যা দেখি, যা শুনি – ৩০

কী অপূর্ব সুন্দর কাটানো একটি সন্ধ্যা

অনুষ্ঠানসূচিতে দেখলাম, দ্বিতীয়ার্ধে রয়েছে একটি বাচ্চাদের নাটক। আমাদের মতন যাদের মাঝে মাঝে মঞ্চে উঠতে হয় এবং বক্তৃতার নামে কিছু এলোমেলো কথা বললেই চলে, তারা এই ধরনের অনুষ্ঠানের প্রথম অংশ শেষ হলেই নানান ছুতো দেখিয়ে সরে পড়ে। আমিও। তবু কেন আমি সে দিনের ‘সায়ক’-এর অনুষ্ঠানে রয়ে গেলাম শেষ পর্যন্ত?

বয়েস হয়েছে তো, এখন ছোটদের সংস্পর্শ বেশি ভাল লাগে। হয়তো মানুষ ওই সব শিশুর মধ্যে নিজের শৈশব খোঁজে। একটা ব্যাপার দেখা যায়, মানুষ তার ছেলেমেয়েদের প্রতি যতটা স্নেহ দিতে পারে, তার চেয়ে অনেক বেশি স্নেহপ্রবণ হয় নাতিনাতনিদের প্রতি। ছেলেমেয়েদের তবু মাঝে মাঝে শাসন করতে হয়, নাতিনাতনিদের বেলায় সে প্রশ্ন সেই, শুধু আদর আর প্রশ্রয়।

আমাদের বাড়িতে কোনও শিশু নেই। কয়েক দিন আগে আমাদের ছেলে সপরিবার এসে ঝটিকা সফরের পর ফিরে চলে গেছে প্রবাসে, এখন আমাদের ফ্ল্যাট আগের চেয়ে তিন গুণ ফাঁকা। তাই বাৎসল্যরসের টানেই আমি বসে রইলাম দর্শক আসনে। এখন স্কুল ছুটির পর ছাত্রছাত্রীদের উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগে, এমনকি টিভি-র বিজ্ঞাপনে কোনও শিশুশিল্পী থাকলেই আগ্রহের সঙ্গে দেখি। খবরের কাগজে যখন জানা যায়, কোনও বাচ্চা ছেলে বা মেয়েকে ধরে নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণ চাইছে বদমাসরা, তখন ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে ওই বদমাসগুলোকে…ইচ্ছে তো হয় অনেক কিছুই, কিন্তু আমার আর সাধ্য কতখানি।

নাটক শুরু হওয়ার আগে একটা তথ্য জেনে আশ্চর্য হলাম, ‘সায়ক’-এর ছোটদের বিভাগে ছয় থেকে যোলো বছরের প্রায় চল্লিশটি ছেলেমেয়ে নাটকের ট্রেনিং নেয়। রুদ্রপ্রসাদদের নান্দীকার-এও এ রকম বিভাগ আছে অনেক দিন, অন্য বড় বড় নাটকের দলেও এ সব ব্যবস্থা আছে কি না জানি না। তার মানে কি এই যে, এখন অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের নাটক-অভিনয় শিক্ষা করার জন্য পাঠাচ্ছেন। আমাদের বাল্যকালে তো এটা অকল্পনীয় ছিল। বাবা-মায়েরা সন্তানদের শুধু বলতেন, পড়, পড়, ফার্স্ট-সেকেন্ড হ! উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের বড়জোর কিছুদিনের জন্য সাঁতারের ক্লাসে নিয়ে যাওয়া হত। কিন্তু নাটক শেখা? এর সঙ্গে কি জীবিকার যোগ আছে? নাট্যজগতে দু’-চার জনই বিখ্যাত হয়ে স্বাবলম্বী হতে পারেন, সেও অনিশ্চয়তার ব্যাপার। আসলে এই সব ছেলেমেয়ে প্রায় সবাই জীবিকার জন্য অন্য পড়াশুনো চালিয়ে যাবে নিশ্চয়ই, তবে এই স্বল্পকালীন নাট্যশিক্ষাও অবশ্যই কাজে লেগে যাবে। বাকি জীবনে তাদের নাটকের সঙ্গে সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক, তারা শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে শিখবে, নাটকের পাত্রপাত্রীদের সমতুল্য অনেক চরিত্রেরও দেখা মিলবে।

এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলি। কোল ইন্ডিয়ার একটা অনুষ্ঠানে একবার গিয়েছিলাম মধ্যপ্রদেশে। খাতিরযত্নের অভাব নেই, ঠিকঠাক চলছে সবই। দ্বিতীয় দিনে শুনলাম, সেই সংস্থার সর্বোচ্চ পদাধিকারী একজন বাঙালি, তিনি আমাদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকারে আসবেন, অতি ব্যস্ত তিনি, সময় মাত্র পনেরো মিনিট, আমরা যারা আমন্ত্রিত, তারা যেন নির্দিষ্ট সময়ে এক জায়গায় বসে থাকি। যথা সময়ে তিনি এলেন, অত বড় অফিসাররা বাঙালি না পাঞ্জাবি, তাতে কিছু আসে যায় না, তাঁদের মুখে লেগে থাকে নকল গাম্ভীর্য, কথা বলেন একটু ভুরু তুলে, এবং আর সবাই যেন তাঁর অধস্তন কর্মচারী। এই ধরনের বড় অফিসারদের সামনে পাঁচ মিনিটের বেশি বসে থাকতে আমার চুলকুনি হয়, সিগারেট টানার অছিলায় উঠে যাচ্ছিলাম, একজন ফিসফিস করে আমার কানে কানে বললেন, জানেন তো, ইনি এক সময় বহুরূপীতে অভিনয় করতেন। তা শুনে আমার কৌতুহল হল, আমি ফিরে গিয়ে সব প্রোটোকল ভেঙে তাঁর সামনে গিয়ে বললাম, হ্যাঁ মশাই, আপনি নাকি এক সময় বাংলা নাটকে অভিনয় করতেন? সে সব কোনও নাটকের কথা মনে আছে?

তিনি তক্ষুনি কোনও উত্তর না দিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন এক-দেড় মিনিট। তাঁর মুখ থেকে মিলিয়ে যেতে লাগল নকল-কঠোর ভাব, তিনি টাই খুলে ফেললেন, তারপর চমৎকার উদাত্ত গলায় উচ্চারণ করতে লাগলেন বিসর্জন নাটকে জয়সিংহের সংলাপ। তখন আর তাঁকে শুধু অফিসার নয়, একজন সম্পূর্ণ মানুষ বলে মনে হতে লাগল।

‘সায়ক’-এর এই কিশোর-নাট্যটির নাম মানিকচাঁদ। সুপরিচিত নাট্যকার চন্দন সেন এটা লিখে দিয়েছেন। ঠিক রূপকথা নয়, আবার বাস্তব কাহিনিও নয়, দুইয়ের সংমিশ্রণ বলা যায়। অভিনেতাদের মধ্যে একজনও অভিজ্ঞ, বয়স্ক নেই, সবাই শৈশব থেকে কৈশোরে পৌঁছনো। মেঘনাদ ভট্টাচার্য কী দারুণ যত্নে এদের শিখিয়েছেন, কেউ একটুও ভুলভাল করল না, বরং যথাযথ আবেগ ফুটিয়ে তুলল। আমি আশা করছিলাম, কেউ একজন পার্ট ভুলে গিয়ে আমাদের আরও আনন্দ দেবে। না, তা হল না, এরা সবাই যেন বাচ্চা প্রফেশনাল! এদের নাচ ও গান শিখিয়েছেন কবীর সেন বরাট আর শুভেন্দু মাইতি, এ সব নাটক নাচগান ছাড়া জমে না।

প্রথম বার একটা নাটক দেখতে দেখতে মনে হয়, সব চরিত্রের অভিনেতারাই একেবারে মানানসই। ঠিক যেন খুঁজে খুঁজে জোগাড় করে আনা হয়েছে। বড়দের নাটকে এ রকম হয় না, তখন তো বেশ কয়েকজন চেনাই থাকে, আর তাই আমরা মনে করি, এই এই ভূমিকায় এই এই অভিনেতা মঞ্চে এসেছেন। কয়েক বছর আগে রমাপ্রসাদ বণিকের ‘একলা পাগল’ নামে অসাধারণ নাটকটি একটি স্কুলের ছেলেমেয়েদের দিয়ে অভিনয় উপস্থাপনা দেখেছিলাম। সেখানে একটি পাঞ্জাবি চরিত্রের মেয়েটিকে মনে হয়েছিল অবশ্যই পাঞ্জাবি, কিছু কিছু বাংলা কথা শিখেছে। পরে দেখি, সে এক লাজুক বাঙালি মেয়ে। এ সবই পরিচালকের কৃতিত্ব।

এই নাটকেও শিহরন জাগানো অনেক মুহূর্ত আছে। মূল চরিত্র মানিকচাঁদের ভূমিকায় যে ছেলেটি অভিনয় করছে, তার বর্ণনায় আছে, তার মাথাভর্তি সোনালি চুল, আর গায়ের রং খুব ফর্সা। সোনালি চুলটা কোনও সমস্যা নয়, কিন্তু বেশি পাউডার ঘষেও সত্যিকারের ফর্সা হওয়া যায় না। এই মানিকচাঁদ সত্যি সত্যি খুব ফর্সা, কী সুন্দর, সরল তেজের সঙ্গে সে অভিনয় করে গেল, দেখতে দেখতে আর সময়জ্ঞান রইল না আমার। কী অপূর্ব সুন্দর কাটল যে এই সন্ধেটা।

নাটকটা শেষ হতেই একটি যুবতী আমার সামনে এসে জিজ্ঞেস করল, সুনীলকাকা, আমায় চিনতে পারছ না?

আমি কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই সে বলল, আমি মতি নন্দীর ছোট মেয়ে, আমার ছেলে আজ অভিনয় করেছে।

মতি নন্দীর তিন মেয়েই খুব ফর্সা, ওদের মায়ের মতন, ওদের ছেলেমেয়েরাও সে রকমই হবে।

কোন ভূমিকায় অভিনয় করেছে তোমার ছেলে?

ওই যে, নায়ক, মানিকচাঁদ।

মতি নন্দী আমার বিশিষ্ট বন্ধু ছিল, তার নাতি তো আমারও নাতির মতন। তার প্রতি আমার কিছুটা পক্ষপাতিত্ব তো থাকতেই পারে। কিন্তু তার পরিচয় না জেনেই তো আমি আগেই মানিকচাঁদের ভূমিকায় দীপচাঁদকে ফার্স্ট করে দিয়েছি।

অমুক ওয়েডস ওমুক

এখন যাকে বলে বিয়ের সিজন। পাড়ায় পাড়ায় সুসজ্জিত বিয়েবাড়িগুলোর বাইরে ফুলের অক্ষরে লেখা থাকে ‘সঞ্জয় ওয়েডস বনলতা’, ‘বিমান ওয়েডস নয়না’ ইত্যাদি। দেখলেই বিরক্তিতে আমার নাক কুঁচকে যায়। না, ইংরিজি ভাষার জন্য নয়, যার যা ইচ্ছে তা তো লিখতেই পারে, আর সামাজিক-সাংস্কৃতিক নির্বুদ্ধিতার এই উদাহরণ এ যুগেও দেখলে আমারও নাক কুঁচকোবার অধিকার থাকবেই। আজও শুধু ছেলেরাই বিয়ে করে। আর মেয়েদের বিয়ে হয়! তাদের সমান অধিকার নেই।

এরই মধ্যে এক বিয়েবাড়ির বাইরে লেখা ‘সুরেলা-রাহুলের শুভ বিবাহ’, তা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল।

১৪. ১২. ২০১১

সবচেয়ে দীর্ঘ এক মিনিট, তার চিন্তা

এখন নানা কারণেই মাঝে মাঝে শোকপ্রস্তাব নিতে হয়। একজন কেউ এক মিনিট নীরবতা পালনের প্রস্তাব করেন, সবাই উঠে দাঁড়ায়, সামনের দিকে হাত, দৃষ্টি মাটির দিকে। পৃথিবীতে এ রকম লম্বা এক মিনিট আছে কি না সন্দেহ। অনেকেই আড় চোখে বার বার ঘড়ি দেখে নেয়।

এই এক মিনিটে মানুষ কী ভাবে? ঘোষণা করা হয় যে সদ্য মৃত একজন বা কয়েক জনের পরলোকগত আত্মার শান্তির উদ্দেশে…আমার মুশকিল হচ্ছে, আমি তো পরলোকে বিশ্বাস করি না। পরজন্ম বলে কিছু নেই। স্বর্গ-টর্গ সবই সুমধুর কল্পনা মাত্র। এই পৃথিবীতে শেষ নিশ্বাস ফেলা মানেই চরম শেষ, সে আর কোথাও নেই। আত্মার অস্তিত্বেও আমি বিশ্বাস হারিয়েছি অনেক কাল আগে। আত্মাও মুনি-ঋষি, দার্শনিকদের মনগড়া একটা ব্যাপার, মৃত্যুর পর মানুষের শরীর থেকে কিছুই বেরিয়ে যায় না। ঈশ্বরের অস্তিত্বও স্বীকার করার কোনও কারণ নেই, বিগ ব্যাং ঘটেছে প্রাকৃতিক কারণে, তার আগে সময়েরও অস্তিত্ব ছিল না, সময়ও ছিল না? কী সাঙঘাতিক কথা!

অনেকের হৃদয়ে ভক্তি ও বিশ্বাসে একজন ঈশ্বর আছেন, যিনি শুধুমাত্র এই ছোটখাটো পৃথিবীটা চালান, যিনি পেটের অসুখ সারিয়ে দেন, পরীক্ষায় পাশ করান, যাঁর নামে কান্নাকাটি করে বহু মানুষ বিপদে বা দুঃখের দিনে সান্ত্বনা পায়। এই ঈশ্বরের অধীনে একটা চমৎকার স্বর্গ আছে, নরকও আছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, সব ধর্মেই তো আলাদা আলাদা ঈশ্বর, অথচ ধর্মগুলি একেশ্বরবাদী। সেই একাধিক ঈশ্বর স্বর্গে বসে নিজেদের মধ্যে কখনও বিবাদ করেন কি না জানি না, তবে পৃথিবীতে তাঁদের ভক্তরা বীভৎস হানাহানি করেছে বহুবার। এখন মহাকাশের মানচিত্র যতটা পাওয়া গেছে, তাতে আমাদের এই প্রিয় পৃথিবীকে আলাদা করে রাখার কোনও উপায় নেই। পৃথিবীটা একটা অতি সামান্য গ্রহ, সূর্যও নিতান্তই এক ছোটখাটো নক্ষত্র, আরও কোটি কোটি গ্রহ-নক্ষত্র রয়েছে এই মহাবিশ্বে, তাদের মধ্যে বড়সড় যে-কোনও একটিই একশোটা পৃথিবীর সমান, একই জন্মলগ্নের পর এরা ছুটছে আবার পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সে ছবি দেখলে খানিকটা আতঙ্কই হয়, এত লক্ষ কোটি গ্রহ-নক্ষত্রের জন্ম হল কেন, কী উদ্দেশ্যে? তারা কি ছুটে যাচ্ছে ধ্বংসের দিকে? মাঝে মাঝে রাক্ষসের মতন ব্ল্যাক হোল, যারা কাছাকাছি কোনও গ্রহ-তারকা পেলে কপাত করে গিলে ফেলে, এমনকী আলোর রশ্মিরও নিস্তার নেই। গ্রহ-নক্ষত্র ছাড়াও অনেক বড় বড় ঢেলা ঘুরে বেড়াচ্ছে মহাকাশে। তাদের কয়েকটা যদি ছুটে এসে আছড়ে পড়ে এই পৃথিবীতে, তা হলেই আমাদের লীলাখেলা শেষ, কোনও ঈশ্বরই আমাদের বাঁচাতে পারবেন না বোধহয়। একবার তো হয়েছিলও তা-ই, যখন পৃথিবীতে ডায়নোসরের মতো বিদঘুটে বড় আকারের প্রাণীরা রাজত্ব করত, এক ঝাঁক উল্কার আঘাতেই তারা সব শেষ। ডায়নোসরদের কোনও ঈশ্বর ছিলেন না সম্ভবত।

সভাপতি বললেন, এক মিনিট শেষ, আপনারা বসুন। এই এক মিনিটের মধ্যে আমি এত সব ভেবে ফেললাম?

কোনও কোনও শোকপ্রস্তাবের সময় দেখেছি, যিনি প্রস্তাবক, তিনি এক মিনিট নীরবতার কথা বললেও নিজেই অধৈর্য হয়ে পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড হতেই ইঙ্গিত করেন যে, সময় পূর্ণ হয়ে গেছে। অর্থাৎ, ওই সব শোক প্রস্তাবক পনেরো সেকেন্ড সময় চুরি করে নেন। যাঁরা শোকপ্রস্তাবে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকেন, তাঁরা কি ওই সুদীর্ঘ ষাট সেকেন্ড শুধু মৃতদের আত্মার শান্তির কথাই ভাবেন, না কি এ সব নেহাতই এক বিলিত প্রথার অনুকরণ! আমার দৃঢ় ধারণা, ওই সময় অনেক সাহেবের মাথাতেও অনেক কুচিন্তা (অন্য যে-কোনও চিন্তাই কুচিন্তা) এসে যায়।

কলেজজীবন থেকেই আমি নাস্তিক। কী করে হলাম, তা জানি না। সম্ভবত ধর্মের নামে দাঙ্গা ও রক্তপাত দেখেই। সত্যি কথা বলতে কি, প্রত্যেকটা ধর্মই বেশ কিছুটা ভণ্ডামির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। হিন্দুরা মূর্তি পুজো করে বলে খ্রিস্টানরা কত গালাগালি দিয়ে গেল, কিন্তু তারাও তো গির্জায় গিয়ে যিশু কিংবা মেরি-র মূর্তির সামনে মোমবাতি জ্বালায়, অনেকে সেখানে প্রার্থনা করে, কাঁদে। মূর্তিপূজার সঙ্গে এর কী তফাত? ইসলাম অতি উচ্চাঙ্গের ধর্ম, সেখানে কোনও মূর্তি কিংবা ছবিরও স্থান নেই। খ্রিস্টধর্মে যেমন যিশু-মেরি ছাড়াও অনেক সন্তের মূর্তি গির্জাগুলিতে শোভা পায় (ক্যাথলিকদের কথাই বলছি, পৃথিবীতে এখনও তাদেরই সংখ্যাধিক্য), ইসলামে স্বয়ং পয়গম্বর ছাড়া আর কোনও সন্ত নেই। আল্লা নিরাকার। আমার মাথায় অনেক দিন ধরেই একটা প্রশ্ন ঘোরে, বিশ্বের কোটি কোটি ইসলামধর্মী প্রার্থনার সময় কি শুধু সেই নিরাকারের কথাই কল্পনা করে? তাই যদি হয়, তবে তার জন্য কী দারুণ চিত্তশুদ্ধি দরকার!

আমার এক শুভার্থী বন্ধু এক বার বলেছিল, তুই খামোখা নাস্তিক হতে গেলি কেন? প্রত্যেক ধর্মেই কত উৎসব হয়, তুই কোনও উৎসবের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারিস না। নাস্তিকরা নিঃসঙ্গ। যেহেতু এটা কোনও ধর্ম নয়, তাই এদের মিলিত হওয়ার কোনও জায়গাও নেই।

আমি তাকে বলেছি, কোনও ধর্ম কিংবা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী না হয়েও, এবং জ্ঞানত কারও কোনও ক্ষতি না করেও তো পৌনে একটা শতাব্দীরও কিছু বেশি বছর তো দিব্যি কাটিয়ে গেলাম এই পৃথিবীতে। কোনও অসুবিধে তো হল না। অবিশ্বাসীদেরও পূর্ণ জীবন কাটাবার অধিকার আছে। আর অবিশ্বাসী হলেও উৎসবে যোগ দিতে তো কোনও বাধা নেই। ক্রিসমাসের সময় কত হুল্লোড়ে যোগ দিয়েছি এক সময়, একবার মধ্যরাতের পর সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলাম, কী সুন্দর ভাবগম্ভীর দৃশ্য দেখেছি। আর ঈদের সময় মুসলমান বন্ধুর বাড়িতে গেছি বিরিয়ানি আস্বাদের লোভে। সবাইকে ঈদ মুবারক বলেছি। হিন্দুদের অনেক ধর্মীয় উৎসবে এখন ধর্ম প্রায় বিলীন হয়ে উৎসবটাই আসল হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে নিজেকে মিশিয়ে দিতে কোনও বাধা নেই তো?

আমার কোনও ধর্মেই বিশ্বাস নেই বলে আমি অপর কারও ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দেওয়ার কথা চিন্তাও করি না। ধর্মের ধ্বজাধারীরা যখন পারস্পরিক হানাহানিতেমেতে ওঠে, শিশুদেরও বাদ দেয় না, তখন যে ধর্মেরই হোক, নিহত জননী ও শিশুদের জন্য বড় কষ্ট হয়, বড় কষ্ট হয়। কোনও ধর্মেই এ রকম নির্দেশ নেই, অতি তুচ্ছ কারণে কিংবা জেদের বশে জীবনের এ কী অপচয়!

নাস্তিকেরা নিঃসঙ্গ শুধু নয়, তাদের নিজস্ব তেমন কোনও সাহিত্য নেই, সংগীত নেই। রাশিয়া কিংবা চিনের কথা জানি না, কিন্তু আমাদের দেশে ধর্ম ও ঈশ্বরবিশ্বাসীরা কত উচ্চাঙ্গের সাহিত্য রচনা করেছেন, কত গান, সে সবই আমি উপভোগ করি। কোনও কোনও গান শুনতে শুনতে হঠাৎ আমার চোখে জল এসে যায়। তখন আমার স্ত্রী সকৌতুকে আমার দিকে তাকালে তাঁকে বলি, কান্নার মতন আনন্দের আর কী আছে, বলো!

অল্প বয়েসে মনে হত, পৃথিবীতে যদি একটা ধর্ম থাকত, যার নাম ভালবাসা, তা হলে তো এখানেই স্বর্গ রচিত হতে পারত। এখন মনে হয়, তা হলে ভালবাসার কতই না কদৰ্থ হত। যাক, ভালবাসা নিয়ে বেশি হই চই করার দরকার নেই। ভালবাসা যত নিভৃতে রাখা যায় ততই ভাল।

আমার বিজ্ঞান-জ্ঞান যৎসামান্য, তবে কৌতূহল অনন্ত। সহজ করে লেখা মহাকাশবিজ্ঞানের বইগুলি আগ্রহের সঙ্গে পড়ি। একটা মজার ব্যাপার এই যে, ইদানীং অনেক বিজ্ঞানীর বইয়ের নামেই ‘গড’ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়। তাতে নাকি পাঠকদের কৌতূহল চাঙ্গা হয়, বই ভাল বিকোয়। আমার হাতের কাছেই দু’টি বই রয়েছে, রিচার্ড ডকিনস-এর ‘দ্য গড ডিলিউশন’ আর পল ডেভিস-এর ‘গড অ্যান্ড দ্য নিউ ফিজিক্স’। এমনকী হিক্‌স বোসন নামে অঙ্ক থেকে জাত যে কণিকাটির বাস্তব অস্তিত্ব আছে কি নেই, তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলছে, যেন মজা করেই তার নাম দেওয়া হয়েছে পার্টিকল!

অনেক কাল আগে ব্রেখটের একটি ছোট কবিতা পড়েছিলাম। এটা একবার পড়লে মুখস্থ হয়ে যায়— জানুয়ারি টেন/সিক্সটিন টেন/গালিলেয়ো গালিলি/ অ্যাবলিশেষ হেভেন!

২৮. ১২. ২০১১

নতুন বিমানবন্দরে কি একটাও বাংলা অক্ষর দেখা যাবে?

মানুষটি এমনই সুপুরষ গৌরবর্ণ, সুগঠিত শরীর, মাথাভর্তি সোনালি চুল, স্বপ্নময় চক্ষু দুটি মাঝে মাঝে ঝকমক করে ওঠে, এই মানুষটিকে অপ্সরারা যখন তখন ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত, তাঁর স্ত্রী হেমবতীর পাহারাদারিতেই সেটা সম্ভব হয়নি।

কে ওই রূপবান পুরুষ?

নাম বললে অধিকাংশ বাঙালিই চিনতে পারবেন না। কিংবা বলা যায়, খুব অল্পসংখ্যক বাঙালি যাঁরা সাহিত্য নিয়ে গবেষণা-টবেষণা করেন, তাঁরা চিনবেন। এঁর নাম কুয়েমপু, কর্নাটকের এক অত্যন্ত বিখ্যাত কবি। গড়পড়তা বাঙালি পাঠক এঁকে চিনবেন কী করে, তাঁরা তো ভারতের অন্যান্য ভাষায় কী লেখা হচ্ছে, তা জানতেও চান না। অনুবাদে তাঁরা ফরাসি, জার্মান, রুশ সাহিত্য পাঠ করেন। কিন্তু কোনও আগ্রহ নেই অন্যান্য ভারতীয় ভাষার সাহিত্যে।

না না, আমি পাঠকদের মোটেই বকাবকি করার জন্য এ লেখা শুরু করিনি। বাঙালি পাঠকদের যে মরাঠি, গুজরাতি বা তামিল সাহিত্য পড়তেই হবে, এ রকম মাথার দিব্যি কে দিয়েছে! পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই নির্বাচন করার ব্যাপারে প্রত্যেক পাঠকই স্বাধীন। তাঁরা উচ্চাঙ্গ সাহিত্য কিংবা বাজার-চলতি কুসাহিত্য, যা খুশি পড়তে পারেন, তা ছাড়া, অতগুলি ভারতীয় ভাষার কোন কোনটা তাঁরা পড়বেন? না, সম্ভব নয়। তবে, হঠাৎ অন্য ভাষার এক জন বড় কবি সম্পর্কে কিছুটা জেনে ফেললেও ক্ষতি নেই।

কুয়েমপু ছদ্মনামেই লিখেছেন। ইংরেজি বানানে Kuvempu, তবে তাঁর ভক্তদের মুখে শুনেছি, মাঝখানের ভি উচ্চারিত হয় না। ইনি কর্নাটকে কন্নড় ভাষায় একজন মহাকবি হিসাবে গণ্য। যদিও ওই ভাষায় আরও অনেক বড় বড় কবি আছেন। তবু কুয়েমপুর প্রসঙ্গ তোলার উপলক্ষ এই যে, বাংলার সঙ্গে তাঁর বেশ সম্পর্ক ছিল।

প্রথম কথা, ইনি আগাগোড়া রবীন্দ্রভক্ত। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে, তিনি রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করেন। শান্তিনিকেতনের আদর্শে তিনি তাঁর গ্রামের বসতবাড়িটাও একটা আশ্রমের মতন করে বানিয়ে ফেলেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই কবির প্রধান অমিল, রবীন্দ্রনাথ যেমন বিশ্বের বহু দেশে ঘুরেছেন অক্লান্ত ভাবে, কর্নাটকের এই কবি একেবারেই ভ্রমণবিলাসী ছিলেন না। বরং ঘরকুনোই বলা যায়। লেখাপড়া শিখেছেন মহীশূর কলেজে। তারপর সেই কলেজেই চাকরি। ক্রমশ বিভাগীয় প্রধান এবং শেষ পর্যন্ত উপাচার্য। বাড়ি আর কলেজ, এইটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাঁর জীবন। কর্নাটকই তাঁর স্বর্গ। বন্ধুবান্ধবরা ঠেলেঠুলেও তাঁকে বাইরে পাঠাতে পারেন না। তিনি যে বার জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেলেন, সে বারও দিল্লি যেতে চাননি। তবে ১৯২৯ সালে কুয়েমপু কলকাতায় আসেন স্বামী সিদ্ধেশ্বরানন্দের অনুগামী হয়ে।

সে বারে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ-পরিচয় হয়েছিল কি না, তার কোনও বিবরণ পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ তখন দেশে ছিলেন কি না, তাই বা কে জানে। কুয়েমপু অবশ্য এসেছিলেন অন্য একটি উদ্দেশ্যে। তিনি বেলুড় এবং দক্ষিণেশ্বরে যান এবং তখনকার রামকৃষ্ণ মিশনের সভাপতি স্বামী শিবানন্দের কাছে দীক্ষা নেন। রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল আজীবন।

তিনি পুরস্কার এবং সম্মান পেয়েছেন অজস্র। তার মধ্যে আছে জ্ঞানপীঠ ও ভারতরত্ন। তিনি লিখেছেনও প্রচুর। কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, অনুবাদ, শিশু সাহিত্য এবং দুটি জীবনীগ্রন্থ: স্বামী বিবেকানন্দ ও শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা: ‘রামায়ণ দর্শন’। সেই বিপুলাকার গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে বটে, কিন্তু আমার তা পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। তবে, ওই বইটি সম্পর্কে আলোচনায় একটা মজার ঘটনা জানলাম। সীতার অগ্নিপরীক্ষার মতন তিনি রামকেও অগ্নিপরীক্ষা করিয়েছেন।

একজন লেখক সম্পর্কে শুধু আলোচনা পড়ে ফেলা ঠিক নয়, তাঁর রচনার কিঞ্চিৎ স্বাদও পাওয়া উচিত। তাঁর বহু লেখাই ইংরেজিতে অনূদিত। আমি এয়ারপোর্টে বসে তাঁর একটি ছোট কবিতার দ্রুত অনুবাদ করে দিচ্ছি:

একটি রাস্তা— খুব সাধারণ

যখন সন্ধে এসে আকাশকে রঙে ছেয়ে দেয়

(মরুভূমি যেমন উপহার দেয় মরূদ্যান)

দেখুন এই সাধারণ রাস্তাটাকে

সোজা চলে যাচ্ছে স্বর্গের দিকে।

অন্য সময় এই রাস্তাটা

নোংরা, ছাইভস্মে ঢাকা

দুদিকেই সারি সারি টেলিগ্রাফের পোল

যেন একটা কুৎসিত মুখে গর্বের চিহ্ন।

কয়েকটা ইতস্তত বাড়ি, অতি সাধারণ

কোথাও কোনও সুন্দরের চিহ্ন নেই

রাস্তাটা উঁচু হয়ে গেছে পশ্চিম দিকে

তাও পরিকল্পনাহীন, এলোমেলো

কিন্তু যেই সন্ধে নেমে আসে

(একটা বেড়াল হয়ে যায় বাঘ)

দেখো, দেখো, এই অতি সাধারণ রাস্তাটা

চলে যাচ্ছে স্বর্গের দিকে।

বিমানবন্দরে অলস চিন্তা

কর্নাটকের মানুষ তাদের ভাষাকে খুব ভালবাসে৷ রাজ্য পরিচালনার অনেক ক্ষেত্রে কন্নড় ভাষার প্রয়োগ হয়। বেঙ্গালুরুর অতি আধুনিক, অতি সুদৃশ্য বিমানবন্দরে বসে কফি খেতে খেতে দেখতে পাচ্ছি, সমস্ত লিখিত নির্দেশিকাতেই ইংরেজি হিন্দির সঙ্গে কন্নড় ভাষাও স্থান করে নিয়েছে।

বাইরে অলস ভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি লাগল। আমাদের কলকাতায় তো খুব শিগগিরই সম্পূর্ণ আধুনিক এবং বেশ বড় আকারের বিমানবন্দরের উদ্বোধন হবে। সেখানে কি একটাও বাংলা অক্ষর থাকবে?

সন্দেহ হচ্ছে কেন? মনে কেন কুডাক ডাকছে!

কাউকে তো দাবি জানাতে হবে। সবাই যেন কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে বাংলা ভাষার অপব্যবহার দেখি, কেউ কোনও প্রতিবাদ করে না। তাই আমি আবার এই প্রশ্ন তুলছি:

কলকাতার নতুন বিমানবন্দরে কি একটাও বাংলা অক্ষর দেখা যাবে?

২৫. ১. ২০১২

ব্রিজের নীচে, সময় ওদের ছোঁয় না

জীবনের এতগুলি বছর কেটে গেল, এখন মাঝে মাঝেই মনে হয়, কিছু কিছু ব্যাপার চিরকালের মতো হারিয়ে ফেলেছি। জীবনে আর সে সব ফিরে আসবে না।

যেমন, দুর্গা, দুর্গা।

বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারেই ছেলেমেয়েদের স্কুল ও কলেজ জীবনের মধ্যে একটা স্পষ্ট ভাগ থাকে। যেন দুটো আলাদা মানুষের জীবন। অনেক সময়ই দেখা যায়, শৈশব-কৈশোরে যে লাজুক ও মুখচোরা, পরবর্তী জীবনে সেই-ই হয়ে ওঠে, বিখ্যাত জননেতা এবং সুবক্তা। আসল কথা হল, স্কুল বয়সটার অনেকখানিই থাকে নিজের পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ (কল্পনায় অবশ্য দুর্গম গিরি থেকে কান্তার মরু সবই ঘুরে আসা যেতে পারে) আর কলেজ জীবনে পাওয়া যায় বাইরের বাস্তব পৃথিবী। একা বাড়ি থেকে বেরোবার স্বাধীনতা। সেটাই অনেকখানি।

আমি যখন একখানা মাত্র খাতা হাতে নিয়ে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে যেতে শুরু করি, হাফ প্যান্টের বদলে ট্রাউজার্স, শার্টের কয়েকটা বোতাম খোলা, তখন মা প্রায় প্রতিদিনই আমার সঙ্গে সঙ্গে আসতেন সদর দরজা পর্যন্ত। দু’বার দুর্গা দুর্গা বলে একটা হাত রাখতেন আমার পিঠে কিংবা বাহুতে। তখন ব্যাপারটার কোনও গুরুত্বই ছিল না আমার কাছে। মনে হত মায়ের আদিখ্যেতা। আমি তো সে বয়সে ইচ্ছে করে চলন্ত বাসে লাফিয়ে উঠি। এক একদিন কলেজ যাওয়ার নাম করে অন্য কোথাও চলে যাই।

দুর্গা এখনও আছেন। কিন্তু মায়ের সেই উৎকণ্ঠা, প্রার্থনা, স্নেহমিশ্রিত কণ্ঠস্বর আর কখনও শুনতে পাব না। আর পিঠে কিংবা বাহুতে আলতো করে হাত রাখা।

এখনকার ছেলেমেয়েরা যখন প্রথম প্রথম একা বাড়ির বাইরে যেতে শুরু করে, তখন কী বলে তাদের মা? কিংবা কিছুই বলে না?

অবশ্য এখনকার ছেলেমেয়েরা আমাদের তুলনায় অনেক বেশি সপ্রতিভ।

কিছু কিছু মাছও নাকি হারিয়ে যাচ্ছে চিরকালের মতো। বন্ধুদের মুখে প্রায়ই শুনি খলসে মাছের কথা। আজকাল আর দেখাই পাওয়া যায় না। খলসে মাছ কোনও দিনই খাদ্য হিসাবে আমার প্রিয় ছিল না। কাঁটাগুলো বড্ড ধারালো। খাওয়ার চেয়েও দেখার পক্ষে বেশি ভাল। জলের মধ্যে থাকার সময় নানা রঙের ঝিলিক দেয়, তখন মনে হয় অ্যাকোরিয়ামে পোষা মাছ হিসেবেই খলসেকে বেশি মানায়। হঠাৎ এই মাছটা অদৃশ্য হয়ে গেল কেন?

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে কই মাছের কথা। কই মাছ খলসে মাছের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। আগে কথায় বলা হত, কই-খলসে। শহরের চেনাশোনা লোকেরা বিশ্বাসই করতে চায় না যে কই মাছ মাঝে মাঝে ডাঙায় হেঁটে বেড়ায়। খালি হাতেই ধরা যায়, আমি নিজেই রাস্তা থেকে কই মাছ ধরেছি, দু’বার। যখন খুব মেঘ ডাকে, বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে, তখন পুকুরের কই মাছ জল থেকে উঠে আসে ডাঙায়। কানকোতে ভর দিয়ে কোথায় যেন যেতে চায়। যাঁরা কখনও গ্রামে যাননি, তাঁরা এই কথা শুনে প্রবল অবিশ্বাসের সঙ্গে বলে, ধ্যাৎ বাজে কথা। মেঘের গর্জনে আর কোনও মাছের কোনও প্রতিক্রিয়া হয় না, শুধু কই মাছ কেন উঠে আসবে জল থেকে? সত্যি কথা বলতে কী, এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না। তবে স্বচক্ষে এই ব্যাপারটা আমি দেখেছি। আশা করি, গ্রামে-গঞ্জে কই মাছ এখনও তাদের এই স্বভাবটা বজায় রেখেছে।

সময় দেখার জন্য একটা দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাতেই মনে পড়ল, পেন্ডুলাম দেওয়া ঘড়িও হারিয়ে গেছে চিরকালের মতো। আগে দেওয়াল ঘড়ি মানেই পেন্ডুলামের টক টক শব্দ। এই শব্দটার মজা এই যে, যখন একলা বসে কোনও কিছু চিন্তা করছি, তখন শোনা যেত বেশ প্রকট ভাবে। আর যখন একসঙ্গে কয়েক জন মিলে গল্পগুজব করছি, তখনও শব্দটা চলছে ঠিকই, কিন্তু শোনা যায় না। এক কালের কত কবিতায়-গল্পে এই টক টক আওয়াজের উল্লেখ থাকত। সময় যে এগিয়ে চলেছে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। যে সময় ধনী-নির্ধন কারওকে গ্রাহ্য করে না। এখন আর পেন্ডুলাম নেই। শব্দও নেই, সময় বয়ে যায় নিঃশব্দে।

এ সবই বলা যায়, অলস জল্পনা। এ রকম কিছু কিছু পরিবর্তন তো হবেই। তাতে জীবনের কী আসে যায়।

উল্টোডাঙার এই ব্রিজটার উপর দিয়ে যাওয়ার সময় প্রত্যেক বারই তলার দিকে আমার চোখ চলে যায়। সেখানে অনেকখানি সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো জায়গা। সেখানে একটা পরিবার থাকে। তা তো থাকতেই পারে। ওপরে আচ্ছাদন আছে। কিন্তু মজার কথা এই যে, বহু বছর ধরে আমি একই পরিবারকে দেখছি ওখানে। রুখু দাড়িওয়ালা একজন মাঝবয়সি স্বামী। তার চ্যাপ্টা চেহারার স্ত্রী। নানা বয়সের গোটা তিনেক ছেলেমেয়ে। এদের বয়স বাড়ে না। এরা কাগজ কুড়োয় না ভিক্ষে করে, কিংবা ছিঁচকে চুরিতে হাত পাকায় তা আমি জানি না। দুপুরের দিকে এলে দেখতে পাই, ইটের উনুনে, মাটির হাঁড়িতে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। এক এক বার আমার ইচ্ছে হয়েছে, ওদের পাশে বসে ওই খিচুড়ির স্বাদ নিতে। তবে এ রকম অনেক ইচ্ছেই তো হয় আমাদের। সত্যি সত্যি যাওয়া হয়ে ওঠে না।

ব্রিজের বাঁ পাশে একটা পরিত্যক্ত তেল কল পড়েছিল অনেক দিন। বেশ গাছ টাছ গজিয়ে গেছে। এ বারেই দেখলাম সেখানে একটা বহুতল বাড়ি উঠছে, পাঁচ ছ’তলার কনস্ট্রাকশনও হয়ে গেছে। আর ব্রিজের নীচে সেই একই পরিবার রয়ে গেছে বহু বছর ধরে। সময় ওদের ছোঁয় না।

আমাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী

অসমিয়াভাষীদের মধ্যে ভট্টাচার্য অনেক আছেন, তাঁরা কিন্তু বাঙালি নন। যেমন দাস কিংবা দত্ত। অসমিয়াভাষীদের মধ্যে ধীরেন ভট্টাচার্য ছিলেন প্রখ্যাত লেখক এবং সাহিত্য আকাদেমির সভাপতি। হীরেন ভট্টাচার্যও সেই ভাষার প্রধান কবি হিসেবে গণ্য। হীরেন ভট্টাচার্যের মাতৃভাষা অসমিয়া। তিনি বাংলাও বেশ ভাল জানেন। তিনি সম্প্রতি একটা কাজ করেছেন, সেটা একটা চমৎকার ব্যতিক্রম। তিনি নিজের কিছু কবিতা নিজেই অনুবাদ করেছেন বাংলায়। বইও প্রকাশিত হয়েছে ‘শিশির থেকে পাতা অব্দি’। এমন সাবলীল অনুবাদ আমি খুব কমই পড়েছি। যেমন:

আস্তে আস্তে চারদিক অন্ধকার হয়ে এলো

বাতাসে এক এক করে ঝরে পড়ছে গানের পাপড়ি,

গান আমার প্রিয় পৃথিবীর সুরেলা উপহার।

আজ হঠাৎ অতিথি হয়ে আসা এক টুকরো মেঘ

অলীক হাতে ঢেকে ধরেছে তারা— বোঝা এক বুক-আকাশ

বাঘের চোখের মতো তারাগুলো…

৮. ২. ২০১২

আমি বলতে গেলে গ্রন্থাগারেরই সন্তান

বরানগরের মিলনী নামে একটি পাঠাগারের আজ বিশেষ আনন্দের দিন। তাদের নিজস্ব ভবনের একতলার ওপরে দোতলায় একটি ঘর খোলা হয়েছে, তার উদ্বোধন হবে। ষাট-সত্তর বছর আগে এই পল্লির কয়েকজন আদর্শবাদী মানুষ প্রচুর যত্ন ও পরিশ্রমে যে গ্রন্থাগারটি চালু করেছিলেন, (প্রথম দিকে স্থানাভাবে কারও গ্যারেজে) তাঁরা আজ আর কেউ ইহলোকে নেই, কিন্তু গ্রন্থাগারটি বেঁচে আছে। পরবর্তী প্রজন্মের আরও কয়েকজন সেই আদর্শ ও দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে ভাগ করে নিয়েছেন এবং গ্রন্থাগারটি সচল রেখেছেন। এখন নিজস্ব দোতলা ভবন তো সমৃদ্ধিরই দিকে।

সত্যিই কি তাই?

শুধু বরানগর কেন, টালিগঞ্জ কিংবা বেলেঘাটায়, ডায়মন্ড হারবার কিংবা ব্যারাকপুরে, অথবা আরও দূরে অনেক মফস্সল শহরে, এমনকী কোনও কোনও গ্রামেও ছড়িয়ে আছে এ রকম বেসরকারি ছোট-বড় গ্রন্থাগার। স্বাধীনতার ঠিক আগে বা পরে বাঙালিদের মধ্যে গ্রন্থাগার-আন্দোলনের প্রতি একটা ঝোঁক দেখা যায়। তখন কোনও রকম সরকারি সাহায্যের সম্ভাবনা ছিল না, কিছু কিছু মানুষ সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ ভাবে নিজেদের পাড়ায় পাড়ায় এ-রকম লাইব্রেরি গড়ে তুলেছেন, তাদের কোনওটি এখন সুবর্ণজয়ন্তী কিংবা হীরকজয়ন্তী পালন করছে, তা আমরা জানি। তবে সে রকম কিছু লাইব্রেরির মৃত্যু ঘটেছে কিংবা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কি না তা আমরা জানি না, সে রকম কোনও পরিসংখ্যান আছে কি?

আমি বলতে গেলে গ্রন্থাগারেরই সন্তান।

শৈশবে-কৈশোরেই বই পড়ার তীব্র নেশা জন্মেছিল, কিন্তু নতুন বই পাব কোথায়? সুতরাং পাড়ার লাইব্রেরিই ভরসা। (কিছু কিছু বই চুরিও করেছি অবশ্য। কোনও নেমন্তন্ন বাড়িতে গেলেই আমি ইঁদুরের মতন এ-ঘর ও-ঘর ঘুরে বেড়াতাম, কোথাও কোনও বই পড়ে থাকতে দেখলেই চট করে তুলে জামার তলায় পেটে গুঁজে নিতাম। কোনও দিন ধরা পড়িনি অবশ্য। তবে দু’-একবার এমন অবস্থা হয়েছে, যা নিয়ে অনায়াসেই হাসির গল্প লেখা যায়। কোন কোন বাড়ি থেকে আমি কী কী বিখ্যাত বই হাপিশ করেছি, তার কিছু কিছু এখনও আমার মনে আছে, কিন্তু এত কাল পরে তার স্বীকারোক্তি দেওয়ারও কোনও মানে হয় না)।

আমাদের শৈশবে শিশুসাহিত্য খুব বেশি ছিল না, তাই একখানা বই-ই পড়তাম তিন-চার বার। তার পর খিদের জ্বালায় উইপোকার মতন বড়দের বইও খেতে শুরু করলাম। আমার মায়ের ছিল বই পড়ার প্রচণ্ড নেশা, পাড়ার লাইব্রেরির মেম্বার, কিন্তু নিজে তো যেতেন না, তাঁর হয়ে বই আনার দায়িত্ব ছিল আমার। মা রান্না করতে বসেও বই পড়তেন, কোনও দিন অবশ্য কোনও রান্নায় নুন বেশি বা কম হয়নি। মা যখন একখানা বই পড়তেন, সেই সময় অন্য বইটি কৌশল করে আমি পড়ে নিতাম। তখন অনেক লোক বলত, এখনও কেউ কেউ বলে যে, ছোটরা বড়দের বই পড়লে চরিত্র খারাপ হয়ে যায়, কিংবা বখে যায়। এই সব কথার জ্বলন্ত প্রতিবাদ আমি নিজে। গোঁফ গজাবার আগেই আমি শত শত গল্পের বই, তার মধ্যে ‘চিতা বহ্নিমান’ কিংবা ‘অথৈ জলে’র মতন বইও ছিল, কিন্তু তার জন্য আমার চরিত্র খারাপ কিংবা বখে যাবার মতন কিছুই হয়নি। আমার আর যত দোষই থাক, এ রকম কোনও অভিযোগ কখনও শুনিনি।

পাড়ার লাইব্রেরিটি ছোট থেকে ক্রমশ বড় হচ্ছিল, কয়েকজন পাড়ার মানুষের নিষ্ঠায়। তাঁদের মধ্যে একজন মানুষের কথা আমার বিশেষ ভাবে মনে আছে। পুরো নাম জানি না, সবাই ডাকত, মিত্তিরদা, ছোট্টখাট্টো চেহারার ছটফটে মানুষটি। আমি যে-দিনই যেতাম, তাঁকে দেখেছি। উপস্থিত প্রত্যেকের সঙ্গে ডেকে-ডেকে বাড়ির খবর নিতেন। শুনেছি, তিনি রোজ বিকেলে তালা খোলার সময় থেকে রাত ন’টায় তালা বন্ধ করা পর্যন্ত নিজে থাকতেন। কোনও সদস্য বই নিয়ে আট-দশ দিনের মধ্যে ফেরত না দিলে সোজা চলে যেতেন তার বাড়ি। তিনি কিন্তু লাইব্রেরিয়ান ছিলেন না, কোনও বিশেষ বিভাগের ভার ছিল না তাঁর ওপর, বরং অভিভাবকের মতন। কোনও হঠাৎ ছুটি উপলক্ষে লাইব্রেরি বন্ধ রাখার প্রস্তাব করলে তিনি প্রতিবাদ জানাতেন। পরবর্তী কালে আমি ভেবেছি, ওঁর নিজের বাড়ি-ঘর, সংসার আছে, ছেলেমেয়ে আছে, তবু প্রতিদিন সন্ধেটা যে ব্যয় করতেন লাইব্রেরিতে এসে, তা কীসের টানে? এর উত্তর পাওয়া সহজ নয়।

এই মিত্তিরদার মতন অন্যান্য পাড়ার লাইব্রেরিতেও এরকম নিষ্ঠাবান এক-এক জন মানুষ থাকতেন, যাঁদের জন্য লাইব্রেরি বেঁচে থেকেছে। শুধু বাঁচা নয়, গ্রন্থাগারের আয়তন বেড়েছে, পাকা বাড়ি হয়েছে এখন। তবু সত্যিকারের উন্নতি হয়েছে কি?

অনেক জায়গাতেই শুনতে পাই, বইয়ের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, টাকা পয়সার সমস্যাও অনেকটা মিটেছে, সরকারি সাহায্যও পাওয়া যায়, কিন্তু কমে যাচ্ছে সদস্য-সংখ্যা। অনেক লাইব্রেরিতে এখন ভিড় নেই, দুপুর-বিকেল খাঁ-খাঁ করে, সন্ধেবেলাতেও লাইব্রেরিতে যাওয়ার চেয়ে বাড়িতে টিভি দেখার আকর্ষণ বেশি। ছোট ছোট লাইব্রেরিতে যদি এই অবস্থা হয়, তা হলে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতেও কি কমে যাচ্ছে পাঠকের সংখ্যা?

ওই মিত্তিরদার কাছে আমি একদিন ধমক খেয়েছিলাম। মায়ের জন্য রোজ দু’টি উপন্যাস নিয়ে যাবার কথা, একদিন তার মধ্যে ‘শেষের কবিতা’ নামে একটি বই দেখে আমি বলেছিলাম, না না, কবিতার বই চাই না, কবিতার বই চলবে না। সে কথা শুনে মিত্তিরদা বলেছিলেন, রবি ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’র যে নাম শোনেনি, তার কান ধরে দু’মিনিট দাঁড়িয়ে থাকা উচিত। কান ধর, কান ধর।

তিনি আমাকে লঘু পাপে গুরু দণ্ড দিয়েছিলেন। আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। ক্লাস সিক্সের ছেলের পক্ষে রবীন্দ্রনাথের ওই উপন্যাস সম্পর্কে না-জানা কি অমার্জনীয় অপরাধ?

বাড়ি ফিরেই ‘শেষের কবিতা’ খুলে বসি। আমার জীবনে সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের কোনও উপন্যাস পাঠ। ও রকম ধমক খাবার জন্যেই বোধহয় সেই পাঠের স্মৃতি আজও অমলিন হয়ে আছে।

২২. ২. ২০১২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *