স্বপ্ন দেখা এবং আমার ভয়ে কেঁপে ওঠা
কেশবচন্দ্র সেনের মেয়ে সুনীতির সঙ্গে কোচবিহারের রাজকুমারের বিয়ে উপলক্ষে বাংলার সমাজে আর সাংস্কৃতিক জগতে যে প্রবল আলোড়ন চলেছিল, তা অনেকেই জানেন। কবে, বিয়ের রাতে এবং নববধূ হিসেবে রাজপ্রাসাদে গিয়ে সুনীতি কী অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা কিছুটা অস্পষ্ট। শেষ জীবনে সুনীতিদেবী একটা আত্মজীবনী লিখেছিলেন ইংরেজিতে। তার থেকে অনেক তথ্য জানা যায়।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রবর্তিত ব্রাহ্ম ধর্মের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র কেশবচন্দ্র। শিক্ষিত, মুক্তচিন্তার অধিকারী এবং উদ্যমী পুরুষ। সেই সময় হিন্দু ধর্ম নানা রকম কুসংস্কার, কদাচার ও কুপ্রথায় জর্জরিত। রূপকার্থে বলা যায়, হিন্দুত্বের গা থেকে পচা গন্ধ বেরোচ্ছে। সেই সময় ব্রাহ্মরা নতুন আলোর সন্ধান দিয়েছিলেন। ব্রাহ্মরা যদিও বলতেন যে, তাঁদের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁরা নতুন এক ধর্মে দীক্ষিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা হিন্দুধর্মেরই এক পরিচ্ছন্ন ও সুসংস্কৃত রূপ।
একেশ্বরবাদ কিন্তু হিন্দু ধর্মেও একেবারে অপরিচিত নয়। ব্রাহ্ম ধর্ম যদি প্রবল ভাবে প্রচারিত হত, সাধারণ মানুষকে সহজ ভাবে আকৃষ্ট করা যেত, তা হলে সেই সময়কার ইতিহাস অন্য রকম হত।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই নব্য ধর্ম হয়ে রইল ওপরতলার মানুষদের ব্যাপার, এলিটিস্ট। খ্রিস্টানরা তাদের গৃহভৃত্য কিংবা ক্রীতদাসদেরও নিজেদের ধর্মে টেনে আনত। মুসলমানরা, যে হেতু তাদের ধর্মে বর্ণভেদ নেই, অস্পৃশ্যতা নেই, তাই সমস্যাদীর্ণ হিন্দু সমাজের তথাকথিত নিচুতলার মানুষ শূদ্র এবং অন্যান্যরা বামুন কায়েতদের অত্যাচারে ও অপমানে অস্থির হয়ে দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। আর হিন্দু ধর্মে নতুন কাউকে আহ্বান তো নেই-ই, নিজেদের ধর্ম থেকে বহু মানুষকে ঠেলে বার করে দিয়েছে, সামান্যতম কারণে।
আরও দুঃখের কথা, নতুন ব্রাহ্ম ধার্মিকরা নিজেদের দৃঢ় ভাবে সংগঠিত করার আগেই দলাদলি আর বিচ্ছেদ শুরু করে দেয়। দেবেন্দ্রনাথের তুলনায় কেশবচন্দ্র অনেক আধুনিক চিন্তাধারার অধিকারী। দু’জনের মধ্যে মতভেদ শুরু হয়। এক সময় আদি ব্রাহ্ম সমাজ থেকে সদলবল বেরিয়ে এলেন কেশবচন্দ্র। নিজে আলাদা দল গড়লেন, ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ। এক থেকে হল দুই, আর কিছু কালের মধ্যেই এই সমাজ তিন টুকরো হয়ে যাবে। দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে কেশবচন্দ্রের এই বিরোধের অনেক কারণ আছে। আত্মজীবনীতে সুনীতি লিখেছেন, অন্যতম কারণ— দলের মধ্যে তাঁর বাবার বিপুল জনপ্রিয়তা দেখে মহর্ষি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। (মহাপুরুষদেরও ঈর্ষা হয়?)
কেশবচন্দ্র তাঁর নতুন দল নিয়ে অনেক সমাজ-সংস্কারে ব্রতী হন। বিশেষত, নারীদের মুক্তির ব্যাপারে তাঁর উদ্যোগ বিশেষ প্রশংসনীয়। তখনকার দিনে আট, ন’বছর বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। লেখাপড়া শেখার বিশেষ সুযোগ ছিল না। বাকি জীবন অন্তঃপুরে বন্দিনী হয়ে থাকাই ছিল তাদের নিয়তি। এর মধ্যে আবার বিধবা হয়ে গেলে তো তাদের উপর অত্যাচার এবং নিষ্ঠুরতার কোনও সীমা থাকত না।
কেশবচন্দ্র নারীদের শিক্ষার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। বাল্যবিবাহ রোধ করতে না-পারলে এই শিক্ষাও অর্থহীন। মেয়েদের বিয়ের বয়স হওয়া উচিত অন্তত চোদ্দো বছর আর ছেলেদের আঠারো। দলবল সমেত কেশবচন্দ্রের আন্দোলনের ফলেই সরকার বিয়ের এই বয়সের সীমা মেনে নিয়ে বিবাহ বিষয়ে একটা আইন জারি করে। লোকের মুখে মুখে তার নাম হয়ে যায় তিন আইন। এটা কেশবচন্দ্রেরই জয়।
কিন্তু এর পর কী হল? কোচবিহারের রাজবাড়ি থেকে যুবরাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে কেশবচন্দ্রের বড় মেয়ে সুনীতির বিয়ের প্রস্তাব এল। কিন্তু সুনীতি তখনও চোদ্দো বছরে পৌঁছাননি। আর নৃপেন্দ্রনারায়ণেরও বয়স আঠারোর কম। তবু কেশবচন্দ্র এই বিয়ের প্রস্তাব মেনে নিলেন।
প্রথমে সবাই হতবাক হয়েছিল। বিয়ের বয়সের সীমা নিয়ে কেশবচন্দ্র যে আন্দোলন করেছিলেন, নিজেই তা ভাঙতে রাজি হয়ে গেলেন? বাংলার সমাজে এটা একটা দারুণ আলোচনা ও নিন্দামন্দের প্রধান বিষয় হয়ে উঠল। কেশবচন্দ্র রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য এত দুর্বল হয়ে গেলেন কেন?
রাজপরিবার থেকে আরও দাবি জানানো হল যে, বিয়ের অনুষ্ঠান হবে হিন্দু মতে। এবং কেশবচন্দ্র নিজে কন্যা সম্প্রদান করতে পারবেন না। কারণ, তিনি এর আগে বিলেতে গিয়েছিলেন, সে জন্য জাতিচ্যুত। হিন্দু পুরোহিতরা এসে এই বিবাহ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন।
আসলে এই অভিনব বিয়ের প্রস্তাবের পিছনে ছিল ইংরেজ সরকারের কারসাজি। কোচবিহার তখনও পুরোপুরি ইংরেজদের অধীন না-হলেও রাজপরিবারের অনেক বিষয়েই কলকাঠি নাড়েন ইংরেজ প্রতিনিধিরা। তাঁদের ইচ্ছা ছিল, নৃপেন্দ্রনারায়ণকে তাঁরা বিলেতে ঘুরিয়ে আনবেন। আর রাজকুমারের স্ত্রী কিছুটা ইংরেজি জানবে। এবং বড় বড় রাজপুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারবে।
তখন কেশবচন্দ্রের পরিবারের মেয়েরাই ছিল প্রগতিশীল। পাত্রপক্ষ যা চাইবে তাই শুনতে হবে। এর প্রতিবাদ করার সুযোগ কেশবচন্দ্রের নেই। শুধু তিনি চাইলেন রাজপরিবার থেকে একটা ঘোষণা যে, নৃপেন্দ্রনারায়ণ এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী এবং বহুবিবাহের বিরোধী। নৃপেন্দ্রনারায়ণ বিলেত যাবেন বলেই এই বিয়ের ব্যবস্থা দ্রুত সেরে ফেলতে হবে।
এই উপলক্ষে কেশবচন্দ্র বার বার অপমানিত হয়েছিলেন এবং মেনেও নিয়েছিলেন।
বিয়ের রাত্তিরেও নানা রকম মতবিরোধ হয়েছিল। বিয়ে প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। সুনীতির মা চাইছিলেন, বিয়ের অনুষ্ঠান ছাঁটাই করে সংক্ষিপ্ত ভাবে যেন কিছু ব্রাহ্ম প্রথাও অনুসৃত হয়। আর রাজমাতা ধরে বসে রইলেন যে, বিয়ে হবে। পুরোপুরি হিন্দু মতে। হিন্দু মতে না-হলে তা সিদ্ধ হবে না। সুনীতিও মহারানির মর্যাদা পাবেন না। এবং সুনীতির মাকে বেশ অপমানজনক ভাষায় এ সব শুনতে হল।
এই তর্কাতর্কিতে বিয়ের সব অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে গেল। বিয়ের সব আলোর রোশনাই ও সাজসজ্জা, সব বন্ধ হয়ে গেল। সুনীতির লগ্নভ্রষ্টা হওয়ার উপক্রম হল। বাংলার সমাজে লগ্নভ্রষ্টা কুমারীদের যে কত রকম অপমান ও নির্যাতন সইতে হয়, তা অনেকেই জানেন।
পরে রাত তিনটের সময় আর একটা লগ্ন ছিল। রাজকুমার ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে ডেকে তোলা হল। কেশবচন্দ্রকে নিয়ে আসা হল বিবাহবাসরে। কেশবচন্দ্র সবই মেনে নিলেন। নমো নমো করে বিয়ে হয়ে গেল। এর পরেও কোচবিহারের রাজবাড়িতে সুনীতিকে অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছে।
তিনি যখন গর্ভবতী হন, তখনই জেনে গিয়েছিলেন পুত্রসন্তান না-জন্মালে সে রানিকে অপয়া মনে করা হয়। তার প্রতি আকারে-ইঙ্গিতে প্রচুর বিদ্রুপ বর্ষিত হয়। কিন্তু সন্তান ছেলে না মেয়ে, তা তো জানার কোনও উপায় ছিল না। শেষের দিকে একটা মাস সুনীতির নিদারুণ উৎকণ্ঠার মধ্যে কেটেছিল। সুখের বিষয়, সুনীতির প্রথম সন্তানটি তো ছেলেই হয়।
এ দিকে কেশবচন্দ্র সেনের এই কাণ্ডের পর, ব্রাহ্ম ধর্মের তরুণ নেতারা খুবই আহত বোধ করেন। আবার এই সমাজ ভেঙে তৃতীয় একটি দল তৈরি করেন শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ। সেটার নাম দেওয়া হয় সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ। অর্থাৎ এক প্রজন্মের মধ্যেই ব্রাহ্মদের দল তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এদের নিয়ে সুদূরপ্রসারী কোনও ব্যবস্থার প্রবর্তন করার সম্ভাবনা ছিল না।
সুনীতির ইংরেজি আত্মজীবনীটি আমি এখনও পড়ার সুযোগ পাইনি। তবে ‘বলাকা’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকায় চিত্ররেখা গুপ্ত ওই বইটি সম্পর্কে একটি বিস্তৃত প্রবন্ধ লিখেছেন। তার থেকে আমি অনেক কিছু জেনেছি।
ধনঞ্জয় ঘোষালের সম্পাদনায় ‘বলাকা’ একটি বিশেষ ধরনের পত্রিকা। গল্প-উপন্যাসের পরিবর্তে কোনও একটি বিষয়ের উপর মূল্যবান লেখা আমি এই পত্রিকায় দেখেছি। যেমন, এই সংখ্যার বিষয় ‘নবচেতনায় বঙ্গনারী’। এই সংখ্যাটি নারীস্বাধীনতা বা নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের অবশ্য সংগ্রহযোগ্য।
‘কোরক’ পত্রিকাটিও প্রতি সংখ্যার বিষয় ভিত্তিক। তাদের নতুন সংখ্যাটির বিষয়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, তাঁর রচনা ও জীবন। বাংলা ভাষার এখনকার প্রবীণতম কবি নীরেন্দ্রনাথ আজও সৃষ্টিশীল।
স্বপ্ন দেখে আমার ভয়
এই লেখাটি লেখার পর রাত্তিরে আমি বেশ বড় আকারের একটা স্বপ্ন দেখলাম। রাস্তায় একটা মিছিল বেরিয়েছে, তা এগিয়ে আসছে আমারই বাড়ির দিকে। সেই মিছিলে একজনও পুরুষ নেই, সবই নারী। কাছাকাছি আসার পর তাদের স্লোগান শুনে আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম। এরা বলছে, আগামী পাঁচ বছর কোনও পুরুষ লেখকের কোনও কিছু লেখার অধিকার থাকবে না। সকলের কলম কেড়ে নেওয়া হবে। মিছিলে বেশ কয়েকটি পরিচিত মুখও দেখলাম।
আমি নীচে নেমে গিয়ে সেই মিছিলের সামনে দু’হাত তুলে বললাম, পুরুষদের লেখা বন্ধ? অনেক পুরুষই তো নারীস্বাধীনতার বিষয়ে লেখে। আমি নিজেকে একজন কট্টর নারীবাদী বলে মনে করি। লেখা বন্ধ হয়ে গেলে আমি বাঁচব কী নিয়ে?
৭. ৩. ২০১২
কবিতা থেকে নাটক, এক সুদীর্ঘ যাত্রা
বরিশাল শহর ছেড়ে ঠিক স্বাধীনতার বছরেই কলকাতায় চলে আসে একটি চোদ্দো বছরের ছেলে রোগা লাজুক, দারুণ রকমের বই-পড়ুয়া। তখনই হয়তো বোঝা যায়নি যে, এই ছেলেটি বাংলা সাহিত্যের জন্য বলিপ্রদত্ত। সারা জীবন সে বাংলা সাহিত্যের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে পারবে না। কবিতা লেখা থেকে শুরু, সিটি কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ার সময় সে একটা ছোটখাটো কবিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। তখন কৃত্তিবাস পত্রিকাকে ঘিরে এই গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। মোহিত চট্টোপাধ্যায় চলে আসে তার সামনের সারিতে। তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘গোলাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ তাকে বিশেষ খ্যাতিমান করে তোলে।
ছাত্রজীবন শেষ করার পর কবিদের কোনও না কোনও জীবিকা নিতেই হয়। দায়িত্ব নিতে হয় সংসারের। অধিকাংশ কবিই স্কুল বা কলেজে পড়াবার খোঁজে, কেউ বা ঢুকে পড়ে সংবাদপত্রের অলিন্দে। সংবাদপত্র অনেক সময় গিলে ফেলে কবিকে। শিক্ষকতা বা অধ্যাপনাও অনেক সময় কবিকে করে তোলে গদ্যময়। সারা জীবন সাহিত্যকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকা খুব শক্ত ব্যাপার। কিন্তু মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের তো উপায়ও নেই, ইচ্ছে করলেও সে সাহিত্য থেকে সরে যেতে পারবে না।
অধ্যাপনার কাজের মধ্যেও কবিতা লিখতে লিখতে সে এক সময় ঝুঁকে পড়ে নাটকের দিকে। তার প্রথম নাটক, ‘কণ্ঠনালীতে সূর্য’। এক সময় সে কবিতা খুব কম লিখে নাট্য রচনাতেই মনোযোগ দেয় বেশি। সেই সময় তার কবি বন্ধুরা অনেকেই আফসোস করে বলত, বাংলা কাব্যজগৎ একজন প্রতিভাবান কবিকে হারাল। আমিও সে রকমই ভেবেছিলাম। পরে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের এই রূপান্তর তার ব্যক্তিগত সাফল্যের চেয়েও অন্য দিকে এক বিশেষ ঐতিহাসিক তাৎপর্য আনে।
সেই ষাট সত্তরের দশকে বাংলা নাটকের অবস্থা কী ছিল? উত্তর কলকাতার পেশাদারি নাট্যদলগুলো টিমটিম করছে কিংবা ভেঙে পড়ছে। আর অন্য দিকে, বিপুল উদ্দীপনায় শুরু হয়েছে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন। নতুন আঙ্গিক, আধুনিক চিন্তাধারা, বিষয় অনুযায়ী মঞ্চসজ্জা, অতি-নাটকীয় কিংবা গলাকাঁপানো অভিনয় ধারার পুরো পরিবর্তন। কিন্তু কী নাটক তারা মঞ্চস্থ করছে। হয় রবীন্দ্রনাথ অথবা কোনও প্রকাশিত উপন্যাসের নাট্যরূপ। অথবা কোনও বিদেশি নাটকের ভাবানুবাদ। তৃতীয়টাই বেশি।
এক সময় বের্টোল্ট ব্রেখটের দুটি নাটক একই সঙ্গে মঞ্চস্থ করছিল দুটি দল। মৌলিক বাংলা নাটক কোথায়? শিশিরকুমার ভাদুড়ী মাঝে মাঝে হাহাকার করতেন, নতুন সার্থক বাংলা নাটক তিনি পেলেন না। অতিশয় দুর্বল কিছু নাটকে তাঁর অভিনয়-প্রতিভা নষ্ট হয়েছে।
বিদেশি নাটককে বাংলার ঘরে আনা দোষের কিছু নয়। তাতে আমাদের নাট্যজগৎই সমৃদ্ধ হয়। তবে একটাও মৌলিক নাটকের দেখা নেই। শুধু নির্ভর করতে হবে বিদেশি নাটকের উপর? এ রকম অবস্থা লজ্জাজনক নয়? এই সময় মোহিত চট্টোপাধ্যায় একটার পর একটা নাটক লিখতে শুরু করে। তার প্রথম দিকের কয়েকটি নাটকের সংলাপে একটু বেশি বেশি কাব্যিক ভাব থাকলেও অচিরেই সে নতুন ভাষা আয়ত্ত করে। তার নাটকগুলো মঞ্চে সাফল্য পায়। নাট্যকার হিসেবে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের সাফল্য যত না ব্যক্তিগত, তার চেয়েও বেশি ছিল বাংলার নাট্যজগতে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন যোগ্য নাট্যকারকে পাওয়া।
অবশ্য শুধু মোহিত নন, প্রায় এক সময়ে নাট্য রচনা শুরু করেন বাদল সরকার, মনোজ মিত্র, রমাপ্রসাদ বণিক, ব্রাত্য বসু এবং আরও কয়েকজন। এখন দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলা যায়, বাংলা নাটকের দৈন্যদশা কেটে গেছে। আমরা বেশ কিছু সার্থক, স্মরণীয় বাংলা মৌলিক নাটক পেয়েছি।
মোহিতের নাটকের সংখ্যা একশোর এদিক-ওদিক। বিষয় বৈচিত্রেও উপভোগ্য। তার সাম্প্রতিকতম নাটকটির নাম— তথাগত। ‘রঙ্গপট’ প্রযোজিত এই নাটকটি দেখতে যাওয়ার আগে মনে আশঙ্কা ছিল, মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ব না তো? মহাপুরুষদের জীবন আলেখ্য নিয়ে এই সংশয় থাকতেই পারে। কারণ, ঘটনাগুলো আমাদের জানা। গৌতম বুদ্ধের জীবনীতে তেমন কোনও টানাপড়েন নেই, উচ্চকণ্ঠ নেই, রোমান্টিক দৃশ্যের অবতারণার সুযোগ নেই। এখানেই মোহিতের প্রধান কৃতিত্ব এই যে, এমন একটি শান্ত রসের নাটকেও আমাদের মনোযোগ একবারও বিচলিত হয়নি। বুদ্ধের ভূমিকায় ডাক্তার তপনজ্যোতি দাস একই সঙ্গে সংযমী ও দৃঢ়। অন্যরাও বিশ্বাসযোগ্য। শেষ দৃশ্যটি অবিস্মরণীয়।
মোহিত এখন বেশ অসুস্থ। সে নাকি বলেছে, এত পরিশ্রম করে এ রকম পূর্ণাঙ্গ নাটক রচনা তার ইহজীবনে আর সম্ভব হবে না। এই শেষ নাটকটিই তার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক। তিনি অবিলম্বে সুস্থ হয়ে উঠুন, এ রকম আশা করা যেতেই পারে। তার চেয়েও বড় কথা, এমন কঠিন রোগকেও সহ্য করে শক্তি অর্জন করা।
মোহিতের কবিতার এক টুকরো নিদর্শন:
বুকের ওপর একটা খবরের কাগজ পড়ে আছে
লোকটি খবরের কাগজ চাপা পড়ে মরে যায়নি তো?
কাগজের চেয়ে খবরের ওজন কোটিগুণ ভারি!
অথচ গল্পের একটা ফল দেখুন
একটা কথা পর্যন্ত না বলে ধীরে ধীরে রসে ভরে ওঠে।
ভালোবাসা পেলেই না সুন্দর সহজ হাঁটা
ইচ্ছা সুখের ছায়া পড়বে
বুকের মধ্যে গোপন পাখি ডানা মেলে
বাইরে আসবে। মুঠোর মধ্যে আয়না ধরো।
দু’হাত মেলে বাতাস ধরো—উড়ে যাবে।
(কমল সাহা রচিত ‘হৃদয়ের থেকে ভালো বাসভূমি নেই’ গ্রন্থ থেকে কিছু তথ্য সংগৃহীত।)
২১. ৩. ২০১২
দুটি বিস্ময়: অ-সাধারণ অভিজ্ঞতা
যত দূর মনে পড়ে বুদ্ধদেব বসুর একটি নিবন্ধে লিটল ম্যাগাজিন-এর উল্লেখ আর কিছুটা পরিচিতি ছিল। তার আগেও অনেক ছোট ছোট সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হত, কিন্তু সেগুলির কোনও ডাক-নাম ছিল না। এখন লিটল ম্যাগাজিন বহুলপ্রচারিত। অ-ব্যবসায়িক, সাহিত্য নিয়ে অনেক পরীক্ষা, নিরীক্ষা, অপরিচিত প্রতিভাবানদের তুলে ধরা, এই সবই এ ধরনের পত্রিকার চরিত্র। ম্যাগাজিনের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা একটা প্রয়োজনীয় কাজ হতেই পারে। আমি অবশ্য এ দায়িত্ব নিতে পারব না, বেশ পরিশ্রমসাধ্য এ কাজের যোগ্যতাও আমার নেই, অন্য কেউ নেবেন আশা করি।
লিটল ম্যাগাজিনগুলিতে প্রকাশিত রচনার সমীক্ষা ছাড়াও এই সব পত্রিকা কারা প্রকাশ করে, পয়সা পায় কোথা থেকে, কেন কয়েক বছরের মধ্যেই এ রকম অনেক পত্রিকাই বন্ধ হয়ে যায়, হারিয়ে যায়, এ সব জানাও খুব জরুরি। প্রত্যেক পত্রিকার পিছনেই থাকে একটা ছোটখাটো গোষ্ঠী। কয়েকজন বন্ধু এবং সম-মনস্ক ছেলেমেয়ে সাহিত্যজগতে নতুন কিছু সৃষ্টির তাগিদেই একটা পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। তারা চাঁদা করে প্রেসের খরচ মেটায়। পত্রিকা প্রকাশের দিনটিতে তাদের সে কী উন্মাদনা। কয়েক সংখ্যা বেরোবার পরই এই গোষ্ঠীতে ভাঙন ধরে, ব্যক্তিত্ব বা আমিত্ব নিয়ে সংঘর্ষ হয়, বন্ধ হয়ে যায় চাঁদা দেওয়া, পত্রিকাটির অবস্থা টলমল করে। শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘এক দশকে সঙ্ঘ ভেঙে যায়’, বাংলা লিটল ম্যাগাজিনে এই ভাঙাভাঙির জন্য দশ বছরও লাগে না। অনেক উচ্চমানের লিটল ম্যাগাজিন চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে যায়।
কোনও কোনও লিটল ম্যাগাজিনের জেদি সম্পাদক বন্ধুবান্ধবদের অসহযোগিতা সত্ত্বেও একাই পত্রিকা চালিয়ে যায় আরও কয়েকটা সংখ্যা। কোথা থেকে অর্থের সংস্থান হয়, তা অনুমান করাও শক্ত। আমি নিজেও কৃত্তিবাস পত্রিকা চালাতে গিয়ে কিছু দিনের জন্য একা হয়ে পড়েছিলাম। তখন আমি বেকার, টিউশনি করে প্রেসের ধার মেটাবার চেষ্টা করেছি, তাও পুরোপুরি মেটাতে পারিনি। বেশি ধার হয়ে গেলে প্রেস বদল করতাম। আগের প্রেসের ছায়াও মাড়াতাম না। ধরা যাক, সেই প্রেসটি মৌলালির মোড়ে, সেই মৌলালি আমার পক্ষে নিষিদ্ধ এলাকা হয়ে যায়। তবে এ কথাও বলতে হয়, অনেক প্রেসের মালিক এই সব লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি সহৃদয় কোমল। এ পর্যন্ত কোনও লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি মামলা বা হামলা করেনি কেউ।
আমার লেখালেখির শুরু লিটল ম্যাগাজিন থেকেই। এখন অবশ্য অনেক পত্রিকায় লেখা দিতে পারি না। কিন্তু পড়ি। বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিনের মান অনেক উন্নত। শুধু গল্প-কবিতা নয়, এই সব পত্র-পত্রিকায় অনেক মূল্যবান প্রবন্ধ থাকে, যা বহুলপ্রচারিত পত্রিকায় পাওয়া যায় না। কিছু কিছু পত্রিকা হাতে নিয়ে আমি মুগ্ধ হই, হঠাৎ কোনও পত্রিকা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। সে রকম একটা পত্রিকা সম্পর্কে দু’চার কথা।
‘অমিত্রাক্ষর’ নামের পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় মেদিনীপুর থেকে। ‘সাহিত্য ও গবেষণামূলক নির্বাচিত বিষয়ের খেয়ালি ষাণ্মাসিক’, সম্পাদক অচিন্ত্য মারিক। এই সংখ্যাটি পুরোপুরি চড়াই পাখি বিষয়ে। চড়াই পাখির সংখ্যাও দ্রুত কমে যাচ্ছে, সারা পৃথিবীতেই এ নিয়ে আলোচনা চলছে। চড়াই একটা ঘরোয়া পাখি। বড় বড় গাছে বাসা না-বেঁধে তারা মানুষের খুব কাছাকাছি থাকতে চায়। এ কালের বাড়িতে ঘুলঘুলি থাকে না, চওড়া, ঢাকা বারান্দা থাকে না, তা হলে তারা বাসা বাঁধবে কোথায়? বাইরে গাছে এই ছোট্ট সুন্দর পাখিটি বাসা বাঁধলে কাক শালিকরা এসে উৎপাত করবে। ডিম খেয়ে নেবে। পোকামাকড় মারার জন্য এখন প্রচুর কীটনাশক বিষ ছড়ানো হয়, সেই বিষাক্তপোকামাকড় খাওয়ার ফলে চড়াই পাখিদের নির্ঘাত মৃত্যু। এমনকী এখন মোবাইল ফোনের সংখ্যা এত বেশি বাড়ছে তাদের তরঙ্গের ম্যাগনেটিক এফেক্টেও এদের ছোট প্রাণ টিকে থাকতে পারছে না। পৃথিবীতে কত রকম চড়াই আছে, তার সচিত্র বিবরণ এবং বাইবেল থেকে শুরু করে সালিম আলির রচনায় চড়াই পাখির উল্লেখও সংগৃহীত হয়েছে এই সংখ্যায়।
গ্রামাঞ্চলে তবু এখনও কিন্তু চড়াই দেখা যায়। কিন্তু বড় বড় শহরে মানুষের সব থেকে চেনা এই পাখিটি একেবারে উধাও হয়ে যাচ্ছে।
রচনাগুণে এই পত্রিকাটি বিশেষ সমৃদ্ধ তো বটেই, তা ছাড়াও আমি মুগ্ধ হয়েছি এই সংখ্যাটির নির্মাণকুশলতা দেখে। অনেক রকমের ছবি, প্রতিটি পৃষ্ঠার লে-আউটও অনবদ্য। শহরের অনেক বড় পত্রিকাকেও অঙ্গসজ্জায় হার মানিয়ে দেবে।
অমিত্রাক্ষর পত্রিকা ও তার সম্পাদককে সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানাই।
‘ইটসি বিটসি’ মানে কী?
আমি নাট্যবিশারদ বা নাট্যসমালোচক নই। নাটক দেখতে ভালবাসি। দর্শক হিসাবে আমার তিন রকম অভিজ্ঞতা হয়। কিছু কিছু নাটক দেখে মন ভরে যায়। সময়টা বেশ ভাল কাটে। দু’একটি নাটক বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে ও প্রয়োগে এবং অভিনয়ে এতই উচ্চাঙ্গের যে বাইরে এসে অনেকের সঙ্গে সেই নাটকটি নিয়ে অনেকক্ষণ মত বিনিময় করা যায় আর দৈবাৎ দু’একটি নাটক (এ দেশে বা বিদেশে) দেখতে দেখতে মুগ্ধতার চেয়েও বিস্ময়বোধ বাড়তে থাকে। বেশ ভাল কিংবা ততটা সাথর্ক নয়, এই বিচারও মনে আসে না।
এই তৃতীয় ধরনের অনুভূতির নাটক ইটসি বিটসি। এই শিরোনামের মানে যে জানতেই হবে, তার কোনও মানে নেই। এখন গ্রুপ থিয়েটারের বেশ কয়েকটি নাটকই সার্থক, গর্ব করার মতো। তবে সে সব নাটকের কাহিনিতে একটা ধারাবাহিকতা থাকে কিন্তু নাটকটির প্রথম কয়েকটি দৃশ্য দেখার পরই মনে প্রশ্ন জাগে যে, সত্যিই কি কলকাতার কোনও মঞ্চে এ রকম নাটক দর্শকদের চক্ষু ও কর্ণ টেনে রাখতে পারে? এ নাটকে দৃশ্যের পর দৃশ্যের কোনও পারস্পর্য নেই। এর গঠন অনেকটা বিমূর্ত ধরনের।
বিমূর্ত আঙ্গিকের নাটক মঞ্চস্থ করা বেশ ঝুঁকিবহুল। কারণ, মঞ্চ ও অভিনয় দেখে মুগ্ধ হলেও দর্শকবৃন্দ কাহিনিটি অনুসরণ করতে চায়, নচেৎ এক সময় ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে।
আশ্চর্য ব্যাপার, এ নাটকে সে রকম কিছু ঘটেনি, বরং মাঝে মাঝেই দর্শকদের উষ্ণ সমর্থনের প্রমাণ পাওয়া গেছে হাত চাপুড়িতে।
যে হেতু এ নাটকে টানা কোনও কাহিনি নেই, তাই গল্পের চুম্বক দেওয়ার প্রয়োজন নেই। মূল চরিত্র, দুই ভাই, বড় ভাইটি খানিকটা পাগলাটে প্রতিভাবান, রাজনীতির দ্বিধাদ্বন্দ্বে বিদীর্ণ, আর ছোট ভাইটি চতুর, সমসাময়িক ব্যবস্থায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে চায়।
বড় ভাইয়ের ভূমিকায় গৌতম হালদার অভিনয় সাফল্যে তাঁর জীবনে আর একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। আর অন্য ভাইয়ের ভূমিকায় স্বল্প পরিচিত চিরঞ্জীব বসু, সে-ই নাট্যকার। তার সাবলীল অভিনয় এবং এ রকম একটি নাটক রচনায় যে সাহসের পরিচয় দিয়েছে সে জন্য তাকে বিশেষ সাধুবাদ জানাতে হয়।
হাতে খড়ি নামে নতুন সংস্থার প্রযোজনায় এবং দেবাশিস ঘোষ দস্তিদারের পরিচালনায় এই নাটকটি সত্যিই অসাধারণ।
নাটকটিতে রাজনীতির কিছু কিছু স্পর্শ আছে। তার চেয়েও বেশি আছে মানব-সম্পর্কের অন্দরমহলের কথা। সেখানেও মাতিয়ে দিয়েছে দোয়েলপাখি দাশগুপ্ত।
এ নাটক অবিস্মরণীয়।
৪. ৪. ২০১২
ও বিদ্যাসাগর, আমার পাঁচ গণ্ডা পয়সা দরকার…
এক সময় উচ্চবিত্ত বাঙালিরা, এমনকী কিছু মধ্যবিত্ত বাঙালিও প্রতি বছর অন্তত একবার হাওয়া বদল করার জন্য পশ্চিমে যেতেন। এখনকার হিসেবে বেশি দূর নয়, ঘাটশিলা, মধুপুর, শিমুলতলা ইত্যাদি জায়গায় কিছুদিন মুক্তজীবন যাপন করতেন। হাওয়া বদলের ধারণাটা সাহেবদের কাছ থেকে পাওয়া। একই জায়গায় বছরের পর বছর থেকে গেলে শরীর ঠিক থাকে না, তাই অন্য কোথাও গিয়ে, সেখানকার হাওয়া গায়ে লাগিয়ে এলে শরীর নতুন বল পায়, আয়ুও নাকি বেড়ে যায়। যে-জন্য সাহেবরা ছুটি পেলেই ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়ে, এমনকী উইক-এন্ডেও তাদের পাওয়া যায় না। প্রথম দিকের শিক্ষিত বাঙালিরা অনেক বিষয়েই ইংরেজদের অনুকরণ করতে চাইতেন, বাংলার বাতাস থেকে কিছু দূরের কোনও জায়গায় অন্য রকম বাতাস উপভোগ করে আসতেন, কিছু কিছু ধনাঢ্য পরিবার ওই সব শহরে একটা বাড়িও রাখতেন, বেশ বড় ও সুদর্শনীয়। ওই সব অঞ্চলকে কেন ‘পশ্চিম’ বলা হত, তা আমি এখনও জানি না, ওই সব শখের বাড়ির অধিকাংশ এখন জরাজীর্ণ, প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মতন অথবা হস্তান্তর হয়ে গেছে। সেই সব বিত্তশালী পরিবারের কেউ কেউ এখনও হাওয়া বদলাতে যায়, তবে বিহার বা উত্তরপ্রদেশে নয়, তারা যায় প্রকৃত পশ্চিমে, অর্থাৎ ইউরোপ, আমেরিকায়।
ছোট ছোট পাহাড় বা যেখানে সেখানে খানিকটা জঙ্গল, এ রকম স্থানই বাঙালিদের বেশি পছন্দ ছিল। শহর ছাড়াও কোনও গ্রামাঞ্চলে এ রকম পরিবেশ পেলে সেখানেও বাড়ি বানিয়ে রাখত বাঙালিরা। এই রকমই একটি আকর্ষণীয় অঞ্চলের নাম বাঙালি উচ্চারণে কার্মাটা। আসল নাম কর্মাটাঁড়। অর্থাৎ কর্মা নামে একজন সাঁওতাল মাঝির টান। মানে উঁচু জায়গা যা বন্যাতে কখনও ডোবে না। সেইখানে রেল স্টেশনের পাশেই একটা বাড়ি কিনেছিলেন কিংবা নির্মাণ করিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এ তথ্য অনেকেই জানেন। বিদ্যাসাগরের শেষ জীবন মোটেই সুখে কাটেনি। সেই যে উত্তরপাড়ায় একটা বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শন করতে মিস কম্পেস্টারকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে তার বগি গাড়িটি উলটে যায়। ছিটকে বিদ্যাসাগর মাটিতে পড়ে গিয়েই অজ্ঞান হয়ে যান। তারপর এক মাস শয্যাশায়ী ছিলেন। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন বটে, কিন্তু আঘাতের পরিণাম তাঁর শরীরকে ছাড়েনি। তার ফলেই তাঁর আয়ু ফুরিয়ে যেতে থাকে। তা ছাড়াও কিছু কিছু বন্ধু স্থানীয় মানুষ এবং যাঁদের তিনি অনেক উপকার করেছেন, তাদের কয়েকজনের দুর্ব্যবহারে তিনি মর্মাহত হন। তাঁর জন্মস্থান বীরসিংহ গ্রামের কিছু ব্যক্তির অকৃতজ্ঞতার কারণে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, জীবনে আর কখনও তিনি সেই গ্রামে পা দেবেন না। কর্মাটাঁড়ের অধিকাংশ মানুষই সাঁওতাল, তাদের সরল ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে বিদ্যাসাগর বাকি জীবনটা সেখানেই কাটাবেন ঠিক করেছিলেন। তা অবশ্য হয়নি। মাঝে মাঝেই তাঁকে কলকাতায় আসতে হয়েছে। মৃত্যুও হয় এই শহরেই।
তার পর কর্মাটাঁড়ের বাড়িটার অবস্থা কী হল? পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে পিতার মোটেই সুসম্পর্ক ছিল না। বিদ্যাসাগর তাঁর সঙ্গে বাক্যালাপও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পিতার মৃত্যুর পরেই নারায়ণচন্দ্র সেই বাড়ি ও সম্পত্তি বিক্রি করে দেয় কলকাতার এক মল্লিক পরিবারের কাছে। তারা বাড়িটি এমনিই ফেলে রাখে। বিহারের বাঙালি সমিতি সেখানে বিদ্যাসাগরের স্মৃতিরক্ষার জন্য উদ্যোগী হয়ে মল্লিক পরিবারের কাছ থেকে কিনে নেয় চব্বিশ হাজার টাকাতে। সেখানে এই সমিতি একটি মেয়েদের স্কুল চালু করে। (অনেকের মতে বিধবা বিবাহের আইনি স্বীকৃতি আদায় করাই বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারের প্রধান কীর্তি। আমার মতে, মেয়েদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য বিদ্যাসাগরের অনলস পরিশ্রমের কীর্তিও অন্য কিছুর থেকে কম নয়।)
এখন কর্মাটাঁড়ের নাম বিদ্যাসাগর। রেল স্টেশনটিরও ওই নাম। বিহার বাঙালি সমিতি সেই স্থানে অনেক সেবামূলক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে সব কাজে অর্থ অকুলান নয়। পত্রান্তরে কলকাতার এক ডাক্তার প্রশান্তকুমার মল্লিক, যিনি সদ্য ওখানে কয়েক দিন কাটিয়ে এসেছেন, তাঁর একটি চিঠি পড়ে জানা গেল, অর্থাভাব সত্ত্বেও কী সব কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমার মনে পড়ল, কর্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগর নামে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর একটি অনবদ্য লেখা পড়েছিলাম অনেক দিন আগে। সেটা আর একবার পড়ার ইচ্ছা হল।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বিদ্যাসাগরের অন্যতম সার্থক শিষ্য। তিনি লখনউয়ের এক কলেজে সংস্কৃত পড়াবার আমন্ত্রণ পান। যাওয়ার সময়ে তিনি মাঝপথে কর্মাটাঁড় নেমে পড়েন। সেখানে দু’দিন থেকে তিনি দেখে নেন, তাঁর গুরুর প্রতিটি দিনযাপনের চিত্র। সাঁওতালদের মধ্যে উপযুক্ত চিকিৎসার খুব অভাব। বিদ্যাসাগর তাদের হোমিওপ্যাথির ওষুধ দেন। কোনও গুরুতর রোগীর বাড়িতে গিয়েও সেবা করেন। সারা দিন তিনি ব্যস্ত। এর মধ্যে মজার ব্যাপার এই, সকাল বেলাতেই একজন সাঁওতাল এসে বলল, ও বিদ্যাসাগর, আমার পাঁচ গণ্ডা পয়সার খুব দরকার। তুই আমার এই পাঁচটা ভুট্টা নিয়ে পয়সা দে। বিদ্যাসাগর ভুট্টা নিয়ে তাকে পয়সা দিলেন। তার পর সারা সকাল ধরেই আরও কয়েক জন সাঁওতাল কিছু ভুট্টার বদলে পয়সা চাইতে লাগল। দরদামের কোনও প্রশ্ন নেই। যে যা চায় তাই দিতে লাগলেন বিদ্যাসাগর। ক্রমে ভুট্টার পাহাড় জমে গেল। বিকেলের দিকে একদল এসে বলল, খিদে পেয়েছে। কিছু খেতে দে না। তখন শুকনো কাঠ আর পাতাটাতায় আগুন জ্বালা হল, বিদ্যাসাগর তাদের সেই সব ভুট্টা বিলিয়ে দিলেন। তারা মহানন্দে যার যতটা খুশি সেই ভুট্টা পুড়িয়ে খেতে লাগল।
যাঁরা বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষার কর্মকাণ্ডে কিছু আর্থিক সাহায্য করতে চান, তাঁরা বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন, বিহার-এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
পাপ না পুণ্যফল
বিদ্যাসাগর মশাই আর হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দু’জনেই মৃত্যুর পরে স্বর্গে গেছেন। স্বর্গে তো কামনা বাসনা মেটাবার কোনও সীমারেখা নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী একদিন একটা বাগানের মধ্যে যেতে যেতে দেখলেন, এক জায়গায় বিদ্যাসাগর মশাই বসে আছেন। তার কোলে বসেছে বিশ্ববিখ্যাত অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো। তা দেখেই হরপ্রসাদ মুখ লুকিয়ে অন্য দিকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করতেই বিদ্যাসাগর হেঁকে বললেন, এই হরো, যাচ্ছিস কোথায়, এ দিকে আয়।
হরপ্রসাদ বললেন, গুরুদেব, আপনি সারা জীবন কত পরিশ্রম করেছেন। কত মানুষকে অর্থ সাহায্য দিয়ে বাঁচিয়েছেন। সেই পুণ্যফলে আপনি স্বর্গে এসে এমন রূপসীকে পেয়েছেন। এখানে থাকা উচিত নয়।
বিদ্যাসাগর হরপ্রসাদের পেটে চিমটি কেটে বললেন, আজও তোর বুদ্ধিশুদ্ধি হল না। বুঝিস না, এটা আমার পুণ্যফল না, এই মেয়েটির পাপের শাস্তি।
১৮. ৪. ২০১২
ভালবেসে মিটল না সাধ, জীবন এত ছোট
কেমন আছো, মণিদা?
আরেঃ! তুই এসেছিস, পথ ভুলে নাকি?
এই দিকে এক জায়গায় একটা কাজ ছিল। কাজটা তাড়াতাড়ি মিটে গেল, তাই ভাবলাম একবার তোমার সঙ্গে দেখা করে যাই।
মানে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যই তুই বাড়ি থেকে বেরোসনি, এ দিকে তোকে আসতে হয়েছিল বলেই…
তাই। হাসপাতাল কিংবা নার্সিংহোমে আমার আসতে ইচ্ছা করে না। আবার তোমার সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয়নি সে জন্যও…
বেশ! বোস বোস, আমার আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুবান্ধব নিজেদের সময় নষ্ট করে আমাকে দেখতে আসবে, এসে গজল্লা করবে, সেটা আমার মোটেই ভাল লাগে না। নার্সিংহোমে থাকাটা বেশ পছন্দ হয়েছে আমার, খুব নিরিবিলি…
কত বড় নার্সিংহোম, কত মানুষের আসা যাওয়া, তুমি বলছ নিরিবিলি?
কেবিনের দরজা বন্ধ করে দিলে আর কিছুই টের পাওয়া যায় না। জানলা দিয়ে দেখি, একটা পার্কের মধ্যে একটা সরোবর। ঠিক একই জায়গায় রোজ বসে থাকে দুটি বক। মাঝে মাঝে দু’জন নার্স আসে আমাকে খাওয়াতে টাওয়াতে। কী সুন্দর তাদের ব্যবহার।
তোমাকে এখন বেশ ভালই দেখাচ্ছে, চোখ-মুখ বেশ স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
ভাল দেখাচ্ছে, তাই না? চলে যাওয়ার আগে চেহারাটা দুর্বল, প্যাঁকাটে, কিম্ভূতকিমাকার করার কোনও মানে হয় না।
চলে যাওয়া… মানে… তুমি নার্সিংহোম থেকে কবে ছুটি পাচ্ছ?
যে কোনও দিন। আমি ইচ্ছা করলে এক্ষুনি। এখানে আমার আর চিকিৎসার কিছু নেই। চলে যাওয়া মানে একেবারেই চলে যাওয়া।
এ কী বলছ মণিদা। আমরা তো জানি যে তুমি—
চিরযুবা, তাই না? বয়স আমাকে ছুঁতে পারে না। আমাকে ওই সব টক্ দিস না। আমার আয়ু আর মাত্র দু’মাস। শোন, এ দেশের ডাক্তাররা ক্রিটিকাল রোগীর কাছে আসল অবস্থাটার কথা লুকিয়ে যায়। অনেক দেশে রোগীদের পুরো সত্যটা জানিয়ে দেয়, তাতে তাদের মনের জোর বাড়তে পারে। এখানে একজন তরুণ ডাক্তার, সদ্য বিলেত থেকে ফিরেছে। তাকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমার আয়ু আর কত দিন, সত্যি করে বলুন তো ভাই। সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, দু’মাস থেকে ছ’মাস। আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞানে আপনাকে সাহায্য করার মতো আর কিছু নেই। সে কথা শুনে আমার বেশ ভাল লাগল। আমার বয়স তো কম হল না। জীবনকে যথেষ্ট উপভোগ করেছি। এখন চলে গেলে কেউ অকালমৃত্যু বলবে না। যেতে তো হবেই। তবে একটা কী আফসোস রয়ে গেল, জানিস? ভেবেছিলাম, আমার জীবৎকালেই দেখে যেতে পারব যে ধর্ম নিয়ে মানুষের মূর্খতা, পাগলামি, অসভ্যতা, নিষ্ঠুরতা একেবারে শেষ হয়ে যাবে। ধর্ম নিয়ে মানুষের পরিচয় হবে না। কিন্তু তা তো হলই না, বরং যেন দিন দিন বাড়ছে। এমনকী বহু শিক্ষিত মানুষও….
শিক্ষিত তুমি কাদের বলবে মণিদা? যাদের মনের মধ্যে কোনও যুক্তিবোধ তৈরি হয়নি, যাদের মনের মধ্যে ভালবাসা শুকিয়ে গেছে, তাদের কিছু কেতাবি পড়াশোনার জন্যই শিক্ষিত বলা যায়? হিন্দু-মুসলমান, ইহুদি আর আরবের মুসলমান, খ্রিস্টান আর বৌদ্ধরা যখন তখন মারামারি করার জন্য তৈরি হয়ে আছে।
ধর্ম কথাটার সঠিক মানে কী, বল তো নীলু?
সঠিক কোনও মানে এখন নেই। কিংবা থাকলে এখন কেউ মানে না। পুরনো বাঁধাধরা বিশ্বাসকেই আগলে রেখেছে। মজার কথা কী জানো মণিদা, প্রত্যেক ধর্মেই একজন করে আলাদা ঈশ্বর আছে। খ্রিস্টান, ইসলাম, হিন্দু মুনি-ঋষিদের পরম ব্রহ্ম। এদের কারওর সঙ্গে অন্যদের কোনও মিল নেই। তবু এরা মনে করে নিজের নিজের ধর্মের ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। এই বিশ্বাসের মধ্যে যে একটা চরম ছেলেমানুষি আছে, তা এই সব সম্প্রদায়ের শিক্ষিত লোকরাও বোঝে না? কিংবা বুঝেও ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় নিজের নিজের ধর্মের ঢাক পেটায়।
থাক, বাদ দে ও সব কথা। আমাদের কাশ্মীর সমস্যাও কোনও দিন মিটবে না। ইজরায়েল ও আরব দেশগুলির শত্রুতাও চলবে অনন্তকাল। আমার আর একটা আফসোস কী জানিস, ভেবেছিলাম আমি বেঁচে থাকতে থাকতেই দেখে যাব, আমাদের পৃথিবীর মতো এই মহাবিশ্বের আরও কোনও গ্রহে মানুষ কিংবা আর কোনও জ্যান্ত প্রাণী আছে কি না? বিজ্ঞানের এত উন্নতি হয়েছে, তবু এ পর্যন্ত কিছুই জানা গেল না।
এই মহাবিশ্বটা বড্ড বড়।
ঠিক বলেছিস, বিচ্ছিরি রকমের বড়। কত যে ছোট গ্রহ নক্ষত্র রয়েছে। তা আজও আমরা গুনে শেষ করতে পারিনি। আমাদের কল্পনাও এখানে হার মেনে যায়। এই পৃথিবীতে মানুষ ও কত সুন্দর প্রকৃতি রয়েছে। বিশ্বের আর কোথাও তা নেই। পৃথিবীর এই সৌভাগ্য হল কেন? আমরা খালি চোখে যত তারাকে ঝিকমিক করতে দেখি তার মধ্যে বেশ কিছু তারাই আর বেঁচে নেই। তবু তাদের আমরা দেখি। কারণ, তাদের আলো এখানে এসে পৌঁছতে বহু সহস্রাব্দ লেগে যায়। তার মানে, একটা জিনিস নেই, তবু তাকে আমরা দেখি, এটা একটা মজার ব্যাপার না?
মণিদা, তোমাকে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে, আমাদের সবাইকেই যেতে হবে তা নিয়ে কি তোমার মনে…
আমি মৃত্যুকে ভয় পাই কি না জানতে চাইছিস? ঠিক ভয় নয়। তবে, আমি তো জানি, চলে যাওয়ার ব্যাপার কিছু নেই। মানুষের শেষ নিশ্বাস ফেলা মানেই সব কিছু শেষ। পরজন্ম ফরজন্ম বলে কিছু নেই, ও সব রূপকথা। মানুষের আত্মা বলেও কিছু নেই। ঈশ্বরের অস্তিত্বের মতো ওটাও একটা গুজব। যে হেতু এ সব আমি নিশ্চিত ভাবে জানি, তাই শেষ নিশ্বাস ফেলাটা যত দূর সম্ভব ঠেকিয়ে রাখা যায়, সে রকম ইচ্ছা তো হবেই। ভয় নয়, তবু সব মানুষেরই এ রকম আকাঙক্ষা থাকে। অনেকে আবার আত্মহত্যাও করে। তারাও মূর্খ, কিংবা আমি তাদের বুঝি না। ক’টা বাজল রে? এ বার বোধহয় আমার যাওয়ার সময় হয়েছে।
আমিও এবার উঠব। তোমার ছবিগুলোর জন্য তোমাকে অনেকেই মনে রাখবে।
মনে রাখুক বা না রাখুক, তাতে আমার বয়েই গেল। আমি তো তা জানতে পারছি না। হ্যাঁ রে, রবীন্দ্রনাথ নাকি আড়াই হাজার ছবি এঁকে গেছেন?
সে রকমই তো একটা হিসেব পাওয়া যায়।
অত লেখালেখি, কত গান, কত মিটিং তাঁর মধ্যে এত ছবি এঁকে গেছেন? কী অসাধারণ মানুষ! আমি তো এঁকেছি মাত্র দুশো আড়াইশো। ওঁর চোখে আমি একটা শিশু।
রবীন্দ্রনাথ অনেক ছোট ছবি, কাগজের উপর অনেক স্কেচ রেখে গেছেন, সেই সব মিলিয়ে আড়াই হাজার। রবীন্দ্রনাথ গ্রেট তো বটেই, কিন্তু তাঁর সঙ্গে তোমার তুলনাটা ঠিক নয়। তুমি এঁকেছ ক্যানভাসে, বেশির ভাগই অয়েলের কাজ। রবীন্দ্রনাথ তেল রং নিয়ে কিছু কাজ করেছেন কি না, তা আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। তোমার ছবি তো বিদেশেও বিক্রি হয়েছে।
শোন, তোরা যারা ছবি আঁকার প্রক্রিয়াটা ঠিক জানিস না, তারা বুঝবি না, এখন তেল রঙের বদলে অ্যাক্রিলিকে অনেকেই কাজ করে। তাতে অনেকটা সময় বাঁচে। অ্যাক্রিলিক তাড়াতাড়ি শুকোয়। আমার কোনও ছবিই ঠিক যেন পারফেকশনে পৌঁছয়নি। তুই উঠছিস? ঠিক আছে আবার দেখা হবে কি না জানি না।
হ্যাঁ, দেখা হবে। তুমি এই নার্সিংহোমে থাক কিংবা বাড়িতে। আমি তার কাছাকাছি একটা কাজের ছুতোয় তোমার কাছে আসব।
শোন, আমি ধর্ম কিংবা মহাকাশ নিয়ে যা বলেছি, তা অতি সাধারণ কথা। আসলে ক্ষোভ কী জানিস, এখন আমার প্রায়ই মনে হয়, জীবন এত ছোট কেন? ভালবাসার সাধ তো মিটল না। এ বিষয়ে বোধ হয় তারাশঙ্করবাবুর একটা লেখা আছে। আমি কিছু মানুষের ভালবাসা পেয়েছি ঠিকই, তবু যেন এখন এক সময় বুকের মধ্যে খাঁ খাঁ করে। একা থাকলেই মনে মনে বলতে থাকি, ভালবেসে মিটল না সাধ, ভালবেসে মিটল না সাধ, মিটল না সাধ…
৯. ৫. ২০১২