যা দেখি, যা শুনি – ৪০

অরসিকের প্রতি রস নিবেদন, ললাটে লিখো না, এই মিনতি

একটা গাছের ওপরের দিকে যদি কিছু ফল ফলে থাকে, তা হলে একজন লম্বা মানুষ হাত বাড়ালেই সেই ফল ছিঁড়ে নিতে পারে। কিন্তু একজন বেঁটে-বাঁটকুলও যদি সেই চেষ্টা করে, তা হলে তা দেখে লোকে হাসবে। সেই রকম, আমি একজন মূঢ় মানুষ হয়েও যদি কবি হিসাবে খ্যাতি পাওয়ার জন্য লালায়িত হই, তা হলে লোকের কাছে হাস্যাস্পদ হব।

এটা বিনয়-বচনের এক চরম উদাহরণ। কারণ, এ কথা যিনি বলছেন, তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং কবি কালিদাস। ‘রঘুবংশ’ রচনার আগে তিনি এ কথা লিখেছিলেন। মূল সংস্কৃতে অবশ্য মূঢ় মানুষের বদলে রয়েছে ‘মন্দঃ কবিযশঃ প্রার্থী’। বাংলায় ‘মন্দ’কথাটার অন্য অর্থ হয়ে যায়। এখন আর ‘রঘুবংশ’ ক’জনই বা পড়ে। তবু ‘মন্দ কবি যশ প্রার্থী’ এক কালে ব্যবহার করতেন বাংলার কিছু কিছু কবি। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেও বাংলা গদ্য রচনায় মাঝে মাঝেই ব্যবহৃত হত সংস্কৃত শব্দ বা প্রবাদ। পাঠকদের তা বুঝতে অসুবিধা হত না। কারণ, তখনও স্কুলে সংস্কৃত শিক্ষা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। আমি নিজেও সংস্কৃত পড়েছি। ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে। অবশ্য খুব একটা ইচ্ছের জোর ছিল না, তার কারণ, এই ভাষা শিক্ষার পদ্ধতিটা ছিল নীরস আর কৃত্রিম। প্রথমেই শব্দরূপ আর ধাতুরূপ মুখস্থ করতে হত। (নরঃ, নরৌ, নরাঃ ইত্যাদি) তবু যেটুকু শিখেছিলাম তা আজও কাজে লাগে।

অনেক প্রবাদের পশ্চাতেই থাকে একটা করে গল্প। পুরোটা লেখার দরকার হত না, একটা ছোট শব্দেই বাকিটা বোঝা যেত। যেমন, কাউকে জোর করে গলাধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া বোঝাতে শুধু লেখা হত, প্রহারেণ ধনঞ্জয়ঃ। এর পিছনে গল্পটা কী? এক সময় চার লাইনের পুরো শ্লোকটিই আমার মুখস্থ ছিল। হঠাৎ কিছু দিন আগে একটা লাইন হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিছুতেই আর মনে পড়ে না। কোনও জানা জিনিস স্মৃতি থেকে পালিয়ে গেলে খুবই অস্বস্তি হয়। কোথায় খুঁজে পাব, তা জানি না। মানুষের স্মৃতি খুবই দুর্বোধ্য আচরণ করে। খুব প্রয়োজনীয় কোনও বিষয় স্মৃতি থেকে পিছলে চলে যায়। আবার কোনও এলেবেলে কথা মনে গেঁথে থাকে। যা যা হারিয়ে যায়, তাঁর মধ্যে দু’একটি আবার ফিরেও আসে। যেমন, আজ সকালেই সেই হারিয়ে যাওয়া পঙ্ক্তিটি মগজে কেন যে ফিরে এল কে জানে?

গল্পটা এই, এক বাড়িতে চারটি কন্যার স্বামীই ঘরজামাই। খায়দায়, আরাম করে, কিছুতেই যেতে চায় না। জোর করে তো তাড়িয়ে দেওয়া যায় না, জামাই বলে কথা। এদের মধ্যে যার নাম হরি, সে এক দিন খেতে বসে দেখল, তার পাতে ঘি দেওয়া হয়নি। তাতে অপমানিত বোধ করে সে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গেল (হবিৰ্বিনা হরির্যাতি)। তার পর একদিন মাধব নামে জামাই দেখল, খাওয়ার জন্য তার আসন পেতে দেওয়া হয়নি, তখন সে-ও সরে পড়ল (বিনা পীঠেন মাধবঃ) পরের জামাই পুণ্ডরীকাক্ষ দেখল, তার ভাতে কাঁকর (কদনৈঃ পুণ্ডরীকাক্ষঃ)। শেষ জামাইটি আর কিছুতেই যেতে চায় না। কোনও অপমানই সে গায়ে মাখে না। তারপর এক দিন তার শালারা তাকে মারধর শুরু করতে সে পালাতে বাধ্য হল (প্রহারেণ ধনঞ্জয়ঃ)।

যস্মিন দেশে যদাচারঃ— একটা বহুব্যবহৃত উৎপ্রেক্ষা। অর্থাৎ যে দেশে যা আচারবিচার তা মেনে চলতে হয়। এর পিছনে কোনও কাহিনি নেই। কিন্তু রয়েছে এক বিচিত্র তালিকা। যেমন, মগধ দেশে মদ্যপানে কোনও দোষ নেই। কলিঙ্গে অন্ন বিচার আর যৌন বিচার নেই। ওড্র দেশে (এখন এর নাম অন্য কিন্তু সেটা আমি উল্লেখ করতে চাই না) ভ্রাতৃবধূ উপভোগে দোষ নেই। গৌড়ে মাছ খাওয়ার দোষ নেই। আর দ্রাবিড় দেশে মামাতো বোনকে বিয়ে করা যায়।

অনেক প্রবাদই কবি কালিদাসের নামে চলে। সেগুলির ঐতিহাসিক সত্যতা কতখানি, তা বলা শক্ত। এক দিন কবি যাচ্ছেন রাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভায় যোগ দিতে। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় তাঁর স্ত্রী বললেন, বাড়িতে কিন্তু চাল বাড়ন্ত, ও বেলা আমরা কী খাব, তার ঠিক নেই। বাড়িতে চাল নেই, টাকাপয়সাও নেই কালিদাসের কাছে। তবু রাজার ডাকে যেতে তো হবেই। বৈঠক চলছে অনেকক্ষণ, রাজা বিক্রমাদিত্য লক্ষ করলেন কালিদাস অন্য দিনের মতো হাস্যকৌতুকে যোগ দিচ্ছেন না। কবিতার লাইনও বলছেন না। রাজা জিজ্ঞেস করলেন, আজ তোমার কী হয়েছে কবি?

