্বাতী কিছু লোকের ভুল পরামর্শে পুকুরটার চার পাশ সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে দেয়। কিছু কিছু ক্লাবের সুইমিং পুল থাকে এ রকম। কিন্তু তাদের ব্যবস্থা অন্যরকম। গাঁয়ে গঞ্জে সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য পুকুরে এ রকম ভাবে বাঁধানোর রীতি নেই। কারণ, বৃষ্টির সময় পাড়ের মাটি ধুয়ে ধুয়ে যে জলের ধারা পুকুরের জলে মেশে, তার মধ্যেই থাকে মাছ ও অন্যান্য পোকা-মাকড়ের কিছুটা খাদ্য। সিমেন্টের ওপর দিয়ে জল গড়িয়ে এলে তাতে কিছুই থাকে না। এটা এক ধরনের পরিবেশ দূষণও বটে।
মুকুতা এক দিন এসে আমাদের পুকুরের সেই দশা দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। তারপর বলতে লাগল, ছি ছি ছি, বউদি, তুমি এই কাজ করলে? আমি অনেক জায়গায় পুকুর বাঁধানোর কাজ আটকাবার জন্য ধর্না দিই, আর তুমি আমার প্রিয় বউদি এ কাজ করলে?
মুকুতার এই ধরনের আহত ছটফটানি দেখে স্বাতী বলল, আমি ভুল করেছি রে। ঠিক বুঝতে পারিনি। এখন বুঝেছি, ওই পুকুর ধারের সিমেন্ট আমি সব ভেঙে দেব।
আমিও তাতে যোগ দিয়ে বললাম, মুকুতা শান্ত হও। আমরা আজ কালের মধ্যেই ওটা ভেঙে ফেলার ব্যবস্থা করছি।
পরে খবর নিয়ে জানলাম, পুকুর পাড় সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া সহজ, ভেঙে ফেলা তার থেকে অনেক শক্ত। খরচও অনেক বেশি। ভাঙা সিমেন্টের চাঁই জমে গেলে তা আবার ওঠানো খুবই কষ্টসাধ্য।
মুকুতাকে আমরা কথা দিয়েছিলাম। সে কথা রাখতে পারিনি এখনও। মুকুতা আমাদের আর একটু সময় দিল না। আগেই বলেছি, মুকুতা কারওকে খুন করে ফেললেও ততটা অবাক হতাম না। কিন্তু আত্মহত্যা! আমার সমস্ত অভিজ্ঞতার বাইরে। মুকুতার পক্ষে এমন আত্মহত্যা একেবারেই মানায় না। কোনও আত্মহত্যার খবর শুনলে অনেক মানুষ তার একটা কার্য-কারণ খোঁজার চেষ্টা করে। নিজেরা কিছু তত্ত্বও বানিয়ে ফেলে। মুকুতার এই ব্যাপার সম্পর্কে নিজস্ব কোনও তত্ত্ব বলতে আমি অক্ষম। আর এক পরিবারের কয়েক জন মিলে আত্মহত্যা আমার পক্ষে সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য ব্যাপার। মুকুতা এই কাণ্ডটি করার আগে যদি ঘুণাক্ষরেও কিছু ইঙ্গিত দিত, তা হলে তাকে বকেঝকে হয়তো নিবৃত্ত করতেও পারতাম। মুকুতা সে সুযোগ আমাদের দিল না।
১২. ৯. ২০১২
বন্ধু বলছিলেন, ভারত নাকি অহিংসার দেশ!
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব। তিনি জেনে গেলেন কি না জানি না, স্বাধীনতা এসে গিয়েছিল তার পাঁচ সাত বছর পরেই। কিন্তু রক্তের স্রোত থামেনি, বেড়েই চলেছে।
আমার জন্ম পরাধীন ভারতে। দেশভাগ আর স্বাধীনতা যখন আসে, তখন আমার কৈশোর, সেই সময়কার অনেক স্মৃতিই এখনও মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করে। সেই বয়েসে মানুষের বিশ্বাস ও আদর্শে কোনও ভেজাল থাকে না। সত্যি আর মিথ্যার মধ্যে থাকে একটা স্পষ্ট বিভাজিকা।
সেই চল্লিশের দশকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখেছি আমরা। তাতে কত লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল তাঁর সঠিক হিসেব আজও হয়নি। হিটলারের ইহুদি নিধনের কাছাকাছিই হবে। তার পর ছেচল্লিশের সাঙ্ঘাতিক দাঙ্গা এবং স্বাধীনতার প্রাক্কালে দেশভাগের নির্মম ট্র্যাজেডি। আমাদের পরিবারও সেই ট্র্যাজেডির মধ্যে পড়েছিল। এত সব কাণ্ডের মধ্যেও আমরা কী করে যে বেঁচে রইলাম, সেটা আজও বিস্ময়কর মনে হয়। এর সব কিছুরই জন্য দায়ী আমাদের শাসক বিদেশি সরকার। যারা এ দেশের ভালমন্দ কিছু গ্রাহ্যই করে না, তারা যতদূর সম্ভব ভারতীয় সম্পদ লুটেপুটে নিয়ে যেতে চায়। সুতরাং ওরা চলে গেলেই কিংবা যেতে বাধ্য হলেই স্বাধীন ভাবে সোনার ভারত গড়ার কার্যক্রম শুরু হবে। আমরা সত্যিই বিশ্বাস করেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সেই দৃপ্ত ঘোষণায়, দেশ স্বাধীন হলেই তিনি কালোবাজারিদের ধরে ধরে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবেন। এটা অতিশয়োক্তি হতে পারে, কিন্তু কিছু তো করবেন তিনি। কিন্তু কিছুই করেননি, বা করতে পারেননি। বরং তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি হচ্ছিল হু হু করে। এখনকার খোলা বাজারের মতোই সে যুগে কালোবাজার দেশকে গ্রাস করে নিচ্ছিল।
যাই হোক, এ সব নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে, এখনও হয়। আমি আর তা চর্বিতচর্বণ করতে চাই না। তবে সেই সব স্মৃতি হঠাৎ আমার মনে গজগজ করছে। তাই না লিখে পারছি না। আমি লেখালেখির জগতে প্রবেশ করার পর পোল্যান্ডের এক লেখিকার সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তিনি বেশ খ্যাতিময়ী। নোবেল পুরস্কারের জন্যও কয়েক বার তাঁর নাম উঠেছিল। তিনি একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন, পৃথিবীর মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করেন ভারতকে। কারণ, কখনও ভারত অন্য কোনও দেশ আক্রমণ করেনি। সাম্রাজ্য বিস্তারেরও কোনও চেষ্টা করেনি। ভারত হচ্ছে অহিংসা ও শান্তির দেশ।
এ কথা শুনে কি গর্বে আমার বুক ফুলে ওঠা উচিত ছিল? না, আমার তা হয়নি, আমি বরং লজ্জায় অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ছিলাম। এত বড় প্রশংসা ভারতের প্রাপ্য নয়, ইতিহাসসম্মতও নয়। ভারত অন্য কোনও দেশ আক্রমণ করেনি, তার মূল কারণ, ভারতের সে রকম ক্ষমতাই ছিল না। এত বড় দেশে কোনও বিশাল ও মজবুত সেনাবাহিনী গড়ে ওঠেনি। এমনকী মোগল আমলেও না।
আর অহিংসা আর শান্তির দেশ? অহিংসা শব্দটি তখন পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল মহাত্মা গাঁধীকে কেন্দ্র করে। তাঁর অহিংসা সত্যাগ্রহ আন্দোলন সারা পৃথিবীতেই অভিনব। কিন্তু আমরা জানি, এ দেশের মানুষ মোটেও অহিংস নয়। গাঁধীজি পরাধীন আমলে খুন হননি, খুন হয়েছেন স্বাধীন ভারতে। ভারতীয়রা আত্মকলহ কিংবা নিজেদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বেই বেশি দক্ষ। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ‘শক-হুণ দল পাঠান-মোগল’ যখন-তখন এসেছে আর ভারতীয়রা মারও খেয়েছে। তাও তো চেঙ্গিস খান এ দেশে ঢোকেননি। ঢুকলে আরও কত লক্ষ মানুষ তাদের মুণ্ডু হারাত, কে জানে।
ছেলেবেলায় পাঁঠাবলি দেখেছি। তখন শুনতাম এক বলিতেই পাঁঠার গলা কাটতে হবে। কেউ যদি তা না-পারে, তা হলে দুর্গা বা কালীমাতা অত্যন্ত রেগে যাবে। অভিশাপও দিয়ে ফেলতে পারেন। সেই জন্য সে অঞ্চলের কোনও বলশালী লোককে ডেকে আনা হত। পালোয়ান সেজেগুজে এসে দাঁড়াত। পাঁঠাটাকে রাখা হত হাঁড়িকাঠে। দু’তিন জন লোক উল্টো দিক থেকে পাঁঠার মাথা টেনে ধরত, যাতে তার গলাটা যত দূর সম্ভব লম্বা করা যায়। পাঁঠাটা মৃত্যুভয়ে চেঁচাত আর আততায়ীরাও ভক্তিভরে ডাকত মা মা… তার পরেই ঘচাং। কখনও সে কোপ ব্যর্থ হতে দেখিনি।
আমাদের ধারণা ছিল, মানুষের গলা কাটা অত সহজ নয়। ভুল ধারণা। এখন তো দেখছি প্রায়ই এখানে সেখানে মুণ্ডহীন ধড় পাওয়া যাচ্ছে। এ রকম বর্বরতা অন্য কোনও সভ্য দেশে নেই। ছেলেবেলায় শুনতাম, কোনও কোনও অঞ্চলে এক জন অসহায় নারীর উপর ডাইনিগিরির অভিযোগ চাপিয়ে পুড়িয়ে মারা হত। আজও তেমন ঘটনা শুনতে পাই। পঞ্চাশ ষাট বছর আগে বড় বড় রাস্তার মোড়ে স্ত্রীলোককে দেখেছি একটা শিশুকে কোলে নিয়ে ভিক্ষে চায়। এখনও তা দেখি। হঠাৎ আমার মনে হয়, যেন এত বছর ধরে সেই একই স্ত্রীলোক একই শিশু নিয়ে ফিরে ফিরে আসে।
এক সময় শোনা যেত যে, ভারতের তিনটি বড় বড় শহরের মধ্যে এক একটাকে এক এক পরিচয় দেগে দেওয়া হয়েছে। যেমন, দিল্লি তো অবশ্যই রাজনৈতিক রাজধানী। বম্বে অর্থাৎ অধুনা মুম্বই হচ্ছে ব্যবসাবাণিজ্যের রাজধানী আর কলকাতা হচ্ছে শিল্প সাহিত্যের রাজধানী। কে রটিয়েছে তা জানি না। হয়তো বাঙালিরাই। বাঙালিরা ব্যবসা বাণিজ্য করতে জানে না, রাজনীতিতেও তেমন উঁচু জায়গায় পৌঁছতে পারে না। তাই তাদের দেওয়া হয়েছে শিল্প সংস্কৃতির তকমা। যদিও এটা অর্থহীন। বাঙালিদের মধ্যে বহু স্রষ্টার অভূতপূর্ব উত্থান হয়েছে, যেমন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, যামিনী রায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। কিন্তু তাদের প্রভাব কতখানি? একটা ছোট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। অধিকাংশ বাঙালি মূর্খ, তাদের শিল্প-সাহিত্যের কোনও বোধই নেই। অর্ধেকের বেশি বাঙালি তো এখনও পড়তে-লিখতেই জানে না।
লেখাটা থামিয়ে হঠাৎ আমার মনে হল, এ সব আমি লিখছি কেন? আমি তো সাধারণত নৈরাজ্যের কথা লিখতে চাই না। আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও আমার হাতে ঠিক আসে না। এ লেখা কি শেষ হবে তিক্ততার স্বাদ নিয়ে?
তা হলে একটা অন্য কথা বলি। বারো-পনেরো বছর আগেকার কথা। এক সন্ধেবেলা আমি এক কবিবন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম, সে দিনটা যে তাঁর জন্মদিন তা না-জেনে। বাইরের বসার ঘরে অনেক ফুলের তোড়া আর কিছু কিছু নারী পুরুষ রয়েছে। কবি সেখানে নেই। তিনি উঠে গেছেন একটু আগে একটা ভেতরের ঘরে। এ বাড়িতে আমার অবাধ ঘোরাফেরার অধিকার আছে, তাই চলে গেলাম সেই ভেতরের ঘরে। নতুন ধুতি পাঞ্জাবি আর কপালে চন্দনের ফোঁটা নিয়ে মাটিতে আধশোয়া হয়ে রয়েছেন সেই কবি। আরও আট দশ জন তরুণ দু’জন তরুণী সমেত সেখানে বসে আছে, কেউ চেয়ারে, কেউ মাটিতে।
বন্ধুটি আমাকে বসতে বলল। ওদের একজন একটা কবিতা পড়তে শুরু করল। তখন ওদের দিকে তাকিয়ে কয়েক জনকে চিনতে পারলাম। জয় গোস্বামী, পিনাকী ঠাকুর, শ্রীজাত, বিনায়ক, শিবাশিস, শ্যামলকান্তি, রূপক, চিরঞ্জীব, জয়দেব, সেবন্তী আর প্রায় তরুণী নবনীতা। আরও কেউ কেউ হয়তো ছিল। এরা সবাই নতুন কবিতা এনেছে এখানে পাঠ করার জন্য। বর্ষীয়ান কবিকে শোনাবার জন্য নয়। নিজেরাই নিজেদের কবিতা শোনাবে। এমনকী সেই কবিও একটু লাজুক মুখে বললেন, আমিও দুটো কবিতা নতুন লিখেছি। যদি তোমরা আমায় একটা চান্স দাও।
প্রথমটায় সেই কবিতা পাঠে আমি মনোযোগ দিতে পারিনি। মনটা খুবই চঞ্চল হয়েছিল। সে দিন সকাল থেকে নানা কুৎসিত ও বীভৎস ঘটনা শুনতে হয়েছে। শুনেছি, একটা ছোটদের স্কুলে কিছু অস্ত্রধারী (তারা ডাকাত না বিপ্লবী তা অবশ্য জানা যায়নি) ছাত্রদের সামনেই শিক্ষককে গুলি করে হত্যা করেছে। এখানে এই কবিতার আসরে সে সব ঘটনার চিহ্নমাত্র নেই। তাদের কবিতা যেমন নানা বিষয়ে, তেমনই তাদের পাঠেও গুরুগম্ভীর জ্যাঠামি নেই। আমার মনে এই প্রশ্ন এসে গেল, কবিতা কি মুছে দিতে পারে সমাজের এত গ্লানি? ক্রমে সব প্রশ্নটশ্ন ভুলে গিয়ে আমিও ডুবে গেলাম কবিতার রসে।
সেই দিনটি আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। তারপর থেকেই যখন কোনও সাংঘাতিক ঘৃণ্য ব্যাপার ঘটতে থাকে, যার প্রতিকার করার ক্ষমতা আমার নেই, শুধু শুধু মর্মযাতনা ভোগ করতে হয়, তখন আমি কোনও প্রিয় কবির কবিতার বই খুলে পড়তে শুরু করি। প্রথমে কয়েক মিনিট মন বসাতে পারি না, তারপর আস্তে আস্তে নিমজ্জিত হই কবিতার রসে। হ্যাঁ, কবিতার সেই শক্তি আছে। বাস্তবের নগ্ন দিকটা সে ভুলিয়ে দিতে পারে।
২৬. ৩. ২০১২