কবি বললেন, দারিদ্র হচ্ছে ছাই দিয়ে ঢাকা আগুনের মতো। তাতে গুণের স্ফুরণ হয় না। অন্নচিন্তায় কাতর হলে কবিতা আসবে কী করে? ‘অন্নচিন্তা চমৎকারা কাতরে কবিতা কৃতঃ।’ পৃথিবীর নানা ভাষার অনেক কবিই কখনও না কখনও এ রকম কথা উচ্চারণ করেছেন। ‘অন্নচিন্তা চমৎকারা’, চমৎকারা শব্দটির ব্যবহার অত্যাশ্চর্যজনক।

‘ন যযৌ ন তস্থৌ’— এই ব্যাপারটা বোঝাবার জন্য কোনও বাংলা শব্দ নেই। দেবী পার্বতী যখন মহাদেবকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার কল্পনায় গভীর তপস্যায় নিমগ্ন, তখন স্বয়ং শিব ছদ্মবেশে এসে দাঁড়ালেন তাঁর সামনে। এবং খুব শিব-নিন্দা করতে লাগলেন। পার্বতী তখন কানে হাত চাপা দিয়ে সে স্থান থেকে সরে যেতে চাইলেন। মহাদেবও ছদ্মবেশ খুলে দাঁড়ালেন তাঁর পথ রোধ করে। তখন পার্বতীর কী অবস্থা, তিনি যাওয়ার জন্য যে পা তুলেছিলেন, দাঁড়িয়ে রইলেন সেই ভাবে। এই সময়ের বর্ণনা দিতে কালিদাস লিখেছেন, নদী যখন কোনও পাহাড়ের কাছে গিয়ে আটকে যায়, তখন সে এগোতেও পারে না, আবার স্থির হয়েও থাকতে পারে না। পার্বতীর অবস্থা সে রকম, ন যযৌ ন তস্থৌ!

একটি প্রবাদ আমার ছেলেবেলা থেকেই প্রিয়। কোন অজ্ঞাত কবি এ রকম একটি মোক্ষম উক্তি করেছিলেন তা জানি না। ‘শিরসি মা লিখ’ পড়লেই সেটা মনে পড়ে যায়। কবি বিধাতাকে অনুরোধ জানিয়ে বলছেন, তুমি আমাকে যত রকম দুঃখ দিতে চাও, দাও। কিন্তু কোনও বেরসিকের কাছে রসের নিবেদন করার যে দুঃখ, তা আমার কপালে লিখো না, লিখো না। ‘অরসিকেযু রসস্য নিবেদনং শিরসি মা লিখ, মা লিখ।’

২৩. ৫. ২০১২

যে সব প্রশ্নের কিছুতেই উত্তর খুঁজে পাই না

কয়েকটি ব্যাপারে আমার মনের মধ্যে খটকা রয়ে গেছে, কিছুতেই তার উত্তর খুঁজে পাই না। কোনও রকম যুক্তি দিয়েও তা মেলানো যায় না।

প্রথমেই ধরা যাক, একজন শিক্ষিত মানুষ আর একজন অশিক্ষিত মানুষের মুখের ভাব আলাদা হয় কেন? এখানে আমি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা কিংবা উপকার বিষয়ে প্রবন্ধ ফাঁদতে বসিনি, কিংবা প্রকৃত শিক্ষা কাকে বলে, কিংবা পুঁথিগত শিক্ষার চেয়েও যারা নিরক্ষর হলেও, যারা জীবন ও প্রকৃতি থেকে উচ্চাঙ্গের পাঠ নিতে সক্ষম, তাদেরও শিক্ষিত বলা যাবে কি না, এই সব গূঢ় প্রশ্ন তুলতে চাই না। খুবই সাদামাঠা ভাবে, যারা স্কুল-কলেজে মাঝারি ধরনের শিক্ষা পেয়েছে, তাদের তুলনায় যারা এই শিক্ষার সুযোগ পায়নি কিংবা নেয়নি, তাদের মুখভঙ্গির কেন তফাত হয়ে যায়, তা নিয়েই খটকা। পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন একজনও নিরক্ষর মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, কিন্তু আমাদের দেশে এ রকম মানুষের সংখ্যা বিপুল। তাদের দেখলেই আমরা বুঝতে পারি। দু’চারটে ক্ষেত্রে ভুল হতেই পারে, তা ব্যতিক্রম হিসেবেই গণ্য। কী ভাবে আমরা এটা বুঝতে পারি, তার কোনও যুক্তি আমরা খুঁজে পাই না।

গ্রামের মানুষ আর শহুরে মানুষের মধ্যে এই তফাত? গ্রামের মানুষের মধ্যেই শিক্ষাহীনদের সংখ্যা বেশি, এটাও তো ঠিক। কিন্তু আজকাল গ্রামাঞ্চলে যেখানে শিক্ষার সুযোগ আছে, সেখানে অনেক ছেলেমেয়েই আগ্রহের সঙ্গে পড়তে যায়। কিশোরী মেয়েরা অল্পবয়সে বিয়ের বদলে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে, প্রায়ই তো এ রকম শোনা যাচ্ছে। আবার, গ্রাম থেকে জীবিকার খোঁজে যে-সব নিরক্ষর মানুষ শহরে আসে, শহরেই বহু বছর থেকে যায়, স্কুল-টুলে যাওয়ার সুযোগ নিতে পারে না, তাদেরও তো শুধু শহুরে হওয়ার সুবাদেই মুখের ছাঁদ বদলায় না। আমি এ রকম দু’চার জনকে চিনি। আবার গ্রামে বসেই যাঁরা পড়াশোনা করেছেন, তাদেরও মুখের ছাপ বদলে যায়।

শিক্ষা মানুষকে কী দেয়? আত্মবিশ্বাস? না, আমি এটা মানতে রাজি নই। অনেক শিক্ষিত মানুষকেই দেখেছি, অস্থির ও দুর্বল চিত্ত। এদের অনেকেই জ্যোতিষীদের কাছে যায়। শিক্ষা মানুষকে বৃহত্তর জগৎসংসারের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দেয় বলেই এ রকম পরিবর্তন ঘটে? ধনী কিংবা দরিদ্র, শহুরে বা গ্রাম্য, প্রত্যেক শিশুরই জন্মের পর কয়েক বছর মুখের ভাব একই রকম থাকে, তার পর তাদের মধ্যে যারা স্কুলে পড়তে যেতে শুরু করে, তাদের মুখের চামড়াও আস্তে আস্তে বদলে যায়, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? না!

ভাষা কিংবা ধর্ম বিশ্বাসের জন্যও কি মানুষের মুখচ্ছবি নানা রকম হতে পারে? শিশুদের কোনও ভাষা বা ধর্মবোধ থাকে না, সে সব আস্তে আস্তে অর্জন করতে হয়। সে জন্য তাদের পোশাক কিংবা ভাষারও পরিবর্তন হয়, কিংবা শারীরিক চিহ্ন, যেমন হিন্দু মাথায় টিকি কিংবা মুসলমানদের গোঁফবিহীন দাড়ি। এখন অবশ্য অনেক ধর্মীয় মানুষের ওই সব চিহ্ন আর থাকে না, পোশাকও একই রকম, দূর থেকে তাদের মুখের ভাষা না শুনেও, শুধু দেখে কী ভাবে বলা যাবে যে তারা কোন ধর্মের আশ্রিত? কোনও যুক্তি নেই, তবু এক-এক সময় বোঝা যায় কিন্তু।

টিভি’তে অন্য এক ভাষার ধারাবাহিক দেখতে দেখতে আমার স্ত্রী ওর নায়িকা সম্পর্কে বলেছিলেন, ওই মেয়েটাকে খুব বাঙালি-বাঙালি দেখতে!

এই বাঙালি-বাঙালি ব্যাপারটা কী? কিছু কাল আগেও বাঙালি হিন্দু রমণীদের শাড়ি পরার ধরন এবং ঘোমটা ছিল মুসলমান রমণীদের চেয়েও বেশ আলাদা, আর বাঙালি বাবুদের কোঁচা দোলানো ধুতি। কিন্তু এখন তো তা ঘুচে-মুচে গেছে। বিশেষ কোনও অনুষ্ঠান ছাড়া কাজের জীবনে হিন্দু ও মুসলমানের পোশাকের তফাত থাকে না, তাদের মুখের ভাষা না-শুনেও দূর থেকে তাদের চিহ্নিত করার কোনও উপায় থাকে না, তবু মাঝে মাঝে চেনা যায়ও ঠিক।

এর মধ্যে চেক রিপাবলিকের প্রাগ (প্রাহা) শহরে বইমেলা উপলক্ষে ভারতীয় লেখকদের একটি প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে আমাকে যেতে হয়েছিল। কয়েকটি সেমিনারে দর্শক বা শ্রোতা খুবই কম। কারণ, কোনও ভারতীয় ভাষার বোঝার তো কোনও প্রশ্নই নেই, অনেকেই ইংরিজিও জানে না, দোভাষীর মাধ্যমেও জমে না। আমাদের দোভাষিনীর ইংরেজি জ্ঞানও বেশ কম। অনুষ্ঠানের মধ্যপথে চার-পাঁচ জনের একটি দল এসে পেছন দিকে বসল। এখন পৃথিবীর সব দেশে কিছু না কিছু বাঙালি থাকে। এখানে এ পর্যন্ত কোনও বাঙালির সঙ্গেই যোগাযোগ হয়নি। ওই দলটির মধ্যে এক জন যুবককে দেখেই মনে হল, এ নিশ্চয়ই বাঙালি।

কী করে মনে হল? গায়ের রং দেখে বলা যায় যে সাহেব নয়, তবে ভারতের যে-কোনও রাজ্যের বা বাংলাদেশের বা পাকিস্তানের বা শ্রীলঙ্কার হতে পারে। সাধারণ প্যান্ট-শার্ট পরা। আলাদা কোনও রকম বৈশিষ্ট্যই নেই। নিজের মনকেই জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী করে ওকে বাঙালি ঠাওরালে? মন বলল, মনে তো হল। তার আমি কী করব? যুক্তিহীন বিশ্বাস আমি কোনও কালেই পছন্দ করি না, তাই নিজের মনের সঙ্গেই তর্কাতর্কি শুরু হল।

অনুষ্ঠানের শেষে সেই পাঁচ জন নারী-পুরুষের দল এগিয়ে এল মঞ্চের দিকে। যুবকটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদা, আপনি…। সে শুধু নয়, পাঁচ জনই বাঙালি। যুবকটি বাংলাদেশি, তাঁর নাম মামুন। সে এই শহরে একটা রেস্তোরাঁ চালায়। সেখানে আজ সন্ধেয় আমাদের আমন্ত্রণ।

তবু, কিছুতেই আমার খটকা মিটল না। কেন আমি তাকে বাঙালি বলে ধরে নিলাম? আগে থেকেই!

অতৃপ্তি এবং আগুন

শুনেছি, না শুধু শুনিনি, কৃষ্ণনগরবাসী বিখ্যাত গবেষক সুধীর চক্রবর্তীর একটি লেখায় পড়েছি, অমিয়নাথ সান্যাল তাঁর বাড়ির উঠোনে তাঁর রচিত গ্রন্থের স্তূপে নিজেই আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন। অমিয়নাথ সান্যাল আমার খুব প্রিয় লেখক, তাঁর একটি বই পড়ে আমি তাঁর ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম, যদিও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি কখনও। বইটির নাম ‘স্মৃতির অতলে’। উচ্চাঙ্গ সংগীতের কয়েক জন অসাধারণ শিল্পী ও ব্যক্তিত্বকে নিয়ে এমন মর্মস্পর্শী রচনা বাংলায় আগে কখনও লেখা হয়নি। আমি নিজে এই বই কয়েকটি কিনে কিনে বন্ধুদের উপহার দিয়েছি। কোন ক্ষোভে, কোন মর্মযাতনায় তিনি সেই রচনা আগুনে পুড়িয়ে দিলেন, তা জানি না। অবশ্য অনুমান করা শক্ত নয়।

সম্প্রতি ‘চরাচর সারে’ নামে একটি বই আমার হাতে এল। এর শেষ মলাটে লেখা আছে যে, এই লেখক দিবাকর ভট্টাচার্য তাঁর উত্তরাধিকারীদের স্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর সমস্ত লেখাপত্তর যেন আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তাঁর ছেলে রঞ্জন ভট্টাচার্য একজন প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক, তিনি বাবার নির্দেশ মানেননি। বারোটি গল্প নিয়ে একটি সংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে সদ্য। বইটি একবার আদ্যোপান্ত পড়া শেষ করে আবার পড়তে ইচ্ছে হয়েছে আমার, এমনই অসাধারণ সেই সব রচনা। যেমন ভাষাজ্ঞান, তেমনই চিন্তার গভীরতা। রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, তাঁর স্ত্রী— এই সব চরিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে।

তাঁর আসল নাম হরেরাম ভট্টাচার্য, জয়নগর মজিলপুরে জন্ম, উচ্চশিক্ষিত, সারা জীবনই প্রায় অধ্যাপনা করেছেন অর্থনীতিতে। ভাগ্যিস আগুন তাঁর রচনাগুলি ছুঁতে পারেনি। তাঁর অন্য রচনাও অবিলম্বে প্রকাশ হওয়া উচিত।

৬. ৬. ২০১২

সোনার জিভ, দুই চোখের মণিতে হিরে

গভীর নিশুতি রাত। চতুর্দিক নিস্তব্ধ। যেন সারা শহরের মানুষকে কোনও মন্ত্রবলে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। এখন কৃষ্ণপক্ষ, আকাশেও কোনও আলো নেই। একটা গাছ থেকে খসে-পড়া দুটি শুকনো পাতা, মাটিতে এ দিক ও দিক ঘুরঘুর করছে, শোনা যাচ্ছে সামান্য খরখর শব্দ, দিনের বেলায় এই শব্দ শোনাই যেত না, এখন মনে হচ্ছে বেশ জোরালো। এমনও মনে হতেই পারে যে এরা যেন জীবন্ত, কেউ দেখছে না বলেই এরা যেন খেলাধুলো কিংবা নাচে মেতে আছে।

সারা দিনের তুলনায় রাত্রির শহরের যেন কোনও মিলই নেই। দিনের বেলা অতি ব্যস্ত রাস্তা গাড়ি-ঘোড়া, মানুষের দৌড়াদৌড়ির শব্দে কানে তালা লাগিয়ে দেয়। এমনকী সুমধুর নিস্তব্ধতা আর অনাবিল মৃদু বাতাস।

এই রাস্তায় কিছু খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে, বোধহয় পাইপ-টাইপ কিছু বসানোর ব্যাপার। এখনও শেষ হয়নি। একটা জায়গায় কিছু ত্রিপলের স্তূপ উঁচু হয়ে আছে, মনে হয় দরকারি মালপত্তর কিংবা মেশিন টেশিন ঢাকা দেওয়া আছে। হঠাৎ দেখা গেল, সেই স্তূপ থেকে বেরিয়ে আসছে খুব সতর্ক ভাবে তিন জন মানুষ। আঠেরো থেকে তিরিশের মতো বয়স। চকচকে খালি গা, হাতে কী সব রয়েছে, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

এরা কারা?

আমাদের দেশের রাত্রিকে চারটে প্রহরে ভাগ করা হয়। এ বিষয়ে একটা হিন্দি ছড়া আছে। ‘পহেলা প্রহরমে সব কোই জাগে/দুসরা প্রহরমে ভোগী।’ অর্থাৎ রাত ন’টা দশটা পর্যন্ত প্রথম প্রহর। তখন মোটামুটি সবাই জেগেই থাকে। আর দ্বিতীয় প্রহরে মোটামুটি রাত সাড়ে বারোটা একটা। তখন প্রায় সবাই বিছানায় চলে যায়। তখন স্বামী স্ত্রী কিংবা যে কোনও নারী পুরুষের যৌনক্রিয়া বেশ ভাল জমে। তার পর ‘তিসরা প্রহরমে চৌরা জাগে/চৌঠা প্রহরমে যোগী।’

তৃতীয় প্রহরে শুধু চোর নয়, ডাকাত, খুনে, ধর্ষক, নারী পাচারকারী আর এই ধরনের মানুষজনদের কাজকর্ম শুরু হয়। মোটামুটি রাত দেড়টা থেকে চারটে। এখন রাত তিনটে। এই তিন জন লোক সেই তৃতীয় প্রহরের জীব।

দেওয়াল ঘেঁষে খুব সাবধানে এই তিন জন এগোতে লাগল সামনের দিকে। একটু পরেই ডান দিকে একটা বেশ পুরনো আমলের কালী মন্দির। অনেকেই বলে, এই রক্ষেকালী খুব জাগ্রত দেবী। এঁর পুজো দিলে মামলার জয়, সন্তানপ্রাপ্তি, সর্বরোগ-হর মাদুলি ইত্যাদি পাওয়া যায়। সারা দিন এখানে ভক্তদের ভিড় লেগেই থাকে। সামনের গেট বন্ধ হয় রাত দশটায়। আবার খোলে সকাল ছ’টায়। একজন মাত্র সেবাইত থাকে ভিতরে।

এই তিনজন প্রথমেই খুলে ফেলল গেটের তালা। এরা তালা খোলায় এক্সপার্ট। একটা গাবদা গোছের তালা তো এদের পক্ষে নস্যি। মন্দিরটার চার পাশে এরা এক পাক ঘুরতেই দেখা গেল সামনের চাতালটায় বসে আছেন সেই সেবাইত। ইনি কর্তব্যে অবহেলা করেন না। বিছানা পেতে শুতে যান না, সারা রাত বসে থাকেন ওই চেয়ারে। বসে থাকতে থাকতে যদি ঘুম এসে যায়, তাতে ইনি কী করবেন! এরা আগে থেকেই খবর নিয়েছে যে সেবাইত মহাশয়ের ঘুম খুব গাঢ়। এখন ওঁর গলায় একটা টিকটিকি ছুড়ে দিলেও ইনি জাগবেন না। তবু সাবধানের মার নেই। একজন কাছে গিয়ে ওঁর নাকে একটা ক্লোরোফর্ম ভেজানো ন্যাকড়া চেপে ধরল। এখন তিন চার ঘণ্টার জন্য নিশ্চিন্তি।

সারা মন্দির তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তেমন কোনও দামি জিনিস পাওয়া গেল না। এক দিনের প্রণামী বাবদ রয়েছে হাজার তিনেক টাকা। তাতে কি পড়তা পোষায়? তাও খুচরোই বেশি। আজকাল ওই সব খুচরো দোকানদাররা নিতে চায় না। ভিখিরিরাও প্রত্যাখান করে। মায়ের মাথায় একটা মুকুট, ভাল করে দেখলেই বোঝা যায়, আসল সোনা নয়, ঝুটো।

নিরাশ হতে হতে একজন চোর মূর্তির পিছন দিকে গিয়ে একটা ব্যাপার আবিষ্কার করে ফেলল। সেখানে রয়েছে আর একটা দরজা। সেটা খুলতেই দেখা গেল, সেখানে রয়েছে অপেক্ষাকৃত ছোট কালী মূর্তি। সেটার দিকে তাকাতেই প্রথমে চোখ ঝলমলিয়ে যায়। একে বলে গর্ভগৃহ। এখানে খুব কম মানুষেরই প্রবেশের অধিকার থাকে।

এখানে কোনও কিছুই নকল নয়। মাথায় সত্যিকারের সোনার মুকুট। গায়ের কিছু অলংকারও আসল। চোখ দুটি সোনার পাতের। মাঝখানে হিরে বসানো। জিভটাও সোনার। একমাত্র ধনী ভক্তরাই এখানে মায়ের পুজো দিতে পারে। নতুন নতুন গয়না গড়িয়ে দেয়। হিন্দু ধর্মে তো আছেই, যে যত বেশি পয়সা খরচ করতে পারে সে তত বেশি পুণ্য অর্জন করে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এই মূল কালীমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ওই তিন চোর কী করবে? ধরা যাক, এটা একটা ছোট গল্প। এর পর কী ঘটতে পারে? চোর তিনটে কি পটাপট মায়ের মূর্তি থেকে মূল্যবান গয়না খুলে নেবে? খুবলে নেবে চোখ দুটো? শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কিংবা সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় এর পর কী করতেন? এঁরা দু’জনেই আমার সমসাময়িক। আমি এঁদের দুজনেরই ভক্ত। এই দু’জনেই কালজয়ী লেখক তো বটেই, তা ছাড়াও তাঁরা গভীর ভাবে ধর্ম বিশ্বাসী। কয়েকটি ছিঁচকে চোর তাদের নোংরা হাতে জাগ্রত দেবী মূর্তির অঙ্গ স্পর্শ করবে, তা কি তাঁরা মেনে নিতেন? নিশ্চয়ই তাঁরা এখান থেকে গল্পের গতি ঘুরিয়ে দিতেন অন্য দিকে। কী ভাবে তাঁরা তা করতেন, তা আমি জানব কী করে? ওঁদের মতো কল্পনাশক্তি কিংবা ভাষাজ্ঞানও আমার নেই।

আমার অবস্থা খানিকটা শোচনীয়। আমার নাস্তিকতার কথা অনেকেই জেনে গেছে। কিন্তু আমি নাস্তিকতা প্রচারের জন্যও কোনও চেষ্টা করি না। একমাত্র আমার স্ত্রী ছাড়া আর কারও সঙ্গে তর্কও করি না এ বিষয়ে। আমার অবস্থান, কমলকুমার মজুমদারের গল্পের সেই ছোট ভাইটির মতন। যদিও আমি বুট জুতো পরে রান্নাঘরে খাওয়ার কথা ভাবি না। কিংবা কেউ কোনও পুজোর প্রসাদ দিলে তা থেকে পচা কলার টুকরো বেছে ফেলে দিয়ে বাকিটা বিনা আপত্তিতে খেয়ে ফেলি। কেউ যদি আমাকে এই বিষয়ে একটা গল্প লেখার জন্য অনুরোধ করতেন, আমি হাত জোড় করে বলতাম, ক্ষমা করবেন। এ বিষয়ে কিছু লেখার ক্ষমতা আমার নেই।

তবু খবরের কাগজে তো মাঝে মাঝেই মন্দির থেকে দেবদেবীর গয়না চুরির ঘটনা পড়ি। কিন্তু যারা ধরা পড়ে, তাদের নাম তো থাকে না। হিন্দু চোরদের পক্ষে এ কাজ কি সম্ভব? তারা এতটাই নির্ভীক আর নাস্তিক হয়ে গেছে? তবে কি এরা সবাই অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ? বাল্যকাল থেকেই যাদের মনে মূর্তি পুজো নিয়ে আবেগ তৈরি হয়নি, তাদের পক্ষে এই সব হিন্দু দেবদেবী সম্পর্কে ভয় বা ভক্তিসঞ্চারের সম্ভাবনাও থাকে না।

অন্য সম্প্রদায় বলতে যদি আমাদের নিকটতম প্রতিবেশীদের বোঝায়, তা হলে নাম-টামের উল্লেখ না-করাই ভাল। তাতে আবার অন্য ঝঞ্জাট সৃষ্টি হতে পারে। সাধারণ আইনে তাদের বিচার হওয়াই উচিত।

২০. ৬. ২০১২

শেক্সপিয়ার, বিবেকানন্দ এবং মহাভারত

আমার লেখার টেবিলের ঠিক সামনের দেওয়ালের র‍্যাকে কয়েকখানা বইয়ের মধ্যে রয়েছে একখণ্ডে শেক্সপিয়ারের সমগ্র রচনাবলি। তার মানে অবশ্য এই নয় যে আমি ওই বইটি মাঝে মাঝে পড়ি। অত শখ আমার নেই। এই সব বই সাজিয়ে রাখলেই ভাল দেখায়, মাঝে মাঝে শুধু ধুলো ঝাড়তে হয়।

কয়েক দিন আগে এক সকালে মনে হল, সেই বইটি নামিয়ে ম্যাকবেথ নাটকটিতে একবার চোখ বুলিয়ে নেব নাকি? কারণ, সে দিন সন্ধেবেলায় স্বপ্নসন্ধানী দলের প্রযোজনায়, কৌশিক সেনের পরিচালনা ও অভিনয়ে ম্যাকবেথ নাটকটি দেখতে যাওয়ার কথা। বইটির দিকে হাত বাড়িয়েও থেমে গেলাম। মনে হল, থাক দরকার নেই।

ম্যাকবেথের গল্প তো সবাই জানে। অনেক কাল আগে আমি মূল নাটকটি পড়েওছি কোনও কারণে, কিন্তু এখন অনেক কিছুই মনে নেই, অনেক চরিত্র ও সংলাপ, এখন বই পড়ার বদলে মঞ্চরূপ দেখলে নতুনের মতনই মনে হবে। সব শিল্প-সাহিত্যেই যে মৃদু সাসপেন্স থাকে তা-ও উপভোগ করা যাবে।

সেই গিরিশবাবুর আমল থেকেই শেক্সপিয়ার বাংলা রঙ্গমঞ্চে উপস্থিত। প্রধান প্রধান নাটকগুলির একাধিক অনুবাদ করেছেন অনেক বিশিষ্ট লেখক। রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক গৃহশিক্ষকের আদেশে ম্যাকবেথ অনুবাদ করতে শুরু করেছিলেন। প্রত্যেক দিন কয়েক পাতা করতেই হবে। যে দিন রবীন্দ্রনাথ ফাঁকি দিতে চাইতেন, সে দিন তাঁকে ঘরে আটকে রাখা হত। কয়েক পাতা অন্তত অনুবাদ না-দেখাতে পারলে তাঁকে ছাড়া হত না।

রবীন্দ্রনাথ পুরো নাটকটির অনুবাদ শেষ করতে পেরেছিলেন কি না, সে আমরা জানি না। কারণ সেটা পাওয়া যায়নি। তবে সেই অনুবাদের কয়েকটি পৃষ্ঠা সেই কিশোর কবি শোনাতে গিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর মশাইকে। বিদ্যাসাগর সে সম্পর্কে কী মতামত দিয়েছিলেন, তাঁর কোনও রেকর্ড নেই। (সেই সময় রবীন্দ্রনাথ অন্য এক শিক্ষকের প্ররোচনায় সংস্কৃত থেকে অনুবাদ করেছিলেন কালিদাসের নাটক কুমারসম্ভব। ওই বয়সে একই সঙ্গে দুটি ভাষার দুটি ক্লাসিক রচনার অনুবাদে ব্যাপৃত হওয়ার মতো অসাধারণ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর আর কোনও ভাষায় আছে কি?)

সৌভাগ্যবশত আমার সিটটা মৃণাল সেনের ঠিক পাশেই। ওঁর কত বয়স তা বোঝাই যায় না। তিনি এখনও নিয়মিত নতুন নতুন নাটক বা তরুণ পরিচালকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী ফিল্ম আর রুচিসম্মত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসেন। স্মৃতিশক্তি এখনও বিস্ময়কর। দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় তাঁর কাছে রয়েছে অনেক গল্পের ঝুড়ি। ম্যাকবেথ কে কে অনুবাদ করেছেন, সেই সব আলোচনা করতে করতে মৃণালদা বললেন, তাঁদের যৌবনকালে বঙ্গবাসী কলেজের এক অধ্যাপক (নাম উল্লেখ করছি না আমি) ম্যাকবেথের অনুবাদ করেছিলেন। মূল নাটকের এক জায়গায় ছিল ও হরর, হরর, হরর। (ম্যাকবেথের উক্তি) তার অনুবাদ ছিল ত্রাস, ত্রাস, ত্রাস। এর সমালোচনায় ইংরেজি স্টেটসম্যান পত্রিকা (এক সময় এই পত্রিকাটিকে বাঙালিরা বেশ ভক্তিশ্রদ্ধা করত) লিখেছিল, ট্র্যাশ, ট্র্যাশ, ট্র্যাশ।

এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে, কোনও রকম উপলক্ষ নেই, কোনও কিছু উদ্‌যাপনের দায় নেই, তবু কলকাতার রঙ্গমঞ্চে পুরোপুরি আধিপত্য করতে এসেছেন শেক্সপিয়ার। সুমন মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনয়ে সমৃদ্ধ কিং লিয়র। বিভাস চক্রবর্তীর সুদক্ষ পরিচালনায় আর সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মরণীয় অভিনয় এবং নতুন আঙ্গিকে হ্যামলেট। এই কৌশিক সেনের দলের ম্যাকবেথ। এ ছাড়াও রোমিও জুলিয়েট, মিড সামার নাইটস ড্রিম, অ্যাজ ইউ লাইক ইট-এর মতন আরও কয়েকটি নাটকেরও বিজ্ঞাপন দেখতে পাই। সত্যিই, হঠাৎ এত শেক্সপিয়ার কেন? ধন্য শেক্সপিয়ার।

কৌশিক সেনের অভিনয় প্রতিভার আমি অনেক দিন থেকেই ভক্ত। কয়েক দশক আগে ‘স্লুথ’ নামে একটি ইংরেজি নাটক খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ইংল্যান্ড-আমেরিকায়। তাতে দু’জন মাত্র অভিনেতা তিনটি চরিত্রে এক রুদ্ধশ্বাস রহস্য- কাহিনি জমিয়ে দিতেন। বাংলায় টিকটিকি নামে তার রূপান্তর মঞ্চস্থ হয়েছিল। তাতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতন অভিজ্ঞ ও দক্ষ অভিনেতার সঙ্গে সমানে টক্কর দিয়েছিলেন কৌশিক সেন এক তরুণ। আমি বিদেশে মূল ইংরেজি নাটকটি দেখেছি। আর কলকাতায় টিকটিকি। আমার মতে বাংলা নাটকটির রূপান্তর কোনও অংশেই কৃতিত্বে কম নয়, হয়তো বেশি। এর পর কৌশিকের দলের ‘মুখোমুখি বসিবার’ নামে ব্রাত্য বসুর নাটকটিতে অন্য রকম স্বাদ পেয়েছি। এখন তো কৌশিক থিয়েটার আর সিনেমায় সমান ভাবে সার্থকতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন।

কৌশিক সেনের মুখশ্রী ও কণ্ঠস্বরে বেশ নরম ও মায়াময় ভাব আছে। সম্ভবত সে জন্যই তাঁকে অন্তর্মুখী চরিত্রেই বেশ মানায়। সেই ইমেজটা বদলাবার জন্যই কি কৌশিক সেন ম্যাকবেথের মতন এক কঠোর রুক্ষ চরিত্রে নেমেছেন? তাতেও তিনি সার্থক হয়েছেন অবশ্যই। তবে দ্বিধাদীর্ণ ম্যাকবেথের দাপাদাপির মধ্যেও মাঝে মাঝে হঠাৎ সেই কোমল, মায়াময় রূপটি উঁকি মেরেছে।

বাংলায় ম্যাকবেথের নাট্যকার উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়। ইদানীং কালে তিনি নাট্যকার হিসেবে সুপরিচিত। এতেও তাঁর সংলাপগুলি বেশ স্বচ্ছন্দ। মুশকিল হচ্ছে, এই যে ম্যাকবেথ নাটকটিই বেশ নাটকীয়। সর্বক্ষণ টান টান হয়ে দেখতে হয়। এক এক দৃশ্যে মঞ্চে অনেক মানুষের উপস্থিতি এবং এ কালের ফিজিক্যাল অ্যাকটিং-এর মান্যতায় দৌড়াদৌড়িও অনেক আছে। এত সব চরিত্রের অভিনয়ে কোথাও কারও পদঙ্খলন ঘটেনি। উচ্চারণও নিখুঁত। এতে পরিচালকের পরিশ্রম ও সার্থকতারই পরিচয় পাওয়া যায়। লেডি ম্যাকবেথ সমেত অন্যান্য প্রধান চরিত্রগুলিও যথাযথ। স্বপ্নসন্ধানীর পরিবেশনায় এই ম্যাকবেথ সাম্প্রতিক কালের এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য নাটক হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত।

অতঃপর বিবেকানন্দ

রবীন্দ্রনাথের জন্মের দেড়শত বছরের উদ্‌যাপন সদ্য শেষ হল। এ বারে তাঁর থেকে দেড় দু’বছরের ছোট স্বামী বিবেকানন্দ এসে পড়লেন। তাঁকে কেন্দ্র করে নানান উৎসবের মধ্যে নাটকের স্থান থাকাও স্বাভাবিক। এর মধ্যেই দুটি নাটক দেখার সৌভাগ্য হল আমার। তার একটি চন্দন সেনের পরিচালনায় ‘যুগনায়ক’ অন্যটি গণকৃষ্টির প্রযোজনায় উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিলে।’ এর পরিচালক ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়।

বিবেকানন্দর জীবন নিয়ে নাটক রচনা খুব ঝুঁকিবহুল। সেই মহাপুরুষের অগণিত ভক্তদের শ্যেন দৃষ্টির কথা মনে রাখতেই হয়। কোনও রোমান্সের দৃশ্যের প্রশ্নই ওঠে না। নরেন দত্তর স্বামী বিবেকানন্দ হিসেবে রূপান্তর ছাড়া আর কোনও নাটকীয় ঘটনাই নেই। যত দূর সম্ভব না-ছুঁই পানিতে মাছ ধরতেই হয় এবং তা বক্তৃতাবহুল হতে বাধ্য।

‘যুগনায়ক’-এ কৈশোরের নরেন আর বিশ্ববিখ্যাত বিবেকানন্দর ভূমিকায় আছেন দু’জন অভিনেতা। আর ‘বিলে’ নাটকে আরও বাচ্চা বয়সের নরেন আর স্বামী বিবেকানন্দকে মুখোমুখি আনা হয়েছে বারবার। তাদের কাল্পনিক সংলাপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে অনেক ঘটনার। প্রথম দিকে যুগ্ম নাট্যকার মানস দাশগুপ্ত ও চন্দন সেনের এই পরিকল্পনা অভিনব মনে হয়েছে। শেষের দিকে তা খানিকটা কৃত্রিমতায় আক্রান্ত।

দ্বিতীয় নাটকটিতে বিবেকানন্দর ভূমিকায় আছেন দেবশঙ্কর হালদার। এই প্রতিভাবান অভিনেতার যে কোনও নাটক দেখার জন্যই আমি উন্মুখ হয়ে থাকি। কিন্তু এই নাটকে দেবশঙ্কর বিশেষ কোনও সুযোগ পাননি, যেন একমেটে মূর্তি, তাতে রং লাগেনি। যুগনায়ক নাটকে বিবেকানন্দর ধর্মীয় ভূমিকার চেয়ে প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর সমাজ সংস্কারকের পরিচয়। তাতে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন শান্তিলাল। দুটি নাটকই অবশ্য দ্রষ্টব্য।

এবং মহাভারত

এখনকার গ্রুপ থিয়েটারের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো সংস্থা বহুরূপী। ছেলেবেলা থেকেই এই দলের নাটক দেখছি নিয়মিত। এখন শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, সবিতাব্রত দত্ত, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, কুমার রায় নেই। তবু কয়েক জন নিষ্ঠাবান নাট্যপ্রেমিকের উদ্যোগে দল ভেঙে যায়নি, বরং নতুন নতুন নাটকের প্রযোজনায় এগিয়ে চলেছে। আমারই ভাগ্যদোষে গত কয়েক বছর বহুরূপীর কোনও নাটক আমার দেখা হয়নি। কয়েক দিন আগে হঠাৎ এই দলের নতুন নাটক ‘নানা ফুলের মালা’ দেখার সুযোগ এসে গেল।

নবীন নাট্যকার অলখ মুখোপাধ্যায়ের এই নাটকের পরিচালক দেবেশ রায় চৌধুরী, বিষয়বস্তু মহাভারতের একটি অংশের নতুন ইন্টারপ্রিটেশন। এতে দুর্যোধনকে নিছক ভিলেনই সাজানো হয়নি। নানা রকম ফুলের মালা একটি প্রতীক। সেই মালাটি বার বার কণ্ঠবদল করেছে।

দুর্যোধনের বক্তব্য এই যে, নানান রাজ্য মিলিয়ে এই দেশ। সেই সব রাজ্যের আলাদা আলাদা ভাষা, আলাদা সংস্কৃতি, সেই সব নষ্ট না-করে, সামগ্রিক ভাবে দেশ গড়ে ওঠে। তিনি তাই চেয়েছেন। কিন্তু যুধিষ্ঠির যে রাজসূয় যজ্ঞ করেছিলেন তাতেই বোঝা যায়, পাণ্ডবরা সাম্রাজ্যবাদী।

আমি নিজেকে এক জন ছোটখাটো মহাভারত বিশেষজ্ঞ মনে করি। (অবশ্যই আত্মশ্লাঘা ছাড়া আর কিছুই নয়। নাটকে বার বার দেশ শব্দটি উচ্চারিত শুনে আমার মনে হয়েছে, মহাভারতের সময়ে কেউ কি দেশ শব্দটি জানত? দেশাত্মবোধ সম্পর্কে কারওর কোনও ধারণা ছিল?

সে যেই হোক, ভিন্ন মত তো হতেই পারে। সামগ্রিক দৃশ্যগুলিতে এবং সু-অভিনয়ে নাটকটি বেশ উপভোগ্য। বহুরূপী তাদের পূর্ব সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছে।

৪. ৭. ২০১২

এ রাজ্যের পাহাড়ে বাংলা ভাষা থাকবে না?

এমন মানুষ কি আছে কোথাও, যে মাঝে মাঝে নিজের মনের সঙ্গে কথা বলে না? সেই সব অনেক কথাই নিজের স্ত্রী বা স্বামীকে কিংবা মাকে, খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুকেও বলা যায় না প্রকাশ্য উচ্চারণে। সে সব কথাই মনের মধ্যে গোপন থেকে যায়।

আমি তো যখন-তখন মনের সঙ্গে কথা বলি। কখনও মনের মধ্যেই একটা তর্কযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। অনেক চিন্তাই নিছক একমুখী হয় না। নানান শাখায় বিভক্ত হয়ে গোলমাল পাকায়। তারপর ঘুম আসে, তারপর স্বপ্নের মধ্যে এসে যায় অন্য একটা জীবন। স্বপ্নের কথা থাক, সেই সব মনে মনে কথার কয়েকটা টুকরো আজ প্রকাশ্যে লিখিত ভাবে রেখে যাওয়ার ইচ্ছা হল। অবশ্যই একান্ত ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে। লিখছি এই জন্য যে, আমি যা ভাবি, তা অন্য মানুষরাও কি সেই বিষয় নিয়ে ভাবে, এটা জানতে খুব কৌতূহল হয়। যেমন, বাঙালিরা কি আবার একটা বঙ্গভঙ্গ চায়? উনিশশো পাঁচ সালে ইংরেজরা একবার বাংলাদেশকে ভাঙতে চেয়েছিল। তার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ জীবনের প্রথম ও শেষ বার রাস্তায় নেমে, খালি পায়ে হেঁটে মিছিলে শামিল হয়েছিলেন। কয়েক বছর পর ইংরেজরা সেই বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়েছিল। আবার সাতচল্লিশে, এ দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় ইংরেজরা যাকে বলে পার্টিং কিক হিসেবে বাংলা ও পঞ্জাবকে ভাগ করে দিয়ে যায়। অবশ্য সে-সময়ের এ-রাজ্যের বাঙালিদের এবং সর্বভারতীয় নেতাদের অদূরদর্শিতা বা মূর্খতাও অনেকটা দায়ী। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথকে তা দেখে যেতে হয়নি। তিনি তার আগেই চলে গিয়ে বেশ করেছিলেন।

সেই দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গের ক্ষত কিন্তু এখনও মিলিয়ে যায়নি, বরং দগদগ করে। আমাদের এখনকার অনেক সমস্যার মূলেই আছে সেই বঙ্গভঙ্গ। এখন কি আমরা আবার এই পশ্চিমবাংলা থেকে খানিকটা করে অংশ কেটে নিয়ে গোর্খাল্যান্ড কিংবা কামতাপুরী গড়ার প্রস্তাব মেনে নেব? তার আগেই আমি চলে যেতে চাই। তার বেশি দেরি নেইও বোধহয়। কোথায় চলে যাব? বিস্মৃতির অনন্ত অন্ধকারে?

একটা রাজ্যের আয়তন যত ছোট হয়ে যায়, ততই সর্বভারতীয় রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সে রাজ্যের গুরুত্বও কমতে থাকে। তা তো সবাই জানে। স্বাধীনতার আগে অখণ্ড বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে, সংস্কৃতি-সাহিত্যে বাংলার স্থান ছিল অনেক উঁচুতে। এখন তা হু হু করে নীচে নেমে যাচ্ছে। এখনই ভারতের অনেক অংশে বিশেষত উত্তর ভারতে, হতমান বাঙালিদের নিয়ে অনেক ঠাট্টা তামাশা হয়। যাক, এ কথাটা তো খুবই সত্যি যে, পাহাড় অঞ্চলের উন্নতির উদ্যোগ অন্যান্য জায়গার চেয়ে অনেক কম হয়েছে। দার্জিলিং, কালিম্পং এবং কাছাকাছি বেশ কিছু অঞ্চলকে আমরা সমতলবাসীরা ভেবেছি অপূর্ব মায়াময় বেড়াবার জায়গা এবং আরও আরও অনেক কিছু। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবন যাপনের নানান সমস্যা নিয়ে আমাদের কোনও সরকারও বিশেষ মাথা ঘামায়নি। তিরিশ চল্লিশ বছর আগে দার্জিলিঙের পানীয় জলের অভাবের কথা শুনেছি। এখনও তা শোনা যায়। যাতায়াত ব্যবস্থারও তেমন কিছু উন্নতি হয়নি। এর মধ্যে পাহাড় জেগেছে, সেখানে তৈরি হয়েছে স্থানীয় দল, তারা অনেক রকম দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন প্রবল ভাবে শুরু করেছে। এবং প্রথম প্রথম এই ধরনের আন্দোলন বেশি বিশ্রী ও হিংস্র হয়। তাই খুনোখুনি ও কথায় কথায় বন্‌ধ। ক্রমশ এই আন্দোলনের নেতৃবর্গ নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, এই পদ্ধতিতে কোনও দাবি আদায় করা যায় না। আমরা পাহাড়ের নানান দাবির অনেকগুলিরই সমর্থক। শুধু একটি ছাড়া। পশ্চিমবাংলার মানচিত্রের কিছু কিছু অংশ ছুরি দিয়ে কেটে আলাদা রাজ্য গড়া যাবে না। কিছুতেই না। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন পেলে তাঁরা নিজেরাই অনেক দাবি মিটিয়ে ফেলতে পারবেন।

বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মাঝে মাঝেই পাহাড় অঞ্চলে যাচ্ছেন, ওখানকার নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন, তাতে যুদ্ধং দেহি ভাবটা নেই। বেশ একটা খোলামেলা ভাব তৈরি হয়েছে। সেটা বেশ ভাল ব্যাপার। মুখ্যমন্ত্রীর এই চঞ্চলতার সঙ্গে দৃঢ়তার মিশ্রিত ব্যবহার সত্যিই খুব প্রশংসা করার মতো। পাহাড়ের নেতারা অনেকেই মুখ্যমন্ত্রীর এই কূটনীতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছেন না। তাঁরা তাঁদের বাঘনখ লুকিয়ে রাখছেন এবং কিছু কিছু গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে নিচ্ছেন। সাধারণ মানুষ মুখ্যমন্ত্রীকে মনে করছেন তাঁদের আপনজন। তবে মাঝে মাঝেই পাহাড়ি নেতাদের কেউ কেউ বলে ফেলছেন, গোর্খাল্যান্ডের দাবি তাঁরা আপাতত মুলতুবি রাখছেন বটে, কিন্তু সেই মূল দাবি থেকে একটুও সরছেন না। এই উক্তির একটা গূঢ় অর্থ এই হতে পারে যে, মুলতুবির এ-সময় তাঁরা ভেতরে ভেতরে শক্তি সঞ্চয় করে নিচ্ছেন।

মুখ্যমন্ত্রী পাহাড়ি নেতাদের সঙ্গে কোন ভাষায় কথা বলেন? কোনও সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদনে দেখলাম, বৃহৎ জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী প্রথম কয়েকটা বাক্য বলেন, নেপালি ভাষায়। সেটা তো খুবই চমৎকার, সব মানুষই নিজেদের মাতৃভাষা অন্য কোনও ভাষাভাষীর মুখে শুনলে খুশি হয়। এক সময় সাহেবরাও যেমন কিছু কিছু বাংলা শিখে নিতেন। তারপর মুখ্যমন্ত্রী মূল বক্তৃতা দেন কোন ভাষায়? কোনও প্রতিবেদনেই আমি তার উল্লেখ দেখিনি। হিন্দি না ইংরাজিতে? বাংলা বললে তো ওরা প্রায় কেউই বুঝবে না। কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যদি নিজের রাজ্যেরই কিছু নাগরিকের সামনে নিজের ভাষায় কথা বলতে না-পারেন, সেটাকে আমি শুধু দুর্ভাগ্যজনক বলে মানতে রাজি নই, তা অত্যন্ত গ্লানিজনক।

দূরদর্শনের অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝে দেখি, পাহাড়ের বিশিষ্ট নেতারা সরকার পক্ষের বিভিন্ন মুখপাত্রের সঙ্গে কথা বলছেন হিন্দিতে কিংবা ইংরেজিতে। তাঁরা একটাও বাংলা শব্দ উচ্চারণ করেন না। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁদের এত বিরাগ কেন? আমরা জানি না, এই সব নেতা কি এই প্রজন্মেই নেপাল থেকে এসেছেন, না কয়েক পুরুষ ধরে আছেন এখানে, তাঁরা ভূমিপুত্র? যদি এই জন্মেই নেপাল থেকে এসে থাকেন, তবে তাঁদের কোনও দাবিতেই কর্ণপাত করা উচিত নয়। আর যদি জন্ম, কর্ম এখানেই হয়ে তাকে, তা হলে তাঁরা এতদিনে একটুও বাংলা শেখেননি? ভাইচুং ভুটিয়া এখানে খেলতে এসে দিব্যি বাংলা বলেন। এমনকী সাংমা যিনি রাষ্ট্রপতির পদের অন্যতম প্রার্থী, তিনি কিছু বছর কলকাতায় ছিলেন বলে কিছু কিছু বাংলা বলার চেষ্টা করেন। আর দার্জিলিঙের নেপালিরা এক বর্ণও বাংলা জানবেন না?

বেশ কিছু বছর আগে এক দিন দার্জিলিঙের নেপালি ভাষার এক সাহিত্যিক আক্ষেপের সঙ্গে আমাকে বলেছিলেন, আমি স্কুলে বাংলা পড়েছি, তাই আমি রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়তে পারি। বাংলা ভাষায় যে অনেক বিশ্বমানের রচনা আছে, তা তো অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এখনকার নেপালি ছেলেমেয়েরা ইস্কুলে বাংলা পড়ে না। তাই তারা বাংলা সাহিত্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর জন্য আপনারাই দায়ী। এখনকার পাহাড়ি অঞ্চলের স্কুলগুলিতে বাংলা পড়া লেখা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে কিনা, তা আমার জানা নেই। তবে কলকাতার কিছু কিছু স্কুলে বাংলা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় আছে, তা জানি।

সেই জন্য আমরা এ রাজ্যের সব স্কুলে অন্তত ক্লাস এইট পর্যন্ত বাংলা পাঠকে আবশ্যিক করার জন্য এক সময় আন্দোলন করেছি। বাংলা ভাষার অনেক প্রসিদ্ধ লেখক ও বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে কিছু কিছু পথ আমিও হেঁটেছি এই দাবি নিয়ে বিভিন্ন মিছিলে। ভারতের অনেক রাজ্যেই এই ব্যবস্থা আছে। মহারাষ্ট্রের সব স্কুলে মরাঠি ভাষাকে অন্যতম বিষয় হিসাবে নেওয়া বাধ্যতামূলক। এই প্রসঙ্গ নিয়ে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছি। মুম্বই শহরের গুজরাতিরা যে একটা শক্তিশালী গোষ্ঠী, তা সবাই জানে। এঁদের দ্বারা পরিচালিত কিছু কিছু স্কুলে মরাঠি ভাষার বদলে গুজরাতি ভাষা পাঠ্য। তা নিয়ে মহারাষ্ট্রে সরকারের সঙ্গে এই সব স্কুলের কর্তৃপক্ষের অনেক রকম মামলা মোকদ্দমা হয়। শেষ পর্যন্ত তা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। সুপ্রিম কোর্টের রায় মহারাষ্ট্রের সরকারের পক্ষেই যায়। রায় দিয়ে বিচারক মন্তব্য করেছিলেন, কোনও রাজ্যে যদি অন্য রাজ্য থেকে কেউ এসে চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য থাকতে চান, তা হলে তাঁদের এবং তাঁদের ছেলেমেয়েদেরও সেই রাজ্যের ভাষা শিক্ষা করা আবশ্যকীয় হওয়া উচিত। নইলে তাঁরা সেই রাজ্যের প্রধান ভাষাগোষ্ঠীর মানুষজনের সঙ্গে সাবলীল ভাবে মেলামেশা করতে পারবেন না।

আমরা পশ্চিম বাংলায় এই নীতি প্রবর্তনের জন্য আন্দোলন করেছি। কিছু রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও গেছি দাবিপত্র নিয়ে। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বুঝেছি, তাঁরা কেউই নীতিগত ভাবে এর বিরোধী নন, তাঁরাও বাংলা সাহিত্যকে ভালবাসেন। তবু কেন যে, তাঁরা ইতস্তত করছিলেন, এই নীতি কার্যকর করতে পারেননি, তা আজও আমার বোধগম্য নয়।

রাজ্যে এখন নতুন সরকার এসেছে। তারা বাংলা ভাষা প্রচারের জন্য এই শিক্ষা নীতি স্কুলে প্রবর্তন করার উদ্যোগ নিতে পারে না? এই নিয়ে যদি আন্দোলন করতে হয়, তবে সে দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে। আমাদের অনেকেরই এখন অন্তরালে চলে যাওয়ার সময় এসে গেছে।

১৮. ৭. ২০১২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *